আষাঢ়ে শ্রাবণের বর্ষণ পর্ব-০৫

0
1641

#আষাঢ়ে_শ্রাবণের_বর্ষণ
#মাইশাতুল_মিহির

[পর্ব-০৫]

বিছানায় গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন আবরার। গতকাল রাত তিনটায় কাজ শেষ করে ঘুমিয়েছে সে। এখন সকাল সাড়ে দশটা বাজে তাও ঘুম ভেঙ্গে উঠতে পারেনি। বিছানায় উপুড় হয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে। হঠাৎ-ই ফোনের কর্কষ রিংটোনের শব্দে ঘুম ভাঙ্গলো তার। বিরক্ত হয়ে মুখে ‘চ’ উচ্চারণ করলো। বালিশের পাশ থেকে মোবাইল হাতে নিয়ে দেখলো নিশিতা কল দিয়েছে। এতোক্ষণ বিরক্ত লাগলেও মোবাইলে ইংরেজি ক্যাপিটাল ওয়ার্ডে ‘AMMU’ লেখা দেখে মুখে হাসি ফুটে উঠলো তার। এক মুহূর্তও দেড়ি না করে কল রিসিভ করে স্বাভাবিক কন্ঠে বলে উঠলো, ‘আম্মু?’

অপর পাশ থেকে প্রসন্ন আওয়াজে নিশিতা বললো, ‘হ্যাঁ বাবা! কেমন আছিস?’

‘ভালো! তুমি কেমন আছো? বাসার সবাই ভালো আছে?’

‘হ্যাঁ সবাই ভালো। এখনো ঘুমাচ্ছিলি নাকি?’

আবরার উঠে বিছানার হেডসাইডে হেলান দিয়ে বসলো। আয়েশী ভঙ্গিতে বললো, ‘রাতে দেড়িতে ঘুমিয়েছিলাম। তাই এখনো ঘুম আছে।’

‘কাজের চাপ বেশি? সময় করে একটু আয় না বাবা। কতদিন তোকে দেখি না।’

‘মা এমন ভাবে বলছো যেনো আমি চট্টগ্রামে কত থেকেছি। তাছাড়া তিন মাস আগেই তো চট্টগ্রাম গিয়েছিলাম।’

‘হ্যাঁ! সেটা তো তিন মাস আগের কথা। মাত্র তিন দিন থেকেছিলি।’

‘ওই তিন দিনেই যা কান্ড ঘটিয়েছো তোমরা। তার পরেও কি মনে হয় আমি সেখানে থাকবো?’

‘যা হওয়ার হয়েছে তো। তকদিরে যা থাকে তাই হয়। ভাগ্যের লিখন কেউ মুছতে পারে না।’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ জানি।’ ত্যাঁছড়া করে বললো আবরার।

‘এই দিকে পাহাড়ি দের আঞ্চলিক মেলা বসবে। তাছাড়া রাইমাকে দেখতে আসবে কিছুদিন পর। তুই বড় ভাই হয়ে থাকবি না? রিমি তো কেঁদে কেটে ভাসিয়ে দেয় তোর জন্য। কত বছর হয়েছে তুই আমাদের সাথে থাকিস না। আমাদের কি ইচ্ছে করে না তোকে কাছে পেতে বল? তোর বাবার কথা বাদ দিয়ে আমাদের কথা চিন্তা করেও কিছু দিন সময় নিয়ে আসতে পারিস।’ শেষের কথা গুলো অনুনয় স্বরে বললো নিশিতা।

মায়ের এই অনুরোধ ফেলতে পারেনি আবরার। ছোট করে ‘দেখা যাক!’ বলে লাইন কেটে দিল সে।

মোবাইল টা হালকা করে ছুড়ে ফেললো বিছানার উপর। সিলিং’য়ের দিকে তাকিয়ে রইলো এক দৃষ্টিতে। বাড়িতে যাওয়ার ইচ্ছে তার একদমই নেই। তবে গতকাল রাতের পর থেকে কেমন অদ্ভুত ভাবে মায়া কাজ করছে। বারবার মনে হচ্ছে বাড়ির কথা। মনে পরছে লাল কুর্তি পরা মেয়েটির কথা। মেয়েটিকে দেখার আগ্রহ বাড়ছে। বাড়িতে থাকলে নিশ্চয় মেয়েটিকে দেখতে পারতো সে। এই মেয়েটি-ই কি সেই মেয়েটি? যার সাথে তার বিয়ে হয়েছে। শীট! ওইদিন রাগ না করে যদি মেয়েটির চেহারা ভালো করে দেখতে পারতো। মাত্র দুইবার অল্প সময়ের জন্য দেখেছিলো তাও তিন মাস আগে। এতোদিনে চেহারাও ভুলে গেছে। হতাশ হয়ে নিজের চুল মুষ্টিবদ্ধ করলো আবরার। মায়ের বলা কথা গুলো ভাবতে লাগলো। একটা মানুষের সাথে রাগ করে এতোদিন বাড়ি থেকে দূরে থাকার মানেই হয়না। তাছাড়া সে এখন যথেষ্ট এস্টাবলিশড। তার নিজেরই টাকার অভাব নেই। সুতরাং সেখানে অনায়াসে সে যেতেই পারে। বহুক্ষণ ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নিলো আবরার। অতঃপর বিছানা থেকে নেমে অভ্রকে ডাকলো। এখন সাপ্তাহ খানেকের জন্য ফ্রি সে। এই কয়েকদিন নাহয় চট্টগ্রামে কাটানো যাক। তাই আবরার সিদ্ধান্ত নিলো সএ চট্টগ্রামে যাবে। অভ্র কে নিজের জিনিস পত্র গুছাতে বলে ওয়াশরুমে ফ্রেশ হতে গেলো।
_____________

সাইন্সের ক্লাসে বসে বইয়ে মুখ ডুবিয়ে রেখেছে সকল শিক্ষার্থী। আসলে ক্লাস শুরু হওয়ার আগে সবাই আড্ডায় মশগুল থাকলেও ‘মুফতাহির রাজ’ স্যারের ক্লাসের আগে সবাই পড়া রিভার্স করে। মুফতাহির রাজ ফিজিক্স আর হায়ার ম্যাথম্যাটিকস ক্লাস করায়। এখন ফিজিক্স ক্লাসের পালা। স্যারের ধ’ম’ক খাওয়া থেকে বাঁচার জন্য সবাই ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা চালাচ্ছে এখন।

মুফতাহির রাজ ক্লাসে ঢুকতেই সবাই উঠে দাঁড়ালো। সুঠাম দেহের অধিকারী উজ্জ্বল ফরশা গায়ের রঙ। মেদহীন শরিরের সঙ্গে গায়ের বর্ণ পারফেক্ট। দেখতে সুদর্শন হলেও গম্ভীর ও রাগি একজন মানুষ। প্রথম কয়েকদিন ক্রাশ বলে সবাই চেঁচালেও বর্তামানে তার রাগের কারণে সেই ক্রাশ কারোর মাঝে রইলো না।

রাজ ক্লাসে ঢুকার পরেই এক পলক দীবার দিকে তাকিয়ে গম্ভীর মুখে সবাইকে বললো, ‘সিট ডাউন!’

ফিজিক্স প্রথম পত্র বই বের করে ষষ্ঠ অধ্যায় ‘মহাকর্ষ এবং অভিকর্ষ’ পড়ানো শুরু করলো রাজ। বোর্ডে লিখছে আর হাত নেড়ে পড়া বুঝাচ্ছে সবাইকে। চেহারা, কন্ঠে স্পষ্ট গম্ভীরতা ভাস্যমান। নুরা গালে এক হাত রেখে অপলক চোখে তাকিয়ে আছে রাজের দিকে। লোকটার কথা বলার ভঙ্গিমা দেখে বারবার-ই মুগ্ধ হয় সে। এই যে এখন লেকচার দিচ্ছে আর পাশাপাশি দুই হাত নেড়ে কথা বলছে। সিল্কি চুল গুলো কপালে ঝাপটে পরে আছে। কথার সঙ্গে লালচে গোলাপি ঠোঁট দুটো নড়ছে। বরাবরই প্রেমে পরার মতো অবস্থা। নুরা মৃদু হাসি ঠোঁটে রেখে তাকিয়ে আছে রাজের দিকে। রিমি ও দীবা বোর্ডে তাকিয়ে মনোযোগ দিয়ে শুনছে সব। তখন দীবার হাতে হাল্কা ধাক্কা দিলো নুরা। দীবা তার দিকে তাকাতেই নুরা রাজের দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে থেকে আনমনে বলে উঠলো, ‘বইন দেখ কি সুন্দর লাগতাছে স্যার কে। উফফ এতো কিউট কেনো স্যার? খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে একদম।’

দীবা চোখ বড় বড় করে তাকালো নুরার দিকে। তারপর বললো, ‘ছিঃ কি বলছিস এসব? উনি আমাদের টিচার।’

‘হ্যাঁ তো? টিচাররা কি স্টুডেন্টদের বিয়ে করে না? করে করে। বিয়ে করে বাচ্চাকাচ্চাও পয়দা করে। রাজ জানুর বংশের বাত্তি জ্বালাতে আমাকে বিয়ে করবে। দেখে নিস।’

দীবা আওয়াজ নিচু করে বললো, ‘ বিয়ের পর ফুটবল টিম বানানোর চিন্তা বাদ দিয়ে পড়ায় মনোযোগ দে। নয়তো তোর মতো গাধা কে স্যার জীবনেও পাত্তা দিবে না।’

দুজনের কথোপকথন রাজের অগোচর হলো না। ক্লাসের ফাঁকে কথা বলা তার মোটেও পছন্দ না। পকেটে দুই হাত গুঁজে গম্ভীর কন্ঠে দীবাকে ডেকে উঠলো, ‘মিস দীবা সানজিদাহ। স্টেন্ড আপ!’

রাজের কথা শুনে হকচকিয়ে গেলো দীবা। আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো ক্লাসের উপস্থিত সকলের দৃষ্টি তার দিকে। বিব্রতবোধ করলো সে। দাঁতে দাঁত কিড়মিড় করে নুরার দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো দীবা। নউতো ও ভয়ার্ত তার দৃষ্টি।

রাজ গম্ভীর কন্ঠে বললো, ‘আপনি জানেন আমার ক্লাসে কথা বলা আমি একদম পছন্দ করি না। তাহলে কথা বলছিলেন কেনো?’

ধাতস্থ হলো দীবা। কিছুটা আমতা আমতা করে বললো, ‘সরি স্যার! আর হবে।’

রাজ দীবার দিকে প্রগাঢ়ভাবে তাকালো। তার জড়তা, ইতস্ততবোধ দেখে মনে মনে হাসলো রাজ। এই মেয়েটা এতো ভীতু কেনো? কি সুন্দর করে কথা বলে। বরাবরই সে মুগ্ধ হয় দীবাকে দেখে। ভিতরে তার ভালোলাগা কাজ করলেও উপরে গম্ভীরভাব রেখে বলে উঠলো, ‘ফারদার যদি দেখি আমার ক্লাসে আপনি কথা বলেছেন তো ক্লাস থেকে বের করতে বাধ্য হবো। গট ইট?’

দীবা মাথা নিচু করে মিনমিনে গলায় উত্তর দিল, ‘জি!’

‘ওকে সিট ডাউন!’

দীবা চুপচাপ বসে পরলো। মন খারাপ হলো বেশ। এভাবে সবার সামনে দাঁড়িয়ে থাকার কারণে অনেক লজ্জা পেয়েছে। ইশ! স্যার কি ভাবলো তাকে? নিশ্চয় বেয়াদব ভেবেছে। ক্ষুন্ন হলো মন। কান্না পেল্য ভীষণ। চুপচাপ বই হাতে নিয়ে বসে রইলো।

রাজ আবারো ব্যস্ত হয়ে ক্লাস শুরু করলো। পড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে আড়চোখে দীবার দিকে তাকাচ্ছে। ক্লাসে সবার সামনে এভাবে দাঁড় করিয়েছে বলে দীবা মুখ গুমরো করে বসে আছে। দীবার মন খারাপ দেখে বুকের বাম পাশে গিয়ে লেগেছে। ঠিক এমন-ই গুমরো ঠোঁট ফুলানো দীবাকে মেলায় দেখে সে প্রথম মুগ্ধ হয়েছিলো। আর আজ আবারো মুগ্ধ হলো রাজ। এই মেয়ের মাঝে থাকা সব কিছুই যেনো রাজকে মুগ্ধ করে। কাছে টানে তাকে। ভেবেই সকলের অগোচরে মুচকি হাসলো।
______________

সকালের মধ্যেই সব কিছু গুছিয়ে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে বের হলো আবরার। কিন্তু বাড়ির কাউকে জানায় নি। কারণ হঠাৎ করে ‘শান্তিনিবাস’ এ উপস্থিত হয়ে সবাই কে বড়সড় একটা সারপ্রাইজ দিবে সে। ভাবতেই নিজের মাঝে ভালো লাগা কাজ করলো। মনটা বেশ ফুরফুরে আবরারের।

গাড়িতে আবরার ও অভ্র পাশাপাশি বসে আছে। আবরারের মন এতো খুশি খুশি দেখে বার বার আড় চোখে তাকাচ্ছে অভ্র। এই কয়েক বছরে কোথাও যাওয়া নিয়ে এবিকে সে এতো এক্সাইটেড দেখিনি। তাই আজ এতো অবাক হচ্ছে। নিজের কৌতূহল দমাতে না পেরে আবরারকে বলে উঠলো, ‘স্যার আপনাকে এতো এক্সাইটেড লাগছে কেনো?’

আবরার অভ্রর দিকে ফিরে তাকাতেই অভ্র ভড়জে গিয়ে আমতা আমতা করে বললো, ‘না মানে কখনো তো কোথাও যাওয়া নিয়ে এতো এক্সাইটেড হতে দেখি নি। আবার যাচ্ছেন কয়েক দিনের জন্য তাই জিজ্ঞেস করলাম আরকি।’

আবরার মিষ্টি করে একটা হাসি দিয়ে বললো, ‘অনেক দিন পর বাড়িতে যাচ্ছি। এক্সাইটেড লাগবে না?’

অভ্র আলতো হেসে মাথা দুলালো। বললো, ‘বাড়ি যাওয়ার আনন্দটা অনেক।’

আবরার মুখে হাসি রেখেই বললো, ‘অনেক ভেবে দেখেছি অভ্র একটা মানুষের জন্য কেনো আমি বাকি মানুষ গুলোকে কষ্ট দিবো? আমার জন্য সবাই কষ্ট পাচ্ছে। তারাই তো আমার কাছের মানুষ। অন্তত্য ওদের জন্য হলেও আমার চট্টগ্রাম যাওয়া উচিত।’

বিনিময়ে অভ্রও মুচকি হেসে সম্মতি জানালো। বহুদিন পর স্যার কে এতো এক্সাইটেড দেখছে সে। একপ্রকার রাগের কারণে পরিবারকে ছেড়ে ঢাকা চলে এসেছিল আবরার। যতোই গানে নিজেকে ডুবিয়ে রাখুক না কেনো ভিতরে থাকা চাপা কষ্ট যেনো বিরাজমান। আবরার কাঁচ নামিয়ে আপাতত বাহিরের পরিবেশ দেখতে ব্যস্ত। গাড়ি চলছে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে।

চলমান..