আষাঢ়ি পূর্ণিমা পর্ব-১৯+২০

0
310

#আষাঢ়ি_পূর্ণিমা
#পর্ব_১৯
#খাদিজা_আক্তার

ঘুম ভাঙতেই ফোন হাতে নিলো রাত্রি। আগের সীমকার্ড বদলে সে নতুন সীমকার্ড নিয়েছে। এ নম্বর আপাতত শর্মি ছাড়া কেউ জানে না৷ তবে গতকাল রাতে আদীকে মেসেজ পাঠিয়েছিল। মেসেজ পাঠিয়ে রাত্রি জেগেছিল, রাত দু’টো অব্দি। কিন্তু আদী কোনো জবাব দেয়নি। খুব কান্না পেয়েছিল। তবে সে নিজের মনকে শক্ত করে বুঝিয়েছিল,

—কেউ ভালোবাসতে না চাইলে তাকে জোর করা যায় না।

ফোনের স্ক্রিন ওপেন করতেই রাত্রি দেখতে পেল শর্মির নম্বর থেকে অনেকগুলো কল এসেছে। এত কল করার তো কথা নয়। তাই রাত্রি অবাক হলো এবং প্রায় সাথে সাথে শর্মিকে কল করল,

—কী হয়েছে? এত কল করলি কেন?

—কোথায় ছিলি তুই? আমি তোকে…

—আরে এত উত্তেজিত কেন হচ্ছিস? আমি তো বোডিঙেই ছিলাম। আসলে কালকে রাতে ঘুমাতে অনেক দেরি হয়েছে। তাই ঘুমানোর আগে ফোন সাইলেন্ট করে রেখেছিলাম যেন সাতসকালে ফোন আমাকে তুলে না দেয়।

—রাত্রি থাম প্লিজ। ওদিকে যে কী অঘটন ঘটেছে সে খবর কি তোর আছে? তুই এক্ষুনি স্কয়ার হসপিটালে যা।

—হসপিটালে যাব মানে?

হতভম্ব হয়ে গেল রাত্রি। শর্মির অবস্থাও বেশ করুণ মনে হচ্ছে। ফলে রাত্রির মনে অজানা ভয় কাজ করছে।

—আদী… আদী…

—আদী! কী হয়েছে আদীর?

—গতকাল রাতে আদী স্টোক করেছে। তাকে হসপিটালে ভর্তি করা হয়েছে; আইসিইউ আছে। ডাক্তার জানিয়েছে অবস্থা ভালো নয়। তুই প্লিজ নিজেকে শক্ত কর আর এক্ষুনি হসপিটালে যা। আমার কিচ্ছু ভালো লাগছে না।

স্তব্ধ হয়ে গেল রাত্রি। নিজের কানকে সে বিশ্বাসই করাতে পারছে না। এমন খবর শুনে কী রকম প্রতিক্রিয়া দেখাতে হয় তাও রাত্রি বুঝতে পারছে না।

—রাত্রি? নিজেকে শক্ত কর। ভেঙে পড়িস না।

শর্মি বলেই যাচ্ছে। কিন্তু কোনো কথাই রাত্রির কানে যাচ্ছে না। নিস্তেজ হওয়া শরীর যেন আঁকড়ে ধরার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে। ফলে রাত্রির হাত থেকে ফোন পড়ে গেল আর সে নিজেও দুম করে মেজেতে বসে পড়ল। দুই হাতে মুখ ঢেকে রাত্রি ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠল আর একটিই শব্দই উচ্চারণ করল,

—আদী!

*

বাস থেকে নেমে রিকশা নিলো রাত্রি। বাড়ি ছেড়ে সে তার ইউনিভার্সিটির পাশেই একটি বোডিঙে সিট নিয়েছিল। বাড়ি থেকে ইউনিভার্সিটি ছিল এক ঘণ্টার পথ। বাসে আসাযাওয়া করার অভ্যাস তার আগে থেকেই ছিল। কিন্তু আজকে স্কয়ার হসপিটালে আসতে গিয়ে সে অনুভব করল যেন পথঘাট তার কিচ্ছু চেনা না।

এখন দ্বিপ্রহর চলছে। মাথার ওপর কড়কড়ে রোদ। কিন্তু এসব নিয়ে তো আর চিন্তা করার সময় নেই। অন্তর জ্বলছে অবিরাম। রাত্রি বিশ্বাসই করতে না পারলেও সে জানে আদী নিজের প্রতি কতটুকু অবহেলা করে। ব্লাডপ্রেশারের রোগী হয়েও আদী নিজের প্রতি খেয়াল রাখেনি। এমন অযত্নে একটি অঘটন হওয়া আর কী এমন বড়ো ব্যাপার? কিন্তু কালকে রাতেই কেন এসব হলো? তাহলে কি রাত্রির মেসেজ আদীর এ অবস্থার জন্য দায়ী? এমন চিন্তা মাথায় আসতেই রাত্রি পাগলপ্রায় হয়ে পড়ছে।

বুকের ভেতর সাগর সমান দুঃখজল নিয়ে রাত্রি ছুটছে আদীর কাছে। রাত্রি জানে না আদী কোথায় আছে অর্থাৎ কত নম্বর রুমে তাকে পাওয়া যাবে। এখানে আসার আগে রাত্রি একবার ভেবেছিল,

—বাসায় ফোন করে কি জেনে নিবো?

কিন্তু সাথে সাথে এ চিন্তা বাদ দিয়ে শর্মিকে বলেছে আদীর সম্পূর্ণ তথ্য যোগাড় করতে। শর্মি বলেছে,

—তুই আগে হসপিটালে পৌঁছে যায়। আমি এর মধ্যেই তোকে সব টেক্সট করে দিবো।

—ঠিক আছে।

রাত্রি ছুটতে ছুটতে থেমে গেল। অবাক আর রাগ এ মূহুর্তে তাকে ঘিরে ধরল। কারণ সাদা কোর্ট পরে ইব্রাহিম দাঁড়িয়ে আছে তারই চোখের সামনে। রাত্রি ভুলেই গিয়েছিল যে কিছু দিন আগে ইব্রাহিম পাকাপাকি ভাবে স্কয়ার হসপিটালের ডক্টর হিসাবে নিয়োগ পেয়েছে। রাত্রি অবশ্য এ তথ্য জেনে কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেনি, কিন্তু ইব্রাহিমের মুখোমুখি হয়ে তার সমস্ত শরীরে অদৃশ্য কাটা যেন ফুটছে অতিরিক্ত রাগে।

ইব্রাহিমকে পাশ কাটিয়ে রাত্রি চলে যেতে চাইল। কিন্তু ইব্রাহিম রাত্রির পথ আটকে বলল,

—তোমার সাথে আমার কথা আছে।

—আমার কারো সাথে কোনো কথা নেই।

—তোমার কথা শুনতে চাইছে কে? কিন্তু আমার কথা তোমাকে শুনতেই হবে।

রাত্রি তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল ইব্রাহিমের দিকে। তার চোখে জল টলমল করছে। কেঁদেকুটে ভারী হওয়া গলায় রাত্রি বলল,

—একটা মানুষ আইসিইউতে মৃত্যুর সাথে লড়ছে আর আপনি আমার সাথে…

—রাত্রি, প্লিজ আমার…

ইব্রাহিম ভালোভাবেই রাত্রিকে বোঝাতে চাইল। কিন্তু রাত্রি নাছোড়বান্দা হয়ে ওঠতেই ইব্রাহিম ধমকে ওঠল,

—চুপপপ। একদম চুপ। আমার কথা শেষ হওয়ার আগে কোথাও যাওয়া চলবে না৷ কথা শেষ হতে হতে কেউ যদি মরেও যায় আমার কোনো মাথা ব্যথা নেই।

এ বলে ইব্রাহিম রাত্রির হাত টেনে হাঁটতে শুরু করল আর রাত্রি হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতে গিয়ে বলে ওঠল,

—হাত ছাড়ুন আমার। হসপিটাল ভর্তি লোকের সামনে তামাশা করবেন না। হাত ছাড়ুন বলছি।

ইব্রাহিম রাত্রির কথা কানে তুলল না। হসপিটালের এক নিরিবিলি জায়গায় এনে রাত্রিকে দাঁড় করিয়ে দিলো। রাত্রির হাত এরই মধ্যে রাত্রি ছাড়িয়ে নিলো আর জীবনের প্রথম নিজের হাতের পাঁচ আঙ্গুল কোনো ছেলের গালে বসিয়ে দিলো। সশব্দে চ””ড় খেয়ে ইব্রাহিম মেঝের দিকে ঝুঁকে গিয়েছে। নিজের গালে হাত রেখে ইব্রাহিম যখন রাত্রির দিকে তাকাল, তখন রাত্রির চোখেমুখে রাগের অন্য এক আগুন দেখতে পেল। এতে আরও তব্দা খেয়ে গেল ইব্রাহিম, কিন্তু তার মাঝেও রাগের সৃষ্টি হচ্ছে। রাগে সে রাত্রির বাহু চেপে ফুঁসে ওঠল,

—এ থাপ্পড় আমি তোমাকে দিতে চেয়েছিলাম বহু আগেই। কিন্তু দেওয়া হয়নি কারণ তোমার মুখের দিকে তাকালেই আমার মন কেমন করে ওঠত। তোমার মাঝে আমি ছন্দাকে দেখতে পেতাম। তাই হয়তো তোমাকে বিয়ে করব না ঠিক করেও নিজেকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘রাত্রিকে কি আমার বিয়ে করা উচিত?’ কিন্তু পরে মনে হলো একজনকে ভালোবেসে অন্যজনকে বিয়ে করে কী লাভ? সারাজীবন শুধু পস্তাতে হবে। তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও তোমাকে নোংরা কথা শোনাতাম। আমি এমন করতাম যেন তুমি বিয়ে ভেঙে দাও কারণ আমার বাপ আমাকে বিয়ে করানোর জন্য ওঠে পড়ে লেগেছে। আর রাত্রি, তোমার ভালো চাইতে গিয়ে নিজের এমন হাল হবে আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। তুমি কী না কী চিঠিতে লিখে বাড়ি ছেড়েছ। এদিকে আদী ভেবে বসে আছে আমার জন্য তুমি বাড়ি ছেড়েছ আর সে আমাকে কুকুরের মতো মেরে হাসপাতালে পাঠিয়েছে। আর…

ইব্রাহিম আরও কিছু বলতে চেয়েছিল, কিন্তু হঠাৎ তার ফোন বেজে ওঠল। তাই সে রাত্রিকে ছেড়ে দিয়ে ফোন হাতে নিলো। কল রিসিভ করে বলল,

—সাজ্জাদ স্যার, বলুন।

রাত্রির দিকে তাকিয়ে ইব্রাহিম আবার জবাব দিলো,

—হ্যাঁ, এসেছে। আমার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে।

এ কথা শুনে রাত্রির বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে ইব্রাহিম তার কথাই বলছে। ইব্রাহিম বলে গেল,

—আপনি শিগগির আসুন। সামলানো কঠিন হয়ে যাচ্ছে… আদীর বিষয় আমার ওপর ছাড়ুন। আপনি এসে আগে এ ধানিলঙ্কাকে সামলান।

এরপর ইব্রাহিম সাজ্জাদকে বলে দিলো কোথায় আসতে হবে এবং কল কেটে দিলো।
(চলবে)

#আষাঢ়ি_পূর্ণিমা
#পর্ব_২০
#খাদিজা_আক্তার

রাত্রি আচমকা নির্জীব হয়ে গেল। থমথমে বদনে সে মেঝেতে তাকিয়ে আছে। সাজ্জাদের সাথে কথা শেষ করেও ইব্রাহিম রাত্রির দিকে তাকিয়ে আছে। না, এ চেহারায় কোনো আগুন নেই যা পুরুষের চোখ ধাঁধিয়ে দিতে পারে; ঝলসানো রূপের অধিকারীও রাত্রি নয়। তাহলে কী এমন আছে রাত্রির মাঝে? ইব্রাহিম হয়তো রাত্রির ভালোর জন্য তাকে নোংরা কথা শোনাত, কিন্তু এ মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকলে সত্যি নেশা হয়ে যায়। ইব্রাহিম গল্প-উপন্যাসে কখনো বিভোর হওয়ার লোক নয়। তবে জীবনানন্দ দাশের সেই বনলতা সেনের কথা সে শুনেছে যার চোখ না কি পাখির নীড়ের মতো। ইব্রাহিমের কানে জীবনানন্দ দাশের সে কবিতার লাইন প্রায়শই বেজে ওঠে,

পাখির নীড়ের মতো চোখ দু’টি তোমার— এ লাইন খুব বেশি মনে পড়ে, যখন রাত্রি তার চোখের চাহনিতে ইব্রাহিমের বুকে তোলপাড় সৃষ্টি করে। সত্যি তখন ইব্রাহিমের মনে হয়,

—আমি জীবনানন্দের বনলতা সেনকে দেখিনি, দেখিনি পাখির নীড়ের মতো চোখের অধিকারী কোনো রমণীকে। কিন্তু আমি তোমাকে দেখেছি রাত্রি যার চোখের তারা আমার বুকের ভেতর ভাঙচুর করে সারাবেলা।

এতক্ষণ ধরে ইব্রাহিম রাত্রির দিকে তাকিয়ে আছে, কিন্তু এ মেয়ে একটিবারও চোখ তুলে দেখল না; দেখল না সুদর্শন এক যুবকের চোখে তাকে দেখার ব্যাকুলতা। হঠাৎ আদীর কথা মনে পড়তেই ইব্রাহিম নিঃশব্দে হেসে ওঠল। বিষাদের হাসিতে তার মুখের আকাশ বদলে যেতেই সে রাত্রির থেকে চোখ সরিয়ে নিলো। ভাবল,

—শালা! আমার চেয়ে হ্যান্ডসাম নয়। না আছে ভালো চাকরি আর না আছে শিক্ষাগত যোগ্যতা অথচ…

ইব্রাহিম হঠাৎ তার ভাবনা থামিয়ে দিলো। সে বুঝতে পারছে সে আদীকে হিংসা করছে তাও রাত্রির মতো একটি মেয়ের জন্য যার না আছে বাপের টাকা আর না বিশ্বসেরা রূপ।

—ইব্রাহিম?

নিজের নাম শুনতে পেয়ে ফিরে তাকাল ইব্রাহিম। আদীর বন্ধু সাজ্জাদ এগিয়ে আসছে। কাছাকাছি হতেই ইব্রাহিম হ্যান্ডশেক করে বলল,

—এবার একে বুঝিয়ে বলুন। আদীর মতো এ-ও আমার সাথে মারপিট করছে।

ইব্রাহিমের কথা শুনে সাজ্জাদ অবাক হাসি হেসে রাত্রিকে জিজ্ঞাসা করল,

—এটি কি সত্যি রাত্রি?

রাত্রি সাজ্জাদকে চেনে, কিন্তু সাজ্জাদের সাথে ইব্রাহিমের কবে সম্পর্ক হলো সেটিই সে ভাবছে। আর ভাবছে বলে কোনো উত্তর না দিয়ে চুপ করে রইল। রাত্রির নীরবতা দেখে সাজ্জাদ এগিয়ে এসে রাত্রিকে বোঝাতে শুরু করল,

—রাত্রি, আমিই ইব্রাহিমকে বলেছিলাম তোমাকে সব খুলে বলতে। কিন্তু তুমি মনে হচ্ছে শুনতে চাচ্ছ না। তাই আমি…

রাত্রি হঠাৎ সাজ্জাদকে থামিয়ে দিয়ে বলল,

—আপনি তো আদীর বন্ধু। আপনার বন্ধু আইসিইউতে মৃত্যুর সাথে লড়ছে আর আপনিও আমাকে আটকে রেখেছেন? আপনারা কি চাইছেন বড়ো অঘটন ঘটার আগে আমি যেন আদীকে দেখতে না পারি?

—রাত্রি তুমি ভুল…

সাজ্জাদ কিছু বলতে চাইল, কিন্তু এবারও বাঁধা প্রাপ্ত হলো। ইব্রাহিম তাকে বলল,

—সাজ্জাদ স্যার, একে আদীর কাছেই বরং নিয়ে যান। লা””শ দেখে যদি এর হুঁশ ফেরে।

—লা””শ মানে?

হতভম্ব হয়ে গেল রাত্রি। কিন্তু সেদিকে পাত্তা না দিয়ে সাজ্জাদ পা বাড়িয়ে বলল,

—এসে আমাদের সাথে।

—লা””শ কেন? কী হয়েছে আদীর? আপনারা…

রাত্রি কেঁদে দিলো প্রায় আর এসব দেখে ইব্রাহিম বিরক্ত হয়ে বলল,

—ধ্যাৎ! কিছু হলেই কান্নাকাটি। এসব কাঁদাকাটি একদম সহ্য হয় না। চুপচাপ চলো নয়তো…

রাত্রি আর কথা বাড়ালো না। চুপচাপই সাজ্জাদ এবং ইব্রাহিমকে অনুসরণ করতে লাগল। প্রায় পাঁচ মিনিট আকাশ সমান কান্না চেপে যখন একটি রুমে এসে সবাই থামল, তখন বিছানা থাকা আদীর নিথর দেহের কাছে ছুটে গিয়ে রাত্রি মরাকান্না জুড়ে দিলো। রুমে যে নিজের আব্বা আম্মা এবং আদীর আব্বা আম্মা আছে তা রাত্রি তোয়াক্কা করল না। সবাই হঠাৎ রাত্রিকে দেখে চমকে গেলেও পিছন থেকে সাজ্জাদের করা ইশারা কিচ্ছুটি বলল। সাজ্জাদ আবারও ইশারা করতে আদীর এবং রাত্রির আব্বা আম্মা রুম ছেড়ে চলে গেল। এদিকে রাত্রি কেঁদে চলেছে আর আদী লা””শ হয়ে পড়ে আছে। হঠাৎ সাজ্জাদ চলে এলো আদীর বিছানার কাছে তারপর বলল,

—আদী ওঠ। সবাই বাইরে চলে গেছে।

সাজ্জাদের এমন কথা শুনে রাত্রির কান্না আচম্বিতে থেমে। রাত্রি মেঝেতে বসে সাদা বিছানায় মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল। এখন অশ্রুভেজা চোখে সাজ্জাদকে দেখছে আর তার কথাগুলো বোঝার চেষ্টা করছে। এরমধ্যে আদীকে ওঠে বসতে দেখে রাত্রি সমস্ত ভাবনা ফেলে উঠে দাঁড়িয়ে আদীকে জড়িয়ে ধরল। আবারও সে মরাকান্না জুড়ে দিয়ে বলতে লাগল,

—আদী! আমি… আমি…

রাত্রি প্রাণপণে কিছু বলতে চাইছে, কিন্তু কান্নার বেগ এত বাড়ছে যে কিছুই মুখ দিয়ে বের হচ্ছে না। আদী রাত্রিকে বাহুডোরে আবদ্ধ করে নিয়েছিল। এখন হাতের বাঁধন শক্ত করে রাত্রির সুরেই বলল,

—আমি তোমাকে ভালোবাসি।

মাত্র তিনটি শব্দের জাদুকরী ছোঁয়া রাত্রির কান্না যেন রোধ করল। আদীকে হারানোর যে যন্ত্রণা রাত্রি এতক্ষণ ধরে অনুভব করছিল তা এখন সরে যাচ্ছে একটু একটু করে। সমস্ত ব্যাকুলতা মনের আকাশ থেকে সরে গিয়ে সেথায় লজ্জার বৃষ্টি নামছে আর এতেই রাত্রি গুটিয়ে যাচ্ছে।

—রাত্রি?

আদীর ডাকে রাত্রি সাড়া দিলো না। লজ্জার অদৃশ্য জালে আবদ্ধ হয়ে থাকলে কি আর উত্তর দেওয়া যায়? আদীও বুঝতে পারছে আর দেখতে পারছে পাশে দাঁড়িয়ে সাজ্জাদ মিটমিট করে হাসছে। এতে আদীও নিজের মাঝে লজ্জা অনুভব করছে। কিন্তু বহু প্রত্যাশিত ব্যক্তিটি যখন নিজের বুকেই মাথা গুঁজে দেওয়ার ঠাঁই খুঁজে নেয়, তখন কী লজ্জাকে প্রশ্রয় দেওয়া যায়?

—রাত্রি, কেমন আছ?

আবারও আদী প্রশ্ন করল। এ প্রশ্নের উত্তরে রাত্রি আবারও নীরব হয়ে রইল, কিন্তু আদী ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে বসল। লজ্জা জড়ানো চোখ নামিয়ে রাখল। এদিকে তাদের এসব কাণ্ড দেখে ইব্রাহিম অস্থিরতা প্রকাশ করে বলল,

—আদী, আগে আমার বিষয়টি রাত্রিকে ক্লিয়ার করে বলুন। আমি ঠিক শান্তি পাচ্ছি না। তাছাড়া ও আমাকে চড়ও মেরেছে। আজ পর্যন্ত কোনো মেয়ের এমন সাহস হয়নি। আমি ঠিক নিতে পারছি না বিষয়টি।

ইব্রাহিমের কথা শুনে আদী অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল,

—সত্যিই চড় মেরেছে?

—ভাই, এত অবাক হবেন না। এ হলো ধানিলঙ্কা। এমনিতে চুপচাপ, কিন্তু ক্ষেপে গেলে যাচ্ছেতাই করে বসে।

আদীর এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না। তবে সেটি প্রকাশ করে সে ইব্রাহিমকে বলল,

—ওর হয়ে আমি আপনার কাছে ক্ষমা চাইছি। আমিও তো আপনাকে মেরে…

—না না, ক্ষমা চাইতে হবে না। আপনি শুধু আমার বিষয়টি ক্লিয়ার করুন। আমাকে একটু পরেই যেতে হবে।

—ঠিক আছে। আমি বলছি।

এ বলে আদী এবার রাত্রিকে বোঝাতে শুরু করল,

—রাত্রি, আমি যা বলছি মন দিয়ে শোনো। স্বর্ণালির আত্ম””হ””ত্যা পিছনে জড়িত ব্যক্তিদের ধরা হয়েছে। এমনকি তাদের বিচার কাজ চলছে।

—আমি পত্রিকায় দেখেছি। ঢাকা মেডিক্যালের এবং স্কয়ারের দু’জন বড়ো ডাক্তারের নোংরামি স্বীকার হয়েছে স্বর্ণালি আর তাদের সাথে জড়িত ছিল তোমার বন্ধু জহিরও। তোমার বাড়ির পাশের যে মেয়েটি আত্ম””হ””ত্যা করেছে তার পিছনে জহিরের হাত ছিল।

—হ্যাঁ, মূলত জহির বিভিন্ন ছেলেদের ছবি ব্যবহার করে ফেসবুকে প্রেম করত। এরপর কোনো মেয়ে অসুস্থ হলে তাকে চিকিৎসার জন্য হয় ঢাকা মেডিক্যালে নয়তো স্কয়ারে যাওয়ার কথা বলত। এরপর তারা সেখানে চেক-আপ করতে গেলে অজ্ঞান করে তাদের ভিডিয়ো তৈরি করা হতো। ভিডিয়ো দেখিয়ে যখন ব্ল্যাকমেইল করত, তখন মেয়েগুলো আত্মসম্মানের ভয়ে আত্ম””হ””ত্যা করত। তবে এমন ঘটনা বেশি ঘটত বিভিন্ন লেডিস্ বোডিঙে। সেই বোডিঙের সাথে জহির সহ অন্য দুই ডাক্তারের যোগাযোগ ছিল। ফলে মেয়েগুলো মারা গেলেই তাদের হাতে লা””শ তুলে দিতো আর তারা ভোগ করে…
(চলবে)