#আসক্তিময়_ভালবাসা
#Part_22
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
অবছা অন্ধকারে ঘেরা রুমটি। গুমোট গন্ধ ছড়িয়ে আছে চারদিকে। নিস্তব্ধ রুমটিতে চেয়ার টানার কর্কশ শব্দ চারদেয়ালে বারি খেয়ে এইদিক সেইদিক ছুটা ছুটি করছে। টেবিলের উপর থাকা ল্যাপটপটি কেউ ক্ষণে ক্ষণে জ্বালাচ্ছে আবার নিভিয়ে ফেলছে। সে বরং আর কেউ নয় সেই মাস্ক পরিধান ব্যক্তিটি। আজও তার হিংস্র চোখ দুইটি ব্যতীত কিছুই দেখা যাচ্ছে না। তার ভাব-ভঙ্গি অতি শান্ত। কিছু মানুষের হিংস্র ভাব থেকে শান্ত ভাবটা সবচেয়ে বেশি ভয়ংকর হয়ে থাকে। কথাটি যেন এই লোকটির জন্য শতগুণ প্রযোজ্য।
মাস্ক পরিধানকারী লোকটি থেকে দশ-বারো হাত দূরে আসিফ আর রহিম মাথা নুয়ে দাঁড়িয়ে আছে। লোকটি শান্ত ভঙ্গিতেই তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। পরিবেশটা থমথমে। হুট করে কাউরো শীতল কন্ঠ কানে আসতে ভয়ে তারা একদম জমে যাচ্ছে।
— একটা ইনফরমেশন কালেক্ট করতে তোদের এত সময় লাগে?
আসিফ তো রীতিমতো ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছে। রহিমের চেহেরায়ও ভয়ের রেখা ফুটে উঠেছে। হুট করে কাউরো গর্জনে তারা দুইজনে ভয়ে দুই পা পিছিয়ে যায়। মাস্ক পড়া লোকটি গর্জে উঠে বলে,
— আমি কি তোমাদের চট্টগ্রাম পিকনিক করতে পাঠিয়েছিলাম? নাকি বসতি স্থাপন করতে? একটা ইনফরমেশন বের করতে এত মাস লাগে কিভাবে?
কথাগুলো শুনতেই রহিম শুকনো গলায় কয়েকটা ঢোক গিলে নেয়। জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট দুইটি ভিজিয়ে নেন। অতঃপর কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে,
— সরি বস! কিন্তু সেখানে গিয়ে যারেই জিজ্ঞাস করি হেই কয় জানি না। সব কিছু এতই গোপনে করা হইছিল যে কেউ কিছুই কইবার এই পারে না। সামান্যটুকু ইনফরমেশন নিতেও মেলা সময় লাইজ্ঞা গেসে।
মাস্ক পড়া লোকটি কঠোর গলায় বলে,
— এক্সিউজ না দিয়ে মূল কথায় আসো। কোন ইনফরমেশন পেয়েছ কি না?
রহিম দাঁত বের করে বলে,
— একদম চাঙা খবর পাইসি বস। আপনার যে যে ইনফরমেশন দরকার সব আনসি।
আপনি যেই মাফিয়া রে খুঁজতাসেন হেতি আরও কয়েকবছর আগেই মারা গেছে। অন্য কোন একদলের লোক নাকি হেরে বহুত বাজে ভাবে মারসে।
গোপন সূত্র থেকে জানতে পারসি যে মরার আগ পর্যন্ত ওই জিনিসটা হের কাছেই ছিল। সে ওইটা বড় এক মাফিয়ার দলের কাছে বিক্রি করতে নিসিল। বিক্রি করেও ফেলে। কিন্তু ওই পক্ষের লোকেরা জিনিসটা পেয়ে ওই মাফিয়াকে নির্মম ভাবে হত্যা করে দেয়। যাতে ও কখনো এইসবের কথা কাউকে কইবার না পারে। ওই পক্ষের লোকেরা এত বড় জিনিস হাতিয়ে নেওয়ার জন্য পার্টি করবো বলে ঠিক করে। আর জিনিসগুলো আলমারিতে রেখে চলে যায়। অতঃপর যখন তারা ফিরে এসে জিনিসটা নিতে আসে তখন দেখে সেইগুলো নিজ জায়গায় নেই। অনেক খোঁজ করেও সেইগুলো খুঁজে পাওয়া যায় নি। অতঃপর জানা যায় ওইখানে একটা মাইয়া মানুষ রে দেখা গেসিল। সবার সন্দেহ ছিল ওই মাইয়াটাই হয়তো এই আকামটি করসে। কিন্তু কেউ নাকি ওই মাইয়ার চেহেরা দেখে নি। সাথে খোঁজ ও পায় নি। কিভাবে আইলো, কিভাবে গেল কেউ কইবার পারে না।
মাস্ক পরিধান লোকটি সরু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,
— তা তোরা জানতে পেরেছিস?
রহিম হেসে বলে,
— হো পাইসি! এই মাইয়ার খোঁজ পাইতে গিয়াই তো এত সময় লাইজ্ঞা গেল। বাচ্চা একটা মাইয়া বস।
— বেশি কথা না বলে ইনফরমেশন দে।
— জ্বী! জ্বী বস! এই যে বস ওই মাইয়ার ছবি।
টেবিলের উপর একটা ছবি রেখে তা এগিয়ে দিয়ে। মাস্ক পরিধানকারী ব্যক্তিটি ছবি হাতে নিয়ে থমকে যায়। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ছবিটির দিকে। এইদিকে রহিম বলা শুরু করে,
— মাইয়ার নাম রিয়ানা ইসলাম। বাপে জাহাজ ব্যবসায়ী আর মায়ে একজন সামাজিক সেবিকা। মাইয়া ছোট থেকে চট্টগ্রামেই বড় হইসে। খোঁজ নিয়ে জানবার পারসি এখন নাকি ঢাকাতেই আছে।
আপনি কইলে বস এখনই আমরা খোঁজ লাগাইয়া দেই। বেশি সময় লাগবো না হেরে পাইতে।
এই বলে রহিম উৎসুক দৃষ্টিতে মাস্ক পড়া লোকটির দিকে তাকায়। কিন্তু সেই মাস্ক পড়া ব্যক্তির কোন খোঁজই নেই। সে নির্বাক! শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ছবিটির দিকে। এইদিকে রহিম কোন জবাব না পেয়ে আবার বলে,
— কি হইলো বস কিছু কন? খোঁজ লাগামু নি? খোঁজ পাওয়ার সাথে সাথেই মাইয়ারে ধইরা বাইন্দা নিয়া আমু। মাইয়া মানুষ একটু ভয় দেখালেই সব বইলা দিব।
রহিমের কথা শুনে আসিফ বলে,
— মেয়েটার মধ্যে যদি ভয় থাকতো তাহলে নিজের জানের রিস্ক এইভাবে নিত না।
রহিম আসিফের কথা শুনে দাঁত কেলিয়ে বলে,
— ভয় না পাইলে কি হইসে। ভয় পাইবো। আমগো থেরাড ডিগরি (থার্ড ডিগ্রি) টর্চার দিলেই তোতাপাখির মত বকবক করা শুরু কইরা দিব নে।
এই বলে রহিম হাল্কা শব্দ করে আসে। এমন সময় কাউরো গর্জনের আওয়াজ কানে আসতেই রহিম চুপসে যায়। মাস্ক পড়া লোকটি চেঁচিয়ে বলে,
— জাস্ট শার্ট আপ! তোদের আমি বেশি কথা বলতে বলেছি? তাহলে বলছিস কেন?
আসিফ আর রহিম মাথা নিচু করে বলে,
— সরি বস!
— তোরা যা এইখান থেকে। আমি না বলা পর্যন্ত আগ বাড়িয়ে কিছু করবি না তোরা।
দুইজনই মাথা নাড়িয়ে দরজার পথে হাটা দেয়। দরজা পেরুতেই আসিফ রহিমের কানে ফিসফিসিয়ে বলে,
— বস হুট করে এমন গর্জে উঠলো কেন?
— মুই কেমনে কইতাম? মানুষ কয় মাইয়া মানুষের মন বুঝা বড় দায় কিন্তু এইহানে বসের মন বুঝা বড় দায়। হেতি রে বুঝার সাধ্য কাউরো নাই বুঝলি।
আসিফ মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানায়। আসলে মানুষটা বহুত রহস্যময় আর বিচিত্র ধরনের।
___________________________________________
পুরো আকাশ জুড়ে আজ ধূসর মেঘের বসবাস। বিকেল এখনো পুরোপুরিভাবে নামে নি। বিকেল নামতে অনেক দেরি। কিন্তু তাও চারদিকে আবছা অন্ধকার ছেঁয়ে আছে। শো শো শব্দে বাতাস বইছে। রাস্তা ঘাট শুকনো থাকায় বাতাসের সাথে ধূলোবালি মিশে একাকার। গাছের কচিপাতায় ভরা ডালাগুলোর উপর দল বেঁধে সারিভাবে বসে আছে চার-পাঁচটা কাক। কাক গুলো অলস ভঙ্গিতে বসে আছে। মাঝে মধ্যে কর্কশ কন্ঠে ডেকে উঠছে নিজের উপস্থিতি সকলকে বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য। রাস্তার পাশেই একটা কুকুর ওদের দেখে ঘেউ ঘেউ করছে। কিন্তু ওরা কুকুরটিকে পাত্তাই দিচ্ছে না। এইদিকে সেদিকে কিছু পথচারী শিশু ঘুরে ঘুরে ভিক্ষা করছে। কেউ তাদের ভিক্ষা দিচ্ছে তো কেউ না। কেউ আবার দূর দূর করে তাড়িয়ে দিচ্ছে তাদের। কিন্তু খুদার দায়ে পড়ে তারা বেহাইয়ার মত তাদের পিছে ছুটেই চলেছে। দৃশ্যটা সত্যি মর্মান্তিক। কিন্তু এর মধ্যেও একটা হাস্যকর বিষয় হলো মানুষ এদের দেখে মনে মনে কতই না করুণা করে। কত সিম্পাতি তাদের প্রতি। অথচ যদি কখনো এদের জন্য কিছু করার উদ্যোগ নেওয়া হয় তখন এরা ভুলেও এই উদ্যোগ এর ধারের কাছে ঘেসে না। বিষয়টা মজার না? হাইরে মানুষ! কিছু যখন করতেই পারবে না তাদের জন্য তাহলে অযথা এই করুণা দেখিয়ে কি লাভ? এইটা কি নিতান্তই তাদের ছোট করে দেখা হচ্ছে না?
আমি পার্কের এক বেঞ্চিতে বসে এইসবই লক্ষ্য করছিলাম। আর মনে মনে এইসব ভাবছিলাম। এমন সময় ৭-৮ বছর বয়সী একটা ছেলে এসে আমার সামনে দাঁড়ায়। গায়ে শার্ট নেই। শুধু একটা প্যান্ট পড়া। গায়ে কালি মাখা। আমাকে দেখে বলে,
— দশটা টাকা দিয়েন আফা। সকাল থেকে কিছু খাই নি।
আমি মিষ্টি হাসি হেসে বলি,
— আচ্ছা তুমি কি খাবে বল?
— যা খাওয়ান।
— তোমার সাথে আর কেউ আছে?
— হো আছে। ওই তো পাশেই ওরা ভিক্ষা করছে।
আমি নিজের ব্যাগ থেকে পার্স বের করে দেখি পার্সে বেশি টাকা নেই। ২০০ টাকার মত আছে। আমি ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করলাম,
— কয়জন হবে?
— আমায় নিয়ে ৫ জন। কিল্লিজ্ঞা?
আমি কি যেন ভেবে আসে পাশে তাকাই। আমাদের থেকে কিছুটা দূরেই একটা ফুচকাওয়ালাকে দেখতে পেলাম। সাথে সাথে আমার মুখে হাসি ফুটে উঠে। আমি হাসি মুখে বলি,
— ফুচকা খেতে পারবে?
— হো পারুম। পেটে কিছু যাওয়ান দিয়া কথা।
— আচ্ছা ঠিক আছে। চল! আর শুনো তুমি ওদেরও ডেকে নিয়ে ফুচকার দোকানের সামনে আসো।
ছেলেটা খুশি হয়ে দৌঁড়ে সেইদিকে যায়, ওদের ডেকে আনার জন্য। আমি গিয়ে ফুচকার দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে বলি,
— মামা কম জ্বাল দিয়ে ৬ প্লেট ফুচকা দিও তো।
ওর্ডার দিতে দিতেই দেখি বাচ্চা পাটিরা এসে হাজির। অতঃপর একটা একটা করে আমি সকলের মাঝে ফুচকার প্লেটটা ধরিয়ে দেই। সকলেই ফুচকা পেয়ে সেটার উপর হামলে পড়ে। আমিও ওদের সাথে একটা প্লেট নেই। ওদের সাথেই খেতে থাকি। মনটা ভালো ছিল না বিধায় আনিশার বাসা থেকে সোজা পার্কে এসে পড়েছিলাম। মন খারাপের কারণ ছিল আনিশা৷ আনিশার আজ আকদ হয়ে গিয়েছে। তাও ডা. মারুফের সাথে। কিভাবে কি তা আমি আর পায়েল কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। ডা. মারুফের সাথে বিয়ে মানে কি?
অতঃপর কাহিনী জিজ্ঞেস করলে জানতে পারি ডা. মারুফ নাকি আগে থেকেই আনিশাকে ভালবাসতো। সাথে ওর জন্য নাকি মহা পাগল। অথচ এইসবের আমি আর পায়েল কিছুই জানি না। এইটা কি কোন কথা? বেশ অভিমান হয়েছিল আনিশার উপর। এমন কেন করলো ও? কিন্তু মুখে কিছু বলি নি। অনুষ্ঠান শেষে চুপচাপ বেড়িয়ে এসেছিলাম অভিমানটা নিয়ে। কিন্তু এখন এই বাচ্চাদের হাস্যজ্জ্বল মুখটা দেখে মনটা একদম ভালো হয়ে গেল। সত্যি এদের মুখে হাসি ফুটাতে বেশি কিছু করা লাগে না। অতি সামান্য কিছুই এদের জন্য অনেক। ফুচকা খাওয়া শেষ হতেই সকলে বিভিন্ন দিকে চলে যায়। আমি বিল মিটিয়ে পার্ক থেকে বেড়িয়ে আসি।
রাস্তার পাশ ঘেষে হেটে চলেছি। বড় রাস্তায় প্রচন্ড জ্যাম। যার জন্য এখান থেকে রিকশায় চড়লাম না। অযথা জ্যামে বসে সময় ব্যয় করার চেয়ে হাটা ভালো। হাটতে হাটতে বা দিকের গলিতে ঢুকে পড়াম। গলির শেষ মাথায় আরেকটি রাস্তা। ওই রাস্তায় সাধারণ কোন জ্যাম থাকে না। সেখান থেকে সাচ্ছন্দ্যে রিকশা নেওয়া যাবে। আমি রাস্তার ধারে আসতেই দেখি আজ এইদিকটা বেশ ফাঁকা ফাঁকা। তুলনামূলক গাড়ির চলাচল কম। আমি রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে রইলাম রিকশার অপেক্ষায়। কিছুক্ষণের মাঝে একটা রিকশা দেখতে পেলাম। সেটাকে ডাকতেই যাব এমন সময় পিছন থেকে একজন ডেকে উঠে,
— এক্সকিউজ মি ম্যাম!
আমি পাশে ফিরেই দেখি সাদামিটে একজন ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। আমি ভ্রু কুচকে তার দিকে তাকাই। অতঃপর বলি,
— জ্বী কি চাই?
— আসলে আমি না এই ঠিকানাটা খুঁজে পাচ্ছি না। যদি একটু দেখে বলতে এইটা কোথায়।
একটা কাগজ আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে। আমি কাগজটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম। মনে করার চেষ্টা করলাম। আমি আদৌ চিনি কি না। এইসব ভাবতে ভাবতেই অনুভব করলাম কেউ আমার মুখ চেপে ধরেছে। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। আমি দ্রুত গতিতে হাত পা ছড়াছড়ি শুরু করলাম। কিন্তু বিশেষ কোন লাভ হলো না। আস্তে আস্তে আমি নিস্তেজ হয়ে পড়ি। চোখের সামনে অন্ধকার ছেয়ে যায়। ঘটনাক্রম বুঝার আগেই জ্ঞান হারাই আমি।
#চলবে