আসক্তিময়_ভালবাসা পর্ব-২৯ এবং শেষ পর্ব

0
5069

#আসক্তিময়_ভালবাসা
#Part_29
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat

— আজ তোমার সব অভিমান দূর করে দিব। তোমার সকল প্রশ্নের উত্তর দিব আজ। ইতি টানবো তোমার আর আমার অপেক্ষার প্রহরের।

এই বলে রিয়ান আমাকে ছেড়ে দেয়। আমি কৌতূহলী চোখে তার দিকে তাকিয়ে রই। তা দেখে রিয়ান বলে,

— জানি তোমার মনে এত এত প্রশ্ন ঘুরছে। সবগুলো প্রশ্নের উত্তরই তোমার অজানা। আজ তুমি সেই অজানা প্রশ্নের উত্তর গুলোই পাবে।

এই বলে রিয়ান দীর্ঘ শ্বাস নেয়। আমিও নিজেকে সামলে নিয়ে বলি,

— চলুন ওইদিকটায় যাই।

রিয়ানও মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানায়। দুইজনই ছাদের পূর্বদিকে চলে যাই। ছাদের রেলিং ঘেষে দাঁড়িয়ে পড়ি। আমি শূন্য দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে রই। আমি রিয়ানের দিকে না তাকিয়েই বুঝতে পারি যে রিয়ান আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। যার ফলে ধীরে ধীরে আমার মধ্যে অস্বস্তি নামক শব্দটি বাসা বাঁধতে শুরু করে। আমি একটু নড়েচড়ে দাঁড়াতেই রিয়ান চোখ ঘুরিয়ে নেয়। অতঃপর চোখ বন্ধ করে লম্বা এক নিশ্বাস নিয়ে বলতে শুরু করে,

— তুমি তো জানোই আমি ইন্টারমিডিয়েট পাস করার পর সিডনিতে চলে গিয়েছিলাম হাইয়ার স্টাডি এর জন্য। সেখানে একা একাই থেকেছি এবং নিজের স্টাডি কমপ্লিট করেছি৷ তো আমি ওইখানে পড়াকালীন একটা প্রফেসরের সাথে আমার পরিচয় হয়। ড. ইথেন! অল্প সময়ের মধ্যেই তার সাথে আমার ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠে। তিনি পেশায় একজন সাইন্টিস্ট ছিলেন। গবেষণার পাশাপাশি শখের বসে শিক্ষকতাও করতেন তিনি। তিনি মূলত কেমিস্ট গবেষক ছিলেন। তার কাজই ছিল বিভিন্ন ধরনের কেমিক্যাল নিয়ে কাজ করা এবং তা দিয়ে মেডিসিন এন্ড ভ্যাকসিন তৈরি করা। তার সাথে থাকতে থাকতে আমারও এইসবের প্রতি ঝোঁক সৃষ্টি হয়ে। তাকে আমি জানাই আমি তার সাথে থেকে কাজ শিখতে চাই তখন তিনি খুশি হয়ে আমাকে তার ল্যাবে নিয়ে যায়। আমাকে সেখানেই এইসব নিয়ে গবেষণা করার ব্যবস্থা করে দেন। যার ফলে ধীরে ধীরে আমি কেমিক্যাল আর মেডিসিন নিয়ে বিভিন্ন ধরনের রিসার্চ এর সাথে জড়িয়ে যাই। পড়া লেখালেখির পাশাপাশি তার সাথে ল্যাবেও সময় কাটাতাম। এমনকি ড. ইথেনকে বিভিন্ন ধরনের মেডিসিন আবিষ্কার করতেও সাহায্য করি। বলতে গেলে কম সময়ের মধ্যেই আমার কেমিক্যাল নিয়ে একটা ভালো ধারণা হয়ে গিয়েছিল। তা দেখে ড. ইথেন আমার প্রতি মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন আর এরপর থেকেই তিনি আমাকে তার সকল রিসার্চে সাথে রাখতেন। কিন্তু আমি কখনো এইটাকে নিজের পেশা বানাতে চাই নি। যার জন্য আমার পড়ালেখা শেষ হতেই আমি বিডিতে ব্যাক করি। সাথে সাথে কোথাও জয়েন করতে চাচ্ছিলাম না বলে ১ বছর রেস্ট এ থাকবো বলে ঠিক করেছিলাম। আমার বিডিতে আসার ৬ মাস পরই ড. ইথেন এর কল আসে আমার কাছে। কলটা সোসাল সাইট থেকে এসেছিল। আর সেই কলটাই আমার জীবনের সব উলোটপালোট করে দেয়।
তিনি ফোনে জানান আমাকে ইমেডিয়েটলি সিডনিতে আসতে হবে। তার নাকি আমাকে প্রয়োজন। তিনি এতটাই ডেসপারেট ছিলেন যে তিনি টিকিটও বুক করে ফেলেন। আমি কারণ জানতে চাইলে তিনি আমাকে তখন জানান নি। শুধু বলেছিলেন আমি যেন আসি। কথাটা তিনি আকুতি সুরেই বলেছিলেন যার জন্য আমিও মানা করতে পারি নি। বাসায় জানিয়ে চলে যাই সিডনি।

এতটুকু বলে রিয়ান দম নেন। দীর্ঘ এক নিশ্বাস নিয়ে আবার বলতে শুরু করেন,

— সিডনিতে পৌঁছানোর পর জানতে পারি আসলে আমাকে কেন ডাকা হয়েছিল। ড. ইথেন আমায় জানান যে, অন্য এক সাইন্টিস্ট গ্রুপ এমন এক লিকুইড মেডিসিন বানিয়েছে যা পুরো মানবজাতির জন্য অতি ক্ষতিকর। আর তাদের এই মেডিসিন নিয়ে পরিকল্পনাও অতি ভয়ংকর। কিন্তু খবরটা তিনি কিভাবে পান তা আমায় জানায় নি। অতঃপর তিনি আমাকে যা বলেছিলেন তাতে আমি প্রস্তুত ছিলাম না। তিনি এই পরিকল্পনা বিনষ্ট করার দায়িত্ব আমাকে দিতে চান। সাথেই চান যে আমি যাতে সেই মেডিসিনটা ডিএক্টিভেট করতে তার সাহায্য করি। যেহেতু আমার এইসব নিয়ে ধারণা বেশ প্রখর ছিল তাই তিনি আমারই হ্যাল্প চাইলেন। আমিও সব শুনে রাজি হয়ে যাই। কেন না ড. ইথেনকে আমি ভালো মতই চিনতাম। সে খারাপের পক্ষে কখনো ছিলেন না। যার জন্য সন্দেহ নামক জিনিসটা কখনো আমার মধ্যে কাজ করে নি।
পরবর্তীতে আমি তার আসল প্লেন জানতে চাইলে তিনি জানান আমাকে সেই সাইন্টিস্ট গ্রুপের মেমবার হতে হবে। তাদের হয়ে কাজ করতে হবে এবং সুযোগ বুঝে সেই মেডিসিনটা নিয়ে আসতে হবে। এতে আমার লাইফের রিস্ক ছিল জানা কিন্তু তাও আমি মানা করি নি। আর তিনিও আমার কাছে এর জন্য ক্ষমা চেয়েছিলেন। বলেছিলেন সে নিরুপায়। তিনি আমাকে যুক্তিও দেখান। আমাকে চুস করার কারণ আমাকে কেউ চিনতো না। আর আমার ব্যাকগ্রাউন্ড চেক করলেও সন্দেহজনক কিছু তারা পেত না। আমাদের এই প্লেন সম্পর্কে আমি আর ড. ইথেন বাদে আরেকজন জানতো। সে ছিলেন ড. ইথেন এর বন্ধু মি. ফ্রয়েড। তিনি পেশায় একজন সিক্রেট এজেন্ট ছিলেন। তাকে সব জানানো হলে তিনি আমাদের সাহায্য করেন। এবং সেই গ্রুপ সামিল করিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থাও করে দেন। প্রথমত সেখানে সামিল হয়ে তাদের থেকে ইনফরমেশন নেওয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু সব চেষ্টাই বৃথা যাচ্ছিল। তাই আমি তাদের বিশ্বাস অর্জন করার চেষ্টায় লেগে পড়ি। তাদের বিশ্বাস অর্জন করতে আমার প্রায় ৪ মাস লেগে গিয়েছিল। অতঃপর জানতে পারি সেই মেডিসিনটা চুরি হয়ে যায়। তাদের মেমবারের মধ্যেই একজন এই কাজটা করেছে। সে নাকি মেডিসিনটা নিয়ে বিডিতে চলে গিয়েছে। তারা খোঁজ লাগিয়েছিল সেই ব্যক্তিটা বিডির কোথায়। কিন্তু খুঁজে পায় নি। সব শুনে তাদের আমি প্রস্তাব দেই, আমি যেন প্রস্তাব দেই আমি বিডিতে গিয়ে সেই ব্যক্তি আর মেডিসিন খুঁজে বের করবো। প্রথম দিকে তারা আমায় ট্রাস্ট করতে না পারলেও পরবর্তীতে করেছিল।
এইদিকে আমি ড. ইথেন আর মি. ফ্রয়েডকে সব জানিয়ে দিয়েছিলাম। সব শুনে ফ্রয়েড বলেছিলেন বিডিতে তার পরিচিত ৩-৪ জন সিক্রেট এজেন্ট আছে। যারা আমাকে সেই ব্যক্তিকে খুঁজে পেতে সাহায্য করবে এবং আমার সাথেই থাকবে। আমিও তাদের সাই দেই। কেন না একা আমার পক্ষে এইসব সামলানো সম্ভব ছিল না। অতঃপর আমি চলে আসি বিডিতে। এরপর থেকেই শুরু হয় সেই ব্যক্তিকে খুঁজা। আর আমার এই কাজে আমার হেল্প করেছেন আসিফ আর রহিম। মানে যারা তোমায় কিডন্যাপ করেছিল।

বলেই চুপ করে যায় রিয়ান। আমি ফ্যাল ফ্যাল করে তার দিকে তাকিয়ে থাকি। ধীরে ধীরে আমি সবকিছুর মধ্যে কানেকশন খুঁজে পাচ্ছিলাম। রিয়ান আমার দিকে তাকিয়ে বলে,

— বিডিতে এসে আমি বিভিন্ন জায়গায় ডাক্তার হিসেবে কর্মরত হওয়ার জন্য ট্রাই করছিলাম৷ কেন না খুঁজাখুঁজির কাজটা আসিফ আর রহিমই করতো। আমি অবসরই ছিলাম। কয়েকমাসের মধ্যেই আমি ঢাকা মেডিক্যালে এজ আ ডাক্তার নিয়োগ হই। এর আরও কয়েকমাস পরই তোমার আগমন হয় আমার জীবনে। এরপরই তোমার আংশিক রেসপন্সিবিলিটি আসে আমার ঘাড়ে। প্রথম দিকে তোমাকে আমার অনেক অসহ্য লাগতো। উটকো ঝামেলা লাগতো। কিন্তু এই তুমি যে কবে আমার অভ্যাসে আর সেই অভ্যাস থেকে বদভ্যাসে পরিনত হয়ে যাও বুঝতেই পারি নি। যেই আমি নিজের লাইফের চিন্তা কখনোই করতাম ধীরে ধীরে নিজের লাইফের চিন্তা করতে লাগলাম। মৃত্যুকে ভয় পেতে শুরু করেলাম। এর কারণ জানো কি ছিল? তুমি ছিলে কারণটা। কারণে অকারণে তুমি আমার জীবনের সাথে জড়িয়ে গিয়েছিলে। তাও খুব গভীরভাবে।
তাই আমি যতদ্রুত সম্ভব এইসব থেকে বেড়িয়ে আসতে চেয়েছিলাম। কিন্তু পারছিলাম না। সেই এক ব্যক্তিকে খুঁজতে গিয়ে আরও অনেক লিংক আপ বেড়িয়ে আসছিলাম। যারা বেরিয়ে আসে তারা দেশের বিরুদ্ধে কাজ করছিল। বলতে গেলে তারা জঙ্গিবাদ-এর সাথে জড়িত ছিল। তখন না চাইতেও আমাকে তাদের মারতে হয়েছিল। অবশ্য এতে আইনি সাপোর্ট ছিল। আইনি লোকের সাথেই তো ছিলাম। আমার সাথে থাকাকালীন তারাও এমন অনেকজনকে মারতে বাধ্য হয়েছে। এরই মধ্যে বুঝতে পারি সেই সাইন্টিস্ট এর লোকেরা আমার উপর নজর রাখছে। এবং তারা আমার কাজ দেখে সন্তুষ্ট যার জন্য আমার কাজ আরও সহজ হয়ে উঠে। অবশেষে অনেক খোঁজ নিয়ে জানতে পারি সেই ব্যক্তিটা মারা গিয়েছে যার কাছে মেডিসিনটা ছিল। মারা যাওয়ার আগে সে সেই মেডিসিনটা অন্য এক মাফিয়া দলের কাছে দিয়ে দেয় কিন্তু সেখান থেকেও কেউ তা চুরি করে নেয়। আর সেই চুরিটা করেছিলে তুমি। কথাটা জানার পর আমি থমকে গিয়েছিলাম। সব যেন কেমন উলোটপালোট হয়ে যাচ্ছিল। সব শুনে আমার মস্তিষ্কে প্রথমে এই প্রশ্ন নাড়া দেয় নি যে, “তুমি কিভাবে ওইখানে গিয়েছিলে? কিভাবে মেডিসিনটা তোমার কাছে মেডিসিনটা? তুমি কেন চুরি করেছিলে মেডিসিনটা?” বরং আমার মস্তিষ্কে প্রথমে এই প্রশ্ন নাড়া দেয় যে, “মেডিসিন তোমার কাছে মানে তোমার লাইফ এখন রিস্কে আছে। ইউ আর ইন রিস্ক।”
আমি শুধু তখন জানতাম তোমার থেকে যেকোন মূল্যে হোক মেডিসিনটা নিতেই হবে। কেন না আজ আমি জেনেছি পরবর্তীতে অন্য কেউ জানবে। আর তখন তারা জানার সাথেই তোমার উপর এট্যাক করবে। আমি চাইতাম না তুমি আমার পরিচয়টা জানো। তাই আমি তোমায় কিডন্যাপ করি আর তোমার সামনে মাফিয়া বেশে আসি। তোমাকে মারি, সেইরকম ব্যবহার করি যাতে তুমি ভয়ে বাধ্য হয় সব কিছু বলতে। সাথে আরেকটা কারণ ছিল তুমি যাতে আমায় চিনতে পারো। তোমার সাথে সেই আচরণটা করতে আমার কত কষ্ট হয়েছি তা শুধুমাত্র আমিই জানি। তোমাকে নিজ হাতে কষ্ট দিয়েছি বলে আমার সেই হাত কেটে ফেলতে ইচ্ছে করছিল। তোমার কান্না দেখে নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু কথায় আছে না, “যেখানে বাঘের ভয় সেখানে সন্ধ্যে হয়।” তুমি আমাকে চিনে নিয়েছিলে। কিন্তু তখন আমি চাইলেও কিছু বলতে পারছিলাম না। কেন না তোমাকে কিছুই বলাই মানে ছিল তোমার উপর বিপদ ডেকে আনা। তাই আমি সেইদিন চুপ ছিলাম।

আমি কাঁপা কাঁপা গলায় বলি,

— এই এক বছর তাহলে কি আপনি….

আমার কথার মাঝেই রিয়ান বলে উঠে,

— হ্যাঁ যা ভাবছো তাই। আমি এই এক বছর সেই মেডিসিনটাই ডিয়েক্টিভেট করার পিছেই লেগেছিলাম। মেডিসিনটা অনেক পাওয়ারফুল ছিল যার জন্য সহজেই এর সক্রিয়তা দমন করা যাচ্ছিল না। যার জন্য এতটা সময় লেগে যায়। আমি আর ড. ইথেন মেডিসিনটার সাথে জড়িত সকল তথ্য ধ্বংস করে দেই। যাতে কেউ আর চাইলেও তা দ্বিতীয়বার না বানাতে পারে।

— আর সেই সাইন্টিস্টদের কি হলো?

— তাদেরকে সিডনি পুলিশ নিজের কব্জায় নিয়ে নিয়েছে। আমি যেই কয়েকমাস ওদের সাথে ছিলাম সেই কয়েকমাসে ওদের বিরুদ্ধে সকল তথ্য জোগাড় করে নিয়েছিলাম। আর ইনফরমেশনগুলো সিডনির পুলিশদের কাছে দিতে বাকি ব্যবস্থা তারা করে নেয়। বাইরের দেশের আইন তো জানোই কত কড়াকড়ি। এখন আমিও এইসব থেকে মুক্ত আর সকলেও সেই বিপদ থেকে মুক্ত।

আমি কিছু না বলে রিয়ানকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে উঠি। রিয়ান আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে।

— জানি তোমার সাথে যোগাযোগ করতে পারি নি বলে রেগে আছো। কিন্তু বুঝার চেষ্টা করো। তখন আমার লাইফই রিস্কে ছিল। আমি যদি কাউরো সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করতাম তাহলে তার উপরও বিপদ নেমে আসতো।

আমি ফুঁপিয়ে বলি,

— আর এমন কাজে আপনি লিপ্ত হবে না। কখনো না!

রিয়ান মুচকি হেসে বলে,

— তা তুমি বলো। তুমি এই মেডিসিনটা কিভাবে পেয়েছিলে?

আমি ফোপাঁতে ফোপাঁতে রিয়ানকে সব খুলে বলি। রিয়ান সব শুনে বলে,

— বাহ! পেত্নি রিয়ানা দেখি বাঘিনী পেত্নি রিয়ানা বের হলো। তা আর কত রুপ আর রহস্য লুকিয়ে রেখেছ নিজের মধ্যে?

আমার বুঝতে দেরি নেই রিয়ান আমার লেগপুল করছেন। আমি রেগে রিয়ানের বুকে দুই তিনটা কিল বসিয়ে দেই। সে মৃদু হেসে বলে,

— রিয়ুপাখি!

সাথে সাথে আমি পাথরের ন্যায় দাঁড়িয়ে যাই। তার এই ডাক যে আমায় মূহুর্তেই দূর্বল করে দেয় তা কি সে বুঝে না? আমি মাথা নুয়ে তার বুকে মাথা রেখে শান্ত হয়ে যাই। রিয়ান এইবার আবেগী সুরে বলে,

— এইবার কিন্তু তোমার পালা। আমাকে এতটা বিশ্বাস করার দ্বিতীয় কারণটা কি? আর কি হই আমি তোমার?

প্রশ্ন গুলো শুনার সাথে সাথে আমার গালদুটো লাল হয়ে আসে। রিয়ানকে নিয়ে এত এত প্রশ্ন মাথায় ঘুরঘুর করার ফলে মাথা থেকে এই প্রশ্নইটাই বেড়িয়ে যায়। আমি লজ্জায় রিয়ানের মুখ লুকাতেই সে বলে,

— মুখ লুকালে হবে না? উত্তর কিন্তু তোমায় দিতেই হবে।

আমি এইবার মৃদু গলায় বলি,

— আপনাকে বিশ্বাস করার দ্বিতীয় কারণটি হচ্ছে আমারই অংশ বিশেষ আপনি। যেমন রিয়ানার মাঝেই রিয়ানের অস্তিত্ব তেমনেই রিয়ানের মাঝেই রিয়ানার অস্তিত্ব। আপনাকে বিশ্বাস নাই করতে পারি কিন্তু নিজের অস্তিত্বকে কিভাবে অবিশ্বাস করি?

আমি রিয়ানের চেহেরা না দেখলেও বলে দিতে পারছি তার ঠোঁটের কোনে এক চওড়া হাসি ফুটে উঠেছে। রিয়ান আমাকে ছেড়ে দিয়ে তার সামনে
এনে দাঁড় করায়। আমার চোখে দিকে তাকিয়ে বলে,

— তোমাকে ভালবাসি কি না জানি না। ভালবাসার সংজ্ঞা কি তাও জানি না। আমি শুধু এতটুকু জানি, আমি তোমাতে আসক্ত। তীব্র ভাবে আসক্ত। আর আমি কিন্তু এই আসক্ত থেকে বের হতে চাই না। বরং এই আসক্তিতে আরও গভীরভাবে ডুবে যেতে চাই। তাই আজ আমি তোমায় বলতে চাই…

এই বলে রিয়ান আমায় ছেড়ে দিয়ে নিজের ট্রাউজার এর পকেট থেকে কিছু একটা বের করে এক হাটু ভাঁজ করে মেঝেতে বসে পড়ে। আমার সামনে একটা রিং এগিয়ে দিয়ে বলে,

— আমাকে কি তোমাতে গভীরভাবে আসক্ত হওয়ার একটা সুযোগ দিবে? সারাজীবনের জন্য তোমাকে “আমার রিয়ুপাখি” বলার অধিকারটা দিবে? আমাকে কি তোমার ঠোঁটের কোনের মিষ্টি হাসি বানাবে?

এই বলে রিয়ান চুপ হয়ে যায়। আর আমি স্নিগ্ধ চোখে তার দিকে তাকিয়ে রই। গলা গিয়ে কোন কথা বের হচ্ছে না। একটু পর রিয়ান বলে উঠে,

— Will you be mine addiction for ever and ever?

কথাটা শুনে আমি স্তব্ধ হয়ে যাই। হুট করে চোখ পানি পড়তে শুরু করে। গলার ভিতরে যেন সব শব্দ দলা পাকিয়ে যাচ্ছে। খুশির চোটে যেন আমি কোন কথাই মুখ দিয়ে বের করতে পারছি না। আমি কিছু না বলে ধীর গতিতে আমার হাতটা এগিয়ে দেই। রিয়ান আমার দিকে তাকাতেই আমি মাথা নেড়ে সম্মতি জানাই। সাথে সাথে তার চোখ খুশিতে চিকচিক করে উঠে। সে আমার অনামিকা আঙ্গুলে রিংটা পড়িয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। আমার মুখের সামনে ঝুঁকে কপালে ভালোবাসার পরশ একে দেন। আমি হাল্কা হেসে মনে মনে বলি,

— আপনাতে আমি আসক্ত কিনা জানি কিন্তু আপনার আসক্তিময় ভালবাসায় বিভোর আমি। আর সারাজীবন এইভাবেই থাকতে চাই।

রিয়ান কিছু না বলে একটু পিছিয়ে গিয়ে একটা গোলাপের গাছ থেকে গোলাপ ছিঁড়ে এনে আমার কানে গুঁজে দেয়। আমার দিকে একটু ঝুঁকে কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিসিয়ে বলে,

— আমার রিয়ুপাখি!

__________________________________________

দেখতেই দেখতে কিভাবে দশটা বছর পেরিয়ে গেল বুঝতে পারলাম না। সময়ের এই স্রোতে গা ভাসাতেই বদলে গিয়েছে সকলের জীবনযাত্রা। কোন না কোন নতুনত্ব এসেছে সকলের জীবনে। যা তাদের জীবনে বিশেষ ভাবে লক্ষিত।

পায়েলেরই কথা বলা যাক। পায়েল এখন একজন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তার। বনানীর একটা প্রাইভেট হসপিটালেই বসে। পায়েল আর আদিব ভাইয়ার বিয়ে হয়েছে আজ বারো বছর হতে চললো। কিন্তু এখনো তাদের মধ্যে থাকা ভালবাসা একটু কমে নেই। এইতো চার বছর আগে তারা একটা ছেলেকে দত্তক নিয়েছেন। দুইজন মিলে নাম রেখেছে ওর ‘আদিল’। বাসায় এখন সবার চোখের মনি সে। ইসমি বেগম প্রথমে ওকে মেনে নিতে একটু দমনদোষা করলেও পরে মেনে নেয়। তিনি এখন আদিলকে চোখে হারায়।

অন্যদিকে, আনিশাও বেশ ভালো আছে। পাঁচ বছর আগেই একটা হসপিটালে কার্ডিলজিস্ট হিসাবে জয়েন করে। দুইবছর আগেই ওর একটা মেয়ে সন্তান হয়। নাম তার ‘মানতাশা’। ডা. মারুফ আর আনিশা দুইজন মিলেই পছন্দ করেছে নামটা। আনিশা মানতাশার জন্য আপাতত অবসর নিয়েছে। শ্বাশুড়ির সাথে আনিশার সম্পর্ক এখন যেন জমে ক্ষীর। দুইজনের মধ্যে বেশ ভাব। মানতাশা হওয়ার পর যেন সম্পর্কটা আরও মধুর হয়ে যায়। বলতে গেলে, শ্যাম আর শ্যামলতার সংসার ভালোই চলছে।

আর রইলো আমার কথা? আমিও ভালোই আছি। রিয়ান আর আমার বিয়ের ছয় বছর পূর্ণ হতে চলেছে। পড়ালেখা চলাকালিন আমার আর রিয়ানের এনগেজমেন্টটা করে রাখা হয়েছিল৷ অতঃপর আমার পড়ালেখা শেষেই আমাদের বিয়ে সম্পন্ন হয়। অবশ্য দুই পরিবারের মতামতেই হয়েছিল বিয়েটা। বিয়ের পর আমি রিয়ানের সাথে একই হসপিটালে নিউরোলজিস্ট হিসাবে জয়েন করি। বিয়ের তিন বছরের মাথায় আমার কোল জুড়ে আসে ‘রোয়েন’। আমাদের ছেলে। রোয়েন দেখতে একদম তার বাবার মত হয়েছে। সরু নাক, পাতলা ঠোঁট। চোখ দুইটি অবিকল রিয়ানের মত। রিয়ানের মত ওর ও বা গালের ছোট একটা কালো তিল আছে। শুধু গায়ের রঙটা পেয়েছে আমার। রিয়ানের প্রাণভোমরা হচ্ছে ‘রোয়েন’। কিন্তু তাই বলে আমি যে তুচ্ছ হয়ে গিয়েছি তা না। আমি তো আছিই তার আসক্তি হয়ে। আর সারাজীবন থাকবোও। কথা ভেবেই আমি হেসে দিলাম। এমন সময় অনুভব করলাম কেউ আমাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরছে। সাথে সাথে আমি কেঁপে উঠে। মূহুর্তেই আমি কেউ আমায় তার বাহুদ্বয়ের মাঝে আবদ্ধ করে ফেলে। নাকে একটা মিষ্টি একটা আসতেই বুঝে যাই এই হাত জোড়ার মালিক আর কেউ না বরং রিয়ান নিজেই। রিয়ান আমার কাধে থুতনি রেখে মৃদু গলায় বলে,

— এত রাতে বারান্দায় কি করছো?

আমি রিয়ানের বুকে ভর ছেড়ে দিয়ে বলি,

— তেমন কিছুই না। আজ হঠাৎ আকাশ দেখতে ইচ্ছে করলো তাই চলে আসলাম। রোয়েন কি রুমে?

— হ্যাঁ! ঘুমাচ্ছে।

— অহহ! তা আজ একটা জিনিস খেয়াল করলাম।

রিয়ান কৌতূহলী গলায় জিজ্ঞেস করে,

— কি?

— আপনি কিন্তু এই দশ বছরে একবারের জন্যও সেই তিনটা মধুর শব্দ বলেন নি।

রিয়ান হাল্কা হেসে আমার কাধে চুমু খেয়ে বলে,

— তুমি বুঝি বলেছ?

আমি কিছু না বলে চুপ করে রয়ে যাই। তা দেখে রিয়ান রিয়ান ভুবন ভুলানো হাসি দিয়ে বলে,

— সবসময় সবকিছু প্রকাশ করতে নেই। কিছু অনুভূতি অনুভব করতেই ভালো লাগে। সেগুলো যদি শব্দে প্রকাশ করতে যাও তাহলে তা ফিকে পড়ে যায়। শব্দগুলো কেমন সস্তা মনে হয়। আর এই ভাবনার মাঝেই ভাঁজেই অনুভূতিগুলো চাপা পড়ে যায়। অথচ তুমি যতক্ষণ না সেগুলো শব্দে প্রকাশ করছো ততক্ষণ তা থাকবে একদম সতেজ। একদম প্রথম ভালো লাগার প্রথম অনুভূতির মত। বুঝলে?

— কিন্তু সবসময় না হলেও দুই এক সময় অনুভূতি গুলো প্রকাশ করতে হয়। সবাই কিন্তু মনে কথা বা অনুভূতি মুখে না বললে বুঝতে পারে না। তাদের মনের শান্তির জন্যও দুই একসময় কথাগুলো বলতে হয়। তা না হলে মনের মধ্যে ভুল বুঝাবুঝি বাসা বাঁধে। অতঃপর ধীরে ধীরে সৃষ্টি হয় দূরত্ব।

রিয়ান আমাকে আরও গভীরভাবে জড়িয়ে ধরে বলে,

— কিন্তু সেগুলো অন্যদের বেলায়। যার বউ এত বুঝদার তাকে কোন কিছু প্রকাশ করার প্রয়োজন নেই।

— কেন যে আমি আপনার সামনে বুঝদার হতে গেলাম। আমি অবুঝই ভালো ছিলাম। নিজেকে এখন গালি দিতে ইচ্ছে করছে।

রিয়ান এইবার একটু গলা উঁচিয়ে বলে,

— এই খবরদার আমার রিয়ুপাখি তুমি গালি দিবা না। তা না হলে তোমাকে একদম খেয়ে ফেলবো আমি।

আমি ভেংচি কেটে বলি,

— দরদও দেখান আবার হুমকিও দেন? এইটা কোন কথা?

— আসলেই এইটা কি কোন কথা?

সাথে সাথে আমি আর রিয়ান এক সাথে হেসে উঠি। রিয়ান আমাকে তার দিকে ঘুরিয়ে কপালে ভালবাসার পরশ দিয়ে বলেন,

— আমাকে তোমাতে আসক্ত করার জন্য ধন্যবাদ।

আমি রিয়ানের বুকে মাথা রেখে বলি,

— আমাকে আপনার আসক্তময় ভালবাসায় বিভোর করার জন্য ধন্যবাদ।

রিয়ান কিছু না বলে আমাকে কোলে নিয়ে বারান্দায় রাখা চেয়ারে বসে পড়ে। আলতো হাতে আমার মাথায় বিলি কেটে দিতে থাকে। আমিও পরম যত্নে তার কাধে মাথা রেখে আকাশে চাঁদের দিকে তাকিয়ে রই। কখন যে আমি তার কাধেই ঘুমিয়ে পড়ি জানি না। রিয়ান তা দেখে আমার কানের কাছে মুখ এনে আলতো করে কান ছুঁয়ে দিয়ে বলে,

— ভালবাসি রিয়ুপাখি।

ঘুমের ঘোরেই আমি তার কথা শুনে কেঁপে উঠি। রিয়ানের গলা আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরি। তা থেকে রিয়ান মুচকি হেসে আমাকে কোলে নিয়েই রুমে দিকে চলে যায়। হয়তো এইভাবেই চলতে থাকবে আমার আর রিয়ানের খুনসুটিতে ভরা আসক্তিময় ভালবাসা।

🌸সমাপ্ত🌸

আগেই সরি বলে নিচ্ছি এত বাজে একটি গল্প আপনাদের মাঝে উপস্থাপন করার জন্য। গল্পটা হয়তো সুন্দর হতে পারতো যদি আমি গল্পটা লিখার আগেই ভালো মত গল্পের প্লটটা সাজিয়ে নিতাম। গল্পটা পুরো না সাজিয়ে লিখার ফলে মাঝ দিয়ে পুরো গল্পের সৌন্দর্যই নষ্ট হয়ে যায়। আর গল্পটা বাজে হয়ে যায়। মাঝে মধ্যে হয়তো বা অন্য গল্পের সাথে কিছু জিনিস মিলেও গিয়েছে। তা হয়তো আমি খেয়াল করেও করি নি। এর জন্য আমি প্রচন্ড পরিমাণে দুঃখিত।

এতদিন এই গল্পের পাশে থাকার জন্য ধন্যবাদ আর এমন একটা বাজে গল্প দেওয়ার জন্য এগেইন সরি।🙂