আড়ালে আবডালে পর্ব-২৬+২৭

0
5101

#আড়ালে_আবডালে
#পর্ব_২৬
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
___________________

নিহি কাঁপছে। ঠোঁট কাঁপছে অনবরত। শীতের ঠান্ডা হাওয়ায় নয় বরং আমানের স্পর্শে। শীতল হাতে যখন নিহির হাত ছুঁয়ে দেয় তখন শরীরের কাঁপুনি যেন আরো বেড়ে যায়। নিহির ঠোঁট কাঁপা দেখে আমান হেসে ফেলে। নিজের বাহুবন্ধন থেকে নিহিকে ছেড়ে দেয়। গায়ের জ্যাকেট খুলে নিহির গায়ে পরিয়ে দিতে গেলে নিহি বাঁধা দিয়ে বলে,
“লাগবে না। আমি এখন ঘরে চলে যাব।”
“কীহ্! ঘরে চলে যাবেন?”
“হু।”
“ওকে। চলুন।”
“আপনি কোথায় যাবেন?”
“আপনার সঙ্গে। আপনার ঘরে।”
“পাগল? আমার সঙ্গে তরু থাকে।”
“তো? আমি এতদূর থেকে শুধুমাত্র আপনার সঙ্গে দেখা করার জন্য এসেছি, আর আপনি যাওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন!” কথাটা অভিমানি সুরেই বলল আমান। নিহি এক পলক তার দিকে তাকিয়ে জ্যাকেটটা হাত থেকে ছোঁ মেরে নিয়ে নিজে পরে নেয়। আমান মৃদু হাসে। নিহি ছাদের রেলিং এর দিকে এগিয়ে যায়। রেলিং এর সঙ্গে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বলে,

“যাচ্ছি না আমি। আছি।”
আমানের ঠোঁটে তখনো মৃদু মুচকি হাসি। নিহি এখন প্রায় দু/তিন হাত দূরে আছে আমানের থেকে। নিহি আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। তারা তো একদম নেই বললেই চলে। অর্ধ চাঁদ রয়েছে তাও কুয়াশার জন্য পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে না। ঘোলা মনে হচ্ছে। নিহি যখন আকাশের তারা, চাঁদ নিয়ে ভাবতে ব্যস্ত আমান তখন মনের প্রেয়সীকে দেখে নিচ্ছে মন ভরে। তবুও যেন মনের তৃষ্ণা, চোখের পিপাসা মেটে না। অনন্ত কাল সামনে বসিয়ে রাখলেও বোধ হয় দেখার সাধ পূরণ হবে না। এসব ভাবতে ভাবতে আমান নিজেই হেসে ফেলে। শীতে শরীরের লোম সব প্রায় দাঁড়িয়ে গেছে। এই মুহূর্তে আমানের গায়ে হাফ স্লিভ কালো টি-শার্ট আর প্যান্ট রয়েছে। জ্যাকেট তো নিহির গায়ে। শীত লাগাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে নিহির দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। আকাশ থেকে চোখ সরাতেই নিহির চোখ আটকে যায় আমানের দিকে। আমান যে শীতে কাঁপছে সেটা বোঝা যাচ্ছে। নিহি একটু নড়েচড়ে দু’হাত বগলদাবা করে দাঁড়িয়ে নাক ফুলিয়ে বলে,
“এখন কেমন লাগছে?”
আমান ভ্রু দুটি উঁচু করে বলে,
“কেমন?”
“ঠান্ডায় কেমন লাগছে?”
“ভালোই।”
ভ্রুকুটি কুঞ্চিত হয়ে যায় নিহির। নাকের ডগায় তীব্র রাগ। শুধু কিছু বলতেই পারছে না। অন্যদিকে চোখ ফিরিয়ে নেয় নিহি।
আমান এক পা, দু পা করে নিহির সামনে এগিয়ে যায়। নিহি সেটা খেয়াল করে বলে,
“খবরদার কাছে আসবেন না। সরুন।”

আমান নিহির বাঁধা মানে না। সামনে এগিয়ে যায়। নিহির দু’পাশে হাত রেখে মুখটা সামনে এগিয়ে নেয়। নিহি নিচের দিকে একটু বেঁকিয়ে পড়ে। আমান একটু ঝুঁকে প্রশ্ন করে,
“এত রাগ কেন?”
নিহি একবার নিচের দিকে তাকিয়ে বড় ঢোক গিলে। তারপর দু’হাতে আমানকে ঠেলে দূরে সরিয়ে দিয়ে বলে,
“রাগ করার মতো কাজ করতে পারবেন। আর আমি রাগ করলেই দোষ?”
“তা এখন কী করলে রাগ ভাঙবে?”
“কিচ্ছু করতে হবে না। সরুন।”

নিহি আমানের থেকে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়ায়। আমান এবার রেলিং এর সঙ্গে হেলান দিয়ে দাঁড়ায়। রাতের মৃদুমন্দ আলোতে নিহির মুখের দিকে তাকিয়ে কাঁপা কণ্ঠে গান শুরু করে।

“Dil ko dil se kuchh hai kehna
Dil se ab na door rehna
Dil ki bas yehi ghuzarish hai.”

নিহি একবার আমানের দিকে তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নেয়।

“Dhadkanon ko ki sun’ne baatein
Jo labon se keh na paate
Dil ki bas yehi ghuzarish hai.”

আমান গান গাইতে গাইতে নিহির দিকে এগিয়ে যায়। নিহির এক হাত ধরে একটু উঁচু করে আঙুল ধরে নিহিকে ঘুরায় আর গান গায়,

“Jab se mera dil tera hua
Poochho na mujhko mujhe kya hua
Ab teri baahon mein jeena mujhe
Warna hai mar jaana.”

নিহির মাথা ঘুরাচ্ছে। নিহি হকচকিয়ে গিয়েছিল প্রথমে। এখন নিজেকে সামলে নিয়েছে। আমানের বুকে আড়ষ্ট হয়ে মাথা রেখেছে। আমান মুচকি মুচকি হাসছে। ফিসফিস করে বলে,
“এখন আর ঠান্ডা লাগছে না।”
নিহি কোনো উত্তর করছে না। নিশ্চুপ হয়ে আমানের বুকের ধুকপুকানি শুনছে। নিজেকে অনেক বেশিই সুখী মনে হচ্ছে নিহির এখন। বেশ কিছুক্ষণ এভাবেই কেটে যায়। এরপর আমান নিজেই বলে,
“এখন ঘুমাতে যান।”
নিহি আমানের বুক থেকে মাথা না তুলেই বলে,
“আপনি ঘুমাবেন না?”
“হ্যাঁ। আপনি আগে যান। তারপর আমি আসছি।”
আমানকে ছেড়ে দিয়ে লজ্জায় আর এক মুহূর্তও দাঁড়াতে পারে না সেখানে। দৌঁড়ে পালিয়ে যায়। সিঁড়ি দিয়ে প্রথমে ধূপধাপ করে নামলেও পরে আস্তেধীরে নামে। নয়তো যদি পরে আবার বাড়ির কেউ টের পায়! নিহি যতবার এভাবে লজ্জা পেয়ে পালিয়ে যায়, ততবার আমানের বুকে খুশির ঢেউ নাচানাচি করে।
.
.
‘এলোকেশী,
ঘুমজড়ানো মিষ্টি রোদে দৃষ্টি দিয়ে সূর্যকে কাবু করো না। ঐ মিষ্টি হাসি প্রকৃতিকে দেখিও না। তাহলে যে প্রকৃতিও তোমার প্রেমে পড়ে যাব। তোমার ঐ মিষ্টি রূপ, মিষ্টি হাসি আমার দৃষ্টিতে আবদ্ধ থাকবে। আর কাউকে দেবো না সেই সৌন্দর্যের ভাগ।’

চিঠিটা পড়ে নিহি কিছুক্ষণ থম মেরে বসে থাকে। সকালে তমা ফোন দিয়ে হোয়াটসএপে যেতে বলল। গিয়ে দেখে এই চিঠিটার ছবি পাঠিয়েছে। সঙ্গে একটা ম্যাসেজ। ‘এটা আজকের চিঠি। বাকি চিঠিগুলো লুকিয়ে রেখেছি। কী এক মুসিবত বলো তো? তোমার কথামতো আমি বারণ করেছি চিঠি দিতে। তবুও তারা শোনে না। হয় পিয়ন, নয়তো ঐ ছোট ছেলেটা এসে চিঠি দিয়ে যায়। কিছু বলার সুযোগও দেয় না।’

নিহি ম্যাসেজটা পড়ে রিপ্লাই করে,
‘আচ্ছা ইয়ারচেঞ্জ পরীক্ষার পর আমি বাড়িতে ফিরে বিষয়টা দেখছি।’ রিপ্লাই করে অফলাইন হয়ে যায়। এক মনে ভাবে আমানকে বিষয়টা জানাবে। আবার আরেক মনে ভাবে না, থাক! দেখিই না কী হয়! বিছানা ছেড়ে নিহি ফ্রেশ হতে চলে যায়। কলেজ ড্রেস পরে রেডি হয়ে ডাইনিং রুমে যায়। নিরব, আমান, লিমন, তরু, লিয়াকত শিকদার আর মামী আগে থেকেই ছিল। নিহিকে দেখেই এক গাল হাসি দিলো নিরব। সবার দিকে তাকিয়ে আগে লক্ষ করল নিহি, কেউ দেখেছে কী-না! তাকিয়ে দেখল আমান বাদে আর কেউই দেখেনি। একটা চেয়ার টেনে তরুর পাশে বসে নিহি। নাস্তা করতে করতে আড়চোখে আমানের দিকে তাকায়। নিহি তখন হতবাক! আমানও চোরের মতো আড়চোখে একটু পরপর নিহিকে দেখছে। নিহি এবার অবাক করার মতো একটা কাজ করে বসল। সকলের দৃষ্টির আড়ালে ঠোঁটদুলো কিঞ্চিৎ চোখা করে ফ্লাইং কিস দেয়। সঙ্গে সঙ্গে দুজন ব্যক্তির হেঁচকি উঠে যায়। একজন আমান আর অন্যজন নিরব। চুমুটা দেওয়ার সময়ই নিরব নিহির দিকে তাকায়। দুজনের একসঙ্গে হেঁচকি উঠা দেখে তরু আর নিহি শব্দ করে হেসে ফেলে। মামা তখন মামীকে বলেন, “ওদেরকে পানি দাও।”
মামী ওদেরকে পানি এগিয়ে দেয়। নিহি আমানের দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে। পানি পান করা শেষ হলে নিরব আমানের সঙ্গে ঘেঁষে বসে ফিসফিস করে বলে, “স্যার, কবে জানি আমি স্ট্রোক করে ফেলি!”
উত্তরে আমান হাসে।

নাস্তা করা শেষ হলে আমান আর নিরব বাড়ির সবার থেকে বিদায় নিয়ে আগেই চলে যায়। ওদের যাওয়ার কিছুক্ষণ পরই নিহি আর তরু কলেজে যাওয়ার জন্য বের হয়। আমান তখন নিহির ফোনে টেক্সট করে,
“আজও কি ঐ জায়গায় আসবেন?”
নিহি তখন তরুর দিকে তাকায়। ওর বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে কথা বলছে। এবং এটাও জানতে পারে আজও ওরা দেখা করবে। নিহি ছোট করে রিপ্লাই করে, “হুম।”

আমান আর কোনো রিপ্লাই না করে সেখানে গিয়ে অপেক্ষা করে।
প্রতিদিনকার মতো আজও তরু ওর বয়ফ্রেন্ড শিশিরের সঙ্গে আলাদা কথা বলে। নিহি হাঁটতে হাঁটতে ভেতরের দিকে যায়। আমান পিছন থেকে পা টিপে টিপে নিহির কাছে আসে। ফিসফিস করে বলে,
“এইতো এখানে আমি।”
আচমকা নিহি ভয় পেয়ে যায়। নিজেকে সামলে নিয়ে আমানের বাহুতে কিল দিয়ে বলে, “ভয় পাইয়ে দিয়েছেন!”

আমান অসীম সাহসিকতার সাথে নিহির হাত চেপে ধরল। নিহি একবার ধরে রাখা হাতের দিকে তাকিয়ে তারপর আমানের দিকে তাকালো। আমানের চোখের গভীর ভালোবাসার রেশ নিহিকে আবদ্ধ করে ফেলছে ক্রমাগত। নিহি দ্রুত চোখ সরিয়ে নেয়। দৃষ্টি দূরে সরালেও হাত ছাড়ানোর বিন্দুমাত্র চেষ্টা করে না। হাত ধরেই দুজনে নিশ্চুপ হাঁটতে থাকে। নিহির হাত কাঁপছে। কিছুক্ষণ নিরবতা পালন করে প্রথম কথা বলা আমানই শুরু করে।জিজ্ঞেস করে,
“কাল তো শুক্রবার। প্রাইভেট, কোচিং কিছু আছে?”

“নাহ্!” ঠোঁট বাঁকিয়ে উত্তর দেয় নিহি। আমান তখন খুশি হয়ে বলে,
“তাহলে চলুন কোথাও থেকে ঘুরে আসি।” নিহি ভারী অবাক হয়ে প্রশ্ন করে,
“কোথায়?”
“জাফলং।”
“বাড়িতে কী বলব আমি? একা তো ছাড়বে না।”
“কিছু একটা বলে ম্যানেজ করুন। প্লিজ। বেশি সময় তো থাকব না।”
নিহি কিছুক্ষণ ভেবে বলে,
“আচ্ছা আমি দেখছি।”
হাঁটতে হাঁটতে থমকে যায় দুজনে। ওদের থেকে কিছুটা দূরে তরু আর শিশির দাঁড়িয়ে আছে। দুজনই নিহি আর আমানকে হাত ধরা অবস্থায় দেখে ফেলে। ভয়ে জমে যায় নিহি। ভয় পেলেও আমান বা নিহি কেউই কারো হাত ছাড়ে না। বড় বড় ঢোক গিলে নিহি তরুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।

_____________________

থাই গ্লাসের কাঁচ গলে সূর্যের রোদের আলো অনলের বিছানায় এসে ঘাপটি মেরে বসেছে। লেপের ভেতর থেকে মাথা বের করে চোখ বন্ধ করেই আড়মোড়া ভাঙে অনল। আস্তে আস্তে চোখ খুলে জানালার দিকে তাকিয়ে একটা হাই তুলে। কাল রাতে এসেই শুয়ে পড়েছিল। জানালার পর্দাও টেনে দিতে মনে ছিল না। যার দরুণ ঘরে সূর্যের আলো প্রবেশ করতে পেরেছে। অবশ্য এমন মিষ্টি রোদ অনলের খারাপ লাগছে না; বরং আলস্যকে আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। নরম গরম বিছানা সঙ্গে এমন মিষ্টি রোদ বিছানায়! কারই বা ইচ্ছে করবে আরামের ঘুম ছেড়ে উঠতে? তবে অলসতাকে প্রাধান্য দিলে এখন চলবে না। ভার্সিটিতে যেতে হবে। মিলন রাতে ফোন করে জানিয়েছে জরুরী কথা আছে। তাই অলসতা ত্যাগ করে অনল বিছানা ছেড়ে ওঠে। ফ্রেশ হয়ে একদম রেডি হয়েই কলেজের উদ্দেশ্যে বের হয়। হাত-ঘড়িতে দেখে নেয় অলরেডি দশ মিনিট লেট।

যেতে এখনো আরো বিশ মিনিটের মতো লাগবে। এর মাঝেই ট্রাফিক জ্যামে আটকে রয়েছে। বাইকে বসেই আশপাশটা দেখছিল অনল। হুট করেই চোখ আটকে যায় একটি রিক্সায়। দুজন কাপল বসে আছে। ছেলেটির হাতে মেয়েটির হাত আবদ্ধ। মেয়েটি হাসলেও ছেলেটির মুখে অভিমানের ছাঁপ। বোঝা যায় কিছু একটা নিয়ে মেয়েটার সঙ্গেই অভিমান করেছে। মেয়েটা অভিমান ভাঙার বদলে উল্টো হাসছে। অনলের নিহির কথা মনে পড়ে যায়। বুকটা ধক করে ওঠে তখন। এরকমই একদিন নিহির সঙ্গে রিক্সায় যাওয়ার সময় অনল অভিমান করেছিল। তার কারণ ছিল নিহি ভাই ডেকেছিল। নিহিও অভিমান ভাঙানোর বদলে হেসেছিল খুব। পার্থক্য এইটুকুই ওরা যেমন হাত ধরে আছে অনল আর নিহি হাত ধরা অবস্থায় ছিল না। একরাশ একাকীত্ব অনলকে জাপটে ধরেছে। সবকিছুই শূন্য শূন্য লাগছে। রাস্তার এত কোলাহল, ড্রাইভারদের তর্ক কোনো কিছুই অনলের মস্তিষ্কে অবস্থান করতে পারছে না। ট্রাফিক জ্যাম যে এর মাঝেই ছেড়ে দিয়েছে সেদিকেও কোনো খেয়াল নেই। ওর পেছনের লোকজনও ওকে অতিক্রম করে গাড়ি নিয়ে ছুটে চলেছে। অনল তখনো নিহির ভাবনায় নিমজ্জিত। মনে হচ্ছে বুকের ভেতর থেকে কেউ খুব দামী জিনিস কেড়ে নিয়ে যাচ্ছে। ধ্যান ভাঙে ফোনের রিংটোনে। অনল খেয়াল করে দেখে গাড়ি চলছে তাদের নিজের গতিতে। অনল ফোন রিসিভ করে না। কল কেটে দিয়ে বাইক স্টার্ট দেয়। দশ মিনিটের মাথায় অনল কলেজে পৌঁছে যায়।

অনলকে দেখে মিলন আর সাকিব এগিয়ে আসে। মিলন জিজ্ঞেস করে,
“কীরে ফোন দিলাম ধরলি না কেন?”
“বাইকে ছিলাম।”
অনলের চোখমুখ শুকনো। যেই প্রফুল্লতা নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়েছিল সেটা আর নেই। চুপচাপ হাঁটছে। ওর সঙ্গে সাকিব আর মিলনও আসে।
“ইরার সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে নাকি আবার?” জিজ্ঞেস করে সাকিব।
অনল বিরক্তিকরভাবে ‘চ’ উচ্চারিত শব্দের মতো ব্যাঙ্গ করে বলে,
“এক সপ্তাহ্-র বেশি হবে কথা হয় না।”
“কেন?”
“আমিই বলি না। ভালো লাগে না।”
“আচ্ছা বাদ দে। চল ক্যান্টিনে যাই। সুমু আর লিসা ক্যান্টিনেই আছে।”
“চল।”

ক্যান্টিনের দিকে যাওয়ার পথে একবার নিহিদের ক্লাসরুমের দিকে তাকায় অনল। ঐ বারান্দায় কতবার নিহিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছে। মজার বিষয় হলো, একটা সময় নিহি লুকিয়েও অনলকে দেখত। সেই সময় আর এই সময়ের মাঝে এখন বিস্তর তফাৎ। সেই চাঞ্চল্য, তেজী রূপ, স্নিগ্ধ মুখ এখন হঠাৎ শুধু চোখের সামনেই ভাসে। বাস্তবে আর দৃশ্যমান হয় না। বুকচিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে অনলের। নিহি চলে যাওয়ার পর এত খারাপ কখনোই অনলের লাগেনি। যতটা আজ, এখন লাগছে। সকালে মনে হয়েছিল আজ দিনটা ভালোই কাটবে। তবে এখন মনে হচ্ছে সারা দিনরাত আজ শুধু বিষণ্ণতায় কাটবে। এত হতাশারা ঘিরে ধরেছে যা অনল কল্পনাও করতে পারছে না। কী অদ্ভুত বিষাদ! প্রচণ্ড বিষাদ।

ক্যান্টিনে কফি অর্ডার দিয়ে বসে। সুমাইয়া জিজ্ঞেস করে,
“মন খারাপ নাকি তোর?”
“না, ঠিক আছি। তোরা বল। কী এত জরুরী কথা?”
মিলন এবার উৎসুক হয়ে বলে,
“দোস্ত অনেকদিন হয়েছে ট্যুর দেওয়া হয় না। চল কোথাও থেকে ঘুরে আসি।”
অনল চেয়ারের সঙ্গে হেলান দিয়ে বেঁকিয়ে বসেছিল। মিলনের প্রস্তাব শুনে একবার মিলনের দিকে তাকালো। মনে মনে ভাবল, একটা ট্যুর দিলে মন্দ হয় না। নিহির ভূত শুধু মাথাতেই নয় মনের মাঝেও এসে পড়েছে। ভূত তাড়াতে হবে। লাই দেওয়া যাবে না একদম। মাথার ভূত সর্বোচ্চ দু’দিন থাকে। কিন্তু মনের অসুখ সারানো সহজ নয়। ট্যুর দিলে মাইন্ড রিফ্রেশ হবে। অনল এবার সোজা হয়ে বসে। টেবিলের ওপর বাইকের চাবি ঘুরাতে ঘুরাতে বলে,
“বল কবে যাবি?”
অনল রাজি এটা ভেবেই সবাই খুশি হয়। সাকিব বলে,
“আমরা তো সব রেডি করেই রেখেছি। শুধু তোর ‘হ্যাঁ’ বলার অপেক্ষাতে ছিলাম।”
অনল মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করে,
“আমি যদি না যেতাম?”
উত্তরে তখন মিলন বলে,
“এহ্! হাতে-পায়ে ধরে হলেও রাজি করাতাম।”
অনল এবার শব্দ করে হেসে বলে,
“আচ্ছা বল এখন। কোথায় যাবি আর কবে যাবি?”
“আজ রাতেই রওনা দেবো। সিলেট যাব। চা বাগান আর জাফলং-এ ঘুরব।”
“ওকে ডান।”

কফি এসে পড়েছে। সবাই কফি খেতে খেতে ট্যুর নিয়ে ডিসকাস করছে। অনল কফির মগ হাতে নিয়ে এক দৃষ্টিতে কফির দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলে,
“আমি তোমায় কিছুতেই আমার মনে এলাউ করব না নিহি। কিছুতেই না!”

চলবে…

#আড়ালে_আবডালে
#পর্ব_২৭
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
___________________

বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তরু তাকিয়ে আছে নিহির দিকে। একবার নিহি আর আমানের মুখের দিকে তাকায় আরেকবার তাকায় ধরে রাখা হাতের দিকে। অন্যদিকে অপ্রস্তুত আমান আর নিহিও বুঝতে পারছে না কী করবে! তরুর যেন মুখ থেকে কোনো কথা বের হচ্ছে না। তরু এটাই ভেবে পাচ্ছে না মাত্র একদিনের পরিচয়ে একটা ছেলের সাথে হাত ধরে কীভাবে হাঁটে? তাছাড়া উনার সাথে তো নিহির কথাও হয়নি! তবে কি ওরা আগে থেকেই পরিচিত? কিন্তু এটা কী করে সম্ভব? যোগসূত্র বা সমীকরণ কোনোটাই তরু মেলাতে পারছে না। দূরত্ব ঘোচায় আমান। নিহিকে নিয়ে তরুর সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকে তরু আর শিশির। আমানই প্রথম কথা বলা শুরু করে বলে,
“আমি বুঝতে পারছি আপনি একটা ঘোরের মাঝে আছেন। যখন দুজনকে একসঙ্গে দেখেই ফেলেছেন তখন সব পরিষ্কার করেই বলি। নিহির সঙ্গে আমার সম্পর্ক আরো আগে থেকেই আছে।”
“তার মানে আপনারা পূর্বপরিচিত?” বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করে তরু।

আমান বলে,
“হ্যাঁ। ওর জন্যই আমি ঢাকা থেকে সিলেটে এসেছি।”
“হায় আল্লাহ্! আমি বুঝতেও পারিনি।”
এরপরই হেসে নিহিকে বলে,
“কীরে নিহি? আমি তো তোকে সব বলি। তাহলে তুই আমায় বলিসনি কেন?”

মনের ভেতর যেই ভয়গুলো পাহাড়সম হয়ে ছিল নিহির তা এখন ভেঙেচুরে গেছে তরুর হাসিতে। তার মানে তরু মেনেই নিয়েছে! তাছাড়া না মানারও তো তেমন কোনো কারণ নেই। আমান নিজেও ভাবেনি তরু এত সহজেই সবটা মেনে নেবে। নিজেকে নিয়ে আমানের কোনো ভয় ছিল না। ভয় ছিল নিহিকে নিয়ে। যদি ওর বাড়ির কেউ জানতো তাহলে অনেক বেশিই সমস্যা হয়ে যেত। নিহি হাসার চেষ্টা করে বলে,
“বলতাম কিছুদিন পর।”
“হয়েছে। আর বলতে হবে না। এখন তো আমি জেনেই গেছি।”
নিহি আমতা আমতা করে বলে,
“বাড়ির কাউকে বোলো না প্লিজ!”
“ধুর! পাগল নাকি? নিশ্চিন্তে থাক। কাউকে বলব না।”

তখন শিশির প্রস্তাব করে,
“পাশেই একটা চায়ের দোকান আছে। ওখানে গিয়ে বসে কথা বলা যায় না?”
“হ্যাঁ,শিওর।” বলে আমান।

তারপর চারজন মিলে হাঁটতে থাকে কথা বলতে বলতে। নিরব গাড়িতে বসে ছিল। আমান ফোন করে গাড়ি লক করে বাইরে আসতে বলে। তারপর পাঁচজন মিলে চায়ের দোকানে বসে আড্ডা দেয়। আমান তখন জাফলং-এ যাওয়ার প্রস্তাব করে। নিহির মতো তরুরও ভয় যদি বাড়িতে রাজি না হয়? তবুও ওদের কথা দেয় যে, বাড়িতে রাজি করানোর জন্য যথেষ্ট চেষ্টা করবে। কলেজের সময় হয়ে এসেছে বলে ওরা তরু আর নিহিকে কলেজে পৌঁছে দেয়। ক্লাস শুরু হতে এখনো দশ মিনিট আছে হাতে। আমান, নিরব আর শিশির গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। দুই তলার ক্লাসের বারান্দা থেকে রাস্তা দেখা যায়। নিহি আর তরু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওদের দেখছে আর মিটিমিটি হাসছে। ক্লাসের তরুর অনেক বান্ধবীই শিশিরের কথা জানে। ওরাও বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। ওদের মধ্যে নৌরিন এসে তরুর গলা জড়িয়ে ধরে বলে,
“কী? দুলাভাইকে দেখা হচ্ছে?”

তরু লজ্জা পেয়ে হাসে। বাকিরা শব্দ করে হাসে। সঙ্গে নিহিও হাসে। নৌরিন হাসতে হাসতে রাস্তার দিকে তাকায়। হঠাৎ-ই ওর হাসি থেমে যায়। চোখ আটকে যায় কালো শার্টের ওপর ডেনিম জ্যাকেট পরা ছেলেটির দিকে। মোহময় দৃষ্টিতে তাকিয়ে তরুকে জিজ্ঞেস করে,
“তরু, দুলাভাইর পাশে কালো শার্ট পরা ছেলেটা কে রে?”
নিহির মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে যায়। আমান-ই কালো শার্ট পরে আছে। ওর কথা কেন জিজ্ঞেস করছে নৌরিন? এদিকে আমান আর নিহির সম্পর্কের কথাও কাউকে জানানো যাবে না। তরু নিহির দিকে তাকায়। নিহি উত্তরে বলে,
“শিশির ভাইয়ের বন্ধু।”

নৌরিন পুলকিত হয়ে বলে,
“ইশ! কী হ্যান্ডসাম! এত্ত সুন্দর কেন?”
এরপরই তরুকে অনুরোধের স্বরে বলে,
“তরু, তরু প্লিজ শিশির ভাইকে বল তার নাম্বারটা আমায় এনে দিতে প্লিজ!”
নিহি ক্রোধানল দৃষ্টিতে তাকায় নৌরিনের দিকে। ইচ্ছে করছে চুলের মুঠি ধরে আছড়াতে। হতচ্ছারি বেয়াদব মেয়ে! তোর উনার দিকে কেন নজর দিতে হবে রে?

এর মাঝেই ক্লাস শুরু হওয়ার ঘণ্টা পড়ে যায়। নিহি হনহন করে ক্লাসে চলে যায়। তরুও আর সময় বিলম্ব করে না। দৌঁড়ে ক্লাসে চলে যায়। নৌরিন তখনো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমানকে দেখছে। নিহি ক্লাসে গিয়ে ফোন নিয়ে এক কোণায় বসে। আমানকে ফোন করে। দু’বার রিং হওয়ার পর আমান ফোন রিসিভ করে বলে,
“এখন না ক্লাস শুরু হবে?”

নিহির মেজাজ গেল আরো খারাপ হয়ে। ক্লাস শুরু হয়েছে তাতে তার কী? তার কি ক্লাস শুরু হয়েছে নাকি আমার? মায়ের চেয়ে যেন মাসির দরদ বেশি! রাগে বিড়বিড় করতে করতে লাগল নিহি। রাগকে আর কন্ট্রোল করতে না পেরে বলল,
“আমার ক্লাস শুরু হইছে তাতে তোর কী? আমি ফোন দিছি বলে তোর সমস্যা হয়ে গেছে? সমস্যা হলে আমার কী? আমি ফোন দিবোই! তাতে তোর কী?”

আমান হতভম্ব হয়ে ফোন কানে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একটুর জন্য হাত ফস্কে ফোনটা পড়ে যায়নি। বিশ্বাসই করতে পারছে না নিহি যে এমন তুই-তোকারী করে কথা বলছে! এতদিন রাগ করলেও কখনোই তুই বলেনি। আজ তুই! তাও কোনো কারণ ছাড়াই?
আমানকে চুপ থাকতে দেখে নিহির মেজাজ আরো বিগড়ে যায়। রাগ দেখিয়ে বলে,
“চুপ করে আছিস কেন এখন?”
“কী হয়েছে নিহু? এত রেগে গেছেন কেন?”
“একশো বার রাগব। তোর কী? তোকে বলে রাগ করব আমি? তুই এক্ষণী কলেজের সামনে থেকে চলে যা।”
“কেন?”
“যেতে বলছি যা। এত প্রশ্ন করিস কেন? তুই এখনই যাবি মানে এখনই যাবি।”
“আচ্ছা রিল্যাক্স! আমি যাচ্ছি।”

নিহি ফোন কেটে যায়। রাগে থরথর করে শরীর কাঁপছে। স্যার ক্লাসে আসার সঙ্গে সঙ্গে নৌরিনও ক্লাসে আসে। ওকে দেখে আরো রাগ বেড়ে যায়। এবং আলগা পিরিত দেখাতে এখন ওর সিট রেখে এই সিটে এসে বসেছে। বসেছে তরুর পাশেই। বারবার ফিসফিস করে বলছে আমানের নাম্বার দিতে। তরুর কী বলা উচিত তরু জানে না। নিহি ওর কথা সবই শুনতে পাচ্ছে। দাঁতে দাঁত চেপে শুনছিল সব। আর সহ্য করতে না পেরে চিৎকার করে বলে,
“এটা ক্লাস নৌরিন! তোমার কথা বলায় আমার পড়তে সমস্যা হচ্ছে।”

স্যার রোল কল করছিল। নিহির কথায় স্যারসহ ক্লাসের সবাই ওদের দিকে তাকায়। নৌরিন কিছুক্ষণ অবাক হয়ে নিহির দিকে তাকিয়ে থাকে। এতদিন একসঙ্গে পড়েছে কখনো এমন করেনি। আজ হঠাৎ কী হলো? স্যার নিহিকে জিজ্ঞেস করেন,
“কী হয়েছে নিহি?”
নিহি দাঁড়িয়ে বলে,
“এত কথা বলায় পড়তে সমস্যা হয়।”
“ওকে। সিট ডাউন।”
স্যার এবার নৌরিনকে ধমক দিয়ে বলেন,
“কথা বলার হলে বাইরে গিয়ে কথা বলো।”
নৌরিন স্যরি বলে। স্যার আর কিছু না বলে রোল কল করেন আবার।

নৌরিন সাদা কাগজে স্যরি লিখে নিহিকে দেয়। এটা দেখে নিহি তেলে-বেগুনে আরো জ্বলে ওঠে। এত আদিখ্যেতা কেন দেখাতে হবে এই মেয়ের? নিহি কিছুই বলে না। চার ক্লাস পর টিফিন দেয়। নিহি তরুকে নিয়ে ক্যান্টিনে যায় খেতে। পেছন পেছন নৌরিনও আসে। কিছুতেই এখন তরুর পিছু ছাড়ছে না। আমানের সম্পর্কে অনেক প্রশ্ন করতেছে। তরুর উত্তর ছিল শুধু,
“আমি এতকিছু জানি না।”
নিহি চুপচাপ খাচ্ছিল। নৌরিন এবার নিহিকে বলে,
“এখনো রেগে আছো আমার ওপর? স্যরি ইয়ার!”

নিহি না তাকিয়েই উত্তর দেয়,
“ইট’স ওকে।”
নৌরিন আবারও আমানকে নিয়ে কথা বলা শুরু করে। ক্লাস থেকে বের হওয়ার সময় দেখেছে আমানকে বাইরে। নিহি খেতে খেতে নৌরিনকে বলে,
“উনাকে তোমার এত পছন্দ হয়েছে?”
“ভীষণ! তরু তো কোনো হেল্পই করতে চাচ্ছে না। তুমি কি আমায় হেল্প করতে পারবে? প্লিজ নিহি! তুমি তো শিশির ভাইয়ের কাছে তার নাম্বার চাইতেই পারো। করবে সাহায্য? প্লিজ!”

নিহি রহস্যজনকভাবে হেসে বলে,
“অবশ্যই।”
তরু ভ্রু কুঁচকে নিহির দিকে তাকায়। নিহি নৌরিনকে বলে,
“চলো।”
“কোথায়?”
“চলো তো!”

নৌরিনের হাত ধরে কলেজের বাইরে নিয়ে যায় নিহি। সোজা গিয়ে দাঁড়ায় আমানের সামনে। আমান একটু অপ্রস্তুত হয়ে দাঁড়ায়। পর মুহূর্তেই নিজেকে সামলে নেয়। নিহির চোখে ক্রোধ। নৌরিন ভয়ে নাকি লজ্জায় জড়োসড়ো হয়ে আছে তা নিহি বুঝতে পারছে না। নিহি চোখমুখ বুজে এক দমে বলে,
“ও নৌরিন। আমার আর তরুর ক্লাসমেট। আপনাকে দেখেই ওর ভালো লেগেছে। আপনার নাম্বার চাইছিল এতক্ষণ। বুঝতেই পারছেন কেন চেয়েছে?”

নৌরিন নিহির হাত চেপে ধরে। আমান শুনল মনোযোগ দিয়ে নিহির কথা। আর বুঝতেও পারল নিহির রাগের কারণ। নিরব অবাক হয়ে নিহির মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। এমন রণচণ্ডী রূপ অনেকদিন বাদে আজ দেখল। আগের তুলনায় এই রূপের তেজ অনেক অনেক গুন বেশি! আমান এবার সশব্দে হাসলো। নিহি আর নৌরিন দুজনই ভ্রু কুঁচকে ওর দিকে তাকায়। আমান মিষ্টি হেসে নিহির মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,
“আপনার ফ্রেন্ডকে বলে দিন আমি বিবাহিত। আমার মিষ্টি একটা বউ আছে। যাকে ছাড়া আমি নিজেকে ভাবতেও পারি না। আমার মন, দুনিয়া জুড়ে শুধুই আমার মিষ্টি বউপাখি।”

নৌরিনের মনটা যেন এখন নিমিষেই ভেঙে গুড়িয়ে গেল। মুখের বর্ণ পাল্টে গেছে। পাংশু আকার ধারণ করেছে। পছন্দের মানুষটির বউ আছে! নিহির রাগ এবার পানি হয়ে গেছে। আমান এমন কোনো উত্তর দেবে নিহি ভাবতে পারেনি। আমান মুচকি মুচকি হাসছে। নৌরিন দৌঁড়ে ভেতরে চলে যায়। নিহি নিস্তব্ধ হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে গুটিগুটি পায়ে কলেজের ভেতর চলে যায়। নিহির এখন বেশ খুশি খুশি লাগছে। মুখ টিপে হাসছে। এতক্ষণ নৌরিনকে দেখলে যে এত রাগ হতো! অথচ এখন ওকে দেখলেই হাসি পাচ্ছে। উচিত শিক্ষা হয়েছে। তরু হেসে নিহিকে বলে,
“তুই পারিসও বটে!”
.
.
বাড়িতে গিয়ে নিহি আর তরু পড়েছে সবাইকে রাজি করানোর প্ল্যান নিয়ে। মামা-মামি রাজি হলেও লিমনকে নিয়েই ভয়টা বেশি। ঐ নাছোড়বান্দাই বেঁকে বসবে। রাতে খাওয়ার টেবিলে বসে নিহি বলল,
“মামা সিলেটে এতবার আসলাম। অথচ এখনো জাফলং-এ যেতে পারলাম না। কাল তো কলেজ বন্ধ। আমি আর তরু গিয়ে ঘুরে আসি।”
লিমন বড় বড় চোখ করে নিহির দিকে তাকায়। তরু বলে,
“হ্যাঁ, আব্বু যাই প্লিজ?”
লিয়াকত শিকদার খেতে খেতে বলেন,
“না, না। একা একা যেতে দেওয়া যাবে না।”
তরু তখন ফট করে বলে,
“একা না তো! ক্লাসের আরো অনেক বান্ধবীরাই যাবে। আর বেশি দূরেও না তো! যাই আব্বু?”

তরুর অকপটে বলা মিথ্যা শুনে হাসি আসলেও নিহি নিজেকে সামলে নেয়। লিয়াকত শিকদার উত্তর দেওয়ার আগেই মামি ঘোর আপত্তি জানায়। এবার লিমনও বলে,
“আমিও মায়ের সঙ্গে একমত। যতই কাছে হোক কাল তোদের কোথাও যাওয়া হবে না।”
নিহি ক্ষেপে গিয়ে বলে,
“তুমি সবসময়ই শুধু এমন করো! প্লিজ ভাইয়া যাই?”
“হ্যাঁ ভাইয়া, বারণ কইরো না। যাই?” বলে তরু।
লিমন তখন ধমক দিয়ে বলে,
“বললাম তো না! যাওয়া হবে না মানে যাওয়া হবে না।”

ধমক খেয়ে নিহি আর তরু দুজনই খাওয়া শেষ না করেই ঘরে চলে যায়। লিমন আরো রাগ দেখিয়ে বলে,
“খাওয়ার ওপর রাগ দেখিয়ে লাভ নেই। তোদের যাওয়া হবে না।”
শব্দ করে দরজা লাগানোর আওয়াজ হয়। লিয়াকত শিকদার বলেন,
“রাগারাগি করিস কেন বাচ্চাদের সাথে? সুন্দর করে বুঝিয়ে বললেই তো হয়।”
“ওরা বোঝার মতো মেয়ে না। দুইটাই ঘাড়ত্যাড়া। দেশের অবস্থা ভালো না। যতগুলো মেয়েই যাক, কোন আক্কেলে ওদের একা ছাড়ার কথা ভাবো?”
“হয়েছে বাবা! থাম। আমি কি আর পারমিশন দিয়েছি?”
“আমি বারণ না করলে ঠিকই তো পারমিশন দিতে।”
“ঘাট হয়েছে আমার বাপ। খা এখন।”
.
নিহি আর তরুর রাগ হচ্ছে খুব। লিমন যখন একবার বারণ করে দিয়েছে তখন আর যাওয়া হবে না শিওর। নিহির এখন কান্না পাচ্ছে খুব। আমান এত ইচ্ছে করে বলল! নিহি আমানকে কল করে। আমান কেটে দিয়ে ব্যাক করে। নিহি কাঁদো কাঁদো স্বরে বলে,
“হ্যালো।”
“কী হয়েছে নিহু?” অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করে আমান।
“বাড়িতে রাজি হয়নি।”
আমান হেসে বলে,
“পাগলী! তাই বলে কি কাঁদতে হবে?”
“আপনি কত শখ করে বললেন!”
“তাতে কী? আপনার কত স্মৃতি রয়েছে আমার কাছে। এবার হয়নি সমস্যা নেই। কিছুদিন পর না আপনার ইয়ারচেঞ্জ পরীক্ষা। পরীক্ষা শেষ করে তো ঢাকায় আসবেন। তখন আমরা ঘুরব কেমন?”
“আপনার মন খারাপ হয়নি তো?”
“একদম না নিহুপাখি।”

নিহি ফুঁপিয়ে বলে,
“গান শুনব। গান শুনান।”
“আচ্ছা ছাদে গিয়ে শুনাচ্ছি।”
আমান কথা বলতে বলতেই ছাদে যায়। দুজন কথা বলতে বলতে সময় কাটে বহুগুণ। আমান গান শুনিয়ে নিহির মন ভালো করে দেয়।
রাত ১২টা নাগাদ কথা বলা শেষ করে নিহি ঘুমাতে যায়। আমান কিছুক্ষণ ছাদে দাঁড়িয়ে পায়চারি করছে। নিহির কথা ভেবে ভেবে আনমনেই হাসে আমান। ফোনের ওয়ালপেপারে নিহির ছবির দিকে তাকিয়ে বলে,
“ভালোবাসি নিহুপাখি।”
তারপর ওয়ালপেপারে একটা চুমু খেয়ে ঘরে চলে যায়। নিরব লেপ, কম্বল জড়িয়ে গুটিসুটি হয়ে ঘুমিয়ে আছে। আমান নিজেও লেপ গায়ে জড়িয়ে শুয়ে পড়ে। নানান কথা ভাবতে ভাবতেই ঘুম চলে আসে চোখে।

ফোনের রিংটোন বাজছে। ঘুম ঘুম চোখে আমান ফোনটা হাতে তুলে নেয়। ফোনের স্ক্রিনে ভেসে ওঠে ‘জান’ লেখা। টাইম দেখে নেয়। পৌনে দুইটা বাজে। এত রাতে মা কেন ফোন করেছে? দুশ্চিন্তায় চোখের ঘুমও চলে যায়। তড়িঘড়ি করে ফোন রিসিভ করে বলে,
“কী হয়েছে মা? এত রাতে?”
ওপাশ থেকে অনামিকা রহমান অস্থির হয়ে বলেন,
“তোমার বাবার অবস্থাটা হুট করেই খারাপ করেছে।”
“আব্বু বাড়িতে এসেছে?”
“হ্যাঁ। আজ সন্ধ্যায় ফিরেছে। তখন থেকেই গায়ে জ্বর ছিল। এখন জ্বর বেড়েছে। কাশছে খুব। কাল নাকি একটা গুরুত্বপূর্ণ মিটিং-ও আছে। অসুস্থ শরীর নিয়ে তো কাল মিটিং-এ যেতে পারবে না। তাই তোমাকে আসতে বলল। তুমি কি আসতে পারবে?”
“আচ্ছা আমি এখনই রওনা দিচ্ছি।”
“না,না। এত রাতে বের হওয়ার দরকার নেই। ভোরে রওনা দিও।”
“আচ্ছা আমি দেখছি। তুমি আব্বুর খেয়াল রেখো।”

দেখছি বললেও ফোন কেটে দিয়ে আমান দ্রুত শার্টের ওপর জ্যাকেট পরে নেয়। নিরবকে ঘুম থেকে ডেকে তোলে। আর জানায় এখনই ঢাকায় ব্যাক করতে হবে। নিরব উঠে খালা আর খালুকে ডেকে তোলে। তাদের থেকে বিদায় নিয়ে রওনা দেয় ঢাকার উদ্দেশ্য। নিহিকে ফোন না দিয়ে টেক্সট করে ঢাকায় ব্যাক করার কথা জানিয়ে দেয় আমান।
______________________

ফাঁকা রাস্তায় গুটিকয়েক গাড়ি চলাচল করছে। এই গুটি কয়েক গাড়ির মাঝে রয়েছে অনলদের মাইক্রো কার। ওদের পাঁচজনের গ্রুপই শুধু যাচ্ছে না। সঙ্গে যাচ্ছে ক্লাসের আরো কয়েকজন ছেলে-মেয়ে। সন্ধ্যার দিকে রওনা দেওয়ার কথা থাকলেও ওরা রওনা দেয় রাত এগারোটার দিকে। সকলে মিলে হৈ-হুল্লোড় করতে করতে যাচ্ছে। গান চলছে গাড়িতে। অনল বসেছে জানালার সাইডে। জানালার কাঁচ খুলে রেখেছে। খোলা জানালা দিয়ে শাঁ শাঁ শব্দে বাতাস ভেতরে আসছে। যা বাহ্যিক দিকটাকে শীতল করতে পারলেও মনকে শীতল করতে পারছে না অনলের। মনের ভেতর অজানা এক ভয় দানা বাঁধতে শুরু করেছে। ভয়টা এখন থেকেই নয় বরং সিলেটে আসার সময় থেকেই শুরু হয়েছে। এমন ভয়ের কি কোনো কারণ আছে? নাকি কোনো মানে! উত্তর খুঁজেও কোনো উত্তর পাচ্ছে না অনল। যতবার নিহিকে ভু্লতে চাচ্ছে ততবার নিহির কথা তীব্রভাবে মনের ভেতর কড়া নাড়ছে। কেন জানি হুট করেই নিহিকে একটা পলক দেখার জন্য মন অস্থির হয়ে আছে। একটা নজর দেখতে পারলেই যেন সকল অশান্তি দূর হয়ে যাবে। কিন্তু কেন যাবে? কী আছে নিহির মাঝে? কেন নিহির জন্য মন অস্থির হবে? আচ্ছা নিহি তো এখন ঢাকায় নেই। কোনোভাবে কি এমন হতে পারে না নিহি সিলেটেই আছে?

চলবে…
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।]