#আড়ালে_আবডালে
#পর্ব_৪০
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
_______________
অনলের পাগলামি বেড়েছে। ওকে কিছুতেই মানানো যাচ্ছে না। অনলের বন্ধু, ভাই, ডাক্তার সবাই মিলে ধরে৷ তারপর নার্স ঘুমের ইঞ্জেকশন দিয়ে দেয়। ঘুম না আসা পর্যন্তও ওকে কেউ ছাড়েনি৷ যখন ঘুমে প্রায় ঢুলুঢুলু অবস্থা তখন ওকে বেডে শুইয়ে দেওয়া হয়৷ এক কোণায় কাচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে নিহি। আজমল আহমেদ ডাক্তারের উদ্দেশ্যে বলেন,
“আপনি বলেছিলেন নিহিকে আনলে অনলের অবস্থার উন্নতি হবে৷ এখন তো আমার ছেলে আরো বেশি পাগলামি করছে।”
ডাক্তার চিন্তিত মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকেন কিছুক্ষণ। তারপর নিহিকে জিজ্ঞেস করেন,
“উনি হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে পড়লেন কেন?”
নিহির অস্বস্তি লাগছে৷ কী বলবে তাদের? নিহিকে এই সিচুয়েশন থেকে বাঁচায় আমান৷ উত্তরে বলে,
“আপনি ডাক্তার৷ বর্তমানে অনলের চিকিৎসাও আপনি করছেন। তাই আপনার থেকে কিছু না লুকানোই ভালো।”
“জি, জি অবশ্যই।”
আমান অকপটে বলে ফেলে,
“নিহি আমার স্ত্রী।”
ডাক্তার ঘাবড়ে যান। চোখ বড় বড় করে তাকান তিনি। বড় ভাইয়ের বউয়ের জন্য ছোটভাই এমন পাগলামি করবে কেন? তিনি একটু নড়ে-চড়ে দাঁড়ান। তারপর বলেন,
“আপনারা আমার চেম্বারে আসুন। এখানে নার্সরা আছে। তারা অনলের টেক কেয়ার করবে। আমি পুরো বিষয়টা রিল্যাক্সে শুনতে চাচ্ছি।”
চেম্বারে উপস্থিত আছেন আজমল আহমেদ, অনামিকা রহমান, আমান, নিহি এবং ডাক্তার। নিহির মুখ থেকে একটু আগে যা যা শুনেছে তার সবটা শুরু থেকে বর্ণনা করে আমান বলে৷ নিহি হাত মুষ্টিবদ্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে। ডাক্তারের কপালে ভাঁজ পড়ে। চেয়ারে বসে খানিকটা নড়াচড়া করতে করতে বলেন,
“খুবই ক্রিটিকাল! আসলে পেশেন্ট আপনার সঙ্গে আপনার মিসেসকে সহ্য করতে পারছে না৷ যদি সে অন্য কারো ওয়াইফও হতো তাহলেও এতটা পাগলামি করত না। ভালোবাসার মানুষটি নিজেরই আপন ভাইয়ের বউ! এটা আসলেই সহ্য করা ক্ষমতার বাইরে।”
মুখ ভার করে আজমল আহমেদ প্রশ্ন করেন,
“তাহলে এখন কী করব আমরা?”
“সাইকিয়াট্রিস্ট ছাড়া আর কোনো উপায় দেখি না৷ আমার পরিচিত একজন সাইকিয়াট্রিস্ট আছে। আপনারা তার কাছেই যেতেই পারেন।”
কথাগুলো বলতে বলতে একটা কার্ড এগিয়ে দেন তিনি।
.
.
চেম্বার থেকে বের হয়ে থমথমে মুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন আজমল আহমেদ। আমান খুব শান্তকণ্ঠে বলে,
“আমি নিহিকে রেখে আসছি।”
তিনি দাঁত কটমট করে বলেন,
“আসার কী দরকার আর? আসতে হবে না! বউ নিয়েই থাকো।”
আমান চারপাশে একবার তাকালো। নিহির মুখের বর্ণ পাল্টে যায়৷ আমান চাপাস্বরে বলে,
“কোথায় কী বলছ আব্বু? আশেপাশে মানুষজন আছে!”
“হ্যাঁ,তো? তারাও জানুক বিয়ের পর ছেলেরা কেমন চেঞ্জ হয়ে যায়! একটাবার আমাদের জানানোরও প্রয়োজন মনে করে না। এমনকি এখনো অসুস্থ ভাইয়ের কথা ভাবছে না। শোনো, একটা কথা সরাসরি তোমায় বলছি। এই মেয়েকে তুমি ডিভোর্স দাও। যতবার অনল তোমাকে ওর সাথে দেখবে ততবারই পাগলামি করবে। অনলকে আর কষ্ট পেতে দেখতে পারব না আমি। পাগল হয়ে গেছে ছেলেটা দেখেছ তুমি?”
আমান কিছুক্ষণ চুপ করে ভাবে এখানে কিছু বলা উচিত নাকি চুপ করে থাকা। ডিভোর্স নিয়ে কথা উঠেছে। চুপ করে থাকা মানে বাবার কথায় সায় দেওয়া। তাই আমান বলে,
“আমি নিহুকে ভালোবাসি। ওকে ছেড়ে থাকার কথা যেখানে ভাবতে পারি না সেখানে ডিভোর্স তো অনেক দূরের কথা!”
“একটা মেয়ে এখন জীবনের সবকিছু হয়ে গেছে? আমরা কেউ কিছু না তোমার?”
অনামিকা রহমান বলেন,
“থামো প্লিজ!”
আজমল আহমেদ দ্বিগুন ক্ষেপে বলেন,
“ওকে আমার চোখের সামনে থেকে যেতে বলো।”
আমানও আর এক মুহূর্ত দেরি না করে নিহিকে নিয়ে হাসপাতাল থেকে বের হয়ে যায়। রাগে চোখমুখ লাল হয়ে গেছে। নাকের পাটা ফুলে আছে। কিছু বলারও সাহস পাচ্ছে না নিহি। চুপচাপ আমানের পাশের সীটে বসে আছে। অনেক কষ্টে সাহস সঞ্চয় করে বলে,
“উনার ওপর রাগ করবেন না। আসলে বাবা তো উনি! ছেলের এমন অবস্থা দেখে মাথা ঠিক রাখতে পারেননি।”
আমান ধমকের স্বরে বলে,
“অনল ছেলে আমি ছেলে না? আমার কথা ভাবার প্রয়োজন নেই তার? সবকিছু জানার পরও কীভাবে এমন কথা বলেন? কিছু মানুষ থাকে যারা চোখ থাকতেও অন্ধ থাকতে পছন্দ করেন। আমার বাবাও হচ্ছেন ঠিক তেমন।”
নিহি চুপসে যায়। এরপর আর কেউই কিছু বলেনি। নিরব থেকেছে দুজনই। গাড়ি থামে সোজা মিহির বাড়ির সামনে। নিহি গাড়ি থেকে নামার সময় আমান বলে,
“আমি এখানেই আছি।”
নিহি কিছু বলল না৷ উপরে গিয়ে বেশ কিছুক্ষণ পর তরুকে নিয়ে ফিরে আসলো। সঙ্গে মিহিও এসেছে। আমানকে বলেছে সাবধানে পৌঁছে দিতে। আবুল, টুকটুকি, মিহি ওদের সবার থেকে বিদায় নিয়ে ওরা আবার যাত্রা শুরু করে। আমানের রাগ দমে গেছে। হুশ ফিরেছে এখন। নিহি চলে যাচ্ছে! বুকের ভেতর কেমন যেন যন্ত্রণার উদয় হচ্ছে। এত ঝামেলা পোহাতে হলো মেয়েটাকে। আমান আড়চোখে একবার নিহির দিকে তাকালো। সীটের সাথে হেলান দিয়ে জানালার পানে তাকিয়ে আছে নিহি। আমান হাত বাড়াতে গিয়েও তরুর দিকে চোখ পড়ে যায়। তাই আর নিহিকে ডাকলো না। সে তরুকে জিজ্ঞেস করে,
“পরীক্ষা শেষ হলে আসবেন তো আবার?”
তরু হেসে বলে,
“শিওর জানিনা ভাইয়া। আমরা না আসি, আপনি তো যাবেন।”
“দেখি কী হয়!”
নিহির বাড়ির সামনে আসার পর তরু আর নিহি নেমে পড়ে। তরু ব্যাগ নিয়ে আগেই ভেতরে চলে যায়। আমানও গাড়ি থেকে বের হয়েছে। নিহির মুখোমুখি দাঁড়াতেই নিহি জিজ্ঞেস করে,
“আজও নিশ্চয়ই বাড়িতে আসবেন না?”
মোহময় দৃষ্টিতে আমান তাকিয়ে থাকে তার প্রিয়তমার দিকে। কী মায়া, কী ভালোবাসা সেই চোখেমুখে৷ তার ঠোঁটের কোনে হাসি ফুঁটে ওঠে। গালে আলতো করে হাত ছুঁয়ে দিয়ে বলে,
“ভালোবাসি।”
নিহির ঠোঁটের কোণেও হাসির রেখা প্রতিফলিত হয়। আমান তার হাত দুটো ধরে বলে,
“স্যরি!”
“স্যরি কেন?”
“তখন রাগ দেখিয়ে কথা বলার জন্য। ওভাবে উচ্চস্বরে কথা বলা ঠিক হয়নি।”
“আপনি তো আর আমায় বলেননি! যাই হোক, বাবার ওপর রাগ করে থাকবেন না।”
কিছুক্ষণ মৌন থেকে আমান বলল,
“আমার ভয় করে নিহু।”
“ভয়? কীসের ভয়?”
“তোমাকে হারানোর ভয়। সেই সময়গুলোই তো ভালো ছিল। যখন শুধু আমরা দুজনই দুজনার ছিলাম। হুট করে সব এমন এলোমেলো হয়ে গেল কেন?”
নিহি দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে বলল,
“কোনোকিছুই এলোমেলো হয়নি৷ সবই সাজানো-গোছানো আছে। এটা আসলে হওয়ারই ছিল।”
“যত যাই হোক, তুমি আমায় কথা দাও আমায় ছেড়ে কখনো যাবে না?”
আরেকটু শক্ত করে নিহি আমানের হাত চেপে ধরল। চোখে চোখ রেখে বলল,
“যাওয়ার হলে তো প্রথমেই চলে যেতাম। যাইনি। আর যাবও না।”
তৃপ্তির হাসি হাসে আমান। বলে,
“অনলকে তুমি ক্ষমা করে দিও। কথা দিচ্ছি, ও তোমাকে যতটা কষ্ট দিয়েছে তারচেয়ে হাজার গুণ ভালোবাসা দিয়ে আমি সেই কষ্ট ভুলিয়ে দেবো।”
“আমি আপনাকে বিশ্বাস করি।”
“একটা কথা বলব?”
“হুম।”
“না গেলে হয় না?”
“আমার পরীক্ষা!”
“শেষ হলে আবার আসবে?”
“আসব।”
“নিহু?”
“হু!”
“তোমার বাবা যদি জেনে যায়?”
“আপনার বাবাও তো জেনে গেছে। সে আপনাকে বলেছে আমায় ডিভোর্স দিতে। আপনি কি রাজি হয়েছেন? আমার হাত ছেড়েছেন? এতটুকু ভরসা আমার ওপর করতে পারেন। আমার পরিবার না চাইলেও আমি আপনাকে ছাড়ব না।”
“আমি আমার নিহুপাখিকে বিশ্বাস করি। সাবধানে থেকো।”
“আপনিও সাবধানে থাকবেন।”
“থাকব। ভেতরে যাও এখন।”
“না। আপনি আগে যান।”
“জি না৷ তুমি আগে।”
“না, আপনি আগে।”
“তুমি আগে।”
“আপনি আগে।”
“কথা না শুনলে এখানেই চুমু খাব কিন্তু!”
নিহি চোখমুখ কুঁচকে বলে,
“ফাজিল! যাচ্ছি।”
আমান শব্দ করে হাসে। নিহি তার গাল ছুঁয়ে চুমু খেয়ে বলে,
“সবসময়েই এই হাসিটা দেখতে চাই। তাহলে যত বাঁধাই আসুক না কেন আমি সব পার হতে পারব।”
“তুমি সারাজীবন আমার হয়ে আমার জীবনে থাকলে এই হাসিও সারাজীবন থাকবে।”
নিহি মৃদুমুচকি হেসে বলে,
“থাকব। আসছি।”
“যাও।”
কয়েক কদম এগিয়ে আবার ফিরে আসে নিহি৷ আমান ভ্রু কিঞ্চিৎ বাঁকা করে জিজ্ঞেস করে,
“কী?”
“আমি কিন্তু অপেক্ষায় আছি।”
“কীসের?”
“আপনার না বলা কথাগুলো শোনার জন্য।”
“সময় হলেই বলব।”
“আচ্ছা। সাবধানে যাবেন।”
নিহি ভেতরে যাওয়ার পর আমানও চলে যায়। ড্রয়িংরুমে সাহেলা বেগম টিভি দেখছিলেন। নিহি আসার পর জিজ্ঞেস করেন,
“আমান আসলো না?”
“সে তো বলেছে একেবারে নিতে আসবে।”
“তুই এক পাগল, স্বামীও পেয়েছিস আরেক পাগল।”
নিহি সাহেলা বেগমের পাশে বসে কোলে মাথা রেখে বলে,
“হুম আম্মা৷ ভালোবাসার পাগল!”
তিনি হেসে ফেলেন। বলেন,
“যা ফ্রেশ হয়ে আয়। খেতে দিচ্ছি।”
সাহেলা বেগম উঠে রান্নাঘরে যান। তমা তখন ঘর থেকে বের হয়ে আসে। নিহিকে জিজ্ঞেস করে,
“কখন আসলে?”
“এখনই৷ তিতির কোথায়?”
“ঘরে। ফ্রেশ হতে যাও।”
“যাচ্ছি।”
নিহি যাওয়ার পথে তমাকে পিছু ডেকে জিজ্ঞেস করে,
“ভাবি আর কি কোনো চিঠি এসেছিল?”
“না। কেন?”
“এমনিই জিজ্ঞেস করলাম।”
নিজের রুমে যেতে যেতে কতশত চিন্তাভাবনার যে উদয় হয়েছে তা বলে শেষ করা যাবে না। তরু এসেই শুয়ে পড়েছে। নিহি যায় ফ্রেশ হতে। ফ্রেশ হয়ে এসে সবার সঙ্গে খেতে খেতে গল্পগুজব করে। কাউকে বুঝতে দেয় না মনের ভেতর বয়ে চলা ঝড়ের আভাস! বিশ্রাম নেওয়ার জন্য ঘরে এসে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। আমানের সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করছে। বিছানা থেকে উঠে টিবেলের ওপর থেকে ফোন নিয়ে এসে আবার শোয়। ফোন অন করতেই দেখে আননোন নাম্বার থেকে একটা ম্যাসেজ এসেছে। আগে ম্যাসেজটা ওপেন করে সে। চমকে যেতে হয় প্রতিটা লাইন পড়ে। হুট করেই এমন ম্যাসেজ! তৎক্ষণাৎ ঐ নাম্বারে কল করে নিহি কিন্তু নাম্বারটি বন্ধ। কয়েকবার কল করে। কোনো লাভ হলো না। সে আবার ম্যাসেজটা পড়ে।
‘নিহি কাজটা একদম ভালো করোনি তুমি। আমার থেকে আমার ভালোবাসা কেড়ে নিয়ে চরম ভুল করেছ। এর শাস্তি তো তোমায় পেতেই হবে। সময় থাকতে চলে যাও আমানের জীবন থেকে। নয়তো এর খেসারত দিতে হবে তোমার জীবন দিয়ে!’
চলবে…
#আড়ালে_আবডালে
#পর্ব_৪১
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
_________________
নিহি আর তরুর সামনে বসে আছে উপমা। তিরতির করে ঘামছে সে। জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। বোঝাই যাচ্ছে ওর অস্থিরতা। নিহি পানি নিয়ে বসে আছে। উপমা পানিটুকু শেষ করে নিহির হাত চেপে ধরে বলে,
“তুই সিলেটে চলে যা নিহি। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।”
নিহি উপমাকে শান্ত করার চেষ্টা করে। জিজ্ঞেস করে,
“কী হয়েছে? আমায় বল।”
“আমান ভাইয়া আর অনল যে আপন ভাই সেটা জানতি তুই?”
“জানতাম।”
“পুরো কলেজ জেনে গেছে আমান ভাইয়ের বউ তুই। আর অনল ভাইয়া যে তোর পিছু পিছু ঘোরে, পাগলামি করে, হাসপাতালে ভর্তি এটাও পুরো কলেজ জেনে গেছে।”
“কবে জেনেছে?”
“কাল বিকেলে। ছুটির পর শুনলাম সবাই এটাই বলাবলি করছে। বাসায় গিয়ে তোকে ফোন দিয়েছিলাম। তোর ফোন বন্ধ ছিল।”
“এসব কথা তো জানলে শুধু অনলের বন্ধুদেরই জানার কথা।”
“ওরা হয়তো স্যার, ম্যামকে বলেছে।”
“হতে পারে। এতে তুই এত ভয় পাচ্ছিস কেন?”
“কারণ…”
“কারণ?”
“আজকে কলেজে যাওয়ার পর বাংলা ক্লাস হচ্ছিল। তখন দপ্তরি আমায় নিচে ডেকে পাঠালো। বলল, কে যেন আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে।”
“পরে?”
“আমি নিচে নেমে দেখি চারটা মেয়ে আর দুটো ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। সকলেই মাস্ক পরা ছিল। ওদের মধ্য থেকে একজন মেয়ে এগিয়ে এসে বলল,
‘তুমিই উপমা?’
‘জি। আপনারা কারা?’
‘তুমি আমাদের চিনবে না। তুমি নিহির ফ্রেন্ড তো?’
‘হ্যাঁ।’
তারপর মেয়েটা হাতের তালু চুলকাতে চুলকাতে বলল,
‘ফ্রেন্ড হয়ে ফ্রেন্ডের উপকার করা ভালো। নিহিকে সাবধান করে দিও।’
‘বুঝলাম না।’
‘ওকে বলে দিও আমানের থেকে দূরে সরে যেতে।’
‘মানে? কেন? আপনি কে?’
‘শসস! বেশি প্রশ্ন পছন্দ না। সময় থাকতে নিহি যদি না সরে যায়, তাহলে কিন্তু পরিণাম অনেক ভয়াবহ হবে। হতে পারে সেটা মৃত্যু!’
‘শুনুন!’
আমি ডাকলাম তারা আর শুনল না। সবাই চলে গেল। আমি কী করব বুঝতে পারছিলাম না। কলেজ থেকে ছুটি চেয়েছিলাম। ছুটিও দেয়নি৷ তাই এখন ছুটি হওয়ার সাথে সাথে চলে এসেছি। ঐ ছেলে দুটোর হাতে ছুড়ি ছিল নিহি! আমার খুব ভয় করছে। ওরা তোর কোনো ক্ষতি করে ফেলবে।”
উপমার উৎকন্ঠা তরুর মাঝেও প্রবেশ করে। দুজনই বেশ ভয় পেয়েছে। নিহি ঠিক ভয় পায়নি বললে ভুল হবে। এমন হুমকি বার্তা তাও মৃত্যুর! কারো জন্যই তো স্বাভাবিক না৷ কে হতে পারে সে? আমান যে বলেছিল কিছু কথা বলার আছে। কী এমন কথা বলার আছে? আর এই মেয়ে কে? আমানের অতীতের কেউ?
উপমা নিহির হাত আরেকটু শক্ত করে চেপে ধরে বলে,
“তুই প্লিজ এখানে থাকিস না!”
নিহি উপমাকে জড়িয়ে ধরে পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে বলে,
“শান্ত হ। কিছু হবে না আমার।”
“তুই আগের সব কথা ইগনোর করতি। আমি শুনতাম। কিন্তু এই ঘটনাটাকে তুই সিম্পল নিস না রে!”
“এমনিতেও কাল সিলেট চলে যেতাম। তবে আমানের সঙ্গে আগে কথা বলতে হবে। এই থ্রেট আমায়ও ম্যাসেজে করেছে।”
উপমা আর তরু অবাক হয়ে বলে,
“কীহ্! কখন?”
“ম্যাসেজটা সকালেই এসেছিল। আমি দেখিনি৷ ফোন দিয়েছিলাম। নাম্বার বন্ধ।”
“চল আমান ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করি।” বলে তরু।
নিহি জিজ্ঞেস করে,
“এখন?”
“হ্যাঁ এখন৷ তবে তুই যাবি না। আমি আর উপমা যাব।”
“আমি যাব না কেন?”
“যদি তোর কোনো ক্ষতি করে কেউ!”
উপমা তখন বলে,
“তরু একদম ঠিক বলেছে।”
“আচ্ছা কারোরই যাওয়ার দরকার নেই৷ আমি উনাকে ফোন দিয়ে বাড়ির নিচে আসতে বলি।”
“আচ্ছা ফোন দে তাহলে।”
.
ফ্রেশ না হয়েই বিছানায় শুয়ে আছে আমান। শরীর ক্লান্ত লাগছে। সেই সঙ্গে মনটাও ভালো নেই। একদিকে ভাইয়ের জন্য মন খারাপ। আর অন্যদিকে নিহির চলে যাওয়ার বিরহ। আবার বাবার এহেন ব্যবহারেও আমান বিষাদিত। এতটা অবজ্ঞা, তিরস্কার বাবার থেকে আশা করেনি সে। দু’চোখের পাতায় ঘুম জেঁকে ধরেছে। গতকাল ঘুমানো হয়নি বলেই হয়তো এখন ঘুম পাচ্ছে। বালিশের মধ্যে মুখ গুঁজে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিতেই ফোনটা বেজে ওঠে। কে ফোন করেছে সেটাও দেখতে ইচ্ছে করছে না। মোট কথা ভীষণ ক্লান্ত লাগছে। সেই সঙ্গে অলসতা। প্রচণ্ড অলসতা লাগা সত্ত্বেও বিছানা হাতরিয়ে ফোন বের করে স্ক্রিনে তাকায়। ‘নিহু পাখি’ লেখা দেখে নড়েচড়ে শুয়ে কল কেটে দেয়। তারপর নিজেই ব্যাক করে।
“হ্যালো নিহু।”
“কোথায় আছেন আপনি?”
“বাসায়। ক্লান্ত লাগছে খুব।”
নিহির মত পাল্টে গেল। এত খাটাখাটুনির পর এখন আবার নিজে ড্রাইভ করে আসবে। এটা ভাবতেই নিহির খারাপ লাগল। এদিকে ফোনেও কথাগুলো বলা সম্ভব নয়। অনেককিছু জানার আছে আমানের থেকে। যেটা সরাসরি জানতে ও শুনতে চায় নিহি। কথা ঘুরিয়ে নিহি জিজ্ঞেস করে,
“আপনি খেয়েছেন?”
“এখনো না। তুমি খেয়েছ?”
“হ্যাঁ। আপনি খাননি কেন?”
“ভালো লাগছে না।”
“এরকম অনিয়ম করলে আমি আপনার সঙ্গে আর কথা বলব না।”
“আচ্ছা স্যরি। আর হবে না।”
“তাহলে এখনই খেয়ে নিন।”
“কথা শেষ হোক। ফোন দিলে যে৷ কোনো সমস্যা?”
“নাহ্! ফোন দিতে পারি না?”
“অবশ্যই পারো।”
“তাহলে? আচ্ছা বাদ দিন। কাল সকালে চলে যাওয়ার সময় আসবেন তো?”
“আসব।”
“ঠিকাছে। আধ ঘণ্টা আগেই চলে আসবেন। এখন খেয়ে নিন। রাখছি।”
“শোনো।”
“কী?”
“ভালোবাসি।”
“সব পরিস্থিতিতেই ভালোবাসি!”
“সব পরিস্থিতিতে?”
“কিছু না। যান তো খেয়ে নিন।”
ফোন রাখতেই নিহি আর তরু ক্ষেপে বলল,
“আসল কথাটাই বললি না কেন?”
“কী করে বলতাম বল তো? এমনিতেই তার মানসিক অবস্থা ভালো না। তার মধ্যে ক্লান্ত সে। এখন যদি এগুলো বলতাম, সঙ্গে সঙ্গে ছুটে আসতো। সেও তো একটা মানুষ!”
ওরা দুজনে বড় করে শ্বাস নিলো। উপমা বলল,
“কাল বলে দিস। আর একা একা কোথাও যাবি না।”
“তুই এত চিন্তা করিস না। আর নিজেও সাবধানে থাকবি।”
“আচ্ছা।”
“এখন খেতে আয়। কলেজ থেকে তো এখানে চলে এসেছিস।”
“বাড়িতে গিয়ে খাব।”
“চুপ৷ ভাবি খাবার গরম করেছে চল।”
নিহির জোড়াজুড়ির কাছে উপমা বরাবরই ব্যর্থ।
__________________
রাত প্রায় বারোটা বাজতে চলল। অনলকে বাড়িতে নিয়ে আসা হয়েছে। বিছানায় চুপচাপ সোজা হয়ে শুয়ে আছে। বিছানার সাথে লাগোয়া জানালার কাঁচ গলে চাঁদের আলো আসছে। অনলের দৃষ্টি এখন রূপালী চাঁদের মাঝেই আবদ্ধ। ঘরের দরজার সামনে এসে দাঁড়ান আজমল আহমেদ। ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে বুকটা কেঁপে ওঠে। বড় করে শ্বাস নেন। কষ্ট হয় তার। মুখ শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে অনলের। ঘুম ভাঙার পর থেকেই সে আর কোনো পাগলামি করেনি। চিৎকার, চেঁচামেচি করেনি। নিহিকেও দেখতে চায়নি। হাসপাতাল থেকে রিলিজ করে দিয়েছে। কাল সকালে যাবে সাইকিয়াট্রিকের কাছে।
তিনি ধীরপায়ে এগিয়ে গিয়ে অনলের শিয়রে বসে ডাকেন।
“বাবা অনল!”
অনল মুখ ফিরে তাকায়। কোনো কথা বলে না। তিনি জিজ্ঞেস করেন,
“এখনো ঘুমাওনি কেন?”
অনল আবার চাঁদের দিকে তাকায়। আজমল আহমেদ উত্তরের জন্য অপেক্ষা করেন। কিছুক্ষণ পর অনল উত্তর দেয়।
“ঘুম আসছে না।”
“না ঘুমালে তো শরীর খারাপ করবে।”
সে তাচ্ছিল্য করে হাসলো। যেখানে মনেই শান্তি নেই সেখানে আবার শরীর খারাপ ভাবার চিন্তা! অনলের এই হাসি পীড়াদায়ক। কিছু বলার ভাষা খুঁজে পান না তিনি। তবুও ছেলের মন ভালো করার চেষ্টা করতে বলেন,
“চলো গেমস্ খেলি।”
“না।”
“তুমি এখনো আপসেট?”
অনল নিশ্চুপ। তিনি এবার অনলের কাছে গিয়ে বসেন। তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,
“তুমি মন খারাপ কোরো না আব্বু। কষ্টও পাবে না। আমি এমন ব্যবস্থা করব, যেটাতে তোমায় হাসতে হবে। শুধু আমার ওপর ভরসা রাখো। নিহি তোম…”
চাঁদের থেকে দৃষ্টি এনে অনল এবার বাবার দিকে তাকায়৷ পুরো কথা বলার আগেই থামিয়ে দিয়ে বলে,
“তুমি কিছু করবে না আব্বু।”
.
.
সিলেট যাওয়ার বাস ১০টায়।
আমান ৯ঃ২০-এ এসে বসে আছে বাস স্টপে। সঙ্গে নিরব। নিহির আসতে ৯ঃ৩৫ বাজে। সঙ্গে ওর পরিবারের সবাইও আছে।
আমান উঠে এসে ওদের সামনে দাঁড়ায়। নিহি ফিসফিস করে বলে,
“একটু দেরি হয়ে গেল।”
“সমস্যা নেই।” বলে আমান নিজাম ইসলাম এবং সালেহা বেগমকে সালাম দেয়। বাকিদের সাথে সাক্ষাৎ বিনিময় করে। নিজাম ইসলাম বলেন,
“দেখেশুনে নিয়ে যেও বাবা। সাবধানে যাবে।”
“আপনি চিন্তা করবেন না আব্বু।”
“পৌঁছে ফোন দিও।” বলল নীলম।
নিহি ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। কারো কথার কোনো মাথাই বুঝতে পারছে না। শুধু সকলের কথা শুনে যাচ্ছে। নিহির দিকে তাকিয়ে আমান বলে,
“গাড়িতে ওঠো।”
“গাড়িতে উঠব মানে? আমরা তো বাসে যাব।”
“না, গাড়িতেই।”
“মানে! সিলেট যাব না?”
নীলম নিহিকে কাছে টেনে নিয়ে বলে,
“আরে পাগলী সিলেটেই যাবি৷ আমান দিয়ে আসবে।”
“তোমরা যাবে না?”
“না। আমরা পরে যাব।”
নিহি এখনো কিছু বুঝতে পারছে না। বোকার মতো তাকিয়ে আছে। আমান ফিসফিস করে বলে,
“পরে সব বুঝিয়ে বলব। চলো এখন।”
সবার থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে বসল নিহি৷ পেছনের সীটে তরু আর নিরব। সামনে আমান এবং নিহি। সবাইকে হাত নাড়িয়ে টাটা দেয় নিহি। গাড়ি চলা শুরু করে। মনের ভেতর জমে থাকা প্রশ্নগুলো গড়গড় করে বের করতে যাবে তার আগেই আমান বলে,
“কাজটা একদম ভালো করোনি নিহু৷ কালই আমায় জানানো উচিত ছিল।”
“মানে? বুঝলাম না।” ভড়কে গিয়ে বলল নিহি।
“কালকের ম্যাসেজটার কথা বলছি।”
“আপনি কী করে জানলেন?”
“তোমার কণ্ঠ শুনেই সন্দেহ হয়েছিল কিছু একটা লুকিয়েছ তুমি। তখন ফোন না দিয়ে রাতে আমি তরুকে ফোন করি। তরুর থেকে সব শুনে উপমাকে ফোন করি৷ ওর থেকেই ডিটেইলস সব পাই।”
“এতকিছু হয়ে গেল আর আমি জানলাম না!”
“এতে তোমার কিছু হয়নি। কিন্তু তুমি কী করে পারলে? কথাটা জানার পর থেকে সারারাত আমার ঘুম হয়নি।”
“এজন্যই বলিনি।”
“আর কখনো এমন করবে না। আর ঐ ম্যাসেজটা দেখি?”
নিহি ব্যাগ থেকে ফোন বের করে ম্যাসেজটা দেখায়। আমান ফোনটা নিরবের কাছে দিয়ে বলে,
“নাম্বারটা ওদেরকে পাঠিয়ে দাও। সবসময় নজর রাখতে বলবে। যাতে নাম্বারটা খুললেই ট্রেস করতে পারে।”
“জি স্যার।”
আমান ড্রাইভ করতে করতে নিহিকে জিজ্ঞেস করে,
“পরীক্ষার রুটিন পেয়েছ?”
“হ্যাঁ।”
“উল্টাপাল্টা কোনো চিন্তা করবে না। মোট কথা কোনো চিন্তাভাবনাই করা যাবে না। শুধু মন দিয়ে পড়বে। আর ঠান্ডা মাথায় পরীক্ষা দেবে। আমি আছি সবসময়।”
“মানে? আপনি থাকবেন সিলেটে?”
“হ্যাঁ। পরীক্ষা শেষ হলে তোমায় নিয়েই ফিরব।”
“আর আপনার অফিস?”
“আমার জীবনে সবচেয়ে ইম্পর্ট্যান্ট আগে তুমি। তোমাকে আমি বিপদে রেখে শান্তিতে দূরে থাকতে পারব না। ঢাকায় এসেও তুমি আমার কাছে, আমার বাসায় থাকবে। তোমার বাবার কোনো বারণ আমি শুনব না। আমিও দেখব কী করে কেউ তোমার ক্ষতি করতে পারে। আর তাকে পেলে তার কলিজা টেনে ছিঁড়ে ফেলব আমি!”
মুহূর্তেই আমান রেগে গেছে। নিহি মুগ্ধ হয় এই রাগ দেখে। হতেই হয় তাকে মুগ্ধ। অস্পষ্টভাবে বলে ফেলে,
“এত ভালো কেন বাসেন!”
চলবে…
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।]