#আড়ালে_আবডালে
#পর্ব_৪২
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
_______________
বাড়িতে ফিরে কোনো রকম ফ্রেশ হয়েই ঘুমিয়ে পড়েছে নিহি। সঙ্গে তরুও ঘুম দিয়েছে। আমান আর নিরব বাহিরে আছে। নিহির পরীক্ষা শেষ না হওয়া পর্যন্ত তরুদের বাসাতেই থাকবে। নিরবকে ঢাকা থেকে সিলেটে নিয়ে এসেছে মূলত এ কারণেই। কারণ নিরব ব্যতীত আমান তো এই বাড়িতে আসতে পারবে না। থাকা তো অনেক দূরের কথা৷ নিরব লিমনকে জানিয়েছে কিছু দরকারি কাজের জন্য বেশ কয়েকদিন সিলেট থাকতে হবে। খালার বাড়ি থেকে যাতায়াতের রাস্তা বেশ দূরে হয়ে যায় তাই ওর বাসাতেই থাকবে। লিমনও কোনো বাঁধা দেয়নি৷ পুরো এক রাতের মাঝে সবকিছু ম্যানেজ করে ফেলেছিল আমান। তরু এবং উপমার থেকে সব কথা জানার পরপরই সে ফোন করেছিল নিজাম ইসলামকে। বুদ্ধি খাটিয়ে কনভেস করেছে তাকে। এরপর ফোন করেছিল নিরবকে। জানিয়েছে তাকে সিলেট যাওয়ার কথা৷ নিরব আপত্তি করেনি। করারও কোনো কথা নয়। বরং খুশি হয়েছে। জান্নাতকে দেখতে পাওয়ার খুশি। সেই রাতেই নিরব লিমনকে ফোন করে যাওয়ার কথা জানিয়েছে। ওরা সিলেট আসলেও যে মামার বাড়িতেই থাকবে এটা জানতো না নিহি। বাড়ির সামনে এসে বিস্মিত হয়েছে যখন দেখেছে আমান আর নিরবও ভেতরে আসছে। মামি অবশ্য পরে তরু আর নিহিকে জিজ্ঞেস করেছিল যে ওদের সাথে কেন পাঠিয়েছে? নিহি বুদ্ধি খাটিয়ে বলে দিয়েছে আমান নীলমের অনেক পুরনো আর ভালো বন্ধু। বাবা কিছুটা অসুস্থ এবং নীলম অফিসের কাজে ব্যস্ত তাই তাদের সাথে পাঠিয়ে দিয়েছে। মামি আর কথা বাড়াননি৷ কারণ এর আগে যখন ওরা এসেছিল তখনই বুঝেছিল ছেলে দুটো ভদ্র। তাছাড়া লিমনের ফ্রেন্ড। অন্যকিছু ভাবার প্রশ্নই আসে না।
সুরেলা মিষ্টি কণ্ঠে গানের শব্দ ভেসে আসছে কানে। কিন্তু ঘুমানোর ফলে এই সুরেলা শব্দটাকেই ভীষণ বিদঘুটে লাগছে নিহির। বোঝার চেষ্টা করে শব্দটা কীসের! পরক্ষণেই আধো আধো চোখ খুলে পাশে তাকিয়ে দেখে তরু ঘুমাচ্ছে। এবং মাথার কাছে বালিশের পাশে তরুর ফোন বাজছে। কেমন ঘুমরে বাবা! নিহি তরুকে আস্তে আস্তে ধাক্কা দিয়ে বলে,
“তরু! এই তরু! তোর ফোন বাজে।”
ঘুমে ঢুলতে ঢুলতে ফোন রিসিভ করে তরু৷ শিশির ফোন করেছে। নিহি আবারও ঘুমিয়ে পড়ে। কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে রাখে৷ কিন্তু আগের ঘুমটা আর আসছে না৷ এই হচ্ছে একটা সমস্যা। একবার ঘুম ভাঙলে আর কিছুতেই ঘুম আসবে না।
আলসেমি নিয়ে কিছুক্ষণ শুয়ে থেকে উঠে পড়ে। ফ্রেশ হয়ে এসে ডাইনিং রুমে যায়৷ টেবিলে কোনো খাবার নেই। সব খাবার ফ্রিজে রাখা। এখন গরমও করতে ইচ্ছে করছে না। মামির ঘরে উঁকি দিয়ে দেখে কেউ নেই৷ লিমনের ঘরও ফাঁকা৷ কোথায় গেছে সবাই কে জানে! ফ্রিজ খুলে একটা আপেল নিয়ে খেতে খেতে ঘরে চলে যায়। তরু তখনো ফোনে কথা বলছে। আমানকে ফোন দিতে যাবে তখন মনে পড়ল ওর কাছে তো ফোন নেই। কী করবে আর ভেবে না পেয়ে বই নিয়ে বসল।
কিছুক্ষণ পরই মামি শুকনো কাপড় নিয়ে বাসায় আসে। তার মানে ছাদে গেছিল। কাপড়গুলো রেখে ওদের ঘরে এসে জিজ্ঞেস করছে,
“নাস্তা করেছিস?”
তরু বারান্দায় চলে গেছে। নিহি বলে,
“না মামি।”
“নাস্তায় কী খাবি বল। বানিয়ে দিচ্ছি।”
“একটা কিছু বানালেই হবে।”
“আচ্ছা।”
মামি রান্নাঘরে চলে যায়। প্রায় ১০ মিনিট পর আমান আর নিরব বাড়িতে আসে। সোজা ওদের ঘরের সামনে এসে ফোনটা টেবিলের ওপর রেখে অন্য ঘরে চলে যায়। হতভম্ব হয়ে যায় নিহি। যদি মামি দেখে ফেলত! ফোন হাতে নিতে যাবে তখন একটা ম্যাসেজ আসে।
“এখনই ছাদে আসো।”
আমানের নাম্বার থেকে ম্যাসেজটা এসেছে। কিন্তু ওর নাম্বার তো ফোনে সেভ করা ছিল। কোনো রকম লুকিয়ে ছাদে চলে যায় সে। যাওয়ার আগে তরুকে বলে যায়, ‘মামি খুঁজলে বলবি ওয়াশরুমে আছি।’
.
সময়টা প্রায় সন্ধ্যা। সূর্য ডোবার মুহূর্ত। পুরো আকাশ হলদে হয়ে আছে৷ সূর্যকে এখন ডিমের কুসুমের মতো লাগছে। মৃদু মৃদু বাতাসে ছাদে লাগানো গাছের পাতাগুলো এদিক-সেদিক দুলছে। গাছের চিকন ডালগুলো নুয়ে নুয়ে যাচ্ছে। দমকা হাওয়া আসলে মনে হয় গাছের ডালপালা, পাতাগুলো মনের খুশিতে নাচছে। ছাদের কার্ণিশ ঘেঁষে হাঁটছে আমান। সূর্যর মুখোমুখি থাকায় এক পাশ থেকে ছায়ার মতো অন্ধকার দেখাচ্ছে তাকে। মুখ স্পষ্ট নয়। নিহি ছাদে গিয়ে গুটি গুটি পায়ে আমানের কাছে যায়৷ কাছাকাছি যাওয়ার পর মুখটা স্পষ্ট হয়। ঘামে লেপ্টে আছে কিছু চুল কপালে। আর কিছু চুল বাতাসে নড়ে কপালেই আছড়ে পড়ছে। নিহিকে দেখে সেই ভুবনময়ী হাসিটা দেয়। বুকের ভেতর ঠান্ডা হয়ে যায় নিহি। সে বলে,
“আপনি তো ঘেমে গেছেন।”
“আমার বউটা একদম আনরোমান্টিক।”
“এ কথা বললেন কেন?”
“বলব না কেন? সে কি পারতো না এখন তার ওড়না দিয়ে আমার কপালের ঘাম মুছে দিতে?”
ভালোবাসা মিশ্রিত অভিযোগ শুনে নিহি লজ্জিত হয়। সত্যি বলতে তারও ইচ্ছে করছিল ওড়না দিয়ে পরম যত্নে আমানের কপালে মুক্তর মতো চকচক করা ঘামগুলোকে মুছে দিতে। কিন্তু লজ্জা আর সংকোচে গুমোট বেঁধে গেছিল সে। তবে সেই লজ্জার চেয়ে আমানের অভিযোগের লজ্জার মাত্রা অনেক বেশি। অপরাধীর মতো মাথা নত করে মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে নেয় নিহি। আমান ওর দু’গালে ধরে নিজের দিকে মুখ এনে বলে,
“আমাকে দেখতে এতই বাজে লাগছে যে আমার বউ আমার দিকে তাকাচ্ছেও না?”
আমানের হাত সরিয়ে দিলো নিহি৷ ওড়নার এক কোণা নিয়ে কপালের ঘাম মুছে দিতে দিতে বলল,
“এতটাই আকর্ষণীয় লাগছে যে আপনার নিহুর ইচ্ছে করছে আপনাকে খেয়ে ফেলতে।”
ঘাম মুছে ওড়না নামাতেই আমান নিহির গালে চুমু খেয়ে বসে। নিহি গালে হাত দিয়ে আশেপাশে তাকায়। অস্পষ্ট স্বরে বলে,
“আপনিও না!”
“আমি তোমার।”
“জি, জানি। আপনি আমার। কোথায় গেছিলেন?”
“বাইরে। তোমার ফোনে কিন্তু এখন নতুন সিম।”
“নতুন সিম কেন?”
“চেঞ্জ করে দিয়েছি। আগের সিম ভেঙে ফেলেছি। খুব কাছের কেউ ছাড়া যেন এই নাম্বার আর কেউ না জানে।”
“আচ্ছা।”
“আর সব চিন্তাভাবনা বাদ দিয়ে পড়তে বসবে।”
“আচ্ছা।”
“একটা নাটক করবে।”
“মানে? কী নাটক?”
“যখন বাড়িতে পড়তে বসবে তখন বুঝো আর না বুঝো একটা টপিক নিয়ে মামিকে বলবে তুমি এই পড়া বোঝো না৷ তরুকে শিখিয়ে দেবে সেও যেন সায় দেয়। তারপর আমি তখন বলব, আমি তোমায় বুঝিয়ে দেবো৷ ভয় নেই৷ আমিও সায়েন্সের স্টুডেন্ট ছিলাম। তোমাকে পড়াতে পারব।”
“আপনার ভেতরে তো দেখি অনেক প্যাঁচ!”
“এই ভালেবাসাকে তুমি প্যাঁচ বললে? আমার ভালোবাসা তুমি বুঝলে না নিহু৷ বুঝলে না।”
“হুহ! ঢং। আপনি জিলাপি।”
“তাহলে খেয়ে ফেলো।”
আমানের বাহুতে কিল দিয়ে নিহি বলে,
“ধুর, যা! আপনার কাছে আমি পড়তে পারব না।”
“কেন?”
“লজ্জা লাগবে।”
“লজ্জা লাগবে নাকি টাকা দেওয়ার ভয়ে বলবে না? ভয় নেই আমি টাকা নেব না৷ বউয়ের সঙ্গে শালীকেও ফ্রি পড়াব। আমি আবার উদার মনের মানুষ তো!”
“ইশ! আসছে আমার উদার মনের মানুষটা।”
“বিশ্বাস হয় না? সমস্যা নেই। বিশ্বাস করিয়ে দেবো৷ তুমি শুধু সুন্দর করে এই নাটকটা করবে।”
“আপনি কি সত্যিই বলছেন? মানে সিরিয়াস?”
“একদম সিরিয়াস।”
“ঠিকাছে। কিন্তু একটা শর্ত আছে।”
“কী শর্ত?”
“পড়া না পারলে কিন্তু বকবেন না।”
“আচ্ছা বকব না।”
“সত্যি তো?”
“হ্যাঁ।”
“তিন সত্যি?”
“সত্যি বললাম তো।”
“না, তিন সত্যি বলেন।”
“আচ্ছা তিন সত্যি।”
নিহি খুশিতে তখন আনমনেই আমানকে জড়িয়ে ধরে। আমানও আপনমনে হাসে৷ সেও জড়িয়ে ধরে। আমান বলে,
“যাদু দেখবে নিহু?”
“কীসের যাদু?”
“দেখবে নাকি বলো।”
“হ্যাঁ, দেখব।”
“তাহলে চোখ বন্ধ করো।”
“কেন?”
“যাদু দেখতে হলে চোখ বন্ধ করতে হবে।”
“আচ্ছা করলাম।”
সূর্য ডুবে গিয়ে চারিদিক অন্ধকার চাদরে ঢেকে গেছে। দমকা বাতাসে নিহির ওড়না উড়ছে। তার গালে হাত রাখে আমান। ঠোঁট এগিয়ে নিয়ে যায় নিহির ঠোঁটের দিকে।
তখন তরু ছাদে আসে। আমান নিহিকে সরিয়ে দিয়ে নিজেও দূরে সরে যায়। অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে সে। তরু আমতা আমতা করতে থাকে। এদিক-ওদিক তাকিয়ে বলে,
“মা খেতে ডাকে।”
“হ্যাঁ,আসছি।”
আমান বিড়বিড় করে বলে,
“শালীকাও না! আসার আর সময় পেল না৷ আমার যাদু!”
বিড়বিড় করে বললেও নিহির কানে যায় কথাগুলো। মুখ টিপে হাসে সে। আমানের মুখের দিকে ঝুঁকে ফিসফিস করে বলে,
“রাত এগারোটায় ছাদে আসবেন৷ তখন যাদু দেখব। আর হ্যাঁ, চুমু খাওয়ার জন্য এত ছলনার দরকার নেই।”
মুখ টিপে হাসতে হাসতে নিহি তরুর সঙ্গে চলে যায়। আমান মাথার পিছনে চুলের মাঝে হাত ডুবিয়ে লজ্জামিশ্রিত হাসে।
.
নিহি চলে যাওয়ার পর আমান সাইবার ক্রাইমের সদস্যের কাছে ফোন করে। যাকে ঐ নাম্বারটি ট্র্যাক করতে দেওয়া হয়েছে। তিনবারের মাথায় ফোন রিসিভ করে সালাম দিয়ে বলে,
“দুঃখিত ভাই একটু ব্যস্ত ছিলাম।”
“সমস্যা নেই৷ নাম্বারটি কি ট্র্যাক করা গেছে?”
“না ভাই৷ নাম্বারটি আর খোলা হয়নি।”
“আচ্ছা আপনারা চেষ্টা করতে থাকুন। কোনো আপডেট পেলে আমায় জানাবেন।”
“জি অবশ্যই। আপনার কাছে কোনো ম্যাসেজ বা কল আসলে আমায় জানাবেন।”
“ঠিকাছে।”
ফোন কেটে দিয়ে এবার নিরবকে ছাদে আসতে বলল। নিরব ছাদে এলো নিহির পুরাতন সিমটা নিয়ে। সিমটা অন্য ফোনে অন করে আমান৷ কোনো ম্যাসেজ আসেনি। নিরব জিজ্ঞেস করে,
“সিমটি কি এখন আপনিই ব্যবহার করবেন স্যার?”
“ব্যবহার করব বলতে শুধু আপডেটের জন্য। অর্থাৎ হুমকি বার্তাগুলো তো এই নাম্বারেই আসবে। ম্যাসেজগুলো দেখলে নিশ্চয়ই কিছু না কিছু ক্লু পাওয়া যাবে।”
“আপনার কি মনে হয় আবার ম্যাসেজ আসবে?”
“অবশ্যই। যে ম্যাসেজটি করেছে সে নিশ্চয়ই খবর নেবে। খবর নিয়ে জানবে নিহি আমার সঙ্গেই৷ তখন আবারও নিহিকে থ্রেট করবে। আমি চাই না নিহি ঘাবড়ে যাক। বা কোনো রকম চিন্তার মধ্যে পড়ুক। তাই ওকে বলেছি সিমটা আমি ভেঙে ফেলেছি।”
“আপনিও সাবধানে থাকবেন স্যার।”
“আমার নিজেকে নিয়ে কোনো ভয় নেই নিরব। নিহুকে নিয়েই আমার যত ভয়!”
“আপনি থাকতে ম্যামের কিছু হবে না স্যার।” স্মিত হেসে বলল নিরব।
_______________
রাতের খাবার খেয়ে তরু আর নিহি পড়তে বসেছে। হায়ার ম্যাথ বই সামনে। গাইডও খুলে রেখেছে একপাশে। কাঙ্ক্ষিত প্রশ্নটির উত্তর তন্ন তন্ন করে খুঁজেও গাইডে পায়নি। তরু নিজেও পারে না। হাতের ওপর মাথা ভর দিয়ে কলম কামড়াতে কামড়াতে অঙ্কটা নিয়ে ভাবছে নিহি। তখনই আমানের বলা কথাটা মাথায় আসে। নাটক যখন করতেই হবে তখন সত্যিকারের প্রবলেম নিয়েই করুক।
মামা-মামি ঘুমিয়ে পড়েছে। আমান, লিমন এবং নিরব তিনজনে একসঙ্গে ড্রয়িংরুমে বসে টিভি দেখছিল। নিহি তখন ওদের পেছনে দাঁড়িয়ে লিমনকে ডেকে বলে,
“ভাইয়া এই অঙ্কটা বুঝিয়ে দেবে?”
তিনজনেই পেছনে তাকায়। লিমন জিজ্ঞেস করে,
“কোন অঙ্ক?”
“হায়ার ম্যাথ।”
“আমি কমার্সের স্টুডেন্ট তুই জানিস না? আমি হায়ার ম্যাথ কীভাবে সলভ্ করে দেবো? কালকে প্রাইভেটে গিয়ে শিখে নিস।”
নিরব তখন বলে,
“কী আশ্চর্য! স্যারের আশায় বসে থাকতে হবে উনার? আমার বস তো সায়েন্সের স্টুডেন্ট ছিল।”
তারপর আমানের দিকে তাকে সহাস্যে বলে,
“আপনার কোনো সমস্যা না থাকলে যদি উনাকে অঙ্কটা একটু বুঝিয়ে দিতেন স্যার!”
“উনার যদি আমার কাছে পড়তে আনইজি না লাগে তাহলে আমার কোনো সমস্যা নেই।” বলল আমান।
উত্তরে লিমন বলল,
“আনইজি লাগবে কেন? পড়া পারে না এটায় যখন লজ্জা লাগেনি, তখন আপনার কাছে পড়তেও আনইজি লাগবে না। তাও যদি তিড়িংবিড়িং করে তাহলে দু, চার ঘা লাগিয়ে দিয়েন। আমি পারমিশন দিয়ে দিলাম।”
নিহি দাঁতমুখ খিঁচে লিমনের দিকে তাকিয়ে আছে। মনে মনে ওর চৌদ্দ গুষ্ঠি উদ্ধার করছে। এদিকে আমান আর নিরব মুখ টিপে হাসছে। নিহি ফোস ফোস করে উঠে বলল,
“আমার কোনো সমস্যা নাই হুহ্!”
তারপর গটগট করতে করতে ঘরে চলে গেল। আমান আসলো মিনিট পাঁচেক পর। চেয়ারে বসে আছে নিহি। আমানকে দেখে তরু পাশের চেয়ারটা ছেড়ে বিছানায় গিয়ে বসল বই নিয়ে। আমান কাশি দিল।
“এহেম! এহেম!”
“এত দৃষ্টি আকর্ষণ করতে হবে না। বসেন।” উত্তর দিল নিহি।
আমান পাশের চেয়ারে বসে বলল,
“অঙ্কটা কি সত্যিই পারো না? নাকি নাটক করলে?”
“সত্যিই পারি না। ইংরেজি আর অঙ্কে আমি খুব কাঁচা। বিয়ের পর দুটো সাবজেক্ট বাচ্চাকাচ্চাদের আপনাকেই পড়াতে হবে।”
আমানের বিষম উঠে যায়। কীসের আর তার আনইজি লাগবে! উল্টো আমানকেই নাকানিচুবানি খাওয়াচ্ছে। নিজেকে সামলে নিয়ে আমান বলল,
“দেখি অঙ্কটা।”
অঙ্কটা দেখিয়ে দিল নিহি৷ পুরো অঙ্কটা সলভ্ করে নিহিকে বুঝিয়ে দিল। একবারেই বুঝেনি। দশবারের অধিকবার বোঝাতে হয়েছে। এখন এই অঙ্কটা এতবার কি নিহি আসলেই বোঝেনি নাকি আমানকে আরেকটু নাকানিচুবানি খাওয়ার জন্য ইচ্ছে করেই না বোঝার অভিনয় করেছে তা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু মজার বিষয় হচ্ছে, তাতে আমান একটু বিরক্ত হয়নি। রাগ হয়নি। নিহিকে একটা ধমকও পর্যন্ত দেয়নি৷ ধৈর্য নিয়ে নিহিকে বুঝিয়েছে। পড়ার পার্ট শেষ হলে আমান ঘরে চলে যায়। তখন ঘড়িতে পৌনে এগারোটা বাজে। লিমন আর নিরব শুয়ে পড়েছে। আমান ছাদে চলে গেল। নিহি গেল এগারোটা বাজার প্রায় পাঁচ মিনিট পর।
গুণগুণ করে গান গাইতে গাইতে ছাদের দরজার সামনে গিয়ে থমকে দাঁড়ায় নিহি। বাতাসে বাতাসে ভেসে আসছে আমানের গায়ের ঘ্রাণ। এটা গায়ের ঘ্রাণ? নাকি পারফিউমের! কে জানে! যাই হোক, দুটোর সংমিশ্রণ তো বটে। শব্দহীন পায়ে পেছন থেকে গিয়ে ‘ভাউউউউ’ বলে শব্দ করে নিহি। আমান ভয়ে আৎকে ওঠে। খিলখিল করে হাসে নিহি। ওর হাসি দেখে আমানও হেসে ফেলে।
হাসতে হাসতে নিহি বলে,
“কী ভীতু!”
“ভীতুর কী হলো? এভাবে হুট করে আসলে যে কেউই ভয় পাবে।”
“হয়েছে। জানি।”
“আর কী জানো?”
“অনেককিছু। আচ্ছা আজকে আকাশে চাঁদ নেই কেন?”
“আকাশের চাঁদ মাটিতে যে তাই।”
“মানে?”
“মানে তুমি। প্রতিদিন দুটো চাঁদ থাকে। একটা আকাশে আরেকটা জমিনে। আকাশের চাঁদ তো চেনোই। আর জমিনের চাঁদ তুমি! আজকে আকাশের চাঁদ মেঘের আড়ালে লুকিয়ে আছে। আর জমিনের চাঁদ আমার সামনে। প্রত্যেক প্রিয় মানুষটার কাছেই তার প্রিয়তমা চাঁদের সমতূল্য। তাই সেও তার প্রিয়তমাকে চাঁদ হিসেবেই দেখে৷ যেমন আমার চাঁদ তুমি!”
“আমি এতদিন ভাবতাম আপনি চাইলে গায়ক হতে পারতেন। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে আপনি শুধু গায়কই নন; বরং একাধারে গায়ক, কবি, গল্পকার হতে পারবেন।”
“এতকিছু তো হওয়ার প্রয়োজন নেই আমার। আমি গান গাইলে সেটা আমার বউ নিহুর জন্যই গাইব। আমি কবিতা লিখলে আমার নিহুর জন্যই লিখব। আমি গল্প লিখলে সেটাও আমার নিহু পাখির জন্যই লিখব। মুগ্ধ হলে শুধু আমার নিহুপাখিই হোক৷ অন্য কাউকে আকর্ষিত বা মুগ্ধ করার ইচ্ছে আমার নেই।”
কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলে নিহি। এত ভালোবাসা মিশ্রিত কথা শোনার পর ঠিক কী উত্তর যে কথাগুলোর প্রাপ্য যোগ্য হবে সেটা নিহি জানে না। মাঝে মাঝে নিজেকেই নিজের হিংসে লাগে। এত ভালোবাসে বলেই বোধ হয় এত বাঁধা-বিপত্তি আসে। এবং সব বিপদে নিহির সামনে ঢাল হয়ে দাঁড়ায় আমান। তার কাছে গিয়ে পাশাপাশি দাঁড়ায় নিহি। এক হাত পেঁচিয়ে ধরে কাঁধে মাথা রাখে। আমান নিজের হাতের আঙুলের ফাঁকে নিহির হাতের আঙুল পুরে নেয়। নিহি বলে,
“আপনি আমায় এত ভালোবাসেন কেন? এত ভালোবাসবেন না! নজর পড়বে আমাদের ভালোবাসায়। আমি আপনাকে হারাতে চাই না।”
“আল্লাহ্ আছে তো নিহু৷ তিনি সব নজর কাটিয়ে দেবেন। এটা আমার বিশ্বাস। আর আমি তোমায় হারাতে দেবো না।”
চলবে…
#আড়ালে_আবডালে
#পর্ব_৪৩
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
_______________
নিহির ইয়ারচেঞ্জ পরীক্ষা শেষ হয়েছে আজ দু’দিন হলো। পরীক্ষার আগে থেকে শুরু করে পরীক্ষা পর্যন্ত আমানই নিহিকে পড়িয়েছে। সবসময় ওর ছায়া হয়ে থেকেছে। যতক্ষণ পরীক্ষা হয়েছে ততক্ষণ কলেজের বাইরে অপেক্ষা করেছে। সর্বোপরি একদম আগলে রেখেছে। এর মাঝে ঐ নাম্বারে আর কোনো হুমকি বার্তা আসেনি। তবে সেই লোকগুলো আবারও উপমাকে হুমকি-ধামকি দিয়েছে। নিহিকে আমানের জীবন থেকে সরে যেতে বলেছে। হুমকির মাত্রা বাড়তেই থাকে। কখনো ফোনে, কখনো বা ম্যাসেজে। আমান চেষ্টা করেছিল সেই নাম্বারটাও ট্র্যাক করতে। কিন্তু ব্যর্থ হতে হয়েছে। হতাশায় ডুবে যায় উপমা। ওর নিরাপত্তার জন্য কিছু লোক সবসময় ওর আশেপাশে রাখে আমান। এর কিছুই নিহি জানে না। বলে রাখা ভালো আমান জানায়নি।
কাল ঢাকায় ব্যাক করবে ওরা। তখন তো উপমার সঙ্গে দেখা হবে। সবটা জেনে কি নিহি রাগ করবে?
“শুনছেন?”
নিহির ডাকে হুশ ফেরে আমানের। হাসি দিয়ে বলে,
“শুনছি। বলো।”
“চলেন কোথাও থেকে ঘুরে আসি।”
“কোথায় যাবে?”
“যেদিকে দু-চোখ যায়।”
আমান স্মিত হেসে বলে,
“চলো এমন এক জায়গায় যাই যেখানে তুমি আর আমি ছাড়া আর কেউ থাকবে না।”
“সেই জায়গাটা কোথায়?”
“জানা নেই৷ তবে খুঁজে নেব।”
“প্লিজ মজা করা বাদ দেন৷ চলেন যাই।”
“কোথায় যাবে সেটা তো বলো।”
“জায়গা আপনি ঠিক করেন। কাল তো ঢাকায় ফিরে যাব। যাওয়ার আগে কোথাও থেকে ঘুরে যেতে চাই।”
“নিরবের খালামনির বাসা থেকে ঘুরে আসি চলো।”
“সেখানে কী আছে?”
“তেমন কিছুই নেই। আবার অনেককিছুই আছে।”
“তাহলে তো অবশ্যই যাওয়া উচিত।”
“কিন্তু লিমনকে কী বলে ম্যানেজ করবে?”
“ভাইয়া তো বাসায় নেই। শ্বশুরবাড়ি গেছে। কালকে আসবে। আর মামা-মামিকে বলব ফ্রেন্ডের জন্মদিন আজ।”
“জন্মদিন কি কারো আসলেই আছে?”
“ধুর! না। মিথ্যা বলব।”
“মিথ্যা বলাও শিখে ফেলছ?”
“শেখার কী আছে? প্রেম করার জন্য একটু আধটু মিথ্যা বললে কিছু হয় না।”
আমান হেসে বলে,
“ঠিকাছে। কে কে যাচ্ছি আমরা?”
“আপনি, আমি, তরু আর শিশির। সঙ্গে ক্যাবলাকান্ত তো ফ্রি।”
নিরব পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। নিহির কথা শুনে অসহায়ের মতো মুখ করে বলে,
“আমাকে ফ্রি বানিয়ে দিলেন ম্যাম?”
নিহি হাত দিয়ে চুল প্যাঁচাতে প্যাঁচাতে বলে,
“আপনি দুধভাত।”
এবার নিরব হেসে ফেলল। সঙ্গে আমান আর নিহিও হাসলো।
.
.
আকাশ আজ পরিষ্কার। খুব বেশিই পরিষ্কার। রাশি রাশি তারা আকাশে জ্বলজ্বল করছে। একটি মাত্র চাঁদ থালার মতো পূর্ণাঙ্গ আকৃতির। চাঁদের আলো ঠিকরে পড়ছে মাটিতে। বড়ো বড়ো গাছপালার মাঝ বাগানে দাঁড়ালেও স্পষ্ট দেখা যাবে মুখাকৃতি। মেঠো পথ দিয়ে হাঁটছে তিনজন কপোত-কপোতী। আমান-নিহি, শিশির-তরু এবং নিরব-জান্নাত। নিরব আর জান্নাতের ভাব-ভালোবাসাও হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। এক্ষেত্রে অবশ্যই সাহায্য করেছে আমান এবং নিহি। বাড়িতেও জানানো হয়েছে। খুব শীঘ্রই বিয়ে করে ফেলবে বলে জানিয়েছে দুই পরিবার। তাদের সিদ্ধান্তে দুজনই ভীষণ খুশি। ভালোবাসার মানুষকে নিজের করে পাওয়ার আনন্দ কার না থাকে?
চাঁদের আলোয় মাঠ-ঘাট পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে বলে আলাদা লাইটের কোনো প্রয়োজন হয়নি। বর্তমানে সবাই এখন আছে জান্নাতদের বাড়ির কাছাকাছি জায়গাতে। এসেছে বিকেলেই। তবে হাঁটতে বের হয়েছে এখন। সামনেই একটা নদী আছে। ঘাটে বাঁধা আছে সারি সারি নৌকা। নিহি নৌকায় চড়তে ভালোবাসে। আমান সেটা জানে এবং এজন্যই এই জায়গাতে নিয়ে আসে। খোলা আকাশের নিচে এক নৌকায় দুজনে বসে গল্প করবে। নিহিকে জানিয়ে দেবে অজানা কথাগুলো। ভাবতেই মনের মাঝে দোলা দিয়ে যায়৷ আবার ভয়ও লাগে। কী জানি কী না রিয়াক্ট করে বসে!
হাঁটতে হাঁটতে ঘাটে চলে আসে সবাই। তিনটে নৌকায় দুজন করে উঠে বসে। নৌকার এক মাথায় আমান বৈঠা হাতে বসেছে। নিহি শেষ প্রান্তে বসতে গেলে আমান বলে,
“ওখানে নয়। মাঝখানে বসো। পড়ে যেতে পারো।”
“না, পড়ব না। এর আগেও আমি নৌকায় উঠেছি।”
“আমি কোনো রিস্ক নিতে চাই না নিহু!”
হালকা রাগ ও ধমক মিশ্রিত কণ্ঠে কথাটা শুনে নিহির আর সাহস হয়নি ওখানে বসার। নৌকার মাঝ বরাবর নারিকেল পাতার ছোটো পাটি বিছানো আছে। নিহি সেখানে গিয়ে বসল। পানিতে বৈঠা ফেলতেই গোলাকৃতির মতো পানি ছড়িয়ে পড়ল। চারপাশে থৈ থৈ করছে পানি। বিশুদ্ধ বাতাস বয়ে চলেছে। পূর্ণাঙ্গ চাঁদটার প্রতিচ্ছবি পানির মাঝেও ভেসে উঠছে। তরু, শিশির, নিরব এবং জান্নাত ওদের নৌকা অনেকদূর চলে গিয়েছে দেখে নিহি বলল,
“ওরা সবাই কত দূরে চলে গেল! আর আমরা এখনো এখানেই পড়ে আছি।”
“ইচ্ছে করেই যাইনি।”
“কেন?”
“তোমার অপেক্ষার প্রহর আজ শেষ করব তাই।”
নিহি আৎকে উঠে বলে,
“ধাক্কা দিয়ে পানিতে ফেলে দিবেন নাকি?”
“নিহু!” মেকি ধমক দিলো আমান।
নিহি চুপসে গিয়ে বলল,
“ধমক দেন কেন? আমি তো মজা করে বলেছি।”
“এসব মজা একদম করবে না। অন্তত আমার সাথে তো নয়-ই!”
“হু।”
অভিমানে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে তাকায় নিহি৷ বৈঠা নৌকার ওপর রেখে তার পাশে আমান বসে। নিহি চমকে গিয়ে বলে,
“একি! উঠে আসলেন কেন? নৌকা ডুবে যাবে তো!”
“ডুববে না। তুমিই না তখন বলেছিলে যেদিকে দু’চোখ যায় সেদিকেই যাবে? তাহলে এখন নৌকা আমাদের যেদিকে নিয়ে যাবে আমরাও সেদিকে যাব।”
“যদি ডুবে যায়?”
“আমায় বিশ্বাস করো?”
আমানের চোখের দিকে তাকালো নিহি। ঘোর লাগানো দৃষ্টি তার। চোখে চোখ রেখে বলল,
“অনেক বেশি!”
“ব্যাস! তাহলেই হবে। এতটুকু ভরসা রাখো শুধু, আমি থাকতে তোমার কিছু হবে না।”
“আমি জানি সেটা। আচ্ছা কী যেন বলবেন বলেছিলেন?”
আমান চুপ করে থাকল কিছুক্ষণ।নিহির হাত দুটো নিজের হাতের মাঝে রেখেছে।নিহি উত্তরের জন্য আমানের দিকে তাকিয়ে আছে। আমান ঘাড় বাঁকিয়ে অন্যদিকে তাকায়। ঠোঁট কামড়ে বলে,
“আমি অন্য একজনকে ভালোবাসি!”
সঙ্গে সঙ্গে নিহির দুটো আলগা হয়ে যায়। চোখ দুটো ছলছল করে ওঠে। আমান আবার বলে,
“শুধু তাই নয়। বিগত চার বছর ধরে ভালোবাসি। কিন্তু কখনোই তাকে ভালোবাসার কথা বলতে পারিনি।”
নিহি নিশ্চুপ হয়ে তাকিয়ে আছে। কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। আমানের কথাগুলো মনে হচ্ছে প্রতিধ্বনি হয়ে কানে আসছে। বুকের ভেতর চিনচিনে ব্যথা অনুভব হচ্ছে। অন্য কাউকে ভালোবাসে সে? তাহলে এতটা দিন এসব কী ছিল? নাটক! নাহ্, আর ভাবা যাচ্ছে না। এরচেয়ে গলায় কলসি বেঁধে নৌকায় ডুব দিলেও এতটা কষ্ট হতো না। চোখের পানি চাঁদের আলোয় চিকচিক করে ওঠে। গলা ধরে আসছে। কান্নাগুলো দলা পাকিয়ে গলায় আটকে আছে। যেকোনো মুহূর্তে হুহু করে কেঁদে ফেলবে। অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিল নিহি।
আমান আবার বলল,
“তখন সে ক্লাস এইটে পড়ত। মাঝে মাঝেই তাকে দেখতাম ছাঁদে। লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতাম। সে আমায় দেখতো না। এরপর…”
নিহি বসা থেকে দাঁড়িয়ে পড়ে। আমান হাত টেনে ধরে নিহির৷ পাছে আবার পানিতে ঝাপ দেয়! নিহি কোনোরকমভাবে বলে,
“আমি বাড়ি যাব!”
“বাড়িতে নিয়ে যাব। তার আগে আমি কথা শেষ করি।”
নিহি এবার কেঁদে ফেলে। কাঁদতে কাঁদতে বসে পড়ে। দু’হাতে মুখ ঢেকে কেঁদে বলে,
“আপনার এসব কথা শোনার সাহস হচ্ছে না আমার। বুকের ভেতর তীরের মতো বিঁধছে। আমি পারব না আপনার পুরো কথা শুনতে।”
‘যদি গো তোমায় বলি
আমি তার নাম;
তুমি কি বাসবে ভালো,
দেবে তার দাম?’
আমানের সুরেলা কণ্ঠে পরিচিত গানের লাইনগুলো শুনে নিহি চমকে তাকায়। আমানের ঠোঁটে মুচকি হাসি।
‘কাজল কালো দুটি চোখে
সে যখনই আমায় দেখে,
পড়ে না চোখেতে পলক;
আর আসে না কথা মুখে।
তার চলে যাওয়া
ফিরে একটু চাওয়া
এই বুকেতে ঝড় তুলে যায়!
যার ছবি এই মন এঁকে যায়
যার কথা ভেবে দিন কেটে যায়,
সে কি জানে শুধু তাকে
ভালোবাসে আমার হৃদয়!’
ডাগর ডাগর অশ্রুশিক্ত চোখে নিহি এখনো নিশ্চুপ হয়ে তাকিয়ে আছে।
‘তুমি সুন্দর। চাঁদের আলোয় ঠিকরে পড়া তোমার হাসির ধ্বনি, নদীর কলকলানিতে মুখরিত হয়ে ওঠে। তোমার ঐ দুটো টানা টানা চোখে অশ্রু বেমানান। তুমি হাসবে। তোমার সঙ্গে হাসবে ঈর্ষান্বিত প্রকৃতি৷ হাসবে অপরূপ ধরণী। যে ভালোবাসা লুকিয়ে ছিল এতটা সময় দীর্ঘকাল, আজ তার সবটাই করব প্রকাশ। আমি ভালোবাসি তোমায়। তুমি কি দেবে সেই ভালোবাসার দাম?’
“তার মানে! তার মানে আপনিই সেই নাম না জানা উড়োচিঠির মালিক?” কাঁপা কাঁপা ঠোঁটে প্রশ্ন করে নিহি।
আমান দু’হাত প্রসারিত করে মুচকি হেসে গায়,
‘কবে জানবে তুমি?
কবে বলব আমি?
কেউ আছে গো;
তোমার আশায়।’
নিহি সঙ্গে সঙ্গে আমানের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
________________
উপমার বাবার শরীরটা বেশ কয়েকদিন ধরেই ভালো যাচ্ছে না। ওষুধও শেষ। ওষুধের প্রেসক্রিপশন আর টাকা নিয়ে মাকে বলে বাসা থেকে বের হয় উপমা। রাত তখন সাড়ে দশটা। বাড়ির সামনেই রিক্সা পেয়ে যায়। দোকান থেকে ওষুধ কিনে আনার সময় খেয়াল করে কয়েকজন ওকে ফলো করছে। আসলেই ফলো করছে নাকি এটাও শিওর না। আন্দাজে কিছু বলাও যাচ্ছে না। দ্রুত পা চালিয়ে একটা রিক্সায় উঠে উপমা। মাঝ রাস্তায় এসে কয়েকজন ছেলে রিক্সা থামায়। এক প্রকার জোর করেই উপমাকে রিক্সা থেকে নামায়। বাড়ি এবং বাজারের মাঝ বরাবর এই রাস্তাটা নির্জনই বলা চলে। উপমা আৎকে ওঠে। নিয়ন বাতির আলোতে চেহারাগুলো ঝাপসা বোঝা যাচ্ছে। ওদের মধ্যে দুজন মেয়েও আছে। একজন মেয়ে ওর হাত ধরে বলল,
“চলো।”
“কে আপনারা? আমি কোথাও যাব না।” হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে বলল উপমা।
ওরা আর কেউ কোনো কথা না বলে ক্লোরোফর্ম মাখানো রুমালটা উপমার মুখে চেপে ধরে। উপমা অজ্ঞান হওয়ার সাথে সাথে ওদের গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে যায়।
.
.
ঝিঁ ঝিঁ পোকার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। দূরে কোথাও হুতুম পেঁচাও ডাকছে বলে মনে হচ্ছে। উপমা নড়াচড়া করতে গিয়ে বুঝতে পারল কিছুর সাথে শক্ত করে ওকে বেঁধে রাখা হয়েছে। মুখ থেকে শব্দ বের হচ্ছে না। মুখও বাঁধা। চারপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকার। ভয়ে গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। কথা বলতে না পারায় ফ্যাসফ্যাসে গোঙানোর শব্দ হচ্ছে। শক্ত রশি দিয়ে হাত বাঁধা আছে বোঝা যাচ্ছে। হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতে গেলেই অসহনীয় ব্যথা লাগছে।
হুট করেই মাথার ওপর সাদা লাইট জ্বলে ওঠে। আলো খুব বেশি নয়। তবে এতটুকু আলোতে বোঝা যাচ্ছে কেউ একজন ওর দিকে এগিয়ে আসছে৷ মুখ দেখা যাচ্ছে না। তবে অবয়ব দেখে বোঝা যাচ্ছে সে একজন ছেলে!
চলবে…
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ। চিঠির রহস্য আরো বাকি আছে।]