#আড়ালে_আবডালে
#পর্ব_৪৯
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
_______________
ভোরের আলো ফুঁটতে চলল। প্রতিদিনকার মতো সূর্য উদয় হয় আবার অস্তও যায়। শুধু মানুষের জীবনের পরিবর্তনগুলোই ক্ষণে ক্ষণে রং বদলায়। কখনো রক্তিম আভায় রাঙায়িত আবার কখনো ঘন মেঘ বর্ষণের আবর্তিত রূপ। বিছানায় এসে বসতেই চিন্তায়, অস্থিরতায় ক্লান্তিরা চোখে ঘুম নিয়ে এসেছিল আমানের। কখন যে একপাশ হয়ে শুয়ে পড়েছে সেটা বুঝতেও পারেনি। পাখিদের কিচিরমিচির শব্দ কানে প্রবেশ করতেই ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে। মাথা ঝিম ধরে আছে। নিহির কথা মনে পড়তেই বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে ওঠে। কান্নারা দলা পাকিয়ে আটকে থাকে গলায়। এভাবে বসে থাকলে চলবে না। খুঁজতে হবে নিহিকে৷ বিছানা ছেড়ে দাঁড়াতেই মাথা চক্কর দিয়ে ওঠে। চোখের সামনে সবকিছু অন্ধকার লাগে। পূণরায় বিছানায় বসে চোখ বন্ধ করে নিজেকে ধাতস্থ করে আগে। তারপর মিটমিট করে চোখ মেলে তাকায়। জুতা পরতে গিয়ে দেখে একটা আছে, আরেকটা নেই। পরক্ষণে মনে হলো গতকাল রাতে জুতা খুলতে গিয়ে ঠেলে খাটের নিচে ছুঁড়ে মেরেছে। অলসতায় আনাও হয়নি৷ ফ্লোরে বসে জুতা আনতে হাত বাড়ায়। খাটের শেষ প্রান্তে জুতো। হামাগুড়ির মতো করে খাটের নিচে ঢুকতেই দেখতে পায় পাপোশ বিছানো। খাটের নিচে কেন পাপোশ থাকবে? হয়তো পুরান পাপোশ! মাথা আর না ঘামিয়ে জুতার জন্য হাত বাড়াতেই হাতের সাথে পাপোশ লেগে পাপোশটা সরে যায়। তখন আবছা আবছা একটা ঢাকনার মতো কিছু স্পষ্ট হয়।
পকেট থেকে ফোন বের করে টর্চ অন করে। আসলেই একটা সিমেন্টের একটা ঢাকনার মতো স্তুপ। কিন্তু এটার নিচে কী? এই রুমে সচারাচর কারো আসা হয় না। রুমের দরজা খোলাই থাকে সবসময়। বাড়ির কারো এই রুমে আসার দরকার হয় না। প্রত্যেকের জন্য আলাদা ঘর রয়েছে। আমান এখানে থাকে না বলে ওর রুমটা লক করা। অনলের সঙ্গে থাকতেও ইচ্ছে হচ্ছিল না বলে এই রুমে এসে শোয় আমান। মেহমানদের থাকার জন্য এই রুম ছাড়াও আরো তিনটা রুম আছে৷ অনেকেরই আছে একা থাকার অভ্যাস৷ তখন মেহমানদের মধ্যে কেউ কেউ এই রুমে এসে রাতে থাকে। তবে সেটাও খুব কম। রুমটা একদম শেষ প্রান্তে। এখানে কারো আসা-যাওয়া হয় না বললেই চলে। সব হিসেব মিলিয়ে আরো কৌতুহলী হয়ে পড়ে আমান। আস্তেধীরে ঢাকনাটি সরায়। তখনই চোখের সামনে ভেসে ওঠে একটি সুরঙ্গ পথ সঙ্গে একটি মই। নিচে ঘুটঘুটে অন্ধকার। আমান মই বেয়ে নিচে নামে। অন্ধকার পুরো জায়গাটিতে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। মাটির ওপর পা রাখতেই মনে হলো পায়ের ওপর দিয়ে কিছু দৌঁড়ে গেল। চিল্লাতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিলো সে। চারপাশ ঘুরে তাকাতে এক জায়গায় আলোর সন্ধান মিললো। সেদিকেই এগিয়ে যায় আমান। নিজেদের বাড়ির নিচে এমন একটা জায়গা! বিশ্বাসই করতে পারছে না। এই বাড়িটা বানানো হয়েছিল মায়ের পছন্দমতো। মা কি কখনো দেখেনি এই সুড়ঙ্গ? আলোর কাছে এগিয়ে গিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। থমকে যায় সামনে তাকিয়ে।
কাঁচের তৈরি ছোট একটা ঘরে নিহিকে চেয়ারের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে। কাৎ হয়ে চোখ বুজে আছে। মুখও বাঁধা। আমানের বুক কেঁপে ওঠে। সামনে এগিয়ে গিয়ে কাঁচের ওপর আঘাত করে নিহিকে ডাকে। আমানের কণ্ঠস্বর সেই ঘরে প্রবেশ করে না।
“ডেকে লাভ নেই। ঘরটা সাউন্ডপ্রুফ।”
আমান পিছনে ফিরে তাকায়। লিসাকে দেখে চমকে যায়। এখানে লিসা আসলো কীভাবে? আমান জিজ্ঞেস করে,
“তুমি অনলের ফ্রেন্ড না?”
লিসা শব্দ করে হেসে বলে,
“হ্যাঁ।”
এরপরই পেছন থেকে একজন আমানের মাথায় আঘাত করে। ঝাপসা হয়ে আসে তার চোখজোড়া। মাথা ফেঁটে রক্ত বের হয়। মাথা চেপে ধরে লুটিয়ে পড়ে মাটিতে। নিহি চোখ মেলে তাকায় তখন। দেখতে পায় আমানকে একজন টেনে নিয়ে যাচ্ছে। ছেঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে আর ফ্লোরে ছাঁপ রয়ে যাচ্ছে লাল টকটকে তাজা রক্তের। নিহি কেঁদে ফেলে। কিছু বলার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। নিজেকে ছাড়ানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে। বুকটা ফেঁটে যাচ্ছে কষ্টে।
মিনিট দশেক পর অনামিকা আসে। লিসাকে জিজ্ঞেস করে,
“ওর ব্যবস্থা করেছ?
উত্তরে লিসা বলে,
“মাথায় বারি মারা হয়েছে।অজ্ঞান আছে এখন।”
“খাটের নিচে ওকে ঢুকতে দেখেই আমার সন্দেহ হয়েছিল। নিহিকে দুর্বল করার জন্য বলেছিলাম আমানকেও মেরে ফেলব। আমার উদ্দেশ্য ছিল শুধু নিহিকে মারা।নিহিকে মারলেই আমান পাগল হয়ে যেত।দেউলিয়া হয়ে ঘুরে বেড়াতো বন-জঙ্গলে। কিন্তু তা আর হলো কই! ভেবেছিলাম শুধু পাগলই বানাবো। এখন মনে হচ্ছে ওকেও পথ থেকে সরাতে হবে। যাই হোক, তুমি বাসায় যাও এখন। পিছনের দরজা দিয়ে বের হয়ে বাগান দিয়ে যাবে।”
“আচ্ছা।”
পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটিকে বললেন,
“নজর রেখো ওদের ওপর।”
“ওকে বস।”
.
.
বিধ্বস্ত অবস্থায় উপমাকে যেই বাড়িতে আটকে রেখেছে সেই বাড়িতে আসে অনল। দরজায় নক করে। ভেতর থেকে দরজা লাগিয়ে রেখেছে উপমা৷
“কে?” জিজ্ঞেস করে উপমা।
“আমি অনল। দরজাটা খোলো।”
সঙ্গে সঙ্গে উপমা দরজা খুলে দেয়। অনলের চেহারায় চিন্তিত ভাব। পূণরায় উপমা জিজ্ঞেস করে,
“কী হয়েছে?”
অনল কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর বলল,
“নিহিকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তোমার কি কোনোভাবে কাউকে সন্দেহ হয়? কে নিহিকে তুলে নিয়ে যেতে পারে!”
উপমা ঘাবড়ে যায়। সামিয়া নিহির জন্য ক্ষতিকর ছিল। কিন্তু সামিয়া তো এখন আর বেঁচে নেই। তাহলে নিহির নতুন শত্রু কে? নাকি অনলই নিহিকে আটকে রেখে কোনো নতুন নাটক করছে! সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে অনলকে পর্যবেক্ষণ করে উপমা। ভ্রুঁ কুঁচকে বলে,
“আপনি নিহিকে আটকে রেখে নাটক করছেন না তো?”
“বোকার মতো কথা বোলো না! আমি কেন নিহিকে আটকে রাখব? এমন কোনো ইচ্ছে থাকলে আরো আগেই তুলে নিয়ে যেতে পারতাম।”
“তাহলে কে নিহিকে কিডন্যাপ করবে? আর কে আছে নিহির শত্রু?”
“আমি জানিনা!”
উপমা চুপ করে থেকে কিছুক্ষণ ভাবলো। এই মুহুর্তে দুটো মানুষকে সন্দেহের তালিকায় রাখা যায়। ১. লিসা এবং ২.সুমাইয়া। শুরু থেকেই নিহিকে সহ্য করতে পারে না লিসা। তাই এই কাজটা ও করলেও করতে পারে। আর বাকি রইল সুমাইয়া। হতে পারে সুমাইয়া কোনোভাবে জানতে পেরেছে সামিয়াকে খুন অনলই করিয়েছে। আর তাই প্রতিশোধ নিতে নিহির ক্ষতি করতে চাচ্ছে। নিজের মনে নিজেই যুক্তি মেলানোর চেষ্টা করছে। কোথাও কোনো ভুল বা কমতি রয়েছে ভেবে নিজের সন্দেহের তালিকার দুজনের কথাই উপমা অনলকে জানায়।
উপমার কথাগুলো একদম ফেলে দেওয়ার মতো মনে হয়নি অনলের কাছে। তবে সুমাইয়ার সত্যটা জানার সম্ভাবনা খুব কম। লিসাকে সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার পথ নেই। তাই লিসাই এখন নেক্সট টার্গেট। যদি ও সত্যিই কিছু করে থাকে তাহলে ওর থেকেই সবটা জানা যাবে। অনল উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে উপমাকে বলল,
“চলো।”
“কোথায়?”
“তোমার বাড়িতে।”
“ছেড়ে দিচ্ছেন?”
“হ্যাঁ।”
“যদি আমি সত্যিটা সবাইকে বলে দেই?”
অনল হাসলো। মনে হচ্ছে উপমা কোনো জোক্স শুনিয়েছে। হাসতে হাসতে অনল বলে,
“মুখে বললে তো অনেক কিছুই বলা যায়। এই যেমন ধরো, আমি যদি বলি সামিয়াকে তুমি খুন করেছ। তাহলে কি এটা সত্যি হয়ে যাবে? এর জন্য দরকার প্রমাণ। না, তোমার কাছে কোনো প্রমাণ আছে। আর না আমার কাছে। বাড়িতে জানতে চাইলে বলবে, কারা তোমায় তুলে নিয়ে গিয়েছিল তা তুমি জানো না। আর সুযোগ পেয়ে আজ পালিয়ে গিয়েছ। এখন চলো।”
উপমা বুঝতে পারল অনলের বুদ্ধির সাথে উপমার মতো সাধারণ মেয়ে পেরে উঠতে পারবে না। একটা কালো কাপড় দিয়ে উপমার চোখ বেঁধে দিলো অনল। বলল,
“আমি এখন কলেজে যাচ্ছি। লিসা, সুমাইয়া দুজনের সাথেই কথা বলব। যদি কোনো ক্লু পাই তাহলে তোমায় জানাবো। কোনো কাজে তোমার হেল্পও লাগতে পারে আমার।”
“একটা কথা বলি?”
“হু।”
“আমি যাই, আপনার সাথে। আমি গাড়িতে থাকব। আপনি ওদের সঙ্গে দেখা করবেন। যদি কিছু জানতে পারেন তাহলে আমরা দুজনে মিলেই যাব নিহিকে আনতে। নিহির বিপদে আমি ওর পাশে থাকতে চাই।”
“আর যদি কিছু জানতে না পারি? বা আমাদের ধারণা মিথ্যা হয়?”
“তাহলে তখন আমি বাড়িতে ফিরে যাব।”
“ঠিকাছে। চলো।”
অনল উপমা এবং আরো কয়েকজন ছেলেকে নিয়ে বের হলো।
________________
ক্ষুধায় পেটের ভেতর যন্ত্রণা হচ্ছে নিহির। পানির জন্য ছটফট করছে। চিন্তা হচ্ছে আমানের জন্য। ওরা কি আমানকে মেরে ফেলল? চোখের সামনে নিরবের রক্তাক্ত দেহটা ভেসে ওঠে। চোখ ফেঁটে পানি চলে আসে। আমানের সাথেও কি ওরা এরকমটাই করবে? ভাবতে পারছে না নিহি। এরচেয়ে মৃত্যু ভালো। অনেক বেশি ভালো। এতো কষ্ট, প্রিয় মানুষ হারানোর দৃশ্য আর সহ্য করতে পারবে না। উপমারই বা কী খবর? ওকে কি ফিরে পাওয়া গেছে? বাড়ির সবাই কেমন আছে? ভালো আছে তো? ওদের আবার কোনো ক্ষতি হবে কী! প্রশ্নরা আর চিন্তা মাথার ভেতর এঁটে বসেছে। মাথা ভারী হয়ে আছে যন্ত্রণায়।
তখন দরজার লক খোলে ছেলেটি। এক হাতে খাবার আর অন্য হাতে পানির গ্লাস। ফ্লোরে প্লেট আর পানির গ্লাস রেখে হাতের বাঁধন খোলে। তাড়াতাড়ি পানির গ্লাসটা নিয়ে নিহি পানি পান করে। আমানের কথা মনে পড়তেই গ্লাসটা ফ্লোরে পড়ে ভেঙে যায়। ছেলেটি রেগে গিয়ে গালিগালাজ করে নিহিকে। তারপর কাঁচের টুকরো গুলো তোলা শুরু করে। এ খাবার নিহির মুখে রুচবে না। খাবার খাবে না জানিয়ে দেয় নিহি। আবারও হাতের বাঁধন লাগিয়ে ছেলেটি রাগ দেখিয়ে গজরাতে গজরাতে বেরিয়ে যায়।
নিহি বাঁকা চোখে চারপাশটা দেখে। কোথায় কী আছে লক্ষ্য করে। একটা শেষ চেষ্টা করতে হবে। এভাবে মৃত্যু বা পরাজয় মেনে নিলে চলবে না। অন্তত আমানের জন্য হলেও কিছু করতেই হবে।
“কী ডিয়ার? খাবার খাওনি শুনলাম।”
নিহি দরজার দিকে তাকায়। অনামিকা রহমান এসেছেন। চারদিকে শুনশান নিরবতা। তিনি সামনে এসে দাঁড়িয়ে নিহির উসকো-খুশকো চুলগুলো হাত দিয়ে ঠিক করে দেন। নিহি নিশ্চুপ রয়েছে।তিনি বলেন,
“খাবারের সাথে রাগ করে লাভ কী বলো? আজকেই তোমার জীবনের শেষ দিন। শেষ খাবারটা খাওয়া উচিত তোমার।”
নিহি এবার নড়াচড়া করে। কিছু বলতে চাইছে। তিনি সামনে বসে বলেন,
“কিছু বলবে?”
নিহি উপরনিচ মাথা নাড়ায়। তিনি মুখের বাঁধন খুলে দিতেই আগে প্রাণ ভরে শ্বাস নেয় নিহি৷ একটু হাঁপিয়ে বলে,
“আমি শেষবারের মতো আমানকে একবার দেখতে চাই।”
“ওহো হো! ভালোবাসার মানুষটিকেই শেষমেশ দেখতে মন চাইলো? তোমার যখন ইচ্ছে হয়েছে তখন অবশ্যই ইচ্ছে পূরণ করব।”
তিনি ঐ ছেলেটিকে ডেকে বললেন,
“আমানের ঘরের লক খোলো।আমি নিহিকে নিয়ে আসছি।”
তারপর তিনি নিজেই নিহির হাতের বাঁধন খুলে দেন। রুমের ভেতর দুজন একা। সুড়ঙ্গ ঘরে কেউ নেই এখন। রাতে আসবে সবাই। এই সুযোগ। যদি কিছু করতে হয় তাহলে আজ এবং এখনই করতে হবে। ঘরও ভেতর থেকে লক করা। কাঁচ যে ভাঙবে এমন শক্তি কারো নেই। এই কাঁচ ভাঙবেও না। নিহি তখন ইচ্ছে করেই কাঁচের গ্লাসটা ভেঙেছিল এবং অতি গোপনে সরু একটা কাঁচের টুকরো হাতে লুকিয়ে রেখেছিল।
ছেলেটি চলে যেতে যেতে নিহির হাতের বাঁধন খোলা প্রায় শেষ। তিনি বলেন,
“ভুলেও এখান থেকে পালানোর চেষ্টা কোরো না। সব পথ বন্ধ।”
নিহি কিছু বলে না। চুপচাপ উঠে দাঁড়ায়। চোখ বন্ধ করে নিরবের মুখটা কল্পনায় দেখে নেয়। আমানের রক্তাত দেহ টানতে টানতে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে ওঠে। কষ্টগুলো এখন সব রাগ আর ক্ষোভে পরিণত হয়েছে। হাত-পা কাঁপতে থাকে। হাতের মুঠোয় থাকা কাঁচের টুকরাটি চেপে ধরে। সরু বলে খুব সহজেই কাঁচটি হাতে ঢুকে যায়। চোখ খুলে গোপনে কাঁচটি হাতের তালু থেকে বেরও করে নেয়। অনামিকা রহমান যখন দরজার লক খুলতে যান তখনই পেছন থেকে তার মুখ চেপে ধরে কাঁচের টুকরো গলায় ঢুকিয়ে দেয় নিহি। তিনি দুর্বল হয়ে পড়েন কিছুক্ষণের জন্য। চিৎকারও দিতে পারেন না।গলা থেকে কাঁচের টুকরোটি বের করে দুইচোখেও ঢুকায়। এবার তিনি ফ্লোরে বসে পড়েন। চিৎকার করেন। কিন্তু তার চিৎকারের শব্দ বাইরে প্রবেশ করে না। ছটফট করতে শুরু করেন। দপরাচ্ছেন। নিহির শান্তি শান্তি অনুভব হচ্ছে কিছুটা। সময় নষ্ট না করে যেই রশি দিয়ে নিহিকে বেঁধেছিল সেই রশি দিয়েই তাকে বেঁধে ফেলে। নিহির ওড়না দিয়ে মুখ বেঁধে সেখান থেকে বের হয়। ঘর থেকে বের হতেই বাইরেই রাম দা দেখতে পায়। নিহি এখন আর নিজের মাঝে নেই। অনন্য রণচণ্ডী রূপ আজ তার মাঝে। সেই রাম দা নিয়েই আমানকে যেদিকে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে সেই ঘরের দিকে যায়।
চোখ বন্ধ অবস্থায় বাঁ দিকে কাৎ হয়ে চোখ বন্ধ করে আছে আমান। ওর হাত-পা’ও রশি দিয়ে চেয়ারের সাথে বেঁধে রাখা। চুলে, কপালে রক্ত জমাট বেঁধে আছে। আর ঐ ছেলেটি আয়েশ করে বসে আছে আমানের চেয়ারের সামনের চেয়ারটিতে। আস্তেধীরে পা ফেলে নিহি এগিয়ে যায়। ছেলেটি কিছু বুঝে ওঠার আগেই কোপ দেয় মাথায়। নিহিকে পাল্টা আঘাত করার পথ প্রথমেই বন্ধ করে নেয়। ইচ্ছেমতো কোপাতে কোপাতে শরীর ছিন্নভিন্ন করে ফেলে। কোপ দিতে দিতে আর কাঁদতে কাঁদতে বলে,
“তুই-ই তো নিরবের পেটে ছুরি ঢুকিয়েছিলি না? তুই তো নিরবকে মেরে ফেলেছিস। তোকে তো আমি ছাড়ব না৷ কোনোভাবেই না।”
দেহ থেকে প্রাণ যেতেই ছেলেটির দপরানো থেমে যায়। ক্ষান্ত হয়ে থামে তখন নিহিও।
আমানের এখনো কোনো হুশ নেই। রক্তে একাকার পুরো ঘর। অনেক রক্ত আমান আর নিহির গায়েও ছিটে গেছে। এরপর রাম দা নিয়ে অনামিকার কাছে ফিরে আসে। নিরবের খুনি তিনি। নিহিকে মেরে ফেলতে চেয়েছে। এমনকি আমানকেও! এই মহিলার বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই। তখনই পেট বরাবর কোপ দেয় তার। গলগল করে রক্ত বের হয় পেট থেকে। বাঁচার জন্য ছটফট করেন। নিহি বলে,
“মৃত্যু আপনার হাতে আমার নয়। আমার হাতে আপনার মৃত্যু ছিল। আপনার মতো ছলনাময়ী, নিকৃষ্ট মহিলার বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই।”
অনামিকা রহমানকে কোপানো অবস্থায় ভেতরে আসে অনল এবং উপমা। লিসার কথায় লিসাকেই ফাঁসিয়ে ওরা সবটা জেনেছে। আর সময় বিলম্ব না করে ছুটে এসেছে। নিজের মাকে খুন করা অবস্থায় নিহিকে দেখে স্তব্ধ হয়ে যায় অনল। কী বলবে,কী করবে, কী করা উচিত তা এখন অনলের মাথায় ঢুকছে না।লিসার মুখে শুনেছে নিজের মায়ের অপকর্মের কথা। তবুও মনের কোথায় যেন একটা হাহাকার! উপমা দৌঁড়ে এসে নিহিকে টেনে সেখান থেকে সরায়। অনল মাথায় হাত দিয়ে ফ্লোরে বসে পড়ে। চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। তখনই কানে ভেসে ওঠে লিসার কথাগুলো। নিজের স্বার্থে তিনি আজমল আহমেদকেও খুন করেছেন। আমান, অনলের বাবা অনামিকার সব সত্যিটা জানতে পেরেছিলেন বলে তাকেও জীবন দিতে হয়েছে। অনল যখন বারবার জানতে চেয়েছিল, আব্বু কোথায় তখন তিনি বলেছেন অফিসের কাজে বাইরে গেছে। ব্যস্ত বলে ফোনও দিতে পারেন না। যেই মহিলা নিজের স্বার্থের জন্য স্বামীকে খুন করতে পারে সেই মহিলা তো নিজের সন্তানদেরও খুন করতে পারবে। তার তো বেঁচে থাকার অধিকার নেই। একদম না!
নিজেকে সামলে নিয়ে উঠে দাঁড়ায় অনল।
নিহিকে জিজ্ঞেস করে,
“ভাইয়া কোথায়?”
নিহি জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। কোনো কথা বলছে না। অনল আবারও জিজ্ঞেস করে,
“ভাইয়া কোথায়?”
নিহি তখন দৌঁড়ে আমানের কাছে যায়। পিছু পিছু উপমা আর অনলও আসে। নিহি হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে আমানকে ডাকে। আমানের কোনো সাড়াশব্দ নেই। অনল নাকের কাছে হাত নিয়ে বলে,
“কিছু হয়নি। প্রাণ আছে। সেন্স নেই ভাইয়ার। তাড়াতাড়ি ভাইয়াকে নিয়ে হাসপাতালে যেতে হবে।”
অনল উপমাকে বলে,
“লিসা বলেছিল পেছনের দিকে একটা দরজা আছে। বাগানের মাঝ দিয়ে যেতে হয়। আমি গাড়ি নিয়ে আমার লোকদের পাঠিয়ে দিচ্ছি। তুমি নিহি আর ভাইয়াকে নিয়ে এখনই যাও।”
“আর আপনি? আপনি তো পুলিশকে ইনফর্ম করবেন বলেছিলেন। করেছিলেন কী? তারা তো তাহলে এখনই চলে আসবে। আপনিও চলুন।”
“না। তোমরা যাও। পুলিশ যেকোনো সময় এসে পড়বে।”
“আসুক!” বলল নিহি।
অশ্রুশিক্ত দৃষ্টি মেলে অনলের দিকে তাকিয়ে আবার বলে,
“আসতে দিন। আমি খুনী। আমার শাস্তি তো হতেই হবে।”
“পাগলামি কোরো না নিহি। আমি লিসার মুখে সব শুনেছি। তোমার ওপর কোনো অভিযোগ রাখব না আমি। প্লিজ চলে যাও।”
“তাহলে আপনিও চলেন। আপনি কেন এখানে থাকবেন?”
“কথা বাড়িও না৷ প্লিজ যাও।”
অনল এর মাঝে একজনকে ফোন করে ভেতরে আনে। তাকে বলে আমানকে কাঁধে করে নিয়ে যেতে। কিন্তু নিহি কিছুতেই যেতে রাজি নয়। সে পুলিশের কাছে নিজের দোষ স্বীকার করতে প্রস্তুত। নিরবের খুনের প্রতিশোধ এবং আমানকে বাঁচাতেই এই খুন করতে হয়েছে নিহির। নিহিকে ওর সিদ্ধান্ত থেকে যখন কোনোভাবেই টলানো যাচ্ছিল না তখন অনল বলে,
“নিহি প্লিজ! তুমি ভাইয়াকে বাঁচাতে খুন করেছো। ভাইয়া এটা জানলে বা তোমার ফাঁসি হলে ভাইয়া বাঁচবে না। যদি ভাইয়াকে মেরেই ফেলতে চাও তাহলে কেন বাঁচালে? আম্মুর হাতে দুজনই মরতে!”
“আপনি আমার কথা বুঝতে…”
“কিচ্ছু বোঝার সময় নেই এখন। যাও!”
“উপমা ওকে নিয়ে যাও প্লিজ!” উপমার দিকে তাকিয়ে বলল অনল।
উপমা নিহিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। নিহি ঝাপসা দৃষ্টিতে পিছনে ফিরে অনলের দিকে তাকায়। অনলের চোখে পানি টলমল করছে। ঠোঁটে মৃদু হাসি৷ সেই হাসি নিহিকে বিষাদিত করছে। বিষাদ! বিষাদ! বিষাদ!
চলবে…
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।]