আয়নামতী পর্ব-০৫

0
411

#আয়নামতী
#পর্ব_৫
#পুষ্পিতা_প্রিমা

নাওয়াজ সাহেবের গর্জনে যেন কেঁপে উঠলো শেখ বাড়ি। তার ছোট ভাই নওফুজ শেখ চোরের মত ভাইয়ের সামনে মাথা নামিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এই দ্বিতীয় বারের মতো ভয়ে ভয়ে বলে উঠলো,

‘ আমি কিছু বলার ও সুযোগ পেলাম না ভাই। তার আগেই আয়ান নাকি চলে গিয়েছে। চাকরি নেবে না বলেছে।

নাওয়াজ শেখ মুখে হাত দিয়ে বসে রইলেন। মেয়ের আদুরে চেহারাখানা ভেসে উঠছে চোখে। সাথে একজোড়া ছলছলে চোখ। কানে যেন এসে বাড়ি খাচ্ছে

‘ তুমি কেন আমায় ভালো থাকতে দিচ্ছ না বাবা? আমার জন্য আয়ানের পরিবারকে ভোগান্তিতে ফেলো না। আমি তাদের খারাপ থাকার কারণ হতে চাই না বাবা।

নাওয়াজ শেখ মুখ থেকে হাত সরালেন। গর্জন ছাড়া তার মুখ দিয়ে শান্ত স্বরে কথা বেরোচ্ছে না। আয়ান চাকরির জন্য এসেছিল, নওফুজকে দেখে চলে যাবে কেন? তারমানে নওফুজ সম্পর্কে খারাপ ধারণা পুষে রেখেছে আয়ান। নাকি নওফুজের কাছে ছোট হয়ে যাবে বলে চাকরি নেই নি। তাদের অবস্থা এই, না খেয়ে থাকবে তবুও কারো কাছে মাথা নোয়াবে না। নাওয়াজ সাহেব ও যেতে পারেন না ওই বাড়িতে। আত্মসম্মানে লাগে। এমনিতে আশেপাশের মানুষের কথার শেষ নেই। তারউপর ওই পাড়ায় গেলে কত কথা! মেয়েকে দেখতে ইচ্ছে হলেও যেতে পারেন না। ফোন করে ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করে নিতে লজ্জা হয়। বাড়ি ফিরে যে মেয়েকে না দেখলে ক্লান্তি দূর হতো না আজ সেই কতদূরে। সেই মেয়ের বাবা ডাক শোনেনা কতদিন। মেজাজ খারাপ তীব্র থেকে তীব্রতর হলো নাওয়াজ সাহেবের।
নামিরার মা নাজমা বেগমের চোখ আধভেজা। মেয়ের কথা উঠলেই তাকে কেঁদে ভাসাতে হয়। মেয়েটা ভালো আছে কিনা কে জানে? ফোন ও তো করতে দেয় না মানুষটা। এ কেমন আত্মসম্মান, যেখানে নিজের মেয়ের শ্বশুরবাড়ি যেতে লজ্জা করে। মা বাবার কাছে সন্তানের চাইতে বড় কিছু হতেই পারেনা। তবে কেন নাওয়াজ শেখ এমন করেন?
নামিরার ভাই ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেবে এই বছর। বোনের জন্য তার ও মন পুড়ে। বাবার কড়া নিষেধ তাই সে বোনকে দেখতে যেতে পারেনা। দুলাভাইকে দেখলো একবার বিশ্ববিদ্যালয়ের ওখানে। নতুন ছাপাখানা দিচ্ছে হয়ত। কিন্তু সে মা বাবাকে বলেনি।

নামিরার চাচার দুই ছেলে। একজন ক্লাস ফাইভে আর একজন ক্লাস এইটে পড়ে। নামিরাকে বড় আপু বলে ডাকে তিনজন। দুইঘরে একটামাত্র মেয়ে হিসেবে বরাবরের মতো আদরের নামিরা। নওফুজ সাহেবের মতে তার ভাতিজী ফালতু ছেলের পাল্লায় পড়ে নষ্ট হয়েছে। ওই ছেলে তার মনমগজ নষ্ট করে দিয়েছে, নাহলে এমন অট্রালিকা ফেলে কেউ ওই কুঁড়েঘরে গিয়ে সংসার পাতে? কতটা নিচুস্তরে চলে গেলে মানুষটা এমনটা করে? ছেলেটার না আছে বংশপদমর্যাদা, না আছে টাকা পয়সা, না আছে তেমন জমিজমা। বসতবাড়ি কামড়ে ধরে রাখা কোনোমতে। নামিরা কি খুঁজে পেল ওই ছেলের মাঝে কে জানে?
ছেলেটার কিছু না থাকা স্বত্বে ও দম্ভের শেষ নেই। তাকে দেখে চাকরি নেবেনা বলে চলে গেল। কত বড় স্পর্ধা! ছেলেটার জন্যেই বড়ভাই তাকে এত কথা শোনালো। সে দেখে নেবে সুযোগ আসলে। বড়লোকের মেয়ে বিয়ে করে দামে উঠেছে ছোটলোকের বাচ্চা। নামিরার নখের যোগ্য ও সে নয়।

____________

আয়না বাগানের ভেতর কাজ করছিল। আয়শা বেগম দাওয়ায় বসে নামিরার মাথায় তেল দিয়ে চুল আঁচড়ে দিচ্ছে। চুল আঁচড়ে দিতে দিতে বলল

‘ মাথায় তেল না দিয়ে থাকো কেমনে বউ? লোকে দেখলে বলবে আমার ছেলে তোমারে তেল ও কিনে দেয় না।

নামিরা অমন কথায় হেসে ফেলল। আয়শা বেগম ধমকে বলল

‘ হাসবানা। তুমি আর ওই বজ্জাত দুটোরে কথা বলে শান্তি পাই না। শুধু গাল এলায়।

নামিরা এবার শব্দহীন হাসলো। আয়না বাগানের ভেতর থেকে জিজ্ঞেস করল,

‘ আম্মা তুমি কি আমাকে বকো?

আয়শা বেগম বললেন

‘ না তোমারে সালাম দিছি। সালাম লওনাই ক্যান?

আয়না হেসে হেসে বলল

‘ ওয়ালাইকুমুস সালাম আম্মা।

রেগে গেল আয়শা বেগম। হাতের চিরুনি ছুঁড়ে মারলেন বাগানের ভেতর। নামিরা হেসে দিল আওয়াজ করে। আয়না পারে ও।
আয়না বাগানে দাঁড়িয়ে হাসতে হাসতে বলল
‘ আম্মা তোমাকে রাগলে কত্ত মিঠা মিঠা লাগে জানো? রাগো কেন? রাগলে তোমারে আমার ঠুক্কুস করে খাই ফেলতে ইচ্ছা করে।

আয়শা বেগম হনহনিয়ে ঘরে চলে গেল। যেতে যেতে আজহার সাহেবকে বলল

‘ এই বান্দরনীরে যেইখানে পারো তাড়াতাড়ি বিয়া দাও।

আজহার সাহেব বললেন

‘ বিয়া দিলে আমাকে এত হাসাবে কে? আমার ঘরটা আঁধার হয়ে যাবে। থাক আমার কাছে। আমার মেয়ে কি কারো ভাত কেড়ে নিচ্ছে?

আয়শা বেগম চলে গেল। বাপ এক সরস, বাপের ঝি এক সরস। কারো থেকে কেউ কম নাহ। নামিরাকে ডাকল আজহার সাহেব।

‘ বউমা বাবু নাপিত কবে পাঠাবে বলছে? চুলগুলো বড় যন্ত্রণা দিচ্ছে আমায়৷

নামিরা বলল
‘ চলে আসবে আব্বা। আর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করুন।

মাটি হাতে আয়না বাগান থেকে ছুটে আসলো। বলল

‘ আব্বা আজ নাপিত কাকু আসলে আমি ও চুল কাটা শিখব।

আজহার সাহেব আর নামিরা একসাথে হেসে উঠলো। আয়না কোমরে হাত দিয়ে বলল

‘ হাসলে কেন দুজন?

নামিরা বলল, না, আমি ভেবেছি তুমি ও চুল কাটব বলবে। কিন্তু তুমি তো চুল কাটা শিখবে বলছো।
আয়না বলল
‘ তুমি বলো, আমি যখন চুল কাটা শিখে যাব, তখন আব্বা আর ভাইয়ার চুল কেটে দিতে পারব। টাকাটা বেঁচে যাবে। আর,,,
নামিরা বলল
‘ আর? বরের চুল ও কেটে দেবে। বরের তাকা বাঁচিয়ে দেবে। তাই না?
আয়না চেঁচিয়ে বলল
‘ আম্মা ঝাঁটা খুজে পাইতেছিনা। তাড়াতাড়ি খুঁজে দাও তো। আমার বাগান পরিষ্কার করতে হবে।
বলতে বলতে প্রস্থান করলো আয়না। আজহার সাহেব নামিরাকে বলল
‘ বিয়ে, বর এসব থেকে সে দূরে থাকতে পারলেই বাঁচে।
নামিরা হাসলো সামান্য।

________________

রজনীগন্ধার সৌরভে বাগান ও বাড়ির আশপাশ সুভাসিত৷ লাল,কমলা,ও হলুদ রঙের গাঁদাফুল ফুটছে। এখনো ছোট ছোট তবে রজনীগন্ধার স্টিকগুলো দ্রুত বেড়েছে। চারমাসের মাথায় এসে পড়লো সময়। আয়না রজনীগন্ধার প্রথম স্টিক কেটে নিজের কাছে রেখে দিল। অনুরাগ তাকে রাখতে বলেছিল প্রথম ফুলটা। পাওনাদারের প্রত্যেকটা আবদার, অভিযোগ শুনতে হয়। রহমত মিয়াকে দেখলে আয়না দিয়ে দেবে। একশটা স্টিক বেঁচার উপযোগী হলো। সেগুলো বাজারের মোড়ে দোকানে নায্যমূল্যে বিক্রি করলো আয়না। তেমন লাভ জোটেনি। প্রথম বিক্রি। তার ধারণা ও নেই তেমন বেচাকেনা নিয়ে। স্টিক কাটার পর আবার পরের স্টিক দ্রুত বাড়ে। এজন্যই বলা হয় রজনীগন্ধায় লাভ বেশি।
পরের বার স্টিক এল এক মাস পেরোতেই। দোকানদার বলেছে স্টিক একটু কচি থাকতে যেন কাটে। তাহলে রজনীগন্ধার মালা দেখতে সুন্দর ও সুগন্ধি হয়। আয়না তাই একটু কচি থাকতেই স্টিক কেটে ফেলল। গাঁদা ফুল ইতোমধ্যে তোলার উপযোগী হয়ে উঠেছে। আয়না রেণুকে নিয়ে ফুল তোলার সমস্ত কাজ করলো। প্যাকিং থেকে শুরু বিক্রি অব্ধি রেণু তাকে সাহায্য করলো। দোকানে পাঠানোর জন্য ভ্যানগাড়ি প্রয়োজন হলো আয়নার। ভ্যানগাড়ির কথা মনে হতেই মনে পড়লো রহমত মিয়ার কথা। রেণুকে দিয়ে রহমত মিয়াকে ডেকে আনলো আয়না। বহুদিন পর রহমত মিয়াকে দেখে আয়না জিজ্ঞেস করল

‘ কি খবর? আপনাকে আজকাল দেখা যায় না কেন?

রহমত মিয়া বলল

‘ আপনি আমার চাকরিডা খাইছেন আপা। এখন কি কামের জন্য ডাকছেন?

আয়না বলল

‘ ফুলের বক্সগুলো দোকানে দিয়ে আসবেন। যাতে কোনোপ্রকার চাপ না পড়ে।

রহমত মিয়া বলল

‘ আইচ্ছা।

আয়না বলল

‘ এখন কি কাজ করেন?

রহমত মিয়া বলল

‘ চায়ের দোকানে কাজ পাইলে করি। নয়ত কামলা। কোনদিন কাজ থাকে, কোনদিন থাকেনা। এই চলতিছে।

আয়না বলল

‘ ওহ। আচ্ছা আপনার যখন কাজ থাকেনা তখন এদিকে আসিয়েন। আমার বাগানটা বড় করব, আর ওই দক্ষিণ পাড়ার দিকে ফজলু কাকু আছে নাহ ওনার বাগানবাড়ি আর বসতবাড়িতে ফুলের বাগান করব। আপনি কি জমিতে চাষ দিতে পারেন? আর চারা রোপণের কাজ?

রহমত মিয়া বলল
‘ হ পারি। আমারে কাজ দিবেন?

আয়না বলল

‘ হ্যা। তবে এখন না। আর ও এক সপ্তাহ পর। আমার সব ফুলগুলো বেঁচার পর হাতে টাকা আসলে, তারপর।

রহমত মিয়া খুশি হলো। বলল

‘ আইচ্ছা আপা। আমি আপনার কাজ করে দিমুনে। আপনি খুশি হয়ে যা দেন।

আয়না বলল

‘ আচ্ছা। আপাতত এই ফুলগুলো দোকানে নিয়ে যান।

রহমত মিয়া মাথা নাড়লো। ফুলের বাক্সগুলো ভ্যানগাড়িতে তুলে নিয়ে গেল। রেণু এসে বলল

‘ আপা আমারে কাল কয়েকটা রজনী দিও। কাল নববর্ষ নাহ? মেলা বেঁচা যাইবো ওই কলেজের গ্যালারির কাছে।

আয়না বলল

‘ কেন?

রেণু বলল

‘ ওখানে অনেক মাইয়্যা আর অনেক পোলা থাকে, ওরা ফুল কিনে নেয় টাকা দিয়া। রজনী ফুল তো সব্বার পছন্দ। তোমার পছন্দ নাহ?

আয়না বলল
‘ ফুল তো সবার পছন্দ।
রেণু বলল
‘ তোমার নাম রজনী হইলে ভালা লাগতো। আমি তোমারে রজনী আপা ডাকিতে পারুম?

আয়না হাসলো। বলল
‘ তোর ভালো লাগলে ডাক।
রেণু বলল
‘ আইচ্ছা। তুমি রাগী হইলেও তোমারে আমার মেলা ভালা লাগে। রাগী মানুষরে অনেকেই চিনতে ভুল করে আমি আর ছোডসাহেব ভুল করিনাই।
আয়না বলল
‘ আচ্ছা বুঝেছি। অনেক পাকা হয়েছিস।
রেণু আবার বলল
‘ আপা তোমারে রজনী দিবো না কাল?
আয়না হাসলো। পড়ে থাকা কিছু গাঁদাফুল কুড়াতে কুড়াতে বলল
‘ কে?
রেণু প্রসঙ্গ পাল্টে বলল
‘ ক্যান? তোমারে কেউ পছন্দ করে না? যে যারে পছন্দ করে সেই তো তারে ফুল দেয়। তুমি ও কাউরে পছন্দ করো না?
আয়না বলল
‘ আমি তো তোকে খুব পছন্দ করি। তোকে দেব। আম্মাকে দেব, আব্বাকে দেব। ভাই আর ভাবিকে দেব। তোর নানাকে দেব।
রেণু যেন রসিকতা করে হেসে ফেলল। আয়না বলল
‘ হাসলি কেন রে?
রেণু বলল
‘ তুমি ছোড মাইয়্যাপোয়াদের মতো কথা কও ক্যান?
আয়না হাসলো। বলল
‘ মাঝেমাঝে তোর মতো ছোট সাজতে ইচ্ছে করে।
রেণু বলল
‘ আইচ্ছা ঠিক আছে। কাল কি রজনী দিবা?
আয়না বলল
‘ নিয়ে যাস। কাল তোকে বিশটা রজনীগন্ধা এমনি এমনি দিলাম।
রেণু খুশি হলো। খুশিতে দুচোখ চকচক করে উঠলো তার। বলল
‘ আপা তোমারে আমি ওই কলেজের মাঠে লইয়্যা যামু। পান্তা ইলিশ খাবা? তুমি একটা লাল পাড়ের সাদা শাড়ি পড়বা। পড়বা না?
আয়না বলল
‘ নাহ। আমি শাড়ি পড়ে হাঁটতে পারিনা। তাছাড়া বোরকা ছাড়া বের হই না আমি। ভালো লাগে না। তুই পড়িস।
রেণু বলল
‘ আমার যে শাড়ি নাই আপা। আমার সাইজ করা শাড়ি কই পামু?
আয়না বলল
‘ চিন্তা নেই। আমার কাছে একটা লাল সাদা ফ্রক আছে। তুই ওইটা পড়িস। ওটা আব্বা আমায় ছোটবেলায় দিয়েছিল যখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ছিলাম তখন। ওটা এখনো আছে। তুই ওটা পড়িস।
রেণু খুশি হয়ে গেল। বলল
‘ তুমি এজন্যই ভালা আপা। দেখবা তোমার বর খুব ভালা হইবো। তোমারে খুব দেখতে পাইবো।
আয়না বলল
‘ এই তোর প্রথম সাময়িক পরীক্ষার রেজাল্ট দিছে? ফেল মারছিস? নাকি পাস করছিস? আমার কাছে পড়তে বলেছিলাম না?
রেণু বিরক্ত হয়ে বলল
‘ তোমারে কইছি এক, তুমি আমারে কও এক।
আয়না হাসলো।

___________

এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ।
তাপসনিশ্বাসবায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে,
বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক॥
যাক পুরাতন স্মৃতি, যাক ভুলে-যাওয়াগীতি,
অশ্রুবাষ্প সুদূরে মিলাক॥
মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা,
অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা।
রসের আবেশরাশি শুষ্ক করি দাও আসি,
আনো আনো আনো তব প্রলয়ের শাঁখ।
মায়ার কুজ্ঝটিজাল যাক দূরে যাক॥ যাক।
এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ। এসো এসো।

পুরোনো বৎসরের সকল গ্লানি,জরা,স্মৃতি সব ধুয়েমুছে নতুন বছরের আগমনে উৎসব উৎসব পরিবেশ গ্রামের প্রতিটা প্রান্তে প্রান্তে।
কলেজের মাঠে বিশাল মেলার আয়োজন। রমনা বটমূল পান্তা ইলিশ, পিঠে পুলি, নাগরদোলা আর ও কত কী!
রাস্তার মোড়ে মোড়ে বসেছে হরেক রকমের দোকানের পসরা। কপালের লাল পট্টিতে শুভ নববর্ষ লিখা রেণুর। গায়ের পড়নে লাল সাদা ফ্রক। রজনীগন্ধা ফুলগুলো সে ডাবল দাম দিয়ে বিক্রি করেছে। রজনী আপার কাছে যদি আর ও থাকে তাহলে সেগুলো এখানে নিয়ে এলে ভালো বেঁচা যাবে। দোকানের চাইতে ও এখানে ভালো টাকায় বেঁচা যাবে। রেণু তাই আয়নাকে গিয়ে বিষয়টস জানালো। আয়না বলল
‘ কে বিক্রি করবে?
রেণু বলল
‘ আমি করুম। আমার সাথে আমার ইস্কুলের বান্ধবী ও আছে। দিয়া দাও সব।
আয়না বলল
‘ আর দেড়শটার মতো আছে। ওগুলো সব বিক্রি করতে হবে।
রেণু বলল
‘ সব বিক্রি কইরা দিমু। আমারে বিশ্বাস করো।
আয়না বলল
‘ আমি তো তোকেই বিশ্বাস করি কিন্তু আজ তোর আনন্দ করার দিন।
রেণু বলল
‘ তো কি হইছে। তোমার ফুল বিক্রি হইলে আমার আনন্দ আর ও দ্বিগুণ বাড়ে আপা। দাও তো।
আয়না সব রজনীগন্ধা দিয়ে দিল।
রেণু বলল
‘ তুমি ও আসো। বোরকা পইড়া আসো। এমনি মেলা দেখবা।
আয়না বলল
‘ যাব? ওখানে যদি বেশি লোক থাকে?
রেণু বলল
‘ মিরা ভাবিরে ও লইয়া আসো। পানিপুরী খাইবা?
আয়না বলল
‘ পানিপুরী?
রেণু বলল
‘ হ। খাইবা?
‘ তুই যাহ। আমি ভাবিকে বলে দেখি। ভাইয়া যেতে বললে যাব।
রেণু ফুল নিয়ে চলে গেল। আয়না নামিরাকে বললে নামিরা ও যেতে রাজী হলো। আয়ানকে জানিয়ে দুজন বের হয়ে গেল। আধঘন্টার পথ সেখানে যাওয়া। রিকশা করে গেলে আর ও তাড়াতাড়ি যাওয়া যায়। বিশ্ববিদ্যালয় চত্ত্বর থেকে শুরু করে কলেজ গেইট পর্যন্ত দোকানের পসরা বসেছে। লাল সাদা শাড়ি আর লাল সাদা পাঞ্জাবি পড়া কপোত-কপোতীরা মাঠে নেমেছে। আয়না কিছুদূর গিয়ে দেখতে পেল রেণুকে। এদিকসেদিক দৌড়ে দৌড়ে মেয়েটা ফুল বিক্রি করছে। নামিরা বলল
‘ আমার কি যে ভালো লাগছে আয়না!
আয়না ও হাসলো। দুজন মিলে পানিপুরী খেল রেণুসহ। হঠাৎ করে নামিরা বলে উঠলো,
‘ আয়না আমি বাড়ি ফিরব।
আয়না বলল
‘ কেন?
নামিরা বলল
‘ হ্যা। ফিরব। তুমি একা একা যেও।
আয়না এদিকওদিক তাকিয়ে দেখলো নামিরার চাচা নওফুজ শেখকে। তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। নামিরা রিকশা নিয়ে চলে গেল উল্টোপথে। আয়না বিরক্তি নিয়ে তাকালো নওফুজ শেখের দিকে। নওফুজ শেখ এগিয়ে এসে বলল
‘ এই মেয়ে তোমার নাকি বিয়ে ভেঙে গেছে? কথাটা কি সত্যি?
আয়না বলল
‘ বিয়ে ভেঙেছে নয়, বিয়ে ভেঙে দিয়েছি।
নওফুজ শেখ বললেন
‘ তোমার ভাই কি করে এখন?
‘ ছাপাখানা দিয়েছে।
নওফুজ শেখ মুখ বিকৃত করে বললেন
‘ ওহহ, দু টাকার ছাপাখানা? অবশ্য তোমাদের দু এক টাকা দিয়ে চলেই যায়। তারউপর বড়লোকের মেয়ে ঘরে তুলেছ, গয়নাগাটি যা পেয়েছ তা কি খাওয়া শেষ?
রাগ উঠলে ও কিচ্ছু বললো না আয়না। নওফুজ শেখ বললেন
‘ ওভাবে কি দেখছ মেয়ে?
আয়না হেসে জবাব দিল।
‘ কোর্ট টাই পড়া বড়লোকের ছদ্মবেশে ছোটলোক দেখছি।
নওফুজ শেখ বললেন,
‘ কি বললে?
আয়না বলল
‘ নিশ্চয়ই শুনতে পেয়েছেন। দ্বিতীয় বার বলতে ইচ্ছে করছে না।
নওফুজ শেখ হনহনিয়ে চলে গেল। আয়না হাসলো।

___________

পথশিশুদের খাবার বিতরণ করা হচ্ছে । দুটো লোকের হাতে বাক্স ধরা। আর সেই বাক্স থেকে প্যাকেট নিয়ে বিতরণ করছে অনুরাগ। রাস্তার একপাশে দাঁড়ানো শায়খ চৌধুরী ও অনিমার স্বামী আশরাফ। মাস তিনেক যেতেই পথশিশুদের খাবার বিতরণ করেম শায়খ চৌধুরী। এই নিয়ম তার আব্বাজানের করা। তিনি মরার সময় বলে গিয়েছেন যাতে পথশিশু আর অসহায় বৃদ্ধ মানুষদের দেখতে। শায়খ চৌধুরী বাবার কথা রাখতেই নিজ ছেলেকে দিয়ে এই কাজটি করান।

বিতরণের একপর্যায়ে এসে ক্লান্ত হলো অনুরাগ। ঘেমে উঠলো কড়া রোদের তেজে।
বোতল থেকে পানি খেয়ে গলা ভিজিয়ে নিল৷ হাঁক ছাড়লো ট্রাকের ড্রাইভারকে। গলার আওয়াজ বড় করে বলল
‘ এই ড্রাইভার গাড়ি এক সাইডে নিন। এভাবে রাস্তার মাঝখানে গাড়ি দাঁড় করালেন কেন? আক্কেল বলতে কি কিছু নাই? আশ্চর্য!
ড্রাইভার বিড়বিড় করল
‘ বাপে কয় একডা। পোলা কয় একডা। মাথা খারাপ কইরা দেয়।
অনুরাগ পানি খেয়ে আবার কাজে লেগে পড়লো। পথশিশুরা খাবার প্যাকেট পেয়ে খুশি হলো।
কিছুক্ষণ পর একজন ছেলে এসে অনুরাগকে বলল
‘ স্যার অনেকগুলো প্যাকেটে ছিঁড়ে নষ্ট হয়ে গিয়েছে।
অনুরাগ কপাল কুঁচকে তাকালো। বলল
‘ তোমরা কোথায় ছিলে ? কতগুলো নষ্ট হয়েছে?
ছেলেটা বলল
‘ বিশটার মতো হবে।
অনুরাগ কপাল ভাঁজ করলো। রাগে কিছু বলতে গিয়ে ও বলল না। অতঃপর বলল
‘ আমার সামনে থেকে যাও। আরেক বোতল পানি নিয়ে এসো দ্রুত। গলা শুকিয়ে যাচ্ছে আমার।
ছেলেটা একদৌড়ে পানি নিয়ে আসলো। অনুরাগের দিকে বাড়িয়ে দিল। অনুরাগ পানি খেতে খেতে তাকালো রাস্তায়। একটা ছোট্ট বাচ্চা মেয়ে ফুল বিক্রি করছে। সাদাশুভ্ররঙের রজনীগন্ধা। অনুরাগ পানি খেয়ে ডাকল মেয়েটিকে। রেণু দৌড়ে এল।
অনুরাগ রেণুর হাতে একটি একটা খাবার প্যাকেট দিয়ে বলল,
‘ এরকম ফুল আর কয়টা আছে?
রেণু ভ্যাবাছাকা খেয়ে বলল
‘ আছে সাহেব, রজনী আপার কাছে। আপনার কি লাগবো?
অনুরাগ বলল
‘ হ্যা। একটা কত টাকা?
রেণু বলল
‘ সিঙ্গেল দশ টাকা, সেমি সিঙ্গেল বিশ টাকা, ডাবল চল্লিশ।
অনুরাগ বলল
‘ কথাগুলো কে মুখস্থ করে দিয়েছে মনে হচ্ছে।
রেণু হেসে বলল
‘ জ্বি সাহেব। রজনী আপা মুখস্থ করায় দিছে।
অনুরাগ বলল
‘ একশটা কত টাকা?
রেণু বলল
‘ আমি হিসাব করতে গেলে পুরোটা দিন চইলা যাইবো। আপনি রজনী আপার কাছে থেইকা জাইনা লন।
অনুরাগ বলল
‘ ডেকে আনো তোমার রজনী আপাকে।
রেণু হাসলো মিটিমিটি। পরে বলল
‘ রজনী আপা আইবো না। আপনারে যাইতে হইবো। এখানে মেলা পুরুষমানুষ। রজনী আপা লজ্জা পায়।
অনুরাগ বলল
‘ কোথায় তোমার রজনী আপা?
রেণু বলল
‘ ওইখানে, ওই যে বোরকা পড়া মাইয়্যাটা আছে।
অনুরাগ পানি আরেক ঢোক খেয়ে যেতে যেতে বলল
‘ দেখি চলো। ফুল কি সব তাজা? তাজা হলেই নেব।
রেণু বলল
‘ এক্কেরে টাটকা ফুল।
অনুরাগ পানি খেতে খেতে এগোলো। রেণু পেছন থেকে ডাক পাড়লো
‘ রজনী আপা সাহেব একশডা ফুল নিবো বলতাছে।
আয়না ফিরলো। বলল
‘ কয়টা?
রেণু হেসেহেসে বলল
‘ একশডা। নাহ সাহেব?
অনুরাগের মুখ থেকে পানির ছিটকে পড়লো। সে কাশতে কাশতে বলল
‘ হ্যা হ্যা একশ, দুশো, একহাজার,দুহাজার, পুরো বাগানটাই।
আয়না রেগে তাকালো রেণুর দিকে। রেণু হাসছে মিটিমিটি। অনুরাগ আর ও ঢকঢক করে পানি খেতে খেতে বলল
‘ রজনী ম্যাডাম আপনার কাছে কি পানির বোতল আছে?
আয়না ঘনঘন মাথা নাড়ালো। অনুরাগ তার গাড়ির কাছে এসে আরেকটা পানির বোতল নিয়ে এল। আয়নার কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে বলল
‘ রজনী ম্যাডাম আপনার পুরো বাগানটাই কিনতে চাই। দাম কত?
আয়না ভুরু কুঁচকে চাইলো। রেণুকে বলল
‘ রেণু আমি বাড়ি ফিরছি হ্যা। তুই তাড়াতাড়ি ফিরিস।
রেণু বলল
‘ আইচ্ছা।
অনুরাগ আয়নার আড়ালে রেণুকে ইশারা করলো। রেণু চলে গেল।
আয়না রেণুকে চলে যেতে দেখে হাঁটা ধরলো। পা বাড়ানোর আগেই বজ্রগম্ভীর কন্ঠস্বর ভেসে এল।
‘ আয়নামতী?
আয়না থমকালো। ফিরলো। অনুরাগ পানি খেতেই থাকলো। আয়না কপাল কুঞ্চন করে ভাবলো
‘ এই অসভ্য লোকের পানি খাওয়ার ঢং দেখে মনে হচ্ছে যেন মদ গিলছে। যত্তসব।
অনুরাগ বলল
‘ আপনার কি তেষ্টা পেয়েছে আয়নামতী? পানি খাবেন?
আয়না বলল
‘ নাহ।
হাসলো অনুরাগ। বলল
‘ দাঁড়ান। আমার প্রচন্ড তেষ্টা পেয়েছে আগে একটু পানি খেয়ে নেই।
আয়না দাঁড়িয়ে থাকলো। অনুরাগের পানি খাওয়া শেষই হচ্ছেনা। আয়নার পায়ে ঝি ঝি ধরে গেল। অনুরাগ একটু একটু পানি খেতে খেতে ভাবলো
‘ আয়নামতী আপনাকে জ্বালাতে আমার এত ভালো লাগে কেন?
আয়না চলে এল, এক মুহূর্ত ও দাঁড়ালো না। অনুরাগ মনে মনে বলল
‘ চারমাস দশদিন পর আপনি আমাকে দেখলেন আয়নামতী। আমি নই। আমি তো রোজ দেখি।

চলবে,
টাইপিং মিসটেক থাকতে পারে।