আয়নামতী পর্ব-২০+২১

0
437

#আয়নামতী
#পর্ব_২০
#পুষ্পিতা_প্রিমা

সন্তান যখন কোলে ফিরে এল। চারপাশটা তখন আপনাআপনি রঙিন হয়ে উঠেছে। সকল দুঃখকষ্ট ঘুচে গেছে এক লহমায়। আজহার সাহেব নিজের চেষ্টায় হাঁটতেন। যখন থেকে হাঁটা বন্ধ করে দিলেন তখন থেকে আর ও অকেজো হয়ে গেলেন। সন্তানকে দেখে ওই অকোজো পা টা যেন বিদ্যুত গতিতে তরতরিয়ে কাঁপা শুরু করে দিয়েছিল। তিনি হেঁটে ছেলের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে চাইলেন। সন্তানের মুখে আব্বা ডাকটা এতটাই মধুর তিনি হুইল চেয়ারে বসে কাঁদলেন একদম বাচ্চা ছেলেদের মতো। আয়শা বেগম তো সেই ছেলের বুকে পড়ে রয়েছেন সেই কখন থেকে। আয়না মায়ের কাছে গিয়ে বলল
‘ সব আদর কি তুমি খাবে আম্মা? আমি কতদিন ভাইয়ের আদর খাইনা। আমার অনেক গল্প জমে আছে তো।
আয়শা বেগম ছাড়লেন না। ছাড়তে চাইলেন না। ছেলের কপালে অসংখ্য স্নেহ,মমতার স্পর্শ দিয়ে জড়িয়ে ধরে রাখলেন বুকের সাথে। কত জমিয়ে রাখা কথা বলে ফেললেন যেন চোখের জল দিয়ে। ছেলে তো তখন নিশ্চুপ। কোমা থেকে ফিরে হাসপাতালের বেডে সে যখন পড়েছিল মাসের পর মাস। যখন চারপাশটা বিষাক্ত লাগতো তার। পাগলের মতো ব্যবহার করতো তখন বোধহয় এই এমন একটা আশ্রয় তার খুব দরকার ছিল। মায়ের হাতটা তার কপালে ঠেকালে বোধহয় সব যন্ত্রণা লাঘব হয়ে যেত। কত কষ্টের দিনগুলো!

মাকে জড়িয়ে ধরে রাখা অবস্থায় যখন আয়না এসে দাঁড়ালো সামনে তখন মুখ অস্ফুটস্বরে বের হলো
‘ টুনি!
সেই মিষ্টি ডাকটা!
পানিভর্তি টলমলে চোখে তাকিয়ে হাসলো আয়না। কান্নার সাথে হাসি। দৃশ্যটা সুন্দর নাহ?
আর কোনো দুঃখই যেন রইলো না আয়নার। ভাই যখন হাত বাড়িয়ে দিয়ে ডাকলো তখন ছোট্টবেলার সেই ছোট্ট আয়নার মতো ঝাপ দিল সে ভাইয়ের বুকে। কাঁদতে কাঁদতে যেন হাসলো। আবার হাসতে হাসতেই কাঁদলো। রূপা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে সুন্দর দৃশ্যখানি। তার নানাভাই ও কি একদিন ফিরবে? কবে ফিরবে? ভালো হয়েছে ভাইজান ফিরেছে নইলে আপার কষ্ট কখনোই মুছতো না। কিন্তু সায়ানের আব্বা এল, আম্মা যে চলে গেল। কি হবে এখন?

নিজের ঘরটাতে যখন গেল আয়ান তখন দেখলো বাচ্চার একটা ছোট্ট গাড়ি পড়ে রয়েছে। একটা সাদাটে রঙের শাড়ি। মাথার ফুল। তার বহুপুরোনো একটা শার্ট। আর কিছু নেই। মানুষটা ও নেই।
অবশ্য থাকার কথা ও নয়। এই যে সে সুস্থ স্বাভাবিক হলো আজ কতগুলো দিন। একবার ও কি তার মায়ের কাছে,বাবার কাছে,বোনের কাছে ফিরতে ইচ্ছে হয়নি? যে তার সব সুখ দুঃখের সাথী, সঙ্গী, অর্ধাঙ্গিনী ছিল তার কাছে ফিরতে ইচ্ছে হয়নি? হয়েছিল তো। সব ছেড়ে ছুঁড়ে সে ফিরতে চেয়েছিল। কিন্তু তার কাছে যে চিঠি গেল নাওয়াজ শেখের কাছ থেকে।

নাওয়াজ শেখ জানতো সে এখনো বেঁচে আছে সেটা আশ্চর্যের বিষয় নয়, আশ্চর্যের বিষয় তো ছিল এটা যে চিঠিতে লেখা ছিল নামিরার বিয়ে হয়ে গিয়েছে। তিনি ভালো পাত্র দেখে নিজের মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। আয়ান যাতে কখনোই আর না ফিরে নামিরার কাছে। তার একটা বাচ্চা ও হয়েছে।
যার সাথে সারাটাজীবন একসাথে পথ চলার কথা ছিল তার এতবড় প্রতারণা কি সহনীয় কিছু? নাকি বিশ্বাস ভেঙে যাওয়ার যন্ত্রণা? প্রচন্ড অভিমান আর জেদের বশে দেখা দিল না সে মা আর বোনকে। কি করে তারা ও এমন করতে পারলো তার সাথে? তবে চুপিচুপি একদিন শেখ বাড়ির কাছাকাছি এসেছিল সে। লাল টকটকে শাড়ি পড়া বাচ্চা কোলের সেই রমণীকে দেখে সেই যে এক বুক ভাঙা যন্ত্রণায় পিষ্ট হলো সে,, শরীরের সব শুকিয়ে আসা ক্ষত যেন তরতাজা হয়ে উঠলো নিমেষেই। ওই চিঠি যদি ভুল হয়ে থাকে তাহলে স্বামী মরে যাওয়ার পর ও গায়ে লাল শাড়ি কেন থাকবে? কোলে বাচ্চা কেন থাকবে? কার বাচ্চা?
সে বুঝেনি সেদিন তাকে হারানোর ব্যাথা ভুলে থাকার জন্যই মেয়েটা সেজেগুজে থাকার চেষ্টা করত। বাচ্চাকে কোলে নিয়ে অপেক্ষা করত বারান্দায় দাঁড়িয়ে প্রিয় স্বামীটার জন্য। যদি কখনো ও ভুল করে হলেও সে ফিরে আসে। তাকে লাল শাড়িতে দেখলে তো খুশি হয়ে যাবে। কে জানতো সব হিতেই বিপরীত হবে। তাকে পাগলের মতো ভালোবাসার মানুষটিকে সে অবিশ্বাস করেছে। নিজের সন্তানকে সে অন্যের সন্তান ভেবে ঘৃণার চোখে চেয়েছে, সবচাইতে বড় যন্ত্রণার বিষয় তো এটিই। সে কিভাবে মিরার সামনে গিয়ে দাঁড়াবে? ঠিক আগের মতো করে মিরা তাকে ভালোবাসবে তো। নাকি আঘাত করেছ বলে দূরে সরে যাবে?

_______________

গোসল করার পর চুল থেকে তোয়ালেটা খোলার আর নামগন্ধ নেই নামিরার। নাজমা বেগম কত করে বলেন কিন্তু শোনেনা নামিরা। নাজমা বেগম আজ ও একদফা ঝাড়লেন নামিরাকে। বাচ্চাটা বুকের দুধ খাচ্ছে, এ সময় মায়েদের অনেক কিছু মেনে চলতে হয়। মায়ের বকবকানি শুনে সায়ানকে কোল থেকে বিছানায় শুইয়ে দিল নামিরা। তোয়ালে খুলতেই পারলোনা। সায়ান চেঁচিয়ে কেঁদে উঠলো। এমনভাবে কাঁদে ছেলেটা যেন তার গলা কেউ টিপে ধরেছে। আবার বুকে তুলে নিল নামিরা। বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে বলল
‘ চুপ।
ধমক পেয়ে আর ও জোরে কাঁদতে লাগলো সায়ান। হাত পা নেড়ে ধস্তাধস্তি লাগালো মায়ের সাথে। উদ্দেশ্য মায়ের কোল থেকে নেমে যাওয়া। নামিরা ধপ করে বিছানায় শুইয়ে দিল। নাজমা বেগম আসলেন। বললেন
‘ তুই কি পাগল হয়ে গেছিস নামিরা? কি করছিস ছেলেটার সাথে?
নাজমা বেগম কোলে নিতে গেলেন। নামিরা কোলে নিয়ে নিল নিজেই। বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে বলল
‘ ও আমার ছেলে৷ কারো এত দরদ দেখাতে হবে না। যাও তুমি।
নাজমা বেগম কপাল কুঁচকে মেয়ের দিকে চাইলেন। তারপর চলে গেলেন। সায়ানের কান্না খানিকটা থেমেছে। ঠোঁট জোড়া গোল গোল করে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। নামিরা জিজ্ঞেস করল
‘ কি হয়েছে?
সায়ান সোহাগা গলায় গোল ঠোঁটজোড়া টেনে আওয়াজ করল
‘ উঃ!
‘ উঃ আবার কি? ব্যাথা?
‘ উঃ!
নামিরা শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো তাকে। চুম্বন বসালো কপালে। বলল
‘ আর বকা দেব না। আর ব্যাথা পেতে হবে না।
সায়ান চুপ করে শুয়ে থাকলো মায়ের বুকে।
নামিরা তোয়ালে ছাড়ানোর জন্য বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। তিন তলার বাড়ি তাদের। দোতলায় থাকে সে। বারান্দা থেকে দেখা যায় বাগান বিলাস,আর ও কত কী ফুল!
সায়ানকে একহাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রেখে তোয়ালে খুললো সে চুল থেকে। ভেজা চুল লাফ দিয়ে পড়লো কোমর অব্দি। সায়ানের মুখে পড়ার সাথে সাথে চেঁচিয়ে উঠলো সে। নামিরা সরিয়ে বলল
‘ কিছু পড়া যাবেনা তার মুখে। অসভ্য।
সায়ান বলে উঠলো
‘ উঃ।
নামিরা ধমকে বলল
‘ চুপ।
কথা বলতে বলতে চোখ গেল গেইটের কাছে। কে ঢুকছে এই দিন দুপুরে?
কোন আগন্তুক?
নামিরা ভালো করে দেখলো সেই আগন্তুককে। দারোয়ানকে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করলো দারোয়ান গেইট বন্ধ করো। কাউকে ঢুকতে দিওনা। কিন্তু বলা সম্ভব হলো না। ছেলেকে আর ও শক্ত বাঁধনে জড়িয়ে ধরলো সে। চোখের কোণা জ্বলজ্বল করে উঠলো কেন জানি। দমবন্ধ লাগলো। হাঁসফাঁস লাগলো। বুকে ফেটে কান্নারা বেরিয়ে আসতে চাইলো। কিছুই হলোনা, শুধু নীরবে গালটা ভিজে উঠলো মুহূর্তেই। বেশ সংকোচ নিয়ে আগানো ছেলেটা সেই সময় তাকালো এদিকে। চোখাচোখি হয়ে পড়ায় চরম অস্বস্তি লাগলো দু’জনেরই। কেউ মুখ ফিরিয়ে নিল ঘৃণায়,কেউ লজ্জায়। ছেলেকে শক্ত করে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরলো নামিরা। এই ছেলে তার একান্ত। আর কারো না। তার ছেলের দিকে যে অবিশ্বাস্য চোখে তাকায় সে কখনোই তার স্বামী নয়। সে কি চাহনী দেখে বুঝতে পারেনি তখন? দেড়টা বছরের ব্যবধানে কি মানুষ অতটা পাল্টে যেতে পারে কখনো?
একরাশ অভিযোগ নিয়ে নামিরা তার দিকে তাকিয়ে থাকা মানুষটার দিকে তাকালো। এই আকুতিভরা চাহনিটা তাকে দুর্বল করতে যথেষ্ট। তাই পিঠ করে দাঁড়ালো সে। বোবাকান্নার টুপটাপ নোনাজলের ফোঁটা ছেলের মুখের উপর গিয়ে পড়লো। তারপর দ্রুতপায়ে চলে এল ঘরে। সেই আদর মেশানো গলায় পরিচিত ডাকটি ভেসে এল কানে। এই প্রথমবার নামিরা অগ্রাহ্য করলো। অথচ কতগুলো প্রহর গুনেছে সে এই একটি ডাক একবার শোনার জন্য। আজ বহু প্রতীক্ষার পর শুনলো তবে ভুল সময়ে।

_____________

শুকনো মুখে ছেলেকে বাড়ি ফিরতে দেখলো আয়শা বেগম। আয়না তো পুরো ঘরটা নতুন করে সাজিয়েছে। কত রকমের রান্না করা হয়েছে। সায়ান আসবে। কত খুশির দিন!
কিন্তু ভাইকে খালি হাতে ফিরতে দেখে চোখজোড়া ছলছল করে উঠলো আয়নার। সায়ান কোথায়? ভাবি?
আয়ান এসে বসলো বারান্দায় রাখা চেয়ারে। আয়শা বেগম পানির গ্লাস হাতে ছুটে গেলেন। ছেলের মুখ কপাল ছুঁয়ে বললেন
‘ কি হয়েছে রে আব্বা? শরীর খারাপ? মাথা ঘুরছে? সেলাইয়ের জায়গায় ব্যাথা করছে। মাথা ব্যাথা করছে। ওই ডাক্তার মেয়েটাকে কি কল করব?
মায়ের দিকে হতাশ চোখে তাকালো আয়ান। বেশ খানিক্ষন চেয়ে থেকে টেনে আনলো মাকে। চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে মাথা রাখলো মায়ের কোলে। মায়ের হাত যখন তার মাথায় বিলি কাটতে ব্যস্ত তখন আয়ান বলে উঠলো

‘ সায়ানের কত বছর হলো আম্মা?

‘ বছর কোথায়? এখনো বছর হয়নি তো। নয় মাস কি আট মাস চলছে। এইদিনই তো খাবার মুখে দিলাম।

‘ আমি কি অভাগা আম্মা। নিজের ছেলের বয়স কত সেটা ও জানিনা। সেজন্যই বোধহয় মিরা আমাকে ঘৃণা করে।

আয়শা বেগম হাত বুলালেন ছেলের কপালে। চুলের উপর আদর করে বললেন

‘ এমন করে বলছিস কেন আব্বা? সব ঠিক হয়ে যাবে। বউ কি তোর সাথে কথা বলেনি? বলবেই বা কেন? আমরা তো কেউ তার কথা কানে নেইনি। ভেবেছিলাম পাগলামি করছে।

আয়ান মাথা তুললো। বলল

‘ আমি কি পাল্টে গেছি আম্মা? নাকি মিরা পাল্টে গেছে? আমার সব কেমন কেমন লাগছে।

আয়শা বেগম হাসে। বলেন

‘ আমি গিয়া নিয়া আসি বউরে। তোর সাথে রাগ করছে আর কি। তুই ওরে কত কষ্ট দিলি। এখন ও তোরে কষ্ট দিতেছে।

আয়ান বলল

‘ ও তোমার সাথে আসবে?

‘ আসবো না ক্যান? আসবো। আমি বিকালবেলা একবার যামু, নিয়া আসুম আমার বউরে।

‘ যদি না আসে?

আয়শা বেগম হেসে ফেলেন। বলেন

‘ না আসিলে আর কি? তোরে আরেকডা বিয়া করামু।

আয়ান মায়ের কোলে আবার মাথা রেখে ডেকে উঠলো

‘ আম্মা।

খলবলিয়ে হাসেন আয়শা বেগম। আয়না আর রূপা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে হাসে। রূপা খুশিতে বাকুমবাকুম হয়ে বলে উঠে

‘ জেম্মা আমি ও তোমার লগে যাব।

আয়না মাথায় চাটি মেরে বলল

‘ আবার ওসব কথা বলা শুরু করেছিস?

‘ আর কমু না।

আয়না আর ও জোটে চড় মারলো মাথায়। রূপা মাথা ঢলতে ঢলতে বলল

‘ আর বলব না কইছি তো।

আয়না বেত খুঁজতে গেল। দৌড়ে পালালো রূপা।

______________

দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে না হতেই আয়শা বেগমের উপস্থিতি দেখে ভড়কালো না নামিরা। খুশি হলোনা, বেজার ও হলো না। আয়শা বেগম সায়ানকে কোলে নিয়ে আদর করলেন। নামিরা তখন ঘর গোছার কাজে ব্যস্ত। আয়শা বেগম খাটের উপর বসে নাতির সাথে খেলতে খেলতে বললেন

‘ ভাই আমি তো তোরে নিয়া যাইতে আসিনাই। তোর বাপরে আরেকটা বিয়া করামু তার লগে দাওয়াত করতে আইছি। তুই কি যাবি তোর বাপের বিয়া খাইতে? নাহ তুই তো যাইতে পারবিনা তারজন্য তোর মায়ের যাওয়া লাগবো। কিন্তু তোর মা তো যাইবো না।

সায়ান ঠোঁট গোল করে বলল
‘ উঃ।
আয়শা বেগম চুমু খেয়ে বললেন
‘ গু। ছেহঃ।
সায়ান খিলখিলিয়ে হাসে। নামিরা কোন একটা কাজ করতে গিয়ে থেমে থাকে। আবার কাজে মনোযোগ দেয়।
আয়শা বেগম আঁড়চোখে তাকে পরখ করছে। তারপর বলল
‘ শোনো সায়ানের আম্মা তোমার জামাই আরেকডা বিয়া করবে তো তুমি যদি অনুমতি না দাও কেমনে বিয়া করবো?

‘ কে বারণ করেছে বিয়ে করতে? একশটা বিয়ে করান। আমার কি?

আয়শা বেগম শব্দহীন হাসেন। বলেন

‘ ওহ আইচ্ছা। ঠিক আছে, তো আমি আর বইসা আছি ক্যান? চইলা যাই। কত কাজ আমার।

নামিরা ধুপধাপ জিনিস রাখতে শুরু করলো। নাজমা বেগম আসলেন নাশতার প্লেট হাতে নিয়ে হাসিখুশি মুখে। বললেন

‘ জায়নামাজে বসে আমি কতবার শুকরিয়া করলাম আল্লাহর দরবারে। আল্লাহ মুখ ফিরে চাইছে। আমার কি যে খুশি লাগতেছে আপা। নামিরার আব্বা ঠিকই বলছে, ওই পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট আয়ানের ছিল না।

নামিরা বলল

‘ মা থাক ওসব কথা। আম্মাকে প্লেট তুলে দাও।

আয়শা বেগম গাল ফুলিয়ে বললেন

‘ কে আম্মা? কার আম্মা? আয়ান আর আয়না ছাড়া আমি আর কারো আম্মা না। কেউ যেন আমারে আম্মা না ডাকে।

নামিরা চোখ জ্বলে উঠলো। সায়ানকে নিয়ে নেওয়ার জন্য গেল। আয়শা বেগম সায়ানকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে বলল

‘ আমার নাতি।

নামিরা হনহনিয়ে চলে গেল।
নাজমা বেগম বললেন

‘ এই মেয়ে আবার কি শুরু করছে কে জানে?

আয়শা বেগম মিটিমিটি হেসে বললেন

‘ বয়সটাই রাগারাগির। মান অভিমানের। এগুলা ছাড়া কি সংসার হয় নাকি? তারা ঠিক করে নেবে সব।

নাজমা বেগম হাসলেন। বললেন
‘ আচ্ছা আমি ওকে তৈরি হতে বলছি। আয়ানকে পাঠাবেন এখানে, ছেলেটাকে একটু মন ভরে দেখব।

আয়শা বেগম বলল

‘ আইচ্ছা। বউরে একটু তাড়াতাড়ি করতে কন। আমার ভাইডারে আমি রাত নামার আগে ঘরে ঢুকাই। নইলে খারাপ বাতাস টাতাস লাগবো। দিনকাল ভালা না।

_______________

মাগরিবের আযান পড়া শেষ হয়েছে। বাড়ি পৌঁছে আয়শা বেগম নামাজে বসলেন। আয়না রূপাকে সাথে নিয়ে নামাজ পড়ে উঠে ছুটলো সায়ানের কাছে। খ্যা খু আওয়াজ করে সে জানান দিচ্ছে তার উপস্থিতি। আয়না আদরে আদরে ভরিয়ে দিল। রূপা বলল
‘ ধুরর আমি আদর করবার পারিনা ধলা মিয়ারে। চিল্লাইতে থাকে। আমার চুলগুলা টানতে টানতে ছেঁড়ার অবস্থা।

আয়না খিলখিল করে হাসে। বলে
‘ আব্বা তুমি রূপা ফিপির সব চুল ছিঁড়ে ফেলবা। ডাব বানায় ফেলবা পুরা মাথা। কেমন?

সায়ান হেসে আওয়াজ করলো
‘ আম,মাম,মামমা।
আয়না নাকের ডগায় চুমু বসায়। নামিরার দিকে আঁড়চোখে তাকায়। তারপর জিজ্ঞেস করে
‘ আব্বার কাছে যাবে? চলো।
নামিরা বলল
‘ কোথাও যাবে না ও। আমার ছেলে।
আয়না কোলে তুলে নিল। বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে বলল
‘ আমার আব্বা,কলিজা।
বলেই নিয়ে গেল আয়না।
আজহার সাহেবকে ডেকে বলল
‘ আব্বা দেখে যাও, আমার আরেক আব্বা চলে আসছে। আমার দুইটা আব্বা।
সায়ান হাত বাড়িয়ে শক্ত করে ধরলো আয়নার চুল। আয়না চেঁচিয়ে বলে উঠলো
‘ ও আল্লাহ আমার চুল শেষ। শেষ।
এত জোরে চিল্লানোর আওয়াজ শুনে সায়ান ঠোঁট টেনে কেঁদে উঠলো।
আয়না বলল
‘ ওমা আপনাকে কে বকছে আবার? চুল ধরলেন আর আমি চিল্লাইতে পারব না?
সায়ান আর ও জোরে চুল টেনে ধরে।

বাচ্চার কান্নার আওয়াজ শুনে বাড়ির পেছনের দিকটাই দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটির তর সইলো না। কিন্তু লজ্জা আর আড়ষ্টতায় আসা হলো না। কিন্তু রাতে যখন চুপিসারে বাড়িতে ঢুকলো। তখন দাদুর কোলে হাত পা নেড়ে খেলা করা হৃষ্টপুষ্ট শিশুটিকে দেখে মনপ্রাণ প্রশান্তিতে ছেয়ে গেল। পা বাড়াতে গিয়ে পা জোড়া কাঁপলো ঠকঠক করে। হাত কাঁপলো ছোঁয়ার আগে অথচ এর আগে আর ও একবার কোলে নেওয়া হয়েছিল। তখন তো আর জানতো না এই সন্তান তারই?
আয়শা বেগম বলল
‘ শক্ত করে ধর আব্বা। পড়ে যাবে।
আয়ান কোলে তুলে বলে
‘ এত নরম কেন আম্মা? আমরা ও কি এমন ছিলাম?
‘ নাহ এতবড় হয়ে দুনিয়াতে আসছ। যখন জন্ম নিলা তখন ইঁদুরের বাচ্চার মত ওই একটুখানি। কত আদরযত্ন ভালোবাসা দিয়ে এতবড় করছি।
আয়ান ছেলেকে নিয়ে বের হয়ে যায় ঘরে থেকে। ছোট্ট মুখটা ভরিয়ে দেয় অজস্র আদরে। স্নেহ,মমতার স্পর্শ পেয়ে ছেলে পিটপিট করে তাকিয়ে থাকে বাবার দিকে। বুকের কাছে শার্ট খামচে ধরে ছোট্ট হাতটা দিয়ে। মাথার চুল টেনে ধরে মুখে দিতে চায় চুলগুলো। আয়ান হেসে ফেলে
‘ আম্মা কি খেতে দেয়নি? উপোস রেখেছে?
সায়ান ঠোঁট টানে।
আয়ান বলল
‘ আচ্ছা ঠিক আছে আর কখনো এমন বলব না। তোমার আম্মা খুব ভালো। খুব।
সায়ান ডাগর ডাগর চোখ দুটো মেলে তাকিয়ে থাকে।

___________

রাতের খাওয়া দাওয়া তখন শেষ। নামিরা নিজ হাতে সবাইকে বেড়ে খাওয়ালো। মুখে কথা নেই চুপচাপ। আজহার সাহেবের সাথে কথা বললো শুধু। আর কারো সাথে বললো না। আজহার সাহেব খেতে খেতে বললেন
‘ বউমার হাতের রান্না অনেকদিন তো খাই না। কাল তোমার হাতের রান্না খাব বউমা।
নামিরা বলল
‘ ঠিক আছে আব্বা। কাল আমি রান্না করব।
আয়শা বেগম ফিসফিস করে আয়নাকে বলেন
‘ শ্বশুরের লগে তো ভালোই কথা কয়। আমাদের লগে কয় না ক্যান?
আয়না ও ফিসফিস করে বলে
‘ আমরা তো ভাইয়ের পক্ষে তাই।

নামিরা খেল না। আয়না বলল
‘ তুমি ও বসো ভাবি।
নামিরা না করলো। সে খাবে না।
আয়না বলল
‘ আর তো কেউ নেই। তুমি একা একা কিভাবে খাবে? আরেকজন তো বাইরে খাবে। দাওয়াত পড়েছে।
নামিরা গ্লাসে পানি ঢালতে লাগলো।
আজহার সাহেব ও বললেন
‘ বউমা আমার পাশে এসে বসো। খেয়ে নাও। অনেকদিন হাসো না। এইবার একটু হেসো। মুখটা অমন দেখতে ভালা লাগেনা।
নামিরা গিয়ে বসলো শ্বশুরের পাশে। আজহার সাহেব নিজে বেড়ে দিলেন খাবার। মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন
‘ খাও। কিভাবে শুকিয়েছ দেখো।
এত স্নেহময়,আর আদুরে সম্বোধনে গাল ভিজে উঠলো নামিরার। সবাই দেখার আগেই নামিরা তা লুকোতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। এই স্বর্গসুখ যেন আর কখনোই না হারায় তার জীবন থেকে। এই পরিবারটাকে সে ভালোবাসে। পরিবারের মানুষগুলোর সাথে তার এই অদৃশ্য বন্ধনটা খুব দৃঢ় মজবুত। ভালো থাকুক তার আপন মানুষগুলো। এরকম হাসিখুশি থাকুক সবসময়।

__________

রাত তখন দেড়টা। সামনের দরজায় ঠকঠক আওয়াজে ঘুম ছুটে গেল নামিরার। অবশ্য ঘুম তেমন নামেনি তার চোখে। তাই হয়ত অল্পতেই ছুটে গেছে। দরজা খুলে দিতে গেল সে। কে সেটা দেখার প্রয়োজনবোধ করলো না। দরজা খুলে দেওয়া মাত্র চলে এল ঘরে। সায়ানকে দোলনায় দুলাতে লাগলো হালকা হালকা।
দরজা পার হয়ে ঘরে তখুনি প্রবেশ করলো সুঠাম দেহের একটি অবয়ব। নামিরার কৌতূহল জাগলো না ফিরে দেখার। সে তো এড়িয়ে যেতে ব্যস্ত। দোলনা দুলিয়ে উঠে বসলো। সায়ানের ছোট ছোট কাপড়গুলো ব্যাগ থেকে বের করে গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। গোছাতেই পারলো না ঘরের লাইট নিভে গেল। বিরক্তিতে মেজাজ চরম খারাপ হলো নামিরার। সুইচের দিকে যাওয়া ও যাবেনা। মিনিট দুয়েক অপেক্ষা করলো নামিরা। অন্ধকারে কিছু দেখা যাচ্ছেনা। শুধু শোনা যাচ্ছে নিঃশ্বাসের শব্দ। মুখ খুলতে চাইলো নামিরা, খুললো না তবে। ধপাধপ আন্দাজে হেঁটে গেল সুইচ টিপার জন্য। শক্তপোক্ত হাতের বাঁধনে তখুনি বন্দী হলো সে। পেছন থেকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে কাঁধে নাকমুখ গুঁজলো কেউ। শক্ত হয়ে জমে গেল নামিরা৷ সেই পুরোনো ছোঁয়া৷ উদরের উপর টের পেল দুহাতের শক্ত বাঁধন। শীতল হয়ে পড়লো নামিরা। হাত দুটোকে ঝেড়ে ফেলতে চেয়ে পারলো না। কোনো শব্দ ছাড়াই কেটে গেল কয়েকটা মুহূর্ত।

সুযোগ বুঝে যখন নামিরা পালাতে চাইলো তখন আর ও ভালোভাবে বক্ষমাঝে পিষ্ট হয়ে গেল সে। সেই ঘ্রান আর সেই বুকের হৃৎস্পন্দন। সেই হাতের বাঁধন। নামিরার পালানোর কোনো পথই খোলা রইলো না। ফোঁসফোঁস করতে করতে একসময় ফোঁপানি উঠলো তার। তারপর সারাশরীর ঝাঁকিয়ে কাঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো সে। সেই কান্না যেন থামার নয়। তাকে কাঁদতে দিল আয়ান। বাঁধা দিল না। আজ শেষবার কেঁদে নিক৷ নামিরা কাঁদলো ইচ্ছেমত৷ নেতিয়ে পড়লো বুকে ক্লান্ত হয়ে। আয়ান জড়িয়ে নিল তাকে।
বহুসময় পার হওয়ার পর চোখের জল মুছে দিয়ে দীর্ঘ চুম্বন বসালো সে সঙ্গিনীর কপালে, সারা মুখে। ভেজা স্পর্শে রাঙিয়ে দিয়ে আবার ও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল
‘ তুমি তো বাচ্চাই রয়ে গেলে মিরা। বড় হলে কই? তবে এই বাচ্চার মা বাচ্চাটাকে আমি ভীষণরকম ভালোবাসি। আমার উপর থেকে সমস্ত অভিযোগ তুলে নাও মিরা।

চলবে
রিচেক করা হয়নি

#আয়নামতী
#পর্ব_২১
#পুষ্পিতা_প্রিমা

আয়শা বেগম এতদিন শুনে এসেছেন মেয়ের ইয়া বড় বিশাল একটা বাগান আছে। হ্যান আছে, ত্যান আছে। কিন্তু দুচোখে একবারও দেখেননি। এই প্রথমবার দেখামাত্রই চোখ কপালে উঠলো ওনার। আয়না ভুরু উঁচিয়ে মাকে বলল

‘ সুন্দর নাহ আম্মা?

আয়শা বেগম হা করা মুখ বন্ধ করলেন। গালে হাত দিয়ে বললেন

‘ ওমা, মেলা বড় এই বাগানবাড়ি। এইটা তোর?

আয়না বলল

‘ হ্যা। ওই যে দেয়াল দেখছ ইটের। ওইটুকু পর্যন্ত কাকুর জমির সীমানা। যা রূপার নামে দিয়ে গেছেন। ওতটুকু পর্যন্ত যদি বাগান করে ফেলি তাহলে কতবড় হবে ভাবতে পারছো আম্মা?

আয়শা বেগম বলল

‘ হ, অনেক বড়। অনেক মানুষ কাম করে নাহ?

‘ হ্যা, আমি কি একা পারব নাকি? এবার থেকে ফুল আর কোথাও যাবে না আম্মা। ওই দোকানেই ফুল বিক্রি হবে এবার। পাইকারি বিক্রি করব৷ ফুল বিক্রেতারা এসে কিনে নিয়ে যাবে। সুলভ মূল্যে বেঁচতে পারব।

আয়শা বেগম বিস্ময় কাটিয়ে উঠে বলেন

‘ এখন বুঝছি সংসারে টাকা কোত্থেকে দিতি তুই। আল্লাহ অনেক বড় করুক৷ ওই ছোট্ট হাতে করা এত বড় বাগান। আল্লাহ আমার তো এখনো বিশ্বাস করবার মন চাইতেছে না।

আয়না হেসে ফেলল। বলল

‘ আমার হাত কি ছোট আম্মা?
‘ হ ছোডই তো। এইদিন হলো তুই হলি। কত খুশি হলো তোর বাপ ভাই। বাবু তো খুশিতে একসপ্তাহ স্কুল কামাই করলো৷ পড়ালেখা বাদ দিয়া টুনি টুনি করে পাগল হলো।

আয়না শুনে হাসতে লাগলো। শেষে বলল,
‘ ভাইয়া ভাবি কোথায়? বাবু কার কাছে?

আয়শা বেগম এদিকওদিক চোখ বুলালেন। দূরে আঙুল দেখিয়ে বললেন

‘ ওই তো রূপুর কাছে৷ কোল থেকে পড়ে গেলে শেষ আমার ভাই৷ ওরে কে কোলে দিছে?

আয়না গিয়ে কোলে নিয়ে নিল সায়ানকে। রূপা গাল ফুলিয়ে বলল

‘ থাকুক না আমার কাছে।

সায়ান ও হাত পা নেড়ে কেঁদে উঠলো। আয়না আবার দিয়ে দিল রূপার কোলে। ছোট্ট গাল দুটো দু আঙুল দিয়ে টিপে দিয়ে বলল

‘ বাব্বা এখন রূপাকে মনে ধরেছে পঁচা ছেলে?

সায়ান কি বুঝলো কে জানে? কান্না থামিয়ে দন্তহীন গালে হাসলো। আয়না বলল
‘ কি সুন্দর করে হাসে আব্বা?
সায়ান হাসতেই থাকলো৷ রূপা বলল
‘ পুরা পাগল৷ এমনি এমনি হাসে৷ এমনি এমনি কাঁদে।
আয়না চুমু দিল সায়ানের দু গালে। নাক টেনে দিয়ে বলল
‘ আমাল আব্বা চুন্দল। গুলুমুলু।
সায়ান খেউমেউ করে মেতে উঠলো। আয়না বলল
‘ ধুর পাজি ছেলে খেউ মেউ ছাড়া কিছু বলতে জানেনা।

____________

বাগান থেকে একটি জারবেরা ছিঁড়ে নিল আয়ান। নামিরার কানে গুঁজে দিল।
নামিরার ঠোঁটের কোণায় এক চিলতে হাসি। ফুলটা হাত দিয়ে ছুঁয়ে বলল
‘ বাগানের মালিনী তো রাগ করবে ফুল ছিঁড়েছ দেখলে। এটা ভালো হয়নি শ্বশুরের ছেলে।
আয়ান একগাল হাসলো। বলল
‘ মালিনী তোমার শ্বশুরের মেয়ে। সো চাপ নেওয়ার দরকার নেই।
নামিরা আবার ও হাসলো। হাত দুটো বাড়িয়ে শক্ত করে ধরলো আয়ানকে। বুকে মাথা ঠেকিয়ে চুপ করে রইলো অনেক্ক্ষণ। তারপর মাথা তুলে এদিকওদিক তাকিয়ে বলল
‘ কেউ দেখেনি তো?
আয়ান হেসে ফেলে বলল
‘ দেখেছে হয়ত। দেখুক সমস্যা কি? আমরা কি লুকিয়ে প্রেম করছি নাকি? যে ধরা পড়ার ভয় থাকবে?
নামিরা আলতো করে হাত চাপড়ে দিল বুকে৷ বলল
‘ যেতে দাও। আম্মা ডাকবে।
‘ ডাকেনি এখনো৷
বলেই আয়ান মুখ নিয়ে গেল ওই কানে গুঁজে দেওয়া ফুলের কাছে৷ গন্ধ শুঁকে বলল
‘ এই ফুলের চাইতে আমার তুমিটা বেশি সুবাস মিরা।
নামিরা একদম নতুন প্রেমে পড়া প্রেমিকার মতো লজ্জায় রাঙা হলো। আয়ান তার রাঙা মুখখানা দেখে উচ্চস্বরে হেসে উঠলো।
নামিরা নাকফুলিয়ে বলল
‘ ধ্যাত।

********

দুপুরের ঠা ঠা রোদ। উঠোনে রোদ এসে পড়েছে। আয়শা বেগম সায়ানকে রোদে বসিয়েছেন যাতে একটু রোদ গায়ে লাগে। সরিষার তেল ফর্সা পিঠটাতে মালিশ করেছেন। রোদ পড়ায় চকচক করছে পিঠ। আজহার সাহেব কোনোমতে খুঁড়িয়ে হেঁটে উঠোনে পা রাখলেন। সাদা চটের উপর নাতিকে বসে থাকতে দেখে বললেন
‘ ওরে একটা জামা পড়ায় দাও। উদাম রাখছো কেন?
আয়শা বেগম কোলে নিয়ে নিলেন। সায়ান দাদুর মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসাসূচক শব্দ করে
‘ এঃ?
আয়শা বেগম কোলে তুলে নেন। উঠোন থেকে বাড়িতে পা রাখার আগেই গাড়ির হর্নের আওয়াজ শোনা যায় বাইরে। আয়না আর নামিরা বের হয়ে আসে। গাড়িটা এসে থামে উঠোনে। সাদা খয়েরী মিশেল রঙের সেলোয়ার কামিজ আর মাথায় ওড়না পরিহিত একটা অল্পবয়স্কা মেয়ে বেরিয়ে আসে। সাথে একজন মধ্যবয়স্কা আর মধ্যবয়স্ক পুরুষ।
আয়না খুশি হয়। নামিরা তাকিয়ে রইলো।
আয়না এসে সালাম করলো সেলিনা বেগম আর আমিন সাহেবকে। হীরাকে বলল
‘ কেমন আছেন আপু? ভাইয়া এক্ষুনি বের হয়েছে। পইপই করে বলে গিয়েছে আপনারা আসবেন তা যেন মাথায় রাখি।
হীরা হাসলো। আয়শা বেগমের পা ছুঁয়ে সালাম করলো। আজহার সাহেবকে করতে গেলে তিনি মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন
‘ অনেক বছর বেঁচে থাকো।
হীরা নামিরার দিকে তাকালো। নামিরা ঘরে চলে গেল। হীরার চেহারাটা খানিকটা নিভে গেল। আয়না দৌড়ে গিয়ে দাঁড়ালো হীরার পাশে। বলল
‘ আপু ঘরে আসেন। আঙ্কেল আন্টি আপনারা ও আসেন। ভাইয়া এক্ষুণি চলে আসবে।
হীরা মা বাবাকে যেতে বলল। সায়ানের দিকে তাকিয়ে হাত বাড়িয়ে দিল। বলল
‘ কেমন আছেন সায়ান বাবু?
সায়ান দাঁত খেলিয়ে হাসলো। হীরা কোলে নিয়ে বলল
‘ ওরেবাবা চিনতে পেরেছে আন্টিকে।
নামিরা কোথা থেকে যেন এল। সায়ানকে কোলে নিয়ে ফেলল। আয়শা বেগমদের দিকে তাকিয়ে বলল
‘ ওর খাওয়ার সময় হয়ে গেছে।
আয়শা বেগম হাসলো হীরার সাথে। মাথায় হাত বুলিয়ে বলল
‘ আসো আম্মা তোমার সাথে কথা কয়। আমার বাবুটারে বাঁচাইছো তুমি।
হীরা বলল
‘ আমি বাঁচাইনি। উপরওয়ালার বাঁচিয়েছেন। আমি তো শুধু উছিলা। অর্ক কোথায় গেছেন?
‘ অর্ক?
হীরা বলল
‘ ওই মানে আপনার ছেলে, আয়ান। ওনাকে তো আমরা অর্কই ডাকি। আগের নামটা তো জানতাম না।
‘ ওই বাজারে গেছে। অনেকদিন পর বাজারে গেল। কে জানে কি করে?
হীরা এদিকওদিক তাকিয়ে চারপাশটা দেখলো। ইট,কাঠ,টিনের ঘর। রুমগুলো আসবাবপত্রে ঠাঁসা। গোছানো। অনেক সুন্দর। হীরা বলল
‘ আঙ্কেল আগে কি করতেন?
‘ পেঁয়াজ রসুনের ব্যবসা করতো। এখন তো কিছুই পারেনা। মেয়েটাই সব সামলায়। বাবু হারানোর পর তো মেয়েটাই সব দায়ভার নিল। বাগান আছে। ওখান থেকেই পয়সা আসে তা দিয়ে যা হয় আর কি। বাবু চাকরির খোঁজ লাগাবো এইবার। আগের বার তো ছাপাখানা দিল কিছুর কিছুই হলোনা। আমার বাবুটা কত দুঃখ পেল।
চোখে ভিজে আসলো আয়শা বেগমের। হীরা বলল
‘ কাঁদবেন না আন্টি। আর অর্ককে চাকরি খুঁজতে হবে কেন? বাবা তো বলেছে আমাদের কোম্পানিতে সিনিয়র ম্যানাজার পদে ঢুকতে। উনি তো অনেককিছু পারেন, ভালো গ্রাফিক্স ডিজাইন পারেন,অফিসিয়াল সমস্ত কাজ বুঝেন। আমার বাবার একজন বিশ্বস্ত মানুষ দরকার। অর্ক কথাও দিয়েছিল, উনি কখনো বাবার কথা কখনো অমান্য করবেন না।
আয়শা বেগম বলল
‘ ওখানে মারপিট হয়?
হীরা হেসে বলল
‘ নাহ নাহ। মারপিট কেন হবে? একদম নিশ্চিন্তে থাকতে পারবেন আপনি।
‘ কিন্তু ওগুলা তো শহরে। আমার বাবুরে শহরে রাইখা ঘুমামু কেমনে? আমার একটাই ছেলে । আর হারাইতে চাই না।
হীরা বলল
‘ আন্টি আপনারা সবাই ও শহরে চলেন। সায়ান আর সায়ানের আম্মু ও যাবে। আয়না ও। আঙ্কেল ও।
আয়শা বেগম চোখ বড় বড় করে তাকায়। বলে
‘ ভিটেমাটি ছাইড়া শহরে?
হীরা বলল
‘ সপ্তাহে সপ্তাহে দেখতে আসবেন।
আয়না নাশতার ট্রে নিয়ে এসে বলল
‘ রূপার স্কুল এখানে। আর আমার বাগান ও।
হীরা বলল
‘ ওহহ।
আয়না বলল
‘ ভাইয়া সপ্তাহে সপ্তাহে আসবে আর কি। সমস্যা হবে না আম্মা।
আয়শা বেগম চুপ করে থাকেন। তখনি বাজারের থলে হাতে আয়ান আসলো বাজার থেকে। কপালে ঘাম জমেছে। হীরাকে দেখে বলল
‘ আঙ্কেল আন্টি এসেছে?
হীরা বলল
‘ জ্বি, আপনার অপেক্ষায় ছিলাম। মা বাবা ওই ঘরে। আয়ান সেদিকে চলে গেল। সেলিনা বেগম আর আমিন সাহেব খুশি হয় আয়ানকে দেখে। অনেক গল্পগুজব হয়। সেলিনা বেগম কথার ফাঁকে বললেন
‘ সায়ানের আম্মু কোথায়? আর তো দেখা গেল না। আয়ান একবার ডাকলো নামিরাকে। এল না নামিরা। পরে আয়নাকে ইশারায় বলল যাতে ডেকে নিয়ে আসে।
আয়না ডাকলো, নামিরা এল না তারপরও।
আয়ান নিজেই ডাকতে গেল। ব্যাপারটা হীরার চোখ এড়ালো না। নামিরা বোধহয় কোনো কারণে রেগে আছে। হয়ত সত্যিটা না বলায়। কি আর করার? দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে হীরা।
আয়ানকে আসতে দেখে ঘর থেকে বের হয়ে যায় নামিরা। মাথায় কাপড় দিতে দিতে বলল
‘ আমি যাচ্ছিলাম। তোমার আসার প্রয়োজন ছিল না।
আয়ান গেল তার পিছুপিছু।

__________

মাসখানেক পার হতেই শোনা গেল হীরার বিয়ের কথা অনেকদূর এগিয়েছে এমনকি বিয়ের দিনতারিখ ও ঠিক হয়েছে। দাওয়াত পড়লো। আয়ান শহর থেকে এসে জানালো সেলিনা বেগম একসপ্তাহ আগে চলে যেতে বলেছে সবাইকে। নামিরা যেতে চাইলো না। আয়ান জোর করে নিয়ে গেল৷ আয়না আর রূপা ভারী খুশি। আয়না রহমত মিয়াকে বাগানের সমস্ত কাজ দেখিয়ে দিয়ে চলে গেল শহরে। বিয়ের সব ঝামেলা চুকিয়ে ফিরতে প্রায় সপ্তাহ লেগে গেল। আয়না ফিরে এসে লেগে পড়লো বাগানের কাজে। ফুলের দোকানে মানুষ রাখলো৷ ফুল কাটা থেকে শুরু করে বিক্রি অব্দি প্রায় দশজন মানুষ কাজ করে তার হয়ে। সবই গ্রামের বেকার মানুষগুলো। তারা কত যে কৃতজ্ঞ আয়নার প্রতি।
এই প্রথম অনেক বড় এমাউন্টের টাকা হাতে এল আয়নার। বেশ অর্ধেক ফুল পঁচে ও গেল হিমাগারের অভাবে। তবে শুধু লাভ চাইলে তো আর হবে না।
আয়না যখন বাগানে আসে তখন চৌধুরী বাড়ির ছাদে স্পষ্ট দেখতে পায় অনিমাকে। অমি মাঝেমাঝে ঘুরতে আসে বাগানে। রূপার সাথে বেশ ভাবসাব। রূপা পালিয়ে থাকে, অমি টের পেলে রেগে খুন৷ কেন মেয়েটা তাকে ভয় পাবে? সে কি বাঘ নাকি ভাল্লুক?

___________

হীরার বিয়ে যেতেই আয়নার বিয়ের কথা মাথায় আসলো আয়ানের। আয়শা বেগম ও তাল মিলালেন। এইবার ভালো ছেলে দেখে বিয়ে দেওয়া দরকার মেয়েটাকে। এতদিনে বাচ্চার মা হয়ে যেত বিয়ে হলে। আয়ান বলল, আমিন আঙ্কেলের হাতে একটা ভালো পাত্র আছে, বলেছিলেন আমায়। ছেলের বাবার গার্মেন্টস আছে শহরে। রেস্টুরেন্ট ব্যবসা আছে। ছেলে ও বাবার সাথে ব্যবসা সামলায়। একটা মাত্র ছেলে। কিছুদিন হলো গ্র্যাজুয়েশন শেষ করেছে।
আয়শা বেগম বলল
‘ তোর ভালো লাগলে কথা আগা ।
‘ কিন্তু আম্মা টুনি?
‘ ও আর কি বলবে? কিচ্ছু বলবে না। তুই ওসব ভাবিস না।
রূপার চোখজোড়া ছলছল করে উঠে। আপা ছাড়া সে নিঃস্ব।

______

লাখ দুই আড়াই লাখ টাকার মতো ফুল বিক্রি হয়েছে। আয়নার কাছে এটাই অনেক। তার উপার্জন। নিজের। মজুরী খরচ,কর্মচারীদের বেতন আর বাকিসব খরচ হিসাব করে দেখলো লাভ এসেছে একলাখের মতো। কারণ এইবার বেশ টাকা ধারদেনা হয়েছে। কিস্তির টাকা পরিশোধ করা লেগেছে। সংসারটা ও তার টাকায় চলেছে।
আয়নার মনে পড়লো তার আর ও বড় ধরণের একটা ঋণ বাকি আছে। প্রফেসরের কাছে তার অনেক দেনা।
আয়না তার হিসেবের খাতা বের করে অনুরাগের কাছ থেকে নেওয়া সব টাকা যোগ করলো। প্রথমেই চার হাজার টাকার চারা, তারপর আট হাজার, তারপর পুরো একটা বাগান, মজুরী খরচসহ এসেছে বিশ হাজারের মতো । আর কত খরচ যে করা লেগেছে প্রফেসর তো মুখ ফুটে তেমন বলেনি।
এভাবে সব টাকা একে একে যোগ দিতে দিতে এমাউন্ট এসে দাঁড়ালো প্রায় চল্লিশের হাজারের কাছাকাছি।
আয়না ভাবলো এইবারের পনের হাজার টাকা তার কাছে থাকলেই হবে। বাকিটা দিয়ে নামিরাকে একটা গহনা কিনে দেবে। তার সব গহনা বন্ধক যে দিল আর ছাড়াতে পারলো কই? সব গেল। ভাইয়ার চাকরিতে জয়ন করলে পরে বাকিগুলো দেখা যাবে।

অনুরাগের কাছে চল্লিশ হাজার টাকার চেক এল রহমত মিয়ার হাত ধরে। সে এতদিন কক্সবাজার ছিল। কাজ শেষে ফিরলো মাত্র দুদিন হয়েছে। হঠাৎ এমন একটা চেক পেয়ে ভীষণ রকম অবাক হলো অনুরাগ। আয়নামতী তো একেবারে ঋণ শোধ করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে৷ নিল অনুরাগ। রহমত মিয়া আর ও একটি কাগজ দিল অনুরাগকে৷ অনুরাগ দোতলার বারান্দায় চেয়ারে বসে খুললো কাগজটা। সেখানে লিখা

‘ এই সামান্যটা গ্রহণ করুন প্রফেসর । যারা বিপদের সময় এগিয়ে আসে তাদের ঋণ শোধ করা যায় না টাকা দিয়ে। তাই আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা ছাড়া আর কিছু করার নেই আমার। তবে কখনো যদি মনে হয় আমার সাহায্য আপনার ভীষণ প্রয়োজন, সেদিন নিশ্চয়ই আমাকে ডাকবেন, আমি অবশ্যই আসব ।

অনুরাগের চেহারায় কাঠিন্যেতা। খসখস করে সে কাগজের উল্টোপিঠে লিখল

‘ তোমার ডাক পড়ে বিপদে পড়লে, আমার ডাক ও বিপদের দিনে পড়বে সেটা ভাবলে কি করে আয়নামতী? নিশ্চিন্তে থাকো আমি আর সেই বেকুব পুরুষটা নেই। বুঝতে শিখেছি। বাস্তবতা অনেক শিখিয়েছে আমায়। বিপদের বিরুদ্ধে এখন রুখে দাঁড়াতে শিখেছি আমি। তোমার সাহায্য দরকার নেই।
লিখে আবার ছিঁড়ে ফেলল অনুরাগ। মাথা এলিয়ে দিয়ে বসে রইলো চেয়ারে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা এবার ছাড়ার দরকার। রাজনীতি আর শিক্ষকতা দুইটা একসাথে চালানো যায় না। কিন্তু সে দোটানায় ভুগছে। কোন পথটা সঠিক? শিক্ষকতা তার পছন্দের পেশা। অন্যদিকে সে মানুষের সেবা করার ব্রত নিয়েছে।
ওই অশিক্ষিত, সুদখোর, গাঁজাখোর খালিদুজ্জামান গদিতে বসে থাকা মানেই অসহায় দুঃস্থ মানুষদের সর্বনাশ। কিছুতেই আর বসে থাকা যাবেনা। দেখা যাক কি হয়? ডিপার্টমেন্ট থেকে ডাক আসলে চাকরি ছাড়ার কথা ভাবা যাবে।

আনহিতা অনেকদিন পর ছেলেকে পেয়ে বারবার কোনো একটা কথা বলতে গিয়ে থেমে যাচ্ছে। অনুরাগ সেটা পরখ করেছে। আজকাল মাকে সময় কম দেওয়া হচ্ছে। গ্রামে না থাকার দরুন।
অনুরাগ ভাবলো মাকে এইবার শহরে নিয়ে যাবে সে৷ কিন্তু মা তো যেতেই চায় না।
চেয়ার থেকে উঠে সোজা হয়ে দাঁড়ালো অনুরাগ। আনহিতা বেগমকে বলল

‘ কিছু বলবে মা?

আনহিতা কাঁচুমাচু করে বলল,

‘ হ্যা। আসলে তোমার আপার ছোট ননদটার কথা বলছিলাম। ঢাকায় পড়ে। শিক্ষিত মেয়ে। অনিমা নাকি আশরাফের সাথে কথা বলেছে। আশরাফ বলেছে তোমার কোনো আপত্তি না থাকলে কথা আগানো যেতে পারে।

অনুরাগ আঁড়চোখে মায়ের দিকে তাকালো। আনহিতা বলল

‘ দেখো আব্বা, কালকের খবরের কাগজে তোমার নামে কিসব কিসব লেখা উঠেছে। তোমার নাকি বউ পালিয়েছে, প্রতারণা করেছে। যে মানুষের কাছে বউ থাকেনা সে কেমন মানুষ হবে? নিশ্চয়ই খারাপ কিছু দেখেছে। কুহেলী কি করেছে সেটা তো আর কেউ জানেনা।
অনুরাগ হেসে ফেলল৷ বলল

‘ মা এসব ওই লম্পট সাংবাদিকদের কাজ। দুমুঠো ভাতের জন্য এরা এসব করে। বাদ দাও৷ । আরও কত কি বলবে এরা
আনহিতা বলল
‘ কিন্তু বিষয়টা ভেবে দেখো। এভাবে তো চলে না আব্বা। তোমার সবকিছু পার্ফেক্ট থাকা চায় নইলে পাবলিক আঙুল তুলে কথা বলবে৷ আমার কথা ও ভাবো। কোনদিন মরে যাই, নাতি নাতনি যদি না দেখে যাই। আমার একটাই তো ছেলে। তোমার সংসারটা গুছিয়ে দিতে পারলে মরেও শান্তি পাব।

অনুরাগ প্রচন্ড বিরক্ত হলো। শায়খ চৌধুরী একই গান গাইলেন। অনিমা ও। শায়লা বেগম ও।
অনুরাগ ভেবে পেলনা এদের মাথায় এসব বিয়ের ভূত হুটহাট আসে কোথা থেকে। সে কি আদৌ কোনো মেয়েকে বিশ্বাস করে উঠতে পারবে? বিশ্বাসঘাতক, প্রতারকের দল সব। এদের বিশ্বাস করা আর বিড়ালকে মাছ পাহারা দেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া একই কথা।

আনহিতা কোনো না উত্তর না শুনে ভেবেই নিলেন অনুরাগের সায় আছে এই বিয়েতে। এইবার আর ছোটখাটো কোনো অনুষ্ঠান হবেনা। বিরাট আয়োজন হবে। সাংবাদিক এসে মিডিয়ায় তুলবে এই খবর। পুরো গ্রামের মানুষের দুমচে খাওয়াবেন। দোয়া নেবেন। অনিমা ও প্রচন্ড খুশি। যাক লুবনার সাথে অনুরাগের বিয়ে হলে আর কোনো সমস্যাই থাকলো না। তার ভাইটা ভালো থাকলেই হলো।
জরুরি কাজে অনুরাগকে আবার শহরে ফিরে যেতে হলো। এসে দেখলো বিয়ে বিয়ে রব সারাবাড়িতে। অনিমার শ্বশুর শ্বাশুড়ি আরও কতজন! এমনকি যার সাথে তার বিয়ে হওয়ার কথা সেই মেয়ে। ওই মেয়েটা অনেকবার এই বাড়িতে এসেছে। দেখতে চিকনচাকন গড়নের মেয়েটি অনুরাগের মতে একদম বেয়াদব। কারণ অনুরাগ তার অনেক সিনিয়র হলেও মেয়েটি সোজা অনুরাগ বলেই ডাকে অনুরাগকে। অনুরাগের এই কারণে মেয়েটাকে অসহ্য লাগে।
বাড়িতে কি হচ্ছে তা ভালোভাবে জানার চেষ্টা করতেই অনুরাগ জানতে পারলো আজকে একদম সমাপনী কথাবার্তা চলবে। নিশানা হিসাবে আংটি পড়িয়ে দেওয়া হবে লুবনাকে।
আগামী সপ্তাহের দিকে বিয়ের দিনতারিখ।

অনুরাগ চেঁচিয়ে পুরো বাড়ি এক করলো। নিজের ঘরে গিয়ে চেঁচালো ইচ্ছেমত। একবার যে ভুল সে করেছে সে ভুল সে আর করবেনা। আনহিতা এসে বললেন
‘ তোমার বোনের অসম্মান হবে ওর শ্বশুরবাড়িতে। এমন করোনা। লুবনা ভালো মেয়ে। বুঝো আব্বা।
অনুরাগ চেঁচালো৷ রক্ত যেন মাথায় উঠলো। রাগে দিকদিশা হারিয়ে ফেলল সে।
অনিমা এসে এটা ওটা বলে নাকিসুরে কাঁদতেই গর্জে উঠে সে লাতি বসালো বেডসাইড টেবিলে। কুহেলী ছলনাময়ীর মুখ ভেসে উঠছে বারবার। সে আর ঠকতে পারবেনা। । আর না ।
আনহিতা কেঁদে দিলেন ছেলের এমন রূপ দেখে। অনুরাগ ব্যাগপ্যাক গুছিয়ে নিয়ে বলল
‘ জীবনে ও আর এই বাড়িতে আসব না আমি। কেউ বুঝে না আমায়। কেউ মরলে ও আসব না। আমি মরলে ও কেউ খোঁজ নেবেনা। কাউকেই দরকার নেই আমার।
সেই যে গেল, আর ফিরলো না অনুরাগ। এদিকে ছেলের শোকে দিনের পর দিন অসুস্থ হতে লাগলো আনহিতা। শায়খ চৌধুরী একদিন মুঠো ফোন করে ছেলেকে জানালেন

‘ মায়ের মরা মুখ দেখার জন্য প্রস্তুত হও অনু। তোমার মায়ের কিছু হলে তুমি দায়ী।

অনুরাগ দিশেহারা হয়ে পড়লো। কি করবে সে? যখন মাকে দেখতে এল পুরো বাড়িটা তখন খালি। হসপিটাল থেকে ফোন করলো শায়খ চৌধুরী। অনুরাগ শুনলো আনহিতা নাকি বাথরুমে পড়ে গিয়ে হাত পা ভেঙে ফেলেছেন, শারিরীক অসুস্থতা তো আছেই। সাথে অন্যান্য রোগব্যাধি।
অসুস্থ মায়ের শিয়রে বসে কথা জড়িয়ে আসলো অনুরাগের। মা নিশ্চয়ই তার ভালোটা চায়। আনহিতা বললেন
‘ সোহাগ আমি মরার আগে তোমার পাশে কাউকে দেখতে চাই। আমি চাই তুমি ভালো থাকো। খুব ভালো থেকো আমার বাচ্চা।
অনুরাগ মায়ের চোখের জল মুছে দিল। বলল
‘ আমি তোমার কথা রাখব কিন্তু তোমাকেও রাখতে হবে আমার কথা। আমাকে একা করে কোথাও যাবে না মা।
আনহিতা চোখের কোণা বেয়ে শুধু জল গড়ায়। অনুরাগ সেই জল পড়ার আগেই নিজেই মুছে দেয়। মায়ের কপালে চুমু এঁকে বের হয়ে যায় কাঙ্ক্ষিত উদ্দেশ্যে।

টাইপিং মিসেটক হতে পারে। খুব তাড়াহুড়ো করে লিখেছি।