আ না ম পর্ব-৩২ এবং শেষ পর্ব

0
384

“আ না ম”- ৩২ (শেষ পর্ব)
-Azyah সূচনা

দুটো বছর সময় অপেক্ষা করতে হয়েছে রবিনকে। রামশা মেয়েটাকে ফের মানিয়ে নিতে।কেস সলভ হওয়ার পরপরই দৌড়ে গিয়েছিল ঢাকায়।কর্ম বিরতিতে প্রেয়সীর কাছে একজন প্রেমিক হিসেবে ক্ষমা চেয়ে নিবে বলে।একজন সাব ইন্সপেক্টরকে নাকানি চুবানি খাইয়ে তারপর রাজী হয়েছে বিয়েতে।আশ্রমে আবারও সকলে মিলিত হয়েছে। শাবাব,মির্জা,আবির, সাইফা,ফাহাদ।সাথে তাদের পরিবারও।একটা কেস সলভ করতে করতে ভালো বন্ডিং তৈরি হয়েছে তাদের সকলের মধ্যেই।নাহিদ শেখ জেল খাটছে নিজের পেশা আর ক্ষমতার অপব্যবহারের ফলে।জোভানকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়েছে। আগামীমাসে কার্যকর হবে।তাকে উস্কানির অভিযোগে শ্যামলি ডিসুজার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। জাহিনকে মানভ ডিসুজা তার কাছে নিয়ে এসেছেন।আশ্রমটা নতুন সাজে।পুরোনো ভুতুড়ে নেই আর।চারিদিকে লাইটিং।ভিন্ন রকমের বিয়ের অনুষ্ঠান।মির্জা একা নয় এখন।ছোট পরিসরে শাবাবের মেজাজ বিগড়ে দিয়ে রুবির সাথেই বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়।বেশিদিন শাবাবের রাগ টেকেনি।আজকাল রাগ করতে জানে না সে।চুপ হয়ে থাকে।আশ্রমের বাচ্চাগুলো স্কুলে যায়। বৃদ্ধদের সাথে চব্বিশ ঘণ্টা নার্স আর ডাক্তার থাকে।সব চলছে ভালো নিয়মে।তবে লিয়ানার ঘ্রাণ মিশে আছে এখনও প্রতিটি দেয়ালে।আনাচে কানাচে মুখরিত স্মৃতিতে।

সামনে কালো স্যুটে রবিন দাঁড়িয়ে।মুখোমুখি সাদা গাউনে রামশা। হাস্যোজ্জ্বল দেখালো দুজনকেই।আজ বিয়ে তাদের। খ্রীষ্ট ধর্মের বিয়ে সরাসরি আগে কখনো তারা কেউ দেখেনি।প্রথমবারের মত বেশ উৎসাহ নিয়েই দেখছে সকলে।সাথে তাদের বাবা মায়েরা। এ্যারিক রোজারিও এসেছেন।ছেলের শখ পূরণ করতে।এখানটায় তাদের বিয়ের আয়োজন করেন। রিসিপশন হবে ঢাকায়। চার্চ থেকে ফাদার এসে তাদের দুজনের মধ্যে দাঁড়িয়ে তাদের বিবাহ সম্পন্ন করেন।সমস্ত রীতিনীতি মেনে।কাগজে সই করে আবদ্ধ হয়েছে নতুন বন্ধনে।

মাথার একদিকে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে রেখে বসে আছে শাবাব।দেখছে চেয়ে চেয়ে সবকিছু।মির্জা এসে পাশে বসলো।বললো,

-“কি খবর দেবদাস?”

-“মশকরা নিজের বউয়ের সাথে করবে।”

-“শুধু মেজাজ না?নিজের জীবনটা নিয়ে ভেবেছো?কি করবে সামনে?”

শাবাব মির্জার দিকে আড়চোখে চাইলো।বুঝতে পেরেছে মির্জা কি বলতে চাচ্ছে।তারপরও না বোঝার ভান করে বলে উঠলো,

-“কাজ করছি,জীবন চলছে”

-“কাজ ব্যতীত একটা ব্যক্তিগত জীবন আছে তোমার। বয়সতো কম হলো না।”

শাবাব বাঁকা জবাব দেয়, – “হু কেয়ার্স?”

মির্জা সাইফার দিকে চাইলো।সাদা গাউন পড়ে পরি সেজে ঘুরঘুর করছিলো এতক্ষন। শাবাবকে দেখে তার ঠিক কিছুটা দুরত্বে ঘাঁটি স্থাপন করেছে।বসে বসে দেখে যাচ্ছে তাকে।কতটা ধৈর্য্য থাকতে পারে একটা নারীর মধ্যে?একটা পুরুষকে নীরবেই চেয়ে যাচ্ছে।কোনো চাওয়া নেই তার।কোনো অভিমান নেই।

মির্জা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,

– “একজনতো অবশ্যই কেয়ার করে।যাকে তুমি দেখেও না দেখার মতন ভান করে আছো।তোমার এড়িয়ে যাওয়ার স্বভাবের কারণে তুমি আজ পর্যন্ত নিজের কাছে অপরাধী।একজন হারিয়ে গেছে ধরার আগেই।আবার এই ভুলটা করো না।”

শাবাব প্রশ্ন করলো, -“মানে?”

-“একবার নিজের অনুভূতির মূল্য দাওনি।এবার অন্যের অনুভূতির মূল্য দাও।তুমি অনেক লাকি শাবাব।এমন একজনকে সসম্মানে নিজের করে নাও যে তোমাকে ভালোবাসে।ক্ষুদ্র অনুভূতি জাগ্রত হওয়ার পূর্বেই নিঃশেষ হয়ে গেলে কেমন অনুভূত হয় এটা তোমার চেয়ে ভালো কেউ জানে?”

চোখ আপনাআপনি চলে গেলো শেওলার দিকে।তার চারিদিকে ফুল ফুটেছে।সেখানেই নিশ্চুপ হয়ে আছে দেহটা।দূর্বা ও ছোটছোট গাছপাতাগুলো তাকে আবৃত করে রেখেছে নিজের মধ্যে।আড়াল করে আছে।সে কি পরপারে সুখ পেয়েছে?নিশ্চয়ই পেয়েছে।কারণ সেখানে অন্যায় হয়না।সেখানে নিষ্ঠুরতার কোনো জায়গা নেই। দেড় বছর পড়ে শাবাব এখানটায় উপস্থিত।এর মাঝে আসার সাহস হয়নি।বারবার মনে পড়তো সেই কথা!বিনা দোষে তাকে অনেকবার কষ্ট দেওয়া হয়েছে।কোন মুখ দিয়ে দাঁড়াবে লিয়ানার সামনে?অন্তরে দানা বাঁধা অনুভূতির চেয়ে অনুশোচনার ওজন বেশি।

-“সাইফা তোমাকে সেদিন থেকে ভালোবাসে যেদিন থেকে ও আমাদের ব্যুরোতে জয়েন করেছে।মেয়েটা ভীত।মুখ ফুটে বলতে পারেনা।তোমার মনে হয়না ওকে নিয়ে ভাবা উচিত তোমার। সাইফা নিজেও নিরপরাধ।কেনো তোমাকে দুর থেকে ভালোবেসে কষ্ট পাবে?দ্বিতীয় সুযোগ স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা দেন।তুমি ক্ষুদ্র মানুষ।”

-“কি করবো এখন?” শাবাব ইচ্ছেকৃত এই ধরনের প্রশ্ন করলো।

মির্জা ফিক করে হেঁসে বলে, -“বিয়ে!”

-“তারপর তোমার মতন বউ পাগল হয়ে যাবো তাই না?আমি জানি সাইফা ব্যাপারে।আমি ওকে অবজার্ভ করেছি অনেকবার। ও নিজে থেকে কখনো কেনো কিছু বললো না?”

বুক ফুলিয়ে মির্জা বললো,- “বউয়ের জন্য পাগল হবো নাতো কি তোমার জন্য হবো?আর সাইফা কোন মুখে বলবে?তুমি সেই সুযোগটা কখনো রেখেছিলে?”

-“ওর বড্ড সাহস জানো?তেরছা উত্তর দিতে শিখেছে অনেকদিন হলো।অথচ আহাম্মকটা এই কথা বলতে পারেনি।আর আমি যদি ওকে আমার জীবনে আলাদা জায়গা দেই তোমার মনে হয়না ওর প্রতি অন্যায় হবে?”

-“কেনো অন্যায় হবে শাবাব?আমার জীবন থেকে রুবি সরে গিয়েছিল। ঘৃনার জায়গা সৃষ্টি হয়েছিলো।কষ্টের চেয়ে ঘৃনা ভয়ঙ্কর।আমি তারপরও চেষ্টা করেছি।এটা বাস্তব।এখানে সময় সব ঠিক করে দেয়।সময়ের সাথে সাথে সব ঠিক হয়ে যাবে।আর তুমি অন্যায় করবে না আমি জানি।সম্মান চায় মেয়েরা বিশেষ করে।সম্মান দিতে পারবে না?ওর ছোটছোট ইচ্ছাগুলো পূরণ করতে পারবে না?যত্ন নিতে পারবে না?আমি জানি তোমার রুক্ষতা বাহ্যিক।তোমার অন্তরের সাথে তোমার স্বভাবের মিল নেই। মিছেমিছি নিজেকে কঠোর দেখাও।”

আবার ডানপাশে তাকালো শাবাব। সাইফার দিকে। শাবাবকে চাইতে দেখে তড়িৎ গতিতে দৃষ্টি ঘোরায় নিজের।এদিক ওদিক চাওয়াচাওয়ি শুরু করেছে। শাবাব আশ্চর্য্য হলো। এতক্ষন চোখ দিয়ে গিলে ফেলা মেয়ে এখন চোরের মতন চোখ লুকায়।মাথায় ধরলো না তাদের এসব।

সাইফার অস্থির অবস্থা।অনেকক্ষন যাবৎ মুখ ঘুরিয়ে রেখে ঘাড় ব্যাথা অনুভব করছে।সোজা হয়ে বসলো। আড়চোখে তার বাম দিকে চাইলে অবাক হয়।

আনমনে বলে উঠলো, -“মাত্রইতো ছিলো এখানে। কোথায় গেলো?”

-“ঠিক তোমার পেছনে আহাম্মক!”

শাবাবের গলার স্বরটা ঠিক থাপ্পড়ের মতোন করে এসে পড়েছে। ঢোকটাও গিলতে পারলো না।গলায় আটকে আসছে। শাবাব এগিয়ে এসে দাঁড়ায়।কোমরে দুহাত রেখে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। সাইফা বুঝতে পারলো না তাকিয়ে থাকার কারণ কি।সাহস করে প্রশ্ন করে,

-“কিছু বলবেন স্যার?”

শাবাব সরাসরি বলে উঠলো কোনো প্রকার দ্বিধা ছাড়াই,

-“বিয়ে শাদী করার প্ল্যান আছে নাকি তোমার?”

বোকার মতন চেয়ে রইলো সাইফা।এই লোক এই প্রশ্ন করে কেনো?এই ধরনের প্রশ্ন তাকে একদম মানাচ্ছে না।ঠোঁট ভিজিয়ে আমতা আমতা করে বলল,

-“প্ল্যানতো আছে।…..ভালো ছেলে খুঁজে পেলে করে ফেলবো”

-“ছেলে খোঁজা লাগবে না।আমাকে বিয়ে করবে কিনা সেটা বলো?”

বিস্ফোরিত চোখে চাইলো সাইফা এবারে। ঠোঁট জোড়া আপনাআপনি ফাঁকা হয়ে আসে। কান ঠিকঠাকমত শুনছে তো? সাইফা বলে উঠে,

-“কি বলছেন এসব?”

-“কি বলছি কি?বিয়ে করতে চাও কিনা বলো?ওসব রং ঢং আমার পছন্দ না ক্লিয়ার কাট উত্তর দাও।যদি হয় তোমার বাবা মাকে ডাকো।আমার বাবা মাকে আমি ম্যানেজ করছি।কোনো ঝামেলা ছাড়া কোর্টে গিয়ে বিয়ে শাদীর জট ঝামেলা শেষ করবো”

বিয়ের প্রস্তাব দেওয়ার এই শ্রী?সাইফার দেহ- মনে ঐশ্বরিক শক্তি প্রকট হয়।পেয়েছে তাকে হাতে নাতে।এবার একটা ছোটোখাটো শিক্ষা দিয়েই ছাড়বে। গুরুত্বহীনভাবে হেসে বললো,

-“তারপর?”

-“মেজাজ খারাপ হচ্ছে কিন্তু আমার।দ্রুত উত্তর দাও!”

-“বিয়ে শাদী করতে চাচ্ছেন অথচ এতটুকুতেই রেগে যাচ্ছেন?”

-“আমি এখনও ঢং পছন্দ করিনা।ভবিষ্যতেও করবো না।”

-“কেনো বিয়ে করবো আমি আপনাকে তাহলে?”

-“আশ্চর্য্য!মির্জা বললো ভালো টালো নাকি বাসো আমাকে।ভালোবাসলে বিয়ে করবে নাতো লিভ ইন রিলেশনশিপে থাকবে?”

চোখের সামনে অন্ধকার দেখছে সাইফা।এই খাটাশ লোকটাকেই পেয়েছিলো মনে ধরার জন্য?বিয়ের প্রস্তাব দিচ্ছে নাকি হুমকি?একে বিয়ে করলে জীবন তেজপাতার চেয়েও খারাপ অবস্থায় চলে যাবে।

সাইফা বললো,

-“ছিঃ স্যার! আপনি বোধহয় ভুলে যাচ্ছেন আপনি সাব ইন্সপেক্টর শাবাব।এসব কথা আপনাকে মানায় না।”

তর্জনী আঙ্গুল তুলে শাবাব বললো,

-“লিসেন সাইফা!আমি স্বার্থপর এক পুরুষলোক।আমার শান্তি দরকার!তোমার অনুভূতিকে সম্মান দিতে চাচ্ছি।আমি চাচ্ছি না আর কেউ অন্তত আমার জন্য দুঃখের সাগরে ডুবে থাকুক।যেখানে তাকে উদ্ধার করার সুযোগ আছে।কোনো দয়া না।তুমি গ্রহণ করলেই হবে।এটা কোনো মুভি নয়।মানুষের মন ধীরেধীরে সব পাল্টে যায় এক না এক সময়।সাথে এলোমেলো সবটা সামলে নিতে চাই।এর মাঝে কোনো অশান্তি চলবে না বলে দিলাম”

যাওয়ার পথে চোখ পড়লো নিস্তব্ধ শেওলার দিকে। হেঁটে হেঁটে বাবার কাছে গিয়েছে। আশ্চর্য্য!ঘরের কোনো কোণায় তার দেখা মিললো না।সন্দেহ হয় শাবাবের। শাম্মা আর রুনা বেগমকেও কোথাও দেখা যাচ্ছে না।এরা কি পলাতক নাকি?এদিক ওদিক চারিদিকে চোখ বুলিয়ে শেষ নজর যায় খাবার ঘরের দিকে।মুখ্য দরজার দিকে দাঁড়িয়ে দেখতে শুরু করেছে ভেতরের কান্ড-কারখানা।লোকটার বয়স হয়েছে কি বাতাসে?নাকি এই বয়সের দোহাই দিয়ে হিতাহিত জ্ঞান ছুটি নিয়েছে। বাবুর্চি থাকা স্বত্বেও কেনো তার এত বড় খুন্তি নিয়ে ধস্তাধস্তি করতে হবে!

ক্ষেপে গেলো শাবাব।সরাসরি গিয়ে দাঁড়িয়েছে লুৎফর বেইগকে উৎসাহ দেওয়া মা আর বোনের দিকে।বলে উঠলো,

-“মাথা কি কারোই ঠিক জায়গায় নেই?কি করছে কি উনি?”

শাম্মা শাবাবের দিকে চেয়ে বোকা মুখ বানিয়ে বললো,

-“রান্না করছে”

কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলে মাঝেমধ্যে শাবাব। আসলেই কি তার পরিবার এরা?দেখে একেকজনকে সার্কাসের জোকার এর চেয়ে কোনো অংশে কম মনে হয়না।একটা দরকারি কথা বলতে এসেছিল।এসব নাটক দেখে রুচি আসছে না।

শাবাব এগিয়ে গিয়ে খুন্তিটা সরিয়ে নিলো লুৎফর বেইগ এর হাত থেকে। যার জিনিস তাকে ফিরিয়ে দেয়। বাবুর্চি কেনো তার জীবন ফিরে পেয়েছে।লুৎফর বেইগ সরে এসে বললেন,

-“কি সমস্যা তোমার?আমাকে কাজ করতে দিলে না কেনো?”

গতরাতে বাবাকে জড়িয়ে সরি বলার কথা ভুলেই গেছে।নিজের আসল রূপে ফিরে এসেছে। শাবাব বললো,

-“এটা বিয়ের খাবার।আপনার আশায় থাকলে মানুষগুলো খেতে পারতো না এই জনমে”

-“আমাকে আন্ডারেস্টিমেট করছো তুমি?” লুৎফর বেইগ কপট রাগ দেখিয়ে বললেন।

শাবাব লম্বা চওড়া একটা নিঃশ্বাস টেনে নিয়েছে।পরপর শ্বাস ফেলে বাবার দিকে চাইলো।অবুঝ খোকার মতন মুখ বানিয়ে রাখে।চোখে চোখ রেখে বলে বসলো,

-“বিয়ে করবো”

-“কিহ!”

আপনাআপনি লুৎফর বেইগ এর মুখ ফুটে শব্দটি উচ্চারণ হয়।রুনা বেগম হা হয়ে চেয়ে আছেন। শাম্মা ভারী দুষ্টু। শাবাবের কপালে হাত রেখে তাপমাত্রা মেপে নিলো। জ্বর টর আসেনিতো!

শাম্মা প্রশ্ন করে বসলো, – “কি বললি?”

শাবাব রেগে যায়। হাত ঝাড়া দিয়ে সরিয়ে বলতে লাগলো,

-“বাংলায় বলেছি জাপানিজ ভাষায় বলিনি।”

রুনা বেগম জানতে চাইলেন, – “কাকে বিয়ে করবে বাবা?”

-“বাহিরে সাদা গাউন পড়ে একটা মেয়ে বসে আছে।মুখ দেখলেই বুঝবে।বোকার মতন চেয়ে থাকে সবসময়।নাম সাইফা।ওর বাবা মাও আছে এখানে।গিয়ে কথা বলে একটা দফারফা করো।আমি বাহিরে যাচ্ছি কথাবার্তা বলে আমাকে জানাবে।আজকের মধ্যে বিয়ের ঝামেলা শেষ হলে আরো ভালো”

মির্জা বসে আছে রুবির হাত ধরে। শাবাব এর গা টা জ্বলে উঠে এদের এসব ঢং দেখে।বাবা মাকে বলির পাঁঠা বানিয়ে দিয়ে নিরুদ্দেশ।মির্জা শাবাবকে বেরিয়ে যেতে দেখে বললো,

-“জানো রুবিনা আমার মনোবিজ্ঞানী মন কি বলছে?”

রুবি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চেয়ে প্রশ্ন করলো, – “কি বলছে তোমার অধম মনোবিজ্ঞানী মন?”

-“তুমি আমাকে অধম বলবে না!”

ঠোঁট চেপে হাঁসে রুবি।তাদের মধ্যে সম্পর্ক অনেকটা উন্নত হয়েছে।চেষ্টা করছে পদে পদে।আর যেনো কোনো ভুল না হয়। অতীতকে তার মতই পিছনে ফেলে এসেছে।ফিরে তাকায় শুধু একজনের স্মৃতি চরণের জন্য।লিয়ানার জন্য।অল্পদিনের পরিচয়ে মেয়েটাকে মনে ধরেছিল।অদ্ভুত চাহনির মধ্যেও সবুজ চোখে সস্তি দেখতো।

রুবি আবার বলে উঠে, – “আচ্ছা বলবো না।তোমার মনোবিজ্ঞানী মন কি বলছে বলো?”

-“দিন পেরিয়ে রাতের দিকে আরো একটা বিয়ে খাবো।”

ইতিমধ্যে রবিন রামশা এসে হাজির।গাউন গায়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না আর।রবিনের হাতে ভর করে কোনরকম হেঁটে এসেছে আরেক দম্পতির দিকে।

-“আরেকটা বিয়ে মানে কার বিয়ে?” রবিন প্রশ্ন করে।

মির্জা বললো, – “আমাদের শাবাব সাহেব এর।”

রামশা মুখ বেঁকিয়ে বললো, – “এটা এই জীবনে সম্ভব?”

-“অবশ্যই সম্ভব।ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে আমি সম্ভব করে দেখিয়েছি”

রবিন প্রশ্ন করলো পূনরায়, – “কাহিনী কি বলেন তো?”

লাইন বায় লাইন সব বলে গেছে মির্জা।কিভাবে শাবাবকে সাইফার দিকে এগোতে উস্কানি দিয়েছে সে।বলছে আর নিজের উপর গর্ববোধ করছে মির্জা।তবে রামশা, রবিন আর রুবির মনে এখনও দ্বিধা।পেছনে নিশ্চুপ দাঁড়ানো আবির আর ফাহাদ এর মনে আরো বিশাল দ্বিধা।দুই রকম মনোভাব।হয়তো বিয়ে করবে হয়তো করবে না। শাবাব এর মনে কি চলে বুঝা বড় দায়।

হতাশ গলায় আবির বললো, – “আমি কি দোষ করলাম তাহলে?তোমরা জোড়ায় জোড়ায় বিয়ে করছো আর আমি চেয়ে চেয়ে দেখছি।”

তার কথায় বাকিরা হাঁসলেও হাঁসতে পারলো না ফাহাদ।বেচারার অবস্থাও একই।বলে উঠলো,

-“আপনারা বিয়ে করছেন বলে আবির স্যারের কথায় হাঁসি পাচ্ছে আপনাদের।কিন্তু আমি আপনার দুঃখ বুঝি স্যার।আমিও আপনার দলের লোক।”

আবির বললো,- “আমার কষ্ট তুমিই বুঝো একমাত্র ফাহাদ।”

মির্জা খুকখুক করে কেশে উঠলো।আর ঠাট্টা করে বলে উঠলো,

-“এই দেশে কি একজন পুরুষের সাথে আরেকজন পুরুষ এর বিবাহের কোনো আইন আছে?থাকলে আবির আর ফাহাদ এর বিয়েটাও আজকেই….”

আবির রেগে বললো, -“তুমি যা-তা বুঝলে!কোন কথার কোন মিনিং বের করো!”

হাঁসির রোল পড়েছে আঙিনা জুড়ে।অন্যদিকে গুরুত্বপূর্ন আলোচনা চলছে সাইফার বাবা মায়ের সাথে।যত উৎসাহ নিয়ে এখানে এসেছিল সবটাই ফুস হয়ে গেছে সাইফার।ইচ্ছে পূর্ণতা পাচ্ছে।নীরবে যাকে ভালোবেসে গেছে তাকে পাওয়ার সময় কাছে।অথচ ভয় কাটলো না। মুরব্বীদের মধ্যিখানে কাচুমাচু হয়ে বসে। শাবাব গায়েব।তার কোনো খোঁজ নেই। সাইফার বাবা মায়ের সাথে সিদ্ধান্ত তার মেয়ের ইচ্ছের উপর নির্ভর করে।

সাইফার বাবা প্রশ্ন করলেন,

-“তুমি কি শাবাবকে বিয়ে করতে চাও?”

সাইফা আরো জড়োসড়ো হয়ে বসে।মাথা চোখ নামিয়ে শুধু মাথা দোলায় উপর নিচ। হ্যাঁ বোধক উত্তর দেয়। লুৎফর বেইগ,রুনা বেগম এবং শাম্মা অতি মাত্রায় খুশি হন।উভয় পক্ষের সম্মতিতেই সন্ধ্যায় কাজীকে ডাকা হয়েছে। শাবাবকে কল করে জানালো সাইফার। কক্স বাজারে সমুদ্রের তীরে একাকী কিছু সময় কাটিয়েছে এতক্ষন যাবৎ।কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছে।মস্তিষ্কের এলোমেলো চিন্তাগুলোকে সঠিকভাবে সাজিয়ে নিলো।বুকের মাঝে অস্থিরতা এখনও।ভাবলো কেটে যাবে।তার জন্য যেনো অন্য কারো অনুভূতি ধামাচাপা না পড়ে।

কাপড়টা অব্দি পরিবর্তন করলো না শাবাব।শার্টের অবস্থা নাজেহাল।ধুলো বালি লেগে আছে।সাইফার মাথায় শুধু একটি লাল ওড়না টানা।কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে রবিন রামশা পুরোনো বর বউ হয়ে গেলো।নতুনের তালিকায় আরেক জোড়ার আগমন।আবির ফাহাদ এর এখনও বিষয়টা হজম করতে অসুবিধে হচ্ছে। শাবাবের জায়গায় অন্য কেউ নেইতো?

কাজী সাহেব শাবাবের উদ্দেশ্যে বললেন, -“আপনি বর?”

শাবাব তেরছা চোখে চায়।বলে, -“হ্যাঁ কেনো?”

মিনমিনে গলায় কাজী সাহেব বললেন, -“দেখেতো মনে হচ্ছে না।ময়লা পড়া শার্ট..”

বলতে বলতে থেমে যায় কাজী সাহেব। শাবাবের অগ্নিচক্ষুর স্বীকার হয়ে চুপ বনে গেলো।শীতল হয় শাবাবের চাহনি একবার শেওলার দিকে চেয়ে নিলো।শাবাবের দিকে চেয়ে দেনমোহর ধার্য করে বললেন,

-“বলুন কবুল”

শাবাব বাঁধাহীনভাবে বলে উঠলো,

-“কবুল”

-“আবার বলুন কবুল”

-“কবুল”

-“আবার বলুন”

এবার মেজাজটা খারাপ হয়ে গেলো।থমথমে মুখে কাজী সাহেবের দিকে চাইলে সে বলতে লাগল,

-“আরেহ তিনবার বলতে হয়।বিয়ের সময় তিন কবুল আর তালাকের সময় তিন তালাক।আজকালকের ছেলেপেলেরা কিছুই জানেনা”

শাবাব জবাব দেয়, -“আমিতো আপনার মতন এক্সপিরিয়েন্সড না।জীবনের প্রথম আর শেষ বিয়ে।….. যাই হোক কবুল!”

মির্জা আর রবিন মুখ লুকানোর জায়গা খুঁজে বেড়াচ্ছে।এটা কেমন ধরনের বিয়ে?কেমন ধরনের ব্যবহার। বিয়ে করছে নাকি কাঁধে বন্দুক রেখে হুমকি দিচ্ছে?বিয়ের পরও যে শাবাব শাবাবই থাকবে সেটা স্পষ্ট দেখতে পারছে সকলে।অন্যদিকে সাইফার মাথার অনেক উপর দিয়ে যাচ্ছে সবকিছু।

তাকে কবুল বলতে বললে কেঁদে উঠে সে।কপাল কুঁচকে নিলো শাবাব।পরিবেশ পরিস্থিতি বিবেচনা না করেই স্বাভাবিক গলায় বললো,

-“কবুল বলতে বলেছে কান্না করতে বলেনি।”

টলমলে চোখে চাইলো সাইফা। সাইফার বাবা মা খানিকটা অবাক হলেও রুনা বেগম তাদের সামলে নেন।ছেলেটাকে নিয়ে আর পারা গেলোনা।বিয়েকেও কেস হিসেবে নিচ্ছে।এই লোকটা এমন কেনো?মস্তিষ্ক আর মন উভয়েই এই প্রশ্নের উত্তর চেয়েই যাচ্ছে।নাক টানতে টানতে মুখ ফুটে তিন কবুল বলে ফেললো।বিবাহ সম্পন্ন হয়েছে। রেজিস্ট্রি পেপারে সই করে নেয়।

রাতের আঁধারে ছাদে এসে হাজির সাইফা।একাকী পা গুটিয়ে বসে। প্রচন্ড রকমের অসস্তি কাজ করছে তার মধ্যে। শাবাবের মুখোমুখি হতে অজানা এক ভয়।হাতের মধ্যে রুনা বেগমের দেওয়া মোটা বালাটা চিকচিক করলো।এটাই হয়তো তাদের বিয়ের প্রথম নিশান। বিয়ে হয়ে গেছে তার? শাবাবের সাথে?এটা মানার মতন?

-“একা দাঁড়িয়ে আছো কেনো?”

পুরুষালি ভরাট কণ্ঠে রুহ কেঁপে উঠলো।পিছনে তাকানোর সুযোগটা নেই।সামনের দিকে চেয়ে ছোট করে উত্তর দেয় সাইফা,

-“এমনেতেই”

বড়বড় কদম ফেলে সাইফার পাশে এসে দাঁড়ালো শাবাব।তাকে নতজানু হয়ে বসে থাকতে দেখে সেও পা গুটিয়ে বসেছে। কিছু সময় বাদে বলে উঠলো,

-“একটু সময়ের প্রয়োজন।আমি উন্মুক্ত কোনো বইয়ের পৃষ্ঠা নই যে সহজেই পড়ে ফেলতে পারবে।সময় অনেক আঘাত সারিয়ে তোলে।আবার এই সময়ই একটি ছোট্ট আঘাতকে ঘাতক ব্যাধিতে পরিণত করে।”

সাইফা হাতের বালা ঘুরাতে ঘুরাতে প্রশ্ন করলো,

-“লিয়ানাকে ভালোবাসতেন?”

সিদ্ধান্ত সমুদ্র পাড়েই দাঁড়িয়েই নিয়েছে।তাই কোনো প্রকার নীরবতা ছাড়াই চট করে জবাব দিল,

-“ধরে নাও কিছু অনুভূতির সৃষ্টি হচ্ছিলো দুই বছর আগে।তারপর হঠাৎ থেমে গেছে।এখনই অনুভুতিগুলো স্থির আছে সেই জায়গায় ই।”

-“ওর জায়গাটা আমি চাইবো না কোনোদিন।”

শাবাব স্মিথ হাসলো।বললো,

– “স্মৃতির পাতায় নাম উঠেছে লিয়ানার।বর্তমান,ভবিষ্যতে তোমার নাম উঠেছে।শুনতে কথাগুলো স্বার্থপরের মতন শোনালেও আমি চাইনা তোমার অনুভূতিগুলো থেমে যাক আমার মতন করে।”

সাইফা মুচকি হাঁসলো মাথা নুয়ে। শাবাবের এই শীতল কন্ঠটা শুনতে চেয়েছে কতবার।এই সেই সৌভাগ্য হলো।সাথে নিজেকে শাবাবের বর্তমান আর ভবিষ্যতের অংশ জেনে আরো ভালো লাগায় ভরে উঠছে মন।

-“লিয়ানা থাকলে আমি কখনো আসতাম না আপনাদের দুজনের মধ্যে।”

-“সেটা কি ভাগ্যে লেখা ছিল?ভাগ্যে সেটা লেখা ছিলো যা ঘটেছে, ঘটছে।আমাকে মতন জড়বস্তুকে ভালোবাসা দিয়ে গেছে লিয়ানা।আর ওই ভালোবাসাটা তোমাকে দেওয়ার চেষ্টা করবো।….বললামতো সময় লাগবে।”

-“হুম”

-“তোমার উপর দয়া করছি না সাইফা।যে ভুল আগে করেছি সেটা শুধরে নিয়ে নিজের উপর দয়া করছি।আমার শান্তি ভীষণ প্রয়োজন।হয়তো কখনো এই রুক্ষ মেজাজ আমার বদলাবে না।তবে তোমার অসম্মান হয় এমন কিছুই করবো না।আমার বাজে কথার মধ্যকার অর্থটা বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করতে হবে।না বুঝলে নিজে অযথা কষ্ট পাবে।”

শাবাব ঘুমিয়েছে অনেক সময় পেরোয়।জমিনে মাথা ঠেকিয়ে ছিলো। সাইফা মাথাটা তুলে নিলো শক্ত মাটি থেকে।অধিকার খাটিয়ে কোলে মাথা রেখেছে।কি অদ্ভুত মানুষ?ছাদে এই ধুলো বালির মধ্যে দিব্যি শুয়ে পড়েছে।ছন্নছাড়া একটা ভাব।মাঝেমধ্যে বলতো মাটি থেকে এসেছি মাটিতেই ফিরে যাবো।হয়তো সময়ের ব্যবধানে ক্ষত সেরে উঠবে।স্বাভাবিক হয়ে উঠবে সবকিছু।আলাপ করতে করতে কখন এই কাণ্ড ঘটিয়েছে খেয়াল করেনি সাইফা। কুকিয়ে উঠছে খানিক বাদে বাদে।নিষ্পাপ শিশুর মতন দেখালো মুখটা চাঁদের আলোয়।কেমন যেনো অনুভূতি?অন্যের ভালোবাসা নিজের করে পেয়ে অপরাধী মনে হচ্ছে আবার নিজের ভালোবাসার পূর্ণতায় হৃদয় খুশিতে দুলছে।

সাইফা আকাশপানে মুখ তুলে বললো,

-“তুমি আমাকে যা দিয়ে গেছো আমি তাকে শেষ নিঃশ্বাস অব্দি যতনে রাখার চেষ্টা করবো লিয়ানা।”

সমাপ্ত~

[ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন]