#আলিঙ্গনে_ভালোবাসার_মোহ_জেগে_উঠে
#পর্ব_০১
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu
“আফিফার হবু বর মারা গিয়েছে, এই বিয়ে হবে না।” তিক্ত বাক্যটা কর্ণকুহরে আসতেই সমস্ত বিয়ে বাড়ি নিস্তব্ধ হয়ে গেল। আফিফা তার হবু বরের জন্য বধু সেজে অপেক্ষা করছিল। তার হবু স্বামী মারা গিয়েছে বাক্যটা আফিফার কর্ণে পৌঁছাতেই সে চমকে উঠল! চিন্তায় সমস্ত মস্তিষ্ক অকেজো হয়ে গেল। বুদ্ধিরা জোট বেঁধে পালিয়েছে। ভেতরটা শূন্যতায় ভরে উঠল। রিমির মুখে এমন কথা শুনে আফিফার বাবা নিজাম সিকদার ধপ করে জমিনে বসে পড়লেন। আফিফা দৌড়ে এসে বাবার পাশে বসলো। সে উদ্বিগ্ন হয়ে বলল,
“তুমি চিন্তা করো না আব্বু আমার কিছু হবে না। আমি ঠিক আছি আমি থাকতে তোমাকে কেউ কথা শোনাতে পারবে না।” নিজাম সিকদার নিস্তেজ হয়ে বসে রয়েছেন। আফিফার আঁখিযুগল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। সে বিয়ে করতে পারবে না বলে তার আঁখিযুগল ভিজেনি৷ তার আঁখিযুগল ভিজেছে বাবার বিধস্ত মুখশ্রী দেখে। চারদিকে কোলাহল সৃষ্টি হলো কিছু তিক্ত বাক্য কর্ণকুহরে এসে পৌঁছাল।
“এই মেয়ে অপয়া বিয়ে না হতে হবু স্বামী মারা গেল!”
“এই মেয়ে যার ঘরে যাবে তার ঘরটা আঁধারে পরিপূর্ণ হয়ে যাবে।”
“এই মেয়েকে কে বিয়ে করবে?”
“আপনি সমাজে কিভাবে মুখ দেখাবেন নিজাম সিকদার?”
“আমাদের বল্টুর সাথে আফিফার বিয়ে দিয়ে দিন।”
বিষাক্ত বাক্য গুলো ধারালো অস্ত্রের মতো বুকে এসে বিঁধছে। কায়ার সমস্ত হাড় ভাঙা ব্যথা অনুভব করছে আফিফা৷ আরহান বাবা এবং বোনের করুন অবস্থা দেখে দিশেহারা হয়ে পড়লো। সে দ্রুত আফিফার কাছে এগিয়ে এলো। নিজাম সিকদার জ্ঞান হারিয়েছে। আফিফা এবং আরহান বাবার জ্ঞান ফেরালো। নিজাম সিকদারের জ্ঞান আসতেই মেয়েকে বুকের মধ্যে আগলে নিল। সে অস্থির হয়ে শুধালো,
“তোর কি হবে মা? আমি যে তোর সবচেয়ে বড় সর্বনাশটা করে ফেললাম। তুই আমাকে বলেছিলি তুমি অনার্স শেষ করে বিয়ে করবি। আমি এতদিন ধৈর্য ধরলাম আর কয়টা দিন ধরতে পারলাম না।”
বাবার বলা প্রতিটি বাক্য আফিফার ভেতরটা রক্তাক্ত করে দিচ্ছে। সে বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছে। কথা বলার কোনো শক্তি সে ভেতর থেকে সঞ্চয় করতে পারছে না৷ আরহান আফরাতের দিকে দৃষ্টিপাত করল। আফরাতের সমস্ত মুখশ্রীতে গম্ভীরতা ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে। আফরাতের মা মরিয়ম তালুকদার নিজাম সিকদারের কাছে এগিয়ে আসলেন। সে নিজাম সিকদারের পাশে বসে নিম্ন কণ্ঠে শুধালো,
“আমি আপনার সাথে কিছু কথা বলতে চাই ভাইজান। আমি জানি কথা গুলো আপনার কাছে মূল্যহীন লাগবে। তবুও আমি আপনার কাছে এই আর্জিটা করতে চাই। আপনি আমাকে ফিরিয়ে দিবেন না, আশা করছি।” মরিয়ম তালুকদারের কথায় স্থির দৃষ্টিতে মরিয়ম তালুকদারের দিকে দৃষ্টিপাত করল নিজাম সিকদার। আজ শিকদার পরিবার জুড়ে হাহাকার নেমে এসেছে। সেই হাহাকার শুষে নিতে মরিয়ম তালুকদারের আগমন! ব্যাপারটা ভিষণ সুন্দর!
“আপনি আমার ছেলের বন্ধুর মা। আপনার স্বামী আমার খুব ভালো বন্ধু ভাবি। আমি আশা রাখছি এমন কোনো কথা বলবেন না। যেন আমি এবং আমার মেয়ে ভেতর থেকে আঘাতপ্রাপ্ত হই।” নিজাম সিকদারের কথায় মরিয়ম তালুকদার দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। সে শান্ত কণ্ঠে বলল,
“আমি আফিফার সাথে আমার আফরাতের বিয়ে দিতে চাই। আপনি যদি অনুমতি দেন তাহলে এই আসরেই আফিফা বিয়ে হবে।” মরিয়ম তালুকদারের কথায় চমকে উঠল উপস্থিত সবাই! নিজের থেকে তিন বছরের বড় মেয়েকে বিয়ে করবে আফরাত? আফরাতের মুখশ্রীর কোনো পরিবর্তন হয়নি৷ সে আগের ন্যায় গম্ভীর মুখশ্রী করে দাঁড়িয়ে আছে। আফিফার মুখশ্রীর বদল এসেছে। সে বিস্ময় নয়নে মরিয়ম তালুকদারের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। নিজাম সিকদার কিছুক্ষণ ভাবলো। সে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
“আমি রাজি ভাবি। আপনার ছেলেকে বিয়ের জন্য রাজি করান।”
“আমার ছেলে বিয়ের জন্য প্রস্তুত আপনি আফিফাকে রাজি করান।”
“আমি এই বিয়ে করব না আব্বু। নিজের থেকে তিন বছরের ছোট ছেলেকে আমি কিভাবে বিয়ে করব!” আফিফার কথায় স্নিগ্ধ হাসলেন মরিয়ম তালুকদার। তার হাসি দেখে বিরক্ত হলো আফিফা। মরিয়ম তালুকদার আফিফার মস্তকে হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
“নিজের থেকে ছোট ছেলেকে নিয়ে করা কি পাপ মা? তোমার আংকেলের আমি দু’বছরের বড়। এই কথাটা কেউ জানে না আজকে তোমাকে বললাম। তুমি তো বিয়েই করবে মা পাপ তো আর করবে না। একটা ছেলে যদি তার থেকে চার-পাঁচ বছরের ছোট মেয়েকে বিয়ে করতে পারে। তাহলে তুমি কেন তিন বছরের ছোট ছেলেকে বিয়ে করতে পারবে না। বিয়ের পরে তোমাকে শশুর বাড়ি যেতে হবে না। তুমি তোমার বাড়িতে থাকবে আর আফরাত আমার বাড়িতে থাকবে। আফরাতের যখন একটা ভালো চাকরি হয়ে যাবে। তখন তোমাকে আমাদের বাড়িতে তুলে নিয়ে যাব। এখন সবকিছু তোমার ওপরে নির্ভর করছে মা। তোমার অমতে কিছুই হবে না। তুমি রাজি ঢাকলে বিয়ে হবে, না থাকলে বিয়ে হবে না।” মরিয়ম তালুকদারের কথায় সবাই বিস্মিত হলো! আফিফাও ভিষণ আবাক হলো। নিজাম সিকদার আহত কণ্ঠে শুধালো,
“তুই আর অমত করিস নে মা। তুই এই বিয়েতে রাজি হয়ে যা।” আফিফা থমকালো কোনো বাক্য কণ্ঠনালিতে এসে পৌঁছাচ্ছে না। সে ধরে আসা কণ্ঠে বলল,
“তোমার মস্তক খারাপ হয়ে গিয়েছে আব্বু। নিজের থেকে তিন বছরের ছোট ছেলেকে কিভাবে বিয়ে করব? আমি বিয়ে করলেও সমাজ কি আমাদের মেনে নিবে?”
“তুই বিয়ে না করলে সমাজ কি তোকে মেনে নিবে মা? সমাজ তো অনেক কিছুই চায়। তুই সমাজের সকল আবদার পূরন করতে পারবি? তুই যদি এই বিয়ে না করিস। তাহলে আমাকে অনেকটা অসম্মানিত হতে হবে মা।”
“যার সাথে বিয়ে দিবে সে রাজি তো বাবা?” আফিফার কথায় নিজাম সিকদার আফরাতের কাছে গেল। আফরাতের মস্তকে হাত বুলিয়ে শুধালো,
“তুমি আমার মেয়েকে বিয়ে করবে বাবা?” আফরাত গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“বিয়ের শব্দ পুরুষ মানুষকে ঈদের আনন্দ দেয়। বিয়ে করতে পারলেই বোধহয় পুরুষ মানুষ সবচেয়ে সুখী। সেখানে আফিফা আপুর মতো সুন্দরী মেয়ে বউ হিসেবে পেলে কোনো কথাই নেই। আপনি একটা পরীর জন্য জিনের কাছে আবেদন করতে এসেছেন। এত সুন্দর পরী পেলে জিন কি নাকচ করতে পারে! এমন লাল টুকটুকে বউ দেখে আনন্দে নাচতে ইচ্ছে করছে। আপনি কি আমার শশুর হবেন আব্বা?” আফরাতের কথায় লজ্জা পেল নিজাম সিকদার। ছেলেটা দারুন দাম্ভিক কিন্তু কথা বলে অসাধারণ! তা আজকেই উপলব্ধি করতে পারল নিজাম সিকদার। পেটে ক্ষুদা অনুভব করলে যেমন খাবারের গুরুত্ব বোঝা যায়। ঠিক তেমনই বিপদে পড়লে মানুষ চেনা যায়। যে ছেলেটাকে সে সহ্য করতে পারতো না। সেই ছেলেটাই তাকে আনন্দ দেওয়ার প্রয়াস চালাচ্ছে।
ভারাক্রান্ত হৃদয় নিয়ে আফিফা এবং আফরাতের বিবাহ সম্পূর্ণ হয়েছে। আফিফা অনবরত অশ্রু বিসর্জন দিয়ে যাচ্ছে। সে কিছুতেই আফরাতকে স্বামী হিসেবে মেনে নিতে পারছে না। মেনে নিবেই বা কিভাবে? যাকে এতদিন ছোট ভাই হিসেবে জেনেছে। তাকে কি আর হুটহাট স্বামী হিসেবে মানা যায়! তাও মানুষটা তার থেকে তিন বছরের ছোট। আফিফার ভেতরটা হাহাকার করে উঠল। অনুভূতিরা শূন্য হয়ে গিয়েছে। শহরের অলিতে-গলিতে বিরহ মিছিল করছে।
বাড়িতে প্রবেশ করেই আফরাতে মস্তক জ্বলে উঠল। সে আশেপাশের সবকিছু চূর্ণবিচূর্ণ করে ফেলছে। আফরাতের মতো শান্ত মানুষের হঠাৎ কি হয়ে গেল! সে কি এই বিবাহে খুশি নয়? আফরাতের ক্রোধের কারন কেউ উদ্ধার করতে পারছে না। মরিয়ম তালুকদার ছেলের কাছে এসে শুধালো,
“আফরাত, কি হয়েছে? তুমি এমন উন্মাদের মতো আচরণ করছো কেন?” মায়ের প্রশ্নের আফরাত রাগান্বিত হয়ে শুধালো,
“বিয়ে করেছি বউ রেখে দূরে থাকার জন্য! তুমি আমার বউকে কেন তার বাপের বাড়ি রেখে আসলে? আমি তোমাকে এক সেকেন্ড সময় দিব না। তুমি এখনই আমার বউ এনে দিবে। আমি একটা মুহুর্ত বউ ছাড়া থাকতে পারব না৷ হয় আমাকে বউ এনে দিবে নয়তো বা আমাকে ঘর জামাই বানিয়ে দিবে।” আফরাতের কথায় মরিয়ম তালুকদার বিস্ময় নয়নে ছেলের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। তালুকদার বাড়ির প্রতিটি মানুষের মুখে লাজুক হাসি। আফরাত সবাইকে উপেক্ষা করে বউ এনে দাও বউ এনে দাও যব করতে লাগলো।
চলবে…..