ইচ্ছের উল্টোপিঠ পর্ব-০৫

0
916

#ইচ্ছের_উল্টোপিঠ
#পর্ব_৫
#আভা_ইসলাম_রাত্রি

ঐশী বাসের সামনে পিছনে , ডানে বামে তাকালো। কিন্তু কিছুই বুঝতে পারছে না কি হচ্ছে। পাশের ছেলেটা খুব আরামসে সিটে গা এলিয়ে বসে আছে। যেন যা হচ্ছে তা নিয়ে তার কোনো মাথাব্যথা নেই। ঐশী বিরক্ত হলো। কোনো উপায় নেই পেয়ে পাশের বসা ছেলেকে মৃদু সুরে বলল,

” এক্সকিউজ মি ? ”

ছেলেটা কি শুনলো ওর কথা? ঐশীর এভাবে যেচে পড়ে ডাকতে কেমন যেন বাঁধছে। কিন্তু উপায় নেই। বাসের দায়িত্বহীন ড্রাইভারদের অবহেলার কথা আজকাল প্রতিনিয়িত খবরে দেখাচ্ছে। ঐশী আবারও মুখ ঘুরিয়ে ছেলেটার দিকে তাকালো। ফোন স্ক্রল করছে। ঐশী এবার নিজেই উঠে এলো। বাসের ড্রাইভার এর কাছে এসে দেখলো ড্রাইভার আর হেলপার কিছু একটা কথা বলছে আর ড্রাইভ করছে। ঐশী ওদের দিকে তাকিয়ে বললো,

” এক্সকিউজ মি , আপনারা কি কোনো কিছু পোড়ার গন্ধ পাচ্ছেন। ”

হেল্পার ঐশীর কথা শুনে আঙ্গুল উচিয়ে নিজের জোরালো গলায় বললো,

” জ্বী আমি তো সেই কখন থেকে পাচ্ছি। এই কাকু আমার কথার কোনো গুরুত্ব দিচ্ছে না। আমার মনে হয় ইঞ্জিনে কিছু হইসে। ”

ঐশী সব শুনে কঠিন চোখে ড্রাইভারের দিকে তাকালো। ড্রাইভারটা দাঁত কেলিয়ে বললো,

” আসলে, আমার নাক বন্ধ ছিল। তাই গন পাই নাই। দাড়ান। আমি দেখতাছি। ”

ঐশী ভ্রুকুটি করে নিজের সিটে এসে বসলো। ড্রাইভার রাস্তার এক সাইডে গাড়ি পার্ক করে বাস থেকে বেরিয়ে গেলো। একটু পর বাসের হেলপার বাসে উঠে এসে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল,

” সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি । আমাদের বাসের ইঞ্জিন পুড়ে গেছে। তাই বাস এখন আর গন্তব্যে পৌঁছাতে সক্ষম নয়। আমরা খুবই দুঃখিত। আপনারা সবাই নিজ নিজ ভাবে ঢাকায় ফিরে যান। এখান থেকে ঢাকা মাত্র দুই ঘণ্টার রাস্তা। তবে একটা উপায় আছে। আমাদের ঢাকার বাসগুলো অন ডিউটি আছে।আপনারা চাইলে আমরা ময়মনসিং থেকে আরেকটা বাস আনাতে পারি। তবে অনেক সময় লাগবে। ততসময়ে অন্য গাড়ি দিয়ে ঢাকা পৌঁছানো সম্ভব। আমরা আসলেই আমাদের সার্ভিস নিয়ে অত্যন্ত দুঃখিত। ”

ঐশী ভ্রু উচু করে তাকালো। বাসের সবার চোখে মুখে বিরক্তি। কিন্তু ঐশীর চিন্তা ,ও একা একটা মেয়ে এতদূর যাবে কি করে ? ক্ষতি হলে ?

জুভান হেলপারের কথা শোনে ইয়ারপড খুলে মোবাইল থেকে চোখ তুলে তাকালো। ইঞ্জিন পুড়ে গেছে শুনে জুভানের চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো। এসব কিসের সার্ভিস ? আগে থেকে দেখে রাখবে না ? আজ ওই শাহাদাতের সাথে কড়া গলায় দুটো কথা না বললেই হচ্ছে না। জুভান নিজের ব্যাগ কাঁধে উঠিয়ে বাস থেকে নেমে গেলো। এক এক করে বাসের বাকি সবাই নেমে গেলো। ঐশী আর কোনো উপায় না পেয়ে নিজেও ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে গেলো বাস থেকে।

জুভান একটু দূরে হেঁটে যাচ্ছে। ঐশী আর কোনো উপায় নেই পেয়ে সাইড ব্যাগ শক্ত করে ধরে জুভানের পিছনে পিছনে হেঁটে এলো। জুভান ঐশীকে আসতে দেখে হাঁটা বন্ধ করে পিছন ফিরলো। সেদিনের মেয়েটা ওর পিছু পিছু আসছে কেনো ? ভ্রু কুঞ্চিত করে বললো,

” হোয়াই আর ইউ ফলোয়িং মি ? ”

ঐশী জুভানের কথা শুনে থমকে গেলো। কি উত্তর দিবে ? ঐশী চোখ সরু করে এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে বললো,

” আপনি কি ঢাকা যাবেন ? ”

ঐশীর কথা শুনে জুভানের কুঞ্চিত ভ্রু আরো কুঞ্চিত হয়ে গেলো। কেমন প্রশ্ন ? একসাথে ঢাকার বাসে উঠেছে তার মানেই ঢাকাই যাচ্ছে। জুভান কোমরে হাত ধরে বললো,

” হ্যাভ ইউ লস্টেড ? ঢাকার বাসে ছিলাম আমরা। ”

ঐশী নিজের বোকামি বুঝতে পেরে জিভ কাটলো। জুবানকে এখনো দেখেনি ঐশী। মাস্ক পড়া , মাথায় আর্মিদের মত ক্যাপ। সর্বোপরি চেনা মুশকিল। ঐশীকে চুপ থাকতে দেখে জুভান কোনো রিয়েক্ট করলো না। পকেট থেকে ফোন বের করে কাকে যেনো কল দিল। ফোন রিসিভ হলে জুভান বলল,

” গাড়ি পাঠাও। আমি অ্যাড্রেস সেন্ড করছি। কুইক।”

” …..”

” কুইক। ”

জুভান দ্বিতীয় কথা না বলে ফোন কেটে দিলো। ঐশী জুভানের দিকে অসহায় নজরে তাকালো। জুভান সেটা লক্ষ্য করে ফোনের দিকে তাকিয়েই বললো,

” কিছু বলার থাকলে বলো নাহলে গেট লস্ট । ”

ঐশীর কিছুটা রাগ লাগলো। এমনভাবে কথা বলছে কেনো এই লোক ? এত ভাব কিসের ? পরক্ষণে ঐশী ভাবলো না তাকে মাথা গরম করলে চলবে না। এই লোকটাই এখন শেষ ভরসা। ঐশী জুভানের থেকে দূরত্ব রেখে আরো একটু সরে গেলো। ওর দিকে তাকিয়েই বললো,

” আমাকে লিফট দিবেন আপনার গাড়িতে ? ”

জুভান ফোনের দিকে তাকিয়েই ভ্রু কুচকে ফেললো। লিফট ! জুভান ফোন অন রেখেই ঐশীর দিকে ফিরলো। বললো,

” ভয় করে না ? একটা অচেনা ছেলের কাছে লিফট চাইছ ? ”

ঐশী কথাটা শুনে ভিতর ধক করে উঠল। আসলেই লিফট চাইছে তাও একটা অজানা ছেলের কাছে ! কেন ? সে জানে না। ঐশী নিজেকে সাহসী দেখাতে মাথা নেড়ে বলল,

” ভয় কেন পাবো ? আপনি বাঘ না ভাল্লুক। ”

জুভান কিছুসময় ঐশীর দিকে তাকিয়ে আবারও ফোনের দিকে তাকালো । বললো,

” সেটা তোমরা মেয়েরাই ভালো জানো। ”

ঐশী জুভানের কথা শুনে আক্রোশ নিয়ে বললো,

” কটা মেয়ের সাথে চলেছেন আপনি ? সব মেয়ে এক না। যেমন আমি। আমি আপনাদের মত ছেলেদের ভয় পাইনা। ”

জুভানের হাসি পেলো ঐশীর কথা শুনে। কিন্তু হাসি ব্যাপারটা ওর ডিকশনারিতে নেই। তাই হাসি আটকে বললো,

” জাস্ট ফরগেট ইট। ”

ঐশী পায়ের কাছে একটা কালো রঙের পাথর লাথি দিয়ে রাস্তার একটু দূরে সড়িয়ে বললো,

” আপনি ভালো আছেন। তাই সব ভেবেই লিফট চেয়েছি। নাহলে কি চাইতাম ? ”

জুভান অবাক হলো। ফোন থেকে চোখ তুলে ঐশীর দিকে তাকালো। চমক কণ্ঠে বললো,

” আমি ভালো ! কে বলেছে তোমাকে ? ”

” নাহলে মাঝরাত পর্যন্ত একটা মেয়ে আপনার পাশে বসেছিল। চাইলে তো অনেককিছু করতে পারতেন। যেমন হাতে টাচ করা , গায়ে এনিয়েবিনিয়ে হাত লাগানো। কিন্তু আপনি তো ফিরেও তাকান নি। তাই বুঝেছি।আর এই বাসে তো একটাই মেয়েও নাই। মাত্র একটা ছোট পিচ্ছি মেয়ে ছিল। যুবতী বলতে আমি একাই ছিলাম। তাই আর কাউকে বিশ্বাস না করে আপাতত আপনাকেই করলাম। ”

জুভান বুঝতে পারলো মেয়েটা একটু বেশিই কথা বলে। সে এই কথার প্রতিউত্তর না করে আবারও ফোনে মশগুল হয়ে গেলো।

ঐশী সাইড ব্যাগ থেকে ফোন বের করে ওর বাবাকে কল দিল। কিন্তু বন্ধ দেখাচ্ছে। ঐশী প্রায় অনেকবার কল দিল। কিন্তু বারবার বন্ধ দেখাচ্ছে। ঐশী রাগে ফোনটা ঝট করে আবার ব্যাগে রেখে দিল। বুকে হাত গুটিয়ে মুখ ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। মনে মনে বুলি আওয়ারালো ” বাবা খুব খারাপ। খারাপ। খারাপ। ”

গাড়ি এসে গেছে ওদের। জুভান পিছন সিটের দরজা খুলে বসে গেলো। ঐশী জুভানের দিকে তাকালো। জুভান ঐশীকে এখনো গাড়িতে উঠতে না দেখে বিরক্ত হয়ে বললো,

” হোয়াট ? সং এর মত দাঁড়িয়ে আছো কেন ? না গেলে বলো। আমি চলে যাচ্ছি। ”

ঐশী চোখ নামিয়ে এদিক ওদিকে তাকিয়ে আবারও জুভানের দিকে তাকালো। ভয় ভয় গলায় বললো,

” আপনি কি সামনে বসবেন। একসাথে এভাবে পিছন সিটে …”

জুভান এক নিঃশ্বাস ফেলে পিছন সিটের দরজা খুলে সামনের সিটে এসে বসে গেল। ঐশী ব্যাগ শক্ত হাতে আকড়ে ধরে ধীরে ধীরে পিছনের সিটে এসে বসলো।

গাড়ি চলমান। গাড়ির ড্রাইভার একনজরে সামনে তাকিয়ে ড্রাইভ করছে। জুভান ফোন স্ক্রল করছে। ঐশী ব্যাগে সেফটিজোন হিসেবে একটা লাল মরিচ গুঁড়ো এর স্প্রে এনেছিল। সেটা ব্যাগ থেকে বের করে নিজের হাতে লুকিয়ে আকড়ে ধরলো। যতই হোক একটা ছেলেকে বিশ্বাস করা উচিত না। তাই এই ব্যবস্থা।

গাড়ি ঢাকার অনেকটাই কাছে চলে এসেছে। জুভানের মাস্ক পড়ায় গরম লাগছিলো। তাই সে মাস্ক খুলে এসির তাপমাত্রা বাড়িয়ে দিল। ঐশী প্রথমে জুভানকে লক্ষ্য না করলেও এখন সামনে বসে থাকা এই চিরচেনা মির্জা কে দেখে চমকে যায়। কপাল ঘামতে থাকে।এই চরিত্রহীন মির্জার সাথে সে এতক্ষণ এতটা পথ পাড়ি দিয়েছে। আর ও চিনলই না ! কিভাবে ? ঐশী জুভানকে দেখে ভয় পেতে শুরু করে। কিছু ক্ষতি করবে না তো ? ঐশী মরিচ স্প্রে টা আরো জোরে আকড়ে ধরে চিৎকার দিয়ে বলে,

” স্টপ দা কার। আই সে স্টপ দা কার রাইট নাও। ”

জুভান অবাক চোখে পিছন ফিরলো। ঐশী ভয়ে প্রায় কেঁদে দেওয়ার মত অবস্থা। জুভান ভাবছে , হটাৎ করে কি হলো এই মেয়ের ?

#চলবে