ইস্ক পর্ব-২৯

0
586

#ইস্ক
#সাদিয়া

২৯
সেদিন ইয়াদের শাস্তি ছিল বিকেল বেলায় লং ড্রাইভে নিয়ে যেতে হবে তিতিল কে। অফিস ফেলে প্রায়শই তাকে তিতিলের এমন কিছু শাস্তি মাথা পেতে নিতে হয়। ভুলের শাস্তি তো মানতেই হতো।

শহরের কোলাহল হতে সবে নিরিবিলি রাস্তা ধরে এগিয়ে যাচ্ছে গাড়ি। খোশগল্পে মেতে উঠেছে দুজন। রাস্তার পাশে একটা ঝালমুড়ির দোকান দেখে তিতিল জোরে বলে উঠল,
“থামুন থামুন।”

ইয়াদ ব্রেক কষে বিরক্ত কন্ঠে বলে উঠল “আবার কি?”

“ঝালমুড়ি?”

“কি?”

“খাবো।”

ইয়াদ পিছন ফিরে দেখতে পায় ওপাশে একজন ঝালমুড়ি নিয়ে বসেছে। পরিশেষে সিলবেল্ট খুলে হাটা দেয় ওখানে। যাওয়ার আগে স্পষ্ট করে বলে যায় তিতিল যেন এখান থেকে না নড়ে। বাধ্য মেয়ের মতো গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়িয়ে থাকে এক পাশে।

তিতিল তাকিয়ে দেখতে পেল ইয়াদ ঝালমুড়ি হাতে নিয়ে এদিকে আসছে। মাঝে মাঝে দু একটা গাড়ি ফুল স্পিডে সাই সাই করে দূরে সরে যাচ্ছে। নীরব রাস্তা বলে অনায়াসে গাড়ি এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। দেখতে দেখতে চোখের সামনে কি হয়ে গেল বুঝল না তিতিল। অবাক হয়ে কাঠের প্রাণহীন পুতুলের মতো ঠাই দাঁড়িয়ে রইল। হাত থেকে ধুপ করে ফোন টা নিচে পড়ে গেল তার। চোখের সামনেই এমন বিদঘুটে কান্ড হয়ে গেল। ইয়াদ নিস্তেজের মতো রাস্তায় উবু হয়ে পড়ে আছে। রাস্তায় রক্ত পড়ে ভয়ংকর দেখাচ্ছে। তিতিল যেন বিশ্বাসই করতে পারছে না এটা। কি থেকে কি হয়ে গেল? রাস্তায় কয়েকজন মানুষ জড়ো হতে দেখা গেল। তিতিলের চোখ ঝাপসা হতে শুরু করেছে এখন। ওই তো ইয়াদ রক্তাক্ত অবস্থায় রাস্তায় শুয়ে আছে।

ইনা মেয়েটা বেশ কঠিন স্বভাবের। শেষবার মনে হয় বাবার মৃত্যুতে কান্না করেছিল। চোখের পানি ফেলতে ফেলতে ইনা হসপিটালে এলো। দুই ভাই বোন কে নিজের থেকে বেশি ভালোবাসে কিনা! মাকে কোনো রকম বুঝিয়ে হিমার কাছে রেখে এসেছে সে। উনার আবার প্রেশার বেড়ে গেছে বলে ডাক্তার পাঠিয়েই দৌড়ে এসেছে এখানে। ইয়াদের কিছু হলে বুকের ভেতর খুব ব্যথা হয় তার। হন্তদন্ত হয়ে হসপিটালে এসেই একজন কে জিজ্ঞেস করে ইয়াদের কেবিনে ঢুকল। বিছানায় নিস্তেজের মতো পড়ে আছে ছেলেটা। পায়ে, হাতে, কপালে ব্যান্ডেজ। ডাক্তার তিতিল কে বলছিল “দেখুন উনার পা টার অবস্থা তেমন ভালো না। ৩ মাসের আগে কোনো প্রেশার দিতেই পারবেন না। সম্পূর্ণ বেড রেস্টে থাকতে হবে। তাছাড়াও মাথার আঘাতটা এতটা গুরুতর না হলেও খেয়ালে রাখতে হবে। ঔষধ গুলি নিয়মিত খাওয়ালে আর যত্ন নিলে আশা করি তাড়াতাড়ি সেরে উঠবেন উনি। ও হ্যাঁ ১ মাস পরপর চেকআপ করাতে নিয়ে আসবেন।” তিতিল মাথায় সম্মতি জানাল। কথা বের হচ্ছে না তার। কেঁদে কেটে একদম বাজে অবস্থা। সে ত্রাসগতিতে এগিয়ে যায় ইয়াদের কাছে। হাত ধরে হুহু করে আবার কেঁদে উঠে মেয়েটা।

ইনা গিয়ে ভাইয়ের এমন অবস্থা দেখে বেশ রেগেই যায়।
“তিতিল খুব বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে না বিষয়টা? এতটা ন্যাকামো করার কি দরকার ছিল? প্রতিদিন কোনো না কোনো বায়না থেকেই যায় তোমার। দেখো তোমার জন্যে ভাইয়ের আজ এ কি অবস্থা। এত ন্যাকামো না করলেই কি নয়? অফিস, কাজ, ক্লাইট রেখে ছেলেটা তোমার আবদার রাখতে ছুটে। আর কত হ্যাঁ? এবার খুশি হয়েছো তো? দেখো কি করে বিছানায় পড়ে আছে।”

ইনার চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল কথার ফাঁকে। তিতিল ইনার দিকে তাকিয়ে থাকে অসহায়ের মতো। ইনা রাগে কথা গুলি বললেও তার বেশ খারাপ লাগে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলতেই তিতিল তাকে জড়িয়ে ধরে আবার কেঁদে উঠে। এমন ঘটনায় ইনা অনেকটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। তিতিলের মাথায় আলতো হাত রেখে বলে “সরি তিতিল। ভাইয়ের কষ্ট আমার সহ্য হয় না। তুমি চিন্তা করো না দেখবে ভাই একদম ঠিক হয়ে যাবে। কান্না থামাও।”
তিতিলের কান্নার বেগ আরো বাড়ে। হঠাৎ অস্পষ্ট একটা স্বরে তার নাম শুনা যায় “তিতিল।”

ইনা এবং তিতিল দুজনেই তাকায় তার দিকে। ইয়াদ আধোআধো চোখে তাকিয়ে আছে। হাতটা উঁচু করার চেষ্টা করছে সে। তিতিল দৌড়ে গিয়ে ইয়াদের হাত ধরে। বলে “কষ্ট হচ্ছে তোমার?”

ইনা তিতিল কে বলল “তোমরা কথা বলো আমি বাহিরে আছি।”

ইনা চলে যাওয়ার আগে ইয়াদ মৃদু স্বরে ডাকে “আপু।”

দ্রুত ইনা এগিয়ে গেল ইয়াদের কাছে। অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করল “ভাই এখন কেমন লাগছে?”

ইয়াদের শরীর বেশ দূর্বল হওয়ায় কোনো রকম বলল ‘ ভালো ‘। বিষয়টা ইনা বুঝতে পেরে বলে “হয়েছে আর কথা বলার দরকার নেই ভাই। কষ্ট হলে বলিস কি সমস্যা। আমি বাহিরে আছি। তিতিলের এখানে থাকুক।”
ইনা চলে গেলে তিতিল ইয়াদের ব্যান্ডেজ না করা হাতটা ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে। ইয়াদ বেশ কষ্ট করে তাকে কাঁদতে মানা করলেও মেয়েটা নীরবে কেঁদে যায়। নাক টেনে কিছুক্ষণ ফুপায়। তারপর ধরে আসা গলায় বলতে থাকে “আমি আর কখনোই এমন করব না। আমার ভুল হয়ে গিয়েছে। তোমার শাস্তি শেষ হয়ে গিয়েছে। আর শাস্তি দিব না আমি। তুমি তাড়াতাড়ি ঠিক হয়ে যাও শুধু।” বলা শেষ করতেই আবার কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে সে।

ইয়াদ মুখ শক্ত করে তিতিলের হাতের মাঝ থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিতেই অসহায় আর ভীতিগ্রস্ত ভাবে তিতিল তাকায় তার দিকে। তবে কি ইয়াদ এবার তাকে ভুল বুঝবে? তার শাস্তির পরিপ্রেক্ষিতে তাকে কি শাস্তি পেতে হবে? কিন্তু আজ তো ইয়াদ কে সে অন্য এক কারণে নিয়ে এসেছিল। বলার আগেই শরীর কাটা দেওয়া ওমন ভয়ংকর বিদঘুটে একটা ঘটনা ঘটে গেল। এসব ভাবতে ভাবতে নিজের হাতের উপর একটা ভরসার হাতের স্পর্শ পেল সে। মাথা উঁচু করে তাকাতেই দেখতে পেল ইয়াদ স্লান হাসছে। আধোআধো গলায় বলছে,
“পাগলি তুমি আমায় জ্বালাতন করবে, আমায় শাস্তি দিবে আবার রাতে আমার ঘুমন্ত মাথাটা নিজের উষ্ণ বুকে আগলে চেঁপে ধরবে। আমার শেষ দিনটাতেও এমন রূপে চাই আমার তিতিলপাখি। বড্ড ভালোবাসি।”
তিতিল কিছু বলতে পারল না। হু হু করে কেঁদে উঠল। একটা মানুষ কি করে এত ভালোবাসতে পারে সে ধারণা করতে পারে না। কি করে মনে করবে এই মানুষটা একটা সময় তাকে কষ্ট দিয়েছিল? অথচ এত ভালোবাসা দিয়ে সে আগের সব কথা বুলিয়ে দিয়েছে তার মন থেকে। কষ্টের পর সুখ তো সূর্যোদয়!

ইয়াদের হাতে আলতো করে চুমু খেলো তিতিল। তারপর সেই হাতটা গালের সাথে চেঁপে অনুভব করতে থাকে দীর্ঘ সময় নিয়ে।

ইয়াদ আলতো হাসল। এই মেয়েটার নাম তার বক্ষস্থলে খোদাই হয়ে আছে। জীবনের শেষ নিশ্বাসটা এভাবেই এই মেয়েটা কে পাগলের মতো ভালোবেসে পাড় করতে চায়।

“আমি আপনাকে আজ এমনি এমনি নিয়ে আসি নি এখানে।” নাক টেনে বলে তিতিল।

“তবে?”

“বলব না।”

“আমি কষ্ট পাচ্ছি তাও বলবে না?”

তিতিল জবাব দেয় না। শুধু মাথা নাড়ে। ইয়াদ মুচকি হেসে তার গালের দিকে হাতটা বাড়িয়ে দিতেই তিতিল জলদি হাত ধরে নিজেই নিজের গালের উপর রেখে চোখ বন্ধ করে।

“ময়নাপাখি বলো না কেন লং ড্রাইভিং এ যেতে চেয়েছিলে? বিশেষ কারণটা কি?”

ইয়াদ আজ অনেক দিন পর তাকে ‘ময়নাপাখি’ বলে ডেকেছে। এখন আবেশে মেয়েটা যেন ভাসছে। মুচকি হেসে সে উঠে দাঁড়াল। তারপর ইয়াদের হাতটা আস্তে করে নিজের পেটের উপর রেখে লজ্জা ভঙ্গিতে মাথা নিচু করে নিল। ইয়াদের শরীর টা যেন কেঁপে উঠল নিমিষে। বুঝতে তার বেগ পেতে হয় নি। শরীরটা কিরূপ যে কাঁপন ধরেছে স্নিগ্ধ শিহরণে তা তিতিল কে বুঝাতে পারবে না সে। কাঁপাকাঁপা শুকনো ঠোঁটে সে বিড়বিড় করে বলল “আমার স সন্তান?”
তিতিল চোখ তুলে তাকাল। ইয়াদের চোখ তখন টলমল করছিল পানিতে। তিতিল দেখতে পেল টপটপ করে কয়েক ফুটা পানি গড়িয়ে পড়ল। শান্ত গলায় শুধু বলল “তুমি খুশি হও নি?” তিতিলের এমন কথা শুনে হুট করে তিতিলের কোমর টেনে কাছে এনেই পেটে মুখ গুঁজে বাচ্চাদের মতো শব্দ করে কান্না করে দিল। তিতিল বরফের মতো জমে গেছে ইয়াদের এমন কান্ডে। এটা তো সেই ইয়াদ যাকে সে তাকে হারানোর জন্যে প্রথম শব্দ করে কেঁদেছিল। এত বড় একটা এক্সসিডেন্ট হয়েও যে চোখের পানি ফেলেনি সে তার বাচ্চা আসার কথা শুনে এতটা কান্না করছে?

“তিতিল তুুই জানোস না আজ আমাকে কতটা খুশি করে দিলি তুই। আ আমার সন্তান আসবে দুনিয়াতে। আমার রক্ত। আমার অস্তিত্ব। তিতিল আমি আজ দুনিয়ার সব চেয়ে বেশি সুখী মানুষ। হাজার শুকরিয়া আল্লাহ কে আমাকে এত বড় নিয়ামত রূপি উপহার দেওয়ার জন্যে। আমার বাচ্চা!” ঠিক ভাবে কথা বলতে পারছিল না ইয়াদ। তিতিল ঢোক গিলল। ইয়াদের মাথায় আলতে হাত বুলাল। ইয়াদের কান্নায় তার চোখ দিয়েও পানি পড়তে লাগল। সে নিজেও হয়তো এতটা উত্তেজিত হয়নি টেস্ট করার পরে। অথচ এই লোকটা.. তিতিল দাঁত কিটে শক্ত করে জড়িয়ে নিল ইয়াদ কে।

ইয়াদ তার ঘাড়ের পিছনে হাত নিয়ে টেনে কাছে আনল। শুকনো ঠোঁট জোড়া ডুবিয়ে দিল তিতিলের মাঝে। পরম আবেশে ওষ্ঠদ্বয় স্পর্শ করেছে কি না!

চলবে।