উড়ো পাতার ঢেউ পর্ব-৩১+৩২+৩৩

0
335

#উড়ো_পাতার_ঢেউ
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ৩১
_________________

জোনাস হোয়াইট রঙের কাপটাতে গ্রিন টি ঢাললো ইরতিজার জন্য। কাপটা এগিয়ে দিতে দিতে বললো,
“তুমি আর কিছু খাবে টিজা?”

ইরতিজা কঠিন মুখে বসে রয়েছে। পাথুরে দৃষ্টি জোনাসের উপর। জোনাসের এখানে আসা সে মেনে নিতে পারছে না। সবচেয়ে বড়ো ধাক্কা খেয়েছে এটা শুনে যে–জোনাস না কি নিজের গ্র্যাজুয়েট কমপ্লিট করবে সিয়াটলে। সিয়াটল ইউনিভার্সিটিতে এডমিট হয়েছে সে। ইরতিজা ভাবছে ছেলেটার মাথায় নির্ঘাত সমস্যা আছে। এত পাগলামি করার মানে কী? কিছুক্ষণ আগে যে পাগলামিটা করলো সেটার জন্য তো ইরতিজা নিজের মেজাজ সংযত রাখতেই হিমশিম খাচ্ছিল। জোনাস তাকে জো/র করে নিজের বাসায় নিয়ে এসেছে। ঠিক সেই আগের বার যেরকম মুখ চে/পে ধরে নিয়ে এসেছিল, ঠিক এবারও তাই করেছে। ইরতিজা বাসার বাইরে থাকা ডাস্টবিনে কিছু খালি খাবারের প্যাকেট ফেলতে এসেছিল। ঠিক সে সময়ই পিছন থেকে জোনাস তার মুখ চেপে ধরেছিল। অসভ্যর মতো আচরণ হয়েছে জোনাসের!

জোনাস থাকে একটা দুই তলা বাড়ির চিলেকোঠায়। একটা কামরা। কামরার পাশে একটুখানি কিচেনের মতো জায়গা আছে। জায়গাটা পরিসরে ছোটো হলেও খুব পরিপাটি।

ইরতিজা বললো,
“আমি মনে করি তোমার এখান থেকে চলে যাওয়াই ভালো জন।”

“চলে যাব বলে আমি আসিনি। তোমার জন্যই এখানে আসা আমার। সুতরাং এমন কথা বলো না।”

“আমার জন্য কেন আসবে তুমি এখানে?”

“কারণ দূর থেকে তোমাকে ঘৃণা করতে কষ্ট হয়। কাছাকাছি থাকলে রোজ তোমার সাথে দেখা হবে, আর দেখলেই ঘৃণাবোধ হবে মনে। দূর থেকে ঘৃণা করার চেয়ে কাছাকাছি থেকে ঘৃণা করাটা সহজ না?”

জোনাসের কথাগুলো ইরতিজার মনে ঘৃণার সৃষ্টি করছে। সে মুখে স্পষ্ট ঘৃণা এবং বিরক্তি ফুঁটিয়ে তাকিয়ে রইল।
জোনাসও নির্নিমেষ তাকিয়ে রইল ইরতিজার দিকে। হঠাৎই কী মনে করে আসনকৃত টুলটা নিয়ে এগিয়ে এলো ইরতিজার দিকে। একেবারে ইরতিজার কাছে এসে বসতেই ঘাবড়ালো ইরতিজা। ভীষণ চমকে উঠলো। মুখ ফসকে কথাটা বেরিয়ে এলো তার,
“হোয়াট আর ইউ ডুয়িং জন?”

ইরতিজা তড়িৎ গতিতে উঠে দাঁড়াতে চাইলো টুল ছেড়ে, কিন্তু ওঠার আগে জোনাস তার হাত দুটো খপ করে ধরে ফেললো।
ইরতিজা এতে আরও বেশি চমকে উঠলো। জোনাস বললো,
“আমি কাছে আসলেই তুমি চলে যেতে চাও কেন টিজা? আমি তো তোমায় ভালোবাসি না। মানুষ ভালোবাসার মানুষের কাছে এলে এমন পালিয়ে বেড়ানোর চেষ্টা করে। তবে কি তুমি আমায় ভালোবাসো?”

ইরতিজা এমন একটা কথা শোনার জন্য প্রস্তুত ছিল না। তাই হঠাৎই এমন একটা কথা তাকে পুরো স্থির করে দিলো। তবে তার অন্তরিন্দ্রিয়তে এমন কোনো অনুভূতির ঝলকানি হলো না যা দ্বারা তার মনে হবে জোনাস ঠিক বলছে। ভালোবাসার অনুভূতি কেমন হয়? ইরতিজা নিজের মাঝে খারাপ লাগা এবং বিদঘুটে অনুভূতি ছাড়া আর কিছু খুঁজে পেল না। ভালোবাসার অনুভূতি নিশ্চয়ই এমন নয়। ইরতিজার মনে হচ্ছে সে ইতোমধ্যে ভালোবাসার অনুভূতির সাথে পরিচিত হয়েছে। কিন্তু যার জন্য সেই অনুভূতি সেটা জোনাস নয়।

ইরতিজা কিছু না বলে তাকিয়ে ছিল। জোনাস ইরতিজার পুরো বদনখানিতে চোখ বুলিয়ে বললো,
“তুমি কি আগের চেয়ে সুন্দর হয়ে গেছো সুইটহার্ট?”

“তোমার চোখ ভুল দেখছে।”

জোনাস স্মিত হেসে বললো,
“আমার আগে এত রোগ ছিল না। তুমি রিজেক্ট করে দেওয়ার পরই নানান রোগ বাসা বেঁধেছে শরীরে। দেখেছো, চোখেও ইদানিং ভুল দেখতে শুরু করেছি।”

“হাত ছাড়ো।”

“ধরে রেখেছি না কি?”

ইরতিজা হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো। জোনাস শক্ত করে তার হাত দুটি ধরে রেখেছে। ইরতিজা চোখ কঠিন করে তাকালো।
জোনাস ছেড়ে দিলো হাত। বললো,
“এই হাত ছেড়ে দেবো, আবার ক্ষণে ক্ষণেই আঁকড়ে ধরবো। কিন্তু এমন একটা সময় আসবে, যখন আমি পুরো তোমাকেই ব’ন্দি করে ফেলবো আমার অন্তঃখাঁচায়। তখন ‘ছাড়াছাড়ি’ হয়ে যাবে অতীত। আঁকড়ে ধরাই হবে বর্তমান, ভবিষ্যৎ।”

ইরতিজা ফট করে দাঁড়িয়ে গিয়ে বললো,
“তুমি একজন সাইকোলজিস্টের কাছে যাচ্ছ না কেন জন? আই থিংক তোমার ট্রিটমেন্ট দরকার!”

“আমাকে পা’গ’ল বলছো?”

“বলতে বাধ্য হচ্ছি। তুমি আগে এমন ছিলে না। অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছো এখন। এই তুমিটাকে চিনে উঠতে এবং মানতে এখন খুব কষ্ট হয় আমার!”
ইরতিজার কণ্ঠে গভীর বেদনার স্পর্শ। চোখের কার্নিশে বিন্দু বিন্দু জল জমলো। আসলেই পুরোনো প্রিয় বন্ধুটা খুব পরিবর্তন হয়ে গেছে এখন! অতীতের সুন্দর বন্ধুত্বটা এখন কদর্য হয়ে উঠেছে!

“আমার এমন হওয়ার পিছনে তুমিই দায়ী। সেদিন আমাকে গ্রহণ করে নিলে সবকিছু সুন্দর থাকতো। তুমি অযথাই আমাদের সম্পর্কটা নষ্ট করে দিয়েছো!”

“আমি না, তুমি। তোমার করা ওই কাজটা আমি কোনোদিন ভুলবো না। তুমি আমার পরিবারের মাঝে ভুল একটা ধারণার সৃষ্টি করিয়ে আমার জীবনটা এলোমেলো করে দিয়েছো!”

“আমি ভুল কিছু করিনি।”

“এখনও বলছো তুমি ভুল করোনি?”

জোনাস কিছু না বলে তাকিয়ে থাকলো খানিক সময়। অতঃপর বললো,
“তোমার রেডমন্ডের ওই নিউ ফ্রেন্ডটা খুব অ’স’ভ্য টিজা।”

ক্যানিয়লের সম্পর্কে জোনাসের মুখ থেকে এমন একটা কথা শুনতে একদমই ভালো লাগলো না ইরতিজার। কথাটার জন্য তার রাগও হলো জোনাসের উপর। বললো,
“নিজে কতটা অ’স’ভ্য সেটা আগে চিন্তা করো। অন্যের ব্যাপারে পরে চিন্তা করবে। আর হ্যাঁ, রেডমন্ড এসেছো ভালো কথা, আমাদের ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছো সেটাও ভালো কথা। কিন্তু দয়া করে আমাকে আর জ্বালাতন করো না। আর কখনও সামনে এসো না আমার!”

ওই কথাটুকু বলেই বেরিয়ে এলো ইরতিজা। অন্তঃকরণে দোল খাচ্ছে কষ্টের হাওয়া। জোনাসের কাছ থেকে দূরে থাকাই তার জন্য ভালো। জোনাসকে না দেখলে, জোনাসের সাথে কথা না হলে তার মনে পড়ে না জোনাসকে। বুকে কষ্ট অনুভবও হয় না। অথচ জোনাস তাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য এখান অব্দি চলে এসেছে। এমন কেন করলো জোনাস? ইরতিজা এটা নিয়ে এখন আর ভাবতে চাইলো না।

জোনাস যে বাড়ির চিলেকোঠাটা ভাড়া নিয়েছে সেটা একেবারে ইরতিজাদের এরিয়ার পিছনের দিকে অবস্থিত। এ বাসার ছাদ থেকে দেখা যায় দূরে লেকের টলমলে জল। ওদিকটার সৌন্দর্যে তাকিয়ে ইরতিজার হঠাৎ ক্যানিয়লের কথা মনে পড়লো। গতরাতে ফোন করে কী অদ্ভুত একটা কথা বললো ক্যানিয়ল তাকে। ইরতিজা বড়ো করে নিঃশ্বাস ফেলে সিঁড়ি বেয়ে নামতে লাগলো।
সন্ধ্যার আবছা আলোয় মৃদু শীতল হাওয়ার পরশ যখন ইরতিজার মনকে উদ্বুদ্ধ করলো, তখন তার মনে হলো–হ্যাঁ, তারা একে অপরের প্রেমে পড়েছে! কিন্তু কখন, কীভাবে এই প্রেমের জন্ম হলো জানে না। কী অদ্ভুত! ধীরে ধীরে মানুষের অনুভূতি কোথা থেকে কোথায় গিয়ে ঠেকে!
ইরতিজার মনে সহসা কথাগুলো জাগ্রত হয়ে ওঠে,
‘ধীর লয়ে প্রেম আসিয়া বসত গড়িছে মনে,
হে বিদেশি পা’জি, আমি ভালোবেসে ফেলেছি তোমারে!’

শেষের কথাটাতে ইরতিজা নিজেই হেসে উঠলো। বিদেশি পা’জি! ক্যানিয়লের সাথে নামটা আসলেই সুন্দর মানায়।

__________________

আজ আবারও একটা হুমকিমূলক কল এসেছে ক্যানিয়লের কাছে। নাইলা সালেমের মতিগতি সে ঠিক বুঝতে পারছে না। নাইলা সালেম এসব অব্যাহত রেখে কি এটা প্রমাণ করতে চাইছে যে, সে আসলে এসবের পিছনে নেই? কিন্তু এটা প্রমাণ করতে চেয়ে যে লাভ নেই, সে জানে এসবের পিছনে নাইলা সালেমই আছে! ক্যানিয়ল বাসা থেকে বের হলো। আজ সে নিজের মেইন বাড়িতে ছিল। লনে নেমে দেখলো পুরো ফ্যামিলি আজ লনে উপস্থিত আছে। আজ ছুটির দিন যে। ভাই-বোনদের ভিতর একটা খেলায় অংশগ্রহণের প্রস্তুতি চলছে। মূলত ব্যাডমিন্টন খেলা হবে। ভাই-বোনদের সাথে এই খেলাটায় কখনও অংশগ্রহণ করেনি ক্যানিয়ল। সামুরার সাথে খেলেছে বেশ কয়েকবার। এছাড়াও স্টিভেনের সাথেও খেলাটা খেলা হয়েছে অনেক। পরিবারের সকলের উপস্থিতিতে লনটাকে কেমন অপূর্ব সুন্দর লাগছিল। তাদের ফ্যামিলি তো বিশাল বড়ো ফ্যামিলি। তবে ড্যাড নেই এদের ভিতর। ক্যানিয়ল আরও একটা বিশাল শূন্যতা লক্ষ করলো। তার মমও নেই! বুক কেমন ব্যথা করে উঠলো। সকলের চক্ষুর পাশ কাটিয়ে ক্যানিয়ল গ্যারেজের দিকে এগোচ্ছিল। ইয়াদার বড়ো ছেলে এবং ভাই-বোনদের ভিতর সবচেয়ে সিনিয়র ভাইটা অকস্মাৎ ডেকে উঠলো ক্যানিয়লকে,
“হেই ক্যানি…”

ক্যানিয়ল পিছন ফিরে একটু জোর পূর্বক হাসার চেষ্টা করে বললো,
“ইয়েস…”

“মিরান্ডার সাথে তোমার ঝগড়া হয়েছে কোনো বিষয়ে?”

“ঝগড়া? আমার মনে হচ্ছে না লাস্ট পাঁচ মাসে ওর সাথে আমার কখনও ঝগড়া হয়েছে।”

“কিন্তু মিরান্ডা আমাকে এমনটাই বলেছে। যাই হোক, ও তাড়াতাড়িই ফিরে আসছে দেশে। তোমাকে জানাতে বললো।”

“স্বাভাবিক। বিদেশ গিয়েছে তো ফিরে আসার জন্যই। পার্মানেন্ট থাকবে এমন কোনো নিয়ত করে তো যায়নি।”

“কথা সেটা না। ও ফিরলে খুব তাড়াতাড়িই ওর সাথে তোমার বিয়ে দেওয়ার চিন্তা-ভাবনা চলছে।”

ক্যানিয়ল নিঝুম হয়ে গেল। নির্জন দ্বিপ্রহরের মতো কী যেন চিন্তা করলো খানিক সময় ধরে। তারপর চোখ তুলে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
“আমার মনে হচ্ছে না আমি মিরান্ডাকে বিয়ে করবো!”

কথাটায় উপস্থিত সকলে চমকালো। যারা আরকি মনোযোগী ছিল ওদের কথাবার্তায়। মাদার সোফিয়া, ইয়াদা এবং নাইলা সালেম একসাথে বসে ছিলেন একটা টেবিলকে ঘিরে থাকা চেয়ারে। মাদার সোফিয়া ক্যানিয়লের কথা শুনে এগিয়ে এলেন,
“কী বলছো উমরান?”

“স্যরি মাদার সোফিয়া, এই বিয়েটা বোধহয় হবে না। কারণ আমি যে চাই না এই বিয়েটা হোক।”

“চুপ করো, তোমার ড্যাড কথাটা শুনলে কতটা রেগে যাবে ভেবেছো?”

“তিনি রেগে যাবেন, আমাকে মৃ’ত্যুদণ্ড দেওয়ার জারি তো প্রদান করবেন না। সুতরাং ভাবনা কীসের? আমি মৃ’ত্যু’কে ভয় করি মাদার সোফিয়া। অন্য কিছুকে ভয় করে জীবন অসুখী করতে পারব না।”

“মিরান্ডাকে বিয়ে করে তুমি অসুখী হবে বলে তোমার ধারণা?”

“হয়তো ধারণাটা সঠিক, হয়তো বা না। হয়তো আমি কাউকে পছন্দ করি, হয়তো বা না!”

বলে ক্যানিয়ল পা বাড়িয়ে দিলো। ওর শেষের কথাটা শুনে সবাই কিংকর্তব্যবিমূঢ়। কী বলে গেল ছেলেটা?
গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে ক্যানিয়ল। গাড়িটা ধীর গতিতে এগিয়ে চলছে। ওর পাশের সিটটাতে পড়ে আছে এক গুচ্ছ ভায়োবিন ফুল। সঙ্গীহীন মানবটা যেন এই এক গুচ্ছ ফুলকেই আজকের মতো নিজের সঙ্গী করে নিয়েছে। আজ সে বেলভিউ সময় কাটাতে যাবে। আর তার সাথে থাকবে এই একগুচ্ছ ভায়োবিন ফুল।
সে একাকী স্বভাবের। কিন্তু হঠাৎ করে তার এই স্বভাবটাকে আর পছন্দ হচ্ছে না। কেন সে বরাবর বিষাদের সুবিশাল আকাশ মাথার উপর নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে? সে খুব করে চাইতো, একটা উজ্জ্বল নক্ষত্র একদিন হুট করে তার বিষাদের আকাশে জ্বলে উঠে চমকে দিক তাকে। কিন্তু সেই নক্ষত্র দেখা যায়নি। বছরের পর বছর কেটেছে। তবে সে তার ভাবনার মতোই হুট করে একটা জিনিস দেখে চমকে উঠেছে ঠিকই। সে দেখতে পেয়েছে তার বিষাদের আকাশে খুব ঝাপসা করে যেন একটা নক্ষত্র দেখা যায় আজকাল। কী আজব, না?
ক্যানিয়ল হঠাৎ কল করে বসলো ইরতিজাকে। ওপাশ থেকে কলটা রিসিভ হলো দেরি করে।
ক্যানিয়ল বললো,
“হেই ছিঁচকাঁদুনে মেয়ে, ঘুমিয়ে আছো এখনও? আমার সাথে এমন আজব খেলা করা বন্ধ করো। নাহলে একদম জানে মে/রে ফেলবো তোমাকে।”

ফোনের ওপাশে থাকা ইরতিজার শরীর এমন বি’ভী’ষি’কাময় কথার দরুণ কেঁপে উঠলো।

(চলবে)

#উড়ো_পাতার_ঢেউ
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ৩২
_________________

ক্যানিয়লের গাড়িটা ইরতিজাদের বাসা হতে খানিক দূরে পার্কিং সাইডে এসে দাঁড়িয়েছে। সে নামলো গাড়ি থেকে। এগিয়ে যেতে লাগলো ইরতিজাদের বাসার দিকে।
দরজায় নক করলো। পরপর চারবার নক করার পর দরজা খুললো। সামনের ব্যক্তিটা দরজা খুলে কেবল দেখলো তাকে, সাথে সাথেই অপ্রস্তুতভাবে জোরে শব্দ করে বন্ধ করে ফেললো দরজাটা।
এমন একটা ঘটনায় হতবিহ্বল হয়ে গেল ক্যানিয়ল!

ইরতিজার হৃদস্পন্দন স্বাভাবিক থেকে অস্বাভাবিক মাত্রায় বেড়েছে! বাইরে কি সে এইমাত্র ক্যানিয়লকে দাঁড়ানো দেখলো? চোখের ভ্রম হয়নি তো আবার? ইরতিজা বিষয়টা খতিয়ে দেখতে ডোর ভিউতে উঁকি দিলো। ক্যানিয়লের কিংকর্তব্যবিমূঢ় মুখটা চোখে পড়লো তার। হৃদয়ের ঢিপ ঢিপ শব্দটা ক্রমশ বেড়ে চলছে। ক্যানিয়ল তার বাড়িতে এসেছে কেন? আবার দরজায় পড়া করাঘাতে ইরতিজার কর্ণকুহর কম্পিত হয়ে উঠলো। ওপাশ থেকে ক্যানিয়লের গাম্ভীর্য ভরাট কণ্ঠ শুনতে পেল,
“হেই পাকিস্টানি গার্ল, ডোর ওপেন করো। আমার মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিয়ে কি তুমি আমাকে অপমান করার চেষ্টা করছো? দরজা খো’লো বলছি।”
ক্যানিয়লের কণ্ঠে আদেশের সুর।

ইরতিজার মুখে ভীতির ছায়া। ক্যানিয়ল যেরকম উচ্চ গলায় কথা বলছে এতে তো অন্যদের কানে গিয়েও পৌঁছবে ওর কণ্ঠস্বর। যদিও কেউ এখন বাসায় নেই। পাশের ইউনিট, অর্থাৎ চাচাদের বাসায় গিয়েছে। বিরিয়ানি রান্না হয়েছে তাদের বাসায়, তাই খাওয়ার দাওয়াত দিয়েছিল। ইরতিজাও এখনই যেত তাদের ওখানে, কিন্তু এরই মধ্যে ক্যানিয়ল এসে গেল। ক্যানিয়লকে এরকম বাসার সামনে দাঁড় করিয়ে রাখা অনুচিত মনে হলো। সে ফট করে বেডরুমে গিয়ে একটা ওড়না মাথায় জড়িয়ে নিয়ে এসে দরজা খুললো।
ক্যানিয়ল বলে উঠলো,
“তোমার সাহস দেখে আমি স্তব্ধ ইজা!”

“কী চাই? আমার বাড়িতে কেন এসেছো?” ক্যানিয়লের কথায় কর্ণপাত না করে বললো ইরতিজা।

“তোমাকে চাই। কি/ড/ন্যা/প করতে এসেছি তোমাকে।”

ইরতিজা ভ্রু কুঞ্চন করে বললো,
“হোয়াট?”

“শুধু পাঁচ মিনিট সময় আছে তোমার কাছে। আমার সুন্দর গাড়িটা ওখানে দাঁড়িয়ে আছে, ঠিক পাঁচ মিনিট পর চলে আসবে ওখানে। বাই দ্য ওয়ে, তোমার পরিবারের বাকি সদস্যরা কোথায়?”
ক্যানিয়ল দেখার জন্য ইরতিজাকে উপেক্ষা করে বাসার ভিতরে দৃষ্টিপাত করলো।

“আমার পরিবারের সদস্যদের দিয়ে তোমার কাজ কী? নিজের গাড়ির কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকো। আসছি আমি।”
কোনো রকম ঝামেলাযুক্ত কথা না বলে বিষয়টা মিটমাট করে নিলো ইরতিজা।
ঠিক পাঁচ মিনিটের মাথায় বের হলো বাসা থেকে। কর্টইয়ার্ডে নওরিনের সাথে দেখা হলো।

“কোথায় যাচ্ছ?”

“এই কাছেই। এখনই এসে পড়বো।”

ইরতিজা চরণ ফেলতে লাগলো খুব ধীরে। কারণ নওরিন এখান থেকে না যাওয়া পর্যন্ত তো সে ক্যানিয়লের গাড়ির ওখানে যেতে পারবে না। ইরতিজা বিভ্রান্ত বোধ করছিল। এই সময় নওরিনের মোবাইলে আসা ফোনকলটা তাকে বাঁচিয়ে দিলো। নওরিনের কর্মক্ষেত্রের একজন লোক কল করেছে। নওরিন কথা বলতে বলতে বাসার অভ্যন্তরে চলে গেল।
ইরতিজা সুযোগ পেয়ে দ্রুত পা চালিয়ে এলো। ক্যানিয়ল গাড়ির ভিতরে বসে আছে। ইরতিজা জানালা দিয়ে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো,
“এখানে আসতে বলেছো কেন?”

“গাড়িতে উঠে বসো।”

“কেন?”

ক্যানিয়ল দরজাটা খুলে দিয়ে বললো,
“ওঠো।”

ইরতিজা উঠে বসলো। তবে ওঠার সময় ক্যানিয়ল হঠাৎ তাকে থামিয়ে দিয়েছিল,
“স্টপ স্টপ…এই পিচ্চি ভায়োবিন ফুলগুলোর উপর যদি তোমার মতো বৃহৎ একটি প্রাণী উঠে বসে তাহলে তো এগুলো মৃ’ত্যু বরণ করবে।”
ক্যানিয়ল ফুলগুলো সরিয়ে রেখেছে সিট থেকে।

“সিটবেল্ট বেঁধে নাও।” ইরতিজাকে বললো ক্যানিয়ল।

“মানে কী? আমরা কি এখন কোথাও যাব?”

“ইয়াহ, বেলভিউ।”

“বেলভিউ?” চোখ কপালে উঠলো ইরতিজার।
“নামবো আমি।”

“কেন?”

“তোমার কী ধারণা, আমি শুধু তোমার একার সাথে বেলভিউ যাব?”

“যাবে না? কিন্তু আমি একা তো তোমার সাথে নেই। তোমার ওপাশেই তো আরও একজন বসে রয়েছে।”

ইরতিজা চকিতে একবার নিজের অন্য পাশে তাকালো। তারপর আবার ক্যানিয়লের দিকে ফিরে বললো,
“মজা করছো?”

“তুমি দেখতে পাচ্ছ না? অবশ্য দেখতে না পাওয়ারই কথা। এদের যে দেখতে পাওয়া যায় না। অনুভব করতে হয় এদের অস্তিত্ব।” শেষের কথাটা বলতে বলতে ক্যানিয়লের কণ্ঠস্বর নিচু হয়ে আসছিল।

“আমি কোনো কিছু অনুভব করতে পারছি না, আর অনুভব করতে চাচ্ছিও না। দরজা খুলে দাও, নামবো।”

“নেমে যাবে বলে কি তোমাকে গাড়িতে উঠতে বলেছি? উঠেছো যখন চুপচাপ বসে থাকো। নয়তো চুপচাপ রাখারও ব্যবস্থা আছে আমার কাছে।”
ক্যানিয়ল সামনের একটা ড্রয়ার খুলে দেখালো। যেখানে ছোটো একটা ধারালো ছু/রি শোভা পাচ্ছে।
“আশা রাখি এটাকে নিশ্চয়ই তুমি ভুলে যাওনি।”

ইরতিজা চুপচাপ হয়ে গেল। ভয় পেয়ে চুপ হয়েছে এমনটা না, এমনিতেই চুপ হয়ে গেছে সে। এমন পা/জি একটা ছেলের প্রেমে পড়েছে ভাবতেও লজ্জায় মাথা নত হয়ে আসছিল তার। হুট করে আফসোস বোধও করলো। আফসোস বোধের কারণ, ক্যানিয়লের কথা অনুযায়ী ওর কাছে আসতে গিয়ে সে বিরিয়ানি মিস করেছে।

গাড়ি বেলবিউতে প্রবেশ করার পর সোজা চলে এলো বেলভিউ ডাউনটাউন পার্কে। ইরতিজার এই পার্কে ঘুরতে আসার ইচ্ছা হয়েছিল আরও অনেক আগেই। কিন্তু সেখানে সে এসেছে আজ অনেক অনেক দিন পর। তাও কি না আবার অনাহুতভাবে।
বেলভিউ ডাউনটাউন পার্কটি ২০ একর জায়গা জুড়ে অবস্থিত। যা ওয়াশিংটন, সিয়াটলের একটি শহরতলির বেলভিউ শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত। পার্কটিতে একটি বৃত্তাকার বলয় রয়েছে, যার চারপাশে একটি পরিখা এবং হাঁটার পথ রয়েছে। এটি উত্তরে বেলভিউ স্কয়ার মল, পূর্বে বেলভিউ ওয়ে এবং দক্ষিণে প্রধান রাস্তার মধ্যে অবস্থিত।
পার্কের পশ্চিম সীমানা বরাবর একটি পার্কিং লট নির্মিত। পার্কের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে নির্মিত একটি বিশ্রামাগার এবং শিশুদের খেলার জায়গা। পার্কিংয়ে গাড়ি রেখে নামার পর ক্যানিয়ল ইরতিজাকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে নিলো একবার। ইরতিজার মাথায় ভায়োলেট রঙের হিজাব। পরনেও একটা ভায়োলেট কুর্তি। নিজের প্রিয় ভায়োবিন ফুলদের রঙে ইরতিজাকে দেখতে পেয়ে হঠাৎই ভীষণ ভালো লাগলো তার। হাতের ভায়োবিন ফুলগুলো ইরতিজার হাতে দিতে দিতে বললো,
“চেয়েছিলাম আজ শুধু এই ফুলগুলো সঙ্গে নিয়ে ঘুরবো, কিন্তু হুট করে এদের রানিও সঙ্গে চলে এলো। ভায়োবিন ফুলদের রানি মিস ভায়োলেট কুইন, ভায়োবিনদের রঙে ভালোই মানিয়েছে তোমায়। আজ আমার সঙ্গে দুই সঙ্গী আছে। এক এই ভায়োবিন, আর দ্বিতীয় তাদের রানি! আমি এখন আর একা নই। আমার বিষাদ আকাশেও এখন একটা নক্ষত্র দেখা যায়।”

বলে ভারি মিষ্টি একটা হাসি উপহার দিয়ে ওদিকটায় হেঁটে যেতে লাগলো ক্যানিয়ল।
এদিকে ইরতিজার মন ভরে উঠলো শীতল অনুভূতির ছোঁয়ায়। এই অনুভূতিতে ভালো লাগার ঢেউ রিমঝিম নৃত্যের উল্লাসে মেতে উঠলো। সে তাকালো হাতের ভায়োবিন ফুলগুলোর দিকে। মনে মনে ভাবলো, ক্যানিয়লের বিষাদ আকাশে যে নক্ষত্রটা দেখা যায় সেটা কি সে? ইরতিজার মনে হলো ক্যানিয়লের ওই কথাটায় সে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে।

বাচ্চাদের প্লে গ্রাউন্ডটা দারুণ সুন্দর। এটা বাচ্চাদের জন্য হলেও বড়োদের উপস্থিতিও এখানে কম নয়। আজকে ছুটির দিন হওয়ায় মানুষের সমাগম বেশি লক্ষ করা যাচ্ছে। ইরতিজা ঘুরে ঘুরে দেখছিল। এর ভিতর সাত-আট জনকে নজরে পড়লো যাদের দেখে মনে হলো এরা ভারত অথবা বাংলাদেশের অধিবাসী হবে। প্লে গ্রাউন্ডে পাশাপাশি দুটো দোলনা ছিল। ক্যানিয়ল একটায় গিয়ে বসলো, ওর দেখাদেখি ইরতিজাও কিছুক্ষণ বসেছিল। এরপর ওরা গেল লেকের ওদিকটায়। গোলাকার একটা জায়গা নিয়ে অনেকটা জলে বিস্তীর্ণ এলাকা এটা। লেকের পাশ দিয়েই ওয়াকওয়ে চলে গিয়েছে পুরো লেককে প্রদক্ষিণ করে। ওরা কিছু সময় হাঁটলো লেকের পাড় ধরে। আরও অনেকে হাঁটছিল। বেঞ্চিও আছে একটার থেকে আরেকটা খানিক পরিমাণ দূরত্ব রেখে। গাছের ছায়ায় ছিল বেঞ্চিগুলো। ক্লান্ত হয়ে গেলে বসে যাও ওই বেঞ্চিতে। কোনো বাধা নিষেধ নেই।
আজকে একটু বেশি ঠান্ডা অনুভব হচ্ছে। যদিও সূর্য পূর্ণ আলো দিয়ে যাচ্ছে অবিরাম। এখানে একটা ডগ কমিউনিটি আছে। সেখানটায় গেল এরপর।
এসে দেখা গেল এখানে প্রায় সকলের কাছেই ডগ রয়েছে।
ক্যানিয়ল ইরতিজাকে একটু অপেক্ষা করতে বলে কোথায় যেন গেল।
ইরতিজা আশপাশটা দেখছিল। সকলের কাছেই সুন্দর দেখতে কুকুর রয়েছে। অনেকগুলো তো এমন সুন্দর যে মনে হয় ওগুলো কুকুর নয়, কোনো পুতুল।
ক্যানিয়ল কিছুক্ষণ পরে ফিরে এসে বললো,
“চলো।”

“এখনই ফিরে যাব?”

“তো? সবই তো ঘুরে দেখা হয়েছে। আর কী দেখা বাকি আছে?”

ইরতিজা কথা না বাড়িয়ে বললো,
“না, কিছু বাকি নেই।”

পার্কিংয়ে এসে ওরা গাড়িতে উঠলো। ইরতিজা যেতে যেতে পার্কের নামটাকে গভীর চক্ষুতে দেখছিল। আসলে এখানের কোনো কিছুই ভালো করে দেখা হয়নি তাদের। অথচ ক্যানিয়ল বললো সবই তো ঘুরে দেখা হয়েছে! যেদিক দিয়ে ওরা এসেছিল গাড়িটা সেদিকে না গিয়ে বরং উল্টো দিকে যাচ্ছে। ইরতিজা বিষয়টা লক্ষ করে বললো,
“এদিক দিয়ে যাব আমরা?”

“আমরা তো যাচ্ছি না।”

“মানে?”

“অন্য একটা জায়গায় যাব আমরা।”

“কোন জায়গা?”

________________

মাঝারি ধরনের একটা ট্রি হাউজ। সুন্দর করে সব পরিপাটি করে রাখা এই হাউজের ভিতর। সব কিছুই চকচকে পরিষ্কার। হাউজটির মালিক এখানে খুব একটা না আসলেও মনে হয় যেন এখানে কারো নিয়মিত বসবাস। আসলে এটা পরিপাটি করে রাখার জন্য লোক নিয়োগ প্রাপ্ত আছে। ক্যানিয়ল এখানে আসার আগে তাদের জানিয়ে রাখে। আর তারা সবকিছু এমন সুন্দর করে গুছিয়ে রাখে।
এই ট্রি হাউজটা ক্যানিয়লের। ওর নামেই উইল করা। রেডমন্ডে যে ট্রি হাউজটা রয়েছে সেটা মাদার সোফিয়ার প্রোপার্টি। ওটা মাদার সোফিয়ার নামে হলেও বলতে গেলে সেটা এক প্রকার ক্যানিয়লেরই। ক্যানিয়লের আসলে সব সময় এক জায়গায় থাকতে ভালো লাগে না। তাই থাকার জন্য এমন অনেক জায়গা রয়েছে ওর। যখন যেখানে খুশি সেখানে এসে থাকতে পারে। এন্ডারসন হাউজটাও মূলত মাদার সোফিয়ার। যেটা সে ক্যানিয়লের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছে।
কিছুক্ষণ আগে ইরতিজার কাছে কল এসেছিল বাসা থেকে। বাবা-মা দুজনই কল করেছিল। কোথায় আছে জানতে চেয়েছিল সেটা। বেলভিউ এসেছে জানায়নি। বলেছে এক ফ্রেন্ডের সাথে গাম ওয়াল ঘুরতে গিয়েছে। মিথ্যাটা না বলে উপায় ছিল না। সে চায়নি এটা নিয়ে কোনো প্রকার কথাকথি হোক।

ক্যানিয়ল আর ইরতিজা বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল। একজন যুবতী মেয়ে, যে মূলত ওরা আসার আগে সবটা পরিপাটি করে রেখেছে সে এসে দুই কাপ কফি দিয়ে গেল। আর স্প্যানিশ ভাষায় কী যেন বলে গেল।
ইরতিজা বুঝতে পারলো না কিছু। কী বলে গেল জানার আগ্রহও জাগলো না তার মাঝে। সে দৃষ্টি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে শুধু অরণ্যের বুকে এই এক টুকরো বাসভূমিকেই মুগ্ধ আলাপনে দেখতে লাগলো। এই জায়গাটা ভীষণ পছন্দ হয়েছে তার। লোকালয় থেকে একটুখানি দূরে। এখানে বসে প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যকে নিবিড়ভাবে অনুভব করা যায়। পাখির কলকাকলি সবুজের সমারোহের সাথে যুক্ত হয়ে সৃষ্টি করেছে নতুন মাত্রার মুগ্ধতা। শুনতে বেশ ভালো লাগছে ইরতিজার। তার খুব ইচ্ছা জাগলো এমন সবুজে বেষ্টিত অরণ্যের মাঝে দাঁড়িয়ে সে একদিন বৃষ্টি বিলাস করবে। আজ এখন যদি টুপ করে আকাশের পৃষ্ঠদেশ হতে ঝিমঝিম শব্দ করে বৃষ্টি ঝরে পড়তো তাহলে ভালো হতো না? কিন্তু বৃষ্টি তো ঝরবে না আজকে। আকাশ একেবারে ঝকঝকে। আকাশের দিকে তাকালো ইরতিজা। হঠাৎ মনে পড়ে গেল ক্যানিয়লের সেই কথাটাকে,
‘আমার বিষাদ আকাশেও এখন একটা নক্ষত্র দেখা যায়।’
ক্যানিয়লের দিকে চোখ চলে গেল। ছেলেটা দূরের পাহাড়ের চূড়ায় তাকিয়ে কাপে চুমুক দিচ্ছে।
ইরতিজার অন্যমনা চিত্তে গুড়ুম গুড়ুম গর্জনে কেমন এক উন্মাদিনী অনুভূতি ঝিরঝির করে কেঁপে উঠছে। তার সকল জাগতিক চিন্তা ধারাকে ছাপিয়ে গিয়ে সেই উন্মাদিনী অনুভূতিটা ক্যানিয়লকে বলে উঠলো,
“তোমার বিষাদ আকাশে যে নক্ষত্রটা দেখা যায় ওটা কি আমি ক্যানিয়ল?”

হঠাৎ অদ্ভুত একটা প্রশ্ন কানে এসে লাগায় চমকালো ক্যানিয়ল। ইরতিজার দিকে দৃষ্টি দিয়ে বললো,
“কী বলছো?”

“ওই নক্ষত্রটা কি আমি?”

ক্যানিয়লের দৃষ্টি শীতল। বেশ কিছুটা সময় নীরব চেয়ে রইল সে। তখন ওই কথাটা যে সে বলেছিল সেটাই তার মনে ছিল না। নিজেই চিন্তায় পড়ে গেল, তখন কি ওই কথাটা সে বেখেয়ালে বলে ফেলেছিল? যেভাবেই বলুক কথাটা, ওই নক্ষত্রটা যে ইরতিজা সেটা জানে সে। কিন্তু তবুও গলায় দ্বিধা রেখে বললো,
“ওই নক্ষত্রটা তুমিই হবে, আবার নাও হতে পারো। আমি বুঝতে পারছি না সঠিক। তবে ইদানিং একটা নক্ষত্রর অস্তিত্ব টের পাই। একটা নক্ষত্র আছে আমার বিষাদের আকাশে। তোমার কী মনে হয়? তুমিই সেই নক্ষত্র?”

ইরতিজা স্মিত হাসলো। ক্ষুদ্র একটা নিঃশ্বাস ত্যাগ করে জানতে চাইলো,
“বৃষ্টি কবে নামবে ক্যানিয়ল?”

ক্যানিয়ল নিজের প্রশ্নের উত্তরের আশায় বসে ছিল। কিন্তু ইরতিজা উল্টো তাকে আরেকটা প্রশ্ন করে সেই প্রশ্নটা চাপা দিয়ে দিলো। ক্যানিয়ল বললো,
“বৃষ্টির খোঁজ কেন নিচ্ছ? বৃষ্টি তো তোমার অপছন্দ!”

“কখনো কখনো অপছন্দের জিনিসগুলোও পছন্দের হয়ে ওঠে। যেমন তুমিই সেরকম একজন।”

ক্যানিয়ল ইরতিজার কথাটা একটু মনোযোগ সহকারে শোনার কারণে বুঝতে সক্ষম হলো। আর বুঝতে পেরেই হাসলো সে। তার হাসি দেখে ভ্রু কুঞ্চন করলো ইরতিজা।
ক্যানিয়ল হাসিটা সরাতে পারলো না ওষ্ঠাধর থেকে। হাসিটা লেগেই রইল। সরল এবং শান্ত কণ্ঠেই প্রশ্নগুলো করলো সে,
“আমি কি তোমার প্রেমে পড়েছি ইজা? না কি তুমি পড়েছো? না কি আমরা কেউই পড়িনি? না কি আবার দুজনই পড়েছি?”

প্রশ্নগুলো শুনে ধক করে উঠলো ইরতিজার বুক। মনে হলো এত কঠিন প্রশ্ন এর আগে কেউ কখনও করেনি তাকে। এমনকি পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে যে আনকমন প্রশ্নগুলো আসতো, সেগুলোও বোধহয় এত কঠিন লাগতো না!

(চলবে)

#উড়ো_পাতার_ঢেউ
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ৩৩
_________________

ক্যানিয়লের প্রশ্নগুলো ইরতিজার চিন্তা শক্তিকে অতি দুর্বল করে দিলো। এক প্রগাঢ় অনুভূতি অবশ করে ফেলতে চাইছে তার পুরোটা। ক্যানিয়লের দিকে চেয়ে থাকতে পারলো না, দুই চোখ ধরে আসছিল। দ্রুত দৃষ্টি অন্যদিকে সরিয়ে নিয়ে বসা থেকে উঠে বললো,
“আমি বাসায় ফেরার তাগিদ অনুভব করছি। এখনই বাসায় ফিরতে চাই।”
তার বুক ওঠানামা করছে দ্রুত।

ক্যানিয়ল দাঁড়িয়ে বললো,
“এতক্ষণ তো তুমি স্বাভাবিক ছিলে, হঠাৎ বাসায় যাওয়ার জন্য ছটফট করছো কেন?”
ক্যানিয়ল খানিকটা নিকটে এগিয়ে এসে বললো,
“তোমার এই অস্থিরতাই প্রমাণ করছে তুমি আমার প্রেমে পড়েছো! আমার কিন্তু মোটেই মনে হচ্ছে না আমি তোমার প্রেমে পড়েছি! তুমি কেন পড়েছো? আমার মান-সম্মান নষ্ট করতে উঠে-পড়ে লেগেছো কেন?”

এরকম কথা এই মুহূর্তে একদম শুনতে ভালো লাগছে না ইরতিজার। তাকালো ক্যানিয়লের দিকে। ছেলেটা এসব কথা বলে তাকে রাগিয়ে দিয়ে কি মজা পায়?
ইরতিজার মুখটা একেবারে বৈশাখী ঝড় হওয়াকালীন সময়ের মতো কালো রূপ ধারণ করলো। আবারও কঠিন কণ্ঠে বললো,
“আমি এখনই বাসায় ফিরতে চাই।”

“হ্যাঁ যাও, আমি তোমার বস নই যে সকল কাজ আমাকে বলে করতে হবে। তুমি তো স্বাধীন। যা ইচ্ছা করো। বাসায় ফেরার বদলে আমাজন জঙ্গলেও চলে যেতে পারো। আমি কি নিষেধ করবো?”

ক্যানিয়ল নির্বিকার ভঙ্গিতে হাউজে ঢুকলো। কোনোদিক ভ্রুক্ষেপ না করে সোজা বিছানায় এসে শরীর এলিয়ে দিলো। এক-দুই মিনিট করে কাটতে লাগলো সময়। কিছুক্ষণ পর স্প্যানিশ মেয়েটা এসে খবর দিলো,
“তোমার গার্লফ্রেন্ড তো চলে গেছে একা একা!”

ক্যানিয়ল চোখ মেলে এক পলক তাকালো মেয়েটার দিকে। মেয়েটা কৃষাঙ্গ! কিন্তু মুখটা দারুণ সৌন্দর্য দিয়ে খচিত।
ক্যানিয়ল বললো,
“রেগে চলে গেছে? রাগ দেখেছো ওর মুখে?”

“হুম সেরমকই মনে হলো।”

ক্যানিয়ল কিছু বললো না। চোখ মুদিত অবস্থায় নীরব শুয়ে রইল কিয়ৎক্ষণ। অতঃপর এক সময় বললো,
“ও আমার গার্লফ্রেন্ড নয় হেইজ। ও আমার বিষাদ আকাশের নক্ষত্র।”

কথাটা অনুধাবন করতে হেইজের বেশ কিছু সময় ব্যয় করতে হলো। কথাটার অর্থটা যখন সে বুঝতে পারলো তখন বললো,
“আমি মনে করি সেটা গার্লফ্রেন্ড হওয়ার চেয়েও আরও বেশি মূল্যবান। মিরান্ডা তো তোমার বাগদত্তা হয়েও সেই নক্ষত্রটা হয়ে উঠতে পারেনি।”

ক্যানিয়ল উঠে বসলো। উন্মুক্ত জানালা দিয়ে জংলী হাওয়া ছুটে এসে কালো-বাদামি সংমিশ্রিত চুলগুলো হালকা দুলিয়ে দিয়ে গেল। ওর শ্বেত মুখের মাঝে একরাশ সংশয়ের ধূসর নীরদ ঘাপটি মেরে আছে। লালচে ঠোঁট দুটো নির্জনতা বুনে গেল বেশ কিছু সময় ধরে। অবশেষে বললো,
“তোমার ধারণা কী বলে হেইজ? মেয়েটা কি সত্যি আমার প্রেমে পড়েছে?”

হেইজ অলিন্দে চলমান ওদের সকল কথাবার্তা শুনেছিল। এমনকি ইরতিজাকে এখানে নিয়ে আসার ব্যাপারটাতে সে খুব অবাকই হয়েছিল। এক সামুরা ব্যতীত ক্যানিয়ল এখানে আর কাউকে নিয়ে আসেনি কখনও। এমনকি মিরান্ডা আসতে চাওয়া সত্ত্বেও ক্যানিয়ল নিয়ে আসেনি। আজ যখন ক্যানিয়ল হেইজের কাছে কল দিয়ে বললো,
“একা নই, আরও একজন আছে সাথে। মিস ভায়োলেট কুইন!”
তখন হেইজ মনে করেছিল ক্যানিয়ল হয়তো মিরান্ডার কথা বলছে। কিন্তু তার ধারণা ভুল হলো।
হেইজ উত্তর দিলো,
“শুধু মেয়েটা নয়, তুমিও বোধহয় প্রেমে পড়েছো ওর।”

“বেরিয়ে যাও।” হেইজের কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথে বললো ক্যানিয়ল।

হেইজ একটু সচকিত হয়ে তাকালো। ক্যানিয়ল বললো,
“মেয়েদের আমি অপছন্দ করি, জানো সেটা?”

“নিজের মমকে ঘৃণা করো বলে পুরো মেয়ে জাতিকে অপছন্দের তালিকায় করে নিতে পারো না!”

“তুমি কি চাও তোমার বয়ফ্রেন্ডের সাথে তোমার একটা মিসআন্ডারস্ট্যান্ডিং সৃষ্টি করতে আমি সাহায্য করি?”

“ভয় দেখাচ্ছ আমায়? এভাবে?”

ক্যানিয়ল ওষ্ঠ বাঁকিয়ে হাসলো একটু। ঠোঁটে হাসি থাকলেও ভিতরে ভিতরে বড়ো একটি দীর্ঘ নিশ্বাস বেরিয়ে এসে ভিতরটাকে চুপসে দিলো তার। কোথায় যেন হাহাকারের শব্দ হচ্ছে প্রবল। যা দুই কানকে অস্বাভাবিক যন্ত্রণা দিচ্ছে। ক্যানিয়ল উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
“ও কতদূর চলে গিয়েছে বলে মনে হয়?”

“বেশি দূর যায়নি। একটু আগেই তো বের হলো।”

ক্যানিয়ল আর কিছু না বলে প্রায় দৌড়ে বের হয়ে গেল। ইরতিজা বেশি দূরে যায়নি, কিন্তু আবার কম দূরেও যায়নি। ক্যানিয়ল ওকে বাস স্ট্যান্ডে একলা বেঞ্চির উপর বসা দেখলো। গাড়িটা থামালো একেবারে ইরতিজার সামনে। ইরতিজা অন্যমনস্ক হয়ে কী যেন ভাবছিল। ভাবছিল মূলত এটা–সে মেয়েটা কি এতটাই নগণ্য যে, সে যদি ক্যানিয়লের প্রেমে পড়ে তাহলে ক্যানিয়লের মান সম্মান নষ্ট হবে? যদি মান সম্মান নষ্ট হওয়ারই ব্যাপার হয় তাহলে এখনও ওর মান-সম্মান নষ্ট হচ্ছে না কেন?
সে তো ইতোমধ্যে…

“পাকিস্টানি গার্ল!”

পরিচিত কণ্ঠস্বরটায় ইরতিজার ভাবনা ওখানটায়ই থমকে গেল। সামনে তাকিয়ে দেখলো ক্যানিয়ল গাড়ির ভিতর বসে রয়েছে। ইরতিজা দেখেও দেখলো না এমন করে চোখ সরিয়ে নিলো। যা ক্যানিয়লের সম্মানে সূক্ষ্ম ফাটল ধরালো। সে এবার কণ্ঠ গুরুগম্ভীর করে ডাকলো,
“পাকিস্টানি গার্ল…”

ইরতিজা তাকালো। গমগম কণ্ঠে বললো,
“হয়েছে কী? ডাকছো কেন?”

“তুমি যে আমাকে না জানিয়ে সত্যি সত্যি আমাজন জঙ্গলের উদ্দেশ্যে রওনা হবে আমি ভাবতেও পারিনি! একবার ভাবো তো সেখানে গিয়ে যদি তুমি হারিয়ে যাও তাহলে আমার কী হবে? তুমি হারিয়েছো তো আমাজন জঙ্গলে গিয়ে, অথচ তোমার ফ্যামিলির লোকেরা ভাববে আমি তাদের মেয়েকে কি/ড/ন্যা/প করেছি। এরপর আমাকে পুলিশে দেবে। তুমি তো জানো আমি পুলিশদের কতটা ঘৃণা করি।”

ক্যানিয়লের কথাগুলোকেও বিশেষ গায়ে মাখলো না ইরতিজা। যা দেখে সত্যি সত্যি রাগ হলো ক্যানিয়লের। সে ক্ষুব্ধ হয়ে গাড়ি থেকে নামলো। ইরতিজার এক হাত ধরে ওকে বেঞ্চি থেকে উঠিয়ে এনে গাড়ির ভিতর বসিয়ে দিলো। আর বললো,
“তোমার রাগটা কোথায় থাকে পাকিস্টানি গার্ল? বলো আমাকে। আমি সেই রাগ থাকা স্থানটুকু কে/টে ফেলে দিই পানিতে।”

কথাটায় তীব্র একটা ভাঁজ পড়লো ইরতিজার কপালে। যদিও তা আবার ক্ষণিকেই প্রসারিত হলো। ক্যানিয়লের দিক থেকে চোখ সরিয়ে জানালার বাইরে দৃষ্টি দিলো। আর একটা কথা বলার জন্যও মুখ খুলবে না সে। কথাতে শুধু কথা প্যাঁচাবে। দরকার কী কথা বলার?
পুরো রাস্তায় ক্যানিয়লও আর কোনো কথা বললো না। এমনকি ইরতিজা যখন গাড়ি থেকে নামলো তখনও কিছু বললো না।
ইরতিজা অবাক হলো ভীষণ। হঠাৎ এত মৌনতা দেখা দিলো কেন ক্যানিয়লের মাঝে?
যাই হোক, সেও কিছু বললো না।
দুপুর এখন বিকেলের দিকে রওনা হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। শীত অনুভূত হচ্ছে না তেমন। বাসায় প্রবেশ করলে উষ্ণতা যেন আরও খানিকটা জড়িয়ে ধরলো। নওরিন দরজা খুলেই যে সংবাদটা দিলো সেটা হলো, সাজিদ এসেছিল।

“কখন এসেছিল?”

“কিছুক্ষণ আগে। এসেই চলে গেছে, বসেনি বেশি সময়। ব্যস্ততা আছে না কি! তোমাকে কল দিতে চেয়েছিলাম, কিন্তু ও বললো দরকার নেই।”

“এসেছিল কেন?”

“হয়তো তোমাকে দেখতে।”

ইরতিজা নওরিনের এমন সহজ সঙ্গতিক কথায় লজ্জাবোধ করলো। এই লোকটা কী? যখন-তখন দেখার জন্য বাড়ি চলে আসতে হবে? যেখানে সে জানেই এই বিয়েটা হবে না তখন এত দেখতে আসার কী আছে? এমন করে যেন ও সত্যিই তার হবু বউ!
ইরতিজা কিছু বলতেই পারলো না। রুমে চলে এলো। বিছানার উপর গিফট প্যাকেটটা নজরে পড়লো প্রথমেই। ভ্রু জোড়ায় হালকা কুঞ্চন সৃষ্টি হলো। সে প্যাকেটটা নিয়ে গেল আবার নওরিনের কাছে। একবার খুলেও দেখলো না কী আছে ভিতরে।

“এটা আমার রুমে কেন?”

“সাজিদ নিয়ে এসেছিল এটা।”

“ওহ…”

আবার বেডরুমে ফেরত এলো ইরতিজা। হাতের প্যাকেটটা নির্জীবভাবে রাখলো বিছানায়। সাজিদের গিফট দেওয়ার বিষয়টাও সে মানতে পারে না। এর আগেও তাকে শাড়ি এবং নেকলেস দিয়েছিল। আজ আবার কী দিলো?
ইরতিজা প্যাকেটটা খুলে দেখলো। ভিতর থেকে বের হলো আকাশি রঙের একটি শাড়ি। আবার শাড়ি? শাড়ির ভিতর কী দেখতে পেল যে দুই দুইবার শাড়ি উপহার দিলো? ইরতিজা দীর্ঘক্ষণ ধরে দেখতে লাগলো শাড়িটাকে। দেখতে দেখতে হঠাৎ শাড়িটা যেন একটু পছন্দ হয়ে গেল।
সে সাজিদকে এই গিফট দেওয়া-দেয়ি নিয়ে একটা ম্যাসেজ পাঠাবে বলে ফোন হাতে নিয়েছিল, কিন্তু দেখলো তার আগে সাজিদই তাকে ম্যাসেজ পাঠিয়েছে। ম্যাসেজ পাঠিয়েছে আরও অনেক আগে, কিন্তু ফোন সাইলেন্ট থাকায় ম্যাসেজ অবহেলায় পড়ে রয়েছিল।

‘বাসায় গিয়েও আপনার দেখা পাওয়া যায় না খারাপ মেয়ে! আপনাকে দেখার জন্যই কিন্তু গিয়েছিলাম। ইদানিং আপনাকে দেখার তেষ্টা অনুভব হয় ভীষণ! কিন্তু এই তেষ্টা মেটানোর সুযোগ যে অত সহজ কোনো বিষয় নয়। এটা খুব কঠিন! যেটা আপনি আরও বেশি কঠিন করে তোলেন।’

দ্বিতীয় ম্যাসেজ,
‘আমি এমনিতেই আপনার কাছে অবহেলার বস্তু। এখন তো আবার আপনার প্রেমিকও আপনার কাছে চলে এসেছে! এখন কি আরও বেশি বেশি অবহেলা পাবো? এটা করা চলবে না কিন্তু। অবহেলার মাত্রা ওই এক জায়গাতেই অটুট রাখুন। কারণ বিয়ের পর আপনি এই অবহেলাগুলো ভালোবাসা দিয়ে পূরণ করে দিতে পারবেন কি না সে বিষয়ে আমি দ্বিধান্বিত! আমি ঠিক ততটুকুই অবহেলা সহ্য করতে পারবো যতটুকু অবহেলা আপনি ভালোবাসা দিয়ে মুছে দিতে পারবেন। অবহেলা যদি বেশি বেশি হয় তাহলে ভালোবাসাও বেশি বেশি হতে হবে। এটাকে বলে সমান হিসাব। বুঝতে পেরেছেন?’

তৃতীয় ম্যাসেজ,
‘এবার আর শাড়ি পরে ছবি তুলে পাঠাতে হবে না। একটা ছবি পাঠানোর চেয়ে না পাঠানোই উত্তম। হুট করেই আবার কোনো একদিন আপনাকে দেখতে চলে যাব। বাসায় থাকবেন কিন্তু।’

তিনটা ম্যাসেজই খুব মনোযোগ সহকারে পড়লো ইরতিজা। এর মাঝে দ্বিতীয় ম্যাসেজটা মনে বেশি প্রভাব ফেললো। বিশেষ করে ওই লাইনটা,
‘এখন তো আপনার প্রেমিকও আপনার কাছে চলে এসেছে!’
এর মানে সাজিদ ধরেই নিয়েছে জোনাস তার প্রেমিক? এমনটা কেন মনে হয় লোকটার? ইরতিজা ভীষণ বিস্মিত এই ব্যাপারটা নিয়ে। এটা মনে হওয়ার কারণ কী? জোনাসের চিন্তাটা ইরতিজার মনে তিঁতকুটে কষ্টের সৃষ্টি করলো। এমন তেঁতো কষ্টও সহ্য করা যায়? ছেলেটা কেন এলো এখানে? কাছাকাছি থেকে ঘৃণা করা কি এতটাই জরুরি?

রাতের দিকে প্রচুর ঠান্ডা পড়তে লাগলো। হঠাৎ করে তাপমাত্রা অনেক নিচে নেমে গেছে। উষ্ণ কাপড় পরা সত্ত্বেও হাত পা কাঁপছে রীতিমতো। ঘরে ভালো লাগছিল না ইরতিজার। তাই একটা কম্বল পেঁচিয়েই বাইরে বের হয়ে বসেছিল। বাড়ির পিছনের ছোটো লনটায় বসে ক্যানিয়লের বাড়িটা একটু দেখা যায়। ওখানে আলো জ্বলছে। ক্যানিয়ল কি তাহলে এখন এই বাড়িতে আছে? বসে বসে নানান চিন্তা করছিল ইরতিজা। এখানে বসেও সে শুনতে পাচ্ছে ঘরের ভিতর চলা জুহি আর রিশনের ঝগড়া। ওদের ঝগড়া ঝাটি সবসময় উপভোগেরই বিষয় হয়। তবে এই মুহূর্তে ইরতিজার সবকিছু কেমন পানসে লাগছে তাই অত মনোযোগ দিলো না ওদের ঝগড়ার উপর। ইরতিজা নিজের চিন্তা থেকে ক্যানিয়লের মায়ের বিষয়টাও উহ্য রাখতে পারলো না। কেন চলে গিয়েছিল সে ক্যানিয়লকে ছেড়ে? কেন একটা বিষাদের আকাশ ক্যানিয়লের মাথার উপর বিছিয়ে দিয়ে চলে গিয়েছিল? ঘটনাটা জানার আগ্রহ বেশ কিছুক্ষণ ধরে খুঁড়ে খুঁড়ে খেলো ইরতিজাকে। শীতের তীব্রতায় সে কেঁপে উঠছে একটু পরপর। যেমন করে কচি কিশলয় কেঁপে ওঠে মৃদু বায়ুতে।

আজাদ চৌধুরী বেশ কিছুসময় ধরে ইরতিজাকে বসে থাকতে দেখছেন পিছনের লনে। ইরতিজা বসে আছে বলে তার সমস্যা হচ্ছে না। কেন এরকম বসে আছে সেটা জানারও প্রয়োজন বোধ করছে না। সে খুব যত্ন করে এক কাপ কফি বানালো মেয়ের জন্য।
এমন পানসে সময়ে হঠাৎ বাবার হাতের এক কাপ কফি পেয়ে খুশি হলো ইরতিজা। মিষ্টি হেসে কফিটা গ্রহণ করে ‘থ্যাঙ্ক ইউ’ জানালো। আজাদ চৌধুরী মেয়ের মাথায় এক হাত রেখে বললেন,
“ঠান্ডার ভিতর এরকমভাবে বসে থাকা কি তোমার প্রিয় শখ না কি?”

ইরতিজা হাস্যমুখে জানালো,
“ওরকমই কিছু।”
এরপর কফির কাপে এক চুমুক দিয়ে আজাদ চৌধুরীর দিকে চেয়ে বললো,
“মায়ের কী অবস্থা এখন?”

শারমিন আহমদ গতরাত থেকেই অসুস্থ বোধ করছেন। দুপুর পর্যন্ত স্বাভাবিক ভাবে চললেও বিকেলে এসে হঠাৎই বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন! বিছানা ছেড়েই ওঠেনি সেই বিকাল থেকে। মাগরিবের সালাতও আদায় করেননি! আজাদ চৌধুরী বললেন,
“এটা আমাকে জিজ্ঞেস না করে তোমার মাকেই জিজ্ঞেস করতে পারতে সে কেমন আছে। তাহলে সে আরও খুশি হতো।”

“খুশি হতো না কি বিরক্ত হতো?”

“তুমি ভাবছো তোমার মা তোমাকে ঘৃণা করে! আসলে তা না, সে কিন্তু তোমাকে অত্যাধিক ভালোওবাসে।”

ইরতিজা কিছু বললো না। শুধু মুখে একটুখানি হাসি ফোঁটালো।
আজাদ চৌধুরী বললেন,
“বেশিক্ষণ বাইরে বসে থেকো না। তাড়াতাড়ি ভিতরে এসো।”
বলে তিনি চলে গেলেন।

ইরতিজা তাকালো আকাশের দিকে। বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো তার। মা তো ভালোবাসে তাকে। কিন্তু ঘৃণার পরিমাণটা কি তার চেয়ে বেশি নয়?

(চলবে)