উড়ো পাতার ঢেউ পর্ব-৬২ এবং শেষ পর্ব

0
502

#উড়ো_পাতার_ঢেউ
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ৬২ (শেষ পর্ব–প্রথমাংশ)
_________________

‘শরতের রঙে রেঙেছে ভুবন! কিন্তু আমি তো শরৎ, শীত, বসন্ত, গ্রীষ্ম সর্বক্ষণেই রঙিন তোমার ভালোবাসায়! আমার হৃদয়ে বারো মাসই পাতা ঝরার রঙিন দিন চলে। তুমি আমার উড়ো পাতার ঢেউ! তোমায় নিয়ে হারিয়ে যাই বহুদূর। যে স্থান মানবশূন্য। শুধু আছে পায়ের নিচে রঙিন পাতার মড়মড় আওয়াজ এবং আমাদের হৃদয়ের অন্তঃস্থলে গুচ্ছবিদ্ধ গভীর অনুভূতি।’

পুরো লেখা পড়ে ইরতিজার ঠোঁটের কোণে সুমিষ্ট হাসি নেচে উঠলো। চিরকুটটা উলটে-পালটে দেখতে দেখতে ভাবলো, ক্যানিয়ল কি রোমান্টিক হয়ে যাচ্ছে? না, হয়ে যাচ্ছে না, ইতোমধ্যে সে হয়ে গেছে। সে তো পণ করেছে, নিত্য অন্তত একটা হলেও রোমান্টিক কাজ করবে সে। এই যে চিরকুট পাঠিয়েছে এটাও তার রোমান্টিক কাজেরই একটা অংশ। এমনকি এই রোমান্টিক কাজের ভিতর হাতে মেহেন্দি দিয়ে দেওয়াও ছিল। ইরতিজার স্পষ্ট মনে আছে সেই সময়টার কথা। ভীষণ হাসি পাচ্ছিল তখন তার। ইউটিউব দেখে দেখে ক্যানিয়ল মেহেন্দি পরিয়ে দিয়েছিল তার হাতে। ভিডিয়ো দেখার একটু পর পরই হঠাৎ হঠাৎ চমকে গিয়ে বলতো,
“হোয়াট? এটা কীভাবে হলো?”

বলেই পিছনের অংশ আবারও দেখে নিতো একবার। দুই-তিন বারও দেখেছে। খারাপ না, মোটামুটি ভালোই আঁকতে পেরেছিল। তবে আঁকতে গিয়ে বেচারার দুই হাতের অনেকাংশে মেহেন্দি লেগে গিয়েছিল। ইরতিজা হাতের দিকে তাকালো। মেহেন্দির রং এখনও তার হাত থেকে পুরোপুরি মুছে যায়নি। চিরকুটটা বইয়ের ভাঁজে রেখে দিয়ে বাইরে তাকালো জানালা দিয়ে। প্রকৃতির অপূর্ব সৌন্দর্যে দুই নয়ন জুড়ালো। একেক ঋতুর একেক আলাদা সৌন্দর্য। ইরতিজাকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, তোমার প্রিয় ঋতু কোনটি? ইরতিজা তখন নির্দ্বিধায় উত্তর দেবে, শরৎ! আমেরিকায় শরৎকে ‘ফল’ বলা হয়। এ সময় দেখা যায় গাছের পাতার রং বদলাতে। লাল, হলুদ, কমলা, খয়েরি, সবুজ সব রং একই সাথে জেগে ওঠে প্রকৃতির বুকে। শরৎ মানে পত্রঝরা সময়। হালকা শীতের আমেজ এবং কিছুটা গ্রীষ্মের উষ্ণতার উপলব্ধি করা যায় এ সময়। শরৎকালের যেটা বিশেষ আকর্ষণীয় সেটা হলো এখানকার ম্যাপল গাছ। ম্যাপল গাছের পাতার রং হলুদ, কমলা, লাল হয়ে চারিদিক ভরে যায়। সব মিলিয়ে প্রকৃতি হয়ে ওঠে অনন্য!

শীত থেকে শরৎ। সময় গড়িয়েছে সাত মাস। এই সাত মাসে পালটেছে অনেক কিছু। ইরতিজার মনে হয় সে এখন একটা নিশ্চিন্ত জীবনে আছে। জীবনের সবকিছু এখন পরিপাটি। ক্যানিয়লের সাথে আনুষ্ঠানিক ভাবে তার বিয়ে ঠিক হয়েছে। ডিসেম্বরে বিয়ে। নওরিনের বিয়ে হবে ঠিক তার আগের মাসে, নভেম্বরে। নওরিনের হবু বরের নাম বিরুনি। বিরুনি মালয়েশিয়ান ছেলে। সুদর্শন, স্মার্ট এবং স্পষ্টভাষী। নওরিন এবং বিরুনি একে অপরের অফিস সহকর্মী। সপরিবারে আমেরিকাতেই থাকে সে।
হামাদ ঠকিয়েছিল নওরিনকে। ইরতিজার মনে হয় নওরিনের ওই ঠকে যাওয়াটার বিশেষ দরকার ছিল। ঠকেছিল বলেই হামাদের চেয়ে খুব ভালো একজনের আগমন ঘটতে পেরেছে নওরিনের জীবনে। সকল ঠকে যাওয়ার গল্প খারাপ হয়, কিন্তু ঠকে যাওয়ার প্রাপ্তিটা অনেক সময় ভালো হয়। তেমনটা নওরিনের ক্ষেত্রেও। তার ঠকে যাওয়ার প্রাপ্তি হিসাবে সে বিরুনির মতো একজনকে পেয়েছে।
বিরুনি এখন তাদের বাসাতেই আছে। সকালে এসেছে সে।
একটা বিষয় খুব আজব, বিরুনিকে দেখলেই ইরতিজার সাজিদের কথা মনে পড়ে। কোথায় যেন খুব নিখুঁত একটা মিল আছে দুজনের। ইরতিজা নিখুঁত মিলটা অনেক সময় ধরে খুঁজছিল। পুরোপুরি নিখুঁত মিল তো পায়নি, তবে আংশিক একটা মিল পরিলক্ষিত হয়েছে। সেটা হচ্ছে দুজনের হাসি। বিরুনির হাসি কিছুটা সাজিদের মতো।
সাজিদ! মাঝে মাঝেই মানুষটাকে মনে পড়ে যায় ইরতিজার। সাজিদ মানুষ হিসাবে স্মরণে আসার মতোই একজন মানুষ। সাজিদের সাথে এখনও ইরতিজার ফ্যামিলির ভালো সম্পর্ক, বিশেষ করে বাবার সাথে। তবে ইরতিজার সাথে সম্পর্কটা বিব্রতকর। এই মানুষটা এক সময় তার হবু স্বামী ছিল ভাবতেই কেমন বিব্রত অনুভূতি হয়। সাজিদও ঠিক একই অনুভূতি অনুভব করে। দেখা হলে কথা হয় দুজনের। নিতান্তই সাধারণ কথাবার্তা। সৌহার্দ্য বজায় রাখে দুজনেই।
সাজিদের মতো জোনাসকে মনে পড়ে না অত। কালে ভাদ্রে হয়তো একটু-আধটু মনে পড়ে। আসলে জোনাসকে সে একদমই মনে করতে চায় না। কিন্তু কালে ভাদ্রে হঠাৎ হঠাৎ যখন মনে পড়ে যায় তখন সে নিরুপায় অনুভব করে। জোনাস রেডমন্ড থেকে চলে যাওয়ার পর ওর আর কোনো খোঁজ খবর নেই। কখনও কল দেয়নি, দেখাও হয়নি আর। গত তিন মাস আগে সোশ্যাল মিডিয়ায় ওর একটা পোস্ট দেখেছিল। পোস্টটা ছিল–
‘মানুষের জীবনে ব্যর্থতার গল্প থাকে। আমার জীবনে সবচেয়ে বড়ো ব্যর্থতার গল্প হলো, ভুলতে না পারা। তোমাকে আমি বলেছিলাম সুইটহার্ট, কখনও আর আমার হৃদয়ের আশেপাশে এসো না। কিন্তু তুমি ভারি অবাধ্য। এখনও হৃদয়ের মধ্যিখানে তোমার অবস্থান। তোমাকে ভুলতে না পারা সবচেয়ে বড়ো ব্যর্থতা আমার।’

পোস্টটা পড়ার পর ইরতিজার মনে প্রথম যে প্রশ্ন জেগেছিল, তা হলো, পাগল ছেলেটা কি এখনও তাকে ভালোবাসে? ইরতিজা চায় না জোনাস তাকে মনে রাখুক। সে নিজেকে এখন বিশ্বাস করাতে চায় জোনাস তাকে ভুলে গেছে।
কিন্তু ভুলে গেছে কি না সেটা জোনাসই ভালো জানে। ভুলে যাক, ভালো থাকুক। ইরতিজা এটাই চায়। সে এখন নিজের পরিবার, বন্ধু-বান্ধব, ক্যানিয়ল সবাইকে নিয়ে যেমন সুখে আছে, তেমনি প্রত্যেকটা মানুষই সুখে থাকুক।

ইরতিজা আজ পুরো দিবা সময় বাসাতেই অবস্থান করলো। বিকেলে ক্যানিয়লের সাথে দেখা করার কথা ছিল তার। প্রতি উইকেন্ডেই তারা বিকেলে পার্কে ঘোরে। কিন্তু অহনা ফুফু দুপুরের দিকে সিয়াটল ল্যান্ড করার কারণে বিকেলে ঘুরতে যাওয়া ক্যানসেল হলো। মহিলাটিকে ইরতিজা এখনও বিশেষ একটা পছন্দ করে না। সবার মাঝেই সে ভালোর ছটা লক্ষ করছে, কিন্তু মহিলা ঠিক আগের মতোই। খোঁচা দিয়ে কখন কোন কথা বলবে সেই সুযোগের সন্ধান করে। সাজিদের সাথে বিয়ে ভাঙা নিয়ে সাজিদ কখনও অভিযোগ তোলেনি, অথচ অহনা ফুফু একটার পর একটা কথা শুনিয়ে গেছে আর এখনও শোনাচ্ছে!

ইরতিজা ক্যানিয়লকে ম্যাসেজ দিয়ে জানিয়েছিল, সে আজ দেখা করতে পারবে না। ক্যানিয়ল ম্যাসেজ সিন করেছে, কিন্তু কিছু বলেনি। ইরতিজাও এরপর আর কোনো ম্যাসেজ দেয়নি। ক্যানিয়লের সাথে ফোনে তেমন কথাবার্তা হয় না তার। ফোনে যোগাযোগের মাত্রা ঠিক আগের মতোই আছে।

এখন সন্ধ্যা। নাতিশীতোষ্ণর চেয়ে একটু যেন উষ্ণ ঠেকছে আবহাওয়া। ইরতিজা বারান্দায় বসে কথা বলছিল স্যামনের সাথে। স্যামন তার নতুন এক ফ্রেন্ড। কিয়ৎক্ষণ পর হঠাৎ একটা আলোর রশ্মি এসে পড়লো তার মুখে, ঠিক অনেক দিন আগের সেই রাতের মতো। মনোযোগ আকর্ষণ হলো ইরতিজার। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো সে। আলোটা এখন সরে গেছে তার মুখ থেকে। লনে তাকিয়ে দেখতে পেল ক্যানিয়ল দাঁড়িয়ে আছে। স্যামনকে বললো,
“আমি তোমাকে পরে কল ব্যাক করবো স্যামন।”

স্যামনের কল কেটে দিয়ে ক্যানিয়লের কাছে কল দিলো।

“আজ সারাদিনে একবারও আমাদের দেখা হয়নি, এটা কি খারাপ বিষয় নয়?” ক্যানিয়ল বললো।

“আমি তো ম্যাসেজে তোমাকে কারণ জানিয়েছিলাম।”

“ওসব কারণ-টারনে আমার পোষাবে না। তুমি এক্ষুণি বাইরে এসো।”

ইরতিজা বাসা থেকে বের হওয়ার সময় বাবার সম্মুখীন হলো,
“কোথায় যাচ্ছ?”

“ক্যানিয়ল এসেছে।”

“কোথায়? ভিতরে কেন আসছে না?”

“নিয়ে আসছি।”

বেরিয়ে গেল ইরতিজা। হাওয়ার পাল এসে ছুঁয়ে দিতেই শরীর মন জুড়িয়ে গেল। বাইরের পরিবেশ এ সময় মনকাড়া রূপ ধারণ করেছে। আকাশে উজ্জ্বল নক্ষত্রদের ভিড়। প্রতিবেশীর বাড়ির সামনের গাছে জ্বলছে কতকগুলো লণ্ঠন। সাদা রঙের ফুলগুলো থেকে ভেসে আসছে সুগন্ধি। বাসার সামনে কিছু ফুল গাছ লাগিয়েছে নওরিন আর রিশন। এর মাঝে শুধু সাদা ফুলটাই সুগন্ধি ছড়ায়।

“আব্বু ভিতরে ডাকছে তোমায়।”

“কেন ডাকছে? আমি কি তার সাথে দেখা করতে এসেছি? আমি তার মেয়ের সাথে দেখা করতে এসেছি।”

“তাহলে যাবে না?”

“না।”

“ঠিক আছে, তাহলে আমি চলে যাই। দেখে তো নিয়েছো আমায়।”

ইরতিজা স্থান ত্যাগ করতে চাইলেই ক্যানিয়ল গম্ভীর গলায় বললো,
“এক পা সামনে এগোবে না, দু পা ভে/ঙে দেবো তাহলে।”

ইরতিজা দাঁড়িয়ে গেল। ক্যানিয়ল তার সাথে এমনভাবে কথা বলে না তেমন। মাঝে মাঝে বলে আরকি। ইরতিজার তখন পুরোনো ক্যানিয়লের কথা মনে পড়ে যায়। কেমন ছিল ক্যানিয়ল? ক্যানিয়লের সাথে প্রথম দিকের স্মৃতিগুলো মনে পড়ে তখন। আর মন আপনা থেকেই জবাব দিয়ে ওঠে, ‘পাজি ছিল ক্যানিয়ল।’

“কী ভাবছো? মনে মনে আমাকে গালি দিচ্ছ? উর্ডুতে গালি?” ইরতিজাকে অন্যমনস্ক দেখে বললো ক্যানিয়ল।

ইরতিজা কিছু বললো না। তাকালো ক্যানিয়লের দিকে।
ক্যানিয়ল হাতের ভায়োবিন ফুলে ঠোঁট ছুঁইয়ে তা ইরতিজার কানে গুঁজে দিয়ে বললো,
“লং ড্রাইভে যাওয়া যাক পাকিস্টানি গার্ল।”

“এখন তো রাত।”

“রাতে মানুষ লং ড্রাইভে যায় না? তুমি আমি কি বানর যে আমাদের রাতের বেলা লং ড্রাইভে যাওয়া বারণ?”

“আমি যেতে চাই না।”

“তুমি যেতে চাও কি না সেটা তো ইম্পরট্যান্ট না। আমার যেতে চাওয়াই ইম্পরট্যান্ট।”

“আব্বু চিন্তা করবে।”

“তুমি তোমার বাবাকে নিয়ে চিন্তিত?”

ক্যানিয়ল ইরতিজাদের ঘরের দিকে অগ্রসর হলো।

“কোথায় যাচ্ছ?” পিছন থেকে প্রশ্ন করে উঠলো ইরতিজা।

আজাদ চৌধুরী তখনও লিভিং রুমে বসে ছিলেন। ক্যানিয়লের গলার স্বর কানে এলো,
“আসসালামু আলাইকুম।”

ক্যানিয়লের দিকে তাকালেন আজাদ চৌধুরী।
“ওয়াআলাইকুমুস সালাম।”

“আপনার মেয়েকে নিয়ে লং ড্রাইভে যাচ্ছি, এক ঘণ্টা পরই ফিরিয়ে দিয়ে যাব।”
বলেই জায়গাটা থেকে সরে গেল।
ইরতিজা বাসার অভ্যন্তরে প্রবেশ করার পথে ছিল, ক্যানিয়ল ওকে উলটো টেনে বাইরে নিয়ে এলো। পার্কিং সাইডে এসে থামলো দুজন। অসংখ্য গাড়ির মাঝে ক্যানিয়লের নতুন কেনা সাইকেলটা দাঁড়িয়ে আছে। সাইকেল দেখে ইরতিজা খুশি হয়ে গেল।

“নতুন কিনেছো?”

“না কিনে উপায় কী? তোমার জন্য তো আমার সাইকেলটা হারিয়েছিলাম। আচ্ছা, সত্যি করে বলো তো, সাইকেলটা তুমি আর প্লে গার্ল দুজন মিলে চুরি করোনি তো? আমার সাইকেল চুরি করার সাহস কী করে হয় তোমাদের?” কঠিন হয়ে উঠলো ক্যানিয়লের কণ্ঠস্বর।

ইরতিজা অবাক প্রায় কণ্ঠে বললো,
“আমরা চুরি করেছি মানে?”

“সেই রাতের ঘটনা, যেদিন তুমি অথবা প্লে গার্ল, দুজনের একজন আমাকে সাইকেল থেকে ঠ্যালা মেরে ফেলে দিয়ে মা’রা’র চেষ্টা করেছিলে। তখন আমি রাগ করে সাইকেলটা রাস্তায় ফেলে রেখে গিয়েছিলাম। কিন্তু আমার যখন রাগ কমে যায় তখন সাইকেলটা নেওয়ার জন্য আমি আবার এসেছিলাম ওখানটায়। কিন্তু তখন ওখানে কোনো সাইকেল ছিল না। গেল কোথায়? নিশ্চয়ই তোমরা দুজন চুরি করেছো। ইয়েস, আই অ্যাম 100% শিওর।”

ইরতিজার এবার চরম রাগ লাগলো। ক্যানিয়ল তার উপর এমনভাবে মিথ্যা আরোপ করছে কীভাবে? সে আর জুহি কেন সাইকেল চুরি করতে যাবে? তারা তো বরং মানুষের চলাচলের সুবিধার জন্য সাইকেলটা রাস্তা থেকে উঠিয়ে রাস্তার পাশে রেখে দিয়েছিল। এখন কেউ যদি সেটা চুরি করে নিয়ে যায় সেই অপবাদ তাদের উপর কেন দেওয়া হবে? কত পুরোনো একটা ঘটনা এখানে উঠিয়ে এমনভাবে তাকে রাগিয়ে দেওয়ার কী প্রয়োজন ছিল? ইরতিজা রাগান্বিত স্বরে বললো,
“ভেবে-চিন্তে কথা বলবে ক্যানিয়ল। আমরা কেন তোমার সাইকেল চুরি করতে যাব? কী লাভ আমাদের সাইকেল চুরি করে? তুমি আমাকে সাইকেল চোর বলার…”

ইরতিজা কথা সম্পন্ন করার পূর্বেই ক্যানিয়ল ইরতিজার নরম গাল দু খানিতে আলতো পরশে হস্ত রাখলো। সঙ্গে সঙ্গে থেমে গেল ইরতিজার কণ্ঠস্বর।
ক্যানিয়ল নম্র ধীর কণ্ঠে বললো,
“সাইকেল চোর তো নও তুমি, তবে আমার গুরুত্বপূর্ণ কিছু চুরি করেছো। এই চুরির জন্য কখনও কোনো শাস্তি পাবে না তুমি। কেন চুরি করেছো, এই প্রশ্নেরও সম্মুখীন হবে না। তবে মাঝে মাঝে জানতে ইচ্ছা হয়, কীভাবে চুরি করেছো? আমার হৃদয় অত্যন্ত কঠিন ছিল। কীভাবে করেছো এটা?”

ইরতিজা আবছা আলোয় ক্যানিয়লের কোমল মুখখানিতে চেয়ে থেকে বললো,
“কে বলেছে তোমার হৃদয় অত্যন্ত কঠিন ছিল? আমি কখনও কঠিনতা দেখিনি। এটা যত স্পর্শ করেছি ততই কোমলতা অনুভব করেছি। এটা এতটা কোমলপূর্ণ ছিল যে কখন এই কোমলতায় মিশে গেছি নিজেই টের পাইনি।”

ক্যানিয়লের ওষ্ঠ কোণে শান্ত নিঝুম রেখার বিচরণ দেখা গেল।

রাত্রি নিঝুম শহরের বুকে কিছুক্ষণ ঘুরে বেড়ালো দুজন। ক্যানিয়ল এক বক্স চকলেট কিনে দিলো ইরতিজাকে। বক্সটা হাতে নিয়ে ইরতিজার নিজেকে বাচ্চা বাচ্চা মনে হচ্ছিল।
এন্ডারসন হাউজে এলো ওরা। ক্যানিয়ল খাবার অর্ডার করেছিল। একটু সময়ের ভিতরই চলে এলো খাবার। ইরতিজা চুপচাপ খাচ্ছিল। হঠাৎ ক্যানিয়ল জিজ্ঞেস করলো,
“মি. হেনরির ওয়াইফ প্রেগন্যান্ট, জানো?”

ইরতিজা খেতে খেতে জবাব দিলো,
“হুম। না জানার কী আছে? চার মাস চলছে প্রেগন্যান্সির। আমি তো মিস্টার অ্যান্ড মিসেস হেনরিকে অভিনন্দনও জানিয়েছি।”

ক্যানিয়ল চামচ নাড়াচাড়া করা বন্ধ করে দিলো। একদম স্থির ভঙ্গিতে ইরতিজার দিকে তাকিয়ে বললো,
“ভেবে দেখো ইজা, আজ আমাদের বিয়ে হয়ে গেলে তুমিও এক বেবির মা থাকতে পারতে।”

ক্যানিয়লের কথা কানে আসা মাত্র যেন হোঁচট খেল ইরতিজা। তার মুখের ভিতর খাবারের অংশ। হঠাৎ কাশি উঠে গেল ইরতিজার। সে মুখের খাবারটুকু গিলে নিলো অতি সত্বর।
ক্যানিয়ল টেবিলের দিকে অঙ্গুলি করে বললো,
“ওই দেখো, লেকচারার স্টিভেনের বিয়ের ইনভাইটেশন কার্ড। মি. স্টিভেন আর মাত্র পাঁচদিন পর বিয়ে করতে চলেছে। সবাই বিয়ে করে ফেলছে ইজা। তোমার বোনের বিয়েও নভেম্বরের শুরুর দিকে হবে। তাহলে আমাদের বিয়ে কেন এত দেরিতে হবে? শরতের এই রঙিন উৎসব মুখর দিন কী দোষ করেছে? কেন এই রঙিন দিন বাদ দিয়ে আমাদের ডিসেম্বরের কনকনে ঠান্ডার মাঝে বিয়ে করতে হবে? এটা আমি একদমই মানি না। তোমার ড্যাডের সাথে অতি শীঘ্র কথা বলতে হবে আমার। তার এই অন্যায় সিদ্ধান্তকে মানি না আমি।”
ক্যানিয়লের কণ্ঠে স্পষ্ট প্রতিবাদের সুর।

ইরতিজা বাকরুদ্ধ হয়ে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল ক্যানিয়লের দিকে। কীসব বলছে ক্যানিয়ল? ক্যানিয়ল কি বিয়ে পাগল হয়ে যাচ্ছে?

“বিয়ের পর ওমরাহ হজ্বে যাব দুজন সেটা পর্যন্ত ঠিক করে ফেলেছি, অথচ বিয়ে হচ্ছে না এখনও। আগামী কালই বিয়ে করা যাক, হুম?”

“কী বলছো এসব?” বিস্ময়ের ঘোর থেকে বলে উঠলো ইরতিজা।

ক্যানিয়ল হতাশ কণ্ঠে বললো,
“সবার বিয়ে হচ্ছে শুধু আমাদের বিয়ে হচ্ছে না।”

এরপর ক্যানিয়ল চুপচাপ খেতে লাগলো। ইরতিজা আর খেতে পারলো না। ক্যানিয়লের এতক্ষণের কথাবার্তায় তার খাবার পড়ে রইল প্লেটে।
ক্যানিয়ল খাওয়া সম্পূর্ণ করে বললো,
“তোমাকে কিছু দেবো ইজা।”

“কী?”

“ওয়েট।” হাসি হাসি মুখে বলে চলে গেল ক্যানিয়ল। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেল।

এদিকে ইরতিজা সোফার কুশনের নিচ থেকে কালো কীসের একটু অংশ দেখতে পেল যেন। ভ্রু কুঁচকে উঠলো তার। এটা কী? কুশন সরিয়ে ফেললো সে। ভারি অবাক হলো। পিস্তল? হাতে তুলে নিলো পিস্তলটা। হাসি পাচ্ছে তার। ক্যানিয়ল এখনও নকল পিস্তল নিয়ে ঘোরে? এটা কি সেই পিস্তলটা যেটা দিয়ে প্রথম দেখা হওয়ার দিন তাকে ভয় দেখিয়েছিল?

ক্যানিয়ল উপর থেকে নামার পর ইরতিজার হাতে পিস্তল দেখে দাঁড়িয়ে গেল। আতঙ্কিত কণ্ঠে বললো,
“তোমার হাতে পিস্তল কেন পাকিস্টানি গার্ল? তুমি আমাকে খু/ন করতে চাও? আমার পিস্তল ধরেছো কেন?”

ইরতিজা হাস্যভাব মুখে বললো,
“বাচ্চাদের মতো নকল পিস্তল নিয়ে খেলো না কি?”
বলে হাসতে থাকলো।

ক্যানিয়ল ভ্রু কুঁচকে টানা টানা শুধালো,
“নকল পিস্তল? তুমি আমাকে কী মনে করো? আমি একজন সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মগ্রহণ করা ছেলে। তোমার কি ধারণা আমার রিয়েল আর্মস রাখার ক্ষমতা নেই? এটা মোটেই নকল নয়। ইট’স রিয়েল।”

ইরতিজার মুখ থেকে হাসি শুকিয়ে গেল। ভয় খচখচ করে উঠলো ভিতরে। বললো,
“কী?”

“ইট’স নট ফেক। ইট’স কমপ্লিটলি অরিজিনাল।”

ক্যানিয়লের কথা শুনে ইরতিজার হাত ফসকে পিস্তলটা পড়ে গেল। তা দেখে ক্যানিয়ল হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে পিস্তলটা উঠিয়ে নিলো। পিস্তলটার গায়ে নরম করে হাত বুলাতে বুলাতে বিরক্ত চোখে তাকালো ইরতিজার দিকে। বললো,
“কোন সাহসে আমার এত দামি পিস্তল ঠাস করে ফ্লোরে ফেলে দিয়েছো? জানো এটার দাম কত? ইশ, তুমি নিশ্চয়ই ব্যথা দিয়েছো ওকে।”

কাতর হয়ে পিস্তলটার গায়ে হাত বুলাতে লাগলো ক্যানিয়ল। ইরতিজা এসব দেখে ভড়কে গেছে। বললো,
“তুমি বাড়িতে পিস্তল কেন রেখেছো?”

“রাখবো না কেন? সবার বাড়িতেই আর্মস আছে। আমার কাছে থাকলে কী দোষ? অবশ্য এটা তোমার জন্যই কেনা হয়েছে।”

ইরতিজার বুক ধক করে উঠলো। দু চোখে হানা দিলো আতঙ্ক। কম্পমান কণ্ঠে বললো,
“আমার জন্য কেনা হয়েছে মানে? এটা দিয়ে তুমি আমাকে গু/লি করতে চাও?”

ক্যানিয়ল লক্ষ করলো ইরতিজা হঠাৎ কেমন ভয় পাচ্ছে। বিষয়টা ভীষণ ভালো লাগলো তার। পিস্তল দেখে মেয়েটা এভাবে ভয় পাচ্ছে? তার মিসেস উমরান এত ভীতু? ক্যানিয়ল চোখ-মুখের রং পালটে ফেললো হঠাৎ। ইরতিজা তা দেখে তাজ্জব বনে গেল। ক্যানিয়লের চেহারাটা এই মুহূর্তে প্রাণহীন লাগছে। যেন ক্যানিয়লের প্রাণ নেই, মনুষ্যত্ব নেই। দুই চোখ কেমন যেন শীতল। এত শীতল চাহনি যে চাহনির দিকে দৃষ্টি স্থির রাখা যায় না। ভয়ে প্রতিটা হাড় কেঁপে ওঠে। ইরতিজার মনে হচ্ছে এটা কোনো সাইকোপ্যাথের চোখ।
ক্যানিয়ল এগিয়ে গেল ইরতিজার কাছে। ইরতিজা হঠাৎ কয়েক পা পিছিয়ে গেল। ক্যানিয়ল থামলো না, সে এসে ইরতিজার কাছাকাছি দাঁড়ালো। পিস্তলের নলটা চেপে ধরলো ইরতিজার থুতনির নিচের অংশে। গা ছমছম করে উঠলো ইরতিজার। বললো,
“তুমি হঠাৎ এমন করছো কেন?”

ক্যানিয়ল হাসলো। ঠোঁটের বাঁ দিকটা হেলে গেল হাসির প্রকাশক হয়ে। হাসিটাও মারাত্মক রকমের নিঝুম। বললো,
“খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা কথা বলবো পাকিস্টানি গার্ল, মনোযোগ দিয়ে শুনবে।”

“কী কথা?”

“চোখ বন্ধ করো।”

“কেন?” আরও ঘাবড়ে গেল ইরতিজা।

“না হলে তুমি বেশি ভয় পাবে। বন্ধ করো।”

শেষের কথাটা প্রায় ধমকের সুরে বলে উঠলো ক্যানিয়ল। ইরতিজা বন্ধ করে ফেললো চোখ।

ক্যানিয়ল বললো,
“যা বলবো মনোযোগ দিয়ে শুনবে। যদি না শোনো পিস্তল থেকে একটা গুলি তোমার শরীর ভেদ করে গিয়ে দেয়ালে আটকে যাবে।”

“ইজা!”
ডাকলো ক্যানিয়ল।

“হু।” সাড়া দিলো ইরতিজা।

“আই লাভ ইউ!”

তিন শব্দের বাক্যটা ইরতিজার মন থেকে কাটিয়ে দিলো যত ভীত ছায়া। মনটা খড়খড়ে আকাশের এক চিলতে সূর্য রশ্মিতে হেসে উঠলো। চোখ মেলে চাইলো সে। ক্যানিয়লের সরল হাস্য মুখটা দেখতে পাচ্ছে। একটু আগেও যে মুখটা অন্য রকম ছিল, সেই মুখটা এখন ভীষণ সরল দেখাচ্ছে। ঠোঁটের হাসিটাও কী ভীষণ চমৎকার! ঠোঁটের সাথে সাথে চোখ দুটোও হাসছে। তবে ইরতিজার একটু অভিমান হলো। ক্যানিয়ল তাকে ভয় দেখিয়ে মজা নিচ্ছিল? সে একটু রাগী ভাবে বলার চেষ্টা করলো,
“আব্বুকে বলবো বিয়ে এই বছর না দিয়ে যেন আগামী বছরের ডিসেম্বরে দেয়।”

ক্যানিয়ল হাসতে হাসতে পিস্তলটা সরিয়ে নিলো। ফ্লোর থেকে পিস্তল ওঠানোর আগে সে একটা ভারি বক্স রেখেছিল টেবিলের ওপর। সেটা দেখিয়ে বললো,
“বক্সটা কি নেবে? না নেবে না?”

“কী আছে এই বক্সে?”

“মানুষের আঙুল থেকে উঠিয়ে আনা র’ক্তমাখা ন’খ!”

সারা শরীর শিরশির করে উঠলো ইরতিজার।
“বাসায় দিয়ে এসো জলদি। আমি আর এক মুহূর্ত তোমার সাথে থাকতে পারছি না। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে।”

_______________

কাল ক্যানিয়ল বলেছিল বক্সের ভিতর
মানুষের আঙুল থেকে উঠিয়ে আনা র’ক্তমাখা ন’খ আছে। ওটা তো ছিল ফান। আসলে বক্সে ছিল একশ হিজাব, পাঁচটা বোরকা, একটা ল্যাপটপ আর কয়েক জোড়া কানের দুল। এই নিয়ে তিনশ হিজাব দেওয়া হয়ে গেছে ক্যানিয়লের। ইরতিজা বুঝতে পারে না, হিজাব গিফট দিলেই এক সাথে একশটা কেন দিতে হবে? একশ’র কম কি দেওয়া যায় না? বোরকা দিয়েছে এই প্রথম। বিয়ের পর সৌদি আরব যাওয়ার উপলক্ষ্যে কিনেছে। বিয়ে হতে এখনও প্রায় দুই মাস বাকি আর ক্যানিয়ল এখনই বিয়ের পর সৌদি আরব যাওয়া উপলক্ষ্যে বোরকা কিনে দিয়েছে। আর ল্যাপটপ দিয়েছে কেন সেটাও জানে ইরতিজা। কয়েকদিন ধরে তার ল্যাপটপে সমস্যা হচ্ছে, এটা শোনার পরই এটা দিয়েছে।
ইরতিজা এখন বাইরে যাবে। ক্যানিয়ল কল করেছিল আসরের নামাজ আদায়ের আগে। মসজিদের সামনে যেতে বলেছে, তাকে নিয়ে একটা জায়গায় যাবে।
ইরতিজা মেজেন্ডা রঙের জর্জেট থ্রি পিস পরেছে। মাথায় মেজেন্ডা রঙের হিজাব। মুখে ন্যাচারাল মেকআপ। ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক লাগিয়ে নিয়ে নিজেকে একবার পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে নিলো আয়নায়। তারপর বেরিয়ে পড়লো সাইড ব্যাগ নিয়ে।
মসজিদের সামনে এসে ম্যাসেজ দিলো ক্যানিয়লকে। একটু সময় পর বেরিয়ে এলো ক্যানিয়ল। সিঁড়ি থেকে নামতে নামতে মাথা থেকে সাদা টুপিটা খুলে নিলো। ইরতিজার কাছে এসে বললো,
“চলো।”

ইরতিজা কিছু না বলে গাড়িতে উঠে বসলো। এরপর প্রশ্ন করলো,
“কোথায় যাব আমরা?”

ইরতিজা কবর স্থানের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। এখান থেকে দেখছে ক্যানিয়লকে। ক্যানিয়ল মমের কবর জিয়ারত করতে এসেছে। ইরতিজা ক্যানিয়লের সাথে অনেকবার এসেছে এখানে। সে কবর স্থানের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে আর ক্যানিয়ল ভিতরে যায়। ক্যানিয়ল মাঝে মাঝেই তার মমকে খুব বেশি মিস করে। কাঁদে তখন। যদিও অগোচরে কাঁদতে চায়, তবুও ইরতিজা জেনে যায়।
ক্যানিয়ল ফিরে এলো। গাড়িতে উঠে বসার পর নীরব রইল অনেকক্ষণ। এখন গাড়ি নিয়ে কোথায় যাচ্ছে জানে না। তবে ইরতিজার মনে হচ্ছে গাড়ি যেন বেলভিউয়ের দিকেই অগ্রসর হচ্ছে।
গাড়ির ভিতরটা খুব বেশি থমথমে। ইরতিজা কিছু বলার প্রয়োজন বোধ করলো। কিন্তু কিছু খুঁজে পাচ্ছিল না বলার। অনেকক্ষণ চেষ্টা করার পর একটা বিষয় মনে পড়লো তার। বললো,
“মিরান্ডা নিজের ফিয়ন্সের সম্পর্কে সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করেছে দেখেছো?”

ইরতিজা ভালো করেই জানে ক্যানিয়ল মিরান্ডার খোঁজখবর জানার জন্য বসে নেই। তবে ক্যানিয়ল শুনেও কিছু বললো না। কোনো প্রতিক্রিয়াই দেখা গেল না তার মাঝে। ইরতিজা বলে চললো,
“ব্রিটেনেই বিয়ে করবে। সম্ভবত বিয়েটা আগামী বছরের শেষের দিকে হতে পারে কিংবা তার পরের বছর। ওর হবু স্বামী একজন বিজনেসম্যান। আমি মনে করি মিরান্ডা সুখী আছে। তার ক্যারিয়ারের উপর দুর্যোগ বয়ে গেলেও সে আবার নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে তোলার চেষ্টা করছে। মিডিয়ামুখী হয়েছে আবার। আমি চাই ও সুখী থাকুক। পৃথিবী…”

ক্যানিয়ল ইরতিজার কথার মাঝে কথা বলে উঠলো,
“আমি চাই না সুখী থাকুক।”
ইরতিজা ক্যানিয়লের মুখের নিষ্ঠুর ধ্বনি শুনে তাকালো ওর দিকে। ক্যানিয়ল বললো,
“আমি চাই খারাপ মানুষগুলো সব সময় অসুখী থাকুক। কিন্তু আসলে এ চাওয়া-পাওয়ার কোনো দাম নেই। ঠিকই খারাপ মানুষগুলো সুখে আছে। নাইলা সালেমও এমনই একজন। তার যতটা শাস্তি প্রাপ্য ছিল তা সে পায়নি।”

নাইলা সালেম বর্তমানে এরদোয়ানের নিজস্ব একটা বাড়িতে প্রায় বন্দি হয়ে জীবন পার করছে। জেল থেকে ছাড়া পেয়েছিল দুই মাসের মাথায়। এরদোয়ান জামিনে ছাড়িয়ে এনেছিল। চাইলে আরও অনেক আগেই জামিন নিয়ে ছাড়াতে পারতো, সেই ক্ষমতা এরদোয়ানের আছে। কিন্তু তার বিবেক বলেছে নাইলা সালেমের কিছুটা শাস্তি পাওয়া উচিত। এছাড়া মুহাম্মদ ইসহাকের কথাও চিন্তা করেছে। সব মিলিয়ে দুই মাসের মাথায়ই জামিন নিয়ে ছাড়িয়েছিল নাইলা সালেমকে। শত হলেও জন্মদাত্রী। মমের এমন কষ্ট দেখতে খারাপ লাগছিল তার। জামিনের পর এরদোয়ান তাকে নিজের একটা নিজস্ব বাড়িতে থাকার সব বন্দোবস্ত করে দেয়। কারণ মুহাম্মদ ইসহাক এক কথার মানুষ। সে আর গ্রহণ করবে না নাইলা সালেমকে। এরদোয়ান মমের হাতে কোনো টাকা পয়সা দেয় না। বলা তো যায় না টাকা পয়সা হাতে পেয়ে যদি মমের মাথায় ভূত চাপে? যদি আগের মতো আবারও ক্যানিয়লকে মেরে ফেলার ফন্দি আঁটে? মমকে দেখে রাখার জন্য এক মহিলাকে নিযুক্ত করেছে এরদোয়ান। মাসিক বাবদ খরচ সেই মহিলার কাছে দেওয়া হয়। সে প্রয়োজনীয় সব দিক খেয়াল রাখে।

ইরতিজা জানে সব কিছুই। মি. হেনরির কাছ থেকে সবকিছু জানা যায়। মি. হেনরি খুব উপকারী একজন মানুষ। জীবনে দেখা ভালো মানুষদের ভিতর মি. হেনরিও একজন। ইরতিজা ক্যানিয়লের কথার প্রত্যুত্তরে বললো,
“খারাপ মানুষদের নিয়ে ভেবো না আর, সর্বদা নিজের আশেপাশের ভালো মানুষদের নিয়ে ভাবো। তাদের সুখী রাখার চেষ্টা করো।”

“যদি আমি অসুখী হই তবে অসুখী হয়েও তোমাকে সুখী রাখবো ইনশাআল্লাহ।”

ইরতিজা অভয় দিয়ে বললো,
“তুমি সব সময়ই সুখী থাকবে।”

______________

আন্দ্রেজ ফিলাডেলফিয়া চলে যাওয়ার পর আর কখনও কারো সাথে যোগাযোগ করেনি। জুহি জানতো না এমনভাবে হারিয়ে যাবে আন্দ্রেজ। কষ্ট হয় তার, ভীষণ কষ্ট। আন্দ্রেজকে একবার দেখার জন্য তার মন বিদ্রোহ করে যায়। সে বুকের ভিতরই ওই বিদ্রোহ চেপে রাখে। অপেক্ষা করছে কবে আন্দ্রেজ রেডমন্ড আসবে। আন্দ্রেজ তো বলে গিয়েছিল রেডমন্ড আসলে অবশ্যই স্মরণ করবে তাকে। এখনও কেন আসছে না রেডমন্ড? জুহি খুব অধৈর্য বোধ করে, ছটফট করে।
যেদিন আন্দ্রেজ ফিলাডেলফিয়া চলে গেল সেদিন জুহি এক সমুদ্র কষ্ট, অভিমান, জেদ নিয়ে ঘরে বসে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। চেয়েছিল সে আর দেখবে না আন্দ্রেজের মুখ। আন্দ্রেজ তাকে রেখে চলে যেতে পারলে সে কেন কঠিন হয়ে থাকতে পারবে না? কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে তার সিদ্ধান্তে অনড় থাকতে পারেনি। সকল কাঠিন্যতা গুঁড়িয়ে দিয়ে সে ছুটে গিয়েছিল আন্দ্রেজের বাড়িতে। কিন্তু আন্দ্রেজরা ততক্ষণে বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছে। ব্যাকুল হয়ে এয়ারপোর্ট গিয়েও আর দেখা পায়নি আন্দ্রেজের! ততক্ষণে আন্দ্রেজ রেডমন্ড ছেড়ে ফিলাডেলফিয়ার পথে।
পুরোনো সেই দিনটার স্মৃতিচারণ করতে করতে জুহির ভিতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। সে এতগুলো মাসে কত চেষ্টা করেছে স্বাভাবিক হতে, কিন্তু পারেনি। খোঁড়া ছেলেটাকে কিছুতেই ভুলতে পারে না। আন্দ্রেজ কি তাকে মনে রেখেছে? না কি ভুলে গেছে? ভুলে গেছে মনে হলেই কষ্ট তার সবটুকু তিক্ততা নিয়ে উতলে ওঠে জুহির বক্ষস্থলে!
জুহি ইদানিং রিশনকে ভীষণ হিংসা করে। তার জীবন ফ্যাকাশে রূপ ধারণ করেছে, আর রিশনের জীবন এখন রঙে রঙে পূর্ণ।
দুই মাস হলো একজনের সাথে রিলেশনশিপে গেছে রিশন। মেয়েটা ওর ফ্যান। ওর প্রত্যেকটা ভিডিয়োতে মেয়েটার লাইক, কমেন্ট বিদ্যমান। মেয়েটা ওর ভিডিয়ো শেয়ারও করে। মেয়েটাও একজন ইউটিউবার। যেটা রিশনের সবচেয়ে বেশি পছন্দ। আস্তে আস্তে কথা হতে হতে দুজনের সম্পর্ক পরিণয়ে রূপ নিয়েছে। মেয়েটা দুবাইয়ের নাগরিক। রিশনও এখন দুবাই অবস্থান করছে। গার্লফ্রেন্ডকে জানিয়ে যায়নি। সারপ্রাইজ দিতে গিয়েছে। জুহি এই মেয়েটার বেলায়ও বলেছিল রিলেশনে না যেতে। এই রিলেশন টিকবে না। এটা শুনে তো রিশন রেগে আগুন! এই নিয়ে তুলকালাম বেঁধে গিয়েছিল দুজনের মাঝে। মা-বাবা জানে না রিশনের দুবাই যাওয়ার উদ্দেশ্য কী। তারা জানে ব্লগ বানানোর জন্য রিশন দুবাই গেছে।

জুহি উপুড় হয়ে শুয়ে আছে নিজের বিছানায়। আজ শরীরটা ভীষণ দুর্বল লাগছে। আজ সারাদিন বিছানায় শুয়ে-বসে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে। বাইরে তো দূর রুম থেকেই বের হবে না। যেই ভাবা সেই কাজ। রুম থেকে বের হলো না জুহি। খাবারও রুমে দিয়ে যাওয়া হলো।

জুহির মুখে এখন অপরাহ্ণের দুর্বল আলো ঝিকমিক করছে। উদাসী চিত্তে জানালার ধারে বসে আছে সে। ফোন বাজলো কাছে থাকা সেন্টার টেবিলটার উপর। জুহি হাত বাড়িয়ে তুলে নিলো ফোন। অপরিচিত নাম্বারের কল দেখে একটু বিস্ময় প্রকাশ পেল তার মুখে। তার ফোনে অপরিচিত কোনো নাম্বার থেকে কল আসে না বললেই চলে। জুহি কল রিসিভ করে কানে ধরলো। ওপাশ থেকে শান্ত স্পষ্ট একটি কণ্ঠ শোনা গেল,
“বলেছিলাম রেডমন্ড আসলে তোমাকে স্মরণ করবো। করেছি।”

আন্দ্রেজের কণ্ঠ শুনে জুহির বিশ্ব থমকে গেল কস্মিক কালের জন্য। আন্দ্রেজ? নড়েচড়ে উঠলো জুহি। এত মাস পর আন্দ্রেজের কণ্ঠ শুনতে পেয়ে হঠাৎ কান্না পেল তার। বললো,
“তুমি রেডমন্ড এসেছো?”

“কেমন আছো তুমি?”

“ভালো ছিলাম না। তোমাকে মনে পড়তো খুব।” মনের কথা মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল জুহির।

“আমি কিন্তু খারাপ ছিলাম না। আশা করেছিলাম তুমিও ভালো থাকবে। যাই হোক, দেখা করতে পারবে?”

“অবশ্যই, কোথায় দেখা করবে?”

কল কাটার পর আনন্দে, আবেগে একই সাথে হাসি-কান্না দুটোই পাচ্ছিল জুহির। সে খুশিতে দৌড়ে গেল ইরতিজার কাছে।
ইরতিজা নিজের রুমে বসে পড়ছিল। জুহি এসেই উদ্ভাসিত কণ্ঠে বললো,
“ইউ নো, আন্দ্রেজ এসেছে! আন্দ্রেজ এসেছে টিজা। আমাকে ওর সাথে দেখা করতে বলেছে।”

_________________

#উড়ো_পাতার_ঢেউ
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ৬২ (শেষ পর্ব–শেষাংশ)
________________

স্থানীয় একটা রেস্তোরাঁয় দেখা করলো আন্দ্রেজ, জুহি। জুহি যে আনন্দের সহিত এসেছিল সেই আনন্দ আর সে ধরে রাখতে পারলো না আন্দ্রেজের সাথে দেখা হওয়ার পর।
আন্দ্রেজ জানালার পাশে একটা টেবিলে বসে অপেক্ষা করছিল। এই জানলা থেকে দূরের সবুজ পাহাড়ের চূড়াগুলো দেখা যায়। দেখা যায় দীর্ঘ একটা জল থলথলে লেক। আন্দ্রেজের পাশে সুন্দরী কালো চোখের একটা মেয়ে বসে আছে। মেয়েটাকে দেখে কিঞ্চিৎ অবাক হয়েছে জুহি। আর এই অবাক হওয়ার নিচে ঢাকা পড়ে গেল ওর আনন্দের রেশ। জুহিকে দেখে আন্দ্রেজ উঠে দাঁড়ালো।

“তুমি এসে গেছো?”

জুহি এসে বসলো আন্দ্রেজের সম্মুখের চেয়ারে। আন্দ্রেজ ঠিক আগের মতোই আছে। চেহারা ঠিক আগের মতো। আগের মতোই শুকনো গড়নের।

“দীর্ঘ সময় পর তোমাকে দেখে সত্যিই ভীষণ ভালো লাগছে।” বললো আন্দ্রেজ।

জুহির কৌতুহল এখন আন্দ্রেজের পাশে বসে থাকা মেয়েটাকে নিয়ে। কেন যেন ভালো লাগছে না বিষয়টা তার। মেয়েটা তার চেয়ে বয়সে ছোটো সেটা অনুমান করতে পারছে। মেয়েটাকে কোমল প্রকৃতির মনে হলো। জুহি ডিরেক্ট জানতে চেয়ে প্রশ্ন করলো,
“ও কে?”

আন্দ্রেজ মেয়েটার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো। মেয়েটাও হাসলো আন্দ্রেজের দিকে তাকিয়ে। আন্দ্রেজ অতঃপর দৃষ্টি দিলো জুহির উপর। বললো,
“ওর নাম ফ্লোরি। আমার ওয়াইফ!”

খাঁখাঁ করে উঠলো জুহির বুক। মুখ শুকিয়ে রুক্ষ রূপ ধারণ করলো। আন্দ্রেজ কী বললো? ওয়াইফ? এটাই বলেছে? না কি তার শুনতে ভুল হয়েছে? জুহি মজা ভেবে উড়িয়ে দিতে চাইলো কথাটা। যদিও তা করা সম্ভব হলো না। হাসার চেষ্টা করে বললো,
“মজা করছো? এত তাড়াতাড়ি বিয়ে করেছো তুমি? এরকম মজা কেন করছো? কে হয় ও? তোমার ফিলাডেলফিয়ার ফ্রেন্ড?”

আন্দ্রেজ লক্ষ করছে জুহির মুখের নিচে থমথমে একটা ভাব চাপা পড়ে আছে।
জুহির মাঝে এখন উদ্বেগ। সে চাইছে আন্দ্রেজের বলা কথাটা মিথ্যা হোক। আন্দ্রেজের বলা কথাটা সত্যি হলে সে মরে যাবে! আন্দ্রেজ ওকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়ে বললো,
“মজা করছি না। ও সত্যিই আমার ওয়াইফ। আমরা রিসেন্টলি বিয়ে করেছি।”

______________

যে মেয়েটা এত উৎফুল্ল মনে বাসা থেকে বের হয়েছিল সেই মেয়েটার কান্নার আওয়াজে পুরো বাসা এখন করুণ রূপ ধারণ করেছে। জুহির কান্না দেখে ইরতিজার চোখেও জল টলমল করছে। জুহি কান্নারত বিরহ কণ্ঠে বললো,
“আন্দ্রেজ কীভাবে বিয়ে করতে পারে টিজা? ওর গ্র্যান্ডপা চাইলো আর ও অমনি বিয়ে করে নিলো? আমার কথা একবারও মনে পড়লো না ওর? নিজের ওয়াইফকে দেখাবে বলে ও আমাকে ডেকেছিল? না, ও আসলে মানসিক টর্চার করবে বলে আমাকে ডেকেছিল। আমার ভীষণ কষ্ট লাগছে টিজা। আমাকে রেখে আন্দ্রেজ কীভাবে বিয়ে করতে পারলো? ও আমাকে ভালোবাসেনি টিজা। ও আমাকে ভালোবাসেনি! সেই সময়কার ধারণা মিথ্যা ছিল আমার।”

ইরতিজারও ভীষণ খারাপ লাগছে। সে জুহির পিঠে সান্ত্বনার হাত বুলাতে বুলাতে বললো,
“কষ্ট পেয়ো না জুহি। এমনটা হওয়ার ছিল বলে হয়েছে! প্লিজ এমনভাবে কেঁদো না তুমি।”

জুহি কান্না থামালো না। মা-বাবা বাসায় না থাকাতে আরও মনের খায়েশ মিটিয়ে কাঁদলো। ওর মা-বাবা এক বাঙালি বন্ধুর বাসায় ডিনারের দাওয়াতে গেছে।
সন্ধ্যায় জুহি বাসা থেকে বেরিয়ে পড়লো। ইরতিজা ওর জন্য কোল্ড ড্রিংকস প্রস্তুত করার জন্য কিচেনে গিয়েছিল, ফিরে এসে দেখলো জুহি নেই। সদর দরজা দিয়ে বেরিয়ে দেখলো জুহি কোথাও চলে যাচ্ছে। ইরতিজা ডাকলো। কিন্তু জুহি শুনতে পেয়েও কিছু বললো না। পিছনও ফিরলো না।

ক্লাবে এসে রাগ-কষ্টে দুই বোতল বিয়ার পান করলো জুহি। এতেই নেশায় বুদ হয়ে গেল সে। জীবনে এই প্রথম বিয়ার পান করেছে। এর আগে কখনও কোনো মদ্য পান করেনি। কাউন্টারের সামনে বসে আছে সে। কিছুক্ষণ কাউন্টার টেবিলে মাথা নুইয়ে ছিল। আস্তে আস্তে মাথা তুললো। একটা বোতলের তলানিতে একটুখানি বিয়ারের অংশ ছিল সেটুকুও মুখে ঢেলে নিলো। তারপর পুরো ক্লাবটায় তাকালো একবার। উচ্চৈঃ শব্দে গান বাজছে। ডান্স গ্রাউন্ডে প্রায় অনেক গুলো ছেলে মেয়ে নাচানাচি করছে। জুহির বিরক্ত লাগছে এসব। অস্ফুট স্বরে বিড়বিড় করলো,
“ওগুলো সব জম্বির মতো করছে কেন?”

বলে সে নতুন একটা বোতল থেকে আরও কিছু তরল পদার্থ পান করলো। হঠাৎ তার চোখ পড়লো ক্লাবের এক কোণে থাকা শান্ত স্থানটার দিকে। ওখানে বসে কথা বলছে দুজন যুবক। জুহির চোখ একজন যুবকের উপর গাঢ়ভাবে আটকে গেল। যুবকটি পরিচিত হওয়ার পরেও নেশাগ্রস্ত জুহি তাকে চিনতে পারল না। তার চোখে এই মুহূর্তে ওই যুবক একজন রাজপুত্র। সে প্রথম দেখায় প্রেমে পড়ে গেছে ওই রাজপুত্রের। সে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে বলে উঠলো,
“হাউ কিউট! এত সুন্দর কেন ছেলেটা? ইশ কত মুগ্ধকর! আমি মুগ্ধ হয়ে গেছি তার রূপে। এই রাজপুত্র কি আমার সাথে ডেট করবে?”
জুহি টলতে টলতে উঠে দাঁড়ালো।

সাজিদ যেখানে বসে আছে এই জায়গাটি শান্ত স্থান ক্লাবের ভিতর। অফিস থেকে ম্যাক প্রায় জোর করে ধরে এনেছে তাকে। ক্লাব সে খুব একটা পছন্দ করে না। পাগলের কারখানা মনে হয় জায়গাটাকে। এখানে থাকা আর সম্ভব নয়। ম্যাক গা দোলাতে দোলাতে ডান্স গ্রাউন্ডের দিকে চলে গেছে। সাজিদকে এখন যেতে হবে। আর থাকার ধৈর্য নেই এখানে। উঠে দাঁড়ালো সে। যাওয়ার জন্য পাশ ফিরতেই এক নেশাগ্রস্ত মেয়ে তার দুই হাতে হাত স্পর্শ করে দাঁড়ালো।
সাজিদ প্রচণ্ড অবাক হলো। জুহিকে সে এখানে দেখতে পাবে একদম আশা করেনি। জুহি ড্রিংকস করেছে?
জুহি এখন নিজের রাজপুত্রের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তার মনে হাজারো প্রজাপতির ডানা ঝাপটাঝাপটি এখন। খুবই মিষ্টি গলায় বলার চেষ্টা করলো,
“হেই হ্যান্ডসাম প্রিন্স, তুমি কি আমার সাথে ডেটে যাবে? তুমি কি আমায় ভালোবাসবে? আমি তোমার প্রেমে পড়ে গেছি। তুমি কি আমার প্রেমে পড়বে? প্রেমে পড়ো আমার। আমি খুব মিষ্টি একটা মেয়ে। আমার সাথে ডেটে চলো।”

সাজিদ হতাশ। এই মেয়ে তো মাতাল হয়ে গেছে! হঠাৎ এত পান করেছে কেন? শখে? সাজিদ জুহির হাত সরিয়ে দিয়ে বললো,
“জুহি, তুমি কি আমাকে চিনতে পারছো না? এটা আমি, সাজিদ। চিনতে পারছো এখন?”

জুহির কানে ঢুকলো না ওসব। সে তার ধ্যানেই আছে। সে এবার দুই হাতে চেপে ধরলো সাজিদের গাল। চোখের পাতা বন্ধ করে বললো,
“প্লিজ গিভ মি অ্যা লাভলি কিস। প্লিজ মাই প্রিন্স, গিভ অ্যা লাভলি কিস।”

বলে জুহি চুমুর ন্যায় সুচালো করলো ঠোঁট।
সাজিদ নেত্র বন্ধ মাতাল জুহির দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। বললো,
“সত্যি সত্যি পাগল হয়ে গেছে!”

সাজিদ জুহিকে টেনে নিয়ে বেরিয়ে এলো ক্লাব থেকে। জুহি নিজে নিজে হাঁটতে পারছে না। আলুথালু হাঁটার চলন তার। একদিকে হাঁটা দিলে ঘুরে-ফিরে এদিক-ওদিক চলে যাচ্ছে। চোখে কেমন যেন সব অস্বাভাবিক দেখছে। সাজিদ এই অবস্থা দেখে জুহিকে ধরে এনে গাড়িতে বসিয়ে দিলো। এই মেয়েকে একলা ছেড়ে দেওয়া মানে বিপদ। সাজিদও ড্রাইভিং সিটে বসলো। সিট বেল্ট বাঁধার সময় লক্ষ করলো জুহি কেমন যেন করছে। সাজিদ বুঝতে পারলো এখন কী ঘটবে। সে সিটবেল্ট খুলে নামবে তার আগেই যা ঘটার তা ঘটে গেল! জুহি বমি করে দিয়েছে। দিয়েছে তো দিয়েছে তাও আবার সাজিদের গায়ে! ঘৃণায় সাজিদের শরীর কেমন করে উঠলো। দৃশ্যটা দেখার পর তারও বমি বমি পাচ্ছে। সে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে এলো গাড়ি থেকে।

______________

রিশন কাঁদছে। ওর পাশে বসে আছে ইরতিজা। রাতের আঁধারে প্রকৃতি ঢেকে যাওয়ায় জ্বলে উঠেছে কৃত্রিম সব আলোর উৎস। রিশনের মা-বাবা এখনও ফেরেনি। ইরতিজার বাসার সবাইও বাসার অভ্যন্তরে অবস্থান করছে, শুধু রিশন আর ইরতিজা বাইরে লনে বসে আছে। রিশন কিছুক্ষণ পর পর একেকটা টিসু দিয়ে নাক মুছে সেটা ফেলে দিচ্ছে। ইতোমধ্যে বেশ কিছু টিসু জমা হয়েছে তার পায়ের কাছে।
ইরতিজা বুঝতে পারছে না কিছু। আজ একই দিনে দুই ভাই-বোনের কান্নার জলে ভেসে যাচ্ছে সবকিছু। রিশন আজই আমেরিকা ফিরে আসবে এ সম্পর্কে কাউকে কিছু বলেনি। হঠাৎ তাই রিশনকে দেখে চমকে গিয়েছিল সে। খুব চমকে গিয়েছিল। সে রিশনের কাছে হঠাৎ এমনভাবে ফিরে আসার কারণ জানতে চাইলে তখনই কিছু জানায়নি রিশন।
গোসল সেরে ইরতিজাকে ডেকে লনে বসেছে। তারপর সব ঘটনা খুলে বলেছে। বলতে বলতে কান্নার বাধ ভেঙে পড়লো। সেই থেকে কাঁদছে। সব শুনে ইরতিজার মনও চরম খারাপ করেছে। মেয়েটা এরকম করলো কেন? নিষ্পাপ রিশনের সাথে এটা করা মেয়েটার মোটেই উচিত হয়নি!
বাড়ির সামনে রাস্তায় একটা গাড়ি থামতেই ইরতিজা, রিশন দুজনেই সেদিকে তাকালো। ইরতিজা গাড়িটা দেখা মাত্রই চিনলো। এটা সাজিদের গাড়ি।
গাড়ি থেকে প্রথমে নামলো সাজিদ। জুহি বমি করে দেওয়ায় ওর গায়ের কোট খুলে রাখতে হয়েছে। ওর গায়ে এখন স্কাই ব্লু রঙের শার্ট। জুহিকে দরজা খুলে বাইরে বের করলো। জুহি এখন চোখ তুলে তাকাতে পারছে না। ঘুমঘুম দুটি চোখ। সাজিদ ওকে ধরে নিয়ে আসতে লাগলো। জুহিকে এমন দেখে দাঁড়িয়ে গেল ইরতিজা। আতঙ্কিত কণ্ঠে বললো,
“কী হয়েছে ওর?”

ইরতিজার কণ্ঠ কানে এলে জুহি চোখ তুলে তাকালো। চোখ-মুখ কুঁচকে কেমন এক ভঙ্গিতে ইরতিজাকে দেখলো কিছুক্ষণ। তারপর মুখে এক চিলতে হাসি ফুঁটিয়ে বললো,
“ভালো আছো টিজা?”

ইরতিজা বুঝতে পারলো জুহি মদ পান করেছে। জুহির দৃষ্টি হঠাৎ আটকে গেল ইরতিজার পাশে বসে থাকা তার ভাইয়ের উপর। দু চোখ বুজে মাথা ঝাঁকিয়ে দৃষ্টি কিছুটা স্পষ্ট করে দেখার চেষ্টা করলো। হঠাৎ কেঁদে উঠলো জুহি। কাতর কণ্ঠে বললো,
“আমার লক্ষ্মী ভাইটা কাঁদছে কেন টিজা?”

জুহি সাজিদকে ছাড়িয়ে আলুথালু পা ফেলে রিশনের কাছে এসে বসলো। রিশনের চিবুক স্পর্শ করে কাঁদতে কাঁদতে কাতর কণ্ঠে বললো,
“কাঁদছো কেন তুমি?”

বোনকে কাঁদতে দেখে রিশনের কান্না আরও ভারি হলো। সে মনের দুঃখ খুলে বললো জুহির কাছে,
“উম্মেহানি আমার সাথে ছলনা করেছে সিস্টার। ও আমাকে ধোঁকা দিয়েছে। আমি ওকে সারপ্রাইজ দিতে গিয়েছিলাম, কিন্তু আমি নিজে কতটা সারপ্রাইজড হয়ে ফিরে এসেছি তুমি ধারণা করতে পারবে না। উম্মেহানি একজন বিবাহিত মেয়ে। এমনকি ওর একটা পাঁচ মাস বয়সী ছেলে বেবিও আছে। ও ছলনা করেছে আমার সাথে।”

সব শুনতে শুনতে জুহির কান্না একদম বন্ধ হয়ে গেল। সে কিছুক্ষণ নীরব বসে থেকে মস্তিষ্কে ধারণ করালো কথাগুলো। তারপর ফেঁটে পড়লো অট্টহাসিতে।

“আমি আগেই বলেছিলাম…আমি আগেই বলেছিলাম ওই মেয়ের সাথে রিলেশনশিপে না যেতে। দেখলে তো এখন। মেয়েটা আমার মনের মতো একটা কাজ করেছে।”

জুহি হাসতে হাসতে চেয়ারের সাথে হেলান দিয়েছিল, আর সাথে সাথে চেয়ারটা পড়ে গেল। চেয়ারের সাথে সাথে জুহিও পড়লো। পড়ে গিয়ে একটু আর্তনাদ করলো জুহি। ইরতিজা দৌড়ে এসে জুহিকে তুললো। জুহিকে আর থাকতে দিলো না এখানে। ভিতরে নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দিলো বিছানায়। তারপর বেরিয়ে এলো। দরজার কাছে আসতেই দেখতে পেল রিশন সাজিদকে প্রায় জড়িয়ে ধরে সাজিদের বুকে মাথা ঠেকিয়ে কাঁদছে। কীসব বলছে সে শুনতে পাচ্ছে না।

রিশন কান্না ভেজা কণ্ঠে বলছে,
“খুব কষ্ট হচ্ছে ব্রো। মেয়ে জাতি এমন কেন? দুইজন মেয়ে আমার মন নিয়ে ছিনিমিনি খেললো। আমার মন নিয়ে খেলা করা কি তাদের নেশা হয়ে গেছে? প্রথম জন যা করেছিল তাও তো তা মানার মতো ছিল, কিন্তু উম্মেহানি যা করলো তা আমার হৃদয়কে টু’করো টু’করো করে দিয়েছে। মেয়ে জাতি এত নির্দয় কেন?”

সাজিদের চোখ দরজায় গিয়ে পড়লো একবার। ইরতিজাকে দেখতে পেয়ে সে এখান থেকে যাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠলো। রিশনকে ছাড়িয়ে নিয়ে দ্রুত গাড়ির দিকে এগোতে লাগলো সে। ইরতিজাও নেমে এলো লনে। বললো,
“আমাকে দেখে পালিয়ে যাচ্ছেন কেন?”

সাজিদ থামলো এবং পিছন ফিরে তাকালো। ইরতিজা বললো,
“ধন্যবাদ। আমি ভেবেছিলাম ও হয়তো বাইরে হাঁটাহাঁটি করতে বেরিয়েছে। কিন্তু ও যে মদ পান করবে এ আমি কল্পনা করিনি। ও তো এসব খায় না। জুহিকে বাসায় পৌঁছে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।”

“ধন্যবাদের প্রয়োজন নেই।”

বলে সাজিদ আবারও যেতে উদ্যত হলে ইরতিজা বললো,
“আমি আপনার জন্য মেয়ে দেখেছি।”

সাজিদ থামলো। প্রথমে বুঝতে পারলো না কোন মেয়ে দেখার কথা বলছে ইরতিজা, যখন বুঝতে পারলো তখন পিছন ফিরে বললো,
“আপনাকে আমি ঘটকের চাকরি দিইনি।”

“এটা আমার দায়িত্ব ছিল। যেই দায়িত্ব এখন আরও গুরুতর হয়েছে।”

“ভুলে যান ওসব দায়িত্বের কথা। আমি নিজ দায়িত্বে একজন খারাপ মেয়ে খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা করবো। যে মেয়ে আপনার চেয়েও বেশি খারাপ। আপনি এনগেজমেন্টের পর এসে নিজেকে খারাপ বলে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন, আর আমি এমন একজনকে খুঁজে বের করবো যে মেয়ে বিয়ের পর আমার গলা কে’টে দিয়ে বলবে, আমাকে ডিভোর্স দিয়ে দিন। আমি কিন্তু তখন ডিভোর্স দেবো না। তাকে শেখাবো, আমাকে ভালোবাসতে। আপনার সাথেও যদি আমার বিয়ে হয়ে যেত, যদি আপনিও অমনভাবে আমার গলা কে’টে দিতেন, তাহলে আপনাকেও শেখাতাম। আপনাকে আরও বেশি ভালো করে শেখাতাম। এই শেখানো বিদ্যা ভুলে যাওয়ার কোনো উপায় থাকতো না।”

সাজিদ লম্বা পা ফেলে চলে গেল। গাড়ি নিয়ে চোখের অদৃশ্য হয়ে যেতেই ইরতিজা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
“আমি ক্যানিয়লকে নিয়ে ভালো আছি সাজিদ, ভীষণ ভালো আছি। আপনিও কাউকে নিয়ে এমনভাবে ভালো থাকুন। খুব খারাপ একটা মেয়ের আগমন ঘটুক আপনার জীবনে। যেই মেয়েটাকে আপনি ভালো করে তুলবেন নিজের ভালোবাসায়।”

__________________

শরতে ঘুরতে আসা হলো নিউ ইয়র্ক। ইরতিজার পরিচিত নিউ ইয়র্ক। সে আমেরিকা আসার পর এই শহরটাতেই প্রথমে পা রেখেছিল। নিউ ইয়র্ক এসেছে অনেকদিন পর। সেই যে রেডমন্ড গিয়েছিল তারপর আর আসেনি। রিশন আর জুহির মন খারাপ বলে ইরতিজা গত কয়েকদিন ধরে কোথাও ঘুরতে যাওয়ার প্ল্যান করেছিল। যদিও সে মনে মনে ভারমন্ট ঘুরতে যাওয়ার কথা চিন্তা করছিল, কিন্তু ক্যানিয়ল নিউ ইয়র্ক আসার বন্দোবস্ত করে ফেলায় নিউ ইয়র্কই আসা পড়লো। ইরতিজা প্রথমে নিউ ইয়র্ক আসতে চায়নি। কারণ, এই শহরের এক প্রান্তে জোনাসের বসবাস।

নিউ ইয়র্কের গাছে গাছে এখন নানান রং বেরংয়ের তুলির আঁচড়। গাছের পাতায় পাতায় শুধুই লাল, কমলা আর হলুদের ছড়াছড়ি। এখানে এসেছে দুই দিনের সময় নিয়ে। প্রথম দিন গাড়িতে করে ঘুরে বেরিয়েছে আর আপেল পিকিং করেছে শুধু। সেপ্টেম্বর থেকে শুরু করে অক্টোবরের মাঝামাঝি অব্দি চলতে থাকে ‘এপল পিকিং’। নির্দিষ্ট একটা ফি দিয়ে বিশেষ সাইজের ব্যাগ সংগ্রহ করে সবাই ঢুকে পড়ে তাদের পছন্দসই কোনো এক আপেল বাগানে। তারপর ইচ্ছা-পছন্দমতো আপেল নিয়ে ব্যাগ পূর্ণ করতে পারে।
আপেল পিকিং এর পাশাপাশি চলতে থাকে মিষ্টি কুমড়া দিয়ে বিভিন্ন রকমের ভূত তৈরি করা। কারণ অক্টোবরের ৩১ তারিখ যে আমেরিকানদের জনপ্রিয় এক উৎসব মুখর দিন। যাকে বলা হয় ‘হ্যালোইন’। এই হ্যালোইনে মিষ্টি কুমড়া দিয়ে ভূত বানানো খুবই জনপ্রিয়। মিষ্টিকুমড়া দিয়ে তৈরি করা বিভিন্ন রকম ভূতুড়ে মুখের ভিতর বাতি জ্বালিয়ে বাড়িতে বাড়িতে ঝুলিয়ে রাখা হয়। কেউ কেউ আবার উঠোনে মাকড়সার জাল বানিয়ে তাতে টাঙিয়ে দেয় কঙ্কাল। পুরো বাড়িই হয়ে ওঠে ভূতুড়েময়। ছোটো ছোটো ছেলে-মেয়েরা ভূতের পোশাক পরে ভূত সেজে দল বেঁধে বের হয়ে পড়ে চকলেট-ক্যান্ডি সংগ্রহের উদ্দেশ্যে। ইরতিজাদের নিউ ইয়র্কের হ্যালোইন উৎসব দেখা হবে না। কারণ ওরা ৩১ তারিখের আগেই চলে যাবে। ওরা দেখবে রেডমন্ডের হ্যালোইন উৎসব।
আজ নিউ ইয়র্কের দ্বিতীয় দিন ওদের।
আজ বেশিরভাগ সময়ই থাকবে শরতের রঙিন প্রকৃতির সাথে। ঘুরতে যাবে পাহাড়ের বুকে থাকা আঁকাবাঁকা পথে। যে পথের দুই ধারে দাঁড়িয়ে আছে রঙিন গাছ। গাড়িটা এখন সেই পথেই চলছে। ধীরে গতিতে। হলুদ প্রজাপতির দল তাদের রঙিন পাখা নাচিয়ে উড়ছে। নাকে ভেসে আসছে বিভিন্ন বুনো ফুলের ঘ্রাণ। ম্যাপল বনের দিকে অপলক মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে আছে ইরতিজা। চোখ এই ম্যাপল গাছের বাইরে কী আছে তা দেখতে পাচ্ছে না। পুরো বন ম্যাপল গাছেই ঠাসা। পাতা ঝরে পড়ছে দুলে দুলে। কালো পিচের রাস্তার উপর অসংখ্য রঙিন পাতা শুয়ে আছে। কানে আসছে পাখির কিচিরমিচির শব্দ।
গাড়ি থামলো এসে বনের এক প্রান্তে। বনের মাটি ঢেকে দিয়েছে পাতার আস্তরণ। পায়ের নিচে শুধু পাতা আর পাতা। রিশন নিজের ক্যামেরা নিয়ে সর্বদা প্রস্তুত। ইরতিজা, জুহি বনের ওদিকটায় গিয়ে নানা রকম ফটো তুলছে। রিশন ভিডিয়ো করতে করতে যথারীতি বকবক করে চলেছে। ক্যানিয়ল সব মিলিয়ে খুব বিরক্ত হয়ে বসে রইল গাড়ির উপরে। সে যে একটা মানুষ এদের সঙ্গে এসেছে তা কেউ পাত্তাতেই ধরছে না। একটু-আধটু অপমান বোধ হচ্ছে ক্যানিয়লের।
রিশনের ভিডিয়ো করা শেষ হলে সে ক্যানিয়লের কাছে এলো। ক্যানিয়লের সামনে মোবাইল ধরে বললো,
“এটা আমার ইউটিউব চ্যানেল, অবশ্যই সাবস্ক্রাইব করবে। আর ভিডিয়ো গুলোও অবশ্যই দেখবে এবং লাইক করবে। সাথে কমেন্টও দেখতে চাই। ঠিক আছে?
আরও দুটো চ্যানেল আছে। ওগুলোও চিনিয়ে দেবো তোমায়। ওই চ্যানেল গুলোর ভিডিয়ো গুলোও দেখবে। ও কে?”

বিরক্তিতে মুখ বিকৃত হলো ক্যানিয়লের। বললো,
“আমার উচিত ছিল সাথে করে একটা হকি স্টিক নিয়ে আসা। তোমাকে দেখলেই মনে হয় তোমার মাথায় একেকটা করে হকি স্টিক ভাঙি। এই মুহূর্তে হকি স্টিক ভাঙার ইচ্ছাটা আরও বেশি হচ্ছে।”

“তোমার এত বড়ো সাহস? তুমি আমার কাজিনের উডবি হাসব্যান্ড সেটা ভুলে যাবে না। আমার সাথে এমন ব্যবহার করলে কিছুতেই আমি আমার কাজিনের বিয়ে তোমার সাথে হতে দেবো না।”

ক্যানিয়ল ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে রিশনের কথাকে তুচ্ছজ্ঞান করলো। তারপর বললো,
“তুমি তো দুবাইই গিয়ে ছ‍্যাঁকা-ট্যাকা খেয়ে এসেছো, কেঁদে কেটে ভাসিয়ে দিচ্ছিলে রেডমন্ড শহর। তাহলে এখনও কীভাবে তুমি তোমার ইউটিউব চ্যানেলের যত্ন নিচ্ছ? তোমার তো উচিত সব ইউটিউব চ্যানেল ভ্যানিশ করে দিয়ে দেবদাস হয়ে যাওয়া।”

“তোমার মতো গর্দভ হলে তো সেটাই করতাম। কিন্তু আমার মতো বুদ্ধিমানরা এটা করার কথা চিন্তাও করবে না। জানো এই ইউটিউব চ্যানেল দিয়ে আমি মাসে কত ডলার আয় করি? প্রচুর। প্রচুর আয় করি আমি। আমি তো সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি, জুহি এবং টিজা, দুজনকে দুটো ইউটিউব চ্যানেল খুলে দেবো। পারলে নওরিনকে দিয়েও একটা ইউটিউব চ্যানেল চালাবো। আর আমার মনে হয় তোমারও একটা ইউটিউব চ্যানেল খোলা উচিত। বেশি না শুধু প্রথম এক বছর একটু কঠোর পরিশ্রম করে দেখো। দেখবে তুমি এক বছরেই লাখপতি হয়ে গেছো। তারপর আস্তে আস্তে দেখবে ফ্যান ফলোয়ারের সাথে সাথে ডলারের পরিমাণটাও তরতর করে বেড়েই চলবে। এক সময় তুমি লাখপতি থেকে কোটিপতিও হয়ে যাবে।”

“আমি এখনই কোটিপতি ইডিয়ট, এক বছর অপেক্ষা করে লাখপতি হওয়ার কোনো আগ্রহ ইচ্ছা আমার নেই। আর তুমি গর্দভ কাকে বলছো? তোমার সাহস দেখে শিহরিত আমি। মানে তোমার কাজিনকে বিয়ে করবো বলে আমার সাথে যা নয় তাই ব্যবহার করতে পারবে ভেবেছো? ফারদার আমার সাথে এমন ব্যবহার করলে হাত, পা, মাথা, ঘাড়, পাঁজর সব ভে’ঙে দেবো।”

রিশন এমন হুমকিতে যদিও কিছুটা ভয় পেয়েছে, তবুও তা ধরা দিলো না। বললো,
“বড়োলোক বলে আগেই অহংকারে মাটিতে পা পড়তো না তোমার। আর এখন তো বিনা পরিশ্রমে বাবার বিশাল একটা কোম্পানি পেয়ে গেছো। এখন তুমি আকাশে উড়বে সেটাই স্বাভাবিক। তবে আমি টিজাকে একটা ইউটিউব চ্যানেল খুলে দেবোই। ও ওর সুবিধা মতো, পছন্দ মতো ভিডিয়ো বানাবে। আমাদের ফ্যামিলির প্রত্যেকে সফল ইউটিউবার বয়-গার্ল হিসাবে খ্যাতি অর্জন করবে।”

রিশন কেমন অহংকার ভঙ্গিতে হেঁটে চলে গেল। ক্যানিয়লের খুব ইচ্ছা হচ্ছিল পিছন থেকে একটা লা’থি মেরে ফেলে দেয়, কিন্তু অযথাই ঝামেলা বাঁধবে বলে চুপ রইল।

ইরতিজার সবে খেয়াল হলো ক্যানিয়ল তাদের সাথে বনের ভিতরে আসেনি। রাস্তায় গাড়ির উপর উঠে বসে আছে। ইরতিজা ক্যানিয়লের কাছে এসে বললো,
“তুমি রোবটের মতো কেন বসে রয়েছো এখানে? বন ঘুরে দেখবে না?”

“এখানে বসে রয়েছি সেই তো বেশি। তোমাদের তিন পঙ্গপালকে রেখে গাড়ি নিয়ে চলে যাচ্ছি না এটাই তো পরম সৌভাগ্য তোমাদের।”

ইরতিজা বিস্মিত কণ্ঠে বললো,
“প…পঙ্গপাল?”

ক্যানিয়ল আর ও বিষয়ে কোনো কথা বললো না। বললো,
“চলো, পালিয়ে যাওয়া যাক।”

“মানে?”

“মানে হচ্ছে দুই পঙ্গপালকে রেখে আমি এক পঙ্গপালকে নিয়ে পালিয়ে যাব।”

“আমি বুঝতে পারছি না তোমার কথা।”

ক্যানিয়ল নামলো গাড়ি থেকে। ইরতিজাকে গাড়ির ভিতরে ঢুকিয়ে বসালো। তারপর নিজেও গাড়িতে উঠে বসে ভোঁ করে চলে গেল গাড়ি নিয়ে।
গাড়ি যাওয়ার শব্দ হতে জুহি, রিশন দুজনই তাকালো। জুহির মুখ ফসকে বিস্ময় ধ্বনি বেরিয়ে এলো,
“এটা কী হলো?”

পাহাড়ি রাস্তার এক জায়গায় এসে ক্যানিয়ল গাড়ি থামালো আবার। বেশি দূর আসেনি। এখানেও রাস্তার দুই পাশে ম্যাপল গাছ দাঁড়িয়ে আছে মাথায় রঙিন পত্র নিয়ে। ইরতিজা নামতে নামতে বললো,
“এটা কী করলে তুমি? ওদেরকে এমনভাবে ওখানে ফেলে রেখে আসা কি উচিত হয়েছে?”

“এমন তো না যে ওদেরকে পুরো দিন ওখানে ফেলে রাখবো। কিছুক্ষণ পরই আবার ওদের কাছে যাব।”

“আসার কী দরকার ছিল এখানে?”

“কোনো দরকারই ছিল না। তবুও বিনা দরকারে আমি সব করতে পারি।”

“আজব মানুষ তুমি!”

ক্যানিয়ল হাসলো।

এতক্ষণ শান্ত ছিল পরিবেশ। বাতাস হতেই ঝরে পড়তে লাগলো ম্যাপল পাতা। ইরতিজার চোখ ক্যানিয়লের থেকে সরে গিয়ে প্রকৃতিতে গিয়ে আটকালো। দৌড়ে ম্যাপল বনে ঢুকলো সে। উড়ে পড়া পাতাগুলো হাত ছুঁইয়ে দেখলো।
ইরতিজা উড়ে পড়া একটা পাতাকে মুঠো বন্দি করতে চাইলো। যে সময় পাতাটা মুঠো বন্দি হওয়ার পথে ছিল ঠিক তখনই সেই পাতাটা ইরতিজার হাতে পড়ার আগে ক্যানিয়ল ধরে ফেললো। ইরতিজা চকিতে তাকালো ক্যানিয়লের দিকে। ক্যানিয়ল বিরক্ত কণ্ঠে বললো,
“বাচ্চাদের মতো উল্লাস করা বন্ধ করো।”

ইরতিজার মন ক্ষুণ্ন হলো। বললো,
“তুমি এমন কেন?”

“কেমন?”

“ভীষণ বেরসিক মানুষ!”

“উহুঁ, আমি তা নই।”

“তাহলে কী তুমি? সন্ত্রাসী?”

ক্যানিয়ল হেসে বললো,
“তেমনই কিছু।”

ইরতিজা আর কিছু বললো না, গম্ভীর হয়ে গেল। ক্যানিয়ল ইরতিজাকে এমন লক্ষ করে ডাকলো,
“পাকিস্টানি গার্ল!”

“আমি পাকিস্তানি গার্ল নই এটা কতবার বলতে হবে তোমাকে? আমি বাংলাদেশি। আমি বেঙ্গলি গার্ল। আর ডাকবে না আমাকে পাকিস্তানি গার্ল বলে।”

“অবশ্যই ডাকবো। বাংলাডেশি না হয়ে যদি ব্রিটেনেরও হও তবুও আমি তোমাকে পাকিস্টানি গার্ল বলে ডাকবো। কারণ এটা আমার অভ্যাস হয়ে গেছে।”

“বাংলাদেশ নিয়ে গিয়ে তোমাকে গরম ভাতের সাথে কাঁচা মরিচের ভর্তা খাওয়ালেই তোমার অভ্যাস পরিবর্তন হবে।”

ক্যানিয়ল বুঝতে পারলো না ইরতিজার কথা। মেয়েটা এই মাত্র বাংলা বলেছে তো সেজন্য। তবে সে ইরতিজার চেহারা দেখে বুঝতে পারলো তাকে উদ্দেশ্য করে ভালো কিছু বলা হয়নি। সে বললো,
“আর কখনও আমার সামনে বাংলা উচ্চারণ করো না, আমিও তাহলে বাংলা শিখতে বাধ্য হবো।”

“দেখো, দু-চারটা দাঁত যেন পড়ে না যায়।”

বলে খিলখিল করে হাসতে লাগলো।
পাতা ঝরে পড়া থেমেছে। ইরতিজা একটা নিচু ডাল থেকে একটা লাল রঙের পাতা পাড়ার চেষ্টা করলো। কিন্তু তার যেটুকু উচ্চতা তাতে ডালের নাগাল পেল না। অগত্যা ক্যানিয়লকে বললো,
“আমাকে সহযোগিতা করো।”

“কেন আমি তোমার জন্য পাতা পাড়তে যাব? নিজে করে নাও।”

ক্যানিয়ল রাস্তার দিকে মুখ করলো। ধূসর থেকে কালো হয়ে গেল ইরতিজার মুখ। ক্যানিয়লের অবহেলায় কষ্ট পেয়েছে সে। যাক চলে, লাগবে না ক্যানিয়লকে। ইরতিজা পায়ের পাতায় ভর করে আরেকটু উঁচু হয়ে হাত বাড়িয়ে পাতাটা ছেড়ার চেষ্টা করতে লাগলো। পাতা ছিঁড়ে ক্যানিয়লকে দেখিয়ে দিতে হবে। ইরতিজা যখন চেষ্টা করেও পাতার নাগাল পাচ্ছিল না সে সময় কেউ একজন তাকে উঁচু করে উপরে তুলে ধরলো। বিস্ময়ে আড়ষ্ট হয়ে গেল ইরতিজা। তাকিয়ে দেখতে পেল ক্যানিয়ল তাকে উঁচুতে তুলে ধরেছে।

ক্যানিয়ল শুধালো,
“পাতা ছিঁড়বে না? ফেলে দেবো?”

বিস্ময় জড়িত ইরতিজা বলতে পারলো না কিছু। শুধু তাকিয়ে রইল। এইমাত্রই ক্যানিয়ল তাকে সাহায্য না করে চলে যাচ্ছিল। আবার ফিরে এমন করলো। ক্যানিয়ল ইরতিজাকে এমনভাবে নির্বাক চেয়ে থাকতে দেখে বললো,
“ফেলেই দিই।”

ক্যানিয়ল সত্যিই ছেড়ে দিলো ইরতিজাকে। ইরতিজা পড়ে যাচ্ছিল। কিন্তু মাটিতে পড়ার আগেই ক্যানিয়ল ওর এক হাত ধরে নিজের দিকে টেনে বললো,
“পড়বেই যখন, এভাবে পড়ো পাকিস্টানি গার্ল।”

ম্যাপল পাতার উপর দুজন মানুষের পতনের জন্য কেমন এক শব্দের সৃষ্টি হলো। ইরতিজা আতঙ্কে খিঁচে ধরেছিল দুই চোখ। তার মনে হয়েছিল সে মাটিতে পড়ে মাথায় প্রচণ্ড আঘাত পাবে। কিন্তু সে কোনো রকম ব্যথা অনুভব করলো না। পিটপিট করে চোখ খুললো। একটা প্রশস্ত বুকে মাথা রেখে আছে সে। একটু মুখ তুলে ক্যানিয়লের দিকে তাকালো। ক্যানিয়ল নিশ্চিন্ত চিত্তে নিজের মাথার নিচে ডানহাত রেখে বড়ো করে নিঃশ্বাস ত্যাগ করলো। খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো,
“আমার বুকে মাথা রাখা অনেক শান্তির তাই না?”

ইরতিজা হতবিহ্বল হয়ে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল ক্যানিয়লের দিকে। এরপর তড়িঘড়ি করে উঠে যেতে চাইলো ক্যানিয়লের উপর থেকে। কিন্তু উঠে যেতে চাইলেই ক্যানিয়ল ইরতিজার মাথা নিজের বুকে চেপে ধরলো। থমকে গেল ইরতিজা।
ক্যানিয়ল বললো,
“আরও কিছুক্ষণ থাকো এরকম।”

এক সেকেন্ড, দুই সেকেন্ড এরকম করে সময় পার হতে লাগলো। ইরতিজার বক্ষস্থল ঢিপঢিপ করছে। বিব্রত বোধ খুঁড়ে খুঁড়ে খাচ্ছে তার ভিতরকে। তার সাথে সাথে লজ্জা মিশ্রিত এক নিঝুম প্রগাঢ় অনুভূতি ছেয়ে ফেললো তার হৃদয়।

ক্যানিয়ল বললো,
“কেমন হতো পাকিস্টানি গার্ল, যদি এই নির্জন ম্যাপল বনে একটা ট্রি হাউজ তৈরি করা হতো? শরৎ এলেই ম্যাপল বন রঙিন হয়ে উঠতো, ঠিক আমাদের অনুভূতি যেমন সবসময় রঙিন এবং সতেজ। অলিন্দ থাকতো, আমরা দুজন অলিন্দে দাঁড়িয়ে উড়ো পাতার ঢেউ দেখতাম। সাথে বৃষ্টি হলেও মন্দ হতো না। বৃষ্টিতে ভিজতাম। তোমার মুগ্ধতাও আমাকে খুব করে ভিজিয়ে দিয়ে যেতো। আমি কিছু ভেজা ভায়োবিন দিতাম তোমায়। আর কানে কানে বলতাম, ‘ভায়োলেট কুইন, আমার জীবনে আসার জন্য ধন্যবাদ তোমাকে। এই যে তুমি আমার জীবনে আছো, আমি ধন্য। সারাজীবন যে আমার সাথে থাকার সংকল্প করেছো, আমি কৃতজ্ঞ। তুমি আমার ভালো থাকার অন্যতম কারণ।’ ”

ইরতিজার হৃদয় এক পশলা ভালোবাসার বৃষ্টিতে ভিজে গেল। কোমল হৃদয় আরও কোমল হয়ে উঠলো তার। চোখের কোণ বেয়ে সংগোপনে আনন্দ অশ্রু ঝরে পড়লো। ক্যানিয়ল যে তাকে ভীষণ ভালোবাসে এটা সে অনুভব করতে পারে। কীভাবে যেন টের পায় এই ভালোবাসার গভীরত্ব। এই গভীরত্ব ঠিক কতখানি? না, এই গভীরত্ব কোনো কিছু দ্বারা পরিমাপ করা যাবে না। এটা অপরিসীম। এর কোনো পরিমাপ হয় না।

(সমাপ্ত)
______________

ভুলগুলো ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। যারা এতদিন গল্পটার সাথে ছিলেন তাদের প্রতি আমার ভালোবাসা রইল❤️