#উড়ো_পাতার_ঢেউ
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ৩৭
_________________
কুয়াশাচ্ছন্ন সকাল। গাঢ় কুয়াশায় বাইরেটা ঢাকা পড়েছে। আজ হঠাৎ করেই এত কুয়াশা পড়লো। এতদিন এত কুয়াশা পড়তে দেখা যায়নি। একটু পর পর একটা দুটো গাড়ি হেডলাইট জ্বালিয়ে ছুটে যাচ্ছে। এই কুয়াশার মাঝে গাড়ি চালাতে হয় খুব সাবধানে, সচকিতভাবে।
আজাদ চৌধুরীও এখন বেরিয়ে পড়বেন। যাওয়ার আগে দুই মেয়ের জন্য দুই কাপ কফি তৈরি করলেন। শারমিন আহমেদ থাকা সত্ত্বেও সে মাঝে মধ্যেই মেয়েদের নিজ হাতে চা অথবা কফি বানিয়ে খাওয়ায়। নওরিন ঘুমাচ্ছিল। আজাদ চৌধুরী নক করার পর উঠে দরজা খুললো। নওরিনের ঘুম ঘুম চোখ দেখে আজাদ চৌধুরী বললেন,
“তুমি ঘুমাচ্ছিলে?”
নওরিন হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো।
“কাজ নেই আজকে?”
“ছুটি নিয়েছি।”
“তুমি কি কোনো কারণে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত?” নওরিনকে দেখে হঠাৎ এমনই মনে হলো তার।
নওরিন একটু অপ্রস্তুত বোধ করলো। হ্যাঁ সে একটা ব্যাপার নিয়ে ভীষণ দুশ্চিন্তা করছে। কিন্তু সেটা বাবাকে বলা ঠিক মনে হলো না। সে দুই পাশে হালকা মাথা নাড়িয়ে বললো,
“নাথিং। কোনো বিষয় নিয়েই দুশ্চিন্তা করছি না।”
আজাদ চৌধুরীর মন থেকে সংশয় গেল না। তবুও সে মুখে এক চিলতে হাসি ফুঁটিয়ে বললেন,
“ছুটির দিন ভালো কাটুক ডিয়ার।”
নওরিনও হাসলো বাবার সাথে সাথে। কিন্তু বাবা চলে যাওয়া মাত্রই তার মুখ আবার আঁধারে ঢাকলো।
ইরতিজা জানালার ধারে বসে অন্যমনস্ক হয়ে বাইরের কুয়াশাচ্ছন্ন প্রকৃতিতে তাকিয়ে ছিল। এর মাঝে কানে এলো,
“মে আই কাম ইন?”
দরজায় তাকিয়ে দেখলো বাবা দাঁড়িয়ে আছে। একটুখানি হেসে বললো,
“কামিং।”
আজাদ চৌধুরী ভিতরে ঢুকলেন। কফির কাপটা নামিয়ে রাখলেন টেবিলে। ইরতিজার সামনে এসে ওর মুখটা দেখলেন ভালো করে। বললেন,
“তুমিও কি তোমার বোনের মতো কোনো কারণে চিন্তিত?”
চমকে গেল ইরতিজা। বাবা কী করে বুঝতে পারলো? বিষয়টা গোপন রেখে গেল ইরতিজা। বললো,
“নাথিং।”
“তোমার বোনও একই কথা বলেছে, ‘নাথিং’!”
“আসলেই কিছু নিয়ে চিন্তিত ছিলাম না।”
“আমার মেয়েরা মিথ্যা বলায় খুব পারদর্শী, যেটা বুঝতে পারছি আজকাল।”
ইরতিজা ধরা পড়ে গিয়ে মাথা নুইয়ে ফেললো। কিয়ৎকাল নত অবস্থায় থেকে হঠাৎ সোজা হয়ে বসে সবল কণ্ঠে বললো,
“হ্যাঁ আমি চিন্তিত ছিলাম। এটা নিয়ে ভীষণ ভেবেছি আমি। খুব ভালো করে ভেবেছি। আর সব ভেবেচিন্তে যে বিষয়টা উপলব্ধি করতে পেরেছি সেটা হলো, আমি সাজিদকে একদমই বিয়ে করতে পারবো না।”
“কিন্তু বিয়ে করতে হলে একদমই করতে হবে। আমার ধারণা মতে ‘একটুখানি’ বিয়ে করা যায় না।”
“তুমি কি এটাকে মজা ভাবছো আব্বু? আমি সিরিয়াসলি বলেছি। ইট’স নট আ জোক!”
“হ্যাঁ তুমি হয়তো জোক করছো না, কিন্তু এটা অনেকটা তার মতোই শোনালো।”
অসহায়ত্ব যেনো দুই হাত দিয়ে ইরতিজার মুখটা লেপ্টে দিয়ে গেল। তা দেখে একটু সিরিয়াস হলেন আজাদ চৌধুরী। জিজ্ঞেস করলেন,
“কেন বিয়ে করতে চাও না এর উপযুক্ত কারণ কি তোমার কাছে আছে?”
ইরতিজা নিরুত্তর রইল।
“বিয়ে করতে না চাওয়ার কারণটা যেন অবশ্যই জোনাস না হয়!” আজাদ চৌধুরী বললেন।
ইরতিজা যারপরনাই অবাক।
“কী বলছো আব্বু! এটার কারণ জোনাস কেন হবে? কারণটা অবশ্যই ও নয়। সাজিদকে বিয়ে না করার তেমন কোনো কারণও নেই। কিন্তু…”
আজাদ চৌধুরী থামিয়ে দিলেন ইরতিজাকে,
“নিজের কথার মাঝখান থেকে যে যত বেশি ‘কিন্তু’ শব্দকে এড়িয়ে চলতে পারবে, আমি মনে করি তার জীবন তত বেশি সুন্দর। তুমিও নিজের জীবন সুন্দর করার চেষ্টা করো ইরতিজা। ইনশাআল্লাহ তুমি সুখী হবে!”
“কিন্তু আমি যদি ‘কিন্তু’ শব্দটা এড়িয়ে যাই তাহলে এটা আমার পিছনেই পড়ে থাকবে। জীবন সুখীর বদলে আরও কিন্তুপূর্ণ হয়ে উঠবে। কারণ এটার কোনো সমাধান হয়নি। আমি এড়িয়ে গেছি কিন্তুকে। ওই কিন্তুতেই আটকে গেছে সবকিছু, সমাধানহীন। যতক্ষণ না এটা নিজের সমাধান খুঁজে পাবে ততক্ষণ পর্যন্ত এটা আমাকে যন্ত্রণা দিয়ে যাবে।”
আজাদ চৌধুরী এবার সঙ্গে সঙ্গে কোনো দ্বিরুক্তি করলেন না। বেশ কিছু সময় নীরবতা পালন করে বললেন,
“আমি কাকে বেশি ভালোবাসি ইরতিজা? তোমাকে? না কি নওরিনকে?”
“আমাদের দুজনকেই প্রচণ্ড রকম ভালোবাসো, কিন্তু আমি আমার জন্য ভালোবাসাটা একটু বেশি দেখতে পাই।”
“এমনটা কি হওয়ার কথা? সম্পর্ক অনুযায়ী তো আমার নওরিনকে বেশি ভালোবাসা উচিত। কারণ ও আমার মেয়ে।”
“আমিও তোমারই মেয়ে আব্বু।” গলা চড়াও করে বলে উঠলো ইরতিজা। ভীষণ জোর লক্ষ করা গেল তার গলায়।
আজাদ চৌধুরী স্মিত হেসে বললেন,
“হ্যাঁ তুমি আমার মেয়ে। আর আমি তোমার বাবা। যে বাবা তোমাকে অত্যন্ত ভালোবাসে। যে তোমাকে এতটা ভালোবাসে সে নিশ্চয়ই চাইবে না তুমি খারাপ থাকো। চাইবে?”
প্রশ্নটা ইরতিজার দিকে ছুঁড়ে দিলেন।
ইরতিজা বললো,
“চাইবে না।”
“আমি সাজিদের মাঝে ওই জিনিসটা দেখতে পেয়েছি, যেটা দেখে আমার মনে হয়েছে আমার মেয়ে একশ ভাগ ভালো থাকবে এর কাছে। এমন একটা নিশ্চয়তার স্থান ছেড়ে দিয়ে আমি অন্য স্থানের দিকে পা বাড়ালে সেটা এমন নিশ্চয়তার না’ও হতে পারে। তো অযথাই অমন সংশয়ের দিকে আমি কেন এগোবো?”
“এমনটা তোমার কাছে মনে হচ্ছে…”
ইরতিজা আর কিছু বলার আগেই আজাদ চৌধুরী বললেন,
“যেতে হবে আমাকে। এমনিতেই অনেক সময় ব্যয় করে ফেলেছি।”
তিনি ইরতিজার কপালে স্নেহের চুম্বন এঁকে দিয়ে বেরিয়ে গেলেন।
ইরতিজার এই মুহূর্তে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু কাঁদতে পারলো না। শুনতে পেল জুহি তাকে ডাকছে। সে ব্যাগ পত্র নিয়ে বেরিয়ে পড়লো, সাথে কফির কাপটা নিতেও ভুললো না।
লনে এসে দেখলো জুহি এবং রিশন দাঁড়িয়ে আছে। জুহির গায়ে একটা রেড জ্যাকেট সাথে রেড টুপি। ব্লন্ড কালার করা চুলগুলো দুই কাঁধ বেয়ে সামনের দিকে নেমেছে। গতকালই এই কালার করেছে চুলে। ভালোই লাগছে ওকে এই চুলে দেখতে। রিশনের গায়ে একটা নেভি ব্লু জ্যাকেট। প্রায় এই রকমই একটা জ্যাকেট জোনাসেরও আছে। জ্যাকেটটা শুধু একবারই দেখেছিল জোনাসের গায়ে। যেদিন প্রথম জোনাসের সাইকেলে চড়েছিল সেইদিন। রিশনের সমস্যা কী? মাঝে মাঝেই সে জোনাসের মতো করে ওর গাল টেনে দেয়! আজ আবার জোনাসের মতো জ্যাকেটও পরেছে! অবাক বিষয়!
ইরতিজা সামনে এসে দাঁড়াতেই রিশন ইরতিজার হাত থেকে কফির কাপটা নিয়ে বললো,
“থ্যাঙ্ক ইউ আমার জন্য কফি নিয়ে আসার জন্য।”
বলেই কাপে চুমুক দিলো।
এক চুমুক খেয়ে কাপটা আবার ফিরিয়ে দিলো ইরতিজাকে। ইরতিজা কাপটা ধরলো না। বললো,
“এটা আমার আব্বু বানিয়েছিল, আমার জন্য।”
“ও তাহলে তোমার কফি খেয়ে ফেললাম? ইট’স অল রাইট। আঙ্কল তোমার জন্য কফিটা বানিয়েছিল। আর তুমি কী? তুমি হচ্ছ একজন মানুষ। অতএব বলা যায় আঙ্কল একজন মানুষের জন্য কফিটা বানিয়েছিল। আমিও তো একজন মানুষ। সেই হিসাবে তোমার আর আমার মাঝে পার্থক্য নেই।”
বলে হাসলো রিশন।
ইরতিজা তাজ্জব বনে গেল! কী বললো রিশন? মাথার উপর দিয়ে গেছে সব।
জুহি বিরক্ত নিয়ে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
“ইউ জাস্ট শাট আপ ননসেন্স!”
ননসেন্স বলায় খেপে গেল রিশন। খ্যাপা দৃষ্টি জোড়া জুহির উপর নিক্ষেপ করতেই ইরতিজা বুঝতে পারলো এখানে একটা গণ্ডগোল সৃষ্টি হতে চলেছে। সে একদমই চাইছে না কোনো গণ্ডগোলের সৃষ্টি হোক। তাই সে এক মুহূর্ত ব্যয় না করে দুই হাত দিয়ে জুহি এবং রিশনের একটা হাত আঁকড়ে ধরে সামনে এগোতে এগোতে বললো,
“আমদের দেরি হয়ে যাচ্ছে। চলো তাড়াতাড়ি।”
ইউনিভার্সিটিতে প্রবেশের আগে গাড়িতে বসে ইরতিজা মুখ ঢেকে নিয়েছে হিজাব দিয়ে। ক্ষতটা গতকালকের পাওয়া। এখনও বেশ তরতাজা দেখাচ্ছে। ক্ষতটা সে কাউকে দেখাতে চাইছে না। দেখা মাত্রই তো কেউ কেউ প্রশ্ন করে বসবে। সাজিদের মতো অন্য কিছুও ভেবে বসতে পারে তারা!
ক্লাসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল ওরা তিনজন। বেথ নামের বান্ধবিটা ওদের দেখতে পেয়ে এগিয়ে এলো। একটা খবর জানালো। খবরটা ক্যানিয়ল সংক্রান্ত। গতরাতে ক্যানিয়ল একটা ছেলেকে প্রচণ্ড মা/র/ধ/র করেছে। বলা হয়েছে আজ পর্যন্ত ক্যানিয়ল যত জনকে মে’রে’ছে তার ভিতর এই ঘটনাটা সবচেয়ে বেশি মর্মান্তিক!
খবরটা শুনেই গা শিউরে উঠলো জুহির। চোখে-মুখে ভয় ছেপে গেছে মেয়েটার!
ওদিকে ইরতিজাও ভীষণ চমকে গেছে খবরটা শুনে। সেই সাথে একরাশ চিন্তার মেঘ এসে তার ছোট্ট আননখানিতে দখল গেড়ে বসেছে। তার বুঝতে বেশি সময় লাগলো না ক্যানিয়ল কাকে এমন বাজে ভাবে মেরেছে। ওই ছেলেটা বেলিক। হ্যাঁ, বেলিকই এটা। ইরতিজা পিছন ঘুরে দৌড়ে যেতে লাগলো। জুহি অবাক হয়ে পিছন থেকে বলে উঠলো,
“কোথায় যাচ্ছ?”
“ক্যানিয়লের কাছে।”
“ক্যানিয়ল? তুমি পাগল? ওর কাছে কেন যাচ্ছ তুমি? হি ইজ আ সাইকো! সাইকো না হলে এমন ভাবে মা’র’তে পারতো বেচারা ছেলেটিকে?”
ইরতিজা আর কোনো প্রত্যুত্তর করলো না। আজ নিজেকে তার বড্ড নির্দয় বলে মনে হচ্ছে। কারণ বেলিকের খবরটা শুনে তার একটুও খারাপ লাগছে না। বরং কেন যেন আনন্দ উপলব্ধি হচ্ছে। ক্লাসরুম, ক্যাম্পাস খোঁজাখুঁজি করে অবশেষে ক্যান্টিনে পাওয়া গেল ক্যানিয়লকে। স্থির হয়ে দাঁড়ানো মাত্রই হাঁপাতে লাগলো ইরতিজা।
ক্যানিয়ল অবাক হয়ে দেখছিল ইরতিজাকে। আজ একটা সিলভার রঙের হিজাব পরেছে ও। হিজাবের সাথে সিলভার রঙের সুন্দর একটা ব্যান্ডও পরেছে। ক্ষণকাল পার হলে সে বললো,
“তোমার এমন ভাবে ছুটে আসার কারণ বুঝতে পারছি না পাকিস্টানি গার্ল! কী ঘটেছে?”
“বেলিককে মেরেছো তুমি?” প্রশ্নটা করার সময়ও হাঁপানো ভাবটা কমেনি ইরতিজার।
“তা তো জানি না। তবে একটা লম্পটকে মে’রে’ছি। যে মারটা তার প্রাপ্য ছিল, সে মারটা পরিশোধ করেছি। বাস, এটুকুই তো ঘটনা।”
“নিষ্ঠুরের মতো এত বেশি কেন মেরেছো ওকে?”
“এটা ওর প্রাপ্য ছিল।”
“কেন প্রাপ্য ছিল?”
“কারণ আমি চাইছিলাম তাই।”
“আমার সাথে ওরকম আচরণই কি আজ ওর এই অবস্থার জন্য দায়ী?”
ক্যানিয়ল অবজ্ঞাত কণ্ঠে বললো,
“অবশ্যই না। তুমি কে যে তোমার জন্য আমি ওকে এভাবে মা’র’বো?”
“তাহলে কার জন্য মেরেছো?”
“নিজের জন্য।”
“যেমন?”
“ও আমার মানুষের সাথে বাজে আচরণ করেছিল! মানুষটা আমার হওয়ার কারণেই এত মার খেয়েছে। নয়তো শাস্তিটা এর থেকে ছোটো হতো।”
“আমি তোমার মানুষ?”
“নও?”
ইরতিজা ক্যানিয়লের পাশের চেয়ারটায় বসে ওর দিকে খানিকটা এগিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো,
“হাত ভে/ঙে দেবো ছেলে, আর কখনও উত্তর না দিয়ে এমন পাল্টা প্রশ্ন করলে। তোমার এমন প্রশ্ন আমায় বিভ্রান্তিতে ফেলে!”
ইরতিজার কথা শুনে কিছুক্ষণ বিমূর্ত হয়ে বসে রইল ক্যানিয়ল। ইরতিজার চোখের দিকে দৃষ্টি স্থির হয়ে ছিল। হঠাৎ হেসে বললো,
“আমাকে আঘাত করারও দুঃসাহস আছে তোমার?”
“আছে।”
বলে ক্যানিয়লের বক্ষ বরাবর ঘু’ষি মা’রার একটা চেষ্টা চালালেই ক্যানিয়ল হাতটা খপ ধরে ফেললো। বললো,
“কিন্তু আমার সাহস নেই তোমাকে আঘাত করার। আমি পারবো না তোমাকে আঘাত করতে। আঁকড়ে ধরার বস্তুকে আঘাত করবো কীভাবে?”
ক্যানিয়ল ইরতিজার মুখের সামনে থেকে হিজাবের অংশটা সরালো। খুব সাবধানে সরিয়েছে, যাতে করে হিজাবটা ঠিকঠাক থাকে। গালের লালচে ভাবটা এখন আর স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। তবে ঠোঁটের ক্ষতটা এখনও গাঢ় ভাব। জিজ্ঞেস করলো,
“এখনও ব্যথা অনুভব হয়?”
ইরতিজা না বোধক মাথা নাড়লো।
“তাহলে আমি কেন ক্ষতহীন হয়েও তোমার ক্ষত দেখে ব্যথা অনুভব করছি ইজা?” গভীর কণ্ঠে বললো ক্যানিয়ল।
ইরতিজার হৃদয়ে মৃদু ঝিরিঝিরি কাঁপন সৃষ্টি হলো। নিঃশ্বাসের পালা ভারী হয়ে আসছে তার। এই মুহূর্তটায় মনে হলো ক্যানিয়ল তার জনম জনমের আপন কেউ। অথচ ক্যানিয়লের সাথে তার পরিচয় দীর্ঘ কোনো সময়ের নয়। হৃদয়ের কাঁপন ক্রমাগত বাড়ছিল। যেমন হাওয়া এসে ফুলের ডাল হতে কোমল পুষ্পপাপড়ি ঝরিয়ে দিয়ে যায়, তেমনি তার হৃদয়েও অনুভূতি বর্ষণ হতে লাগলো।
পরিবেশটা গুমোট হয়ে উঠেছিল, তাই পরিবেশ হালকা করতে ইরতিজা বললো,
“পুলিশ স্টেশনে গিয়েছিলে?”
“না। তবে যেতে হবে। সকালে কল করেছিল। একটু পর…হয়তো বা এখনই এসে পড়বে পুলিশ। মনে হচ্ছে এবার সহজে ছাড়া পাবো না। একটা দুটো দিন আটক থাকতে হতে পারে।”
কথাটা শুনে ইরতিজার মুখ কালো হয়ে গেল। সে আর কিছু না বলে বসে রইল চুপ করে।
ক্যানিয়ল মজা করে বললো,
“তুমি কিন্তু আমার বিরুদ্ধে সাক্ষী দেবে, যাতে আরও দীর্ঘদিন পুলিশ স্টেশনে থাকার সৌভাগ্য হয় আমার।”
জুহি, রিশন, বেথ, আন্দ্রেজ দূরে দাঁড়িয়ে দেখছিল ক্যানিয়ল আর ইরতিজাকে। তাদের সকলের মনে একই চিন্তার উদয় হচ্ছে। জুহির মনটা অন্ধকারে ঢেকে যাচ্ছিল। উদীয়মান চিন্তাটা সত্যি হওয়ার আশঙ্কায় নয়, এটা আন্দ্রেজের জন্য হচ্ছিল। আন্দ্রেজ তার পাশেই দাঁড়ানো। সে নিচু স্বরে আন্দ্রেজকে বললো,
“সবাই সবার অনুভূতির ব্যাপারে সচেতন হয়ে ওঠে, উঠছে এবং উঠবে। শুধু আমাদের অনুভূতিই কোনোদিন সচেতনতা পাবে না!”
তার কণ্ঠে মিশে আছে অবসাদের আভাস। যেটা খুব উপলব্ধি করতে পারলো আন্দ্রেজ। সে পাশ ফিরে তাকালো ক্ষণিকের জন্য। তারপর এ জায়গা হতে প্রস্থানের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো।
জুহিও ওর পিছন পিছন এসে প্রায় চেঁচিয়ে উঠলো,
“মার্টা কী এমন বিশেষ, যেটা আমি হতে পারি না তোমার কাছে? কোন বিষয়টা আমার মাঝে কম আছে? মার্টা আমার থেকে বেশি সুন্দর এটাই কারণ আমাকে রেখে ওকে পছন্দ করার?…উত্তর দিচ্ছ না কেন ড্যাম?”
আন্দ্রেজ দাঁড়ালো। আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো অনেকের মনোযোগই তার আর জুহির উপর এসে পড়েছে। ভীষণ অপমান বোধ হলো আন্দ্রেজের। লজ্জা, অপমানে মাথাই নত হয়ে আসছে তার। তবুও সে সেসব উপেক্ষা করার চেষ্টা করে বললো,
“সিনক্রিয়েট করো না জুহি। সব জায়গা সিনক্রিয়েট করার জন্য উপযুক্ত নয়।”
বলে সে আবারও হাঁটতে লাগলো।
জুহির হৃদয়ে এই সময় যে কী অসহনীয় যন্ত্রণা হচ্ছিল সেটা কেউ দেখছিল না। শুধু হৃদয় দহনের যন্ত্রণা সে একা ভোগ করছিল, আর একা দেখছিল হৃদয় কীভাবে দগ্ধ হচ্ছে।
আন্দ্রেজের ফেলে রেখে যাওয়া পথে হঠাৎ কয়েকজন ইন্সপেক্টরের পদচারণ পড়লো। সচকিত হয়ে উঠলো জুহির চোখের তারা।
(চলবে)
#উড়ো_পাতার_ঢেউ
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ৩৮
_________________
পুলিশ স্টেশনে কথা কাটাকাটি গেল কিছুক্ষণ যাবৎ। ক্যানিয়লকে এবার সহজে ছাড়তে চাইলো না তারা। মি. হেনরি এবং মুহাম্মদ ইসহাকের পার্সোনাল সেক্রেটারি মি. পল অনেক রকম ভাবে বোঝালো পুলিশদের। তবুও তারা সহজে মানতে চাইলো না। অনেক টাকার চুক্তি হলো। প্রতিবার ক্যানিয়লের এই ব্যাপার মেটাতে যত ডলার খরচ হয়, এবার খচর হলো তার তিনগুণ বেশি। তারা ক্যানিয়লকে পুনরায় এমন ঘটনার সৃষ্টি করা থেকে বিরত থাকতে বললো। কিছু ঘটলে তারা দেখবে। ক্যানিয়ল তাদের এ কথায় কোনোরকম গুরুত্বই দেয়নি! ইরতিজাও আছে এখানে। সাক্ষ্য দিতে হয়েছে তার। ক্যানিয়লকে মুক্ত করার ঝামেলা এখনও শেষ হয়নি। ইরতিজা দূরে একটা চেয়ারে বসে আছে। ক্যানিয়ল আছে পুলিশের সম্মুখের চেয়ারে।
হঠাৎ থমথমে পুলিশ স্টেশনটি একজন নয়ন মুগ্ধকর রমণীর আগমনে যেন হেসে-খেলে উঠলো। সর্বপ্রথম ইরতিজার দৃষ্টি পড়লো সেই রমণীর উপর। গ্লো পিংক কালারের ব্লেজার পরা মেয়েটি। চুল পনিটেল করে বাঁধা। চোখে কালো রোদ চশমা। মেয়েটিকে চিনতে বেশি সময় লাগলো না ইরতিজার। মেয়েটার নাম মিরান্ডা। একজন বিখ্যাত ব্যালে ড্যান্সার। আর সেই সাথে তার আরেকটা পরিচয় হলো সে ক্যানিয়লের উডবি ওয়াইফ!
মিরান্ডা এসেছে সেদিকে লক্ষ করেনি ক্যানিয়ল, তাই মিরান্ডা এসে পিছন থেকে তার গলা জড়িয়ে ধরলেই চমকে উঠলো সে। তাকিয়ে দেখলো মিরান্ডা।
“তুমি?” অবাকের সুর ক্যানিয়লের গলায়।
“দেশে ফিরে নিজের উডবিকে থানায় দেখতে পাওয়াটা দুর্ভাগ্য!”
মিরান্ডা ক্যানিয়লের গালে ঠোঁটের স্পর্শ করতে চাইলেই অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিলো ক্যানিয়ল। গলা জড়িয়ে ধরা মিরান্ডার হাত দুটোও ছাড়িয়ে নিলো বিনা বাক্য ব্যয়ে। মিরান্ডাও আর কথা বললো না তার সাথে। একটা খালি চেয়ার টেনে বসে যোগ দিলো পুলিশদের সাথে কথোপকথনে। এই কথোপকথন চললো আরও কিছুক্ষণ। কথার সমাপ্তি ঘটার পর যখন উঠে দাঁড়ালো তখন মিরান্ডার চোখ পড়লো ইরতিজার উপর। ইরতিজা এখানে আছে সেটা সে খেয়াল করেনি এতক্ষণ। ইরতিজাকে দেখে ক্ষুব্ধতার ঝড় ক্রমশ আরও ভয়াবহ রূপ ধারণ করছিল মিরান্ডার। সে ইরতিজাকে কিছু বলবে বলে এগোচ্ছিল। তিন কদম হেঁটে আসলেই ক্যানিয়ল তার সামনে এসে দাঁড়িয়ে তাকে বাধা দিলো। মিরান্ডা একটু রাগি চোখেই তাকালো ক্যানিয়লের দিকে।
“দেশে ফিরে প্রথমে নিজের উডবি হাসব্যান্ডকে ভালো করে দেখা উচিত তোমার। উডবি হাসব্যান্ডের যার প্রতি অনুভূতি আছে তাকে নয়। আগে আমাকে ভালো করে দেখবে চলো।”
ক্যানিয়ল মিরান্ডাকে টেনে নিয়ে বেরিয়ে এলো। আসার আগে মি. হেনরিকে বললো ইরতিজাকে বাসায় পৌঁছে দিতে।
ক্যানিয়ল মিরান্ডার গাড়ির ড্রাইভিং সিটে উঠে বসলো। পাশেই মিরান্ডা শ্লেষাত্মক হেসে বললো,
“প্রেমিকার প্রতি এত যত্নশীল যে হবু স্ত্রীকে প্রেমিকার কাছ অবধি ঘেঁষতে দিলে না?”
“এবার আমি ঘেঁষতে দিইনি। এরপর থেকে তুমি ঘেঁষার চেষ্টা করবে না।”
মিরান্ডা উচ্চৈঃশব্দে হেসে উঠলো। সেই হাসি থামলো কিয়ৎক্ষণ পর। হাস্যভাবের কিঞ্চিৎ উচ্ছিষ্টও আর তার মাঝে অবলোকন করা যাচ্ছে না এখন। মুখটা কঠিন হয়ে উঠেছে। বললো,
“চেষ্টা করবো এবং ঘেঁষবোও। তুমি আটকাতে পারবে না। আর এই আটকাতে না পারার আফসোস তোমাকে খুব যন্ত্রণা দেবে একটা সময়।”
“হিংসাত্মক হয়ো না মিরান্ডা, আমি তবে হিংস্র হতে বাধ্য হবো!”
“হিংস্র? কী করবে তুমি? অন্যদের যেভাবে মা’রো, আমাকেও সেভাবে মা’র’বে?” চেঁচিয়ে উঠলো মিরান্ডা।
ক্যানিয়লের মেজাজ এত খারাপ হয়ে গেল যে সে নেমে গেল গাড়ি থেকে। উইন্ডো দিয়ে ভিতরে তাকিয়ে বললো,
“এর আগে আমি তোমার প্রতি অনুভূতি অনুভব করতে ব্যর্থ ছিলাম। আর এখন নিজেই চাইছি না তোমার প্রতি আমার কখনও অনুভূতি জন্মাক।”
বলে সে গাড়িতে হাত দিয়ে খুব জোরে একটা শব্দ করে চলে গেল।
মিরান্ডার মুখ মন্ডল তখন কাঁপছিল রাগে। এক দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে রইল, যতক্ষণ পর্যন্ত না ক্যানিয়ল চোখের আড়াল হলো।
________________
মেরিমুর পার্কটা বিশাল এরিয়া নিয়ে তৈরি। তবে ইরতিজা পার্কটার ভিতরের একটা নির্দিষ্ট জায়গা ছাড়া হাঁটাহাঁটি করে না। এখানে হাঁটার জন্য একটা রোড আছে। রোডের পাশে সবুজ ঘাসের বিস্তীর্ণ স্থান। রয়েছে দুটো আপেল গাছ সহ আরও বিভিন্ন গাছপালা। একটা আপেল গাছ ছাড়িয়ে এসে কিছুদূর হাঁটার পর আরেকটা আপেল গাছ দেখা যায়। গাছগুলো এখন শূন্য। গ্রীষ্মকালে থোকায় থোকায় সবুজ আপেল ধরবে। আর তা পেকে গেলে ধারণ করবে লাল বর্ণ। গাছ থেকে আপেল পেড়ে খাওয়ার অভিজ্ঞতা নেই ইরতিজার। এই পার্ক থেকে সেই অভিজ্ঞতাটা লাভ করা যাবে। অনেক আপেল তলাতেও পড়ে থাকে। কিন্তু খাওয়ার মানুষ কই?
এই পার্কে ইরতিজার একটা প্রিয় স্থান আছে। সেই জায়গাটায় প্রচুর গাছ। বসার জন্য একটা বেঞ্চিও আছে। নীরব বসে থেকে উপভোগ করা যায় প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য। পার্কটিতে পাখির কিচিরমিচির শোনা যায় সর্বত্র। ইরতিজা এখানে এলে চুপচাপ বসে থেকে পাখির সেই ডাক শোনে, আর দু চোখে জায়গাটার সৌন্দর্য ধারণ করে। আজ সে একাই এসেছে পার্কে। জুহিকে ডেকেছিল। কিন্তু জুহির মনটা কোনো এক কারণে প্রচণ্ড খারাপ। মন খারাপের কারণ জানতে চাইলে জুহি বলেনি সে সম্পর্কে কিছু। শুধু বলেছে,
“ডিস্টার্ব করো না টিজা। আমায় কিছুটা সময় একলা ছেড়ে দাও।”
ইরতিজা এরপর আর কথা বাড়ায়নি। তবে সে বুঝতে পেরেছে জুহির মন খারাপের কারণটা আন্দ্রেজ হবে সম্ভবত। সে জুহির কাছ থেকে প্রস্থান করে নওরিনের কাছে যায়। গিয়ে বুঝতে পারে নওরিনেরও কোনো একটা কারণে মন খারাপ। অগত্যা সে একাই চলে আসে পার্কে। আজকের দিনে সবার এত মন খারাপ কেন ভাবছে ইরতিজা। তার নিজের মনটাও কেমন কেমন করছে। মনটার যেন অসুখ হয়েছে। কিছুক্ষণ পর পর মনটার গা কাঁপিয়ে জ্বর আসছে মনে হচ্ছে! আজ হঠাৎ মিরান্ডাকে দেখার পর থেকেই এমন হচ্ছে তার।
উদাসী, আনমনা চিত্তে বসে রইল ইরতিজা। ক্ষণকাল পর অকস্মাৎ তার ঘাড়ের পিছন থেকে কেউ মুখ এনে কানে ফিসফিস করে ডাকলো,
“পাকিস্টানি গার্ল!”
ভয় পেয়ে চিৎকার করে উঠে বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেল ইরতিজা। ভয় পেলেও ক্যানিয়লকে দেখার পর খানিক স্বস্তিবোধ ফিরে এলো। তবুও ভয় তো সে পেয়েছেই। ভয়ের ধুকপুকুনিটা গেল না সহজে।
ইরতিজার চিৎকার করে ওঠার ব্যাপারটায় ভীষণ বিরক্ত হয়ে ক্যানিয়ল বললো,
“আমার চেহারা কি কুৎসিত যে আমার চেহারা দেখে তুমি ভয়ে চিৎকার করে উঠেছো?”
“জানলে কী করে যে আমি এখানে আছি?”
“জানতাম না তো। আমি তো গত আধ ঘণ্টা ধরে পার্কের এ কর্ণার থেকে ও কর্ণার ঘুরছি। হঠাৎ দেখতে পেলাম এ কর্ণারে একটা রেড ফেইরি বসে আছে। রেড ফেইরিটাকে চেনা চেনা লাগলো দূর থেকে দেখে। একটু সময় দেখার পর বুঝলাম এ তো কোনো রেড ফেইরি নয়, এ তো আমার ভায়োলেট কুইন!”
ইরতিজা লাল হিজাব পরে আছে বলে ক্যানিয়ল ‘রেড ফেইরি’ কথাটার ব্যবহার করেছে। তবে ইরতিজা অবাক হয়েছে ক্যানিয়লের শেষের বলা কথাটা শুনে। ‘আমার ভায়োলেট কুইন’! ক্যানিয়ল তাকে নিজের বলে দাবি করছে? ক্যানিয়লের এমন দাবির অংশ হয়ে নিবিড় ভালোলাগার দোলায় হৃদয় দুলে উঠলো সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ভাবে।
ক্যানিয়ল বেঞ্চির পিছন ঘুরে সামনে এসে বসলো বেঞ্চিতে। ইরতিজার এক হাত ধরে টান দিতেই ইরতিজা ধপ করে বসে পড়লো ক্যানিয়লের পাশে। হঠাৎই বিব্রত বোধ এসে ঘেরাও করলো ইরতিজাকে। ক্যানিয়ল ওর দু চোখে শান্ত দৃষ্টি রেখে নিবিড় কণ্ঠে বললো,
“আমি কী যেন বলতে চাই তোমাকে, কিন্তু তোমার চোখের দিকে তাকালেই ভুলে যাই কী বলার ছিল!”
বিব্রতবোধটা এবার কাঁটা হয়ে সারা শরীরে বিঁধে বসলো। পর্যাপ্ত অক্সিজেনের যেন অভাব লেগেছে এমন মনে হলো তার। কারণ স্বাভাবিকভাবে শ্বাস নিতে পারছে না সে! চাচ্ছে এই মুহূর্তে ক্যানিয়লের দৃষ্টির সীমা হতে ছুটে পালিয়ে যেতে, কিন্তু সে নিজেই ক্যানিয়লের দিক থেকে চোখ সরাতে পারছে না। দুই জোড়া আঁখি কিছু সময় একত্রিত হয়ে রইল। এরপর ক্যানিয়ল চোখ সরিয়ে নিয়ে একটু নড়েচড়ে বসলো। এতক্ষণ যেন সে মনের ভুলেই তাকিয়ে ছিল ইরতিজার চোখের দিকে। ভীষণ লজ্জাবোধ করলো সে! কয়েকটা মুহূর্ত চুপচাপ কেটে গেল।
এক সময় ক্যানিয়ল বললো,
“জোনাকির মেলা কখনও দেখেছো ইজা?”
“জোনাকির মেলা?”
“হুম। আমার ট্রি হাউজে বেশিরভাগ সময়ই জোনাকির মেলা বসে। কখনও একা একা দেখি সেই মেলা, কখনো বা সামুরা সাথে থাকে। তবে আমি চাইছি আমার নতুন একজন সঙ্গী হোক।”
ক্যানিয়ল ইরতিজার দিকে ফিরে বললো,
“উইল ইউ বি মাই নিউ পার্টনার?”
ইরতিজার বক্ষৎপঞ্জর মৃদু কেঁপে উঠলো। চমকালো সে। মুখের বাক্যরা সব নিশ্চল হতে শুরু করেছিল। কিন্তু তার আগেই দ্রুত উত্তর দিলো সে,
“নো, ইট’স নট পসিবল। জোনাকিরা তো রাতে আসে। আর রাতে তোমার সাথে কোথাও যাওয়া সম্ভব নয়।”
“কেন? আমি কি ভাল্লুক? তোমাকে রাতের অন্ধকারে খেয়ে ফেলবো?”
“আমার ফ্যামিলির কেউ কখনও চাইবে না আমি একটা অপরিচিত ছেলের সাথে কোথাও যাই। রাত একেবারেই মানবে না তারা।”
“আমি তোমার অপরিচিত?”
“আমার ফ্যামিলির কেউ তোমার সাথে পরিচিত নয়।”
“তাহলে চলো আগে তোমার ফ্যামিলির সাথে পরিচিত হই। তাদের মেয়ে এত গভীরভাবে যার প্রেমে পড়েছে তাকেই চেনে না তারা? না, এটা একটা সমীচীন ব্যাপার হলো না! তোমার অবশ্যই তাদের জানালো উচিত ছিল তুমি একজন সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মগ্রহণ করা ছেলের প্রেমে পড়েছো।”
ক্যানিয়ল ইরতিজার হাত ধরে ওকে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। সামনে কয়েক পা এগোলেই ইরতিজা উল্টো ক্যানিয়লের হাত টেনে ধরে বললো,
“না ক্যানিয়ল, এমনটা কখনও করা যাবে না, ভুলেও করা যাবে না। একটা সামান্য দুর্ঘটনা থেকে আমার জীবন এলোমেলো হয়ে গেছে! আবার কিছু একটা ঘটলে শুধু আমার জীবনের বিধ্বস্ত ভগ্নাংশটুকুই খুঁজে পাওয়া যাবে, আমি বিলীন হয়ে যাব একেবারে!”
ক্যানিয়ল অবাক হয়ে বললো,
“কেন বিলীন হয়ে যাবে?”
“আমার বাবা বিয়ে দিয়ে দেবে আমায়!”
ক্যানিয়ল বুঝতে পারলো না ইরতিজার জীবন কীভাবে বিলীন হবে। আর বিলীন হয়ে যাওয়ার সাথে বিয়ে দিয়ে দেওয়ারই বা কী সম্পর্ক? সে এগুলো নিয়ে ভাবলোও না। তার ধারণা ইরতিজা যা বলেছে তা ইরতিজার নিজেরই বোধগম্য নয়। অযথাই না বুঝে একটা কথা বলে দিয়েছে। সে শুধু একটু নিকটে এগিয়ে এসে শুধালো,
“আমি থাকতে কার সাহস হবে তোমাকে বিয়ে করার? আমার আকাশে ইতোমধ্যে তুমি নিজের আলোর চিহ্ন ফেলে রেখেছো। এটা মুছে ফেলার উপায় নেই। আর তোমাকে ছেড়ে দেওয়ারও উপায় নেই। তোমাকে কেবল আঁকড়ে ধরে রাখা যায়। কার সাহস হবে আমার আঁকড়ে ধরা মানুষকে বিয়ে করবে?”
(চলবে)
#উড়ো_পাতার_ঢেউ
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ৩৯
_________________
ক্যানিয়লের কথাগুলো ইরতিজার কর্ণকুহর স্তব্ধ করে রাখলো অনেকক্ষণ। কথাগুলো তার মনে যে বিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে, সেই বিক্রিয়া এর আগে কখনও সৃষ্টি হয়নি। হঠাৎ এমন ভিন্ন বিক্রিয়ার সাক্ষাতে এসে তার অনুভূতিরা কেমন ছন্নছাড়া প্রগাঢ় মিষ্টি জৌলুস ছড়িয়ে দিলো। বক্ষস্থল তিরতির করে কম্পমান হচ্ছে, কায়াখানিও যেন কাঁপছে অত্যল্পভাবে। তবে তার দৃষ্টিজোড়া অনিবার্যভাবে ক্যানিয়লের উপর স্থায়ী এবং পলকহীন।
অনেকক্ষণ ধরে নির্বাক এবং নিশ্চল ইরতিজাকে দেখে ক্যানিয়ল বললো,
“প্রেমে পড়লে কি মানুষ নির্বাক হয়ে যায় পাকিস্টানি গার্ল? তুমি এত নিশ্চুপ কেন?”
ইরতিজার বক্ষস্থল এবার একটু জোরেশোরেই কেঁপে উঠে বেরিয়ে এলো বেঘোর জগৎ থেকে। কথারা অপ্রস্তুত। অপ্রস্তুত কথারা আর নিজেদের সাজিয়ে-গুছিয়ে উঠতে পারলো না। বিব্রত কণ্ঠে বললো,
“আমি বাসায় ফিরছি।”
বলেই যাওয়ার জন্য ঘুরলো। ক্যানিয়ল সামনে এসে বাধা দিয়ে বললো,
“বাসায় যাচ্ছ মানে? তোমাকে যে নিউ পার্টনার বানালাম তার কী হবে?”
“আমি বললাম তো যাওয়া সম্ভব নয়।”
“ঠিক আছে, আমি তাহলে তোমাকে অসম্ভব ভাবেই নিয়ে যাব।”
বলে সে ইরতিজার একটা হাত আঁকড়ে ধরলো। ওকে নিয়ে যেতে লাগলো নিজের সঙ্গে। ইরতিজা অনুনয় করে বললো,
“কোথায় নিয়ে যাচ্ছ? দেখো এমনটা করো না। আমি কোথাও যেতে চাই না তোমার সাথে। প্লিজ হাত ছাড়ো।”
ক্যানিয়ল দাঁড়িয়ে গেল। কিন্তু হাতটা ছাড়লো না। পিছনে ফিরে দেখলো ইরতিজা মুখ সংকুচিত করে দাঁড়িয়ে আছে। বললো,
“হাত ছেড়ে দেবো? তাহলে তুমি কি চাও হাত ছেড়ে দিয়ে তোমাকে পাঁজাকোলা করে নিই?”
ইরতিজা চমকে উঠলো আকস্মিক এই কথায়।
“অবশ্যই না। অবশ্যই এটা আমি চাই না। আমি কখন বললাম যে আমি এটা চাই?”
“তাহলে কি চাও রোমান্টিক ভাবে হেঁটে যাই? আমার পায়ের পাতায় ভর করে হাঁটতে চাও তুমি?”
ইরতিজা আরেকবার বিস্ময়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে বললো,
“আমি কখন বললাম আমি ওভাবে হাঁটতে চাই?”
ক্যানিয়ল ইরতিজার অতি নিকটে এগিয়ে এসে বললো,
“চাও না?”
ক্যানিয়লের এত কাছে এগিয়ে আসায় বিব্রত আর অস্বস্তিতে শেষ হয়ে যাচ্ছিল ইরতিজা। ক্যানিয়লের ঠোঁটের কোণে হাসিটা নজরে এলো তার। ক্যানিয়ল তাকে মজার পাত্রী ভাবছে? একটুখানি রাগই লাগলো ইরতিজার। সে দুই হাত দিয়ে ক্যানিয়লকে ঠ্যালা দিয়ে সরিয়ে দিলো কাছ থেকে। একটু মেজাজি কণ্ঠেই বললো,
“আসলেই তোমার সাথে কোথাও যাওয়া সম্ভব নয়। তুমি হলে একটা পাজি ছেলে!”
ইরতিজা তড়িৎ গতিতে সামনে পা বাড়ালো। ক্যানিয়ল আবারও তার একহাত ধরে ফেললো খুব দক্ষতার সাথে। হাত ধরে টান দিতেই ইরতিজা আবারও ফিরে এলো ক্যানিয়লের কাছে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ক্যানিয়ল তার দুই হাতে কিছু একটা প্যাঁচাতে শুরু করলো। ইরতিজা দেখলো খুব চিকন একটা দড়ি জাতীয় বস্তু দিয়ে ক্যানিয়ল তার হাত বেঁধে ফেলছে। সে অবাক এবং অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে বললো,
“হেই, কী করছো?”
হাত দুটো পুরোপুরি বেঁধে ফেলেছে ক্যানিয়ল। ইরতিজার চোখ জোড়ায় চোখ রেখে বললো,
“আমি অবাধ্য হতে পারি, কিন্তু অন্যের অবাধ্যতা সহ্য করতে পারি না।”
একটু বিরতি নিয়ে শুধালো,
“সেই অনেক আগে মেরিমুর পার্কে যখন আসছিলাম তখন আমার পিঠে অনেক জোরে আঘাত করেছিলে তুমি। এখনও মাঝে মধ্যে সেই স্থানে ব্যথা অনুভব করি। সেদিনই বুঝতে পেরেছিলাম কেমন বজ্জাত মেয়ে তুমি। তাই চাই না দ্বিতীয় বার আর ওই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটুক। তার জন্যই এই ব্যবস্থা। তোমার বজ্জাত রূপটা দেখতে আমি মোটেই পছন্দ করবো না।”
ক্যানিয়ল ইরতিজাকে নিয়ে এলো পার্কের বাইরে। ওর গাড়িটা পার্কের বাইরে দাঁড় করানো ছিল। ইরতিজার সিটবেল্টটা বেঁধে দিয়ে নিজের সিটবেল্টও বেঁধে নিলো সে। এরপর গাড়ি স্টার্ট করে চলতে লাগলো গন্তব্যে।
ইরতিজার মুখে একরাশ চিন্তা এসে ঘাপটি মারলো। আব্বু অথবা মা কেউ যদি জানতে পারে সে ক্যানিয়লের সাথে ট্রি হাউজে জোনাকি পোকা দেখতে গিয়েছিল তখন কী হবে? এটা জেনে যাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ, কিন্তু তাও যদি কোনো রকম জেনে যায় তখন করণীয় কী হবে? বাবা কি তাকে তাৎক্ষণিক সাজিদের সাথে বিয়ে পড়িয়ে দেবে? ইরতিজার কল্পনায় এমনই একটা বীভৎস দৃশ্য ভেসে উঠলো। সারা শরীর কাঁটা দিয়ে উঠলো তার। বাবা কি আসলেই এমনটা করবে? কীভাবে সম্ভব? যে বিয়েতে তার মত নেই সে বিয়ে বাবা এমনভাবে করিয়ে দিতে পারে না! কিন্তু যদি জোর করে বিয়ে দিতে চায় তখন কী করবে? বাবার সিদ্ধান্তকে তো সে সহজে উপেক্ষা করতে পারবে না। ক্যানিয়লের দিকে তাকালো। ক্যানিয়ল আপন মনে গাড়ি ড্রাইভ করছে। ওর মাঝে নেই কোনো চিন্তা, ভাবনাহীন সুখে বসে আছে ও। ইরতিজা বললো,
“তোমার কারণে যদি আমি বিপদে পড়ি তাহলে তোমাকেও আমি ছা’ড়বো না।”
“দিয়ো না ছেড়ে। আগলে রেখো। আজ পর্যন্ত কেউ আমাকে আগলে রাখেনি। আমার নিজের মম আমাকে ছেড়ে চলে গেছে! আমার ড্যাডের কাছে সময়ই বা কোথায় যে আমার দেখাশোনা করবে? আমার ভাই-বোনেরা যে যার মতো জীবন প্রতিষ্ঠা করছে। তাদের অনেকের কাছে তো আমি চক্ষুশূল। সামুরা আমাকে ভালোবাসে, কিন্তু ওর ভালোবাসাটা আগলে রাখার মতো বিষয়টিকে স্পর্শ করতে পারেনি। মাদার সোফিয়া। তাকে একজন ভালো মানুষ হিসেবে চিনি। সেও আমাকে আগলে রাখেনি। আমার সেই আট বছর বয়স থেকেই আমি একা। জানি না কারো আগলে রাখার অনুভূতিটা কেমন!”
ইরতিজা ডুবে গেল কথাগুলোর মাঝে। সে বুঝতে পারলো ক্যানিয়লের জীবনটা আসলে খুব কষ্টের! ওর উপরিভাগ দেখে ওকে অনেক সুখী মনে হয়। কিন্তু আসলে ওর ভিতরটা প্রতি মুহূর্তে বিষাদে শ্বাস নেয়।
“তোমার মম চলে যাওয়ার পর থেকেই তুমি একা, তাই না?” জিজ্ঞেস করলো ইরতিজা।
“একা ছিলাম। নিজেকে খুব একা মনে হতো। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে আমি একা নই। এখন মনে হয়, তুমি তো আছো।”
ইরতিজার হৃৎকমলের সংকুচিত পাপড়িগুলো হঠাৎ প্রসারিত হয়ে ফুঁটে উঠলো। একটা গাঢ় অনুভূতির রেশ ছুঁয়ে গেল তার অতলস্পর্শ। এই অনুভূতি আরও গভীরের দিকে নিয়ে গেল না সে। বললো,
“কিন্তু আমি তো নেই।”
ইরতিজার কথায় অবাক হয়ে ক্যানিয়ল বললো,
“তুমি তো আমারই পাশে বসে আছো।”
ইরতিজা একটু হাসলো। অতঃপর বললো,
“তখন তুমি জিজ্ঞেস করেছিলে না, মানুষ প্রেমে পড়লে নির্বাক হয়ে যায় কি না? হুম যায়, তার মুখ নির্বাক হয়ে যায় অনেক সময়। তবে তখন তার হৃদয় কথা বলে। মুখ নিশ্চুপ থাকলেও হৃদয় অনর্গল কথা বলে যায়।”
“ও তাহলে এতক্ষণ ধরে বিরতিহীন যে বকর বকরটা শুনতে পাচ্ছিলাম আমি সেটা তোমার হৃদয়ের কথা ছিল?”
ইরতিজা অবাকের সাথে বললো,
“শুনতে পাচ্ছিলে মানে?”
“হুম শুনতে পাচ্ছিলাম তো তোমার হৃদয়ের কথা। মানুষের হৃদয়ও যে এত উচ্চ শব্দে কথা বলতে পারে ধারণাই ছিল না আমার। আমি তো ভাবছিলাম কে কথা বলছে? একবার ভাবলাম মনের ভুল। কিন্তু না, এখন বুঝলাম ওটা তোমার হৃদয়ের কণ্ঠ ছিল।”
ইরতিজা তাজ্জব বনে গেল। বলছে কী ক্যানিয়ল? ছেলেটা আবারও তার সাথে মজার আসর জমিয়ে বসেছে?
“তা কী শুনতে পেয়েছো? কী বলেছে আমার হৃদয়?”
“সেসব কি আর মুখে আনার মতো কোনো কথা ছিল? বলবো কী করে আমি মুখে? তুমি ফোরটি থাউজ্যান্ড হোয়াইট পেপার এবং ফোর থাউজ্যান্ড পেন নিয়ে এসো, আমি লিখে দিচ্ছি তোমাকে।”
“ফোরটি থাউজ্যান্ড পেপার?” চক্ষু কপালে উঠলো ইরতিজার।
“পারবে না আনতে? ঠিক আছে শুনতেও হবে না তাহলে।”
ক্যানিয়ল কথার সমাপ্তি টেনে দিয়ে আবার বললো,
“আর হ্যাঁ, তোমার হৃদয়কে একটু আস্তে কথা বলতে বলো। দু কান বিষ করে দিলো আমার নিজেদের কথা শোনাতে শোনাতে। তোমার হৃদয়টাও একেবারে তোমার মতোই।”
“আমার মতো মানে?”
“তোমার মতোই তোমার হৃদয়ের কণ্ঠেও বজ্র ঝরে।”
“এর মানে?” রেগে গিয়ে বললো ইরতিজা।
“যেটা বুঝেছো সেটাই।”
________________
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা, আর সন্ধ্যা গড়িয়ে নামলো রাত। জঙ্গলের ভিতর অন্ধকার। অন্ধকারের মাঝে আলোর নিশানা জ্বালিয়েছে জোনাকির দল। এছাড়া ক্যানিয়লের ট্রি হাউজ খানায় কৃত্রিম আলোর উৎস আছে। চোখের সামনে এত এত জোনাকির ওড়াউড়ি দেখে ইরতিজার দু চোখের মুগ্ধতা কমছিল না, বরং আরও গভীর থেকে গভীর হচ্ছিল ক্রমশ। সে ছুটছিল জোনাকির পিছন পিছন। হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দিচ্ছিল জোনাকিদের। আহ্লাদে তার হৃদয় আটখানা হচ্ছিল। আর ইরতিজার এসব পাগলামি দেখে মুগ্ধ হচ্ছিল ক্যানিয়ল। আজ সে যতটা মনোযোগ দিয়ে ইরতিজাকে দেখছিল এমন মনোযোগের সহিত আর কাউকে কোনো দিন দেখেনি। ভালো লাগছিল মেয়েটার আনন্দমুখরিত আচরণটা। ইরতিজা অলিন্দের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে জোনাকি পোকার মেলা দেখছিল। অন্ধকারের বুকে কী সুন্দর লাগছে জোনাকির বিচরণ। মনে হচ্ছে পুরো অরণ্যই যেন আজ দখল করেছে জোনাকির দল। অরণ্যের এক টুকরো জায়গাও যেন আজ অন্ধকারে ঢেকে নেই। জোনাকিরা অরণ্যের সর্বত্রটা দখল করছিল। ইরতিজার চোখ দুটো চকচক করছিল আনন্দ উদ্দীপনায়। ক্যানিয়ল ইরতিজার পাশে এসে দাঁড়িয়ে বললো,
“তুমি কি খুশি?”
ইরতিজা সঙ্গে সঙ্গে মাথা দুলিয়ে উত্তর দিলো,
“হু অনেক খুশি। আমি জানতাম না এখানে এত জোনাকি দেখা যায়। আমি জাস্ট বিমুগ্ধ হয়ে যাচ্ছি। রিশন যখন এখানে ভিডিয়ো শুট করার জন্য এসেছিল তখন তো তেমন জোনাকিই ছিল না। কিন্তু আজ…অনেক ধন্যবাদ তোমায় আমাকে এত সুন্দর একটি পরিবেশে নিয়ে আসার জন্য।”
ক্যানিয়ল প্রত্যুত্তরে শুধু মৃদু হাসলো। সে ডান হাতে আঁকড়ে আছে এক গুচ্ছ ভায়োবিন ফুল। আসার সময় তুলে নিয়েছিল সবুজের বুকে থাকা ভায়োবিন ফুলদের। মনে হচ্ছে সে এগুলো ইরতিজার জন্য তুলে এনেছে। কিন্তু ইরতিজাকে যে এগুলো দেবে তা একদমই পারছে না। ইতস্তত বোধ করছে। সে ফুলগুলো না দিয়ে বরং ফেলে দিলো। তারপর গলাটা একটু কেশে পরিষ্কার করে নিয়ে বললো,
“আমার উডবি ওয়াইফকে কেমন লেগেছে তোমার?”
আকস্মিক এমন প্রশ্নে ইরতিজার মুগ্ধতা কেমন হযবরল পাকিয়ে গেল। বিস্মিত আঁখি জোড়া মেলে ক্যানিয়লের দিকে তাকিয়ে বললো,
“হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন করছো?”
“প্রশ্নের জবাবে প্রশ্ন না করে উত্তর দাও সততার সাথে।”
“কেমন লাগবে? ভালো লেগেছে।”
“সততার সাথে উত্তর দিতে বলেছিলাম, মিথ্যার সাথে নয়।”
ইরতিজার হঠাৎই এসব সহ্য হলো না। বলে উঠলো,
“তোমার উডবি ওয়াইফ নিঃসন্দেহে রূপে গুণে অনন্য! কিন্তু সত্যি কথা বলতে আমার তাকে ভালো লাগেনি। কেন ভালো লাগেনি জানি না আমি। শুধু জানি তাকে ভালো লাগেনি!”
“কিন্তু আমি জানি তোমার কেন মিরান্ডাকে ভালো লাগেনি। কারণ হলো-ও আমার উডবি ওয়াইফ। মিরান্ডারও কিন্তু তোমাকে ভালো লাগেনি। তুমি ভীষণ অপছন্দের একজন মানুষ ওর কাছে, অসহ্যও বটে।”
এমন কথা শুনে ইরতিজার মুখটা শুকিয়ে একটুখানি হয়ে গেল। সে আচমকা ক্যানিয়লকে প্রশ্ন করে বসলো,
“আর তোমার কাকে পছন্দ?”
প্রশ্নটায় হকচকিয়ে গেল ক্যানিয়ল। এমন একটা প্রশ্ন তার কাছে আসতে পারে তা ধারণা সীমার বাইরে ছিল। সে যখন মনে মনে ভাবছিল কী উত্তর দেবে ঠিক তখনই কানে ভেসে এলো একটা পুরুষ কণ্ঠ,
“তুমি এই অসভ্য ছেলের সাথে এই অন্ধকার রাতে কী করছো আমার সুইটহার্ট?”
হঠাৎ করে কণ্ঠটা শুনতে পেয়ে ভয়ে চমকে উঠলো ইরতিজা। তার চোখ ছুটে গেল সিঁড়ির দিকে। যেখানে দেখা যাচ্ছে জোনাস দাঁড়িয়ে আছে। ইরতিজার মুখ ফসকে প্রশ্নটা বেরিয়ে আসে,
“তুমি এখানে কেন?”
জোনাস হেসে শুধালো,
“যেখানে থাকবে প্রিয়তমা, সেখানেই তো হবে প্রিয়র আনাগোনা। আমি তোমার প্রিয় নই টিজা?”
(চলবে)