উড়ো পাতার ঢেউ পর্ব-৪০+৪১+৪২

0
308

#উড়ো_পাতার_ঢেউ
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ৪০
_________________

“তুমি কি আমাকে ফলো করো জন?”

জোনাস হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়িয়ে মৃদু হেসে বললো,
“তুমি কি এতে বিরক্ত? তোমাদের পার্সোনাল টাইম বরবাদ করে দেওয়ার জন্য কি তুমি রাগান্বিত?”

ইরতিজা কিঞ্চিৎ অবাকপূর্ণ হয়ে বললো,
“পার্সোনাল টাইম?”

জোনাসের মুখ থেকে কিঞ্চিৎ হাস্যভাব পলায়ন করলো। সে ইরতিজার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বললো,
“প্রথমে অর্টন, আর এখন এই ছেলেটা! আমার কী দোষ ছিল? কেন তুমি আমাকে কষ্ট দিলে? কেন আমি ভালোবাসা পাওয়ার অযোগ্য? কেন প্রত্যাখ্যান করেছিলে?” শেষের কথাটায় মৃদু চিৎকার ধ্বনি উচ্চারিত হলো জোনাসের কণ্ঠনালি থেকে।
জোনাস খুব কাছে চলে আসায় ইরতিজা এক পা পিছিয়ে গেল। কিন্তু পিছিয়ে যাওয়া মাত্রই জোনাস তাকে টেনে আবারও নিজের সামনে আনলো। ধক করে উঠলো ইরতিজার বুক। দু চোখে বিস্ফোরিত ভয়। জোনাস ইরতিজার দুই হাত এত জোরালো ভাবে চেপে ধরলো যে ব্যথা অনুভব করলো ইরতিজা। জোনাস চ্যাঁচানো স্বরে জানতে চাইলো,
“কী ত্রুটি আমার? কেন ওরা দুজন হতে পারলে আমি পারি না? আমাকে এভাবে নীরবে কষ্ট দেওয়া বন্ধ করো। নয়তো তোমাকে হ/ত্যা করে এই কষ্টের ইতিরেখা টানবো…”

কথাটা শেষ করা মাত্রই ক্যানিয়ল জোনাসের এক হাতে সজোরে এক টান মেরে ওকে ফেলে দিলো কাঠের মেঝেতে। জোনাস ব্যথা পেয়ে মৃদু আওয়াজ করলো। ক্যানিয়ল দুই পায়ের উপর ভর করে বসে, জোনাসের দিকে অত্যল্প ঝুঁকে গম্ভীর স্বরে বললো,
“তোমার সাহস কী করে হয় ওকে এত হার্ডলি ভাবে স্পর্শ করার? আর কী বললে? হ/ত্যা?”
ক্যানিয়ল জোনাসের কথাটাকে তুচ্ছজ্ঞান করে ব্যাঙ্গাত্মক হেসে বললো,
“নিজেকে সাবধানে রেখো কালপ্রিট বয়। তুমি নিশ্চয়ই আমার হকি স্টিকের আ’ঘা’ত খাওয়ার ইচ্ছাপোষণ করো না। ইজার ফ্রেন্ড ছিলে সেজন্য আজ ভালোভাবে সাবধান করলাম তোমাকে।”

উঠে দাঁড়ালো ক্যানিয়ল। জোনাস উচ্চ শব্দে হাসলো গা দুলিয়ে কিছু সময়। এরপর উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
“অর্টনের সময় যা হয়েছিল, এবারও নিশ্চয়ই তার ব্যতিক্রম হবে না। আমি তোমার আন্টকে সব জানিয়ে দেবো টিজা।”

জোনাস পকেট থেকে মোবাইল বের করে সেটা দেখিয়ে বললো,
“এটায় কিছু ফটো আছে। সেগুলো শুধু আমার গ্যালারিতে সৌন্দর্য ফুঁটিয়ে তুলছে না ঠিকঠাক। আমি এগুলো অন্য কারো গ্যালারিতে শোভিত দেখার প্রয়োজন বোধ করছি।”

বলে আর এক মুহূর্ত এখানে দাঁড়ালো না জোনাস। দ্রুত পদে নেমে গেল ট্রি হাউজ থেকে। অন্ধকারের বুকে এক চিলতে আলো নিয়ে ডিঙিয়ে যেতে লাগলো অরণ্য।
এদিকে ইরতিজার মাথায় একরাশ চিন্তা ঘুটঘুট করছে। জোনাস কী করতে চলেছে? অর্টনের সময় যেমন কাণ্ড ঘটিয়েছিল, এখনও কি তেমনই কিছু করবে? বুক কেমন করে উঠলো ইরতিজার। ঘৃণার কালো রঙে ঢাকা পড়ে যেতে লাগলো তার বক্ষের শুভ্র পৃষ্ঠাটা। জোনাস এত খারাপ কেন? এই ছেলেটাই কি একসময় তার প্রিয় বন্ধু ছিল? অতীতে জোনাসের বন্ধু রূপটার কথা ভেবে তিক্ত কষ্টের মিশ্রণে মিশে গেল ইরতিজার অনুভূতি। আর ফটো? কী ফটো তুলেছে? কখন তুললো? ভয়ে ঢিপঢিপ করতে শুরু করলো ইরতিজা বক্ষৎপঞ্জর।
ক্যানিয়ল কিছু সময় তাকিয়ে রইল ইরতিজার থমথমে মুখটায়। এতক্ষণের ঘটনা থেকে সে অনেক কিছু ধারণা করতে পেরেছে। কিছু বিষয় আবার বুঝে উঠতে পারেনি। জিজ্ঞেস করলো,
“অর্টন কে?”

ইরতিজা ক্যানিয়লের প্রশ্নে চোখ তুলে তাকালো। চোখ দুটো বিষণ্ণ রেখা এঁকে আছে। এই মুহূর্তে তার এই বিষয়ে কিছু বলতে ইচ্ছা করলো না। বললো,
“বাড়ি যাব।”

“কেন?”

“কেন মানে? আমি কি এখানে থাকবো?”

“থাকবে না?”

“বাড়ি যাব।”

“যাও।”

“যাও মানে?”

“একটু আগেই না বললে থাকবে না। তো যাও।”

ইরতিজা ক্লান্ত কণ্ঠে বললো,
“দেখো আমি মজা করার মুডে নেই। বাসায় পৌঁছে দাও আমাকে।”

“তোমার সাথে তো তোমার পা রয়েছে। তারপরও আমার কেন পৌঁছে দিতে হবে? কীভাবে পৌঁছে দেবো? কোলে করে নিয়ে পৌঁছে দিতে হবে? পারবো না। হেঁটে হেঁটে চলে যাও।”

“আমি কখন বললাম আমাকে তোমার কোলে করে পৌঁছে দিতে হবে? আচ্ছা ছাড়ো, একাই চলে যাচ্ছি।”

ইরতিজা চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালে ক্যানিয়ল সামনে এসে দাঁড়িয়ে বললো,
“এই জঙ্গলে দিনের বেলাতেও খারাপ জিন ঘুরে বেড়ায়। তোমার কি ধারণা রাতের বেলাতে তারা উধাও হয়ে গেছে অন্য কোথাও?”

“আমি মোটেও ভয় পাচ্ছি না। ভয় দেখানোর চেষ্টা করে লাভ নেই।”

ক্যানিয়ল এই ব্যাপার নিয়ে আর কথা বাড়ালো না। কিছু সময় চুপ করে থেকে বললো,
“কালপ্রিট বয় কি তোমাকে প্রোপোজ করেছিল? তুমি প্রত্যাখ্যান করেছো? এরপর থেকেই ও তোমার শত্রু?”

ইরতিজা কোনো উত্তর দিলো না। শুধু তাকিয়ে রইল। ক্যানিয়ল বললো,
“কেন প্রত্যাখ্যান করেছিলে? ও তোমার বন্ধু ছিল তো। প্রশ্নের উত্তর দাও। ট্রি হাউজেও কিছু হকিস্টিকের অস্তিত্ব আছে কিন্তু।”

ইরতিজার শরীর আচমকা কেমন কেঁপে উঠলো। বললো,
“ও ক্রিশ্চিয়ান! আমার ফ্যামিলি নিশ্চয়ই একটা ক্রিশ্চিয়ান ছেলের সাথে আমার সম্পর্ক মেনে নেবে না। আমার বিয়ে দেবে না। আমিও কখনও একজন ক্রিশ্চিয়ান ছেলেকে বিয়ে করার স্বপ্ন দেখিনি। আর একটা ব্যাপার হলো, আমি ওকে বন্ধু ব্যতীত অন্য কোনো চোখে কোনোদিন দেখতে পারিনি। বন্ধু ব্যতীত ওর জন্য বিশেষ কোনো অনুভূতি অনুভব করিনি।”

“এখন করো? কারো জন্য বিশেষ অনুভূতি অনুভব?” ইরতিজার কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথে বললো ক্যানিয়ল।

ইরতিজার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এলো ক্যানিয়লের এই প্রশ্নে। দু চোখে চমকানো ভাব ঝিলিক দিচ্ছে। হৃদয়ের উপকূলে থাকা অনুভূতিরা দিগভ্রান্ত হয়ে পড়লো। উত্তর স্বরূপ কোনো কথা বের হলো না তার মুখ থেকে। গলা শুকিয়ে এলো তার।
ইরতিজার মুখের এই সময়কার অবস্থা দেখে মনে মনে হাসলো ক্যানিয়ল। বললো,
“মানুষটা কি আমি?”

“কোন মানুষ?” অপ্রস্তুত, চমকিত ইরতিজার মুখ থেকে হঠাৎই প্রশ্নটা বেরিয়ে এলো বেখেয়ালে। বিব্রত বোধ কাঁটা হয়ে শরীরে ফুঁটলো তার। মস্তক নত হয়ে এলো। কেন করলো সে এমন প্রশ্ন? নিজের দু গালে নিজেরই চ’ড় মা’রতে ইচ্ছা করছে।

ক্যানিয়ল ইরতিজার অবস্থা দেখে প্রকাশ্যেই হেসে ফেললো। বললো,
“চলো, বাসায় পৌঁছে দিচ্ছি তোমায়।”

________________

রাতে শয়নকালে ইরতিজা ভাবছিল পুরো ঘটনাটা নিয়ে। জোনাসের অমন আকস্মিক আগমন, তারপর ক্যানিয়লের অমন কথাবার্তা! বাড়িতে আসার পর থেকে সে ভয়ে ভয়ে ছিল। মনে হচ্ছিল জোনাস এই বুঝি ফুফুর কাছে ম্যাসেজ আর ফটো পাঠালো, আর এই বুঝি ফুফু বাবাকে কল দিয়ে সব বলে দিলো! কিন্তু এমন কিছুই হয়নি। জোনাস কি তবে ফুফুর কাছে ম্যাসেজ আর ফটো পাঠায়নি? মনে মনে ইরতিজা স্বস্তি অনুভব করে কথাটা ভেবে। যদি জোনাস অমনটা করতো তাহলে তুলকালাম কাণ্ড বেঁধে যেত। নিশ্চয়ই এতক্ষণে সাজিদের সাথে তার বিয়ের বন্দোবস্ত শুরু হয়ে যেত! নাহ, এই ব্যাপারটা নিয়ে আর ভাবতে পারলো না সে।
ওদিকে ক্যানিয়লের কথা চিন্তা করে তো সে বার বার লজ্জায় পড়ছে। এমন সব প্রশ্ন কীভাবে করতে পারে ক্যানিয়ল? ইরতিজার অনুভূতি সম্পর্কে তো সে অবগত। সে তো আর অবুঝ নয় যে এত কাছাকাছি থেকে ওর অনুভূতি বুঝতে পারবে না। তাহলে এসব প্রশ্ন করে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলার মানে কী?
ইরতিজা এ সমস্ত কথা চিন্তা করতে করতে ঘুমিয়ে গিয়েছিল। ঘুমটা ভেঙে গেল হঠাৎ মাঝরাতে। জেগে উঠে যে ব্যাপারটা লক্ষ করলো তাতে তার শরীরের প্রতিটা লোম দাঁড়িয়ে গেল। বারান্দার সাথে রুমের সংযোগ স্থলে যে দরজাটি আছে সেটার গায়ে কেউ শব্দ করছে। ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে গেল ইরতিজা। ঘামে ভিজে যেতে লাগলো সারা শরীর। ভয়ে এতটাই স্তব্ধ হয়ে গেছে যে উঠে গিয়ে লাইটটা পর্যন্ত জ্বালানোর সাহস হলো না। সে স্থির একই জায়গায় দম বন্ধ করে বসে রইল। কাউকে যে ডাকবে তাও পারছে না। ওষ্ঠাধর ফাঁকা করলেও যেন সেই শব্দ দরজার বাইরে বারান্দায় থাকা প্রাণীটির কানে চলে যাবে। আর সে দরজা ভেঙে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসবে ওকে মা’রা’র জন্য। ইরতিজা কাঁপছে। অনেকটা সময় কেটে যাওয়ার পরও যখন শব্দটা থেমে থেমে হচ্ছিল তখন ইরতিজা কোনোরকম একটু সাহস সঞ্চয় করে নামলো বিছানা থেকে। লাইট অন করলো। ভিতরের মানুষটা জাগ্রত হয়েছে বুঝতে পেরে বাইরের মানুষটা দরজার গায়ে আরও জোরে শব্দ করতে লাগলো হাত দিয়ে। ইরতিজার শরীর থরথর করে কেঁপে উঠলো। কে থাকতে পারে দরজার ওপাশে? পর্দার কারণে মানুষটাকে দেখা সম্ভব হচ্ছে না। ইরতিজার একাধারে ভয় করছে, আবার বিষয়টা খতিয়ে দেখারও প্রয়োজন অনুভব হচ্ছে। সে ভীষণই ধীর পায়ে এগোতে লাগলো। দরজার ওপাশে থাকা প্রাণীটি মানুষই তো? না কি আবার অন্য কিছু? কোনো জন্তু? না কি অশরীরী কোনো কিছু?
ইরতিজা ভয়ে ভয়ে পর্দায় হাত দিলো। সাহস হচ্ছে না পর্দাটা সরানোর। বাড়ির কাউকে ডাক দিলে হতো না? না থাক। ইরতিজা একটা শুকনো ঢোক গিলে পর্দাটা এক টানে সরিয়ে ফেললো এক পাশে। সামনে কাউকে দেখতে না পেয়ে বেশ চমকালো। ভয়ের সাথে সাথে এবার জন্ম নিলো কৌতূহল। ব্যাপারটা কী হলো? এতক্ষণ যে শব্দ করলো সে কোথায়? এখন সব কিছু এত নিশ্চুপ কেন? ওর কোনো রকম হ্যালুসিনেশন হয়নি তো? ইরতিজা দরজার লক খুলে বেরিয়ে এলো বারান্দায়। বাম দিকে তাকাতেই ওপাশে একটা মানুষকে দেখতে পেয়ে ভয়টা সর্বকূল দিয়ে ঘিরে ধরলো ভীষণ প্রখর ভাবে। মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসার প্রস্তুতি নিলো একটা ভয়ার্ত ধ্বনি। কিন্তু সেটা জোরেশোরে এলাকা কাঁপানো ধ্বনির রূপ নেওয়ার আগেই সামনের মানুষটা ছুটে এসে তার মুখ চেপে ধরলো। ইরতিজা ছাড়া পাওয়ার জন্য ছটফট করছিল মানুষটা কে তা লক্ষ না করেই। এই সময় তার খুব নিকটে কিছু কথা আওয়াজ তুললো,
“এমন ছটফট করো না সুইটহার্ট। আমাদের ভালোবাসা যেমন শান্ত, তোমারও তেমনি শান্ত থাকা উচিত। ভালোবাসা অশান্ত হয়ে গেলে সেই অশান্ত ভাবটা তুমি সামলে উঠতে পারবে না।”

ইরতিজা স্তব্ধ হয়ে গেল। কণ্ঠস্বরটা যে তার খুব পরিচিত। রুম থেকে ভেসে আসা আলোয় মানুষটার মুখটা খেয়াল করে দেখলো সে। হৃৎপিণ্ড অজান্তেই কেঁপে উঠলো তার। সে রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল জোনাসের দিকে। তার মুখের উপর থেকে নেমে গেল জোনাসের শক্ত হাত। দৃষ্টি নিষ্প্রভ হয়ে এলো হঠাৎই। সারা শরীর অসাড় হয়ে যাওয়ার ক্লান্তি অনুভূতি অনুভব হচ্ছে তার। দৃষ্টি ক্রমশ আরও বেশি ঘোলা হয়ে আসছিল। বেশি দুর্বলতা অনুভব করতেই সে আঁকড়ে ধরলো জোনাসের হুডি। দু চোখ নিভু নিভু করছে তার। অস্ফুটে মুখে একটা কথা উচ্চারণ করলো,
“আমি কি মারা যাচ্ছি?”

কথাটা উচ্চারণের পরপরই তার দু চোখ একেবারে মুদে গেল। সে পিছনের দিকে হেলে পড়ে যাচ্ছিল। কিন্তু জোনাস তাকে বুকে টেনে নিলো। বুকের মধ্যিখানে জড়িয়ে রেখে বললো,
“তুমি কি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছো সুইটহার্ট?”
বলে মৃদু হেসে বললো,
“গিয়েছো বোধহয়। সেজন্যই তো এভাবে আমার বুকের মধ্যিখানে আছো। তোমার জন্য এই জায়গাটা সবচেয়ে বেশি উপযুক্ত, জানো সেটা? অন্য কারো বুকে মাথা রেখে দেখো। দেখবে–এই বুকের মতো প্রশান্তি আর দ্বিতীয় কোথাও পাবে না। এই বক্ষস্থল যে তোমার জন্যই সৃষ্টি, তুমি মাথা রাখবে বলে।”

জোনাস বুকের সাথে মিশে থাকা ইরতিজার মাথাটা সরিয়ে আনলো। লাইটের আলোয় দেখলো ইরতিজার অজ্ঞান মুখখানি। হাসলো। পর মুহূর্তেই মুখ ঢাকলো আবার বিষাদের মেঘে। ইরতিজার মাথার পিছনে একহাত দিয়ে পরম যত্নে আগলে ধরে আছে ওকে। বললো,
“আমার ভালোবাসার তীব্রতা তুমি টের পাও না টিজা? কীভাবে এটা টের পাওয়াবো তোমায়? কোনো উপায় আছে? ভালোবাসি তোমায়। টের পাওনি এখনও বলার পরেও? নিউ ইয়র্ক শহর জানে আমি তোমাকে ভালোবাসি, রেডমন্ডের বাতাসও এতদিনে জেনে গেছে। শুধু তোমার মনই বুঝলো না আমাকে। সত্যিই অনেক ভালোবাসি তোমাকে।”

জোনাসের ওষ্ঠাধর এগিয়ে এলো ইরতিজার দিকে। ক্ষণিকেই তা ছুঁয়ে গেল ইরতিজার ওষ্ঠাধরকে!

(চলবে)

#উড়ো_পাতার_ঢেউ
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ৪১
_________________

মাথায় প্রচুর যন্ত্রণা হচ্ছে। চোখের পাতা দুটো টেনে খোলার মতো কষ্টদায়ক কাজ এই মুহূর্তে আর দ্বিতীয় কোনোটিকে মনে হচ্ছে না। শেষমেশ চোখের পাতা দুটো টেনে খুললো ইরতিজা। ঝাপসা দৃষ্টিতে দেখতে পেল তার সম্মুখ বরাবর দেয়ালে একটা আলোর উৎস জ্বলছে। বাম দিকে তাকালে একটা ছেলে মানুষের অবয়ব দেখতে পেল টলমল নেত্রপট দিয়ে। প্রথমে মনে হলো যে অবয়বটা দেখতে পাচ্ছে ওটা সাজিদের। পরে মনে হলো ওটা ক্যানিয়লের। কিন্তু একটু সময় নিয়ে বুঝতে পারলো ওটা আসলে জোনাস। ইরতিজার মনে পড়ে গেল জ্ঞান হারানোর আগের ঘটনাগুলো। জোনাস গিয়েছিল তার কাছে, সে ভয়ে চিৎকার করতে নিলেই জোনাস এসে তার মুখ চেপে ধরেছিল। আর তারপরই সে জ্ঞান হারায়। সবটা মনে পড়ে যেতেই ইরতিজা শায়িত অবস্থা থেকে উঠে বসলো দ্রুত। জোনাস অন্যদিকে ফিরে কিছু একটা করছে। ইরতিজা বললো,
“তুমি এখনও এখানে? এত রাতে আমার বাড়িতে আসতে পারো কীভাবে?”

ইরতিজার কণ্ঠ শুনতে পেয়ে জোনাস ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। ইরতিজাকে জাগ্রত দেখে মুচকি হেসে বললো,
“জেগেছো তুমি?”

সে এগিয়ে এলো ইরতিজার কাছে। হাতের স্বচ্ছ গ্লাসে কোনো এক পানীয় লক্ষ করা যাচ্ছে। সম্ভবত আঙুরের জুস হবে। সে ইরতিজার কথার প্রত্যুত্তর করলো,
“আমি এখানে নই, তুমি এখানে আছো। ইট’স মাই প্লেস।”

ইরতিজার অন্তঃকরণ সচকিত হলো। দৃষ্টি জোড়া সচকিত হয়ে এদিক-ওদিক তাকালো। কপালে চিন্তিত রেখার সৃষ্টি হয়ে গেল নিমেষহীন। এটা তো জোনাসের রুম। ইরতিজার মনে হয়েছিল সে নিজে কক্ষে আছে। কিন্তু জোনাসের এখানে দেখে তার ভয়ের মাত্রা আরও একগুণ বেড়ে গেল। সেই সাথে রাগ। চিৎকার করে উঠলো ইরতিজা,
“আমাকে নিয়ে সদর দরজা দিয়ে বেরিয়ে এসেছো তুমি?”

জোনাস একটু হাসলো।
“মাটি থেকে তোমার বারান্দার উচ্চতা একটুখানি হওয়াতে কাজটা খুব বেশি কঠিন ছিল না। অবশ্য তোমাকে নিয়ে দুই-তিন তলার বারান্দা থেকে নামতে গেলে নামাটা সম্ভব হতো না বোধ হয়। সম্ভব হলেও খুব কঠিন ব্যাপার হতো আমার জন্য।”

ইরতিজার রাগের মাত্রা আরও কয়েকগুণ বেড়ে গেল। সে রাগি নেত্রতে তাকালো জোনাসের দিকে। জোনাস আঙুরের জুস বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
“এটা তোমার জন্য।”

ইরতিজা তিক্ত চোখে সুমিষ্ট আঙুর রসের দিকে তাকালো। একটা তেঁতো ভাব তার মুখশ্রীতেও প্রকাশ পেয়েছে। জোনাসের উপর চেঁচিয়ে উঠলো সে,
“তুমি আমাকে এখানে এনেছো কেন? কোন সাহসে এনেছো? কেন আমার বাড়িতে গিয়েছিলে? তুমি কি আমাকে অজ্ঞান করেছো?”

“আমি তোমাকে অজ্ঞান করিনি। তুমি ভয়ে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলে।”

ইরতিজা আবারও চেঁচিয়ে উঠলো,
“তুমি আমার অজ্ঞান অবস্থায় আমাকে এখানে এনে একদম ঠিক করোনি। আজ সব লিমিট ক্রস করেছো তুমি। তোমার প্রতি আরও একবার প্রবল ঘৃণা অনুভব করলাম। আমাকে এখানে নিয়ে আসার দুঃসাহস কীভাবে করতে পারলে?”

জোনাস হেসে বললো,
“এটার থেকেও বেশি দুঃসাহস করে ফেলেছি আমি।”

ইরতিজা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“মানে? আর কী করেছো?”

জোনাস আর প্রশ্নের উত্তর দিলো না। বললো,
“আমার সাথে সাইকেলে ঘুরবে টিজা? এজন্যই এনেছি তোমাকে। সাইকেলে ঘোরার জন্যই তোমার কাছে গিয়েছিলাম।”

“এতো বড়ো অন্যায় করার পর সাইকেলে ঘোরার কথা বলছো তুমি? কীভাবে ভাবলে এসবের পরেও তোমার সাথে সাইকেলে ঘুরবো? আমি এই মুহূর্তে বাসায় ফিরতে চাই। তোমার পাগলামিপূর্ণ কাজ আমাকে তিক্ত করে তুলছে। আমি ভাবতে পারছি না কেউ আমাকে আমার বাড়ি থেকে অজ্ঞান অবস্থায় তুলে এনেছে! তুমি যেটা করেছো এটা শত্রুতাতেই মানায়। এমন কাজ হয় শত্রুদের। যত দিন যাচ্ছে আমরা তত একে অপরের ভালো শত্রু হয়ে উঠছি। তুমি আমাদের মাঝে কোনো বন্ধুত্বের চিহ্নই রাখছো না জন। আমাদের মাঝে বন্ধুত্ব না থাকুক, একটা দুটো বন্ধুত্বপূর্ণ চিহ্ন অন্তত থাকতে পারতো। কিন্তু তুমি সবকিছু ধুলিস্মাৎ করে দিচ্ছো।”
বলতে বলতে ইরতিজার দু চোখ বেয়ে হঠাৎই আবেগী অশ্রু নামলো। সে আরও বললো,
“আমাদের মাঝে বন্ধুত্বটা না হয় না-ই থাকতো, কিন্তু তোমার আমার শত্রু হয়ে ওঠাটা কি এতটাই গুরুত্বপূর্ণ ছিল?”

জোনাস বাকহারা হয়ে চেয়ে রইল স্তব্ধ নয়নে। ইরতিজা বললো,
“আমার কষ্ট হয়, যাকে বন্ধু বলে চিনতাম তার শত্রু রূপ মানতে ভীষণ কষ্ট হয় আমার। প্লিজ! আমার সাথে এখানেই শত্রুতার পরিমাণ স্থিতিশীল রাখো। তুমি ফুফুকে নিয়ে হু’মকি দিচ্ছ আমায়, রাতে গিয়ে তুলে আনছো বাসা থেকে, প্লিজ বন্ধ করো এসব। ইতোমধ্যে তুমি শত্রুর মতো আচরণ করে এক বিষাক্ত কাঁটার জন্ম দিয়েছো আমার জীবনে। দ্বিতীয় কোনো কাঁটার জন্ম দিয়ো না আর। দিলে ওই কাঁটার আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যাবে আমার জীবন। নিউ ইয়র্ক ফিরে যাও প্লিজ।”

“আমি তোমার জন্য রেডমন্ড এসেছি টিজা।”

“তুমি আমার সাথে শত্রুতা আরও প্রগাঢ় করার জন্য রেডমন্ড এসেছো। কিন্তু আমি তাতে অনিচ্ছুক। আমি চাই একটু শান্তিতে বাঁচতে। আর তুমি আমার জীবনে এক অশান্তির নাম!”

ইরতিজার মুখচ্চারিত বাক্যে জোনাসের হৃদয় সহসা ছিদ্র হলো ধা’রালো ফলার আঘাতে। ভারাক্রান্ত কণ্ঠে বললো,
“আমি অশান্তি তোমার জীবনে?”

“হ্যাঁ। আগে ছিলে না। আগে তুমি এমন একজন ছিলে যার কারণে হাসি ফুঁটতো আমার মুখে। কিন্তু তুমি নিজ কর্মে অশান্তিময় হয়ে উথেকেইছো এখন!”

কথাটা শুনতে খারাপ লাগলো এবং অসহ্য মনে হলো জোনাসের। কষ্ট লাগলো, সাথে রাগ, জেদও হলো। দৃপ্তকণ্ঠে বলে উঠলো,
“হ্যাঁ অশান্তি! এটাই ঠিক আছে। আমি চাই না তুমি শান্তিতে থাকো। যার জন্য সর্বক্ষণ ঘৃণার বিচরণ অন্তরে সেই মানুষটা শান্তিতে থাকুক একদমই চাই না। তার শান্তিময় জীবন আমাকে অশান্তির স্বাদ দেয়। আমার ঘুম কেড়ে নেয়, আমার নিরালা সময়কে করে ছটফটে। আমি চাই তোমার সারাটা জীবন অশান্তিতে কাটুক। অশান্তি খুব করে জ্বালাতন করুক তোমাকে প্ৰতিটা মুহূর্তে!”

কথাগুলো শুনে ইরতিজার এত ঘৃণা লাগলো যে সে শুধু একটা বাক্য ছাড়া আর কিছু উচ্চারণ করতে পারলো না মুখে,
“তুমি ঘৃণারও অযোগ্য জন!”

কথাটা বলে এক মুহূর্ত আর দাঁড়াতে পারলো না। ঘৃণায় বিষাক্ত হয়ে উঠছিল মন। এত বিষের প্রকোপ এই প্রথম অনুভব করলো জীবনে। যে জোনাসের জন্য তার কষ্ট অনুভব হতো এই কি সেই জোনাস? কিছুদিন আগেকার জোনাস আর এখনকার জোনাসের মাঝেও হাজার তফাতের সৃষ্টি হয়েছে। জোনাস এক সময় তার ভালো বন্ধু ছিল এটা মনে করে আর কষ্ট অনুভব হচ্ছে না। কষ্ট উপলব্ধির স্থানটুকুও ঘৃণারা সম্পূর্ণ রূপে দখল করে ফেলেছে। অতীতে থাকা কোনো বন্ধু কি কখনও কোনো বন্ধুকে এমন করে বলতে পারে?

ইরতিজা সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলো নিচে। জোনাসের হাউজলর্ড আজ বাড়িতে নেই। থাকলে হয়তো সে চিলেকোঠায় হওয়া ঘটনার কিছুটা অংশ হলেও টের পেত। বাইরে অন্ধকার। অনেক দূর থেকে কিছু আলোর রশ্মি ভেসে আসছে। ইরতিজার গায়ে পুরু কোনো শীত পোশাক নেই। একটিমাত্র থাম্পার সোয়েটার, যা শীত উপশম করতে তেমন একটা কার্যকরী নয়। ইরতিজা বাড়িটা থেকে কয়েক পা দূরে হেঁটে আসা মাত্রই জোনাস হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে ইরতিজার একটা হাত ধরে ওকে যেতে বাধা দিলো। আকস্মিক ঘটনায় ইরতিজা ভয়, বিস্ময়ে চমকে উঠলো ভারি। জোনাস বললো,
“তুমি এভাবে চলে যেতে পারবে না। তুমি এভাবে চলে যাবে বলে আমি তোমাকে নিয়ে আসিনি। তুমি আমার সাথে সাইকেলে ঘুরবে না বলে আমি নতুন সাইকেল কিনিনি। আমার সাথে ঘুরবে বলে সাইকেলটা কিনেছি। এখন তোমাকে ঘুরতেই হবে। যেহেতু এটা আমার নিয়ত করা হয়ে গেছে।”

ইরতিজা এক ঝটকায় জোনাসের হাত সরিয়ে দিয়ে বললো,
“এটা এখনও আশা করছো কী করে? লজ্জা করছে না তোমার? তোমার সাইকেলে ঘুরবো আমি? তোমার সাইকেল ভেঙে গুঁড়িয়ে দেবো আমি।”

ইরতিজা অন্ধকার পরোয়া করলো না, নিস্তব্ধ শহরে এই মাঝরাতে একাকী চলার ভয়কেও পরোয়া করলো না। সে হনহন করে হেঁটে চলে এলো জোনাসের থেকে অনেক দূরে। আর চলতে চলতেই মিলিয়ে গেল জোনাসের অবলোকন দৃষ্টি হতে অন্ধকারে। জোনাসের বুকে চলছে থমথমে এক অবস্থা। চলছে কিছুক্ষণ পরপর দমকা হাওয়ার তাণ্ডব। ভেঙে যাচ্ছে তার হৃদয়কূল। সেই সাথে ভাঙছে তার এতদিন মনে পুষে রাখা একটা ভ্রান্তি ধারণাও। ইরতিজার মনে আসলে তার জন্য কোনো ভালোবাসার অনুভূতি ছিল না! একটুকুনি অনুভূতিও ছিল না ভালোবাসার!

_______________

সকালের আলো ফুঁটতে না ফুঁটতেই ঘুম ভেঙে গেল ক্যানিয়লের। ঘুমটা ভেঙেছে মূলত কলের শব্দে। কল রিসিভ করে যখন দেখলো আবারও সেই হুমকিমূলক ফোন তখন রাগের বশে আজ একটা আছাড়ই মেরে বসলো মোবাইলটাকে। মোবাইলটা বিক্ষিপ্তভাবে মেঝেতে পড়েও ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। ক্যানিয়ল চিন্তিত ভঙ্গিতে বসে ছিল বেডে। এই হুমকিমূলক কল আর সহ্য করতে পারছে না। এভাবে চলতে দেওয়া যায় না। কীভাবে নাইলা সালেমের এই খেলাটা বন্ধ করে দেবে? কঠিন উপায়ও আছে, সহজ উপায়ও আছে। কঠিন উপায়ে কিছু করতে গেলে ড্যাড সহ সবাই নাইলা সালেমের এসব ব্যাপারে জেনে যাবে। সহজ উপায়টা হলো– কোম্পানিটা যদি অতি শীঘ্রই নিজের নামে হয়ে যায় তাহলে নিশ্চয়ই নাইলা সালেমের এসব হুমকি-ধামকি বন্ধ হয়ে যাবে। হয়তো কোম্পানিটা ওর নামে হয়ে যাওয়ায় সে রেগে গিয়ে মারাত্মক আক্রমণ করে বসতে পারে। তবে ব্যাপার না, সেগুলো সামলে নেওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকবে। কিন্তু রোজ রোজ এই হুমকি শুনে অতিষ্ঠ তো হতে হবে না। ক্যানিয়ল বসে বসে যখন এসব ভাবছিল তখনই মিরান্ডা প্রবেশ করলো রুমে। প্রথমে তার চোখ চলে গেল মেঝেতে পড়ে থাকা মোবাইলটার উপর। এরপর ক্যানিয়লের দিকে। তার মনে হলো মোবাইলটা এরকমভাবে ক্যানিয়লই ফেলেছে মেঝেতে। সে মোবাইলটা তুলে নিলো মেঝে থেকে। ক্যানিয়লের দিকে আসতে আসতে বললো,
“মোবাইল ছুঁড়ে ফেলেছো কেন? গার্লফ্রেন্ডের সাথে মনোমালিন্য না কি?”

ক্যানিয়ল চোখ তুলে তাকালো। মিরান্ডার মুখে ব্যঙ্গ করা হাসি। ক্যানিয়ল শুধালো,
“গার্লফ্রেন্ডের সাথে তো নয়, তবে উডবি ওয়াইফের সাথে মনোমালিন্যর সৃষ্টি হতে পারে এই মুহূর্তে।”

মিরান্ডা ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো। হাসি হাসি মুখেই সে দাঁতে দাঁত চাপলো রাগে। হাতে থাকা ক্যানিয়লের মোবাইলটা তীব্র আক্রোশে ছুঁড়ে মারলো সামনের দেয়ালে। মোবাইলটা দেয়ালের সাথে বাড়ি খেয়ে মেঝেতে পড়ে উচ্চ ধ্বনিতে শব্দ তৈরি করলো। ক্যানিয়ল ব্যাপারটাতে নির্বিকার। মিরান্ডা রাগে ফুঁসছে। রাগান্বিত ভারী শ্বাস পড়ছে তার। ক্যানিয়ল ভাবলেশহীন উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
“আমি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছি, তোমাকে বিয়ে করবো না।”

মিরান্ডা চকিতে ক্যানিয়লের দিকে তাকিয়ে তেজস্বী কণ্ঠে জানালো,
“কিন্তু আমি অনেক আগে থেকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া, আমি তোমাকে বিয়ে করবো।”

ক্যানিয়ল আর কানে তুললো না মিরান্ডার কথা। নির্বিকার ভঙ্গিতে হেঁটে গেল ওয়াশরুমের দিকে।
ফ্রেশ হয়ে যখন বের হলো তখন মিরান্ডা নেই আর বাড়িতে, চলে গেছে। ক্যানিয়ল ঠান্ডা মাথায় রেডি হয়ে বের হলো বাড়ি থেকে। তার গন্তব্য এখন ইউনিভার্সিটি।
ইউনিভার্সিটি গিয়ে সে খোঁজ করলো ইরতিজার। মেয়েটা গতকাল ভীষণ লজ্জা পেয়েছিল। আজও কি তার লজ্জা কাটেনি? দেখতে পাচ্ছে না কোথাও। লজ্জায় কোথায় মুখ লুকিয়ে রেখেছে? ইরতিজাকে যখন এদিক-ওদিক খুঁজছিল তখন লেকচারার স্টিভেন কোত্থেকে এসে জিজ্ঞেস করলো,
“টিজাকে খুঁজছো?”

“না, আমি কাউকেই খুঁজছি না।”

“তাই?”

“হ্যাঁ। কিন্তু তুমি কি ওকে দেখেছো কোথাও?”

“লাইব্রেরিতে গিয়েছিলাম একটা প্রয়োজনে। সেখানে গিয়ে টিজার মতো একটা মেয়েকে বসা দেখেছিলাম। যদিও আমি শিওর না ওটা টিজা কি না, তবুও তুমি একবার গিয়ে দেখে আসতে পারো। হয়তো তুমি ওকে খুঁজছো না। তারপরও একবার গিয়ে দেখে আসতে পারো।”
বলে ঠাট্টা করে হাসলো স্টিভেন। এরপর চলে যেতে উদ্যত হলেই ক্যানিয়ল বললো,
“আমি ওকেই খুঁজছিলাম মি. স্টিভেন।”

“জানি আমি।”

স্টিভেন চলে গেল।
স্টিভেনের বলা ঠিকানায় এসে দেখা মিললো ইরতিজার। লাইব্রেরির এক কোণে চুপচাপ মুখ গম্ভীর করে বসে আছে। ইরতিজাকে এরকম বসে থাকতে দেখে ব্যাপারটা অস্বাভাবিক লাগলো ক্যানিয়লের কাছে। এসে ইরতিজার সামনে বসে জিজ্ঞেস করলো,
“কী হয়েছে তোমার?”

ইরতিজা তাকালো, আবার চোখ সরিয়ে নিয়ে মনমরা কণ্ঠে উত্তর দিলো,
“কিছু হয়নি।”

“তোমার উত্তরকে মিথ্যা স্বরূপ ধরা হয়েছে।”

ইরতিজা ক্লান্ত ভঙ্গিতে দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করলো। এর মধ্যে হঠাৎই শোনা গেল একজন তৃতীয় ব্যক্তির কণ্ঠ,
“আমি নিজেই আমার সাইকেল ভাঙচুর করেছি টিজা। তোমার আর প্রয়োজন পড়বে না ওটা ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়ার।”

কণ্ঠস্বর অনুসরণ করে তাকাতেই কিছুটা দূরে জোনাসকে দাঁড়ানো দেখা গেল। জোনাসের এমন মানেহীন কথা শুনে অবাক হয়েছে ক্যানিয়ল। অবাক হওয়ার প্রতিফলন তার আননে ছায়া ফেলেছে। জিজ্ঞেস করলো,
“কীসের সাইকেল?”

জোনাস স্পষ্ট উত্তর দিলো,
“যেটায় করে গত মাঝরাতে আমার আর টিজার ঘোরার কথা ছিল।”

(চলবে)

#উড়ো_পাতার_ঢেউ
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ৪২
_________________

জোনাস চলে গেছে। ক্যানিয়লের মুখ ডুবেছে ভাবনার অতল জলে। বেশ কিছু সময় সে একাকী ভাবলো। তারপর ইরতিজাকে জিজ্ঞেস করলো,
“মাঝরাতে সাইকেলে ঘোরার কথা ছিল মানে? কী বোঝালো? তোমাদের দুজনের মাঝরাতে সাইকেলে ঘোরার কথা হয়েছিল?”

ইরতিজা দুই পাশে ঈষৎ মাথা নেড়ে বললো,
“না।”

“তাহলে যে বললো মাঝরাতে সাইকেলে ঘোরার কথা ছিল?”

“ও চেয়েছিল আমাকে নিয়ে সাইকেলে ঘুরতে। কিন্তু আমি চাইনি।”

“তুমি কী চেয়েছিলে? ওর সাইকেল ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে?”

ভাঙনের কথা উঠতেই ইরতিজার হৃদয়ের পাড় গুড়মুড় শব্দ করে ভেঙে পড়লো সমুদ্রের নোনা জলে। ভীষণ অবসন্ন বোধ এসে প্রতিটা শিরায় শিরায় অবসাদ ছেয়ে দিলো। ক্লান্তিতে হঠাৎ লেগে আসতে চাইলো চক্ষুদ্বয়। ইরতিজা ব্যাগটা পিঠে নিয়ে দাঁড়িয়ে বললো,
“আমার শরীর ঠিক লাগছে না। বাসায় চলে যাচ্ছি আমি।”

ইরতিজা লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে এলো। বেশি দূর হেঁটে আসার আগে ক্যানিয়লও বের হলো লাইব্রেরি থেকে। ইরতিজা আর তার মাঝে বেশ কিছুটা দূরত্ব। সে পিছন থেকে উচ্চরবে জানতে চাইলো,
“ওর কি এখনও তোমার প্রতি ফিলিংস আছে?”

প্রশ্নটা কানে আসা মাত্রই দাঁড়ালো ইরতিজা। শরীরের লোমগুলোও দাঁড়িয়ে গেল। ধীর লয়ে পিছন ফিরে তাকালো সে। বললো,
“আমার প্রতি ওর গভীর ঘৃণা আছে।”
কথাটা বলার সময় কণ্ঠ কেমন কম্পিত হয়ে উঠলো ইরতিজার। আর এক মুহূর্ত না দাঁড়িয়ে চলে গেল দ্রুত পা ফেলে।

ক্যানিয়ল ভ্রুর মধ্যস্থলে ভাঁজ ফেলে বিড়বিড় করলো,
“ঘৃণার মানুষটার সাথে সাইকেলে ঘুরতে চায়? স্ট্রেইঞ্জ!”

_______________

শ্রেণিকক্ষটি প্রায় ফাঁকা পড়ে আছে। পাঠদান এখনও শুরু হয়নি বলে শিক্ষার্থীদের বড়ো অংশটাই এখন বাইরে অবস্থান করছে। গুটিকতক স্টুডেন্ট দেখা যাচ্ছে কক্ষটির ভিতর। তার মধ্যে জোনাস একজন। নীরব পরিবেশে জোনাসকে সমাচ্ছন্ন করে রেখেছে ইরতিজার ভাবনা। ইরতিজা তাকে ভালো না বাসলে, ইরতিজার মাঝে সে নিজের জন্য যে আর্দ্র বিষয়টি উপলব্ধি করতো, ওটা কী ছিল? ওটা কি ইরতিজার বন্ধুত্বপূর্ণ অনুভূতির অংশ ছিল? ওটা কি কেবলই বন্ধুত্বই ছিল?
দুটি অদৃশ্য হস্ত কষ্টের রং উলটে-পালটে মাখিয়ে দিতে লাগলো জোনাসের হৃদয়ে। ভীষণ কষ্ট তার হৃৎপিণ্ডকে দগ্ধ করছে!
ক্যানিয়লের আগমন দৃষ্টি কাড়লো জোনাসের। হৃদয়ের দগ্ধতায় বর্ষণ ঝরে হঠাৎই তা সচকিততায় রূপধারণ করলো। তবে সে ঘাবড়ালো না।
ক্যানিয়ল জোনাসের সম্মুখে বসলো। জোনাস তাকে যথাসম্ভব গ্রাহ্য না করার চেষ্টা করলো। ক্যানিয়লও কিছু না বলে নীরবে চোখ বুলিয়ে গেল জোনাসের উপর। ক্যানিয়লের এমন পর্যবেক্ষণ দৃষ্টির সম্মুখে অস্বস্তি হচ্ছিল জোনাসের। শেষ পর্যন্ত সে ক্যানিয়লকে উপেক্ষা না করতে পেরে বললো,
“কিছু বলবে?”

“আমার মনে হচ্ছে না আমি যেসব বলবো তা শুনতে তুমি ইচ্ছুক!”

“অনিচ্ছা হলেও শুনে নেবো।”

“ভালো। ইজার প্রতি কি তোমার ফিলিংস আছে এখনও?”

“নিজের প্রথম পছন্দকে কেউ সহজে ভুলতে পারে না। টিজা আমার মনে কাঁটার মতো গেঁথে আছে, থাকবে।”

“কিন্তু ওই কাঁটাটা যে মন থেকে উঠিয়ে ফেলতে হবে, সেটা কি জানো?”

“আমি কাঁটাটা উঠাবো না, সুতরাং এটা জানার প্রয়োজন বোধ নেই আমার।”

“ইজা তোমাকে পছন্দ করে না। তুমি আগে ওর বন্ধু ছিলে, কিন্তু এখন তুমি ওর কাছে শত্রু হিসেবে আছো, সেটা কি জানো?”

“না জানার মতো বিষয় নয় এটা।”

“তাহলে তুমি ওর সাথে শত্রুর মতোই থাকো। একজন শত্রুর আচরণ কখনও বন্ধুর মতো হলে সেটা কুৎসিত লাগে।”

“কিন্তু আমি যে নিজের শত্রু পরিচয়টা পালটাতে চাইছি।”

“মিত্র থেকে শত্রু হওয়ার পথটা হয়তো সহজ, কিন্তু শত্রু থেকে মিত্র হওয়ার পথটা অত্যন্ত কঠিন বলে মনে করি আমি।”

জোনাস হেসে বললো,
“কিন্তু আমি মোটেই ওর মিত্র হওয়ার চেষ্টা করছি না। মিত্রর থেকে নিশ্চয়ই আমি একজন প্রেমিক রূপে ভালো শোভা পাবো। আমি শত্রু থেকে ওর প্রেমিক হতে চাই।”

জোনাসের কথাটায় ক্যানিয়লের শরীর রাগে উত্তপ্ত হলো। রাগ নিবারণের জন্য হাত খিঁচে ধরলো সে। বললো,
“নক্ষত্রটা যখন অনুজ্জ্বল ভাবে আমার অন্তরিক্ষে ছিল তখনই তুমি এটা ছুঁয়ে দেখার অধিকার রাখোনি। আর এটা যখন এখন উজ্জ্বল ভাবে আমার অন্তরিক্ষ আলোকিত করছে, তখন তো তুমি অবশ্যই এটা ছুঁয়ে দেখার অধিকার রাখছো না। যার উপর তোমার অধিকার নেই তার থেকে সর্বদা দূরত্বে থাকাই শোভনীয়। দূরে থাকো। ইট’স মাই ফার্স্ট এন্ড লাস্ট এডভাইস টু ইউ।”

“কিন্তু আমার এখানে আগমনের একমাত্র কারণই ও। কারণের বিষয় বস্তুকে পাল্টে ফেলা যায় না সহজে।”

“তোমার এখানে আসাটা অহেতুক। কোনো কারণ নেই। ছোটো বেলায় কীভাবে নিজের মানুষদের আঁকড়ে ধরে রাখতে হয় জানতাম না। আর না জানার ফলে গুরুত্বপূর্ণ একজনকে হারিয়ে ফেলেছিলাম। কিন্তু সেই সময়টার পর এখন অনেক সময় অতিবাহিত হয়ে গেছে। এখন আমি জানি কীভাবে নিজের মানুষদের নিজের কাছে রাখতে হয়।”

“আমিও নাছোড়বান্দা!”

“নাছোড়বান্দা হয়ে লাভ কী? যখন জানোই ছেড়ে দিতে হবে।”

জোনাস ভীষণ রেগে গেল। বসা থেকে দাঁড়িয়ে গিয়ে চাপা গর্জনে বললো,
“ইউ শাট আপ।”

রাগের পরিমাণ ক্যানিয়লের মাঝেও বৃদ্ধি পেল। চোয়াল শক্ত করে উঠে দাঁড়ালো সে। রক্ত হিম করা চাহনিতে জোনাসের চোখে তাকিয়ে বললো,
“আমার মনে হয় আমার সাথে উচ্চৈঃকণ্ঠে কথা বলার আগে তোমার একবার আমার সম্বন্ধে ভালো করে জেনে নেওয়া উচিত। ইজাকে বিরক্ত করা বন্ধ করো। নয়তো অন্যদের সাথে যেমনটা হয়, তোমার সাথেও তেমনই ঘটবে। বি কেয়ারফুল, ও কে?”

জোনাস স্তম্ভিত হয়ে চেয়ে রইল।
ক্যানিয়ল শেষ মুহূর্তে ঠোঁটে অদ্ভুত হাসির প্রভা ছড়িয়ে চলে গেল।

_______________

আজকের দিনটাই কেমন অলস ভঙ্গির। নিস্তেজ ভাব আদৌ প্রকৃতির মাঝে, না কি তার মন মাঝে বুঝতে পারছে না ইরতিজা।
ইউনিভার্সিটি থেকে চলে এসেছে অনেকক্ষণ হয়ে গেছে। দুপুরের কড়া রোদ নাচছে প্রকৃতির উপর। হেলেদুলে বাতাস বইছে। বাতাসে দোল খাচ্ছে বারান্দায় টাঙানো তারাগুলো। নতুন লাগানো হয়েছে এগুলো। নওরিন কিনে এনেছে। এগুলোকে এক প্রকার লাইট বলা চলে। কারণ এগুলোতে আলো উৎপন্নের প্রক্রিয়া আছে। রাতের বেলায় এগুলো জ্বালিয়ে দিলে দারুণ দেখা যায় না কি।
আজকের রোদ প্রখর হলেও তাপমাত্রা কিন্তু উষ্ণতম নয়। বরং শীতল। ইরতিজার গায়ে প্রয়োজনীয় উষ্ণ কাপড় জড়ানো।
বেশ কিছুটা সময় ধরে সে উদাসী মনে বসে ছিল। অলস ভঙ্গিতে কিছু বিষয়ের আলপনা এঁকে চলছিল মনে। আর উপলব্ধি করছিল সবচেয়ে সুন্দরতম বিষয়টুকু ক্যানিয়লকে ঘিরেই ঘুরপাক খাচ্ছে। হঠাৎ অপরিচিত একটা রিংটোন কানে এলো। একটু শোনার পর বুঝতে পারলো আসলে এটা অপরিচিত রিংটোন নয়, রিংটোনটা নওরিনের মোবাইল ফোনের। নওরিন কিছুক্ষণ আগে ছিল তার এখানে। যাওয়ার সময় নিশ্চয়ই ফোনটা ভুলে রেখে গেছে। ইরতিজা বারান্দা থেকে রুমে এলো। বেড সাইড টেবিলে ফোনটা বাজছে। হাতে নিয়ে কলারের নামটা দেখে একটু বিস্মিত হলো সে। সাজিদ?
সেদিন কথা বলার পর সাজিদ আর তার কাছে কল দেয়নি। একটা ভুল ধারণা নিয়ে তাকে ভুল বুঝেছে! সাজিদ তাকে জীবনে আর কোনোদিন কল না দিলেও তার কিছু আসে যায় না। কিন্তু সাজিদ তো মূলত ভুল ধারণার উপর ভিত্তি করে রাগ করে কল দিচ্ছে না। যে বিষয়টা আসলে অমন ছিল না, সেই বিষয় নিয়ে কেন রাগ করবে সাজিদ? সাজিদের এমন রাগের কারণে ইরতিজারও এবার বেজায় রাগ হলো। সে নওরিনকে খুঁজলো। কিন্তু পেল না। সাজিদের কল ইতোমধ্যে রিং হয়ে কেটে গেছে। ইরতিজার হঠাৎ কৌতূহল হলো। সাজিদ তো তার কাছেই তেমন একটা কল দেয় না। এখন রাগ করে যোগাযোগ একেবারেই বন্ধ। তাহলে নওরিনের কাছে কল দিয়ে কী বলবে সে? হঠাৎ নওরিনকে কেন কল দিচ্ছে? হঠাৎ? না কি নওরিন আর সাজিদের রোজই কথা হয়? ভীষণ কৌতূহল চেপে ধরলো ইরতিজাকে। বিষয়টা কিছুটা হলেও খতিয়ে দেখার প্রয়োজন মনে করলো সে।
নওরিনের ফোনটা বেজে উঠলো আবার। ইরতিজা আরও বিস্মিত হলো। সাজিদ তাকে কখনও একবারের বেশি কল দেয় না। কোনো কারণে সেই কলটা রিসিভ না করতে পারলে পরে নিজের কল ব্যাক করতে হতো। দ্বিতীয় বার কল দিতো না সাজিদ। নওরিনের ফোনে সাজিদের দ্বিতীয়বার কল করাটা দেখে তাই বিস্ময়ান্বিত হতেই হলো তার। কলটা কেটে যাবে যাবে এমন মুহূর্তে এলেই কোনো কিছু না ভেবেই হঠাৎ টুপ করে কলটা রিসিভ করে ফেললো ইরতিজা। ওপাশ থেকে সাজিদের কণ্ঠ শুনতে পেল,
“আসসালামু আলাইকুম!”

ইরতিজা মনে মনে সালামের উত্তর দিলেও মুখে উত্তরের ধ্বনিটা প্রকাশিত হলো না। তার এপাশটা নীরব রইল। এই নীরবতার দেখাদেখি ওপাশটায়ও নীরবতা ঘনিয়ে এলো। একেবারে নীরব সময় কাটলো এক কি দুই মিনিট। এরপর ওপাশ থেকে সাজিদের গমগমে কণ্ঠ ভেসে এলো,
“হোয়াই ডিড ইউ রিসিভ দ্য কল? হোয়্যার ইজ ইওর সিস্টার?”

ইরতিজা চমকে উঠলো। সাজিদ কী করে বুঝতে পারলো এটা ও ছিল? আর সাজিদের কথা বলার ধরন দেখে রীতিমতো মেজাজ খারাপ হয়েছে ওর। ও কিছু বললো না। আবারও খুঁজতে আরম্ভ করলো নওরিনকে। খুঁজতে খুঁজতে চলে এলো একেবারে সুইমিং পুলের ধারে। এখানে দেখা যাচ্ছে নওরিনকে। প্রতিবেশী এক মেয়ের সাথে আড্ডা দিচ্ছে। ইরতিজা ফোনটা নওরিনের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
“কল দিয়েছে।”

ফিয়ন্সে কল দিয়েছে এমন ভেবে নওরিনের হৃদয়ে খুশির একটা দোল দেখা দিলো। কারণ ফিয়ন্সের সাথে ইদানিং কথাবার্তা হচ্ছে না তার। কল দিলে কল রিসিভ করে না সে। নওরিন উল্লাসের সহিত জিজ্ঞেস করলো,
“কে কল দিয়েছে?”

ইরতিজা উত্তর না দিয়ে ফোনটা ধরিয়ে দিয়ে চলে এলো। ফোন হাতে নিয়ে ভুল ভাঙলো নওরিনের। এটা তার ফিয়ন্সে নয়, সাজিদ।

“হ্যালো!”

“কেমন আছেন?” সাজিদের প্রশ্ন।

“আলহামদুলিল্লাহ। আপনি?

“ভালো।”

“হঠাৎ আমাকে কল দিলেন যে?”

“একটা বিষয় জানানোর ছিল আপনাকে। কিন্তু বিষয়টা জানার পর আপনি কেমন রিয়াক্ট করবেন সেটা ভেবে আমি চিন্তিত।”

সাজিদের এ কথায় নওরিন একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেল। বিস্মিত তো সে বটেই। হঠাৎ কী এমন জানাবে সাজিদ?
নওরিন বললো,
“হ্যাঁ আপনি বলুন যা বলতে চান।”

সাজিদ একটু নীরবতা পালন করে বললো,
“আমার মনে হচ্ছে আপনার ফিয়ন্সের অন্য কারো সাথে রিলেশনশিপ চলছে!”

কথাটা শোনার জন্য প্রস্তুত ছিল না নওরিন। তাই একটু ঝটকা লাগলো হঠাৎই কথাটা শুনে। বলে উঠলো,
“কী বলছেন আপনি?”

“আপনার ফিয়ন্সেকে একটা মেয়ের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে ঘুরতে দেখেছি। আমার মনে হয় না কেউ তার বোনের সাথে এভাবে ঘুরবে, বা নিজের ফ্রেন্ডের সাথে। দেখে মনে হচ্ছিল দুজন কাপল। হবে হয়তো ওটা আপনার উডবির গার্লফ্রেন্ড!”

নওরিনের মস্তিষ্কে বিদ্রোহ চলছে। মাথা ঘুরছে। শরীর আর নিজের চেতনা ধরে রাখতে পারছে না। এটা কী শুনছে? এটা সত্যি? না কি কোনো ঠাট্টা? শরীর মৃদুভাবে কাঁপতে শুরু করলো তার। এমনটা কখনও আশা যোগ্য ছিল না হামাদের থেকে। হামাদ কি সত্যিই এমনটা করছে? এই জন্যই কি হামাদের তার প্রতি এত অবহেলার সৃষ্টি হয়েছে? বুক ফাঁটানো এক হাহাকার বেরিয়ে আসতে চাইছে নওরিনের ভিতর থেকে। কিন্তু সে খুব কষ্টে আটকে রাখলো তা। নিজেকে যথাসম্ভব কঠিন রাখলো।

(চলবে)