উড়ো পাতার ঢেউ পর্ব-৪৩+৪৪+৪৫

0
322

#উড়ো_পাতার_ঢেউ
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ৪৩
_________________

নওরিনের ফিয়ন্সে হামাদ থাকে লস এঞ্জেলেসে। ওখানেই তার জব। সাজিদ লস এঞ্জেলেস গিয়েছিল অফিসিয়ালি কাজে। সাথে আরও দুজন কলিগ ছিল। যারা কি না তার বন্ধুর মতো। শুধু অফিসিয়াল কাজেই তারা আটকে থাকেনি, হালকা ঘোরাঘুরিও করেছে। আর ঘুরতে গিয়েই হামাদের সাথে একটা মেয়ের ঘনিষ্ঠতা নজরে পড়েছে। প্রথম দেখায়ই অস্বাভাবিক লেগেছিল ব্যাপারটা। পরে আবারও দেখতে পেয়েছিল মেয়েটার সাথে হামাদকে।
সাজিদের কাছ থেকে ঘটনাটা জানার পর একেবারে মুষড়ে পড়েছে নওরিন। পুল সাইড থেকে ফিরে রুমে ঢুকে কাঁদলো সে। ঘটনাটা মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু মেনে নিতে না পারলেও জানে এটাই সত্যি। সে নিজেও টের পেয়েছে, আর সাজিদের তো তাকে মিথ্যা বলার কারণ নেই। তবুও সে সাজিদকে ‘আপনি মিথ্যা বলছেন, এই সম্পূর্ণটাই মিথ্যা’ এমন কথা বলে কল কেটে দিয়েছে। হামাদ এমন কী করে করতে পারলো তার সাথে? হামাদ ঠকালো তাকে! মুখোশ পরে কয়েকদিনের জন্য প্রিয়জন হতে এসেছিল। নওরিন আঙুলে থাকা এনগেজমেন্ট রিংটা কষ্ট, রাগে খুলে ছুঁড়ে মারলো। দুই হাত দিয়ে মাথার চুল শক্ত করে আঁকড়ে ধরে বসে পড়লো ফ্লোরে।

_______________

শুনসান রাত্রি। মৃদু শীতল বাতাসের রাজত্ব বাইরে। মানুষজনের চলাচল স্থগিত। এলাকা প্রায় তলিয়ে গেছে ঘুমের অতলে। ইরতিজার রুমের বারান্দায় স্টার লাইটগুলো জ্বলছে। ইরতিজা বেশ কিছু সময় বারান্দায় বসে থেকে লাইটগুলো দেখছিল। ভীষণ ভালো লাগছিল তার। এরপর রুমে ঢুকে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিলো। বারান্দার সাথে সংযোগ স্থাপন করা দরজাটা তখনও বন্ধ করেনি। ওটা যখন বন্ধ করতে গেল একটা আলোক রশ্মি হঠাৎ তার চোখের উপর এসে পড়লো। চোখ বুজে ফেললো ইরতিজা। আস্তে আস্তে করে চোখ খুলে পিটপিট করে তাকানোর চেষ্টা করলো। আলো এখনও তার উপর স্থায়িত্ব। ইরতিজা দেখার চেষ্টা করলো কে ফেলেছে তার উপর এই আলো। কিন্তু সক্ষম হলো না। এটা কি জোনাস? এত রাতে জোনাস আবার তাকে বিরক্ত করতে এসেছে? ইরতিজা
বারান্দার লাইটটা জ্বালিয়ে দিলো। আর এই লাইটের আলোয় মানুষটা তার দৃষ্টিগত হলো। হকচকিয়ে গেল ইরতিজা। এটা তো জোনাস নয়, ক্যানিয়ল! রুমের ভিতর মোবাইলটা বেজে উঠলো এরমধ্যে। ইরতিজা চলে এলো রুমে।
ক্যানিয়ল ফোন করেছে। ফোনটা নিয়ে সে আবার বারান্দায় এলো। ক্যানিয়ল কী করছে বুঝতে পারছে না সে। এত রাতে ক্যানিয়ল কেন এসেছে এখানে? কিছু বলার জন্য কি?

“বারান্দায় আমি যাকে দেখতে পাচ্ছি ওটা কি তুমি পাকিস্টানি গার্ল? না কি তোমার রূপে কোনো প্রেতাত্মা দাঁড়িয়ে আমার সাথে ছলনা করার ফন্দি আঁটছে?” ইরতিজা কল রিসিভ করলে এই কথাটাই সর্বপ্রথম বললো ক্যানিয়ল।

“তুমি এতরাতে এখানে কেন এসেছো?”

“তুমি এতরাত অবধি জেগে কেন আছো? আমার আসার অপেক্ষা করছিলে না কি?”

“আমি এমন দেরিতেই ঘুমাই রোজ।”

“কেন? আমার কথা ভাবতে ভাবতে তোমার ঘুমের দেরি হয় বুঝি?”

কথাটা দুম করে ইরতিজার হৃদয় ছেদ করে গেল। অস্থিরতা বাড়লো হৃদয়ের। এই কথার জবাবে কী বলা উচিত বুঝতে পারছে না। ছেলেটা এমন সব কথা বলে তার মুখের ভাষা কেড়ে নেয় কেন? হৃৎস্পন্দনের গতি স্বাভাবিক থেকে আংশিক দ্রুত সম্পন্ন হলো।

ক্যানিয়ল মোবাইলের ফ্ল্যাশলাইট ফেলে তার পাশে থাকা সাইকেলটা দেখিয়ে বললো,
“নতুন সাইকেল। তোমার জন্য আমি আমার সাইকেল হারিয়েছিলাম। তাই নতুন একটা কিনেছি। ভেবো না তোমার মতো ছিঁচকাঁদুনে মেয়েকে এই সাইকেলে উঠতে দেবো। এই সাইকেল ভীষণ স্পেশাল।”

“তো এই স্পেশাল সাইকেলে কাকে উঠাবে?”

“কারো প্রয়োজন পড়বে না, একাই চড়বো এই সাইকেলে।”

“একা চড়লে দুষ্টু মেয়ে জিনদের নজর পড়বে তোমার উপর। সাইকেলের পিছনে বসে কখন যে তারা তোমাকে জড়িয়ে ধরবে টেরও পাবে না।”

“তবুও তোমাকে চড়তে দেবো না। জিনদের আলিঙ্গন তো তাও শান্তিদায়ক হবে, কারণ জড়িয়ে ধরলে টের পাবো না। কিন্তু ছিঁচকাঁদুনে মেয়ে জড়িয়ে ধরলে তো আমার পিঠ নাকের জল আর চোখের জল দুটো দিয়েই ভিজিয়ে দেবে। ওটা ভীষণ বিরক্তিকর হবে।”

“তাহলে কি নাকের জল আর চোখের জল দিয়ে তোমার বুক ভিজিয়ে দিলে স্বস্তিদায়ক হবে তোমার জন্য?”

ইরতিজার কথায় ভীষণ অপ্রস্তুত এবং ভীষণ রকম চমকালো ক্যানিয়ল। এই ছেলেটাও এরকম চমকাতে পারে এটা আশ্চর্যকর! কিন্তু মেয়েটা তাকে চমকেই দিয়েছে।
ক্ষণিক বাদে ইরতিজা নিজেও বুঝতে পারলো সে কেমন বিব্রতকর একটা কথা বলে ফেলেছে। সে তটস্থ কণ্ঠে বললো,
“আমি একবারও বলিনি আমি তোমার সাইকেলে চড়বো।”
বলেই সে দৌঁড়ে পালিয়ে এলো বারান্দা থেকে। ইশ, কী ভীষণ লজ্জাদায়ক একটা কথা বলে ফেলেছে! মুখ ফসকে এমন একটা কথা বেরিয়ে গেল কীভাবে? নিজের কাছেই নিজের লজ্জিত লাগছে। ক্যানিয়ল কী ভাবছে তাকে? রিংটোনের শব্দে হঠাৎ ইরতিজার অবচেতন মন কেঁপে উঠলো। ফোন হাতে নিয়ে আবারও দেখতে পেল ক্যানিয়লের নাম। রিসিভ করে মৃদু কম্পমান ধ্বনিতে বললো,
“হ্যালো!”

“তোমার কি মানসিক সমস্যা আছে পাকিস্টানি গার্ল? পাগলের মতো ওরকমভাবে দৌঁড়ে চলে গেলে কেন? এক্ষুনি বারান্দায় এসো আবার।”

“কেন? পারবো না। আমি ঘুমাবো। তুমিও গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো। রাত-বিরাতে বাইরে ঘোরাঘুরি করো কেন এত?”

“তোমার কি ভয় হয় আমাকে নিয়ে?”

“কীসের ভয়?”

“রাত-বিরাতে বাইরে ঘুরে বেড়ালে যদি কোনো সুন্দরী মেয়ে জিন আমার প্রেমে পড়ে যায়, সেই ভয়।”

“তারা প্রেমে পড়ে গেলে তুমিও কি প্রেমে পড়বে?”

“পড়তেও তো পারি।”

“আসছি আমি।”

ইরতিজা ক্যানিয়লের কথা মতো বারান্দায় এলো আবার। ক্যানিয়ল বললো,
“তুমি কি ভালো ক্যাচ ধরতে জানো পাকিস্টানি গার্ল?”

“কেন?”

“কারণ আমি কিছু ছুঁড়ে মারবো তোমার দিকে।”

“কী ছুঁড়ে মারবে?”

“সেটা ক্যাচ ধরার পরই দেখতে পাবে।” ক্যানিয়ল একটু এগিয়ে আসলো।

ইরতিজা হাতের মোবাইলটা বারান্দায় থাকা চেয়ারটার উপর রেখে সোজা হয়ে দাঁড়ালো কেবল। এর মধ্যেই একটা ক্যামেরা ছুঁড়ে দিলো ক্যানিয়ল। ইরতিজা অপ্রস্তুত হলেও দুই হাত দিয়ে সামলে নিলো ক্যামেরাটা।
মোবাইলটা উঠিয়ে কানে ধরলো আবার।

ক্যানিয়ল বললো,
“নাও গরিব মেয়ে, তোমার ওই সুন্দর ছবি ওঠা মোবাইলটার থেকে নিশ্চয়ই এই ক্যামেরাটায় ভালো ছবি উঠবে।”

ক্যানিয়লের কথা শুনে ইরতিজার ক্যানিয়লের সাথে তার প্রথম দেখা হওয়া দিনটার কথা মনে পড়ে গেল। সেদিন ইরতিজা যখন নিজের মোবাইলটার জন্য ব্যথিত হৃদয়ের ভাব প্রকাশ করছিল, তখন ক্যানিয়ল তার একটা কথা শুনে বলেছিল,
‘মোবাইলের ক্যামেরা দিয়ে ফটো তোলো তুমি? কেন? তুমি এতটাই গরিব যে তোমার একটা আলাদা ক্যামেরা কেনার ডলার নেই?’

ইরতিজার মনে হলো ক্যানিয়ল যেন ওই ঘটনাটার জন্যই তাকে এই ক্যামেরাটা দিয়েছে। কিন্তু এই ক্যামেরাটা তো তার গ্রহণ করা উচিত নয়। পারবে না সে এই ক্যামেরাটা গ্রহণ করতে। ইরতিজা ক্যানিয়লকে কিছু বলতে যাবে, কিন্তু চোখ তুলে তাকাতেই দেখলো ক্যানিয়ল যে জায়গাটায় দাঁড়িয়ে ছিল সেখানে আর নেই। দূরে তাকিয়ে দেখলো ক্যানিয়ল চলে যাচ্ছে। ফোনটা হাতে এনে দেখলো লাইনেও নেই ক্যানিয়ল। ইরতিজা ডাকতে যাচ্ছিল ক্যানিয়লকে, কিন্তু এত রাতে উচ্চ কণ্ঠে ডাকতে গেলে বাসার মানুষের ঘুম ভেঙে যেতে পারে।
ক্যানিয়ল একটু সময়ের ব্যবধানেই চোখের আড়াল হয়ে গেল।
ইরতিজা ক্যামেরাটার দিকে তাকিয়ে দেখলো ক্যামেরাটার সাথে একটা ক্ষুদ্র কাগজ ঝুলছে। আর তাতে কিছু লেখা।

‘এই ক্যামেরা দিয়ে কোনো ছেলের ফটো তোলার চেষ্টা করবে না, খবরদার! আমি তাহলে এই ক্যামেরা আবার নিয়ে যাব। সব রকম ছেলে নিষিদ্ধ এই ক্যামেরার জন্য।’

ইরতিজা লেখাটা পড়ে হেসে ফেললো। আনমনে বললো,
“তুমিও কি নিষিদ্ধ?”

_______________

দখিনা হাওয়ায় সাজিদের চুলগুলো উড়ছে। খোলা জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছে অদূরে। বিকেলের নরম রোদ এসে ছুঁয়েছে তার মুখ। মনের গহীন প্রান্তরে ইরতিজার ভাবনাখানি পরশ বুলাচ্ছে কোমল আবেশে। গতকাল যখন ইরতিজা নওরিনের ফোনটা রিসিভ করেছিল, আর সে যখন ইরতিজার সাথে গমগমে কণ্ঠে ওই কথাটা বলেছিল তারপর থেকেই হৃদয়ে কেমন যেন এক অনুভূতি হচ্ছে। নিভৃতে অনুভূতিটা তাকে খুব জ্বালাতন করছে। ইরতিজার প্রতি তার একটা রাগান্বিত মনোভাব ছিল। কিন্তু কালকের পর থেকেই নেই। সে ভাবছে, মেয়েটা এমন কেন? রাগ পুষে রাখা যায় না কেন মেয়েটার প্রতি? না, আর এরকম করে থাকা সম্ভব নয় তার পক্ষে। সে বেড সাইড টেবিলের উপর থাকা মোবাইলটার দিকে তাকালো। ভুল হবে এমনভাবে দুই পাশে মাথা নেড়ে বললো,
“উহুঁ না।”

বলেই ঝট করে উঠে দাঁড়ালো। কিচেনে গিয়ে কফির মগটা রেখে আবার এসে ঢুকলো বেডরুমে। রেডি হলো ঝটপট। গাড়ির চাবি নিয়ে বেরিয়ে পড়লো এপার্টমেন্ট থেকে।

তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। ইরতিজা নিজের রুমে বসে বই পড়ছিল। দরজার গায়ে টোকা দিয়ে কেউ ইরতিজার মন আকর্ষণ করলো। ইরতিজা তাকিয়ে দেখলো রিশন দাঁড়িয়ে আছে। ইরতিজা বললো,
“কোনো প্রয়োজন?”

“তোমার সাথে একজন দেখা করার জন্য এসেছে, আর তুমি রুমে ঢুকে বসে আছো? ব্রাইট স্টুডেন্টদের মতো আবার বইও পড়ছো?”

রিশনের কথায় আহত হলো ইরতিজা। সে স্টুডেন্ট হিসাবে ভালোই বলা চলে। অথচ রিশন যেন তাকে তুচ্ছজ্ঞান করে কথা বলেছে। যাই হোক, এ নিয়ে কিছু বললো না সে।

“কে দেখা করতে এসেছে? আমি তো জানি না!”

“বাসা থেকে বের হলেই তাকে দেখতে পাবে। তোমাকে খবরটা জানাতে এসে আমার প্রায় কয়েক মিনিট সময় নষ্ট হয়ে গেছে। এতক্ষণে আমি একটা ভিডিয়ো এডিটের কাজ করতে পারতাম।”

রিশন চলে গেল এটুকু বলে। ইরতিজা মনে মনে বিস্ময়ান্বিত। কে এসেছে তার সাথে দেখা করতে? ইরতিজা বিছানা থেকে নামলো। একটা কালো কোট গায়ে দিয়ে বের হলো বাসা থেকে।
কিন্তু কাউকেই দেখতে পেল না। আশ্চর্য! রিশন কি তার সাথে মজা করলো?
চোখ হঠাৎ পার্কিং সাইডে গিয়ে পড়তেই দেখলো পার্ক করে রাখা গাড়ির ওখানে কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে। পার্কিং সাইডটা অনেকটা দূরবর্তী হওয়ায় মানুষটা কে তা বুঝতে সমস্যা হলো। এছাড়া প্রকৃতিতে অন্ধকারের পসরা বসতে শুরু করেছে ইতোমধ্য। ইরতিজা কিছুক্ষণ দেখার পর বুঝতে পারলো ওটা সাজিদ। বিস্ময়ে তরান্বিত হলো সে। সাজিদ? কী করে সম্ভব? ভ্রম হচ্ছে তার? ইরতিজা দুই-তিনবার চোখের পলক ফেলে আবার তাকালো। এখনও দেখা যাচ্ছে ওখানে সাজিদ দাঁড়িয়ে আছে। ইরতিজা এগিয়ে গেল।

সাজিদ দেখতে পাচ্ছে তার প্রতীক্ষিত মানুষটি তার কাছে আসছে। আরও আগেই দেখা হয়ে যেত মানুষটির সাথে। কিন্তু এপার্টমেন্ট থেকে বের হওয়ার পর হঠাৎ এক অফিস সিনিয়রের কল এসেছিল। এরপর তাকে সেই অফিস সিনিয়রের বাসায় যেতে হয়েছিল। অফিস সিনিয়র নিজের একটা ব্যক্তিগত কাজ তার উপর চাপিয়ে দিয়েছে। কাজটা এমন, অফিস সিনিয়রের দেওয়া একটা বক্স ওয়াশিংটন ডিসি গিয়ে নির্দিষ্ট একটা স্থানে দিয়ে আসতে হবে। এগুলোকে উড়ে এসে জুড়ে বসা কাজ বলা যায়। তো সিনিয়রের ওখান থেকে বের হতে হতে দেরি হয়ে গেছে।
ইরতিজা সাজিদের সামনে এসে দণ্ডায়মান হয়ে বললো,
“আপনি? এই সময় এখানে কী করছেন?”

ইরতিজার কথার পর কয়েক সেকেন্ড চুপ কাটলো। তারপর সাজিদ অকস্মাৎ মোবাইলের ফ্ল্যাশলাইট অন করে তার আলো ফেললো ইরতিজার উপর। অন্ধকারে ইরতিজাকে ভালো করে দেখতে পাচ্ছে না বলে এমন করলো। ইরতিজা চোখ বুজে ফেলেছে। মুখের সামনে এক হাত দিয়ে আলোটাকে বাধা দিয়ে পিটপিট করে চোখ খুলে তাকালো।

“এটা কী করছেন?”

সাজিদ সাথে সাথে কিছু বললো না। সে আরও কয়েক সেকেন্ড নীরবতা পালন করে বললো,
“আপনার ঠোঁটের ক্ষত সেরেছে?”

সাজিদের এমন প্রশ্ন ইরতিজাকে বিস্মিত করলো। সে কিছু সময় তির্যক চোখে তাকিয়ে থাকার পর বললো,
“আমার ঠোঁটের ক্ষত সেরেছে কি না সেটা দেখতে এসেছেন আপনি?”

সাজিদ আলোটা সরাসরি ইরতিজার উপর না ধরে একটু নিচের দিকে নামিয়ে রাখলো। আর এতে ইরতিজা নিজের চোখের সামনে ধরে রাখা হাতটা সরিয়ে ফেলে সরাসরি তাকাতে পারলো সাজিদের দিকে। সাজিদ বললো,
“উহুঁ, আপনার ঠোঁট, চোখ, নাক, গাল, কপাল সবই দেখতে এসেছি। পুরো আপনাকেই দেখতে এসেছি আমি।”

ইরতিজা হতভম্ব হয়ে গেল। মানুষটা না তার উপর রাগান্বিত ছিল? কাল সে কল রিসিভ করেছে বুঝতে পেরে কেমন ভাবেই না কথা বললো। অথচ আজ…

“ভালো আছেন আপনি?” প্রশ্ন করলো সাজিদ।

“হ্যাঁ, আলহামদুলিল্লাহ। আপনি?”

“ভালো নেই!”

“কেন?” অবাক হয়ে জানতে চাইলো ইরতিজা।

“আমি চাইছি যথা শীঘ্রই আপনাকে বিয়ে করে নেবো।”

ইরতিজার দু চোখে ভয় ভর করলো। সচকিত হয়ে উঠেছে দু চোখের তারা।
“কী?” অবিশ্বাস্য ভঙ্গিতে কথাটা বললো ইরতিজা।

সাজিদ হেসে দিলো,
“ভয় পেয়েছেন?”

ইরতিজা থতমত খেলো। থতমত ভাবকে শীঘ্রই সামলে নিয়ে বললো,
“ভয় পাবো কেন? আমি তো আর আপনাকে বিয়ে করবো না। বা জোর করে আমাকে কেউ বিয়ে দিতেও পারবে না।”

সাজিদ শুধু একটুখানি হাসলো। তারপর গাড়ির ভিতরে ঢুকতে গিয়েও ঢুকলো না আবার। ইরতিজার দিকে ফিরে আবারও মোবাইলের আলো ফেললো ইরতিজার উপর।
ইরতিজার চোখ তাৎক্ষণিক বুজে গেল আলোর তান্ডবে। হাত দিয়ে আলোর পথে বাধা সৃষ্টি করলো সে। সাজিদ তন্মনস্ক হয়ে ইরতিজার দিকে তাকিয়ে বললো,
“যখন তুমি এসে আমার সামনে দাঁড়ালে, ওই সময়টায় আমার মন যে বাসনা পোষণ করেছিল তাতে আমি নিজেই ভীষণ লজ্জিত ছিলাম নিজের কাছে।”

ইরতিজা কৌতূহলপূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো।
সাজিদ অধরে মুচকি হাসির প্রজ্ঞাপন করে বললো,
“সেই সময় আমি নিজেকে বিনীত না রাখলে তোমার ক্ষত সেরে যাওয়া ঠোঁটে হয়তো আবারও পড়তো রক্ত চিহ্ন।”

সাজিদের কণ্ঠ ধ্বনিত মারাত্মক আখ্যানে ইরতিজার ওষ্ঠাধর বিভক্ত হলো একে অন্যের থেকে। দু চোখে বিস্ময়ের ঠিকরে পড়া উত্থান। বিস্ময়ের পাশাপাশি ভীতিপ্রদ ছায়াও অন্তরিন্দ্রিয় জ্ঞাপন হলো। সে নিস্পন্দ হয়ে তাকিয়ে আছে। কী বললো এইমাত্র সাজিদ?

(চলবে)

#উড়ো_পাতার_ঢেউ
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ৪৪
_________________

ইরতিজা ক্ষুব্ধ চৈতন্যে বাসার দিকে আসছে। রাগে কাঁপছে তার প্রতিটা কোষ। মাথার উপর সন্ধ্যার পাঁচমিশালি রং ছড়ানো আকাশ। বাতাস মৃদুমন্দ থেকে একটু বেশি বেগবান। ইরতিজার চুলগুলো উড়ছিল সেই বাতাসে। মুখে তার রাগের লেপন। আজাদ চৌধুরী দাঁড়িয়ে ছিলেন বাড়ির সম্মুখে। দূর থেকে সে সাজিদ আর ইরতিজাকে দেখছিলেন। ইরতিজা তার পাশ কাটিয়ে যাওয়া দিলেই তিনি বললেন,
“ছেলেটা এই সন্ধ্যাকালেও তোমায় দেখার জন্য ছুটে এসেছে। বুঝতে পারছো এখন, ছেলেটা কত ভালো?”

বাবার কথা শুনে দাঁড়ায় ইরতিজা। সন্ধ্যার আবছা আলোয় বাবার সরল মুখখানিতে তাকিয়ে কণ্ঠ রাগ ও বিরক্ত নিমজ্জিত করে বললো,
“ভালো না ছাই, খারাপের বাপ উনি। ওনাকে বিয়ে করা অসম্ভব। আমি ওনাকে কিছুতেই বিয়ে করবো না আব্বু।”
বলে দ্রুত পদে বাসার অন্দরে প্রবেশ করলো সে।

আজাদ চৌধুরী কিঞ্চিৎ অবাকপূর্ণ হয়ে মেয়ের গত পথে চেয়ে রইলেন। হঠাৎ এত রাগ, বিরক্তি কেন ইরতিজার মাঝে?

তখন সন্ধ্যার আবছা আলো কেটে গিয়ে গাঢ় কালো হয়েছে প্রকৃতি। কৃত্রিম আলোর বিভিন্ন উৎস জ্বলে উঠেছে শহরের বুকে। ইরতিজা সন্ধ্যার ঘটনাটা নিয়ে এখনও বেশ রাগান্বিত। রুমের ভিতর বসে সে সাজিদের বলা কথাটাকে ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করছিল, কিন্তু সম্ভব হচ্ছে না ভুলে যাওয়া।

নওরিন এখন অবসাদ সময় পার করছে। ঘটনাটা জানার পর সেই যে বিষণ্নতায় ধরলো, আর ছাড়ছে না তাকে। সে পিছনের লনে বসে ভাবছিল পরিবারকে জানিয়ে দেবে ঘটনাটা সম্পর্কে। কিন্তু কীভাবে বলবে বুঝতে পারছিল না। বুক ফেঁটে কান্না পাচ্ছিল তার। পরিবারের সদস্যদের থেকে সে আড়াল রাখছে নিজেকে। কারণ যে কেউ তাকে দেখলে প্রশ্ন করবে, তার কী হয়েছে? আর তখন তাকে পুরো বিষয়টা জানাতে হবে। কিন্তু এটা সে জানানোর জন্য প্রস্তুত নয়। শারমিন আহমেদ অবশ্য নওরিনকে একবার প্রশ্ন করেছিলেন,
“তোমার কি কিছু হয়েছে?”

নওরিন জবাবে কিছু হয়নি বলেছে। শারমিন আহমেদ বলে এড়িয়ে যেতে পেরেছে, কিন্তু বাবা হলে কিছুতেই পারতো না এটা। অবশ্যই কারণটা তখন জানাতে হতো।

শারমিন আহমেদ আজাদ চৌধুরীর জন্য গ্রিন টি দিয়ে লিভিং রুম হতে প্রস্থান করলেন। আজাদ চৌধুরী গ্রিন টি এর কাপটা হাতে তুলে নিলেন। অন্য হাতে সে কানে ফোন ধরে আছে। সাজিদকে কল করেছেন তিনি। কয়েক বার রিং হওয়ার পর ওপাশ থেকে কলটা রিসিভ হলো। সাজিদ সালাম দিলো,
“আসসালামু আলাইকুম আঙ্কল।”

টুকটাক বাক্যলাপ হলো আজাদ চৌধুরী আর সাজিদের মধ্যে। এরপর আজাদ চৌধুরী হঠাৎ জানতে চাইলেন,
“তুমি আমার মেয়েকে কী বলেছো সাজিদ?”

“কখন?”

“আজ সন্ধ্যায়।”

“আপনার মেয়ে কি আপনার কাছে নালিশ দিয়েছে কিছু? আমাকে বিয়ে করবে না এমন কিছু বলেছে?”

“হু। তোমার সাথে দেখা করার পর এত রেগে গেল কেন? কী বলেছো ওকে?”

“তেমন কিছু না আঙ্কল। বিয়ের পর আমাদের কয়টা বাচ্চা-কাচ্চা হবে সে ব্যাপারে ডিসকাস করছিলাম। ও বললো, একটা বেবিই যথেষ্ট। সেটা শুনে আমি বললাম, একটা? মিনিমাম দশটা বেবি তো প্রয়োজনই সংসারে। এটা শুনেই রেগে গেল। বললো, আমি না কি সুখী পরিবার পরিকল্পনা সম্পর্কে একেবারেই অজ্ঞ!”

সাজিদের কথায় শব্দ তুলে হাসলেন আজাদ চৌধুরী। হাসতে হাসতে বললেন,
“তোমার কথায় হাসবো, না লজ্জা পাবো আমি কনফিউজড হয়ে যাই সাজিদ। আমি তোমার হবু শ্বশুর সেটা কি মনে আছে তোমার?”

“হুম, মনে আছে আপনি আমার হবু শ্বশুর। তবে আপনার মেয়ে আমার হবু স্ত্রী এটা মাঝে মাঝে ভুলে যাই। মনে হয় ও হবু নয়, আমার বিয়ে করা স্ত্রী।”

আজাদ চৌধুরী আবারও হেসে উঠলেন। বললেন,
“মজা করার জন্য তুমি শ্বশুরকেই পেলে?”

“কী করবো? আপনার মেয়েকে তো পাওয়া যায় না!”

আজাদ চৌধুরী হাসি নিবারণের চেষ্টা করলেন। বললেন,
“এবার সত্যি করে বলো কী বলেছিলে যার কারণে ইরতিজা অত রেগে গিয়েছিল?”

“আপনার মেয়েকে রাগলেও ভীষণ সুন্দর লাগে আঙ্কল। আপনার মেয়ে এত সৌন্দর্য নিয়ে জন্মগ্রহণ কেন করেছে বলুন তো?”

“সৃষ্টিকর্তা চেয়েছেন তাই।” নমনীয়তার পরশ অনুভব করা গেল আজাদ চৌধুরীর কণ্ঠে।

“সৃষ্টিকর্তা কি এটাও চেয়েছেন, আমি আপনার মেয়ের সৌন্দর্যের গভীর প্রেমে পড়ি?”

আজাদ চৌধুরী থমকে গেলেন। এই প্রশ্নের উত্তর আদৌ কি সে দিতে পারবে? এবার সত্যি সত্যি গভীর লজ্জাবোধ করলেন তিনি। চাইছেন দ্রুত এই কথোপকথনের সমাপ্তি ঘটাতে। তাই বললেন,
“আচ্ছা ভালো থাকো সাজিদ, একটু কাজ আছে। সময় পেলে বেড়াতে এসো।”

“বেড়াতে আসলে যদি আপনার মেয়ে আমাকে মে’রে-টেরে বসে তখন?”

“তাহলে ও নিজেই ডক্টর হয়ে তোমার ট্রিটমেন্ট করবে। ফ্রি সময় পেলে এসো কিন্তু।”

সাজিদ দুই ওষ্ঠকোণ প্রশস্ত করলো হাসিতে।

_____________

১১:৩২ এএম। সামনের চমৎকার দৃশ্যটার দিকে তাকিয়ে আছে ইরতিজা। সে এখন অবস্থান করছে শপের ফিশ বিক্রিত স্থানে। এখানে দেখা যাচ্ছে একজন ফিশ সেলার অন্য এক ফিশ সেলারের দিকে একটি মাছ ছুঁড়ে দিচ্ছে। এবং সেই সেলার খুব দক্ষতার সাথে মাছটি ক্যাচ করে সেটি আবারও ছুঁড়ে দিচ্ছে অপর জনের কাছে। নিজেদের মধ্যে অনেকখানি দূরত্ব রেখে তারা এই কাজটা করছে। এটা মূলত আকর্ষণ বাড়ানোর একটা প্রক্রিয়া। অনেক মানুষ তাদের এই কাজটায় আকৃষ্ট হয়ে মুগ্ধ চিত্তে চেয়ে রয়েছে। কিছুক্ষণ দেখার পর সে চলে এলো ওখান থেকে। শপের গ্রোসারি এরিয়ার দিকে যেতে লাগলো। আজ সবাই একটু ব্যস্ত থাকার ফলে তাকে একাই আসতে হয়েছে শপে। শপ ঘুরে ঘুরে সে কিনলো মিষ্টি কুমড়া, ঢেঁড়শ, থানকুনি পাতা, কচু, কাঁচা আম ও লেবু। কাঁচা আম ও লেবুর দাম এখানে তুলনামূলক একটু বেশি। লেবুর দাম বেশি হলেও টমেটোটা আবার কম দামে পাওয়া যায়। ইরতিজা মিষ্টি আলুর কাছে এসে দাঁড়িয়ে ছিল। মিষ্টি আলু নেবে কি নেবে না ভাবছিল। এখানে দুই ধরনের মিষ্টি আলুই পাওয়া যাবে। সাদা এবং লাল। ইরতিজা একটা আলু হাতে নিয়ে দেখছিল, হঠাৎ একটা নারী কণ্ঠ তার পাশ থেকে বললো,
“তুমিই সেই মেয়ে? ইরটিজা?”

ইরতিজা চমকে উঠলো। চকিতে পাশ ফিরে তাকিয়ে যাকে দেখতে পেল তার জন্য সে একদমই প্রস্তুত ছিল না। সে বিস্ময় স্ফীত চোখে চেয়ে রইল। তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে একজন মহিলা। যার চেহারায় মায়া। দু চোখে সরলতা। ঠোঁটের কোণে সুমিষ্ট একটা হাসি ঝরছে। ঠোঁটের হাসির সাথে সাথে চোখের হাসিও উপেক্ষা করার মতো নয়। কমলা রঙা চোখ দুটো হাসছে নিজ মাধুর্য ছড়িয়ে। ইরতিজার মনে প্রশ্ন জাগলো সহসা, ক্যানিয়ল কি এই মহিলাটির কারণেই এত সুন্দর হয়েছে? কিন্তু চোখের রং ছাড়া চেহারায় তো মিল নেই দুজনের। অন্য মিল না থাকলেও যে কেউ দুজনের চোখ দেখলেই বোধহয় বলতে পারবে এই দুজনের রক্তের সম্পর্ক রয়েছে।

“তোমার নাম ইরটিজা, তাই না?” আবারও মিষ্টি কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন বেলা লিমাস।

ইরতিজা হতবিহ্বলের মতো মাথা নেড়ে সায় জানালো,
“ইয়েস, আই অ্যাম ইরতিজা।”

বেলা লিমাসের ঠোঁটের সুমিষ্ট হাসিটা আরও প্রশস্ত হলো। সে দুই হস্ত দ্বারা ইরতিজার কুসুমকোমল গাল দু খানি স্পর্শ করে মায়া ভরা চোখে বললো,
“কত সুন্দর তুমি! কত মিষ্টি!”

ইরতিজার বুক ধকধক করছিল। অস্বস্তিতে গাঁট হয়ে আসছিল কলেবর। হঠাৎ বেলা লিমাস তার সাথে কথা বলতে এসেছে কেন? আর তার নামই বা জানে কীভাবে? কিছু বুঝতে পারছিল না বা অনুধাবন করতে পারছিল না ইরতিজা। সে মনেপ্রাণে চাইছিল এখান হতে ছুটে পালাতে। কিন্তু বেলা লিমাস তাকে ছাড়লেনই না। সে ইরতিজাকে নিজের বাসায় নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করলেন। কিন্তু ইরতিজা যাওয়ার জন্য সহমত পোষণ করলো না। সে বললো, তার কাজ আছে।
কাজের কথা বলে বেলা লিমাসকে এড়ানো গেল না। যেতে না চেয়ে বেশি অমত করা বেয়াদবি হিসাবে গণ্য হতো। সে অতিরিক্ত বেয়াদবি কী করে করতে পারে ক্যানিয়লের মমের সাথে? একরাশ অস্বস্তির কাঁটা অন্তরে নিয়ে তাকে শেষমেশ আসতে হলো বেলা লিমাসের সাথে। বেলা লিমাস থাকেন একটা এপার্টমেন্টের পনেরো নাম্বার ইউনিটে।
ইরতিজা বেলা লিমাসের এপার্টমেন্টে যখন প্রবেশ করছিল তখন তার শরীর কাঁপছিল। মুখে সংশয়ের ছাপ তো সুস্পষ্ট। আড়ষ্ট ভঙ্গিতে তবুও সে পিছন পিছন এগিয়ে চললো বেলা লিমাসের সাথে। বেলা লিমাস ওকে লিভিংরুমের সোফায় বসার জন্য বললেন,
“দয়া করে এখানে বসো ডিয়ার।”

ইরতিজা বসলো। বেলা লিমাস হাসি হাসি মুখে চলে গেলেন কিচেনে। মহিলা পুরো সময়টিই হাসিখুশি ছিলেন। ইরতিজা আসলেই বুঝতে পারছে না কিছু। তাকে এখানে নিয়ে এলো কেন? তার হঠাৎ চিন্তাও হতে লাগলো। ক্যানিয়ল যদি জানে সে ওর মমের বাসায় এসেছে তাহলে? ইরতিজার হৃদয় ছ‍্যাত করে উঠলো ভয়ে। ক্যানিয়ল জানতে পারলে নিশ্চয়ই খুশি হবে না ব্যাপারটাতে। রাগারাগি করবে। ইরতিজার খুব চিন্তা হতে লাগলো বিষয়টি নিয়ে। এক ঝামেলার উপর কেন আরেক ঝামেলা পতিত হয় তার উপর?
বেশ কিছুটা সময় পরও এলেন না বেলা লিমাস। ইরতিজা একা একা বসে চুপচাপ বাসার উপর নজর বুলাচ্ছিল। বুঝতে পারছিল বেলা লিমাস খুব গোছানো গোছের মানুষ। টেবিলের উপর একটা ছোটো ফ্রেম বাঁধানো একটা ফটো দেখতে পেল ইরতিজা। ফটোটা একটা ছোটো বাচ্চার সাথে সুন্দরী এক যুবতীর হাস্যজ্জ্বল মুখের ছবি। ইরতিজা সহজেই চিনতে পারলো ছবির মানুষ দুজনকে। সুন্দরী যুবতীটা হলেন বেলা লিমাস, যে কি না এখনও দারুণ সুন্দর দেখতে। আর ছোটো যে কিউট বাচ্চাটাকে দেখা যাচ্ছে ওটা ক্যানিয়ল। ইরতিজা হাতে তুলে নিলো ফটোর ফ্রেমটা। ছোটো বেলায় কত সুন্দর দেখতে ছিল ক্যানিয়ল। তবে তার ধারণা ক্যানিয়ল যেন এখন আরও বেশি সুন্দর দেখতে হয়েছে। শুভ্র মুখ, লালচে দুটি ঠোঁট, কমলা রঙা আঁখি, কালো ভ্রু, কালো-বাদামির সংমিশ্রিত চুল।
ইরতিজার মনে হলো সে এ যাবৎ যত ছেলে দেখেছে তাদের সবার থেকে ক্যানিয়ল নিঃসন্দেহে বেশি সুন্দর।

বেলা লিমাস ফিরে এলেন লিভিং রুমে। ইরতিজা হাত থেকে ছবিটা নামিয়ে রাখলো টেবিলে। বেলা লিমাস টেবিলের উপর চিকেন নাগেট এবং তিনটি গ্লাসে তিন রকমের ভিন্ন পানীয় রাখলেন।
ইরতিজার খাবার দেখেই সংকোচ বোধ হলো। বেলা লিমাস ইরতিজার পাশের সোফাতে বসলেন। খাবারের দিকে ইঙ্গিত করে বললেন,
“দয়া করে উপভোগ করো।”

ইরতিজার কুণ্ঠাবোধ হওয়া সত্ত্বেও সে মুখে সৌজন্যস্বরূপ হাসি ফোঁটালো। সংকুচিত হাতে তুলে নিলো সবুজ দেখতে পানীয়র গ্লাসটি। এক চুমুক পান করলো। স্বাদ টক, মিষ্টি সংমিশ্রিত। ভালোই লাগলো ইরতিজার কাছে।
বেলা লিমাস বললেন,
“তোমাকে কেন আমি এখানে নিয়ে এলাম জানো?”

ইরতিজা জিজ্ঞাসু চোখে তাকালো।

“কারণ, তোমাকে আমার ভীষণ পছন্দ হয়েছে।”

ইরতিজার হঠাৎ লজ্জা বোধ হলো। লজ্জিত মুখে হাসলো একটু।

বেলা লিমাসও হাসলেন। অতঃপর বললেন,
“তুমি ক্যানিয়লের গার্লফ্রেন্ড নও, তবে ক্যানিয়ল তোমাকে পছন্দ করে, তাই তো?”

ইরতিজার লজ্জার মাত্রা বৃদ্ধি পেল। সাথে অস্বস্তিও। এমন এক প্রশ্ন কেন করলেন বেলা লিমাস? তিনি কি ক্যানিয়ল আর ওর ব্যাপারে জানেন সবকিছু? ইরতিজা ইতস্তত বোধ করছে। প্রশ্নের জবাবে তার সত্য না মিথ্যা বলা উচিত বুঝতে পারছে না। শেষ পর্যন্ত সত্যই বললো,
“হ্যাঁ।”

“তুমিও পছন্দ করো ওকে?”

ইরতিজা মাথা নাড়িয়ে সায় জানালো,
“হ্যাঁ।”
শব্দটা উচ্চারণ করতে গলার সাথে যুদ্ধ করতে হলো ইরতিজার।

বেলা লিমাস মৃদু হেসে জানালেন,
“তোমায় যখন প্রথম এন্ডারসন হাউজে দেখতে পেয়েছিলাম, ওই দিনই বুঝতে পেরেছিলাম ক্যানিয়লের বিশেষ দৃষ্টি আছে তোমার প্রতি। কারণ এন্ডারসন হাউজে তোমার উপস্থিতি ছিল বিস্ময়কর। আমি শুনেছি ও তোমাকে ট্রি হাউজেও নিয়ে গিয়েছিল, বেলভিউয়ের ট্রি হাউজেও নিয়ে গিয়েছিল। এমনকি তোমার কারণে একটা ছেলেকে খুব কঠিনভাবে মেরেছে। আমি মনে করি এগুলো সত্যিকার অর্থে পছন্দ করার নিদর্শন। আগে ক্যানিয়লের জীবনে তুমি ছিলে না। আগে ওর জীবন এখনকার জীবনের থেকে ভিন্ন ছিল। আমি মনে করি ওর আগেকার জীবনের থেকে এখনকার জীবন উন্নত। আর এই উন্নতির কারণ তুমি। ও নিজ থেকে তোমার সাথে মিশছে। তোমার প্রতি ওর আগ্রহ রয়েছে। এখান থেকে সহজেই বোঝা যায় তুমি ওর ভালো থাকার একটা মাধ্যম। কারণ মানুষ ভালো থাকার মাধ্যমকেই আগলে রাখে, আর…”

“আর খারাপ থাকার মাধ্যমকে বর্জন করে।” বেলা লিমাসের মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে বললো ইরতিজা।
“ক্যানিয়লকে কেন আপনি বর্জন করেছেন? ও আপনার খারাপ থাকার মাধ্যম ছিল?”

অকস্মাৎ এই প্রশ্নে বেলা লিমাস থমকে গেলেন। তার হৃদয় মরুভূমির বালুকণা হঠাৎ কাঁপতে শুরু করলো দুর্বার গতিতে। স্বচ্ছ চোখে হঠাৎ নেমে এলো আবছায়া।

ইরতিজা বললো,
“আমি জানি আমি ওর ভালো থাকার মাধ্যমের ভিতর একটি। আমি জানি আমি ওর সত্যিকার পছন্দ। সবকিছু জানি আমি। শুধু জানি না যে ব্যাপারটা ওর কষ্টের কারণ সেটা ঘটার কারণ কী! কেন আপনি ওকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন? কী কারণ এটার?”

সত্যিটা জানার এটাই সুন্দর একটি সুযোগ মনে হলো ইরতিজার। কেন বেলা লিমাস ক্যানিয়লকে ছেড়ে এসেছিল এই কারণটা ক্যানিয়লেরও জানা নেই। ইরতিজার এই মুহূর্তে কারণটা জানার আগ্রহ প্রবল। কিছুক্ষণ আগের কুণ্ঠাবোধ তাই আর প্রভাব ফেলছে না তার মাঝে।

বেলা লিমাসের ভিতর ব্যথারা চিনচিন করছে। দু চোখের তারায় ভাসছে জল। তার হৃদয় তিক্ত করে তুলছে অজস্র কষ্টের হাতছানি। ওই হাতছানিতে ধীরে ধীরে তলিয়ে যাচ্ছে সে।

_______________

ইরতিজা বেলা লিমাসের এপার্টমেন্ট থেকে বের হলো দুর্বল পা নিয়ে। সারা শরীর অসাড় হয়ে আসছে যেন তার। ক্লান্তি আলিঙ্গন করে রেখেছে। মাথা ঘুরছে তার। ঘামছে অস্বাভাবিক রকম। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে এতক্ষণে। ঢোক গিলে ভিজিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলেও ব্যর্থতা পাচ্ছে কুড়িয়ে। মাথার ভিতরে একই বিষয়ের ভনভন শুধু। এটা কী শুনলো সে? কেন শুনলো? কেন বললো বেলা লিমাস এটা তাকে? ইরতিজার বুক ফেঁটে কান্না পাচ্ছে। তবুও কষ্ট করে সে চোখে জল ধরে রাখলো। ক্যানিয়ল কথাটা জানার পর কী হবে? ক্যানিয়লের কথা চিন্তা করে দু চোখ বেয়ে অশ্রু নামলো বাধা নিষেধ না মেনে।

(চলবে)

#উড়ো_পাতার_ঢেউ
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ৪৫
_________________

ক্লান্ত শরীরখানা কোনো রকম চালিত করে এপার্টমেন্ট এরিয়া থেকে বের হলো ইরতিজা। তার হাতে সবজির ব্যাগ ঝুলছে। ঘাম ঝরে পড়ছে হিজাবের নিচ থেকে। মনে হচ্ছে ব্যাপারটা জানার চেয়ে না জানা শ্রেয় ছিল তার জন্য। এপার্টমেন্ট এরিয়া থেকে খানিকটা দূরে চলে আসলে হঠাৎ ক্যানিয়লের সাথে দেখা হয়ে গেল।
ক্যানিয়ল ইরতিজাকে দেখতে পেয়ে গাড়ি থামালো ক্ষণ সময়ের জন্য। ইরতিজা ক্যানিয়লকে দেখতে পায়নি। সে আগের ন্যায় হেঁটে যাচ্ছিল। ক্যানিয়ল ডাকলো,
“হেই পাকিস্টানি গার্ল!”

ডাক কানে এলে দাঁড়ালো ইরতিজা। পিছন ঘুরে তাকিয়ে দেখতে পেল ক্যানিয়লকে। ক্যানিয়ল বললো,
“এখানে কী করছো তুমি?”

এই সময়ে ক্যানিয়লকে দেখতে পেয়ে ভীষণ কষ্ট অনুভব করলো ইরতিজা। বুক মুচড়ে কান্না বেরিয়ে আসার প্রস্তুতি নেওয়ার কার্যক্রম শুরু হলো। কিন্তু তবুও সে এটা দমিয়ে রাখতে চেষ্টার হাল ছাড়লো না। শেষমেশ নিজের অশ্রু সংযত রাখতে সক্ষম হলো। বললো,
“কিছু না, জাস্ট যাচ্ছিলাম এখান থেকে। ওই যে ওখানে একটা শপ আছে, সেটা দিয়ে কেনাকাটা করলাম।”

ক্যানিয়ল ইরতিজার হাতের ব্যাগটায় তাকালো। হ্যাঁ, এখান থেকে কিছুটা দূরে একটা শপ আছে। ইরতিজা মূলত সেই শপ দিয়ে কেনেনি। কিন্তু জানে ওদিকে একটা শপ আছে, তাই ওই শপের নামটাই ব্যবহার করলো অতিরিক্ত বাক্যালাপ থেকে বিরত থাকতে।

ক্যানিয়ল বললো,
“এসো তোমাকে বাসায় নামিয়ে দিচ্ছি।”

“দরকার নেই। আমি চলে যেতে পারবো।”
বলে পা’টা সামনে বাড়ালো, অমনি ক্যানিয়লের গম্ভীর কণ্ঠ বলে উঠলো,
“আর এক পা সামনে বাড়ালে তোমার পা কা’টা যাবে মেয়ে! সুতরাং সামনে এগিয়ো না আর, পিছিয়ে এসো। গাড়িতে ওঠো এবং বসো আমার পাশে।”

ইরতিজা অবসন্ন চোখে চাইলো। মাথাটা ঝিমঝিম করছে। চোখের দৃষ্টি ঝাপসা ঝাপসা মনে হচ্ছে কেমন। এখান থেকে আর একটুকুনি হেঁটে যাওয়ার শক্তিও বোধহয় তার মাঝে জমাকৃত নেই। সে ক্যানিয়লের কথা মতো গাড়িতে উঠে বসলো। দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে চুপচাপ বসার পর অনুভব করলো তার শরীর আসলেই খুব খারাপ হয়ে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। সারা শরীর নিসাড় হয়ে আসছে। ক্যানিয়ল ইরতিজার দিকে তাকিয়ে বললো,
“এরকম লাগছে কেন তোমাকে?”

“কী রকম লাগছে?” ক্যানিয়লের দিকে তাকালো ইরতিজা।

“অস্বাভাবিক লাগছে। তুমি কি অসুস্থ?”

“না।”

“তাহলে এরকম লাগছে কেন?”
ক্যানিয়ল নড়েচড়ে উঠলো,
“এই, তোমাকে কেউ কিছু বলেছে? বেলিকের বাসা তো এদিকেই। ওর সাথে দেখা হয়েছিল? ও কিছু বলেছে?”

ইরতিজার বন্ধ চোখের কোল বেয়ে পরাপর দুটো জলধারা নেমে গেল। অকস্মাৎ কেঁদে উঠলো সে। কান্না জড়ানো কণ্ঠে বললো,
“কেউ কিছু বলেনি। তুমি প্লিজ, বাসায় নিয়ে চলো তাড়াতাড়ি।”

বলে একনাগাড়ে কাঁদতে থাকলো। হৃদয়ে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। সবচেয়ে বেশি কষ্টটা হচ্ছে ক্যানিয়লের জন্য। ছেলেটা যখন সবকিছু জানবে তখন কী হবে? নিশ্চয়ই খুব কাঁদবে! এতটা কষ্ট হবে তখন ছেলেটার হৃদয়ে, মনে হবে যেন হৃদয় ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছে। এমন অনুভূতিই হবে না ওই সময় ছেলেটার? হুম, এমনই অনুভব করবে সে। হয়তো এর থেকেও বেশি হৃদয়বিদারক যন্ত্রণা পাবে।
ইরতিজাকে কাঁদতে দেখে দিগভ্রান্ত হয়ে পড়লো ক্যানিয়ল। দু চোখে বিস্ময় এবং উদ্বিগ্নতার আঁধার নেমে এলো। সে ব্যতিব্যস্ত কণ্ঠে শুধালো,
“হেই ইজা, তুমি কি অসুস্থ বোধ করছো? হসপিটালে নিয়ে যাব তোমাকে?”

ইরতিজা এখনও কাঁদছে। চোখ জোড়া মুদিত। কাঁদতে কাঁদতে জানালো,
“বাসায় নিয়ে চলো। শুধু বাসায় পৌঁছে দিলেই হবে।”

ক্যানিয়ল বুঝতে পারছে না কিছু। হঠাৎ করে ইরতিজা কাঁদতে শুরু করলো কেন? অসুস্থ বোধ করছে বলে কাঁদছে? হুম, ইরতিজার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে অসুস্থ। ক্যানিয়ল গাড়ি স্টার্ট দিলো দ্রুত।
গাড়ি এসে থামলো একেবারে ইরতিজার বাসার সামনে। ইরতিজা নামার আগে দু চোখ ভরে দেখলো ক্যানিয়লকে। এই ছেলেটার চোখ দিয়ে বৃষ্টি ঝরবে! পারবে না সে সেই করুণ বৃষ্টিপাতের দৃশ্য দেখতে। হৃদয়ে ভীষণ ব্যথা হবে ওই অশ্রুআঁখি দেখে। ইরতিজার শুকিয়ে যাওয়া চোখের কোণে আবারও অশ্রু জমলো। ক্যানিয়ল বললো,
“আমার সুন্দর মুখে এত কি খুঁত খুঁজছো তুমি?”

ইরতিজা গভীর চোখে চেয়ে থেকে বললো,
“এই মুহূর্তে কোনো খুঁত নেই তোমার এই সুন্দর মুখে। খুঁত তো তখনই দৃশ্যমান হবে, যখন তোমার আঁখিতে বর্ষা নামবে। আমার মনে হয় না ওই খুঁতটার চেয়ে আর কোনো খুঁত বেশি মারাত্মক হবে তোমার এই সুন্দর মুখটির জন্য।”

“কিন্তু আমি তো জানতাম মানুষ কাঁদলে তাকে আরও বেশি সুন্দর লাগে।”

“সকল কান্নায় সৌন্দর্য প্রকাশিত হয় না, অনেক কান্নায় কেবল হৃদয়ের চূর্ণিত দশা প্রকাশ পায়।”

“এমন কান্না আমার চোখে নামবে কেন?”

“কান্নারা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে তাই!”

ক্যানিয়ল কিছু বুঝতে পারলো না। স্তব্ধ নয়নে তাকিয়ে রইল ইরতিজার পানে। হঠাৎ ইরতিজার এমন ভারী ভারী কথা বলার মানে আদৌ বুঝতে সক্ষম হলো না তার মন।
ইরতিজা নেমে গেল গাড়ি থেকে। শরীরের দুর্বলতা স্থির। কোনো নড়চড় হচ্ছে না এই দুর্বলতার। ইরতিজা ব্যাগটা শক্ত করে আঁকড়ে ধরে এগিয়ে যাচ্ছিল ঘরের দিকে। এমন সময় ক্যানিয়ল অকস্মাৎ গাড়ির জানালা দিয়ে মাথা বের করে বলে উঠলো,
“আমি কান্না করলে তোমার আমার মাথায় হাত রাখার কথা ছিল ইজা। হতে পারে আমার কান্না সৌন্দর্য প্রকাশ করবে না, কিন্তু আমি কান্নারত থাকাকালীন আমার মাথায় এক ছিঁচকাঁদুনে মেয়ের সান্ত্বনার হাত নিশ্চয়ই পৃথিবীর অন্যতম এক সৌন্দর্যের প্রকাশ ঘটাবে।”

ক্যানিয়লের কথাগুলো ইরতিজার হৃৎমাঝার বরাবর এসে আঘাত হানলো। যে আঘাতে হৃদয় কাঁপলো। সৃষ্টি হলো গভীর অনুভূতির। অতলস্পর্শীয় এই অনুভূতি বিজ্ঞাপিত হয় না বাইরে, শুধু হৃদয় অতলে নিজ বার্তা ছড়াতে থাকে গোপনে।

_________________

নওরিনের ঘরের কোণে অন্ধকার জমতে শুরু করেছে। আলো-আঁধারি পরিবেশে সে বসে আছে ফোন হাতে। হামাদের কাছে কল দিতেও ঘৃণা হচ্ছে তার। ছেলেটা তাকে ঠকানোর সাহস করে কীভাবে? কদিন হলো হামাদ তাকে কল দেয় না? কল না দিয়ে পারে কী করে ছেলেটা? রাগে নওরিনের প্রতিটা লোম জাগ্রত হয়ে উঠছে। আজ তাকে কল দিয়ে কিছু বলতেই হবে হামাদকে। নওরিন আর ইতিউতি না করে দ্রুত কল দিলো হামাদের কাছে। কিন্তু হামাদের ফোন বন্ধ পেল। কী পরিমাণ রাগ যে লাগলো নওরিনের! ইচ্ছা হলো রাগে চিৎকার করে গলা ফাটিয়ে। কিন্তু সে নিজের রাগকে ধাতস্থ করলো। আস্তে আস্তে ঘন অন্ধকারে তলিয়ে গেল রুম। পুরো বাসাই অন্ধকারে তলানো। আজাদ চৌধুরী আর শারমিন আহমেদ বাসায় নেই। তারা বিকেলেই নিউ ইয়র্কের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে। নিউ ইয়র্কে জরুরি একটা কাজ পড়ে যাওয়ায় তাদের যেতে হয়েছে সেখানে। বাড়িতে কেবল সে আর ইরতিজা আছে। ইরতিজার আবার শরীরটা ভালো না। দুপুরে মার্কেট থেকে আসার পর থেকেই সে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। আজাদ চৌধুরী ওষুধপত্র সব গুছিয়ে দিয়ে গিয়েছেন। ইরতিজা রেস্ট নিলে আর ওষুধ খেলেই সুস্থ হয়ে যাবে বলেছেন। আর ইরতিজার প্রতি নওরিনকে যত্ন নিতে বলেছেন তিনি।
নওরিন রুম থেকে বের হয়ে বাসায় আলো জ্বালালো। এরপর কিচেনে এলো ইরতিজা এবং নিজের জন্য দুই গ্লাস কাঁচা আমের শরবত বানাতে। বানাতে বেশি সময় লাগলো না। বানানো হলে তা নিয়ে ইরতিজার রুমে এলো। ইরতিজার রুম অন্ধকার। বোর্ড হাতড়ে আলো জ্বালালো। প্রথমেই বিছানায় নজর পড়লো। যা দেখলো তাতে সে ভয় পেয়ে গেল প্রথমে। দেখলো ইরতিজা বেডের উপর বসা অবস্থায় পাশের দিকে কেমন মুষড়ে পড়ে আছে। সম্ভবত বেডে হেলান দিয়ে বসা ছিল ও। এক দেখায়ই বোঝা যাচ্ছে ইরতিজা সজ্ঞানে নেই, অবচেতন!
নওরিন জুসের গ্লাস টেবিলে রেখে দৌড়ে এলো ইরতিজার কাছে। ইরতিজাকে নাড়া দিয়ে ডাকলো,
“ইরতিজা!”

ইরতিজা সাড়া শব্দহীন। নওরিন লক্ষ করলো ইরতিজার সারা শরীর ঘর্মাক্ত। এই শীতের মাঝেও মেয়েটা ঘেমে নেয়ে একাকার। গায়ের ধূসর গেঞ্জিটা ঘামে ভিজেছে। অনেকক্ষণ ডাকাডাকির পরও ইরতিজা যখন চেতনায় ফিরলো না তখন নওরিনের মনে ভয় কামড় দিলো। দিশেহারা হয়ে গেল সে। কী করবে না করবে কিছু বুঝতে পারলো না। মা-বাবাও বাড়িতে নেই! নওরিন চাচাদের বাসায় ছুটে গেল। দরজার বাইরে দাঁড়িয়েই ডেকে বলতে লাগলো ইরতিজার অবস্থা সম্পর্কে। রিশন পড়ার টেবিলে ছিল, নওরিনের ডাক শুনতে পেয়েই সবার আগে ছুটে এলো সে। নওরিনের সাথে কিছু না বলেই সে ওদের বাসায় প্রবেশ করলো। নওরিনও রিশনের পিছন পিছন ছুটে এলো।
ইরতিজার রুমে প্রবেশ করে দেখলো ইরতিজা অবচেতন হয়ে আছে। রিশনও ডাকাডাকি করলো। ততক্ষণে জুহি আর চাচিও এসে পড়েছে। জুহি তো আতঁকে উঠলো পুরো ঘটনা প্রত্যক্ষ করে। সে এগিয়ে এলো ইরতিজার কাছে। ইরতিজার মুখে দুই হাতের স্পর্শ বুলিয়ে বললো,
“টিজা, কী হয়েছে তোমার? চোখ খোলো। কী হয়েছে? ওঠো। এই ওঠো।”

রিশন বোনকে ঠেলে দূরে সরিয়ে দিলো। বিরক্ত চাহনি দিয়ে বললো,
“এরকম করলে ও জেগে উঠবে না, ওকে হসপিটালে নিতে হবে। সো আদিখ্যেতা বন্ধ করো।”

রিশন আর কারো কোনো কথা শোনার তোয়াক্কা না করে ইরতিজাকে পাঁজাকোলে তুলে নিলো। এরপর বাইরে বের হয়ে ইরতিজাকে গাড়ির ব্যাক সিটে শুইয়ে দিলো। রিশনের পাশের সিটে জুহি উঠে বসা দিলেই রিশন বললো,
“এ স্থান তোমার জন্য নয়, নওরিনের জন্য। অন্য গাড়িতে এসো তুমি। আর নয়তো হেঁটে এসো।”

ইরতিজাকে হাসপাতালে এডমিট করা হয়েছে। বেশ কিছুক্ষণ হয়েছে তারা হাসপাতালে আছে। এতক্ষণে আজাদ চৌধুরীকে জানানো হয়েছে ঘটনাটা সম্পর্কে। শোনার পরই আজাদ চৌধুরী উতলা হয়ে উঠলেন। পারলে এখনই ওয়াশিংটন চলে আসেন এমন উদ্বিগ্নতা তার মাঝে। কিন্তু এখনই তো রওনা দেওয়া সম্ভব নয়। সে সকলের সাথে কথা বলে ফোন রাখলেন। শুধু ইরতিজার সাথে কথা বললেন না। ইরতিজার সাথে কথা বলার জন্য এটাকে উপযুক্ত সময় হিসাবে মনে হলো না তার। ইরতিজা আগে খানিক সুস্থ হয়ে উঠুক তারপর তিনি কথা বলবেন।
রিশন আবার এর মাঝে একটা কাণ্ড ঘটিয়েছে। সে ক্যানিয়ল আর সাজিদকে কল করে জানিয়েছে ইরতিজা অসুস্থ এবং হাসপাতালে ভর্তি আছে। খবরটা শুনে দুজনই বেশ উতলা হয়ে উঠেছে। এমনকি কথা বলার সময় তাদের প্রস্তুতি এমন মনে হলো যে তারা এখনই ছুটে আসবে হয়তো হাসপাতালে। রিশনও সেটাই দেখতে চাইছে, কে আগে আসবে ছুটে। যে আগে আসবে সে নিশ্চয়ই ইরতিজাকে বেশি ভালোবাসে। তাছাড়া সে সামনাসামনি দেখতে চাইছে ইরতিজার প্রতি কার ব্যবহার কেমন হবে এই মুহূর্তে। ইরতিজার সাথে কি ক্যানিয়লের আসলেই তেমন কোনো সম্পর্ক আছে? সবই আজ সামনাসামনি দেখতে চাইছে সে।
ক্যানিয়ল আর সাজিদ দুজন মুখোমুখি হয়ে কী করবে সেটাও দেখতে চাইছে! উত্তেজনায় ভিতরটা কাঁপছে রিশনের। এই পুরো সময়টা যদি সে ক্যামেরাবন্দি করে রাখতে পারতো খুব ভালো হতো।

(চলবে)