#উড়ো_পাতার_ঢেউ
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ৪৬
_________________
হাসপাতালে প্রথমে এসে পৌঁছলো ক্যানিয়ল। রিশন ধারণা করে নিলো ক্যানিয়ল ইরতিজাকে বেশি ভালোবাসে। কিন্তু তার এই ধারণা দীর্ঘক্ষণ বিচরণের সুযোগ পেল না। কারণ হিসেব মোতাবেক ক্যানিয়লেরই আগে পৌঁছনোর কথা। ক্যানিয়ল রেডমন্ডের বাসিন্দা। এখানে আসা তার জন্য অল্প কিছু সময়ের ব্যাপার। অন্যদিকে সাজিদ থাকে সিয়াটল। এছাড়া সাজিদের অফিসও আছে। সবকিছু ম্যানেজ করে আসতে সাজিদের সময় লাগবে এটাই স্বাভাবিক। তো এটা দিয়ে সে ঠিক বুঝতে পারলো না ইরতিজাকে কে বেশি ভালোবাসে। রেডমন্ড-সিয়াটলের ব্যাপারটা আগে তার খেয়ালই ছিল না।
ইরতিজার অবস্থানরত রুমের দরজাটা ক্যানিয়ল খুলে ফেললেই নওরিন ক্যানিয়লকে দেখে একটু চমকে গেল। কারণ ক্যানিয়ল তার কাছে একজন অপরিচিত ব্যক্তি। ক্যানিয়লের সাথে মি. হেনরিও আছে। দুজন অপরিচিতকে দেখে নওরিন বিস্মিত আঁখি জোড়া জুহির উপর ফেললো। জুহি কোনো কিছু না ভেবেই নওরিনকে জানালো,
“আমাদের ফ্রেন্ড, ক্যানিয়ল।”
“ওহ…” অস্ফুটে উচ্চারণ করলো নওরিন। তারপর বললো,
“জানলো কীভাবে?”
“রিশন জানিয়েছে বোধহয়।” জুহি ধারণা করলো কাজটা তার ভাইয়েরই হবে হয়তো।
ক্যানিয়ল প্রবেশ করার পর থেকে ইরতিজার দিকেই তাকিয়ে ছিল। ইরতিজাও অবাক হয়ে চেয়ে আছে। সে হয়তো এই সময় এখানে ক্যানিয়লকে কোনো ভাবেই আশা করতে পারেনি। ক্যানিয়ল হঠাৎ নওরিন আর জুহির উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,
“তোমরা কি একটু বাইরে যেতে পারবে?”
নওরিনের কপালে ভাঁজ পড়লো। বাইরে যাবে মানে? সে কিছু বলার প্রস্তুতি নিচ্ছিল এর মাঝে জুহি দাঁড়িয়ে বললো,
“চলো।”
নওরিন অবাক হয়ে তাকালো। ছেলেটা বলছে আর জুহি যেতে রাজি হয়ে গেল? তাদের কেন বাইরে যেতে হবে? ছেলেটা কি তাদের সামনে যা বলার বলতে পারে না?
ক্যানিয়ল নওরিনকে দ্বিধাগ্রস্ত দেখে বললো,
“তুমি কি বাইরে যেতে অনিচ্ছুক? তাহলে কি আমি ইজাকে নিয়ে বাইরে চলে যাব?”
নওরিন হকচকিয়ে গেল ক্যানিয়লের কথায়। ছেলেটা তো দেখছে খুব সেয়ান। নওরিন আর কিছু না বলে বাইরে চলে এলো জুহির সাথে।
ক্যানিয়ল টুল টেনে একেবারে বেডের কাছে এসে বসলো। কিছুক্ষণ নীরব চেয়ে থেকে দেখলো ইরতিজাকে। তারপর বললো,
“হঠাৎ করে এত অসুস্থ হয়ে পড়েছো কেন তুমি?”
ইরতিজা একবার মি. হেনরির দিকে তাকিয়ে অতঃপর দৃষ্টি আবারও ক্যানিয়লের উপর নিয়ে এসে বললো,
“কই? আমি তো অসুস্থ নই।”
“অসুস্থ নও? তাহলে হসপিটালে কেন এসেছো? হ্যান্ডসাম ডক্টর আর মেল নার্সদের দেখার জন্য?”
ইরতিজা বুঝতে পারলো পূর্বের কথাটা বলে সে বোকামি করেছে। এ নিয়ে সে কথা বাড়াতে ইচ্ছুক নয়। তাই বললো,
“ও আমার বোন ছিল। ওর সাথে এমনভাবে কথা বলা উচিত হয়নি তোমার।”
“তোমার বোন? আমি কী করে বুঝবো যে ও তোমার বোন? হ্যাঁ একদিন দেখেছিলাম ওকে। কিন্তু তাই বলে বুঝবো কী করে ও তোমার বোন? তোমার প্যারেন্টস কোথায়? ডেকে এনে পরিচয় করিয়ে দাও। নয়তো পরে তাদেরও তো চিনতে পারবো না।”
“মা-বাবা নিউ ইয়র্ক আছে।”
“নিউ ইয়র্ক না থেকে এখানে থাকলে কি পরিচয় করিয়ে দিতে?”
ক্যানিয়লের মুখ নিঃসৃত কথাটা শেষ হওয়া মাত্রই রিশন প্রবেশ করলো। ভিতরে না ঢুকে সবটা অবলোকন করবে কী করে?
রিশন প্রবেশ করায় ভিতরে অবস্থান করা তিনজন মানব-মানবীর দৃষ্টিই তার উপর চলে এলো। তবে কারো দৃষ্টিই বেশিক্ষণ টিকলো না। কেউ যেন তাকে গ্রাহ্যই করলো না এমন ভাব প্রকাশ পেল। ক্যানিয়ল আবারও ইরতিজার দিকে দৃষ্টি নিয়ে বললো,
“এখন কেমন বোধ করছো?”
“ভালো বোধ করছি বলেই হয়তো স্বাভাবিকভাবে কথা বলছিলে।”
“না হলে কি অস্বাভাবিকভাবে কথা বলতাম?”
“হুম। তোমার এখনকার ব্যবহারের চেয়ে তখনকার ব্যবহার ভিন্নতর হতো।”
“কেন হতো?”
ইরতিজা থেমে রইল কিছুক্ষণ। রিশন কান পেতে রেখেছিল। ইরতিজা বিব্রত চোখে একবার মি. হেনরি এবং রিশনকে দেখলো। তারপর সহসা ক্যানিয়লের কাছে জানতে চাইলো,
“আমি কি তোমার ভালো থাকার মাধ্যম?”
ক্যানিয়ল অপ্রস্তুত হয়ে গেল হঠাৎ এমন প্রশ্নে। তবে বিচলিত ভাব সে দীর্ঘ সময় নিজ মাঝে পুষলো না। সহজ গলায় বলতে চেষ্টা করলো,
“হবে হয়তো! আমি কী করে জানবো?”
“জানো না? তাহলে আমি সেন্সলেস হয়ে হসপিটালে আছি শুনে কেমন অনুভূতি হয়েছিল তোমার সেটা কি জানো?”
ক্যানিয়ল ইরতিজার চোখে পূর্ণদৃষ্টি রেখে বললো,
“আমি সব জানি।”
ইরতিজা হাসলো। দু চোখে চিকচিক করে উঠলো পানি। বললো,
“আমি কেন তোমার ভালো থাকার মাধ্যম? কীভাবে, কখন হয়ে উঠলাম এটা? আমি কী করে ভালো রাখবো তোমায়? ওই সময়টাতে তো ভালো রাখতে পারবো না। আমার পাওয়া ভালো থাকার মাধ্যম কথাটাতে কলঙ্ক লাগবে তখন।”
ক্যানিয়লের দুই ভ্রুর মধ্যিখানে সূক্ষ্মভাবে দুটো ভাঁজ ফুঁটে উঠেছে। সে ভারি বিস্ময় আবিষ্ট কণ্ঠে বললো,
“কী বলছো তুমি? কিছু বোধগম্য হচ্ছে না আমার।”
ইরতিজা আর কিছু বললো না। ধীরে ধীরে চক্ষু বুজলো। নওরিন আর জুহি দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। এতক্ষণের সব কথা শুনছিল তারা। নওরিন সবটা শোনার পর তার মস্তিষ্কে চাপ অনুভব করছে। অজানা এক শঙ্কায় ধুকধুক করছে বুক। ভালো থাকার মাধ্যম মানে?
ইরতিজার শেষের কথাটা কারোরই বোধগম্য হয়নি। শুধু মি. হেনরি যেন ধরতে পারলো ইরতিজার ওই কথাটার মানে।
ক্যানিয়ল যখন বোঝার চেষ্টা করছিল ইরতিজার কথাটাকে, এমন সময়ে তার মোবাইল বেজে উঠলো। ড্যাড কল করেছে।
“হ্যালো ড্যাড!”
“জরুরি বিষয়ে আলাপ আছে। তোমাকে বাড়িতে প্রয়োজন। এখনই কি আসতে পারবে?”
“এখনই?”
ক্যানিয়ল ইরতিজার দিকে তাকালো। মেয়েটা এমনভাবে চোখ বুজে আছে মনে হচ্ছে যেন ঘুমাচ্ছে। সে বললো,
“ও কে, আসছি।”
কল কাটার পর ক্যানিয়ল ইরতিজার মাথায় হাত রেখে বললো,
“চলে যাচ্ছি পাকিস্টানি গার্ল! পরে আবার দেখা করতে আসবো।”
বলে সে ইরতিজার দিকে ঝুঁকে পড়লো। সকলের চোখ স্ফীত হয়ে উঠলো আচমকা। মি. হেনরি ব্যতীত বাকি তিনজনের মনেই সৃষ্টি হয়েছিল ভ্রান্তি ধারণা। কিন্তু ক্যানিয়ল ইরতিজার কানের কাছে মুখ নিয়ে গেল। ইরতিজা তখনও চোখ বুজে আছে। অনুভব করতে পারছে ক্যানিয়ল এখন তার খুব কাছাকাছি, তবুও সে চোখ খুললো না। একটু পরই ক্যানিয়লের ফিসফিসানো কণ্ঠ শুনতে পেল,
“পাকিস্টানি গার্ল, আমার চোখে ভ্রম হচ্ছে? না কি তোমার চোখে ভালোবাসার ঢল নেমেছে? তোমার দু চোখে কি সত্যিই আমার জন্য ভালোবাসা? না কি এটা আমার মিছে মিছে কল্পনা?”
ইরতিজা চোখ মেলে তাকালো। ক্যানিয়লের চোখে চোখ পড়তেই আটকে গেল তার হৃৎস্পন্দন। ক্যানিয়ল মুচকি হেসে সরে গেল।
“লেট’স গো মি. হেনরি।”
“তুমি একা যাও, আমার একটু কাজ আছে এখানে। আমি সেটা সমাপ্ত করে আসছি।”
ক্যানিয়ল অবাক হয়ে বললো,
“হসপিটালে কী কাজ তোমার?”
“পরিচিত একজন ভর্তি আছে এখানে। ওর কাছে যাব।”
“ও কে, আমি তাহলে তোমার গাড়ি পাঠিয়ে দেবো।”
ক্যানিয়ল বেরিয়ে এলো। তার পিছন পিছন রিশনও এলো। রিশন বললো,
“তুমি টিজার কানে কানে কী বলেছো?”
ক্যানিয়ল পিছন ফিরে রিশনের দিকে তাকালো। রিশনকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত একবার দেখে নিয়ে বললো,
“তোমাকে যখনই দেখি তখনই ইচ্ছা হয় মে/রে হাত-পা ভে/ঙে দিই।”
“হোয়াট?” ক্ষুব্ধ হয়ে উঠলো রিশন।
“সাবধানে থেকো, আমি হয়তো খুব শীঘ্রই তোমার মাথায় হকি স্টিক ভাঙতে চলেছি।”
“তুমি কিন্তু…”
ক্যানিয়ল রিশনকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ঘুরে আবার হাঁটতে শুরু করলো। কিন্তু রিশন দমলো না। পিছন পিছন আসতে আসতে বললো,
“তোমাকে পুলিশ ধরে নিয়ে গিয়ে কেন আবার ছেড়ে দেয়? তুমি যে প্রকাশ্যে মানুষকে মারার হুমকি দাও তা কি তারা জানে না? হুমকি দেওয়াও একটা ভয়াবহ ক্রাইম। তারা যখন তোমার এই ক্রাইমের জন্য তোমাকে ধরতে না আসছে তখন তোমার উচিত নিজ থেকে গিয়ে সারেন্ডার করা পুলিশের কাছে।”
নওরিন আর জুহি নেই এখানে। নওরিন জুহিকে নিয়ে কোথায় যেন চলে গেল। মি. হেনরি কোথাও নড়লো না। ইরতিজার মনে হলো মি. হেনরি কোনো রোগীকে দেখার জন্য হসপিটালে থেকে যায়নি। ক্যানিয়লকে মিথ্যা বলেছে সে। ইরতিজা মি. হেনরিকে একা পেয়ে বললো,
“আপনার কি মনে হয় না ক্যানিয়লকে সব জানানো উচিত?”
“বিষয়টা জানার পর তোমারই এই অবস্থা, ক্যানিয়ল জানার পর ওর কি অবস্থা হবে সেটা নিশ্চয়ই অনুমান করতে পারছো!”
ইরতিজা এ কথার জবাব দিলো না। মি. হেনরি বললো,
“আমার ধারণা ক্যানিয়ল মানসিক ভাবে ভীষণ বিপর্যস্ত হয়ে পড়লেও অজ্ঞান হয়ে যাবে না। তাহলে তুমি কেন এভাবে অজ্ঞান হয়ে গেলে?”
“জীবনে প্রথম এমনভাবে এই বিষয় সম্পর্কে জানতে পেরেছি। আর যার সম্পর্কে জেনেছি সে ক্যানিয়লের মম! এটা আমার জন্য ধাক্কা স্বরূপ ছিল। আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে, অস্থিরতা লাগছে।”
ইরতিজা কিছু সময় নীরব থেকে বললো,
“তাহলে ক্যানিয়ল নিজের মমের ব্যাপারে এখন কিছুই জানতে পারবে না, যখন জানবে তখন অলরেডি ওর মম মৃত থাকবে! আর ওর মম কেন ওকে ছেড়ে গিয়েছিল এটাও মমের মৃত্যুর পরই জানতে পারবে, তাই তো?”
“হুম।”
ইরতিজার চোখের কোণে আবার পানি জমলো। বললো,
“ক্যানিয়ল তো তাহলে কিছুই পারলো না। মমের মৃত্যুর আগে ও মমকে জানাতে পারলো না ও তাকে কতটা ভালোবাসে। যখন ওকে ছেড়ে ওর মমের চলে যাওয়ার কারণটা জানতে পারবে, তখন মমের প্রতি ওর ভালোবাসার পরিমাণটা আরও বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু সেটা জানানোর সুযোগ তখন ওর থাকবে না। নিজের প্রতি নিজে তখন তিক্ততা অনুভব করবে। ভীষণ তিক্ততা!”
ইরতিজা চোখ বুজে ফেললো। চোখের কোণ বেয়ে উষ্ণ একটা ধারা নেমে গেল টুপ করে।
মি. হেনরি বললেন,
“আর বেলা লিমাসের মৃত্যুর আগে ক্যানি এসব জানতে পারলে কেমন হবে? তখন বেলা লিমাসের মৃত্যু মেনে নেওয়াটা ক্যানির জন্য খুব কষ্টকর হবে। মমের মৃত্যুর আগেও ও কষ্ট পাবে, এমনকি পরেও। কষ্টের পরিমাণটা তখন বেশি হবে। আর বেলা লিমাসও ভীষণ কষ্ট পাবেন ছেলের ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ দেখে। কারণ ছেলের ভালোবাসার আবেশে জড়িয়ে থাকার জন্য দীর্ঘ সময় পাবেন না তিনি। বেলা লিমাসের মৃত্যুর পরেই ক্যানিয়লের সবটা জানা ভালো হবে। কারণ তখন বেলা লিমাস মৃত থাকবে! শোকটা কাটিয়ে ওঠা সহজ হবে ওর জন্য। আর ক্যানিয়ল আগে জানলে বেলা লিমাস যতদিন বেঁচে থাকবে ততদিন কষ্টে ডুবে থাকবে ও, তার মৃত্যুর পরও কষ্ট পাবে।”
“বেলা লিমাস আমাকে কেন বললেন তার রোগ সম্পর্কে?”
“কারণ ক্যানিয়লের কাছে তুমি বিশেষ, আর ক্যানিয়ল তার কাছে বিশেষ। উনি মনে করেন ক্যানিয়ল ভেঙে পড়লে তোমার কারণে আবার স্বাভাবিক হতে পারবে সহজে। এটা সত্যও। মানুষ একাকিত্বে থাকলে তখন কষ্টগুলো যেন আরও বেশি করে আষ্টেপৃষ্ঠে ধরার সুযোগ পায়, কিন্তু কেউ সঙ্গ দিলে সেই সঙ্গকে ভালোবেসে কষ্ট ভোলা যায়। আমার ধারণা তুমি ক্যানিয়লের একজন ভালো সঙ্গী হবে। ”
ইরতিজা বেশ কিছু সময় নীরব থাকলো। ভাবলো। ক্যানিয়ল বেলা লিমাসের সন্নিকটে এসে দাঁড়ানো মৃত্যুর খবর জানতে পারলে ওর মানসিক অবস্থা ভীষণ করুণ হয়ে উঠবে। বেলা লিমাসের সেই করুণতা সহ্য করার ক্ষমতা নেই। ইরতিজা বললো,
“ঠিক আছে, বেলা লিমাস যখন চাইবেন তখনই জানবে ক্যানিয়ল!”
“ক্যানিয়লের সাথে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করো।”
“হুম। কিন্তু মমের মৃত্যু এবং অতীতে মমের চলে যাওয়ার কারণ জানার পর ক্যানিয়ল নিজেই তো অস্বাভাবিক হয়ে যাবে!”
“তখন তুমি ওকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করবে। আমি যাচ্ছি। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি তিনি যেন সম্পূর্ণ রূপে তোমাকে সুস্থতা দান করেন।”
মি. হেনরি চলে যেতে উদ্যত হলে ইরতিজা বললো,
“আপনি তো বেলা লিমাসের গুপ্তচর। আমার আর ক্যানিয়লের সম্পর্কে ওনাকে বিস্তারিত সব আপনিই তো জানিয়েছেন, তাই না?”
“হুম।”
“তাহলে আমাকে একটা বিষয় সম্পর্কে জানান তো। ক্যানিয়লের কাছে আমি কেন প্রিয়? ফেমাস ব্যালে ড্যান্সার কেন নয়?”
“উম…এটার উত্তর দেওয়া খুব কঠিন। এমন ধরনের প্রশ্ন সচরাচর কঠিনই হয়। দেখো, মানুষের ব্যক্তিগত একটা পছন্দ থাকে। সবার কাছে সবাইকে ভালো লাগে না। ছোটো বেলা থেকে মিরান্ডার সাথে থেকেও ক্যানি কখনও বিশেষ অনুভূতি উপলব্ধি করেনি মিরান্ডার প্রতি। কিন্তু তোমার সাথে দেখা হওয়ার অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তুমি ওর মনে বিশেষ প্রভাব ফেলেছো। এখন মিরান্ডার প্রতি বিশেষ অনুভূতি না জন্মিয়ে তোমার প্রতি কেন জন্মালো এটা ভাবা আসলে বোকামি। ঈশ্বর চেয়েছেন বলেই এমন হচ্ছে এটা তোমার মনে রাখতে হবে।”
মি. হেনরি চলে গেল। ইরতিজার চোখ আবারও ভিজে উঠছিল অহেতুক। ইরতিজা এক প্রকার রাগ করলো চোখের সাথে। আসলেই কি সে ছিঁচকাঁদুনে? ছিঁচকাঁদুনে না হলে এমন কান্না কান্না পাচ্ছে কেন তার কাঁদবে না বলে প্রতিজ্ঞা করার পরও?
নওরিন জুহিকে নিয়ে ইরতিজার অবস্থানরত রুম থেকে অনেকটা দূরে এসেছিল। এসে জুহিকে জিজ্ঞেস করেছে,
“তুমি কি শিওর ছেলেটা কেবল তোমাদের ফ্রেন্ড, অন্য কিছু নয়?”
নওরিনের সন্দেহের দৃষ্টি দেখে ঘাবড়ে গিয়েছিল জুহি। যদিও ইরতিজা কিছুই বলেনি তার কাছে, তবুও সে এ বিষয়ে নিশ্চিত যে ইরতিজা আর ক্যানিয়লের মাঝে বিশেষ কিছু আছে। কিন্তু এটা এই সময় নওরিনকে বলা যুক্তিসঙ্গত মনে হলো না তার। ঘাবড়ে যাওয়া সত্ত্বেও সে যথেষ্ট স্বাভাবিকতা বজায় রেখে বলেছে,
“ইয়াহ, বন্ধু ছাড়া আর কী হবে?”
“ছেলেটার কথাবার্তা মোটেই স্বাভাবিক লাগছিল না।”
“অস্বাভাবিকও কিছু ছিল না।”
নওরিন আর জুহির মাঝে বিষয়টা নিয়ে বেশ কিছুটা বাক্যালাপ চললো। নওরিন এটাকে যত ভিন্ন আঙ্গিকে দাবি করছিল, জুহি তত তাকে এটা স্বাভাবিক বলে বোঝানোর চেষ্টায় ছিল। নওরিন এক সময় বিরক্ত হয়ে এ নিয়ে কথা থামিয়ে দেয়। কিন্তু জুহি লক্ষ করছিল নওরিনের মুখে তখনও সন্দেহের দুত্যি ঝিলমিল করছে।
একটু পরই সাজিদ এলো। রিশন মনে মনে ভীষণ অসন্তুষ্ট। কারণ সে যা প্ল্যান করে ক্যানিয়ল আর সাজিদকে এক সাথে কল দিয়ে খবরটা জানিয়েছিল, তা কিছুই হয়নি। সে বুঝতে পারেনি কে ইরতিজাকে বেশি ভালোবাসে। কারণ হিসাব মোতাবেক তো ক্যানিয়লেরই আগে আসার কথা ছিল। আর চেয়েছিল সাজিদ আর ক্যানিয়ল সামনাসামনি হলে কেমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় সেটা দেখতে। কিন্তু ক্যানিয়ল তো সাজিদ আসার অনেক আগেই চলে গেছে। আর যাওয়ার সময় কী খারাপ আচরণটাই না করলো তার সাথে! যা মনে পড়তেই রিশনের মনে হচ্ছে ক্যানিয়লকে খবরটা জানিয়ে সে চরম ভুল করেছে। এরপর রইল ইরতিজার প্রতি দুজনের আচরণ বিশ্লেষণ। এটা দ্বারাও সে কিছু বুঝতে পারলো না। তবে ক্যানিয়ল আর ইরতিজাকে দেখে সে এটুকু বুঝতে পেরেছে যে, দুজনেরই দুজনের প্রতি অনুভূতি বিদ্যমান। যেটা সাজিদের বেলায় লক্ষ করেনি। সাজিদের অনুভূতি একপাক্ষিক মনে হয়েছে তার কাছে।
সাজিদ বেশ কিছু সময় ধরে ইরতিজার দিকে তাকিয়ে আছে। আর ইরতিজা অন্যদিকে তাকিয়ে রয়েছে। সে বেশ বিব্রত বোধ করছে সাজিদ এরকম তাকিয়ে থাকায়। ক্যানিয়ল হাসপাতালে আসায় সে যতটা অবাক হয়েছিল সাজিদ আসায় তার থেকে দ্বিগুণ অবাক হলো। সাজিদ তাকে দেখতে এই সময়ে হাসপাতালে আসতে পারে এটা তার ভাবনার ধারে কাছেও ভিড়েনি কখনও। সাজিদ তাকিয়ে থাকাতে এবার সে প্রচণ্ড বিরক্ত বোধ করলো। অতিষ্ঠ হয়ে বললো,
“এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন? আমি কি মন্সটার? উৎসাহী হয়ে মন্সটার দেখছেন?”
“মন্সটার নয়, আমি উৎসাহী হয়ে মানুষই দেখছি।”
“কেন? জীবনে আর কোনোদিন মানুষ দেখেননি?”
“মানুষ অনেক দেখেছি, আপনাকেও দেখেছি বহুবার। তবে এখনও অজস্রবার দেখা বাকি।”
ইরতিজা ভ্রু কুঁচকালো। সাজিদ বললো,
“আপনার কী হয়েছে? ঠোঁটে আঘাত পান, এখন আবার অজ্ঞানও হয়ে যাচ্ছেন! ব্যাপার কী?”
“আমার ব্যাপার নিয়ে আপনাকে অহেতুক ভাবতে বলছি না আমি।”
“কিন্তু আমার তো ভাবতে হবে। বিয়ের পর যদি আপনি হুটহাট করে অজ্ঞান হয়ে যেতে শুরু করেন তাহলে আমার মা-বাবা তো বলবে তাদের জন্য ফিট খাওয়া বউ মা নিয়ে এসেছি।”
“আপনার বাড়িতে আমি যাব না কি? আপনার মা-বাবা বলবে কী করে?”
“আপনি না গেলেও আমি আপনাকে জোর করে তুলে নেবো যে, সেজন্যে।”
“আপনি চলে যান। আমার কারো সাথে কথা বলতে ভালো লাগছে না। বাসায় গিয়ে শুধু আব্বুর সাথে কথা বলবো। এরপর ডিরেক্ট ঘুমিয়ে যাব। আপনি চলে যান।”
“কিন্তু আমার কথা বলতে খারাপ লাগছে না। আর আমার ঘুমানোরও তাড়া নেই। ঘুমাতে গিয়ে বিছানার ওপাশটা খালি দেখলেই ঘুম উবে যায় চোখ থেকে। খুব শীঘ্রই আসলে আমার বিয়ে করে ফেলা উচিত। বিছানার ওপাশটা পূর্ণ হয়ে গেলে ঘুমও পরিপূর্ণ হতো।”
“আপনাকে বিয়ে করতে তো কেউ নিষেধ করছে না। আপনার ঘাড় ত্যারামির জন্যই আপনার বিছানার ওপাশটা খালি। এতদিনে একটা ভালো মেয়ের খোঁজ করে বিয়ে করে ফেললে আমরা একটা বিয়ে খাওয়ার সুযোগ পেতাম।”
সাজিদ ফিক করে হেসে দিলো ইরতিজার কথা শুনে। এরপর বললো,
“ভালো মেয়ে না, খারাপ মেয়ে বিয়ে করবো আমি। আর সেই বিয়েতে তোমাকে দাওয়াত দেবো না। যদি পারো বিনা নিমন্ত্রণে বিয়ে খেতে এসো।”
____________
বাড়িতে যে জরুরি বিষয়ে আলাপ করার জন্য ডেকে আনা হয়েছে এতে রীতিমতো বিরক্ত হলো ক্যানিয়ল। সে বিষয়বস্তুটা ধরতে পেরে বললো,
“আগামী দশ বছরেও আমি বিয়ে করার জন্য প্রিপেয়ার নই ড্যাড।”
কথাটা শুনে মুহাম্মদ ইসহাক যেমন চমকালেন, তেমনি চমকালেন বাকিরাও। মাদার সোফিয়া বললেন,
“কী বলছো উমরান?”
“ইয়েস মাদার সোফিয়া। আমি প্রিপেয়ার নই। সুতরাং এক মাসের মধ্যে আমার বিয়ে কার্য সম্পন্ন হোক এটা চাওয়া দুরাশা।”
মুহাম্মদ ইসহাক বললেন,
“এলজে বলছিল একমাসের ভিতর বিয়েটা হয়ে গেলেই ভালো হয়। শুধু শুধু দেরি করে লাভ কী? আমারও মনে হয় বিয়েটা হয়ে গেলে মন্দ হয় না।”
ক্যানিয়ল বুঝতে পারলো নিশ্চয়ই মিরান্ডা নিজের ড্যাডের মাথায় এই বিয়ে দ্রুত হয়ে যাওয়া ভালো এই বিষয়টা ঢুকিয়েছে। এখন মিরান্ডার ড্যাডের মাথা থেকে তার ড্যাডের মাথায়ও বিষয়টা ট্রান্সফার হয়েছে। ক্যানিয়ল বললো,
“আমি কিন্তু নিজ ইচ্ছাতে এই এনগেজমেন্ট করিনি। আমি তোমাকে বলেছিলাম মিরান্ডার প্রতি আমার কখনও ভিন্ন কোনো অনুভূতি ফিল হয়নি। তুমি বলেছিলে, নেই তো কী হয়েছে? হবে। একসাথে থাকলে অনুভূতি ক্রিয়েট হবে। সময় নিয়ে দেখো। ততদিনে এনগেজমেন্ট হয়ে যাক। এটা নিয়ে সমস্যা তো নেই। তোমার কথা অনুযায়ী এনগেজমেন্ট হলো। আমি চেষ্টা করলাম মিরান্ডার প্রতি অনুভূতি ফিল করতে, কিন্তু এটা কাজ করলো না। আমাদের এনগেজমেন্টের এক বছর হয়ে গেছে, এত দীর্ঘ সময়েও এটা কাজ করলো না। আমার মনে হয় না এটা আর কাজ করবে। স্যরি ড্যাড! আমার মনে হয় না আমি মিরান্ডাকে বিয়ে করতে পারবো!”
মুহাম্মদ ইসহাকের মাঝে অবিশ্বাসের ঝাপটা লাগলো,
“তুমি কী বলছো এটা?”
“আমি মিরান্ডাকে বিয়ে করবো কি না সে ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলাম না। পাকিস্টানি গার্লের সাথে দেখা না হলে আমি মিরান্ডাকে বিয়ে করতেও পারতাম, আবার না-ও করতে পারতাম। ওটা ছিল অনিশ্চিত বিষয়। কিন্তু পাকিস্টানি গার্লের সাথে দেখা হওয়ার পর বিষয়টা নিশ্চিত হয়েছে। আমি স্যরি! আমি বিয়ে করবো না মিরান্ডাকে।”
ক্যানিয়ল উঠে দাঁড়ালো। যেতে চেয়ে পা বাড়ালো। দুই কি তিন কদম এগিয়ে গেলেই মুহাম্মদ ইসহাক বললেন,
“তুমি কার কথা বলছো? কোন পাকিস্তানি গার্ল?”
ক্যানিয়ল থামলো। পিছন ফিরে বললো,
“শি ইজ দ্য ব্রাইটেস্ট স্টার ইন মাই স্কাই।”
“হোয়াট?” বুঝতে পারলেন না মুহাম্মদ ইসহাক।
“ও আমার গার্লফ্রেন্ড নয়, কিন্তু আমি ওর বয়ফ্রেন্ড। আবার ব্যাপারটা এমনও হতে পারে, ও আমার গার্লফ্রেন্ড, কিন্তু আমি ওর বয়ফ্রেন্ড নই। ব্যাপারটা এমনও হতে পারে, আমরা কেউই কারো গার্লফ্রেন্ড-বয়ফ্রেন্ড নই। আবার ব্যাপারটা এরকমও হতে পারে, আমরা দুজনই দুজনের গার্লফ্রেন্ড-বয়ফ্রেন্ড।”
(চলবে)
#উড়ো_পাতার_ঢেউ
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ৪৭
_________________
আজ জুহির জন্মদিন। সন্ধ্যায় ছোটো-খাটো একটা পার্টির আয়োজন করা হবে সেই উপলক্ষ্যে। আন্দ্রেজের মায়ের কল এলো আজ সকাল সকাল। আন্দ্রেজের ফ্যামিলি বলতে শুধু আন্দ্রেজের মা’ই আছে। আন্দ্রেজের মায়ের সাথে জুহির ভালো সম্পর্ক। আজ এত সকাল সকাল কল দেওয়ার মানে বুঝতে অসুবিধা হলো না জুহির। আন্দ্রেজ তার জন্মদিনের কথা ভুলে গেলেও আন্দ্রেজের মা ভুলে যায়নি। ফোন পাওয়ার কিছুক্ষণ পরই জুহি গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। তাদের বাসা থেকে আন্দ্রেজের বাসায় গাড়িতে আসতে মাত্র তেরো-চৌদ্দ মিনিট লাগে। আন্দ্রেজের বাসায় এসে পৌঁছলে প্রথমেই আন্দ্রেজ এবং তার মা এডালিন জুহিকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানালো। জুহির জন্য একটা কেকও তৈরি করে রেখেছিলেন এডালিন। আসলে তিনি জরুরি কাজের জন্য গ্রামে যাবেন। তাই জুহির জন্মদিনের পার্টিতে থাকা হবে না তার। তাই যাওয়ার আগে এভাবে আজকের সকালটুকু উপহার দিলেন জুহিকে।
কেক কাটার পরপরই এডালিন চলে গেলেন। যথাসময়ে তার সেখানে গিয়ে হাজিরা দিতে হবে।
আন্দ্রেজদের ঘর তেমন বড়ো নয়। একটা ছোটো লিভিংরুম, ছোটো কিচেন, একটা বেডরুম। কিচেনের নিচে আছে একটা বেজমেন্ট। বেইজমেন্টটা বেডরুম স্বরূপ ব্যবহার করেন এডালিন। ঘরের জিনিসপত্রেও তেমন বিলাসবহুলতার ছোঁয়া নেই। দেখে বোঝা যায় আন্দ্রেজের পারিবারিক অবস্থা অন্যদের তুলনায় একটু অসহায়। আন্দ্রেজ জানতে চাইলো,
“তুমি কি ব্রেকফাস্ট করে এসেছো?”
“তুমি ব্রেকফাস্ট করাবে?”
আন্দ্রেজ উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
“বসো। মম ব্রেকফাস্টও রেডি করে রেখে গেছে। আমি নিয়ে আসছি।”
বলে ক্রাচে ভর দিয়ে কিচেনের দিকে এগোতে লাগলো আন্দ্রেজ।
জুহি নিজের হাতের দিকে তাকালো। একটা সুন্দর ঘড়ি তার হাতে শোভা পাচ্ছে। এডালিন জন্মদিনের গিফট হিসেবে দিয়েছে এটা। আন্দ্রেজ কিছু দেয়নি। হয়তো পার্টিতে থাকাকালীন দেবে। তবে জুহির তর সইছে না আন্দ্রেজ কী গিফট দেবে সেটা দেখার জন্য। আন্দ্রেজ নিশ্চয়ই তার জন্য ইতোমধ্যে গিফট কিনে রেখেছে। জুহি চুপিচুপি আন্দ্রেজের রুমে চলে এলো। পরিপাটি রুম। রুমের এক জায়গায়ও অগোছালোভাব নজরে পড়ছে না। ওয়্যারড্রোবের কাছে এলো সে। সাধারণত আন্দ্রেজ এখানেই রেখে থাকবে। কিছু সময় খোঁজাখুঁজি করার পর এক জোড়া হেয়ার ক্লিপ নজরে পড়লো শুধু। আর কোনো কিছু দেখে এমন মনে হলো না যে সেটা আন্দ্রেজ তাকে গিফট হিসেবে দিতে পারে। হ্যাঁ, এটাই আন্দ্রেজ তাকে গিফট দেবে। তাকে গিফট না দিলে আন্দ্রেজ ক্লিপ দিয়ে করবে কী? আন্দ্রেজ নিজে তো আর চুলে ক্লিপ দিয়ে বসে থাকবে না। আর এটা নিশ্চয়ই সে নিজের মমের জন্যও কেনেনি। সুতরাং এটা তো তার জন্যই কিনেছে। জুহির খুব পছন্দ হয়েছে ক্লিপ জোড়া। এটা তেমন মূল্যবান কোনো বস্তু নয়, খুবই সাধারণ। তবুও এটা এই মুহূর্ত থেকে তার কাছে বিশেষ হয়ে গেছে।
লিভিং রুম থেকে আন্দ্রেজের ডাক ভেসে এলো,
“জুহি, কোথায় তুমি?”
জুহি দ্রুত ড্রয়ার আটকিয়ে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে এলো। আন্দ্রেজ বললো,
“আমার রুমে কী করছিলে?”
জুহি প্রস্তুত কণ্ঠে উত্তর দিলো,
“আমার একটা নোটের প্রয়োজন ছিল, দেখছিলাম তোমার কাছে সেটা আছে কি না। নেই তোমার কাছে।”
“কী নোটের প্রয়োজন ছিল?”
জুহি এবার একটু অপ্রস্তুত হলো। আমতা আমতা করে বললো,
“ওইতো একটা ইম্পরট্যান্ট বিষয়ের। আমার, টিজার, রিশনের তিনজনেরই প্রয়োজন। সমস্যা নেই বেথের কাছ থেকে নিয়ে নেবো।”
জুহি চেয়ার টেনে বসলো। লিভিংরুমের এক কর্ণারে ছোটো ডাইনিং টেবিল আছে, সেখানে। জুহির ঠোঁটে লেগে আছে আলতো মুচকি হাসি। আনন্দের এই হাসিটুকু সরছে না ঠোঁট থেকে। আন্দ্রেজ ওর হাসি লক্ষ করে বললো,
“হাসছো কেন?”
“তুমি এত ভালো কেন আন্দ্রেজ?”
আন্দ্রেজ চমকে উঠলো। জুহির হঠাৎ তাকে প্রশংসা করার মানে খুঁজে পেল না। জুহি আর কিছু বললো না। আন্দ্রেজও জানতে চাইলো না কিছু। জুহি হাসি হাসি বদনে খেতে লাগলো। আর আন্দ্রেজ অবাক হয়ে দেখতে থাকলো তাকে।
_________________
“চলো।”
ক্যানিয়ল মোবাইলে গেম খেলতে খেলতেই উত্তর দিলো,
“কোথায়?”
“সাইকোলজিস্টের কাছে অ্যাপয়ন্টমেন্ট আছে তোমার।”
মোবাইল স্কিনে চালিত হাত থেমে গেল ক্যানিয়লের। বিস্ময় নিয়ে তাকালো মি. হেনরির দিকে,
“কার অ্যাপয়ন্টমেন্ট আছে?”
“তোমার।”
“মানে? কখন, কীভাবে, কেন আমার অ্যাপয়ন্টমেন্ট আছে সাইকোলজিস্টের কাছে?”
“তোমার ড্যাড রেখেছে অ্যাপয়ন্টমেন্ট। তুমি না কি গতকাল গার্লফ্রেন্ড-বয়ফ্রেন্ড নিয়ে কীসব আবোল-তাবোল বলেছো? যার মানে কেউ বুঝতে পারেনি। ওনার ধারণা মানসিক কোনো সমস্যা হয়েছে হয়তো তোমার। যার কারণে কাল ওরকম আজব কিছু বলেছো। এছাড়া মিরান্ডাকে বিয়েও না কি করবে না বলেছো। এজন্য ওনার ধারণা কোনো একটা প্রবলেম আছে তোমার।”
ক্যানিয়ল উপরের দিকে তাকিয়ে ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো,
“ড্যাড এমন কেন?”
মি. হেনরির দিকে তাকালো ক্যানিয়ল,
“আমাকে দেখে কি তোমার মনে হচ্ছে আমার মানসিক কোনো সমস্যা আছে?”
“না।”
“তাহলে?”
“কিন্তু তোমার একবার যাওয়া উচিত সাইকোলজিস্টের কাছে। যেহেতু তোমার ড্যাড অ্যাপয়ন্টমেন্ট রেখেছে।”
“অসম্ভব। আজ পর্যন্ত আমি যত মানুষকে মেরেছি বলতে গেলে সবাই একেকজন ছোটো-খাটো সাইকো ছিল। এখন আমি যদি সাইকোলজিস্টের কাছে যাই, আর সেই খবর যদি এই ছোটো-খাটো সাইকো গুলো পেয়ে যায়, তাহলে আমার সম্মান কিছু কি আর অবশিষ্ট থাকবে? তুমি চাও আমার মানসম্মানে দাগ লাগুক?”
ক্যানিয়ল কাউচ থেকে উঠে গেল। দরজার দিকে যেতে যেতে বললো,
“ভায়োলেট কুইনের কী খবর? ও কি সুস্থ হয়েছে এখন পুরোপুরিভাবে?”
মি. হেনরি পিছন পিছন আসতে আসতে বললো,
“মনে হচ্ছে হ্যাঁ। দেখেছি জুহি আর রিশনের সাথে শপিংয়ে গিয়েছে। আজ জুহির জন্মদিনের পার্টি আছে সন্ধ্যায়।”
ক্যানিয়ল থেমে গেল। পিছন ফিরে জিজ্ঞেস করলো,
“কোনো ইনভাইটেশন কার্ড আসেনি আমার জন্য?”
মি. হেনরি দুই পাশে মাথা নাড়লো। বিশ্বাস করতে কষ্ট হলো ক্যানিয়লের। বললো,
“কত বড়ো বেয়াদব! আমাকে ইনভাইট করেনি? সামুরাকে করেছে?”
“হ্যাঁ, ওর জন্য সকালেই ইনভাইটেশন কার্ড পাঠিয়েছে।”
ক্যানিয়লের আত্মসম্মান চূর্ণবিচূর্ণ হওয়ার গুড়গুড় শব্দ হলো। সে রাগে কিড়মিড় করে বললো,
“ওরা সবকটা বদ! এমনকি ইজাও!”
বলে হনহন করে বেরিয়ে গেল রুমটা থেকে। বেরিয়েই দেখতে পেল মাদার ইয়াদার বড়ো পুত্র, অর্থাৎ তাদের সবচেয়ে বড়ো ভাই এখানে আছে। ড্যাডের সাথে দাঁড়িয়ে কিছু নিয়ে কথা বলছে। এক বোনও আছে তাদের সাথে। ক্যানিয়লদের থেকে কিছুটা দূরত্বে দাঁড়িয়ে আছে তারা। ক্যানিয়ল এই মুহূর্তে আর ড্যাডের চোখের সামনে পড়তে চাইলো না। তাই চুপচাপ অন্যপথ দিয়ে বেরিয়ে এলো মাইক্রোসফট বিল্ডিং থেকে। ক্যানিয়ল এতক্ষণ যে মাইক্রোসফট বিল্ডিংটায় ছিল ওটা মুহাম্মদ ইসহাকের সবচেয়ে উন্নত এবং বড়ো কোম্পানির একটা। এই কোম্পানিটাই মুহাম্মদ ইসহাক ক্যানিয়লকে দিতে চাইছেন। কদিন ধরে কোম্পানি গ্রহণ না করতে বলে যে হুমকিমূলক কল আসতো, সেটা আর পাচ্ছে না ক্যানিয়ল। নাইলা সালেম কি মেনে নিলেন?
______________
জুহিদের বাসার সামনের লনটা সাজানো হয়েছে। নানা রং-বেরংয়ের বাতি এবং ফ্লাওয়ার দিয়ে সাজানো হয়েছে। একটা টেবিলে কেক রাখা, যা এখনও উন্মুক্ত করা হয়নি। লনে চেয়ার রাখা হয়েছে অনেকগুলো। অনেকটাতে মানুষজন বসে আছে, অনেকটা আবার খালি। মানুষজন বলতে এখানে জুহির কিছু ফ্রেন্ডস এবং প্রতিবেশীরা আছে। চার ধরনের ড্রিংকস সার্ফ করা হচ্ছে। সাথে দুটো বিশেষ আইটেমের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। যে যার চাহিদা অনুযায়ী তা গ্রহণ করতে পারবে।
জুহির পরনে সিলভার রঙের একটা গাউন। গাউনটা রিশন নিজের টাকায় কিনে দিয়েছে। শুধু জুহিকে নয়, ইরতিজা আর নওরিনকেও দুটো ড্রেস গিফট করেছে। একজন সফল ইউটিউবার তো, ভালো টাকাই ইনকাম করে সে।
শীত থাকলেও জুহি কোনো শীতবস্ত্র পরেনি। এই শীতের মাঝে মেয়েটা কীভাবে শীতের পোশাক না পরে ঘুরছে ভাবছে ইরতিজা। ইরতিজার পরনের পোশাকটা গাঢ় নীল। সাথে ম্যাচ করে মাথায় হিজাব। এই হিজাবটাও ক্যানিয়লের দেওয়া সেই একশ হিজাবের ভিতর একটা। সেই একশ হিজাবের বেশি আর হিজাব প্রয়োজন হয় না তার। ইরতিজা চেয়েছিল ক্যানিয়লের দেওয়া ক্যামেরাটা দিয়ে আজ কিছু ফটো তুলবে। কিন্তু ক্যানিয়ল তো ওই ক্যামেরার জন্য সকল ছেলেদের নিষিদ্ধ করেছে। ফটো তুলতে গিয়ে যদি ভুল করে কোনো ছেলের ফটো উঠে যায় ক্যামেরায় তাহলে চরম অন্যায় হয়ে যাবে। অন্য ছেলে কেন? ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলতে দেখলেই তো রিশনও এসে ছবি তোলায় ভাগ বসাবে। ইরতিজা ভিড়ের মাঝে রিশনকে খোঁজার চেষ্টা করলো। দেখতে পেল রিশন নিজের সবচেয়ে প্রিয় কাজ, মানে ভিডিয়ো শ্যুট করছে। নিশ্চয়ই ইউটিউবের জন্যই এই ভিডিয়ো শ্যুট করা। ইরতিজা হেসে ফেললো। এই ছেলেটা কি ভিডিয়ো শ্যুট, আর এডিট করা ছাড়া আর কিছু পারে না?
আজাদ চৌধুরী আর শারমিন ফিরে এসেছেন আজকে বিকালে। আজাদ চৌধুরী কিছুক্ষণ আগেও এসে ইরতিজাকে বলে গেছেন,
“তুমি কি অসুস্থ বোধ করছো? অসুস্থ ফিল হলে রুমে গিয়ে রেস্ট নাও। এখানে থাকার দরকার নেই।”
ইরতিজা অসুস্থ বোধ করছে না। অসুস্থ বোধ করলে সে নিজ থেকেই রুমে চলে যাবে, এমন বলেছে বাবাকে।
আজকে ক্যানিয়ল পার্টিতে আসলে ভালো হতো এমন অনুভূত হচ্ছে ইরতিজার। অথচ জুহি ক্যানিয়লকে ইনভাইট করেনি! জুহি প্রথমে চেয়েছিল ক্যানিয়লকেও ইনভাইটেশন কার্ড পাঠাবে। কিন্তু রিশন তাতে একমত পোষণ করলো না। মূলত ক্যানিয়ল হসপিটালে থাকাকালীন রিশনকে যা যা বলেছিল সেজন্য রিশন চায় না ক্যানিয়ল পার্টিতে আসুক। পরে রিশন জুহিকেও কী কী যেন বুঝালো, এরপর জুহিও রিশনের সাথে সহমত হলো। আর ইনভাইট করলো না ক্যানিয়লকে।
জুহি গতরাতে হসপিটাল থেকে বাসায় ফেরার পর হঠাৎ জানতে চেয়েছিল,
“তোমার আর ক্যানির মাঝে বিশেষ কোনো সম্পর্ক চলছে টিজা?”
প্রশ্নটা এমন বিব্রতকর ছিল যে ইরতিজা কোনো উত্তর দিতে পারেনি। আর উত্তর দেবে কী? তাদের মাঝে ঠিক কী চলছে? তাদের সম্পর্কটা এমন যে এর কোনো নাম নেই। তবে মনে হয় নাম না থাকলেও তাদের সম্পর্কটা বিশেষ কিছুই, এটাকে শুধু বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বলা যায় না। এই সম্পর্ক ব্যাখ্যা করা যায় না। কেবল অনুভূতিটুকু ব্যাখ্যা করা যায়। ইরতিজার কিছু বলতে হয়নি। জুহিই বলেছিল,
“তোমাদের দুজনের মাঝে গভীর অনুভূতি চলছে একে অন্যের জন্য। আমি তোমাদের এই অনুভূতি হিংসা করি। আন্দ্রেজ কেন আমার অনুভূতি বুঝতে পারে না? কেন ওর মাঝে আমার জন্য অনুভূতি নেই?”
কথাগুলো বলে কান্না করে দিয়েছিল জুহি। ইরতিজা বুঝতে পারছিল আন্দ্রেজের জন্য জুহির অনুভূতি বিশুদ্ধ। জুহি হয়তো মজার ছলে অনেক ছেলের আকর্ষণ পাওয়ার চেষ্টা করেছে, ডেটও করেছে কয়েকজনের সাথে। কিন্তু ওর আসল অনুভূতির মানুষটা হচ্ছে আন্দ্রেজ। কথাটা ভাবতে ভাবতে দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করলো ইরতিজা।
আজকে সাজিদেরও আসার কথা ছিল। কিন্তু তাকে আবারও অফিসিয়াল কাজে লস এঞ্জেলেসে যেতে হয়েছে। ইরতিজার বার বার মনে হচ্ছিল জোনাস হয়তো তার আশেপাশেই আছে। পার্টিতে উপস্থিত মানুষজনের সাথে মিশে চুপিচুপি দেখছে তাকে। কিন্তু দু চোখের শান্ত চাহনি জোনাসকে কোথাও দেখতে পায়নি। অবশেষে ইরতিজা ধরে নিয়েছে তার অনুমান ভুল।
“টিজা!”
হঠাৎ সামুরার ডাক শুনতে পেল ইরতিজা। সামুরার দিকে তাকিয়ে একগাল হাসলো। ইরতিজার হাতে কোনো ড্রিংকসের গ্লাস না দেখতে পেয়ে সে একটা গ্লাস এগিয়ে দিলো ইরতিজার দিকে। ড্রিংকস বলতে এখানে আছে ফলের রস দিয়ে বানানো তিন রকমের পানীয় এবং যাদের মদ্যপানের অভ্যাস আছে তাদের জন্য রেড ওয়াইন। সামুরা ইরতিজাকে আনারস দিয়ে বানানো ড্রিংকসটা দিয়েছে। ইরতিজা আনারস পছন্দ করে না। আর সেজন্য সে পানও করলো না। অবশ্য সামুরা যদি দাঁড়িয়ে থাকতো তাহলে তাকে ভদ্রতার খাতিরে একটু হলেও খেতে হতো। কিন্তু সামুরা তাকে গ্লাসটা দিয়েই চলে গিয়েছে।
জুহির ধারণা ছিল আন্দ্রেজ তাকে গিফট স্বরূপ সেই ক্লিপ জোড়া দেবে, কিন্তু না, আন্দ্রেজ তাকে একটা পারফিউম দিয়েছে। পারফিউমটা দেখার পর জুহি প্রায় বলেই ফেলেছিল ক্লিপ জোড়ার কথা।
“পারফিউম? সেই ক্লিপ জোড়া?”
“কোন ক্লিপ?”
জুহির মনে হলো আন্দ্রেজ হয়তো তার সাথে না জানার ভাণ ধরছে। ক্লিপ জোড়া তার জন্যই কিনেছে, হয়তো পরে দেবে। সে বললো,
“না, কিছু না।”
হঠাৎ পার্টি এরিয়ায় ক্যানিয়লকে ঢুকতে দেখে জুহি বিস্মিত হলো। ঝটপট এগিয়ে এসে বললো,
“তুমি? তোমাকে তো ইনভাইট করিনি তুমি এসেছো কেন?”
ক্যানিয়ল আস্ফালন চোখে চেয়ে বললো,
“আমার আসতে যেতে ইনভাইটের প্রয়োজন পড়ে না। আমি যেখানে ইচ্ছা সেখানে রাজত্ব করতে পারি।”
বলে জুহিকে ঠেলে সামনে থেকে সরিয়ে দিলো। তারপর শিথিল পা ফেলে এগোতে লাগলো সামনে। তার থেকে কিছুটা দূরেই দাঁড়িয়ে আছে ইরতিজা। ইরতিজার দু চোখে মুগ্ধতা। ছেলেটা কি আজকের দিনে বেশি সুন্দর হয়ে উঠেছে? না কি সব সময়ই এত বেশিই সুন্দর লাগে ছেলেটাকে? ইরতিজা টের পাচ্ছে তার হৃৎপিণ্ডের চলন স্বাভাবিক অবস্থা হারাচ্ছে। ক্রমশ অস্বাভাবিক হয়ে উঠছে।
ক্যানিয়ল ইরতিজার সামনে এসে থামলো। ক্যানিয়লের চোখ জোড়ায় চোখ পড়তেই কোন জাদুবলে ইরতিজার দৃষ্টি আটকে গেল কে জানে! ক্যানিয়ল মৃদু স্বরে বললো,
“আমার ভায়োলেট কুইন, এত মুগ্ধ চোখে চেয়ে থেকো না। তোমার এমন দৃষ্টিতে আমার সৌন্দর্য লজ্জা পেয়ে মুখ লুকাবে।”
ইরতিজা হঠাৎ লজ্জা পেয়ে গেল ক্যানিয়লের কথায়। চোখ সরিয়ে নিলো সে।
জুহি এসে ক্যানিয়লকে শুধালো,
“তুমি এমনিতেই বিনা ইনভাইটে এসেছো, তারউপর একটা গিফটও আনোনি?”
ক্যানিয়ল জুহির দিকে চেয়ে বললো,
“আমার মতো ধনী একজন ব্যক্তি তোমার মতো নগণ্য একজন মানুষের জন্মদিন পার্টিতে এসেছে, সেটাই যথেষ্ট নয়? এটা নিয়েই গর্বিত থাকা উচিত তোমার।”
“আমি নগণ্য?” রেগে গিয়ে বললো জুহি।
“অবশ্যই, তুমি গণ্য করার মতো ব্যক্তি নও। পৃথিবীর বুকে অতি সামান্য একটা প্রাণী।”
“আর তুমি খুব অসামান্য?”
“তার থেকেও বেশি কিছু।”
“আজ আমার জন্মদিন, তোমার সাথে কথা বলে মুড নষ্ট করতে চাইছি না আমি।”
“হ্যাঁ, তুমি এখন আমার সামনে থেকে সরে যাও। আমিও তোমার এত সুন্দর মুখে দাগের সৃষ্টি করতে চাইছি না।”
“এর মানে?”
ক্যানিয়ল জুহির দিকে একটু এগিয়ে এসে বললো,
“তোমার কি ধারণা আমার হাতের একটা ঘু’সি তোমার মুখে দাগ তৈরি করতে অক্ষম?”
জুহির ভিতরে থাকা রাগ নিজেদের উন্মুক্ত করতে মরিয়া হয়ে উঠছিল, কিন্ত তা উন্মুক্ত হওয়ার আগেই ইরতিজা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এলো। সে জুহির কাছে এসে বললো,
“এটা তোমার বার্থডে পার্টি। মাথা গরম করে পরিবেশ নষ্ট করো না। বদনাম হবে। ওদিকে চলো।”
ইরতিজা জুহিকে নিয়ে ওদিকটায় যাওয়া দিলে ক্যানিয়ল ইরতিজার একহাত ধরে ফেলে বললো,
“হোয়্যার আর ইউ গোয়িং? আমাকে তোমার দেখা হলেও, তোমাকে দেখা সম্পূর্ণ হয়নি আমার। আমার সামনে স্থির থাকো। আর আমার দৃষ্টি জোড়া স্থির থাকুক তার প্রিয়র উপর। তুমি কিন্তু আমার প্রিয় নও পাকিস্টানি গার্ল! তবে কি তুমি আমার চোখের প্রিয়? না কি তুমি আমার মনের প্রিয়?”
ইরতিজার অন্তঃকরণে সুপ্ত অনুভূতির ধারা ঝরলো। কিন্তু হঠাৎই আবার তা ঝাঁঝাঁ রোদ্দুরে শুকিয়ে কাঠ হলো ভয়ে। তার বুক ধকধক করে উঠলো। গলা শুকিয়ে আসছে। ক্যানিয়লের তো ভয় নেই, কিন্তু তার আছে। ক্যানিয়ল এখানে এমন সময়ে এমনভাবে তার হাত ধরতে একবারও ভাবেনি, কিন্তু এমনভাবে হাত ধরেছে বলে তার ভাবতে হচ্ছে শত কথা। শত চিন্তা মস্তিষ্ক খাঁমচে ধরেছে। ফ্যামিলির কেউ যদি ক্যানিয়লের এই হাত ধরার দৃশ্যটা দেখে তাহলে নিশ্চয়ই তার জীবনে আরও একটা বিপর্যয় নেমে আসবে! ঠিক যেমন অর্টন চুমু খেয়েছিল বলে নেমে এসেছিল, ঠিক তেমনিভাবে। ইরতিজা আশেপাশে একবার সচকিত নজর বুলিয়ে নিলো। ফ্যামিলির কাউকে আশেপাশে দেখতে পেল না। স্বস্তি অনুভব করলো সে। কিন্তু তার ধারণায় রয়ে গেল একটা ভুল। ফ্যামিলির একজন ঠিকই দেখেছে সবটা। ক্যানিয়লের প্রবেশ থেকে শুরু করে এ যাবৎ ঘটা কিছুই তার দৃষ্টি এড়ায়নি।
(চলবে)
#উড়ো_পাতার_ঢেউ
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ৪৮
_________________
“হাত ছাড়ো ক্যানিয়ল।” ক্যানিয়লের দিকে ফিরে বললো ইরতিজা।
ক্যানিয়ল ছাড়ার বদলে যেন আরও শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো। ইরতিজার চক্ষু কপালে উঠলো। বললো,
“ছাড়ো, বুঝতে পারছো না তুমি।”
“নিজ থেকে ছাড়িয়ে নাও।”
ইরতিজা উদ্বিগ্ন হয়ে আশেপাশে তাকালো। ভিড়ের মাঝখান থেকে নওরিন যে তাদের উপর দৃষ্টি ক্ষেপন করে আছে তা একটিবারের জন্য দেখতে পেল না। ইরতিজা ক্যানিয়লের কথা মতোই কাজ করলো। জোরে এক ছিটকা দিয়ে সে ক্যানিয়লের হাত থেকে নিজের হাত মুক্ত করে এখান থেকে যেতে উদ্যত হলো। ঠিক তখনই ক্যানিয়ল আবারও তার হাত ধরে ফেললো। থেমে গেল ইরতিজা। তার ভিতরের গুচ্ছবিদ্ধ ভয় এবার বিকট শব্দের বিস্ফোরণে ছড়িয়ে পড়লো। হৃৎপিণ্ড কাঁপতে শুরু করলো থরথর করে।
ক্যানিয়ল পিছন থেকে এসে বললো,
“আমার শক্ত হাতের শক্ত বাঁধন ছিন্ন করা এত সহজ নয় পাকিস্টানি গার্ল। আমি চেয়েছি বলেই তুমি এই বাঁধন ছিন্ন করতে পেরেছো। নরম হাতের নরম বাঁধন ছিন্ন করেছো। আমি কখনও এমন নরম প্রকৃতির ছিলাম না। আমি ছিলাম সব সময়ই কঠিন। কিন্তু তুমি আমায় পরিবর্তন করে দিয়েছো! এমন পরিবর্তন করার জন্য তোমার কঠিনতম শাস্তি হওয়া উচিত। কিন্তু আমি তোমায় শাস্তিও দিতে পারছি না। ভেবে দেখো, কেমন বাজে পরিবর্তন এনেছো তুমি আমার মাঝে। তোমার কী ধারণা? তোমার স্টুপিড কাজিনের বার্থডে সেলিব্রেট করতে আমি এখানে এসেছি? উহুঁ, এটা তো কেবল অজুহাত।
আমার আসলে অজুহাতের প্রয়োজন পড়ে না। কারণ নিজের যা ইচ্ছা তাই করার ক্ষমতা রাখি আমি। কিন্তু দেখো, এখন ব্যাপারটা এমন যে আমি একটা অজুহাতকে আঁকড়ে ধরছি। তোমাকে দেখতে আসার ইচ্ছা একটা অজুহাতের মাধ্যমে পূরণ করছি। কেন করছি এরকম? আমি ইচ্ছা হলেই তোমাকে দেখতে আসার ক্ষমতা রাখি না? সেই ক্ষমতা নেই আমার? ক্ষমতা আছে তো। আমি চাইলে সকাল, সন্ধ্যা, রাত সব সময় তোমাকে দেখতে আসতে পারি। এমনকি তোমাকে তুলে নিয়ে গিয়ে সামনে বসিয়ে রেখেও দেখতে পারি। কিন্তু তাও অজুহাত ধরেই আসলাম আমি!”
ক্যানিয়লের এই অকপটে বলা কথা গুলোতে ইরতিজার ভিতর তোলপাড় শুরু হয়ে গেল। মস্তিষ্ক যেন অচল হয়ে পড়তে চাইছে, কিন্তু ইরতিজা তা হতে দিলো না। সে হাতটা এবার অতি সহজভাবে ছাড়িয়ে নিয়ে বললো,
“আমাকে দেখা হয়নি? এখন চলে যাও।”
“একটা মোমের পুতুল বানালে কেমন হয়?”
“মোমের পুতুল মানে?”
“তোমার চেহারা এবং আকৃতিতে একটা মোমের পুতুল বানাতে হবে।”
বলে ঠাট্টা করে হাসলো ক্যানিয়ল। তারপর গলার স্বর হঠাৎ গাম্ভীর্য করে বললো,
“তোমায় এত সুন্দর লাগছে কেন? বেশি সেজেছো? তোমার উচিত নিজেকে যথাসম্ভব অসুন্দর রাখা এই মুহূর্তে। আর তুমি…”
ক্যানিয়ল আরও গম্ভীর ভাব ধারণ করে বললো,
“দ্রুত নিজেকে অসুন্দর করে তোলার প্রক্রিয়া প্রয়োগ করো, নয়তো হাত-পা উভয়ই ভে/ঙে দেবো তোমার।”
ইরতিজার কম্পমান হৃৎপিণ্ড আরও তীব্রভাবে কেঁপে উঠলো। ক্যানিয়লের শেষ কথাটাতে সে পুরোনো ক্যানিয়লের আচরণকে উপলব্ধি করতে পারলো।
ক্যানিয়ল আর কিছু না বলে হঠাৎই চলে গেল পার্টি থেকে। রিশন এতক্ষণ দূর থেকে ওদেরকে লক্ষ করছিল। সে এবার এগিয়ে এসে ইরতিজার কাছে জানতে চাইলো,
“ক্যানিয়ল এতক্ষণ ধরে কী বললো তোমাকে?”
ইরতিজা প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো,
“তোমরা এই পার্টি আর কতক্ষণ দীর্ঘ করতে চাইছো? স্নো ফল হবে তা কি ভুলে গেছো?”
“স্নো ফল এখনও অনেক পরে হবে। ততক্ষণে তুমি পার্টি শেষ করে ঘুমের প্রস্তুতি সম্পন্ন করে এক দফা ঘুমিয়েও নিতে পারবে।”
___________________
নিস্তব্ধ রাত। আকাশ থেকে ঝরে পড়ছে বরফ কণা। তাদের ঝরে পড়ার গতি শান্ত। পৃথিবীর এক খণ্ড জায়গা সাদা করে দিচ্ছে নিজেদের অস্তিত্ব দ্বারা। এই শান্ত রজনীর শান্ত ঝরে পড়া তুষারপাতের মাঝে একটি অশান্ত মনের মানব বিছানায় শুয়ে আছে ব্যাকুলতা নিয়ে। মানসপটে কেবল দৃশ্যমান হচ্ছে একটি শ্যামবরণ মুখ! ক্যানিয়ল এক কাত থেকে অন্য কাতে ফিরে শুলো। রাত যত গভীর হচ্ছে তার অন্তঃকরণের অস্থিরতা তত বাড়ছে। এটা কেমন যন্ত্রণা? সে শেষমেশ শয়ন থেকে উঠে যেতে বাধ্য হলো। অস্থিরতায় একটা বালিশ ছুঁড়ে মারলো ফ্লোরে। অতঃপর বিছানা থেকে নামলো। ক্লোজেট খুলে একটা জ্যাকেট বের করে পরে নিলো গায়ে। মাথায় টুপি পরে নিতেও ভুললো না। রুম থেকে বের হলো। এখন সে নিজের মেইন বাড়িতে আছে। তবে মেইন বাড়িতে থাকলেও আজকে সে একবার ভুল করেও ড্যাডের সামনে পড়েনি। রাম্মিকা লিভিংরুমে বসে আর্ট করছিল। মেয়েটার আর্টের প্রতি ঝোঁক আছে। বাড়ির কেউ এখন জেগে নেই। অন্তঃকরণে এমন ছটফটানি শুরু না হলে হয়তো ক্যানিয়লও এখন নিদ্রার দেশে পাড়ি জমাতো। কিন্তু এই মেয়েটা এখনও জেগে জেগে আর্ট করছে। ক্যানিয়ল রাম্মিকাকে দেখে থাকলেও কোনো প্রতিক্রিয়া না করে নির্বিকার ভাবে সদর দরজার দিকে এগোচ্ছিল। রাম্মিকা ক্যানিয়লকে দেখে অবাক হয়ে বলে উঠলো,
“এত রাতে কোথায় যাচ্ছ?”
ক্যানিয়ল ক্ষণিকের জন্য পিছন ফিরে উত্তর দিলো,
“একজনের ঘুম কাড়তে।”
“মানে?”
ক্যানিয়ল যেতে যেতে বললো,
“ওর ঘুম না ভাঙিয়ে আমি ঘুমাতে পারবো না।”
রাম্মিকা কিছু বুঝতে পারলো না। কার ঘুম ভাঙানোর কথা বলছে? এতরাতে কার ঘুম ভাঙাতে যাচ্ছে?
ক্যানিয়লের গাড়ি থামলো ইরতিজাদের এরিয়ায় এসে। তুষারপাতের মাঝে গাড়ি চালানো খুব কষ্টকর একটা কাজ। অনেক সময় এক্সিডেন্টও ঘটে।
ক্যানিয়ল ইরতিজাদের বাসার সামনে এসে কল করলো ইরতিজাকে। ইরতিজা তখন গভীর ঘুমের আচ্ছাদনে জড়িয়ে আছে। রিংটোনের শব্দ তার ঘুমকে পাতলা করে দিলো। পিটপিট করে চোখ মেললো সে। কলারের নাম না দেখেই কল রিসিভ করলো।
“হেই পাকিস্টানি গার্ল, আর ইউ স্লিপিং?”
“ইয়াহ।” ঘুম জড়ানো ক্ষীণ গলায় উত্তর দিলো ইরতিজা।
“আই অ্যাম ইন ফ্রন্ট অব ইওর হাউজ।”
“হোয়াট?” ইরতিজার ঘুম এক ছুটে পালিয়ে গেল। সে মোবাইলে সময় দেখে নিলো।
“এত রাতে তুমি আমার বাসার সামনে মানে?”
ইরতিজা উঠে বসলো। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখলো তুষারপাত ঝরছে।
“এখন তো তুষারপাত হচ্ছে!”
“হ্যাঁ হচ্ছে। এই তুষারপাতের মাঝেও তুমি আমাকে আসতে বাধ্য করেছো। তোমাকে একদিন বলেছিলাম, তুমি আমার চোখে ভেসে উঠে আমার ঘুম নষ্ট করবে না। কিন্তু তুমি তো অবাধ্য! কথা শোনোনি। ঠিকই চোখে ভেসে উঠে আমার ঘুমে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছো। আর এখন তো আমার মনের সাথেও…”
ক্যানিয়লের কণ্ঠ হঠাৎ থেমে গেল। কণ্ঠের দ্রুত গতি শিথিল হয়ে এলো,
“আর এখন তো আমার মনের সাথেও যাচ্ছেতাই করছো। এটার জন্য উপযুক্ত শাস্তি দেওয়া প্রয়োজন তোমাকে। আমি আর তোমাকে শাস্তি না দিয়ে পারছি না। আমি তোমার জন্য খুব কঠিন একটা শাস্তি প্রস্তুত করেছি।”
“শ…শাস্তি?”
“হুম, খুব কঠিন শাস্তি। তুমি এখনই আমার সাথে দেখা করো।”
“কী বলছো? এত রাতে কী করে দেখা করবো? সম্ভব নয়।”
“সম্ভব নয় কেন? আমি কি আমার বাড়ি থেকে তোমার বাড়িতে আসিনি এত রাতে? তাহলে তুমি কেন তোমার বাসার সামনে এসে আমার সাথে দেখা করতে পারবে না? শোনো, দেরি করো না। আমি জমে যাচ্ছি বরফে। হারি আপ।”
“আমার আব্বু জেগে গেলে…”
“তুমি কি চাও তোমার ড্যাড, মাদার, সিস্টারকেও আমি জাগিয়ে তুলি ঘুম থেকে?”
“নো নো, আই ডোন’ট ওয়ান্ট দ্যাট!”
“তাহলে তাড়াতাড়ি এসো। এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে আমার। উফ, কী ঠান্ডা! মনে হচ্ছে আমিও একটা বরফের খণ্ডে পরিণত হতে চলেছি।”
ইরতিজা দ্রুত গায়ে উষ্ণ কাপড় পরে নিয়ে বেরিয়ে এলো বাসা থেকে। ক্যানিয়লের এত রাতে পাগলামি করার মানে সে বুঝতে পারছে না। এত রাতে কেন এসেছে? ইরতিজা খুব সাবধানে বের হয়েছে বাসা থেকে। একটুখানি শব্দের উৎপত্তিও করেনি বের হওয়ার সময়। বাসার সামনে লাইট জ্বলছে। পার্টির জন্য যে লাইট আনা হয়েছিল তার ভিতর থেকে একটা এখনও জ্বলছে। হয়তো অফ করতে ভুলে গেছে। ইরতিজা সেই লাইটের আলোয় স্পষ্ট দেখতে পেল ক্যানিয়লকে।
ইরতিজা লনের উপর জমাট বাঁধা বরফের উপর পা ফেলে এগিয়ে এলো। ক্যানিয়লের সম্মুখে দাঁড়িয়ে বললো,
“কেন এসেছো এত রাতে?”
“তোমাকে শাস্তি দিতে!”
“হুম?”
“কিছু বলতে এসেছি।”
“সেটা তুমি আগামীকালও বলতে পারতে।”
“আগামীকাল নয়, এটা এখনই বলা প্রয়োজন।”
“বেশ, তাহলে বলো।”
কীভাবে বলবে? কীরকম ভাবে বলা উচিত? কোনো প্রস্তুতি না নিয়েই চলে এসেছে। ক্যানিয়ল বুঝতে পারছে না তার কীরকম ভাবে কথাটা বলা উচিত! অন্তঃকরণ কেমন অস্থিরতায় কাঁপছে। সে স্বাভাবিকতা আনার চেষ্টা করে ইরতিজার চোখের দিকে তাকালো। হঠাৎই চড়া গলায় বলে উঠলো,
“তোমার কি মনে হয় না তুমি একজন অপরাধী?”
ইরতিজা চমকে গিয়ে বললো,
“আমার এমনটা কেন মনে হবে?”
“কারণ তুমি অন্যায় করেছো!”
ইরতিজা এবার আরও বেশি চমকালো। অবাক হয়ে জানতে চাইলো,
“কার সাথে?”
ক্যানিয়ল সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলো না। কিছু সময় নীরব তাকিয়ে রইল ইরতিজার বিস্ময়, কৌতূহলী আঁখি জোড়ায়। এরপর বললো,
“আমার হৃদয়ের সাথে!”
ইরতিজার দু চোখে বিস্ময় প্রস্ফুটিত হলো। হৃদয়ে জাগ্রত হলো প্রবল শিহরন। বিস্ময়াবিষ্ট নেত্র জোড়া ক্যানিয়লের দিকে স্থির হয়ে রইল অপলক।
ক্যানিয়ল বললো,
“আমার হৃদয়ের সাথে খুব কঠিন অন্যায় করেছো তুমি! এই অন্যায়ের সাজা লিখতেও হিমশিম খেতে হচ্ছে আমাকে। তোমার জন্য আমার হৃদয় এখন আবোল-তাবোল বকছে। বলছে, তোমাকে প্রয়োজন। আমার জীবনের প্রতিটা দিনে তোমাকে প্রয়োজন এমনটা বলছে!”
হঠাৎই এক দমকা হাওয়া বইলো যেন। সেই দমকা হাওয়া যেমন দেহকে শীতল করে শিরশিরে এক কাঁপন তৈরি করলো, ঠিক তেমনি এই হাওয়ার ঝাপটা সমগ্র হৃদয় উপকূলও শীতলতায় সমাচ্ছন্ন করলো এবং সেই সাথে হৃদয়ে শিরশিরে কাঁপনও উপলব্ধমান। সুমধুর স্বপ্ন! হ্যাঁ, সমধুর স্বপ্ন! ইরতিজার মনে হচ্ছে এটা একটা সুমধুর স্বপ্ন বৈ আর কিছুই না। ক্যানিয়ল কি আসলেই বাস্তবে তাকে এই কথাগুলো বলছে?
“তুমি কী করেছো আমার হৃদয়ের সাথে? এমন কেন করছে হৃদয়? তুমি কি জাদুকর? জাদু করেছো? জাদু ব্যতীত এটি এমন কেন করবে? ইউ আর আ ম্যাজিকাল গার্ল?”
ইরতিজা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনে যাচ্ছে ক্যানিয়লের কথা। সে তো জাদুকর নয়, জাদুকর তো ক্যানিয়ল। ক্যানিয়ল নিজের জাদুতে বশীভূত করছে তাকে।
ক্যানিয়ল বললো,
“তুমি আমার চোখের প্রিয়, আমার মনের প্রিয়, আমারও প্রিয়! জানি না কখন, কীভাবে হয়ে উঠেছো। কিন্তু তুমি আমার প্রিয়। পাকিস্টানি গার্ল, আমি নির্ধারণ করতে পারছি না তোমার শাস্তি কী হবে! তুমি কি আমাকে সাহায্য করবে? দয়া করে তুমি বলো, আমি কী শাস্তি দিতে পারি তোমায়?”
ইরতিজা সম্মোহিত হয়ে চেয়ে রয়েছে। প্রকৃতিতে বহমান শীতল আবহাওয়া তার মনেও প্রভাব ফেলেছে। শীতলতা জমিয়ে দিয়েছে তার ভিতরের সকল অনুভূতি। কেবল একটা অনুভূতি সচল। ভালোবাসার অনুভূতি!
“ইউ নো? তোমার জন্য ড্যাড সাইকোলজিস্টের কাছে অ্যাপয়ন্টমেন্ট রেখেছিল আমার জন্য। এমনকি আমি ড্যাডকে বলেছি আমি মিরান্ডাকে বিয়ে করবো না। ড্যাড ভাবছে আমার মানসিক কোনো প্রবলেম ক্রিয়েট হয়েছে হয়তো। তুমি কি এখন বুঝতে পারছো, তুমি কত বড়ো অন্যায় করেছো? কত বড়ো অপরাধী তুমি? আমি এখন এমন অনুভব করছি যে, তোমাকে আমার সারাজীবনের জন্য প্রয়োজন। তুমি কি বুঝতে পারছো আমার হৃদয়কে? আমার হৃদয়ের অবস্থা?”
ক্যানিয়ল একটু সময় বিরতি নিয়ে আবার বললো,
“আমি আর তোমাকে বিনা শাস্তিতে ছেড়ে দিতে পারি না। আমি তোমাকে শাস্তি দেবো। এবং ইতোমধ্যে আমি একটা শাস্তি তোমার জন্য প্রস্তুত করেছি।
পাকিস্টানি গার্ল, উইল ইউ বি মাই মিসেস উমরান?”
(চলবে)