উড়ো পাতার ঢেউ পর্ব-৫১+৫২

0
326

#উড়ো_পাতার_ঢেউ
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ৫১
_________________

শীতল হাওয়া প্রবাহিত হচ্ছে। আকাশের বুকে আলোর রেখা নেই। থমথমে।
দৃশ্যটা দেখে চোখ জ্বালা করছে ক্যানিয়লের। সে স্থির বসে থাকতে পারলো না। গাড়ি থেকে নেমে এলো।
হঠাৎ ক্যানিয়লকে দেখে জোনাস অপ্রত্যাশিতভাবে হতভম্ব হয়ে গেল। কখন যে সে ইরতিজাকে ছেড়ে দিলো তা নিজের খেয়াল থেকেই অদৃশ্য। ইরতিজাও ক্যানিয়লকে দেখার পর একেবারে শান্ত হয়ে গেল। সে ক্যানিয়লের মাঝে হিংস্র প্রতিচ্ছবি দেখতে পাচ্ছে।
ক্যানিয়ল এসেই বিনা বাক্যে জোনাসকে খুব বাজেভাবে একটা ঘু’সি মারলো। জোনাস পড়ে গেল মাটিতে। রাগে মুখমণ্ডল ক্রমাগত কাঁপছে ক্যানিয়লের। সে জোনাসকে মারার জন্য এগোনো দিলেই ইরতিজা তার হাত টেনে ধরলো। বললো,
“নো, ডোন্ট ডু ইট।”

ক্যানিয়ল ইরতিজার কথা উপেক্ষা করে জোনাসের দিকে আবার পা বাড়ালেই ইরতিজা শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো ক্যানিয়লের হাত।
“প্লিজ ক্যানিয়ল! ডোন্ট হিট হিম!”

ক্যানিয়ল নিজের মাঝে বিরাজমান হিংস্র মনোভাবটা শান্ত করার চেষ্টা করলো এবার। প্রচণ্ড রাগান্বিত সে। জোনাসকে কটমট করে বললো,
“ইউ আর আ পাঙ্ক! তোমার সাহস কীভাবে হলো ইজাকে জড়িয়ে ধরার? তোমাকে ভালোয় ভালোয় একদিন বুঝিয়ে বলেছিলাম আমি। তারপরও আজ এই দৃশ্য দেখতে হলো আমার! ইচ্ছার বিরুদ্ধে জড়িয়ে ধরার অপরাধ জানো? ইজা আমাকে থামিয়েছে, নাহলে এই অপরাধের যথাযথ শাস্তি দিতাম আমি তোমাকে।”

বলে ক্যানিয়ল আবারও এগোনোর চেষ্টা করলে ইরতিজা আরও গভীর ভাবে আঁকড়ে ধরলো ক্যানিয়লকে। তার দু চোখে জলের আবির্ভাব ঘটেছে। সে চেনে ক্যানিয়লকে। বেলিকের কথা তার মনে আছে। কী করুণ অবস্থা হয়েছিল বেলিকের। সে সময় সে নিজেই চেয়েছিল বেলিক মার খাক। কিন্তু জোনাসের শারীরিক আঘাত তো সে মেনে নিতে পারবে না। এ সহ্য করার মতো নয়। জোনাসকে সে ঘৃণা করে এ কথা সত্য। কিন্তু তার হৃদয়ের এক অংশে এখনও বন্ধুত্বের মায়া ছায়া ফেলে আছে। পরিস্থিতিটা এমন যে ইরতিজার দু চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়লো। সে অনুরোধের সুরে বললো,
“প্লিজ, করো না এরকম।”

ব্যথায় বিষ হয়ে গেছে জোনাসের নাক। সে তার নাক চেপে ধরলেই হাত ভিজে গেল তরল পদার্থে। তরল পদার্থ দু চোখে দর্শন করলেই দেখতে পেল তার হাত তাজা র’ক্তে ভেজা। নাক বেয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগলো রক্ত। সে আবারও নাক চেপে ধরলো। আঘাতটা এত মারাত্মকভাবে লেগেছে যে সে এই মুহূর্তে কোনো কিছু বলার চেতনাতেই নেই।

ক্যানিয়ল রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বললো,
“ওয়াশিংটন থেকে চলে যাও। বুঝতে পেরেছো? না জানি কবে আমার হাতে মা’র খেয়ে অর্ধ মৃ’ত হও! তার আগে চলে যাও। ইজার সাথে এমন করার কথা পুনরায় চিন্তা করার দুঃসাহস দেখিয়ো না একদম। তাহলে বেলিকের থেকেও অত্যন্ত করুণ অবস্থা হবে তোমার। আমি তোমাকে এবার ছাড় দিচ্ছি। কিন্তু এই ছাড় দ্বিতীয়বার পাবে না।”

ক্যানিয়ল ইরতিজার হাত ধরে ওকে টেনে নিয়ে এলো। গাড়ির দরজা খুলে ওকে গাড়িতে বসিয়ে দিলো। ইউনিভার্সিটির দিকে আর গেল না। গাড়ি ঘুরিয়ে রেডমন্ডের দিকে ফিরতে লাগলো। ইরতিজা নিঃশব্দে কাঁদছে। এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হবে ভাবতে পারেনি। সে যেতে যেতে একবার জানালা দিয়ে জোনাসকে দেখলো। জোনাস যেরকম ছিল এখনও সেরকমই আছে, উঠে বসেনি পর্যন্ত।
ক্যানিয়ল ইরতিজাকে কাঁদতে দেখে বললো,
“কেন কাঁদছো? ওকে মেরেছি বলে?”

ইরতিজা দুই পাশে মাথা নেড়ে জানালো,
“না।”

“তাহলে? কান্না থামাও। কান্নাদেরও কি এখন মা’রধর করতে হবে?”

ইরতিজা কান্না চাপার চেষ্টা করলো। দুই হাতে চোখের অশ্রু মুছে নিয়ে তাকালো ক্যানিয়লের দিকে। বললো,
“তোমার কী অবস্থা? কেমন আছো তুমি?”

ক্যানিয়ল ইরতিজার হাতটা নিয়ে নিজের কপালের ক্ষত স্থানটার উপর রাখলো। বললো,
“ছুঁয়ে দেখো না কেন? ছুঁয়ে না দেখলে বুঝবে কী করে কতটা আছি ভালো?”

“ছুঁয়ে কি বোঝা যায়? আমি বুঝতে পারছি না।”

ক্যানিয়ল কপাল থেকে ইরতিজার হাত নামিয়ে ফেললো। বললো,
“তাহলে হৃদয় ছুঁয়ে দেখো মেয়ে। হৃদয় ছুঁয়ে দেখলে সব বোঝা যায়, ভালো আছি না কি মন্দ!”

“হৃদয় কি ছুঁয়ে দেখা যায়?”

ক্যানিয়ল ইরতিজার হাতটা এবার বুকের বাঁ পাশে নিয়ে রাখলো। বললো,
“এখন বলো, আমি ভালো আছি না কি মন্দ?”

ইরতিজা বিব্রত বোধ করলো। তাই হাতটা সরিয়ে আনলো তাড়াতাড়ি। বললো,
“আমি বুঝতে পারছি না কিছু।”

ক্যানিয়ল যেন চমকালো,
“হৃদয়ের মানুষ হৃদয় ছুঁয়ে বুঝতে পারছে না? এটা প্রেয়সীর মিথ্যাবাদী রূপ নয়তো?”

ইরতিজা বললো না কিছু। ক্যানিয়ল বললো,
“কদিন পর মিসেস উমরান হতে চলেছো, সৎ হও পাকিস্টানি গার্ল। ইউ নো আমি কত সৎ? মিসেস উমরানের অসৎ আচরণ কীভাবে গ্রহণযোগ্য হবে? বলে দিলেই পারো, আমার হৃদয়ে নিজেকে উপলব্ধি করছো।”

ইরতিজা অবাক হয়ে চাইলো। ক্যানিয়ল তার মন-টন পড়ে ফেলছে না তো কোনো রকমভাবে? সে বেশ সন্দিহান অনুভব করলো।

আকাশের বুক চিরে বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। ইরতিজা জানালা দিয়ে বৃষ্টি মুখর প্রকৃতিকে দেখছে। জোনাসের কথা মনে পড়লো এক মুহূর্তের জন্য। জোনাস কি এখন হাসপাতালে গিয়েছে? না কি এখনও সেই নদীর পাড়ে আছে? ছেলেটা খুব পাগল! দ্বিতীয়বার তাকে প্রোপোজ করলো কোন আক্কেলে? কেন এত পাগলামি করে? কেন আজ এমন একটা পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো? দীর্ঘশ্বাস ফেললো ইরতিজা।
হঠাৎ তার মনে হলো গাড়িটা ভিন্ন একটা পথে যাচ্ছে। এটা তাদের এরিয়ার রাস্তা নয়। ইরতিজা একটু খেয়াল চোখে তাকালো। চেনা চেনা লাগছে, কিন্তু ঠিকঠাকভাবে স্মরণে আসছে না। ক্যানিয়লের কাছে জানতে চাইলো,
“কোথায় যাচ্ছি আমরা?”

“ট্রি হাউজে।”
___________

ট্রি হাউজে আসতে গিয়ে পায়ে কাঁদা লেগে গেল একটুখানি। কাঁদাটুকু পরিষ্কার করে নিলো ইরতিজা। ছাতা না থাকায় গাড়ি থেকে বের হয়ে ট্রি হাউজ অব্দি আসতে গিয়ে বৃষ্টিতে অনেকটাই ভিজে গেছে দুজনে। শীত পরিবেশ। ঘরের ভিতরটা উষ্ণ করার জন্য ফায়ারপ্লেসে আগুন জ্বালালো ক্যানিয়ল। গায়ের ওভার জ্যাকেটটা খুলে রাখলো। ইরতিজা বললো,
“এখানে কেন এলাম?”

“বাড়িতে গিয়ে কী করতাম?”

বলে ক্যানিয়ল কিচেনে চলে গেল। বৃষ্টির মাঝে এক কাপ কফি খেলে মন্দ হয় না। কফির সাথে সে কিছু শুকনো ফলও নিলো। রুমে এসে দেখলো ইরতিজা নেই সেখানে। চমকে উঠলো ক্যানিয়ল। কোথায় গেল মেয়েটা?
সে বাইরে বেরিয়ে এলো তাৎক্ষণিক। অলিন্দে দাঁড়িয়ে এদিক-ওদিক দৃষ্টি বুলাতেই ট্রি হাউজের পাশে থাকা দোলনাতে চোখ আটকে গেল। দেখতে পেল দোলনাতে দোল খেতে খেতে উল্লাসে বৃষ্টি উপভোগ করছে এক শ্যামবতী সুন্দরী। দৃশ্যটা তাকে ভীষণ মুগ্ধ করলো। সে এসে অলিন্দের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়ালো। মেয়েটা কীভাবে এই শীতের মাঝে বৃষ্টিতে এত স্বাচ্ছন্দ্যে ভিজতে পারে? ক্যানিয়লের খেয়াল হলো সে নিজেও ভিজছে। তার মাথার ক্যাপটা হয়তো বেশিক্ষণ শুষ্ক থাকবে না। তার ক্ষত স্থানও ভিজে যাবে। সত্যি কথা বলতে এই বৃষ্টির পরশ এই মুহূর্তে উপলব্ধমান হচ্ছে না তার। সে নিচে নেমে এলো। এসে দাঁড়ালো ইরতিজার পিছনে। দোলনাটা পিছন দিকে যখন ধেয়ে আসছে তখন সেটা এসে ধাক্কা দেওয়ার আগেই দুই হাত দিয়ে দোলনাটা থামিয়ে দিলো ক্যানিয়ল। ইরতিজা ঘাড় ঘুরিয়ে পিছন চাইলো। ক্যানিয়ল গভীর নেত্রতে চেয়ে থেকে বললো,
“তুমি ভিজছো বৃষ্টিতে প্রিয়! আর আমার দু চোখ, হৃদয়ভূমি ভিজে যাচ্ছে তোমার মুগ্ধতায়।”

ক্যানিয়ল ইরতিজার দু গালে আলতো হাত রেখে বললো,
“তোমার সৌন্দর্য ব্যাখ্যা করার ক্ষমতা আমার নেই। তুমি অবর্ণনীয়! ঠিক আমার অনুভূতির মতোই।”

_________________

ইরতিজা বারান্দায় বসে আকাশের দিকে চেয়ে আছে। আকাশ পরিষ্কার। তার মনটা ভীষণ ভালো ঠেকছে আজকে। মোবাইলে গান বাজছে। আজ কতদিন পর গান শুনছে নিজেই জানে না। হঠাৎ গান বন্ধ হয়ে গিয়ে কলের শব্দ শোনা গেল। সাজিদের নামটা দেখতে পেয়ে মুখ কালো হয়ে গেল তার। অবসন্নভাব এসে বিরাজ করলো বক্ষস্থলে। তার কষ্ট শূন্য হৃদয়ে হঠাৎ ছোটো ছোটো ঘাসের ন্যায় গজিয়ে উঠতে লাগলো কষ্ট। সে বেশ সময় নিয়ে কলটা রিসিভ করলো।

“কেমন আছো?”

“আপনি কেমন আছেন?”

ইরতিজা প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করায় থতমত খেয়ে গেল সাজিদ। বললো,
“আমি ভালো আছি। কিন্তু মনে হচ্ছে তুমি ভালো নেই। তোমার কি জ্বর এসেছে? জ্বরে আক্রান্ত মানুষ অনেক সময় ওলট-পালট কথা বলে।”

“আমি ওলট-পালট কিছু বলেছি?”

“প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে একই প্রশ্ন আমাকে করাটাও ওলট-পালটের ভিতরই পড়ে।”

এপাশে থম মেরে গেল ইরতিজা। বেশ কিছুক্ষণ নীরবতা পালনের পর বললো,
“আপনাকে খুব ইম্পরট্যান্ট একটা বিষয় সম্পর্কে জানাবো সাজিদ।”

“হুম বলো।”

কথাটা কীরকম ভাবে বলা উচিত ভাবছে ইরতিজা। না, কোনো ইতিউতি করবে না। ডিরেক্ট বলে দেওয়াই ভালো হবে। ইরতিজা স্পষ্ট কণ্ঠে বললো,
“আমি একজনকে ভালোবাসি সাজিদ!”

কথাটা শুনে হাসলো সাজিদ। বললো,
“বিয়ে ভাঙার জন্য আর কত পন্থা অবলম্বন করবেন?”

“আপনি হাসছেন? এটা মিথ্যা নয়। আমি সত্যিই ভালোবাসি ওকে।”

“ও তাই? কে সে? আপনার প্রেমিক?”

‘প্রেমিক’ কথাটা শুনে রেগে গেল ইরতিজা। বললো,
“আপনাকে আমি অনেকবার বলেছি জোনাস আমার প্রেমিক নয়। আপনি তারপরও ওকে আমার প্রেমিক বলেন কেন? আর কত বার বলতে হবে ও আমার প্রেমিক নয়? আমি ওকে ভালোবাসি না, আর কখনও ভালোবাসিওনি। আমি…”

“স্যরি। এক কলিগ ডাকছে। তোমাকে পরে কল করবো আমি। রাখছি, বাই।”

সাজিদ কল কেটে দিলো।
ইরতিজা হতবুদ্ধি হয়ে বসে রইল। সাজিদ তার কথা বিশ্বাস করছে না? এ লোক এমন কেন? আগা-গোড়াই আজব মানুষ একজন!

_______________

আজ অপ্রত্যাশিত ভাবেই নওরিনের কাছে হামাদের কল এলো। অনেকদিন পর হঠাৎ হামাদের কল পেয়ে নওরিনের হাত-পা কেমন কাঁপতে লাগলো। সাথে জ্বলজ্বল করে উঠলো ঘৃণার পৃষ্ঠাটা। সে কাঁপা কাঁপা হাতে কলটা রিসিভ করলো।

“হাউ আর ইউ নারিন?”

রাগে, দুঃখে কাঁদতে ইচ্ছা করছে নওরিনের। এই ছেলেটা এতদিন ধরে একবার কল করেনি, একটিবার তার খোঁজ নেয়নি, আজ কল করে জিজ্ঞেস করছে কেমন আছে? নওরিনের খুব কড়া করে একটা উত্তর দিতে ইচ্ছা করলো। কিন্তু সে তা না করে বললো,
“যেমন থাকার কথা তেমনই আছি।”

হামাদ কিছুটা অনুমান করতে পারলো নওরিনের অবস্থা সম্পর্কে। সে ইতস্তত করতে লাগলো। কথাটা কেমন করে বলা উচিত? সে ইতস্তত কণ্ঠে বললো,
“নারিন, আই থিংক আমরা একে অপরের জন্য সঠিক নই। আমার মনে হয় আমাদের সম্পর্কটা এখানে স্থগিত করে দেওয়া উচিত। আমাদের দুজনের বিয়ের সিদ্ধান্ত আসলে একটা ভুল সিদ্ধান্ত ছিল! আমরা তাড়াহুড়ো করে সিদ্ধান্তটি নিয়েছিলাম। আমাদের আসলে সেটা করা উচিত হয়নি।”

নওরিন অবিশ্বাস্য ভঙ্গিতে শুনলো হামাদের কথা। হামাদ এতদিন পর ফোন করে তাকে এই কথা বলছে? এই কথা বলবে বলেই কি কল করেছে? হঠাৎ রাগ গ্রাস করলো নওরিনকে। সে রোষকষায়িত হয়ে বললো,
“কী বললে তুমি? ভুল সিদ্ধান্ত ছিল? এই বিয়ের সিদ্ধান্ত ভুল?”

“বোঝার চেষ্টা করো। মানুষ মাত্রই ভুল হয়। আমরা দুজনই ভুল করেছিলাম বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়ে। তখন আমাদের মনে হয়েছিল আমরা একে অপরকে খুব ভালোবাসি, আমরা সারাজীবন একসাথে কাটাতে পারবো, সেজন্য বিয়ের সিধান্ত নিয়েছিলাম, এনগেজমেন্ট করেছিলাম। কিন্তু ধীরে ধীরে আমি উপলব্ধি করেছি এটা ভুল। আমার মনে হয় না আমি তোমার সাথে সারাজীবন কাটাতে পারবো। আমার মনে হচ্ছে আমি তোমাকে তেমন জোরালো ভাবে ভালোও বাসিনি। এখন এই ভুল সিদ্ধান্তকে পুরোপুরি ভুলে পরিণত না করে চলো এখানেই এই এনগেজমেন্ট ভেঙে দিই। এটা ভাঙা জটিল কোনো ব্যাপার নয়। এর আগে আমার দুজনের সাথে রিলেশন ছিল। ব্রেকআপের পর তাদের অথবা আমার কারোরই তেমন মন খারাপ হয়নি। এটাও তেমনই। এটা গুরুতর কোনো বিষয় নয় যে এটাতে গুরুতর মন খারাপ হবে। দেখো নারিন, আমি অন্য একজনকে ভালোবাসি। এক মাস ধরে তার সাথে আমার রিলেশনশিপ চলছে। আমি চেয়েছিলাম তোমাকে আরও আগেই এটা সম্পর্কে বলতে, কিন্তু পারছিলাম না। জানতাম না তোমাকে এটা কীভাবে বলবো। আমি এখন বলে দিয়েছি। এবং আমি চাইবো তুমি পুরো বিষয়টা বিজ্ঞ ব্যক্তির মতো উপলব্ধি করার চেষ্টা করো। চলো এখানেই থামিয়ে দিই আমাদের মাঝের যাবতীয় সবকিছু।”

নওরিন এতক্ষণ সবকিছু চুপচাপ শুনলো। আর শুনে সে ক্রোধের আগুনে জ্বলছে। বলে উঠলো,
“শু*রের বাচ্চা তোর কাছে সবকিছু তামাশা মনে হচ্ছে? তুই তামাশা করছিস আমার সাথে?”

নওরিন রাগে বাংলা বলে ফেলেছে। হামাদ তাই বুঝতে পারলো না। জিজ্ঞেস করলো,
“কী বলছো?”

নওরিন ইংলিশে যা নয় তাই বলতে শুরু করলো। রাগে পাগলের মতো হয়ে গেল সে। এত উচ্চবাচ্যে চ্যাঁচামেচি করতে লাগলো যে সবাই শুনতে পেল তার কণ্ঠস্বর। তার বেডরুম বেজমেন্টে, সেখান থেকে তার কণ্ঠস্বর প্রত্যেকের কানে এসে পৌঁছলো। তার কথার মাঝে ইংলিশ, বাংলা মিলে হযবরল কাণ্ড বাঁধিয়ে ফেললো। কত বড়ো সাহস হামাদের! এতদিন পর কল দিয়ে তাকে এসব কথা বলছে? অকপটে স্বীকার করছে সবকিছু? নওরিন নিজেও বুঝতে পারছে হামাদকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত তার চরম ভুল ছিল।
নওরিনের কথার তান্ডবে হামাদ কিছু বলারই সুযোগ পাচ্ছিল না আর। সে কিছু না বলে-কয়ে টুপ করে এক সময় কলটা কেটে দিলো। নওরিন তখন আরও বেশি রেগে গেল। ছটফট করতে লাগলো রাগে। তার মধ্যে কষ্ট নেই কোনো। শুধু রাগ আছে এই মুহূর্তে।

আজাদ চৌধুরী মেয়ের চ্যাঁচানো কণ্ঠস্বর শুনে ছুটে এলেন বেজমেন্টে। এসে দেখলেন নওরিনের মুখ লাল হয়ে আছে রাগে। তিনি জানতে চাইলেন,
“কী হয়েছে?”

নওরিন আর বিষয়টা চেপে রাখলো না। পুরো ঘটনাটা খুলে বললো বাবার কাছে। শারমিনও ততক্ষণে বেজমেন্টে এসে গিয়েছিলেন, তিনিও শুনলেন সবকিছু। ইরতিজা বাসায় নেই। জুহি আর রিশনের সাথে বাইরে বের হয়েছে। তাই সে এখনই জানতে পারলো না সবটা।

________________

জুহির পুরো দিনটা আজ মন্দ কেটেছে। কারো সাথেই আজ তার ডেট ফিক্সড হয়নি। কার সাথে ডেটে যাবে ঠিকই করতে পারছিল না। সব ভেবে একজনকে ঠিক করেছে, তাও আবার বিকেলের শেষ মুহূর্তে। তখন ডেটে গিয়ে লাভ কী? ডেট তো করতে হবে আন্দ্রেজকে দেখিয়ে দেখিয়ে। যে ছেলেটাকে ঠিক করেছে সে জুহিদের ইউনিভার্সিটিরই শিক্ষার্থী। তার অবশ্য একটা গার্লফ্রেন্ডও আছে। কিন্তু জুহির এই ছেলেকে ঠিক করা ছাড়া উপায় ছিল না। ছেলেটা ভীষণ সুন্দর। ভার্সিটির টপ সুন্দর বয়ের ভিতর এই ছেলেটাকে ফেলা যায়। ছেলেটাকে ডেটে যাওয়ার জন্য রাজি করাতে খুব কষ্ট করতে হয়েছে জুহিকে। ছেলেটাকে ডেটে যাওয়ার জন্য তাকে ভালো অঙ্কেরই একটা ডলার খেসারত করতে হবে। মূলত এটা একটা অভিনয় যে তারা ডেট করছে।

জুহি পুরো ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলছিল ইরতিজাকে। জুহির চ্যাপ্টার ক্লোজ হলে ইরতিজা নিজের ব্যাপারে বলতে শুরু করলো।
“আমি কী করবো কিছু বুঝতে পারছি না জুহি। রাতে আমি ঠিক মতো ঘুমাতে পারি না এসব ভাবতে ভাবতে। আমার ঠিক কী করা উচিত? ক্যানিয়লকে জানিয়ে দেওয়া উচিত আমার এনগেজমেন্টের ব্যাপারে? ক্যানিয়ল সবটা জানার পর কেমন করবে? তোমার কোনো আইডিয়া আছে এ ব্যাপারে?”

“ক্যানিকে জানানোর দরকার কী? তুমি তো জানোই ক্যানি কেমন। দেখা গেল তোমার এনগেজমেন্টের কথা শুনে সে সাজিদ ব্রোকে মেরে হাত-পা ভে/ঙে দিয়েছে। তখন কী হবে? জেলে তো ঢুকতে হবে তোমার। ক্যানি তো ধনী বাবার ছেলে হিসাবে জেলে ঢোকার আগেই ছাড়া পেয়ে যাবে। ওকে এসব জানানোর দরকার নেই। আগে আমাদের এদিকটা ঠিক করতে হবে। দরকার পড়লে আমি আঙ্কলের হাতে-পায়ে ধরে তাকে পুরো ব্যাপারটা বোঝাবো।”

“কখন বোঝাবে?”

“আপাতত বিষয়টা গোপন থাক। ভাবতে হবে কখন, কীভাবে জানালে ভালো হবে। সবকিছুর প্রস্তুতি নিয়ে তারপর জানাতে হবে। তবে আমি একটা বিষয় এখনও বুঝতে পারছি না। ক্যানি কীভাবে তোমাকে ভালোবাসতে পারে? মানে এটা কীভাবে ঘটলো? আমি তো ভাবতাম ও একটা রোবট। ওরও ভালোবাসার মতো এমন অনুভূতি হতে পারে? স্ট্রেইঞ্জ! আর তুমিও সব জেনেশুনে ডেঞ্জারেস ক্যানির প্রেমেই পড়লে! আমি তোমাদের বিষয়টা ভেবেই কূলোতে পারি না কিছু।”

রিশন চুপচাপ কফি খাচ্ছিল আর দুই বোনের কথাবার্তা শুনছিল। এবার সে তার নীরবতা ভাঙলো। বললো,
“তোমরা দুজনই পাগল! পৃথিবীতে কি আর ছেলে নেই? ক্যানিয়ল, আন্দ্রেজই কেন তোমাদের মনে লাগলো? বাকি ছেলেদের কী দোষ? একবার ভেবে দেখো সিস্টার…”
রিশন জুহিকে উদ্দেশ্য করলো,
“আন্দ্রেজকে বিয়ে করলে তুমি কখনও একটু দ্রুত পায়ে হাঁটতেও পারবে না। আন্দ্রেজের ক্রাচে ভর দিয়ে হাঁটতে হয়। ও হাঁটবে আস্তে আস্তে। সাধারণ চলাচলের চেয়ে ধীর পায়ে হাঁটবে। তোমাকে ওর সঙ্গে সঙ্গে চলতে হলে ওর মতোই ধীর হাঁটতে হবে। যেখানে স্বাভাবিক গতিতেই হাঁটতে পারবে না সেখানে দৌড়ানোর কথা না হয় বাদই দিলাম। আর টিজা…”
রিশন ইরতিজার দিকে মনোযোগ দিলো,
“ক্যানিকে বিয়ে করলে তো তোমার থানায় যেতে যেতে পায়ে ইনফেকশন হয়ে যাবে। দেখা যাবে ক্যানি সকালে কাউকে মেরেছে সেই অপরাধে থানায় নিয়ে গেছে পুলিশ ওকে। দেখা যাবে বিকেলেও একজনকে মেরেছে, রাতেও একজনকে মেরেছে। পুলিশ তিন বেলায়ই ওকে ধরে নিয়ে যাবে, আর তোমার ওকে তিন বেলায়ই ছাড়িয়ে আনতে হবে। তখন তুমি কী করবে? তুমি কি চাও তোমার পায়ে ইনফেকশন হোক?”

রিশনের এমন সব কথা শুনে ইরতিজা, জুহি দুজনই হতভম্ব। জুহি তো সেই সাথে অতিষ্ঠও। জুহি বললো,
“ক্যানিকে বলবো ও যেন একদিন তোমায় তিন বেলা মা’রধর করে। মা’র খেয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলে তোমার মস্তিষ্ক ঠিক হয়ে যাবে।”

রিশন চেতে গিয়ে বললো,
“হোয়াট ডু ইউ মিন? আমি মানসিক রোগী?”

জুহি হেসে বললো,
“এই তো বুঝেছো তুমি।”

রিশন চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে গেল ঝগড়া করার জন্য। দুজনের মাঝে তুমুল ঝগড়া বেঁধে গেল মুহূর্তেই। ইরতিজা অপমানে কোথায় মুখ লুকাবে বুঝতে পারলো না। ক্যাফের সব মানুষ তাকিয়ে থেকে জুহি আর রিশনের ঝগড়া দেখছে। ইরতিজা বার বার থামতে বললো, কিন্তু দুজনের মাঝে থামার কোনো লক্ষণ নেই।
এমন চলতে থাকলে যদি ক্যাফে মালিক পুলিশদের কাছে ইনফর্ম করে দেয়?
ইরতিজার মোবাইলে হঠাৎ কল এলো। মি. হেনরির কল। ইরতিজা জুহি আর রিশনের কাছ থেকে দূরে সরে এলো। কল রিসিভ করে মি. হেনরির কাছ থেকে যে খবরটা শুনলো তাতে ভয়ে হৃৎপিণ্ড নড়ে উঠলো তার। স্তব্ধ হয়ে গেল পুরো শরীর। শুধু হৃৎপিণ্ড লাফাতে থাকলো। এর মাঝে শুনতে পেল পুলিশের গাড়ির সাইরেন। এই ক্যাফের দিকেই আসছে গাড়িটা। ইরতিজা ক্যাফের বাইরে তাকালো। দেখতে পেল লাল-নীল বাতি জ্বালানো গাড়িটা ক্যাফের সামনে এসে থেমেছে।

(চলবে)

#উড়ো_পাতার_ঢেউ
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ৫২
_________________

ইরতিজা, জুহি, রিশন তিনজনই ভয় পেয়ে গিয়েছিল পুলিশের গাড়ি দেখে। ওদের ধারণা বলছিল ক্যাফেতে বসে ঝগড়া করার জন্য পুলিশ ওদেরকে নিয়ে যাওয়ার জন্য এসেছে। কিন্তু না, ক্যাফেতে একজন অপরাধীকে ধরতে এসেছিল তারা। মার্ডার কেসের আসামি লোকটা। ক্যাফের মালিকই খবরটা দিয়েছিল পুলিশের কাছে। চেহারা গোপন করার চেষ্টা করেও নিজেকে লুকাতে পারেনি অপরাধী। ক্যাফের ভিতর আসামির সাথে পুলিশের হালকা এক দৌড় ঝাঁপ হয়ে গেছে। ক্ষণিকের ভিতরেই ক্যাফেতে এসে ভিড় করেছে সাংবাদিকরা। শোরগোলের সৃষ্টি হয়েছে। রিশন সময় নষ্ট করেনি। দ্রুত সে নিজের মোবাইলে ভিডিয়ো করতে শুরু করলো এখানের পরিবেশ। জুহিও উৎসুক হয়ে দেখতে থাকে ঘটনাটা। ক্যাফের সামনে সাংবাদিকদের প্রশ্ন আগুনের ফুলকির মতো ফুঁটছে। পুলিশ উত্তর দিচ্ছে। অনেক ক্যামেরা, মাইক্রোফোন দেখা যাচ্ছে। বড়ো একটা কেস বোঝাই যাচ্ছে। ইরতিজার অবশ্য এসবে কোনো আগ্রহ নেই। তার চিন্তা মি. হেনরির থেকে পাওয়া ফোন কলটা নিয়ে। তাকে এখনই একবার হাসপাতালে যেতে হবে।
জুহি উৎসুক হয়ে সামনের সাংবাদিক দলটাকে দেখছে। ইরতিজা ডাকলো,
“জুহি!”

অনেক কোলাহল। কোলাহলের শব্দ পেরিয়ে ডাকটা জুহির কানে পৌঁছাতে সমস্যা হলো। ইরতিজা আবার ডাকলো,
“জুহি!”

শুনতে পেল জুহি এবার। জিজ্ঞেস করলো,
“কী?”

“আমাকে একটা জায়গায় যেতে হবে। আমি চলে যাচ্ছি। সেখান থেকে সোজা বাসায় চলে যাব।”

জুহির ধ্যান এখন অন্যদিকে, তাই সে ইরতিজার কথাকে তেমন গ্রাহ্য করলো না। শুধু বললো,
“ঠিক আছে যাও।”

ইরতিজা ভিড় ঠেলে ক্যাফে থেকে দূরে সরে এলো। তারপর একটা ট্যাক্সি নিয়ে সোজা চলে এলো হাসপাতালে।
মি. হেনরির বলা রুম নাম্বারে এসে দেখলো বেলা লিমাস বেডে শুয়ে আছেন। ইরতিজাকে দেখে হাসলেন তিনি। বললেন,
“আমাকে দেখতে এভাবে ছুটে এসেছো কেন?”
বলতে বলতে উঠে বসলেন হেলান দিয়ে।

“আমি ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম!”

ইরতিজা বেলা লিমাসের কাছে এগিয়ে এলো।
বেলা লিমাস ইরতিজাকে নিজের পাশে বসতে বললেন। ইরতিজার মুখখানিতে স্নেহের পরশ বুলিয়ে বললেন,
“তুমি মেয়েটা এত আদুরে কেন? এত আদুরে, মায়াবী বলেই কি আমার ছেলে মায়ায় পড়লো এই মায়াবতীর?”
বেলা লিমাস ইরতিজার কপালে চুমু খেলেন।
এমন স্নেহের চুম্বন পেয়ে ইরতিজার চোখে অশ্রুর ঢল নামলো।

“কী হয়েছিল? হঠাৎ করে…”

“এটা ছোটো-খাটো একটা হার্ট অ্যাটাক! চিন্তা করো না তুমি।”

ইরতিজা ছলছল চোখে তাকিয়ে রইল। বেলা লিমাস বললেন,
“গতকাল দেখা করতে গিয়েছিলাম ক্যানিয়লের সাথে। আবদার করেছিলাম ওর কাছে, যাতে ও আমাকে একবার জড়িয়ে ধরে। কিন্তু জড়িয়ে ধরলো না। নিজ থেকেই জড়িয়ে ধরলাম ওকে। আমার ছেলেটা আমাকে এত ভালোবাসে কেন বলো তো ইরটিজা?”

ইরতিজার দু চোখ দিয়ে ধারা নামে। ভিতরটা কেঁদে ওঠে হু হু করে। বললো,
“ক্যানিয়লের কাছ থেকে এটা গোপন রাখা কি উচিত হচ্ছে?”

“হচ্ছে। আমার মৃত্যুর পর তুমি যখন ওকে দেখবে তখন বুঝতে পারবে এটা করা ঠিক ছিল।”

________________

আজাদ চৌধুরী গতকাল থেকে চিন্তায় আছেন। চিন্তিত মুখ নিয়ে বসে থাকছেন। নওরিনের মুখ থেকে সমস্তটা শোনার পর সে কল করেছিল হামাদকে। হামাদ তাকেও এক কথা বলেছে, এই সিদ্ধান্ত ভুল ছিল, এই ভুলকে আর সামনে এগিয়ে নেওয়া উচিত হবে না। আজাদ চৌধুরী বুঝতে পারছেন না তিনি কী করবেন! চিন্তার যন্ত্রণায় মনে হচ্ছে তার রগ ছিড়ে যাবে। তিনি অবশ্য এই সিন্ধান্ত ভেঙে দেওয়া ছাড়া উপায় দেখছেন না। যেখানে ছেলে চাইছে না তার মেয়েকে বিয়ে করতে, সেখানে সে জোর করে মেয়েকে বিয়ে দিলে তার মেয়ের জীবনটা নষ্ট হবে শুধু। হামাদের কী হবে? ওর তো কিছু হবে না। বিয়ের পরও গার্লফ্রেন্ড নিয়ে সে স্বাধীন চেতনায় বাঁচতে পারবে। এতে তার কোনো সমস্যা হবে না। কারণ সে তো নওরিনকে বিয়েটা করবে চাপে পড়ে, মন থেকে না। আর নওরিন এসব সহ্য করতে না পেরে মনস্তাপ অনলে পুড়বে।

নওরিন পিছনের লনে এসে দেখলো বাবা চেয়ারের সাথে হেলান দিয়ে চোখ বুজে আছেন। বাবা যে হামাদের ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তা করছেন সেটা বোঝা গেল সহজেই। নওরিনের খারাপ লাগলো এটা দেখে। বাবার এমন চিন্তিত মুখ তাকে কষ্ট দিচ্ছে। সে এগিয়ে এসে বাবাকে বললো,
“এত কী চিন্তা করছো আব্বু? আমি ওই বদমাইশটাকে বিয়ে করবো না। ও নিজ থেকেও যদি এখন আমাকে বিয়ে করার জন্য পাগল হয়ে যায় তারপরও বিয়ে করবো না আমি। এই সম্পর্ক ভেঙে দাও। এটা ভাঙা তো তেমন কঠিন কিছু না।”

আজাদ চৌধুরী চোখ খুলে চাইলেন। বললেন,
“তুমি শিওর?”

“হ্যাঁ। আমার খারাপ লাগছে না বিশ্বাস করো। ওর সাথে সম্পর্ক চূর্ণ হলে কষ্ট লাগবে না আমার। কারণ যে মানুষটা আমায় ভালোবাসেনি সেই মানুষটার জন্য কষ্ট কেন পাবো?”

আজাদ চৌধুরী উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,
“কষ্ট হয়তো পেতে, যদি তুমি ওকে সেরকমভাবে ভালোবাসতে। তোমার ভালোবাসার মাঝেও হয়তো ত্রুটি ছিল বলে আমার ধারণা। যেখানে দুজন মানুষের ভালোবাসাই ত্রুটিপূর্ণ সেখানে এই বিয়ের সিদ্ধান্ত আসলেই ভুল ছিল।”
আজাদ চৌধুরী মেয়ের মাথায় হাত রেখে বললেন,
“এটা কোনো ব্যাপার না। মানুষ ভুল থেকেই শিক্ষা গ্রহণ করে। এই ভুল সিদ্ধান্ত নিশ্চয়ই তোমার জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করেছে বলে আমার বিশ্বাস।”

আজাদ চৌধুরী ঘরের ভিতরে চলে গেলেন। নওরিন দরজায় তাকিয়ে দেখতে পেল ওখানে শারমিন আহমেদ দাঁড়িয়ে আছেন। নওরিন এগিয়ে এলো। শারমিন আহমেদের দুই হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে ইতস্তত করে বললো,
“স্যরি মা! তুমি যখন বলেছিলে হামাদ বিদেশি ছেলে, লাইফ পার্টনার হিসেবে কেমন না কেমন হবে, আরও কিছুটা সময় নিয়ে ওকে পরখ করে দেখতে, তোমার কাছে ওকে একটু কেমন যেন মনে হয়েছে, তখন আমি তোমাকে যা নয় তাই বলেছিলাম! সেজন্য আমি একান্ত দুঃখিত!”

শারমিন মৃদু হেসে বললেন,
“মা-মেয়ের মধ্যে কেন এই ‘দুঃখিত’ শব্দটা আসবে?”
সে জড়িয়ে ধরলো নওরিনকে।
“আমার মেয়ের দুঃখিত বলার দরকার নেই আমাকে।”

ইরতিজা দূরে দাঁড়িয়ে মা-বোনের আলিঙ্গনের দৃশ্যপটটি দেখতে পেল। তার কাছে খুব মিষ্টি লাগলো দৃশ্যটা। সেই সাথে কষ্টে বুক মোচড় দিয়ে উঠলো। ভিজে গেল চোখের কোণ!
মা তাকে শেষ কবে এমনভাবে জড়িয়ে ধরেছিল? সময়টা মনে নেই ইরতিজার। সে অস্ফুট স্বরে বিড়বিড় করতে লাগলো,
“কেন ঘৃণা করো মা? আমার তো কোনো দোষ নেই! বিনা দোষে এমন ঘৃণা করা অনুচিত।”

ইরতিজা মাথায় হঠাৎ কারো হাতের স্পর্শ অনুভব করলো। একটা ভরসার হাত যেন তার মাথার উপর। তাকিয়ে দেখলো আজাদ চৌধুরী দাঁড়িয়ে আছেন। আজাদ চৌধুরী বললেন,
“তুমি কি তোমার আব্বুকে কষ্ট দিতে চাও?”

“অবশ্যই না। তাকে কষ্ট দেওয়ার কথা চিন্তা করলেও কষ্ট হবে আমার।”

“তাহলে কান্না থামাও। তোমার চোখের এক ফোঁটা অশ্রুও আমাকে কষ্ট দেয়। অথচ তুমি কত অশ্রু ফেলো এই চোখ দিয়ে।”

ইরতিজার দু চোখ বেয়ে আরও অশ্রু নামতে থাকে। ভাবে এই মানুষটা এমন না হলে তার জীবন কেমন থাকতো আজ? এমন মানুষটা যদি এমন ভালো না হতো? যদি তাকে ভালো না বাসতো? পুরো শরীর ঝিমঝিম করে ওঠে ইরতিজার।

_________________

জোনাসের কী খবর জানা নেই। ইরতিজা একবারও খোঁজ নেয়নি কোনো। খোঁজ নেওয়ার মন নেই তার। সে নিজেকে বোঝাচ্ছে, জোনাসের সাথে অমনটাই হওয়ার ছিল। জোনাস যা যা করেছে তাতে ওই সামান্য একটা ঘু’সি কিছুই না।
আজ ওয়েদার সকাল থেকে রোদ্রজ্জ্বল ছিল। কিন্তু দুপুরের শেষ ভাগ থেকে মেঘলা করেছে। ওয়েদার ফোরকাস্ট জানিয়েছে বিকেলে হালকা তুষারপাত হবে। এ সপ্তাহে এত তুষারপাত হচ্ছে কেন? আগের তুষারপাতের চিহ্নই তো এখনও মুছেনি। আজ আবারও তুষারপাত হবে! ইরতিজা এখন ‘ldylwood Park’এ যাচ্ছে। ঘোরাঘুরির কোনো প্ল্যান আজকে ছিল না। কিন্তু ক্যানিয়ল হঠাৎ কল দিয়ে বললো পার্কে আসতে। পার্কটা বাসা থেকে কাছেই। ইরতিজা এর আগে দুইবার এসেছিল। পার্কের ভিতর লেকও আছে। লেকটা ঠিক কতটা বড়ো সে সম্পর্কে ধারণা নেই ইরতিজার। শুনেছে অনেকগুলো এরিয়ার ভিতর পড়েছে লেকটা। এই পার্ক থেকে যতটা দেখা যায় লেকটা আসলে ততটুকু না। বিশাল বড়ো লেকের কেবল একটা অংশ দেখতে পাওয়া যায় পার্ক থেকে। এই পার্কের ভিতর আছে ওপেন প্লেস। ফ্যামিলি পিকনিকের জন্য ভালো একটা জায়গা। গ্রীষ্মকালে এখানটায় মানুষজন বেশি আসে। উইন্টারে তেমন কেউ আসে না বললেই চলে। তবে ক্যানিয়লের মতো হলে আবার আসতেও পারে। গ্রীষ্মে এখানে বসে মানুষজন বারবিকিউ করে। বারবিকিউয়ের ঘ্রাণ প্রবেশপথ থেকেই নাকে এসে লাগে। এই পার্কে আছে ড্রেস চেঞ্জ করার ব্যবস্থা। অর্থাৎ লেকে সুইমিং করার পর চাইলে ভেজা কাপড় পাল্টে শুকনো কাপড় পরে নিতে পারবে। তার জন্য নির্দিষ্ট কক্ষ আছে। ওয়াশরুমও আছে এখানে। কিছু হাসও দেখা যায় লেকের জলে সাঁতার কাটতে। কেউ কেউ আসে মাছ ধরতে। ওসব গ্রীষ্মে হয়। ইরতিজা এসব জুহির মুখ থেকে শুনেছে। গ্রীষ্ম এসে গেলে সে নিজ চোখে এই পার্কের আসল সৌন্দর্য প্রত্যক্ষ করতে পারবে। সামারে সে একবার এই লেকে সুইমিং করারও চিন্তা করেছে। স্বচ্ছ টলমল জলে সাঁতার কাটবে।
লেকের ওপারে দেখা যায় পাহাড়ের ভ্যালি। অপরূপ সৌন্দর্যের এক মহিমা এখানে। সন্ধ্যায় যখন আকাশ লাল হয়ে যায় একেবারে, ওই সৌন্দর্য তো আরও ঘায়েল করার মতো।
পার্কটার ভিতর একমাত্র মানুষ বলতে ক্যানিয়ল ছিল শুধু, ইরতিজা আসাতে দুজন হলো। ইরতিজা আসার পথেই স্নো ফল শুরু হয়েছে। ড্রেস চেঞ্জের কক্ষের যে ছোটো বিল্ডিংটা আছে, ওটার সামনে দাঁড়িয়ে আছে ক্যানিয়ল। মাথার উপর ছাউনি থাকায় তুষারপাত থেকে সুরক্ষিত সে। ইরতিজাও এসে ক্যানিয়লের কাছে দাঁড়ালো। জলাশয়ের কাছে থেকে তুষারপাত দেখার অভিজ্ঞতা তার জীবনে নতুন। বরফ কণাগুলো উড়ে উড়ে লেকের জলে পড়ছে। পার্কটা সাদা হয়ে উঠছে ক্রমশ।
ইরতিজা বললো,
“এখানে কেন ডেকেছো?”

“সব কিছুর কি কারণ থাকতে হবে?”

“হ্যাঁ, অবশ্যই। সকল কাজের পিছনেই একটা কারণ থাকতে হবে।”

“আমার কাজ করতে গেলে কারণ লাগে না। আমি বিনা কারণেও অনেক কাজ করতে পারি।”

“তাহলে আমাকে ডেকে আনার কোনো কারণ নেই?”

“আমি কি সেটা বলেছি? অবশ্যই কারণ আছে। আমি তো একটা অ্যানাকোন্ডা! তোমাকে টুপ করে মুখে পুরে কপ করে গিলে খা’বো বলে ডেকে এনেছি।”

“তুমি চটাং চটাং করে কথা বলছো কেন?”

ক্যানিয়ল সচকিত হয়ে উঠলো,
“চটাং চটাং করে কথা বলছি না কি?”

ইরতিজা জবাব না দিয়ে অন্যদিকে ঘুরে দাঁড়ালো। ক্যানিয়ল পাশের বেঞ্চিটায় বসতে বসতে বললো,
“তোমাকে এখানে ডাকার একটা কারণ আছে।”

ইরতিজা তেমন প্রতিক্রিয়া করলো না কথাটা শুনে। শুধু একবার তাকালো ক্যানিয়লের দিকে, তারপর আবার চোখ সরিয়ে নিলো। গভীর দৃষ্টি দিলো প্রকৃতির বুকে। আর অন্য এক জোড়া গভীর দৃষ্টি তাকে দেখতে লাগলো যত্ন করে। অনেকক্ষণ চুপচাপ কাটলো। ক্যানিয়ল এক দৃষ্টে তাকিয়ে ছিল ইরতিজার দিকে। ক্যানিয়লের ওই এক দৃষ্ট চাহনিতে চোখ পড়লেই লজ্জা পাচ্ছিল ইরতিজা। হঠাৎ শুনতে পেল তাকে গভীর দৃষ্টিতে দেখা মানুষটি গভীর কণ্ঠে বলছে,
“তুমি উড়ো পাতার ঢেউ ইজা!”

কথাটা শুনে ইরতিজার মুখ দিয়ে বিস্ময়ের ধ্বনি বেরিয়ে এলো,
“হু?”

ইরতিজার জিজ্ঞাসু দৃষ্টি জোড়ার কাছে এসে দাঁড়ালো ক্যানিয়ল।
“আমার জীবনের বারোটা মাসেই কনকনে শীত চলে আর তুষারপাত ঝরে। কিন্তু এবারের মাসগুলোর কী যেন একটা হয়েছে। কনকনে শীত আর অনুভব হয় না, তুষারপাতের সাদা রংও আর অবলোকন করে না নেত্রদ্বয়। এই যে আজ প্রকৃতিতেও তুষারপাত ঝরছে, অথচ আমার দু চোখ দেখছে রঙিন পাতার উড়ো ঢেউ। তুমি ঝরছো আমার জীবনে উড়ো পাতার ঢেউয়ের ন্যায়। এটা তো আসলে উড়ো পাতার ঢেউ নয়, এটা তো ঢেউ নামক আমার হৃদয়ে থাকা অনুভূতির দল। যা হৃদয়কে রাঙিয়েছে শরতের রঙে আর দৃষ্টি করেছে ভ্রম!”

ক্যানিয়ল নেমে গেল তুষারপাতের মাঝে। ফ্লোরের উপর কয়েক খণ্ড কাঠের দণ্ড ছিল। ক্যানিয়ল একটা নিয়ে লেকের দিকে এগোতে থাকলো। বালুকণার উপরে জমা তুষারপাতের আস্তরণের উপর দণ্ড দিয়ে লাভের অর্ধ অংশ আঁকলো, এবং নিজে তার শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে তাকালো ইরতিজার দিকে। বললো,
“আমি চাই না আমার জীবনে আর তুষারপাত নামুক। এটা সর্বদা রাঙা থাকুক শরতের রঙে। হোয়াট ডু ইউ ওয়ান্ট? ইজ ইট স্নোয়িং? অর শুড ইট বি কালারফুল ইন অটাম?”

ইরতিজা নির্নিমেষ তাকিয়ে রইল কয়েক মুহূর্ত। তারপর ফ্লোর থেকে সেও একটা কাঠের দণ্ড তুলে নিয়ে ক্যানিয়লের কাছে এলো। ক্যানিয়লের আঁকা অর্ধ লাভের চিত্রটি সে পূরণ করলো। যখন এটি পূর্ণ হলো তখন হাসলো ক্যানিয়ল।
ইরতিজার নেত্রপটে ভিড় করলো স্বচ্ছ বারি। সে ক্যানিয়লের বুকের বাঁ পাশে হাত রেখে বললো,
“এখানটা থেকে যদি আমার জন্য অনুভূতি বিন্দু পরিমাণও কমে যায়, তাহলে তোমাকে খু’ন করে ফেলবো বিদেশি পাজি!”

ক্যানিয়ল আরও প্রসন্ন হেসে ফেললো। বললো,
“তেমনটা হলে তুমি খু’ন করার আগেই মৃত্যু হবে।”

ক্যানিয়ল ইরতিজার অনামিকায় রিং পরিয়ে দিয়ে হাতে অধর ছোঁয়ালো।
তারপর হাতটা ধরে সহসা এক টান মেরে ইরতিজাকে আরও কাছে এনে বললো,
“তো পাকিস্টানি গার্ল, কবে বিয়ে করতে চাও এই পাজাইইকে? আজ? না কাল?”

(চলবে)