উড়ো পাতার ঢেউ পর্ব-৫৩+৫৪

0
370

#উড়ো_পাতার_ঢেউ
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ৫৩
_________________

রঙিন মুহূর্তে কালো রং ঝরে পড়তে লাগলো মুষলধারে বৃষ্টির ন্যায়। মনের সবটুকু রং তলিয়ে গেল ধীরে ধীরে কালোর অতলে। এত সুন্দর, স্নিগ্ধ মুহূর্তগুলো বার বার কেন এমনভাবে বিনষ্ট হয়ে যায়? কেন মনে পড়ে যায় ওগুলো সম্পর্কে? কেন জীবনে এত বড়ো একটা কাঁটা সৃষ্টি হয়ে আছে?

ক্যানিয়ল দেখলো ইরতিজা তার সম্মুখেই কেঁদে উঠেছে। সে ঘাবড়ে গেল এবং সচকিত হয়ে উঠলো।
“পাকিস্টানি গার্ল! হোয়াই আর ইউ ক্রায়িং?”

ইরতিজার কান্না আরও বিস্তৃত হলো। ক্যানিয়ল বুঝতে পারলো না কোত্থেকে কী হচ্ছে! হঠাৎ কাঁদছে কেন ইরতিজা? ক্যানিয়ল ইরতিজার চিবুক স্পর্শ করে বললো,
“হেই, কেন কাঁদছো? কী হয়েছে?”

ইরতিজা এবার ক্যানিয়লের চোখে চোখ রেখে চাইলো। ক্যানিয়ল দেখলো মায়াবী আঁখি জোড়া থেকে কীভাবে অনর্গল স্বচ্ছ জল গড়িয়ে পড়ছে! ইরতিজা কান্না সিক্ত কণ্ঠে বললো,
“আই অ্যাম এনগেজড ক্যানিয়ল!”

“হ্যাঁ তুমি এনগেজড, এই মাত্রই আমি তোমাকে রিং পরিয়েছি। কিন্তু এখানে কান্নার কী বিষয় রয়েছে? রিং পরানোয় তুমি অখুশি?”

“ব্যাপারটা এমন নয়। কীভাবে যে বলবো তোমায়!”
ইরতিজা একটুখানি বিরতি নিয়ে ভাবলো একটু। তারপর এক শ্বাসে বলে দিলো,
“তুমি রিং পরিয়ে দেওয়ার আগে থেকেই আমি এনগেজড! এটা অন্য কেউ।”

“কী?”

“হ্যাঁ। ওয়াশিংটন আসার আগেই সাজিদ নামের একজনের সাথে আমার এনগেজমেন্ট হয়েছিল!”

ক্যানিয়ল ইরতিজার চিবুক থেকে হাত সরিয়ে এক পা পিছিয়ে গেল। তার দু চোখ ধারণ করছে চমকানোর গভীর খাদ। বিস্ময় স্ফীত চোখে সে তাকিয়ে রইল বেশ কিছু সময়। অনন্তর বললো,
“তাহলে এটা সত্যি ছিল? আমি তো ভাবতাম এটা তুমি এমনিই বলতে। আমার উডবি ওয়াইফ আছে শুনে নিজেও উডবি হাসব্যান্ডের গল্প বানাতে। কিন্তু এটা সত্যি ছিল!”

নীরব কেটে গেল অনেকটা সময়। ক্যানিয়ল এবার নিজের বিস্ময় কাটিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে বললো,
“এই জন্য কাঁদছো তুমি? উডবি হাসব্যান্ড আছে তো কী হয়েছে? ভুলে কেন যাচ্ছ আমারও অন্য একজনের সাথে বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। এটা তেমন জটিল কোনো ব্যাপার নয়।”

“আমি কাঁদছি আমার আব্বুর কথা চিন্তা করে। তাকে কীভাবে বোঝাবো আমি? সবটাই খুব বেশি জটিল লাগে আমার কাছে। অনেক ভেবেও কী থেকে কী করবো কিছু বুঝে উঠতে পারি না আমি। আব্বু চায় সাজিদের সাথেই আমার বিয়ে হোক। তাকে আব্বু খুবই পছন্দ করে…”

“তুমি পছন্দ করো?” ইরতিজাকে থামিয়ে দিলো ক্যানিয়ল, “তুমি চাও ওকে বিয়ে করতে?”

“না। আমি এই এনগেজমেন্ট নিজ ইচ্ছায় করিনি। এই বিয়েতে আমার কোনো মত নেই। আমি কিছুতেই বিয়ে করতে চাই না তাকে।”

“তাহলে এটা নিয়ে আর ভেবো না। শুধু একটা কথাই মনে রাখবে, তুমি আমার। ওই লোক তোমায় ছাড়া ভালো থাকবে, খারাপ কাটবে না তার দিন। কিন্তু তোমাকে ছাড়া আমার প্রতিটা দিন খারাপ কাটবে। কারণ তুমি আমার ভালো থাকা। আমার হ্যাপিনেস!”

ইরতিজা এবার আনন্দে কেঁদে ফেললো। বললো,
“আর তোমাকে ছাড়া আমার দিন গুলো কাটবেই না।”
_______________

ইরতিজা বাসায় ফিরলো সন্ধ্যায়। ফিরে দেখতে পেল জুহি একটা ছেলের সাথে ঝগড়া বাঁধিয়েছে বাসার সামনের রোডে। ভুল না হলে খুব সম্ভবত ছেলেটার নাম পিটার। এই ছেলের সাথেই জুহি ডলারের বিনিময়ে ডেট করছে। ইরতিজা দূরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করলো ওদের ঝগড়া শেষ হওয়ার। শেষ হলে এগিয়ে এসে শুধালো,
“কোন বিষয়ে ঝগড়া হচ্ছিল?”

জুহি ভীষণ বিরক্ত কণ্ঠে বললো,
“আর বলো না টিজা, ও বলছে ডলারের পরিমাণ বাড়িয়ে দিতে হবে। ওর কাছে না কি এক সেকেন্ড সময়েরও মূল্য অনেক বেশি। অযথাই ও নিজের মূল্যবান সময় নষ্ট করতে পারবে না আমার সাথে ডেটে গিয়ে।”

ইরতিজা একটুখানি হাসলো জুহির কথায়। জুহি নিজের বিরক্তি দূরে ঠেলে দিয়ে হঠাৎ সোল্লাসে ইরতিজার এক হাত চেপে ধরে বললো,
“জানো, আমার মনে হচ্ছে আমি উচিত শিক্ষা দিতে পারছি আন্দ্রেজকে। ও বুঝে যাচ্ছে ওর নিজের জায়গাটা। আমাকে বলে কি না আমি পাগল? পাগল ও নিজে। ধীরে ধীরে সেটা বুঝতে পারছে।”

জুহি খুশি মনে ফড়িংয়ের মতো লাফাতে লাফাতে চলে গেল ঘরে। ইরতিজাও পা বাড়ালো ঘরের দিকে।
ঘরে এসে লিভিং রুমে নওরিনকে শুয়ে থাকতে দেখলো। হঠাৎ খারাপ লাগা অনুভব হলো তার। সে নিজেও কখনও ভাবেনি হামাদ ওরকম করতে পারে। নওরিন মানুষ চিনতে ভুল করেছিল। পৃথিবীর অন্যতম কঠিন কাজ মানুষ চিনে ওঠা। তবে সে নিশ্চিত মানুষ চিনতে ভুল করেনি সে। এসব ভাবতে ভাবতে নিজের রুমের দিকে অগ্রসর হলেই নওরিন ডাকলো,
“ইরতিজা…”

ইরতিজা পিছন ফিরে সাড়া দিলো,
“হ্যাঁ?”

নওরিন কাছে আসতে আসতে বললো,
“কোথায় গিয়েছিলে? কল করেছিলাম কিন্তু…”

কাছে এসে দাঁড়ালেই প্রথমে নওরিনের চোখ গেল ইরতিজার অনামিকায়। আর তখনই থেমে গেল সে। ইরতিজার অনামিকায় আংটি দেখে চমকালো সে। এই আংটি সাজিদের পরানো সেই আংটি নয়। নওরিনের চিনতে সময়ই লাগলো না। সে ইরতিজার দিকে তাকালো। খুব সহজেই অনুমান করে নিতে পারলো এই আংটি কেন, কে পরিয়ে দিয়েছে ইরতিজাকে। ইরতিজার মাঝে সে কখনও সাজিদের জন্য অনুভূতির লক্ষ করেনি। আর সাজিদের প্রতি অনুভূতি ছিল না বলেই হয়তো…

ইরতিজা বোনের পর্যবেক্ষণ দৃষ্টি বুঝতে পারলো না। বললো,
“কেন কল করেছিলে? আমার ফোন তো আমি ভুলে রুমে ফেলে রেখে গেছি।”

“মার্কেটে যাওয়ার প্রয়োজন ছিল। ভেবেছিলাম তোমাকে নিয়ে যাব। তাই কল করেছিলাম।”

“এখনও তো যাওয়া যায়, চলো।”

“দরকার নেই। সকালে যাব।”

নওরিন যেতে উদ্যত হয়ে পিছন ফিরলো আবার। ইরতিজার অনামিকায় তাকালো। আংটিটা চকচক করছে। নওরিন ইরতিজার দিকে তাকিয়ে বললো,
“সেটাই করো, যেটা তোমার মন চায়। সেটা করো না যেটা তোমার মনের অনিচ্ছায় তোমার ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হবে।”

নওরিন চলে গেল। স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল ইরতিজা। নওরিন হঠাৎ এ কথা বললো কেন? ইরতিজার চোখ চলে গেল অনামিকায়।

_______________

কালো রাতের মাঝে কী দারুণ সাদার অস্তিত্ব। ন্যাড়া গাছ গুলোর মাথায় শ্বেত তুষারের প্রলেপ পড়ে আছে। রাস্তার দুই পাশে বরফের চিহ্ন। ক্যানিয়লের গাড়িটা সেই রাস্তা ধরে এসে প্রবেশ করলো রাজপ্রাসাদের ন্যায় বাড়িটায়। লনে পার্ক করে নামলো সে গাড়ি থেকে। পুরো বাড়িটায় আলো জ্বলছে। বাইরে থেকে সেসব আলো আরও আকর্ষণীয় করে তুলেছে বাড়িটাকে। বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করে তার দৃষ্টি আটকালো প্রথমে সোফায় বসে থাকা অপরূপা মেয়েটির উপর। মেয়েটি ধূসর চোখ জোড়া তার উপর নিক্ষেপ করে হাসলো। ক্যানিয়লও হাসলো। জানে মেয়েটার এখনকার শান্ত, আনন্দের আচরণ কিছুক্ষণ পর রূঢ় হয়ে উঠতে চলেছে। ক্যানিয়ল একবার দৃষ্টি বুলিয়ে নিলো পুরো হলঘরে। ড্যাড, মাদার সোফিয়া, ইয়াদা, সালেম, আর ভাই-বোনদের অধিকাংশই এখন এখানে উপস্থিত। পারিবারিক গল্পগুজব চলছে এখানে। মুহাম্মদ ইসহাক ছেলেকে দেখে বললেন,
“এতক্ষণ কোথায় ছিলে উমরান?”

ক্যানিয়ল সহাস্যে উত্তর দিলো,
“আমার উডবির কাছে।”

“কিন্তু ও তো এখানে!”

মুহাম্মদ ইসহাক হাতের ইশারায় মিরান্ডাকে দেখিয়ে দিলেন।
ক্যানিয়ল বললো,
“ও তো মিরান্ডা। আমি মিসেস উমরানের সাথে ছিলাম।”

সবাই একটু চমকালো। কারো কারো তো ভ্রুর মধ্য স্থলে ভাঁজের সৃষ্টি হলো। মিসেস উমরান বলতে কাকে বোঝালো ক্যানিয়ল?
মুহাম্মদ ইসহাক বললেন,
“তোমার কথা বুঝতে পারছি না উমরান! ইদানীং তোমার কথা ঠিক বুঝে ওঠা যায় না।”

“তোমার যেন বুঝতে অসুবিধা না হয় সেজন্য আমি স্পষ্টভাবে একটা কথা বলতে চাই তোমায়। যদি তুমি অনুমতি দাও তাহলে আমি কথাটা বলবো। আমি কি বলবো?”

“কী বলতে চাও?”

“আমি যেটা বলবো সেটা আমি মজা অথবা মানসিক কোনো সমস্যা থেকে বলছি না। আমার পক্ষে মিরান্ডাকে বিয়ে করা একদমই অসম্ভব ব্যাপার ড্যাড। আমি বিয়ে করবো না মিরান্ডাকে। আমি অন্য একজনকে পছন্দ করি। ভালোবাসি ওকে। ভালো লাগে ওকে আমার।”

ক্যানিয়লের কথা শেষ হওয়ার পর পিনপতন নীরবতা গ্রাস করলো হলরুমকে। মুহাম্মদ ইসহাক ব্যতীত বাকি সবাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো একে অন্যের। মুহাম্মদ ইসহাক বেশ কিছু সময় ছেলের দিকে তাকিয়ে থাকার পর বললেন,
“কী বলছো তুমি?”

“আমি দ্বিতীয়বার কথাগুলো রিপিট করলেও কথাগুলো পরিবর্তন হবে না ড্যাড।”

মুহাম্মদ ইসহাক দাঁড়িয়ে গেলেন,
“তোমার সাহস কীভাবে হলো এমন একটা কথা বলার? ভালোবাসো? অন্য একজনকে?”

ক্যানিয়ল বিন্দুমাত্র বিচলিত হলো না। বললো,
“আজ আমি ওকে রিং পরিয়েছি। আমি আশা রাখি খুব শীঘ্রই আমাদের বিয়েতে তোমার মত পাবো।”

মুহাম্মদ ইসহাক হুংকার করে উঠলেন,
“খামোশ! আর একটা কথাও বলো না এ ব্যাপারে।”

“তুমি মেনে নিলে বলতে হবে না, কিন্তু মেনে না নিলে কথা বলতে হবে। ততক্ষণ পর্যন্ত বলতে হবে যতক্ষণ পর্যন্ত না এটা তুমি মেনে নিচ্ছ।”

“ড্যাডের সাথে বেয়াদবি করার চেষ্টা করো না।”

“আমি তেমন চেষ্টা করছি না।”

“তাহলে আর একটা কথা না বলে নিজের রুমে চলে যাও।”

“মেয়েটা আমার তেমন ভালোবাসা না যাকে ‘ভুলে যাব’ বললেই ভুলে যেতে সক্ষম হবো। মেয়েটা আমার তেমন ভালোবাসা না যার জন্য হৃদয়ে অনুভূতি থাকা সত্ত্বেও তুমি অন্য একজনের সাথে আমায় জোর করে বিয়ে দিতে সক্ষম হবে। এটা এমন ভালোবাসা যা…”

“বন্ধ করো তোমার এই ভালোবাসার ব্যাখ্যা। আমি এখনই তোমাকে নিজের রুমে চলে যেতে আদেশ করছি। যাও।”

ক্যানিয়ল নিজের অসমাপ্ত কথাকে সমাপ্ত করলো,
“এটা এমন ভালোবাসা যা মানুষের অমতকে মতে পরিণত করবে।”

মুহাম্মদ ইসহাক কাঁপছেন রাগে। ক্যানিয়ল তা নিজের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে সহজেই প্রত্যক্ষ করলো। বললো,
“যাচ্ছি নিজের রুমে। তোমার অমতের মতে পরিণত হওয়ার অপেক্ষায় রইলাম। নিশ্চয়ই তুমি নিজের ছেলের মনে কষ্ট দিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবে না।”

ক্যানিয়ল চলে গেল। সবাই অবিশ্বাস্য চোখে চেয়ে রইল ওর পথের দিকে। ক্ষণিকের ভিতর শুরু হয়ে গেল ওকে নিয়ে উপস্থিত সকলের মন্তব্য। প্রথমে শুরু করলেন নাইলা সালেম। প্রথমে সে ক্যানিয়লের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে কটমট করে বললেন,
“বেয়াদব ছেলে!”
তারপর মুহাম্মদ ইসহাকের দিয়ে চেয়ে বললেন,
“ওর সাহস কীভাবে হলো ইসহাক তোমার সাথে এমনভাবে কথা বলার? ওকে শাসন করা প্রয়োজন। তুমি আজ ওকে এত স্বাধীনতা দিয়েছো বলে ছেলেটা আস্ত একটা শয়তানে পরিণত হয়েছে।”

নাইলা সালেম মনের খায়েশ মিটিয়ে ক্যানিয়লের নামে নিন্দা প্রকাশ করতে থাকলো। এমন সুযোগ সে পায় না বললেই চলে। মুহাম্মদ ইসহাকের কাছে ক্যানিয়লের সমন্ধে কিছু বলতে গেলেই ইসহাক তা শুনতে নারাজ হন। কিন্তু আজ ইসহাক ছেলের এমন কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেছেন। উনি যেন একটা পাথরের মূর্তি এই মুহূর্তে। তাই যার যা ইচ্ছা তাই বলার সুযোগ পেল তার কানের কাছে। কিন্তু সেসব কথা তার কর্ণ শ্রবণ হচ্ছিল না আসলে।
নাইলা সালেমের মনের খায়েশ অবশ্য ক্যানিয়ল সমন্ধে এত কিছু বলেও মিটছিল না। তার মাঝে মাঝে ইচ্ছা হয় ক্যানিয়লকে খু’ন করতে। ক্যানিয়লের তাজা র’ক্তের স্রোত, ওর শেষ নিঃশ্বাস, শেষ আকুতি শুনতে পারলে হয়তো তার মনের খায়েশ মিটতো। ইদানিং এই ইচ্ছাটা তার মাঝে বেজে যাচ্ছে বিরতিহীন। কিন্তু এটা সে করার সাহস পাচ্ছে না।
এক ছিল বেলা লিমাস, আর এখন ক্যানিয়ল। এই দুটো মানুষে নাইলা সালেমের গভীর বিতৃষ্ণা। নাইলা সালেমের দিন এখন কিছুটা ভয়ে ভয়েও কাটছে। কারণ পুলিশ এখনও তদন্ত করছে সেই কেসটা নিয়ে। তদন্তে এখনও কোনো সফলতার মুখ তারা দেখতে পায়নি। কিন্তু একবার যদি গ্যাংয়ের কাউকে ধরে ফেলে তাহলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। কারণ সে যে গ্যাংটাকে এসব করার জন্য ডলার দিচ্ছে রাশি রাশি তারা কিছুটা স্বার্থপর আর বেইমান গোছের, যেটা সে উপলব্ধি করতে পেরেছে। তার নামটা পুলিশের কাছে বলে দিতে একটা বার গলা কাঁপবে না শুঁয়োর গুলোর। এখন তো তার মনে হচ্ছে এইসব কাজের জন্য ওই জা’নো’য়া’র গুলোকে বাছাই করা ভুল হয়ে গেছে তার। কিন্তু এখন আর কোনো উপায় নেই এই ভুল শুধরানোর।

ক্যানিয়ল চলে যাওয়ার একটু পরই মিরান্ডাও হলরুম ত্যাগ করেছে। সে ক্ষুব্ধ বাঘিনীর ন্যায় এগোচ্ছে ক্যানিয়লের রুমের দিকে। চোয়াল শক্ত হয়ে আছে তার। দু চোখে ক্রোধের আগুন দাউদাউ করছে। রুমের দরজাটা দুই হাতে ধাক্কা দিয়ে খুলে ফেললো।
ক্যানিয়ল সবে একটু গা এলিয়েছিল বিছানায়। দরজা খোলার শব্দ কানে এলেই চোখ খুলে ফেললো। দরজা বন্ধ করার শব্দ হলো এর মাঝে। শুনতে পেল মিরান্ডার জোর গলা,
“তোমার আচরণ দেখে আজ আমি স্তব্ধ হয়ে গেছি ক্যানি। কখনও ভাবতেও পরিনি তুমি তোমার ড্যাডের কাছে এমন অকপটে সবকিছু বলে দেওয়ার সাহস রাখো। তোমার সাহস কীভাবে হলো আমাকে বিয়ে করবে না এটা তোমার ড্যাডকে এমন স্ট্রেইট বলে দেওয়ার? ওই মেয়েটার জন্য করছো এসব তাই না? ওই মেয়েটা এখানে আসার পর থেকেই সব কিছু এলোমেলো হয়ে গেছে। আমাদের সম্পর্কটা আজ নড়বড়ে ওই মেয়েটার জন্য। ওই মেয়েটা তোমার মগজ ধোলাই করেছে!”

ক্যানিয়লের শিরা-উপরিশায়ও রাগ বইতে শুরু করলো। সে শোয়া থেকে উঠে বসলো। বললো,
“গলা নিচু করে কথা বলো মিরান্ডা।”

মিরান্ডা ঝড়ের মতো ক্ষিপ্র গতিতে এগিয়ে এসে ধা’ক্কা দিলো ক্যানিয়লকে। ক্যানিয়লের মাথা ধাক্কা খেলো বিছানার নরম গদিতে। মিরান্ডা নুয়ে পড়লো ক্যানিয়লের উপর। দু চোখে রাগ, মুখ কঠিন, কাঁপছে রাগে। কর্কশ কণ্ঠে বললো,
“আমাকে বিয়ে করবে না এই সিদ্ধান্ত তুমি খুব ভালোভাবেই নিয়ে ফেলেছো, তাই না? মনে রেখো চরম ভুল একটা সিদ্ধান্ত এটা। যে ঝড়ের সৃষ্টি তুমি করেছো এই ঝড় ওই মেয়েটার উপর বয়ে তবেই শেষ হবে। মনে রেখো।”

রাগে ক্যানিয়লের মুখও কেঁপে উঠলো। হিংস্র সত্ত্বা গর্জে উঠলো ওর মাঝে। মিরান্ডাকে জোরে এক ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো নিজের কাছ থেকে। ধাক্কাটা এত শক্তিশালী ছিল যে মিরান্ডা ছিটকে গিয়ে ফ্লোরে পড়লো। ব্যথায় মৃদু স্বরে এক আর্তনাদ নির্গত হলো ওর মুখ থেকে। ক্যানিয়লের দিকে তাকিয়ে রাগে ফুঁসতে লাগলো। ক্যানিয়ল এসে বসলো মিরান্ডার কাছে। ওর ঠান্ডা চোখের চাহনি ভয়ংকর লাগছে। তবুও তটস্থ হলো না মিরান্ডা।
ক্যানিয়ল বললো,
“তুমি মেয়ে এবং ছোটো বেলা থেকে আমরা একসাথে বড়ো হয়েছি, তা না হলে এতক্ষণে তোমার এই সুন্দর গলাটায় আমার হাতের ছাপটা আরও সৌন্দর্য নিয়ে ছেপে যেত। শ্বাস রুদ্ধ হতো তোমার।”

মিরান্ডা বললো,
“সেটা তো তুমি পারবে না। কিন্তু আমি কথা দিচ্ছি, যাকে তুমি মিসেস উমরান করার সিদ্ধান্ত নিয়েছো তার গলায় আমার হাতের ছাপ স্পষ্টভাবে এঁকে দেবো আমি। শ্বাস রু’দ্ধ করে দেবো। তোমাকে আমি কাঁদিয়ে ছাড়বো, মনে রেখো।”

(চলবে)

#উড়ো_পাতার_ঢেউ
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ৫৪
_________________

রাতে ভালো ঘুম হয়নি। মাথার ভিতর শুধু একটা চিন্তাই ঘূর্ণমান ছিল, বাবাকে সবটা কীভাবে জানাবে? কীভাবে বোঝাবে? খুব শীঘ্রই ইরতিজা বাবাকে সবটা জানিয়ে দেওয়ার তাগিদ অনুভব করছে। কিন্তু কীভাবে জানাবে ভাবতে গেলেই ভয়ে তার ভিতরটা মিইয়ে যাচ্ছে। বাবা ব্যাপারটা কীভাবে নেবে? চিন্তায় চিন্তায় পাগল হয়ে যাওয়ার উপক্রম ইরতিজার। সকাল বেলা সে উঠলো না রোজকার সময় মেনে। ঘুমাচ্ছিল যে তা না। বালিশে এক গাল ডুবিয়ে সে এসব নিয়েই ভেবে যাচ্ছিল বিরতিহীন। কীভাবে বলবে মনে মনে সেটা সাজাচ্ছিল। কতকদূর গিয়ে আবার সেই সাজানো-গোছানো পরিকল্পনা ভেঙে চুরমার করে দিচ্ছিল। এমনভাবেই যখন চলতে লাগলো তার মস্তিষ্কের কার্যকলাপ, তখনই জোনাসের কল এলো। ইরতিজা অবাক হলো। ওই ঘটনার পর জোনাস তাকে কল দিতে পারে এ তার ধারণা যোগ্য ছিল না। প্রথমে ভাবলো কল রিসিভ করবে না, পরে আবার জোনাসের অবস্থা সম্পর্কে জানার প্রয়োজন বোধ করলো। ক্যানিয়ল যেমন মারাত্মক ভাবে আঘাতটা করেছিল জোনাসকে… ইশ! চোখ খিঁচে ধরলো ইরতিজা। দৃশ্যটা মনে না করাই শ্রেয়। ইরতিজা কল রিসিভ করে নীরব রইল। ওপাশ থেকেও কেউ কিছু বললো না।
কিছু সময় পার হওয়ার পর জোনাসের কণ্ঠ শোনা গেল,
“তোমার সাথে দেখা করতে চাই টিজা। তুমি কি একবার সুইমিংপুলের এখানে আসবে?”

“আমার মনে হয় না ওই ঘটনার পর আমাদের মাঝে আর কোনো দেখা সাক্ষাতের বিষয় অবশিষ্ট থাকতে পারে। আমার সাথে আর দেখা করার চেষ্টা করো না জন।”

“তুমি না এলে আমি তোমার বাড়ি যেতে বাধ্য হবো।”

ইরতিজা গ্রাহ্য করলো না জোনাসের কথা। কল কেটে দিলো। কান্নায় বুক ভার হয়ে এলো তার। এক হাত দিয়ে কম্বল আঁকড়ে ধরলো শক্ত মুষ্টিতে। এই ছেলেটা তার জীবনের আরেক জ্বালাময় ব্যক্তি। যেসব বিষয় অনেক আগে ক্লোজ হয়ে গেছে সেই বিষয়গুলো আবার জাগিয়ে তুলছে ছেলেটা। ভালোবাসে এটা পুরোনো একটা বিষয় ছিল। মাঝখান দিয়ে তাদের সম্পর্কে তীব্র ঘৃণার ঝড় বইছিল শুধু। কিন্তু পুরোনো সেই ভালোবাসার বিষয়টা আবার জাগ্রত করেছে। বিব্রতকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। আগের মতো এবারও প্রত্যাখ্যান হয়ে জোনাসের মানসিক অনুভূতি কেমন এখন? ওর মনে কি এখন আরও তীব্র ঘৃণা ঝংকার তুলেছে? ইরতিজা আর ভাবতে চাইলো না। বিছানা ছেড়ে নামলো।
ফ্রেশ হয়ে কিছু খাওয়ার জন্য কিচেনে গেল। বাড়িতে কেউ নেই এখন। কাজে বেরিয়ে পড়েছে সবাই। ইরতিজাও চাইছে সে পার্ট টাইম জব করবে। তাতে জবটা যে ধরনের হোক, সমস্যা নেই। নিজের কিছু ইনকাম তো থাকবে।
দরজায় করাঘাতের শব্দ কানে এলো নিস্তব্ধতার বুক চিরে। ইরতিজার বুকে ভয় ঠকঠকিয়ে উঠলো। জোনাস সত্যি সত্যি আসেনি তো আবার? কিছুক্ষণ কান পেতে রইল। কিন্তু দ্বিতীয়বার আর কোনো শব্দ শোনা গেল না। ব্যাপার কী? এটা কি জোনাস ছিল? না কি জুহি অথবা রিশন? ইরতিজা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। একবার না গিয়ে দেখলেই নয়।
ইরতিজা দরজার কাছে এসে ডোর ভিউতে উঁকি দিলো। সামনেটা ফাঁকা। যে এসেছে সে কি চলে গেছে? ইরতিজা দরজাটা খুললো। দরজা অর্ধ ফাঁকা হলেই সে জোনাসের অর্ধ অবয়ব দেখতে পেল। দরজার কপাট আর না খুলে ওখানেই থমকে গেল ইরতিজা। দ্রুত দরজা বন্ধ করতে যাবে তখনই জোনাস দরজাটা চেপে ধরলো শক্ত হাতে। ইরতিজার সারা শরীর কেঁপে উঠলো। জোনাস বললো,
“বলেছিলাম আমি আসবো।”

জোনাস দরজার ওপাশে হাত বাড়িয়ে ইরতিজার একটা হাত চেপে ধরলো। একটানে ইরতিজাকে বের করে আনলো ঘর থেকে। ইরতিজা ঘরে প্রবেশের চেষ্টা করলেই জোনাস এবার ওর দুই হাতই শক্ত করে চেপে ধরলো। বললো,
“বোকা বাচ্চাদের মতো ছটফট করো না টিজা। তুমি বাচ্চা নও। শান্ত থাকো। তাহলে আমিও শান্ত থাকবো।”

“অশান্ত থাকলে কী করবে তুমি?” রক্তচক্ষুতে তাকিয়ে বললো ইরতিজা।

জোনাস একটু অদ্ভুত হাসলো। বললো,
“যা করবো সেটা নিশ্চয়ই তুমি চাইবে না। হাগ করার কথাই ধরো। তুমি কি চাইবে আমি তোমাকে হাগ করি?”

জোনাস ইরতিজাকে নিজের নিকটে টেনে নেওয়া দিলেই ইরতিজা বলে উঠলো,
“স্টপ।”

জোনাস হাসলো,
“বরাবরই তোমার সাথে মজা করতে ভালো লাগে টিজা।”
বলে আবারও হাসলো। তারপর বললো,
“লিসন, আমার জাস্ট কিছু কথা বলার আছে তোমাকে। তাই চলো আমার সাথে।”

ইরতিজা দরজাটা বন্ধ করে দিলো। জোনাস ইরতিজাকে নিয়ে এলো সুইমিংপুলে। যেহেতু সে আগেই এখানে বসে ইরতিজার সাথে কথা বলার ইচ্ছা পোষণ করেছিল। এখানে এসে সে ইরতিজার হাত ছেড়ে দিলো। তাদের দুজনের মাঝে দুই-তিন কদম দূরত্বের সৃষ্টি হলো। ইরতিজা জোনাসের নাকের দিকে তাকিয়ে আছে। জোনাসের নাকে আঘাতটা বেশ মারাত্মক ভাবেই লেগেছিল। ঘু’সি মা’রার পরপরই ওর নাক দিয়ে অঝরে রক্ত পড়তে শুরু করেছিল। কিন্তু সে তুলনায় ওকে এখন বেশ সুস্থ মনে হচ্ছে। নাকে ব্যান্ডেজ নেই। কিন্তু নাকটা কেমন অস্বাভাবিক দেখাচ্ছে। জোনাসের কথায় জোনাসের নাক থেকে দৃষ্টি সরে গেল ইরতিজার,
“আমি কেন তোমার কাছে গ্রহণযোগ্য নই টিজা? কী দোষ আমার? দুই দুইবার প্রত্যাখ্যান করেছো আমায়! কী কারণ? আমি কি দেখতে অসুন্দর? না তো, আমি যথেষ্ট সুন্দরই আছি। এমনকি আমার ফ্যামিলিও বেশ উন্নত। ভবিষ্যতে আমার ভালো ইনকাম করার সোর্সও থাকবে। তাহলে দোষটা কী আমার?”

“আমি তোমার সাথে এ ব্যাপারে কথা বলতে একেবারেই অনিচ্ছুক।”

“তাহলে কোন ব্যাপারে কথা বলতে ইচ্ছুক তুমি?”

“আমি তোমার সাথে সবরকম কথা বলতেই অনিচ্ছুক।”

“কিন্তু এ ব্যাপারে কথা বলাটা প্রয়োজন। তোমাকে বলতেই হবে, আমার দোষ কী? উত্তর দাও।” বেশ উঁচুতে চড়ে গেল জোনাসের গলা।

ইরতিজা অতিষ্ঠ বোধ করছে। এসব ব্যাপার সে এড়িয়ে চলতে চায়। সেই এক প্রশ্ন, কী দোষ? জোনাস জানে না ওর কী দোষ? ইরতিজা বললো,
“আমি চলে যাচ্ছি। এসব ফালতু ব্যাপারে কথা বলার জন্য আমাকে নিয়ে এসে একদম ঠিক করোনি।”

ইরতিজা পা বাড়ালো। জোনাস ঝড়ের বেগে এসে ওর পথ আটকে দাঁড়িয়ে বললো,
“আর এক পা সামনে এগোবে না। এরকমভাবে বার বার এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছো আমায়। এবার ওসব চেষ্টা বাদ দাও। উত্তর দাও আমার প্রশ্নের। কী দোষ আমার?”

ইরতিজা এবার অতিষ্ঠ হয়ে বলে উঠলো,
“দোষের কথা বাদই দিলাম। নিজের ধর্মের দিকে দেখো জন। তোমার আর আমার ধর্ম ভিন্ন। তুমি ক্রিশ্চিয়ান আর আমি মুসলিম।”

জোনাস এবার বিরক্ত হওয়ার ভঙ্গি করে বললো,
“উহুঁ টিজা, তুমি বার বার ধর্মের প্রসঙ্গ কেন টানো? এখানে ধর্ম কেন এত মুখ্য তোমার কাছে? আমি তো কখনও তোমার ধর্ম নিয়ে কিছু বলিনি। ভবিষ্যতেও বলবো না কখনও। আমরা যে যার ধর্ম পালন করবো। এখানে তো সমস্যার কিছু নেই। তাহলে ধর্ম নিয়ে কেন এত উদ্‌বিগ্ন তুমি?”

ইরতিজা জোনাসের চোখে স্থির দৃষ্টি রেখে দৃঢ়তার সাথে বললো,
“তোমার সমস্যা না থাকলেও আমার সমস্যা ছিল। একজন ভিন্নধর্মীকে কখনও আমি নিজের জীবনসঙ্গী হিসাবে মানতে পারবো না। আর না তো এটা আমার ফ্যামিলি মানবে। আচ্ছা সকল ব্যাপার বাদ দিলাম। তুমি শুধু আমাকে এটা বলো, তুমি কি আমার জন্য কখনও নিজের ধর্ম ত্যাগ করতে পারতে বা পারবে?”

জোনাস অপ্রস্তুত হয়ে গেল ইরতিজার এই প্রশ্নে।
“তুমি এই…”

“শুধু হ্যাঁ অথবা না’তে জবাব দাও।”

জোনাস থমকে রইল কিছুক্ষণের জন্য। তারপর বললো,
“অবশ্যই না। আমি আমার ধর্মকে ভালোবাসি। সুতরাং এটা ত্যাগ করার প্রশ্নই আসে না।”

“সেটাই, তুমি পারবে না এটা ত্যাগ করতে। তুমি করতে সম্মত হলেও তোমার মা-বাবা কখনও এটা মানবে না। তুমি তাদের একমাত্র সন্তান। খুব বেশি আদরের সন্তান। তুমি তাদের মনে কষ্ট দিয়ে অন্য ধর্ম গ্রহণ করতে পারবে না। তাদের ছেড়ে তুমি থাকতে পারবে না, তারাও তোমাকে ছেড়ে থাকতে পারবে না। আমাদের মাঝে বড়ো একটা দেয়াল ছিল ধর্ম। এটা মাথায় রাখবে। তোমাকে ভালোবাসা কখনও সম্ভব ছিল না কারণ তুমি একজন ভিন্নধর্মী মানুষ। আমি বন্ধু হিসেবে যথেষ্ট ভালোবাসতাম তোমায়। বলতে পারো এখন আমি তোমাকে ঘৃণা করি, তবুও তোমার প্রতি বন্ধুত্বের একটা টান আছে। কিন্তু ওরকমভাবে ভালোবাসা এটা জাস্ট অসম্ভব। কখনও সম্ভব না। বুঝতে পেরেছো? আমি মুসলিম, তুমি ক্রিশ্চিয়ান। তুমি কোনো দিন তোমার ধর্ম ত্যাগ করতে পারবে না সেটা আমি শুরু থেকে জানি।”

ইরতিজা জোনাসের পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়া দিলেই জোনাস বললো,
“আমি ক্রিশ্চিয়ান এটাই কি শুধু আমাকে মেনে না নেওয়ার কারণ?”

ইরতিজা থেমে গেল।

“ওই ছেলেটা কোনো কারণ নয়?”

পিছন ফিরে তাকালো ইরতিজা।

জোনাস বললো,
“ধরে নাও আমি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলাম, তখন তুমি কী করবে? ভালোবাসবে আমাকে? ওইরকম ভালোবাসা?”

“প্রথম যখন আমাকে প্রোপোজ করেছিলে, তখন যদি তুমি তোমার ধর্ম পরিবর্তন করতে আমি জানি না আমি কী করতাম! কিন্তু ব্যাপারটা এখনকার হলে আমি স্পষ্ট জানি আমি কী করবো। যদিও তুমি তোমার ধর্ম কখনোই ত্যাগ করবে না। ওইরকম ভালোবাসা ইতোমধ্যে অন্য কেউ দখল করে নিয়েছে। এই হৃদয়ে আর একটু জায়গাও খালি নেই। এটা পূর্ণ, তার ভালোবাসায়। আমার হৃদয়ের সবটা জুড়ে শুধু তার বিচরণ।”

জোনাস দাঁতে দাঁত চেপে অস্ফুট স্বরে উচ্চারণ করলো,
“ইউ পাঙ্ক!”
এরপর সে ইরতিজার দিকে এগিয়ে এসে ক্ষুব্ধ গলায় বললো,
“তুমি কী ভাবো নিজেকে? আমার জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলে এখন কোন মুখে বলছো তোমার হৃদয় অন্য কারো ভালোবাসায় পূর্ণ?”
জোনাস দুই হাত দিয়ে চেপে ধরলো ইরতিজার দুই গাল। খুব কঠিন হাতে ধরলো।
“তুমি জানো তোমার জন্য আমার মস্তিষ্ক, আমার হৃদয়, আমার সর্ব চেতনায় কেমন প্রলয় ঝড় বয় সব সময়? আমি ছটফট করি। এক মুহূর্ত শান্তিতে থাকতে পারি না। আমার হৃদয় শুকিয়ে মরুভূমি হয়ে যায় তোমার ভালোবাসার তেষ্টায়। অথচ তুমি কখনও বোঝার চেষ্টা করোনি আমায়। শুকনো মরুভূমি কখনও এক ফোঁটা জল পরিমাণও সিক্ত করে তোলোনি তোমার ভালোবাসায়! সব সময় শুধু একেকটা বাহানা দিয়ে সরিয়ে দিয়েছো। অথচ আজ বলছো তোমার হৃদয়ে একটু জায়গাও খালি নেই? সব পূর্ণ অন্য কারো ভালোবাসায়? অসম্ভব!”
জোনাস এবার ইরতিজার গাল থেকে হাত সরিয়ে নিলো। দুই হাতে চেপে ধরলো ইরতিজার দুই বাহু। এত কঠিনভাবে চেপে ধরলো যে ইরতিজার মনে হলো ওই স্থানটা বিষ হয়ে উঠছে ব্যথায়।
জোনাস অগ্নি চোখে তাকিয়ে থেকে বললো,
“আমার জীবন আগে সকালের স্নিগ্ধ রোদের মতো উজ্জ্বল ছিল। কিন্তু তোমার কারণে এখন এটা অমানিশার আঁধারের মতো হয়ে গেছে। আমাকে আমার সেই উজ্জ্বল জীবন ফিরিয়ে দাও। ফিরিয়ে দাও সেটা। মুছে ফেলো ওর জন্য তোমার মনের সকল ভালোবাসা। ওই ভালোবাসা কেবল আমার জন্য। ও একটা নর্দমার কীট! তোমার ভালোবাসা শুধু আমার। তোমাকে আমার প্রয়োজন। আই নিড ইউ। আই নিড ইউ।”

“তুমি বুঝতে পারছো না কেন? আমি অন্য কারো।”

জোনাস আরও জোরে চেপে ধরলো ইরতিজার হাত। ব্যথায় ইরতিজার দু চোখে পানি এসে গেল।
জোনাস কঠিন স্বরে বলতে লাগলো,
“না তুমি নও। তুমি আমার। তোমার কোনো অধিকার নেই আমার জীবন নষ্ট করার। কিন্তু তুমি তা করেছো। তোমার কোনো অধিকার ছিল না আমাকে সর্বক্ষণ ছটফটানির ভিতর রাখার, কিন্তু তুমি তা রেখেছো। এসব করার পর তোমার অধিকার নেই আমাকে ছেড়ে যাওয়ার। আর যদি যেতে চাও তাহলে আমার জীবনকে ঠিক তেমন করে দাও যেমন ছিল তোমাকে ভালোবাসার আগে। করে দাও তেমন। দাও।”
চিৎকার করে উঠলো জোনাস।

ইরতিজার হৃৎপিণ্ড যেন কষ্টে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যাচ্ছে। অতিষ্ঠতা ঝাপটে ধরেছে তাকে। দম বন্ধ হয়ে আসছে তার। সে ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়ে জোনাসকে ছিটকিয়ে সরিয়ে দিলো কাছ থেকে। চেঁচিয়ে উঠলো,
“তুমি পাগল হয়ে গেছো জন। ইউ আর সিক! নিউ ইয়র্ক ফিরে গিয়ে চিকিৎসা করাও তোমার। সাইকোলজিস্টের কাছে যাও। দয়া করে আর বিরক্ত করো না আমায়। অতিষ্ঠ হয়ে গেছি আমি। আমার জীবনে তো অনেক আগেই জ্বালার সৃষ্টি করে দিয়েছো তুমি। এখনও আমাকে আর কী জ্বালানো বাকি আছে তোমার? মেরে ফেলতে চাও আমাকে? মেরে ফেলো।”
ইরতিজা জোনাসের কাছাকাছি এসে জোরে চিৎকার করে বললো,
“মেরে ফেলো আমায়!”

ইরতিজা রাগে রক্তিম চক্ষুতে চেয়ে আছে জোনাসের দিকে। মেয়েটা আজকের মতো এত বেশি আর কখনও রেগে যায়নি। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর ইরতিজা দ্রুত চোখ সরিয়ে নিয়ে ঘুরে দাঁড়ালো। প্রস্থান করার জন্য এক পা, দুই পা, তিন পা যখন এগোলো তখন হঠাৎই জোনাস ওর একটা হাত পিছন থেকে টেনে ধরে ওকে ঘুরিয়ে সুইমিংপুলের দিকে নুইয়ে ধরলো। আতঙ্কে ফ্যাকাশে হয়ে গেল ইরতিজার মুখ। ধুক ধুক শব্দ করতে লাগলো হৃৎপিণ্ড। ভয় এবং বিস্ময় জড়িয়ে তাকিয়ে রইল সে জোনাসের দিকে।
জোনাস হৃদয়ের ঘৃণা নিংড়িয়ে বললো,
“তুমি বিরক্তিকর! বাজে! আমি ভুল করেছি তোমায় ভালোবেসে। ভুল করেছি তোমায় ঘৃণা করেও। তুমি আমার জীবনের বৃথা একটা অংশ বৈ আর কিছুই না!”

জোনাস ছেড়ে দিলো ইরতিজাকে। সে এমনভাবে ইরতিজাকে ধরে রেখেছিল যে, সে ছেড়ে দিলেই ইরতিজা পড়ে যাবে পানিতে। আর তাই হলো। সে ইরতিজাকে ছেড়ে দেওয়ার সাথে সাথে ইরতিজা পড়ে গেল হিম শীতল পানির মাঝে। না কিছু বলার সুযোগ পেল ইরতিজা, আর না কিছু করার। ঝপ করে একটা শব্দ হলো পানিতে। হিমশীতল পানির নিচে যখন ক্ষণিকের জন্য তার মাথা ডুবে গেল, তখন মনে হলো তার প্রাণটা বেরিয়ে যেতে চলেছে দেহ থেকে। সে ধড়ফড় করে মাথা উপরে তুললো। শ্বাস নিতে লাগলো জোরে জোরে। এদিকে তার শরীর জমে যাচ্ছে প্রচণ্ড এই ঠান্ডা পানিতে। সে তাকালো জোনাসের দিকে। জোনাসের ঠোঁটের কোণে আনন্দের হাসিটুকু দেখতে পেয়ে স্তব্ধ হয়ে গেল। জোনাস তাকে এই ঠান্ডার ভিতর এই বরফ সম পানিতে ফেলে দিয়ে আনন্দিত? তাকে ফেলে দিয়ে মজা পাচ্ছে? ঘৃণায় বিষাক্ত হয়ে উঠলো ইরতিজার অন্তঃকরণ। জোনাস চলে গেল।
ইরতিজা অনুভব করছে এই হিমশীতল পানিতে তার শরীর চেতনা হারাচ্ছে ক্রমশ। অবশ হয়ে যাচ্ছে তার গোটা শরীর। সে পানি থেকে ওঠার জন্য ফ্লোরের উপর হাত রাখলো। এমন সময় দেখতে পেল জুহি আর রিশন দৌড়ে আসছে তার দিকে। দৃষ্টি জোড়া ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে তার। চেতনা বিলুপ্তির পথে। ফ্লোরের উপর রাখা হাত দুটো খসে পড়ে গেল আবারও পানিতে।
জুহি আর রিশন মিলে ইরতিজাকে টেনে তুললো পানি থেকে উপরে। রিশন গায়ের জ্যাকেট খুলে ইরতিজার শরীরে জড়িয়ে দিলো। ইরতিজাকে নিয়ে দ্রুতই বাসায় পৌঁছাতে হবে। মেয়েটা অজ্ঞানও হয়ে যেতে পারে!

________________

“বেয়াদবটার সাহস কীভাবে হলো তোমার সাথে এটা করার? ইচ্ছা করছে পুলিশে দিই অসভ্যটাকে! তোমার জীবন নরক করেও বেয়াদবটার মন ভরেনি। এখন তো দেখছি তোমাকে মেরে ফেলতে চায় ও। ভাগ্যিস আমি আর রিশন তখন পেনড্রাইভটা খুঁজতে গিয়েছিলাম। আর না হলে তোমার যে অবস্থা ছিল তাতে তো তুমি পানি থেকে উঠতেই পারতে না। খুব খারাপ কিছু ঘটতে পারতো!”

ইরতিজা কাঁদছে। দু চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে অনর্গল জল ধারা। বর্তমানে সে নিজের রুমে নিজের বিছানায় অবস্থান করছে। হেলান দিয়ে বসে আছে বেডের সাথে। গায়ে কম্বল টেনে দেওয়া বুক পর্যন্ত। সে কাঁদতে কাঁদতে জুহিকে বললো,
“আমি ভাবতে পারিনি জোনাস এমনটা করবে। আমি ভাবতাম ওর মাঝে হয়তো কিছুটা হলেও বন্ধুত্বের টান আছে। কিন্তু ও আসলে শত্রুর থেকেও নিকৃষ্ট। ওর জন্য ঘৃণা অনুভব করতেও ঘৃণা হচ্ছে আমার।”

জুহি টুল থেকে উঠে জড়িয়ে ধরলো ইরতিজাকে।
“কেঁদো না টিজা। কেন কাঁদছো তুমি? শরীর খারাপ করবে তো আরও। কান্না থামাও। আমি ক্যানিকে বলবো এটা সম্পর্কে। ও জানতে পারলে জোনাসকে মে/রে হাড়গোড় ভে/ঙে দেবে।”

ইরতিজা বললো,
“না, ক্যানিয়লকে জানানোর দরকার নেই এটা সম্পর্কে। তুমি এ বিষয়ে ওকে কিছু বলবে না।”

জুহি ইরতিজাকে ছেড়ে দিয়ে বললো,
“ঠিক আছে বলবো না। কিন্তু তুমি কান্না থামাও।”

ইরতিজা কান্না বন্ধ করলো। রিশন রুমে প্রবেশ করলো হাতে একটা গ্লাস নিয়ে। গ্লাসের ভিতর মিল্ক দিয়ে তৈরি একটা পানীয় দেখা যাচ্ছে। সে গ্লাসটা ইরতিজার দিকে বাড়িয়ে দিলো। ইরতিজা নিলো। জুহি ঘড়িতে সময় দেখে রিশনকে বললো,
“তুমি টিজার কাছে থাকো। বিশ মিনিট পরই পিটারের সাথে আমার ডেট আছে। আমার যেতে হবে।”

জুহি ব্যস্ত পায়ে দরজার দিকে দৌড় দিলো। আবার থেমে ইরতিজার দিকে ফিরে বললো,
“যা যা প্রয়োজন হবে সব রিশনকে বলবে। মনে করবে ও তোমার বাসার মেইড।”

বলেই সে বেরিয়ে গেল। রিশনের মুখ হা হয়ে গেছে বোনের কথা শুনে। সে অবিশ্বাস্য কণ্ঠে বললো,
“মেইড?”
তারপর গর্জে উঠে বললো,
“আমার ফ্যানরা যদি জানতে পারে তুমি আমার সম্বন্ধে এমন কথা বলেছো, তাহলে নিশ্চিত ওরা তোমায় তুলে নিয়ে গিয়ে ঠান্ডা পানিতে ভিজিয়ে রাখবে!”

ইরতিজা হেসে উঠলো। রিশন বিস্ময় নিয়ে ইরতিজার দিকে তাকিয়ে বললো,
“হাসছো কেন?”

______________

ইরতিজা সারাদিনে আর রুম থেকে বের হলো না। সন্ধ্যায়ও সে শুয়ে রইল। শরীরের দুর্বল ভাবটা কমে এসেছে। আব্বু এবং মা দুজনই তাকে এমন থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করেছে, সে অসুস্থ কি না? ইরতিজা বলেছে এটা তেমন কিছু না। একটু দুর্বল অনুভব করছে, এই যা।
সন্ধ্যায় একটা কল এলো ইরতিজার মোবাইলে। কল রিসিভ করে যা শুনলো তাতে হৃৎপিণ্ড কিছুক্ষণের জন্য নিজের কাজ বন্ধ করে দিলো। সে থম মেরে রইল কিছু সময়। তারপর আর শুয়ে থাকলো না। দ্রুত বিছানা ত্যাগ করে নামলো। রুম থেকে বের হওয়ার আগে ক্লোজেট খুলে একটা কোট বের করে পরে নিলো শীঘ্র। তারপর দৌড়ে বাসা থেকে বের হলো। দেখতে পেল রিশনও বের হয়েছে। রিশন নিশ্চয়ই যেখানে যাবে সেখানে গাড়ি নিয়েই যাবে। ইরতিজা উৎকণ্ঠা হয়ে বললো,
“আমাকে একটা জায়গায় পৌঁছে দাও রিশন।”

“কোথায়?”

“যেতে যেতে বলছি তোমায়।”

ইরতিজা দৌড়ে পার্কিং সাইডের দিকে যেতে লাগলো। রিশন কিছু বুঝে উঠতে পারলো না। ইরতিজার পিছন পিছন আসতে আসতে বললো,
“কী হয়েছে? হঠাৎ এরকম করছো কেন? তুমি তো অসুস্থ, বাইরে কেন এসেছো?”

(চলবে)