উড়ো পাতার ঢেউ পর্ব-৫৫+৫৬

0
351

#উড়ো_পাতার_ঢেউ
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ৫৫
_________________

রিশন হার্বরভিউ মেডিকেল সেন্টারের পার্কিং এরিয়ায় গাড়ি পার্ক করলো। হন্তদন্ত হয়ে নেমে গেল ইরতিজা। দৌড়ে প্রবেশ করলো ভিতরে। রিশনও দৌড়ে পিছন পিছন এলো। সে বুঝতে পারছে না ঘটনার আগা-গোড়া। কী হয়েছে জিজ্ঞেস করেও সে উত্তর পায়নি ইরতিজার থেকে। ইরতিজা গাড়িতে বসে কাঁদতে শুরু করেছিল। তার চোখের পাপড়ি এখনও ভিজে আছে। সে জানতো মি. হেনরি কোথায় আছে, তাই সে সোজা সেখানে চলে এলো। করিডোরে দাঁড়িয়ে আছে মি. হেনরি। হেনরিকে দেখে ইরতিজার দ্রুতগামী পা জোড়া হঠাৎ দুর্বল হয়ে পড়লো। মনের ভিতর খারাপ শঙ্কার ডঙ্কা বাজছে। ইরতিজা ভিতরের কান্নাকে চেপে রেখেছে ভীষণ কষ্টে। ধীর পায়ে এগিয়ে এসে সে থামলো মি. হেনরির সামনে। কাঁপা কাঁপা স্বরে জানতে চাইলো বেলা লিমাসের সম্পর্কে। মি. হেনরি কয়েক সেকেন্ড নিষ্পলক তাকিয়ে রইল। তারপর বললো,
“শি ইজ ডেড!”

ইরতিজার বুকের ভিতর বিকট শব্দে কিছু একটা বিস্ফোরণ হলো। সে স্তম্ভিত হয়ে কিয়ৎক্ষণ তাকিয়ে রইল মি. হেনরির দিকে। তারপর হঠাৎই সে বসে পড়লো দেয়াল ঘেঁষে। আর ডুকরে কেঁদে উঠলো। তার কান্নার ধ্বনি ধীরে ধীরে তীব্র হতে লাগলো। রিশন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অবাক হয়ে দেখছে ইরতিজাকে। কে মারা গেছে? কার জন্য কাঁদছে ইরতিজা? প্রশ্ন দুটো মনে ধরে দাঁড়িয়ে রইল। কারণ পরিস্থিতি এমন যে প্রশ্নটা সে চাইলেও করতে পারবে না।
ইরতিজার কান্না থামছে না। একে তো সে বেলা লিমাসের মৃত্যুতে ব্যথিত। আবার ক্যানিয়লের কথা ভেবেও সে নিজের কষ্টকে চেপে রাখতে পারছে না। মি. হেনরি যখন বলেছিল, বেলা লিমাসকে হসপিটালে এনে ইমারজেন্সিতে ভর্তি করা হয়েছে এবং তার অবস্থা খুবই সংকটাপন্ন, তখনই ইরতিজার বুক ছ‍্যাতঁ করে উঠেছিল ভয়ে। সে সংবাদটা শোনার পর সাথে সাথে ছুটে এসেও বেলা লিমাসকে জীবিত দেখতে পেল না। এতটুকু সময়ের ভিতর বেলা লিমাসের আত্মা এ ধরা থেকে বিদায় নিয়েছে। ইরতিজা হাতে অর্ধ মুখ ডুবিয়ে কেঁদে যাচ্ছে সমানে। মি. হেনরি আর দাঁড়িয়ে রইল না। ক্যানিয়লকে কি এখনই ব্যাপারটা জানানো উচিত নয়? সে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে কল করলো ক্যানিয়লকে।

“কোথায় তুমি?”

“এন্ডারসন হাউজে।”

“আমি আসছি।”

“কেন? তোমার ওয়াইফ কি তোমাকে বাসা থেকে বের করে দিয়েছে?”
বলে হেসে উঠলো ক্যানিয়ল। তারপর মজা থামিয়ে বললো,
“ঠিক আছে, আসো। আমি তোমাকে রাতে দামি কিছু ডিনার করাবো।”

কল কেটে দেওয়ার পর মি. হেনরি ভাবতে লাগলো, এই ছেলেটার গলায় এখন কষ্টের ছাপ নেই। স্বাভাবিক। অথচ কিছুক্ষণ পরই ওই স্বাভাবিকতা মাড়িয়ে অস্বাভাবিক যন্ত্রণা নেমে আসবে ছেলেটার হৃদয়ে। ছেলেটা কাঁদবে! ওই কান্নারত মুখ দেখার মতো দ্বিতীয় কোনো বিষাদপূর্ণ দৃশ্য হয়তো আর নেই। বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো মি. হেনরির।

এন্ডারসন হাউজে পৌঁছে দেখলো ক্যানিয়ল ঘাসের উপর বল রেখে তাতে হকি স্টিক দিয়ে সজোরে আঘাত করছে। আর বলটা ক্ষিপ্র গতিতে উড়ে গিয়ে পড়ছে দূরে। মি. হেনরিকে দেখে এক মুহূর্তের জন্য থামলো ক্যানিয়ল। তারপর আবার নিজের কাজ শুরু করলো। ওর পিছনে একটা ঝুড়ি, যাতে অনেকগুলো বল দেখা যাচ্ছে। যে বলটা উড়ে গিয়ে দূরে পড়ছে তা এনে তাতে দ্বিতীয়বার আর আঘাত করছে না। নতুন বল নিয়ে আবার একই কাজ করছে। দূরে আঘাতে উড়ে যাওয়া বলগুলো ছোটো-খাটো একটা দল গঠন করেছে।
মি. হেনরি ইতস্তত করছে কথাটা বলতে। সে কথাটা প্রকাশ করতে একটু সময় নিলো। তারপর বললো,
“তোমার মম মারা গেছে ক্যানিয়ল!”

কথাটা কানে আসার সাথে সাথে থমকে গেল ক্যানিয়ল। সে বলে আঘাত করতে উদ্যত হয়েছিল। তার সারা শরীরে যেন বিজলি প্রবাহিত হলো এই মুহূর্তে। বেশ কিছুক্ষণ সে স্তব্ধ হয়ে একই ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইল। মানে সে নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। এই মাত্র কী শ্রবণ করলো সে? মি. হেনরির দিকে তাকালো। ইতোমধ্যে তার চেহারা অস্বাভাবিক রূপ ধারণ করেছে। ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে তাকে! হয়তো তার ভিতর কষ্টের আলাপন শুরু হয়ে গেছে। হ্যাঁ, হৃদয় জ্বালা করছে তার। কিন্তু তবুও সে কথাটাকে অবিশ্বাস করতে চাইলো। সে জোর করে হাসার চেষ্টা করে বললো,
“মজা করছো কেন মি. হেনরি? এটা কেমন মজা?”

মি. হেনরি কিছু বললো না। শুধু তাকিয়ে রইল। ক্যানিয়ল পড়তে পারলো মি. হেনরির চোখের ভাষা। ওই চোখে কোনো মিথ্যা নেই। আর মি. হেনরি এমন মজা করার মতো মানুষ নয় সেটা ভালো করেই জানে সে। ক্যানিয়লের অক্ষি কোটর ভরে উঠলো জলে। হৃদয় হাহাকার করে উঠলো। হৃদয়ের কষ্টের আর্তনাদ স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে সে। হৃৎপিণ্ড যেন একাধিক খণ্ডে বিভক্ত হচ্ছে। সে বলে উঠলো,
“এটা কখনোই সম্ভব নয়। সম্ভব নয় এটা!”

ক্যানিয়ল দৌড়ে গেল গাড়ির দিকে। মি. হেনরিও ওর পিছন পিছন যেতে যেতে ডাকলো,
“ক্যানিয়ল! ক্যানি!”

ক্যানিয়ল ড্রাইভিং সিটের দরজাটা খোলা দিলেই মি. হেনরি ওকে থামালো। সে জানে ক্যানিয়ল এখন ঠিকভাবে ড্রাইভিং করতে পারবে না। কারণ সেই মানসিক অবস্থা এখন ওর মাঝে বিদ্যমান নেই। সে বললো,
“পাশের সিটে গিয়ে বসো।”

ক্যানিয়ল তাই করলো। গাড়িতে উঠে বসার পরই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো ক্যানিয়ল।
ক্যানিয়লের সিটবেল্টটা পর্যন্ত মি. হেনরি বেঁধে দিলো। ক্যানিয়ল কাঁদতে কাঁদতে বললো,
“তুমি মিথ্যা বলছো, তাই না? এটা কীভাবে হতে পারে? কয়েকদিন আগেও সে আমার সাথে দেখা করতে এসেছিল! কীভাবে সম্ভব এটা? তুমি আমার সাথে এত কঠিন মিথ্যা বলার দুঃসাহস কীভাবে করলে? তোমাকে এর জন্য অত্যন্ত কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হবে! এমন মিথ্যা বলার শাস্তি খুবই ভয়ানক হবে!”
বলে আরও জোরে কাঁদতে শুরু করলো সে।

মি. হেনরির হৃদয়ও ব্যথায় নিমজ্জিত হচ্ছে। ক্যানিয়লের কান্না, কষ্টের তোড়ে বলা এসব কথা ভীষণ কষ্টের উৎপত্তি ঘটাচ্ছে তার ভিতর।
কিছুক্ষণ পর ক্যানিয়ল আবারও বললো,
“মম মৃত নয়! এটা অসম্ভব! তুমি মিথ্যা বলছো, তাই তো? এটা তোমার মিথ্যা ছাড়া আর কিছুই নয়!”
ক্যানিয়ল থামলো। কিছুক্ষণ পর বুকের বাঁ পাশে হাত রেখে আবার বললো,
“এখানটায় ব্যথা করছে মি. হেনরি। এত ব্যথা এর আগে কোনোদিনও অনুভব করিনি আমি। এটা অবশ্যই সত্যি নয়। এটা সত্যি হতে পারে না। কেন আমার সাথে এমন কঠিন মিথ্যার সাক্ষাৎ ঘটালে?”

ক্যানিয়ল কাঁদতে কাঁদতে ‘মম’ শব্দটি উচ্চারণ করতে লাগলো কেবল।

গাড়ি থামতেই নেমে গেল ক্যানিয়ল। মি. হেনরির বলা রুম নাম্বারে এসে ঢুকলো সে। ইরতিজা এবং রিশন সেই রুমের ভিতরে ছিল। এছাড়াও আরও দুইজন ব্যক্তি সে রুমে উপস্থিত। ইরতিজা এখানেও ফ্লোরে বসে হাতে মুখ গুঁজে কাঁদছিল। ভিতরে থাকা মানুষ দুজন বলাবলি করছিল ইরতিজা হয়তো বেলা লিমাসের মেয়ে। কিন্তু বেলা লিমাসের মেয়ে আছে তারা এ কথা কখনও জানতো না। তারা জানতো বেলা লিমাসের এক ছেলে আছে। এ নিয়ে তারা বিস্ময় প্রকাশ করছিল। পরে ভাবলো হয়তো তাদের জানার ভিতর ভুল ছিল। তারা বার কয়েক সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করেছে ইরতিজাকে।
দরজা খোলার শব্দ হলেই ইরতিজা মাথা তুলে চাইলো। ক্যানিয়লকে দেখা মাত্রই হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরলো সে। কান্না এবার আর্তনাদের বিকট শব্দ রূপে বেরিয়ে আসতে চাইছে তার মুখ দিয়ে।
ক্যানিয়লের থমথমে দৃষ্টি জোড়া বেডের উপর নিবদ্ধ। একজন শুয়ে আছে। তার মুখের উপর কাপড় টেনে রাখা। যার কারণে মুখ দেখতে পারছে না ক্যানিয়ল। ওটা কি তার মম? প্রশ্নটা মনে আসতেই হৃদয়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হওয়ার মতো অনুভূতি হলো। সে ধীর লয়ে এগিয়ে গেল বেডের কাছে। দু চোখ দিয়ে নোনা জল ঝরছে। কমলা চোখের এমন অশ্রু বিসর্জন ইরতিজার হৃদয় ক্ষত-বিক্ষত করে দিচ্ছে। ক্যানিয়ল কম্পিত কণ্ঠে ডাকলো,
“মম!”

মুখের উপর থেকে পর্দাটা সরানোর সাহস হচ্ছে না তার। অথচ সে কিন্তু খুব সাহসী। কখনও তাকে ভীত দেখা যায়নি। অথচ আজ তার মাঝে অনেক পরিবর্তন লক্ষণীয়! সে কাঁপা হাতে বেলা লিমাসের মুখের উপর থেকে পর্দা সরালো। সাথে সাথে যেন কেউ তার হৃৎপিণ্ডে ধারালো তরবারি দ্বারা আ’ঘা’ত করলো। সশব্দে কেঁদে উঠলো সে। ডাকলো মমকে,
“মম…মম!”
সে বলতে শুরু করলো,
“এটা কীভাবে হতে পারে? এটা কি আমার দুঃস্বপ্ন? ঘুম ভাঙলেই কি এই বিভীষিকাময় স্বপ্ন পলায়ন করবে?”
সে দুই হাতে মমের মুখ স্পর্শ করে বললো,
“মম, ওপেন ইওর আই! প্লিজ, ওপেন ইট। দেখো ইট’স মি। ইওর সান। প্লিজ, ওপেন ইওর আই। মম!” চিৎকার করে ডাকলো ক্যানিয়ল।
“একবার তাকাও। দয়া করে দেখো আমাকে। আমি তোমায় ভীষণ ভালোবাসি। প্লিজ আর একবার জড়িয়ে ধরো আমায়।”
বলে সে মমের মৃত দেহখানি বুকে জড়িয়ে ধরলো।
এই মুহূর্তে আরও বেশি করে জল ঝরলো ইরতিজার চোখ থেকে। দুইহাতে নিজের মুখ চেপে ধরলো শক্ত করে। সে চাইছে না কোনো কষ্টের ধ্বনি বেরিয়ে আসুক তার মুখ ছুটে। রিশনের চোখ দিয়েও কখন যে টুপটাপ করে জল ঝরে পড়তে লাগলো টের পেল না তা রিশন। ক্যানিয়লের কান্নামাখা আহাজারি সবার চোখেই জল এনে দিতে সক্ষম হলো। এক সময় থেমে গেল ক্যানিয়ল। মুখে তার আহাজারি থেমেছে, কিন্তু হৃদয়ের আহাজারি চলতেই থাকলো। আহাজারি থামলেও দু চোখের অশ্রু কিন্তু প্রবাহমানই রইল। সে ছেড়ে দিলো বেলা লিমাসকে। তারপর এক দৌড়ে বেরিয়ে গেল রুম থেকে। ইরতিজা তখন সচকিত হয়ে উঠলো। সেও ক্যানিয়লের পিছন পিছন দৌড়ে বেরিয়ে এলো। কিন্তু ক্যানিয়লকে ধরতে পারলো না। ক্যানিয়ল ততক্ষণে লিফটে উঠে গেছে। সে লিফটের কাছাকাছি আসতেই বন্ধ হয়ে গেল লিফটের দরজা। এই মুহূর্তে দিশেহারা অনুভব করলো ইরতিজা। কোথায় যাচ্ছে ক্যানিয়ল?
রিশনও ইরতিজার পিছন পিছন বেরিয়ে যেতে চাইলে মি. হেনরি বাধা দিয়ে বললো,
“ওদের কিছু সময় একা পার করতে দাও।”

রিশন আর সামনে এগোলো না। সে প্রথমে জানতো না কে মারা গেছে। কিন্তু এখন জানে। সে ভাবতো ক্যানিয়লের মা সোফিয়া হবে হয়তো। কিন্তু আজ জানলো সোফিয়া না, বেলা লিমাস ক্যানিয়লের মা। যে কি না এখন মৃত!

ইরতিজাকে লিফটের জন্য অপেক্ষা করতে হলো। এই হাসপাতালটা অনেক উঁচু। এই উঁচু বিল্ডিংয়ের ছাদে সিঁড়ি বেয়ে ওঠা সম্ভব না। এমনিতেই তার শরীর কিছুটা দুর্বল। লিফট এলে সে ছাদে চলে এলো। রুফটপে এক পা রেখেই থেমে গেল সে। দেখতে পেল ক্যানিয়ল হাঁটু মুড়ে বসে কাঁদছে। যত জোরে ইচ্ছা চিৎকার করে কাঁদছে এখন। মন খুলে একটু কাঁদার জন্যই হয়তো সে এখানে এসেছে। ইরতিজার চোখ দিয়ে আবারও অঝরে বৃষ্টি নামতে শুরু করলো। বুকের ভিতরটা মোচড়াতে শুরু করলো। সে এমন বেদনাপূর্ণভাবে কখনও কাউকে কাঁদতে দেখেনি। কিন্তু আজ দেখেছে এবং এখনও দেখছে। আর সেই মানুষটার কান্নাই দেখছে যে মানুষটা তার প্রিয়! যাকে সে ভালোবাসে। প্রিয় মানুষের এমন কান্না দেখার মতো হৃদয়বিদারক দৃশ্য আর কী হতে পারে? প্রিয় মানুষের এক ফোঁটা চোখের জলও হৃদয়কে ব্যাকুল করে তোলার জন্য যথেষ্ট। সেখানে আজ সে প্রিয়র চোখের এত জল ঝরে পড়ার সাক্ষী! প্রিয়র এই কান্নার শব্দ তাকে বিষাদের অতলে ঢেলে দিচ্ছে। সে সহ্য করতে পারছে না এই কান্নার দৃশ্য, আহাজারি!
সে ক্যানিয়লের কাছে এলো। হাঁটু গেড়ে বসে হাত রাখলো ক্যানিয়লের মাথায়। ক্যানিয়ল চোখ তুলে তাকালো। ওই চোখে তাকিয়ে ইরতিজার হৃদয় আরও তীব্রভাবে কেঁদে উঠলো। ক্যানিয়ল বললো,
“ভীষণ কষ্ট হচ্ছে ইজা! ভীষণ কষ্ট হচ্ছে হৃদয়ে! মনে হচ্ছে এটা কেউ টুকরো টুকরো করে দিচ্ছে ধারালো অ’স্ত্র দিয়ে। এত কষ্ট কেন পাচ্ছি আমি? আমার মম সত্যিই মৃত? এটা কেন হলো? আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে! ভীষণ!”

কান্নারত ইরতিজা এবার তার কান্নারত প্রিয়কে জড়িয়ে ধরলো আলতো পরশে। তার পিঠে সান্ত্বনার হাত রেখে বললো,
“আমরা প্রত্যেক মানুষই জন্মগ্রহণ যখন করেছি মৃত্যুবরণ একদিন করতেই হবে আমাদের! সকল প্রাণীকেই মৃত্যুবরণ করতে হবে। আমাদের ইহকালের জীবন ক্ষণস্থায়ী। কিন্তু আমরা পরকালে একটি সুদীর্ঘ জীবন পাবো। যেটা কখনও শেষ হবে না। তুমি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করো, যেন তুমি সেই সুদীর্ঘ জীবনে তোমার মমের সাথে থাকতে পারো। একটি জান্নাতের প্রত্যাশা করো। তার মৃত্যু হওয়ারই ছিল। এটা নির্দিষ্ট করা ছিল। মৃত্যুর এই নির্দিষ্ট সময়কে এড়িয়ে যাওয়ার ক্ষমতা কারো নেই। এত বেশি কষ্ট পেয়ো না তুমি।”

ক্যানিয়ল বললো,
“আমি সব সময় রুড ছিলাম আমার মমের সাথে! আমি খুব কষ্ট দিয়েছি তার মনে। সে ভীষণ কষ্ট পেতো!”

“কিন্তু সে জানতো তুমি তাকে ভালোবাসো। এটা ভেবে সে আনন্দিত ছিল।”

“আমি মমকে ভীষণ ভালোবাসতাম ইজা।”

“আমি জানি। তুমি তাকে যতটা ঘৃণা করতে তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি ভালোবাসতে।”

এরপর আর দুজনের মাঝে কোনো কথা হলো না। এই নিস্তব্ধ পরিবেশে শুধু কান্নার আওয়াজ শ্রবণীয় হলো। ক্যানিয়ল হয়তো নিজের কান্নার পরিমাণ হিসেব করতে পারবে না। কিন্তু ইরতিজা তার কান্নার সাক্ষী হয়ে রইল। সে ক্যানিয়লের কান্নার পরিমাণকে অনুমান করতে পারবে।

___________________

মুহাম্মদ ইসহাক লনে বসে আছেন। এখন রাত্রি গভীর। শীত ঝেঁকে বসেছে পৃথিবীর বুকে। তার চোখে বেলা লিমাসের সুন্দর মুখটি ভাসছে। সেই সুন্দর মুখটি এখন আর পৃথিবীতে নেই! মুহাম্মদ ইসহাক নিজের চার স্ত্রীর ভিতর সবচেয়ে বেশি ভালোবাসেন সোফিয়াকে। সোফিয়াকে তিনি ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন। সোফিয়ার পরে তিনি যে স্ত্রীকে বেশি ভালোবাসতেন সে ছিল বেলা লিমাস। বেলা লিমাস ছিল অত্যন্ত গরিব ঘরের মেয়ে। তবে ভীষণ সুন্দরী সে! এই সৌন্দর্যে মুগ্ধ হবে না এমন লোক কম। সেও মুগ্ধ হয়েছিল বেলা লিমাসের সৌন্দর্যে। তবে সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে সে বিয়েটা করেনি। বেলা লিমাসকে সুন্দর একটা জীবন উপহার দিতে তিনি বিয়ে করেছিলেন। বেলা লিমাসের ওই অত্যাধিক সৌন্দর্যের জন্য বেলা লিমাসের জীবন উত্যক্ত ধরনের ছিল। এই সমাজে মানুষ রূপী অমানুষের অভাব নেই। বেলা লিমাসের জীবনও কিছু অমানুষ দ্বারা বেষ্টিত হয়ে উঠছিল। বেলা লিমাসের আপন বলতে তার বাবা ছিল শুধু। এছাড়া কেউ ছিল না আর তাদের। সোফিয়া সম্মতি দিয়েছিল এই বিয়েতে। যদি সোফিয়া সম্মতি না দিতো তাহলে তিনি বেলা লিমাসকে কখনও বিয়ে করতেন না। সোফিয়া খুব আগ্রহী ছিল বিয়েটা নিয়ে।
বেলা লিমাস চলে যাওয়ার পর খারাপ লেগেছিল মুহাম্মদ ইসহাকের। ক্যানিয়লের কথা ভেবে আরও বেশি খারাপ লাগতো তার। সে ভেবেছিল বেলা লিমাস আবার ফিরে আসবে, কিন্তু বেলা লিমাস যখন তার কাছে ডিভোর্স লেটার পাঠালো তখন সে ভীষণ রেগে গিয়েছিল। সে রাগ করে সাইন করে দিয়েছিল। আর এই রাগ থেকেই সে কখনও জানার চেষ্টা করেনি বেলা লিমাস কেন চলে গিয়েছিল। নাইলা সালেম বলেছিল, বেলা লিমাস নিজের বয়ফ্রেন্ডের সাথে থাকার জন্য চলে গেছে। এবং অল্প বয়সী একজনকে বিয়ে করার জন্যও সে তখন কথা শুনিয়েছিল ইসহাককে। ইসহাকও তখন বিশ্বাস করেছিলেন নাইলা সালেমের কথা। যদি বেলা লিমাস বয়ফ্রেন্ডের সাথেই থাকার জন্য না যাবে তাহলে গেল কেন? পরে অবশ্য তিনি বুঝতে পেরেছিলেন ওটা মিথ্যা ছিল। কিন্তু ততক্ষণে তাদের ভিতর সৃষ্টি হয়েছিল অনেক দূরত্ব। মাঝে মধ্যে দু একবার বেলা লিমাসের সাথে তার দেখা হয়ে যেত দূর থেকে। কিন্তু ডিভোর্সের পর আর কখনও একটা কথাও হয়নি তাদের ভিতর। কিন্তু তিনি জানতেন বেলা লিমাস ক্যানিয়লের প্রতি যত্নশীল। বছরে তিন-চার বার সে তার ছেলের সাথে দেখা করতে আসতো। এমনিতে দূর থেকে ক্যানিয়লকে দেখতো সব সময়।

যে মানুষ দুটোর ভিতর অনেক বছর যাবৎ একটা বাক্যও বিনিময় হয়নি, সেই মানুষ দুটোর কিন্তু আজকে কথা হয়েছিল একে অপরের সাথে। হ্যাঁ, আজ সকালে বেলা লিমাস দেখা করতে এসেছিলেন মুহাম্মদ ইসহাকের সাথে। দীর্ঘ অনেক বছর পর প্রাক্তন স্ত্রীর সাথে দেখা করে তার অনুভূতি কেমন ছিল সে সময় তা এই শক্তপোক্ত মানুষটার মাঝেই সীমাবদ্ধ কেবল। যে বেলা লিমাসের সাথে সে সকালেও কথা বলেছিল সেই বেলা লিমাসকে রাতে মৃত দেখতে পাবে তা কল্পনাও করেনি সে। বেলা লিমাস অনেক কথাই বলেছিল তার সাথে। মুহাম্মদ ইসহাকের মনে পড়লো সকালের দৃশ্যপটটি।

“ধন্যবাদ আমাকে বিয়ে করার জন্য, ধন্যবাদ একটি সুন্দর জীবনের আলো দেখানোর জন্য, ধন্যবাদ জানাচ্ছি কারণ আমি ক্যানিয়লের মা হতে পেরেছি, ধন্যবাদ ক্যানিয়লকে ভালো রাখার জন্য। সবকিছু মিলিয়ে আমি তোমার প্রতি কৃতজ্ঞ।”

“তোমার কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনে কিছু যায় আসে না।”

বেলা লিমাস কথাটি শুনে মিষ্টি হেসেছিল। এরপর বললো,
“আমি চাই তুমি ক্যানিয়লের মতামতকে প্রাধান্য দাও। ওকে সুখী থাকতে দাও। ক্যানিয়ল মিরান্ডাকে বিয়ে করতে কখনও রাজি ছিল না। ইরটিজা নামের একজনকে ও ভালোবাসে, এটা নিশ্চয়ই শুনেছো তুমি। ওই মেয়েটাকে ক্যানিয়লের সাথে মেনে নাও।”

এই পর্যায়ে রেগে গিয়েছিলেন ইসহাক। হুংকার দিয়ে বলেছিলেন,
“তুমি ওই মেয়েটার নামে সাফাই গাইতে এসেছো আমার কাছে?”

বেলা লিমাস আবারও মিষ্টি হেসেছিল,
“না, আমি সাফাই গাইতে আসিনি। কারণ আমি জানি তুমি ক্যানিয়ল আর ওর সম্পর্ক মেনে নেবে। কারণ তুমি এমনই। ছেলেকে কষ্ট দেওয়ার ইচ্ছা তুমি পোষণ করো না। আমার আসার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছ তুমি। তোমাকে দেখতে এসেছি। শেষবারের মতো। তোমাকেও কিন্তু আমি লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতাম, জানো তো?”

মুহাম্মদ ইসহাক জানতেন না সে কথা। দেখা হওয়ার ঘটনাটা মনে করে মুহাম্মদ ইসহাক হৃদয়ে বেশি কষ্ট অনুভব করলেন হঠাৎ।

বেলা লিমাসকে আগামীকাল সকালে কবর দেওয়া হবে। বেলা লিমাস লিভার ক্যান্সার দ্বারা আক্রান্ত ছিলেন! এছাড়াও হৃদ রোগসহ আরও নানাবিধ রোগ ছিল তার। তার ক্যান্সার ধরা পড়েছিল অনেক দেরি করে। কিন্তু তখনও চিকিৎসা করলে তিনি ভালো হতে পারতেন। কিন্তু বেলা লিমাসের কাছে বেঁচে থাকাই অর্থহীন ছিল। কীসের জন্য বাঁচবে সে? কেউ ছিল না তার। আর তখন তিনি ভাবতেন ক্যানিয়ল শুধু তাকে ঘৃণা করে। ভালোবাসে এটা তো জেনেছিল এন্ডারসন হাউজের ওয়্যারড্রোবের ভিতর তার ছবি দেখে। যেটা ক্যানিয়ল খুব গোপনে লুকিয়ে রেখেছিল। লুকিয়ে লুকিয়ে তার ওই ছবিটা দেখতো ক্যানিয়ল।
বেলা লিমাসকে ওই ছবির কথা জানিয়েছিলেন সোফিয়া। সোফিয়ার সাথে একটু-আধটু যোগাযোগ ছিল বেলা লিমাসের। ওই দিন থেকেই বুঝতে পেরেছিলেন ক্যানিয়ল তাকে কতটা ভালোবাসে। তখন তার বাঁচার ইচ্ছা জেগেছিল। কিন্তু ততক্ষণে খুব দেরি হয়ে গিয়েছিল। ক্যান্সারের চিকিৎসা করে তখন আর কোনো লাভ হতো না। অবশেষে মৃত্যুই অবধারিত ছিল তার জন্য। মুহাম্মদ ইসহাক মি. হেনরির কাছ থেকে এই সমস্তটাই শুনেছেন।

সোফিয়া কখন যে পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন খেয়াল করেননি ইসহাক। সোফিয়ার কণ্ঠস্বরে তার ধ্যান ভাঙলো,
“এখানেই বসে থাকার পরিকল্পনা করেছো সারারাত?”

ইসহাক চমকে পাশে তাকিয়ে দেখতে পেলেন সোফিয়াকে। জিজ্ঞেস করলেন,
“উমরানের খবর কী?”

“মি. হেনরিকে কল দিয়েছিলাম, বললো, ও ঘুমিয়ে গেছে। অসুস্থ হয়ে গেছে বোধহয় ছেলেটা। ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছে।”

“ডাক্তারকে কল করো এখনই।”

“উত্তেজিত হয়ো না। ঘুমালে ঠিক হয়ে যাবে।”

তবুও মুহাম্মদ ইসহাকের অন্তর স্থির হলো না। তিনি তৎক্ষণাৎ উঠে দাঁড়ালেন।
“আমি এন্ডারসন হাউজে যাচ্ছি। ওকে সামনাসামনি না দেখলে স্থির হতে পারবো না।”

________________

সাজিদ নিজের ডেস্কে বসে কিছু জরুরি ফাইল ঘাটছিল। হঠাৎ একজন এসে জানালো,
“আসান, তোমার সাথে একজন দেখা করতে এসেছে।”

সাজিদ একটু চমকালো। সাধারণত তার সাথে কেউ দেখা করতে আসে না তেমন। বিশেষ করে অফিস টাইমে। সে জিজ্ঞেস করলো,
“কে দেখা করতে চায়?”

“তার নামটা হচ্ছে…”
ম্যাক নামটা বলতে গিয়ে দেখলো সে নামটা ভুলে গেছে। সে স্মরণে আনার চেষ্টা করতে করতে বললো,
“জো… জো…জোহানেস…না না জোহানেস নয়। নামটা ‘জে’ দিয়ে ছিল। আসলে আমি ঠিক মনে করতে পারছি না নামটা। এরকমই কিছু একটা ছিল।”

সাজিদ দাঁড়িয়ে গিয়ে ফাইল দিয়ে ম্যাকের মাথায় আঘাত করে বললো,
“ইডিয়ট! সামান্য একটা নাম মনে রাখতে পারো না। কীভাবে তুমি তোমার প্রজেক্ট সম্পন্ন করবে? আমি তোমাকে নিয়ে ভীষণই হতাশ!”

“ভুলে যেয়ো না আসান, গত বছর আমি অনেক ভালো করেছিলাম কাজে। এমনকি আমি আমার পদোন্নতিও করেছি। সুতরাং অতীতকে ভুলে যাবে না। হয়তো এ বছর কিছুটা খারাপ যাচ্ছে আমার…”

“কোথায় দেখা করার জন্য অপেক্ষা করছে?” ম্যাকের কথার মাঝেই জিজ্ঞেস করলো সাজিদ।

ম্যাক একটু আহত হলো। তার মনে হলো সাজিদ তার কথাকে গ্রাহ্য করছে না। বেশ, সেও অত বন্ধুত্ব দেখাবে না। সে অপেক্ষাকারীর স্থান সম্পর্কে বললো সাজিদকে। সাজিদ সেখানে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো। কয়েক পা হেঁটে আসার পর হঠাৎই একটা কথা মনে হতে দাঁড়ালো সে। ম্যাকের কাছে জানতে চাইলো,
“যে দেখা করতে এসেছে তার নাম কি জোনাস?”

ম্যাকের সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে গেল,
“হ্যাঁ হ্যাঁ এই নামই বলেছিল। জোনাস। আচ্ছা তোমাদের রিলেশনটা কী? তোমরা দুজন কি ফ্রেন্ড? না কি কোনো অন্য রিলেশনশিপ? কোথাও তোমরা দুজন একে অন্যের সাথে ডেট করছো না তো?”

বলে হা হা শব্দে হেসে উঠলো ম্যাক। মজা করেছে সে সাজিদের সাথে। কিন্তু দেখলো সাজিদের কোনো প্রতিক্রিয়াই নেই। যেন তার কথা শোনেইনি। ম্যাক লক্ষ করলো সাজিদের ধ্যান অন্য কোথাও।

নামটা ‘জোনাস’ শুনে সাজিদ যারপরনাই অবাক হলো। জোনাস? জোনাস তার সাথে দেখা করতে এসেছে এটা একদমই বিশ্বাসযোগ্য নয় তার কাছে। তাদের দুজনের মাঝে কখনও কথাবার্তাও হয়নি। হঠাৎ জোনাস কেন তার সাথে দেখা করতে আসবে? তার কাছে কি ইরতিজার সম্পর্কে কিছু বলতে এসেছে? সাজিদ নিজের ডেস্কে ফিরে এলো। বসে বললো,
“ওকে গিয়ে বলো আমি ব্যস্ত আছি। আমার পক্ষে দেখা করা সম্ভব নয়। আমার সাথে যেন আর দেখা করতে না আসে।”

(চলবে)

#উড়ো_পাতার_ঢেউ
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ৫৬
_________________

ম্যাক এসে খবর দিলো সাজিদ দেখা করতে অনিচ্ছুক। কিন্তু জোনাস হার মানলো না। সে নিষেধ না শুনে নিজ থেকেই চলে এলো অফিসের অভ্যন্তরে। সোজা সাজিদের ডেস্কের সামনে এসে দাঁড়ালো। সাজিদ চোখ তুলে তাকালো। জোনাসকে দেখে একদমই ভালো লাগলো না তার। বিরক্ত হলো সে।
জোনাস বললো,
“তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে, কিছু দেখানোর আছে।”

“কিন্তু আমি তোমার সাথে কথা বলতে আগ্রহী নই। আমার হাতে অনেক কাজ আছে। আমাকে সেগুলো কমপ্লিট করতে হবে। আমি নিজের কাজের ক্ষতি করতে পারি না। স্যরি!”

“মানছি আমার সাথে কিছু সময় ব্যয় করলে তোমার কাজের ক্ষতি হবে। কিন্তু এটার জন্য তুমি নিশ্চয়ই তোমার চাকরি হারাবে না?”

ম্যাক তাকিয়ে আছে এদিকে। সাজিদ আর জোনাসকে দেখছে। অফিসের আরও কিছু স্টাফ তাকিয়ে আছে। সাজিদের অস্বস্তি হচ্ছে। সে উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
“কথা বলার জন্য খুবই অল্প সময় দেবো তোমায়।”

জোনাস হেসে বললো,
“লোকে দুই মিনিট বলে দুই ঘণ্টা সময় নেয়, কিন্তু আমি কথা দিচ্ছি আমি দুই মিনিটের কথা বলে বিশ মিনিটের বেশি সময় নেবো না।”

সাজিদ আর জোনাস অফিসের ক্যান্টিনে এসে বসলো। সাজিদ দুই কাপ কফি এবং স্যান্ডউইচ অর্ডার করলো ভদ্রতার খাতিরে। জোনাস বললো,
“আমি এই মুহূর্তে তোমাকে যেটা দেখাবো সেটা দেখার পর তোমার ভিতরের অনুভূতি কেমন হবে সেটা দেখার জন্য আমি বেশ কৌতূহল বোধ করছি। আমার ধারণা তুমি বিষয়টা সম্পর্কে একেবারেই কিছু জানো না।”

সাজিদ ভ্রু কুঁচকালো। জোনাস নিজের মোবাইলটা এবার সাজিদের সামনে ধরলো। সাজিদের চোখ চমকে উঠলো মোবাইলের দিকে তাকিয়ে। সে দেখতে পাচ্ছে জোনাসের মোবাইলে একটা স্থির চিত্র। যেখানে দেখা যাচ্ছে তুষারপাতের মাঝে ইরতিজা একটা ছেলের সাথে দাঁড়িয়ে আছে। ছেলেটা ইরতিজার হাতে চুমু খাচ্ছে। তুষারপাতের কারণে ছবিটা ভালো না আসলেও ইরতিজাকে চিনতে সাজিদের একদমই কষ্ট হয়নি। সে বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে চেয়ে রইল ছবিটার দিকে। জোনাস সাজিদের দিকে তাকিয়ে গোপনে হাসলো। শান্তির হাসি। আরও কিছু ছবি দেখালো সে সাজিদকে। ছবিগুলো মেরিমুর পার্ক, জুহির বার্থডে পার্টি আর ldylwood park এ থাকাকালীন মুহূর্তের কিছু ছবি। যেখানে প্রত্যেকটা ছবিতে ইরতিজার সাথে ক্যানিয়লকে দেখা যাচ্ছে। ছবিগুলো দেখে ধীরে ধীরে আক্রোশ জন্ম নিচ্ছে সাজিদের মাঝে। ছবি দেখানোর পাশাপাশি জোনাস মুখেও বলে চললো নানা কথা। যা সাজিদের প্রতি রক্ত কণায় রাগের সংঘর্ষণ ঘটালো। সে জোনাসকে কিছু বলতে পারলো না। প্রমাণ সে নিজের চক্ষু দ্বারা দর্শন করছে! জোনাসকে কী বলবে আর? ইরতিজা কীভাবে পারলো এটা?

_______________

বিকেলের শান্ত রোদ্দুর ইরতিজার মুখখানি ছুঁয়ে দিতে পারছে না। বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে কিছু গাছ। এই গাছগুলোয় পাতা ভরপুর। গাছের ফাঁকফোকর দিয়ে একটু-আধটু রোদ কোনো রকমে রাস্তায় ঢুকেছে। ইরতিজা যাচ্ছে এন্ডারসন হাউজে। ক্যানিয়লের সাথে দেখা করতে। ক্যানিয়ল এখন কেমন আছে জানে না সে। গতরাতে ক্যানিয়লের সেই কান্নার সুর, চিৎকার এখনও তার হৃদয়ে ক্লেশের ঝঞ্ঝা গড়ে তোলে। ওটা যেন এক দুঃস্বপ্ন! গা ঝমঝমিয়ে উঠলো ইরতিজার। বুক চিরে বেরিয়ে এলো দীর্ঘশ্বাস! বেলা লিমাসের হাসি মুখটি এখনও ইরতিজার মানসপটে ঘুরে বেড়ায় হন্নে হয়ে। মনে পড়ে বেলা লিমাসকে। আজ সকালে বেলা লিমাসকে কবর দেওয়া হয়েছে। ইরতিজার থেকে খানিক দূরে একটা গাড়ি এসে থামলো। গাড়িটা দেখেই চিনতে পারলো ইরতিজা। গাড়ি থেকে সাজিদ নেমে এলো। সে ইরতিজার সাথে দেখা করতে ইরতিজার বাড়ি যাচ্ছিল, কিন্তু রাস্তাতেই দেখা হয়ে গেল। সম্পূর্ণ পথ যেতে হয়নি তাকে। অর্ধ পথেই দেখা হয়েছে। অর্ধ পথ। যেমন তাদের সম্পর্কটাও অর্ধ! সে ইরতিজার সামনে এসে দাঁড়ালো। মোবাইল বের করে সেটা ইরতিজার সম্মুখে ধরাকালীন সে ইরতিজার হাতের আংটিটাও দেখতে পেল। রাগে মাথা চড়ে গেল তার। সে কর্কশ স্বরে মোবাইলে থাকা ছবিটাকে ইঙ্গিত করে জানতে চাইলো,
“এটা সত্যি?”

ইরতিজা সাজিদের মোবাইলে তার এবং ক্যানিয়লের ছবি দেখে ভীষণ চমকে গেল। এই ছবি সাজিদের মোবাইলে কীভাবে? ইরতিজা ভেবেচিন্তে উঠতে পারলো না বিষয়টি। ক্যানিয়ল যখন তাকে আংটি পরিয়ে দিয়েছিল তখন কেউ তো ছিল না আশেপাশে। তবে এই ছবি কে তুললো লুকিয়ে লুকিয়ে? জোনাস? ইরতিজার মন এক মুহূর্তেই নিশ্চিত হয়ে যেতে সক্ষম হলো। তবে সে এই মুহূর্তটাকেই সবকিছু সাজিদের কাছে বলে দেওয়ার জন্য উপযুক্ত মনে করছে। সে আগেও বলেছিল সাজিদকে সে অন্য কাউকে ভালোবাসে। কিন্তু সাজিদ অবিশ্বাস করেছিল সে কথা। আজ তো তা পারবে না। ইরতিজা যথেষ্ট দৃঢ়তার সাথে বলতে চেষ্টা করলো,
“হ্যাঁ এটা সত্যি। এটা আমি…”

ইরতিজা এ পর্যন্ত বলা মাত্রই সাজিদ তার গালে একটা চ’ড় মারলো। অন্যদিকে হেলে গেল ইরতিজার মুখ। দু চোখ খিঁচে ধরলো সে। সাজিদ চিৎকার করে উঠলো ইরতিজার উপর,
“এরকমটা কীভাবে করতে পারলেন ইরতিজা? এতদিন ভাবতাম আপনি একটা পাগল মেয়ে, সেই সাথে বোকাও আছেন। কিন্তু আসলে সবচেয়ে বড়ো বোকা তো আমি। আমি ভুল ভাবতাম। আমি ভাবতাম, জোনাসের জন্য আপনার মনে অনুভূতি আছে। কিন্তু আসলে আপনার অনুভূতিতে অন্য কেউ ছিল আর এখনও আছে! আমি ভুল ছিলাম। আমার অনেক আগেই বোঝা উচিত ছিল, যখন এই ছেলের কাছে আমাকে আপনার ভাই বলে পরিচয় দিয়েছিলেন তখনই আমার বোঝা উচিত ছিল। আমি একটা গর্দভ! নিজে একটা গর্দভ হয়ে আপনাকেও গর্দভ ভাবতাম বলেই আপনার কোনো কথাকে কখনও সিরিয়াস ভাবে নিইনি আমি। মজার ছলে নিয়েছিলাম সব কিছু। কিন্তু এখন এটাই সিরিয়াস বলে প্রমাণিত। আর আমার ভাবনাগুলো ভ্রান্ত!”

সাজিদ নিজের গাড়ির দিকে এগোতে লাগলো। ইরতিজা পিছন থেকে রাগে কম্পিত কণ্ঠে বললো,
“আপনার সাহস কীভাবে হলো আমাকে চ’ড় মারার? কোন সাহস, অধিকারে আপনি এটা করেছেন?”

সাজিদ পিছনে তাকালো। দেখতে পেল ইরতিজার দু চোখে অশ্রু টলমল করছে। যেকোনো সময়ে টালমাটাল হয়ে ঝরে পড়তে পারে তারা। হঠাৎ সাজিদের কী যেন হলো। তার মনটা এই মুহূর্তে ভীষণ নরম হয়ে এলো ইরতিজার প্রতি। সে আবারও এগিয়ে এলো ইরতিজার কাছে। ইরতিজা কান্না চেপে রেখেছে। তার স্পষ্ট একটা ছাপ ফুঁটে আছে তার বদনখানিতে। ইরতিজা বললো,
“আমি আপনাকে ব…”

থমকে গেল ইরতিজা। সাজিদ হুট করে তার গালে চুমু খেয়েছে! সেই গালেই, যে গালে সাজিদ চ’ড় মেরেছিল। ইরতিজা স্তব্ধ হয়ে গেছে। অবিশ্বাস্য চোখে তাকালো সাজিদের দিকে। সাজিদ বললো,
“আশা করি জায়গাটা বেশি ব্যথা করবে না।”
বলে ইরতিজার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে গাড়িতে গিয়ে বসলো।
ইরতিজা এমন হতবাক হয়ে গেছে যে কিছু বলতেও পারলো না। সাজিদ চলে যাওয়ার পর সে চিৎকার করে উঠলো রাগে। সাইড ব্যাগ থেকে রুমাল বের করে গালটা মুছতে লাগলো। লোকটা কীভাবে এমনটা করলো? কী জঘন্য! ইরতিজা কেঁদে ফেললো। শুধু রুমাল দিয়ে মুছলে হবে না। পানি প্রয়োজন। পানিতে রুমাল ভিজিয়ে তারপর মুছতে হবে।

ওই ঘটনার পর ইরতিজা আর ক্যানিয়লের সাথে দেখা করতে যাওয়ার মন পেল না। ভীষণ বাজে স্মৃতি হয়ে দাঁড়ালো এটা। ঘৃণা লাগছে দৃশ্যটা মনে করতে। সে বিকেলটুকু পার্কে এসে কাটালো। বাজে স্মৃতিটার পাশাপাশি আরও বেশ কিছু বিষয় তার মস্তিষ্ককে খুঁচিয়ে যেতে লাগলো। সে একশ ভাগ নিশ্চিত ছবি তোলার কাজটা জোনাস করেছে! ও ছাড়া আর কেউ করেনি এটা। কিন্তু এটা সাজিদকে কীভাবে দিয়েছে? দিয়ে কী বলেছে? সাজিদ সবটা শুনে এমন রেগে গেছে কেন? সে তো আগে থেকেই জানতো ও তাকে বিয়ে করতে ইচ্ছুক নয়, তারপরও ব্যাপারটা জানার পর এত হাইপার হয়ে গেল কেন? লোকটা কী করবে এরপর? বাসায় জানিয়ে দেবে না কি সবটা? যন্ত্রণায় ইরতিজা মাথা চেপে ধরলো দুইহাত দিয়ে।
ধীরে ধীরে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। ওয়েদারও খারাপ হচ্ছে ক্রমশ। ইরতিজা তাড়াতাড়ি পার্ক থেকে বেরিয়ে সোজা বাসায় চলে এলো। এসে দেখলো বাসার পরিবেশ থমথমে। শারমিন সন্তর্পণে কাঁদছেন। আজাদ চৌধুরী বসে আছেন গম্ভীর মুখে। নওরিনের মুখ উদ্বিগ্ন। সাজিদকে বাসায় দেখে যা বোঝার বুঝে গেল ইরতিজা। ভয়ে তার গলা শুকিয়ে আসছে। ভিতরটাকে এই মুহূর্তের জন্য প্রস্তুত করেই গৃহে প্রবেশ করা উচিত ছিল তার। সে কাঁপা স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
“কাঁদছো কেন মা?”

শারমিন জবাব দিলেন না, অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলেন।
ইরতিজা বাবার দিকে তাকিয়ে থেকে বললো,
“কী হয়েছে আব্বু?”

আজাদ চৌধুরী শান্ত গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
“পারলে তোমাকে এই মুহূর্তে একটা চড় মারতাম আমি!”

ইরতিজার হৃদয় ছ‍্যাঁত করে উঠলো। মনে হলো তার বিশ্ব-ভূখণ্ড কেঁপে উঠেছে বাবার এই একটা কথায়। তার দু কান অবিশ্বাসের হাওয়ায় দোদুল হয়ে উঠলো। বাবা তার সাথে কখনও একটু কঠিন স্বরেও কথা বলেনি, সেখানে আজ চড় মারার কথা বলছে? ইরতিজার দু চোখ ফেঁটে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। সিক্ত কণ্ঠে ডাকলো,
“আব্বু!”

“তুমি জানো তোমার বিয়ে সাজিদের সঙ্গে ঠিক হওয়া, তোমার আঙুলে সাজিদ আংটি পরিয়ে দিয়েছিল। তুমি সেই একই আঙুলে কী করে অন্য একজনের আংটি পরে আছো? তুমি কি নিজের বিবেককে ভুলে গেছো ইরতিজা?”

ইরতিজা কান্না ভেজা আঁখিতে চেয়ে ডানে-বায়ে মাথা নাড়িয়ে বললো,
“আমি ভুলিনি। আমি কোনো ভুল করিনি। আমি তোমাকে এবং মি. সাজিদকে অনেক বার বলেছিলাম আমি এই বিয়ে করবো না। এমনকি তুমি জানো এনগেজমেন্টের পরের দিন আমি ওনার সাথে দেখা করে বিয়ে ভাঙার চেষ্টা করেছিলাম। আমি বিয়ে করবো না এই কথাটা তোমাকে এবং সাজিদকে অনেকবার বলার পরও তোমরা কেউই আমার কথাকে গ্রাহ্য করোনি। না সাজিদ করেছে, আর না তুমি!”

“গ্রাহ্য করিনি কারণ ভাবতাম ওটা তোমার পাগলামি, এটা এক সময় থাকবে না। কারণ তুমি বুঝবে সাজিদ তোমার জন্য কত নির্ভুল একটা মানুষ। কিন্তু তুমি অন্যদিকে হেঁটে গেছো! যে রাস্তা সম্পর্কে আমার মস্তিষ্ক একটিবারের জন্যও ভাবেনি।”

“ভুলটা তোমাদের ছিল, কারণ তোমরা ভাবোনি। ভুলটা আমার ছিল না।”

“ভুল তোমারই ছিল। যখন তুমি জানতে তুমি অন্য কারো স্ত্রী হওয়ার জন্য নির্ধারিত তখন তুমি কীভাবে পারলে সেই ছেলের প্রেমে পড়তে?”

“পারলাম কারণ আমি চাইনি সাজিদের স্ত্রী হতে। চাই না আমি তাকে বিয়ে করতে। সেই শুরু থেকে আমি তোমাদের এই কথাটা বলছি, কেন বুঝছো না তোমরা? কেন বুঝতে চাইছো না?”
ইরতিজার কান্নার ধ্বনি তীব্র হলো।

আজাদ চৌধুরীর ইরতিজার কান্না দেখে খারাপ লাগলেও তিনি নিজের দুর্বল রূপকে সম্মুখে উপস্থাপন করলেন না। শক্ত কণ্ঠে বললেন,
“এটা বললেই তোমার দোষ ছিল সেটা মিথ্যা হয়ে যায় না। তুমি সাজিদকে বিয়ে করতে ইচ্ছুক নও সেটা ঠিক, কিন্তু তোমার উচিত ছিল এটাতে নিজের সম্মতি স্থাপনের চেষ্টা করা, কিন্তু তুমি তা করোনি। তুমি অন্য আরেক জনের জন্য নিজের অনুভূতি সঁপে দিয়েছো। যা ঠিক করোনি। তোমার উচিত ছিল সাজিদকে নিয়ে তোমার অনুভূতির সাথে সন্ধি ঘটানোর একটা চেষ্টা করা। তুমি সেই চেষ্টা না করেই অন্য কিছু আঁকড়ে ধরেছো।”

আজাদ চৌধুরী ইরতিজাকে একটা ছবি দেখিয়ে বললেন,
“এই ছবি সম্পর্কে তোমার অভিমত কী? মানুষ এই ছবি দেখিয়ে বাজে কমেন্ট করছে! কেন করছে? এটাতেও কি তোমার দোষ জড়িত নয়?”

ইরতিজা দেখলো এটা এমন একটা ছবি যা ওষ্ঠ চুম্বনের দৃশ্যকে ইঙ্গিত করছে! ছবিটা ক্যানিয়লের পিছন দিক থেকে তোলা হয়েছে। ক্যানিয়লের সামনে সে দাঁড়ানো ছিল, যার কারণে এমন একটা ধারণার সৃষ্টি করতে সক্ষম এই ছবি। আসলে ওখানের দৃশ্যপট এমন ছিল না। এই ক্লিকটা তখনই নেওয়া হয়েছে যখন ক্যানিয়ল আংটি পরানোর পর ইরতিজা কেঁদেছিল। যখন ক্যানিয়ল ওর চিবুক স্পর্শ করে বলেছিল,
“হেই, কেন কাঁদছো? কী হয়েছে?” তখনই এই ক্লিকটা নেওয়া হয়। ইচ্ছাকৃতভাবে জোনাস এটা করেছে। ইরতিজার এটা বুঝতে একটুও কষ্ট হলো না। ঘৃণায় তার আত্মা কাঁপলো। বললো,
“এই ছবি মিথ্যা! এমন কিছুই ঘটেনি। ব্যাপারটা এমন ছিল না। ব্যাপারটা ছিল এক রকম, কিন্তু তোমাদের সামনে উপস্থাপন করা হয়েছে অন্য রকম! তোমরা ভুল বুঝো না প্লিজ। আব্বু, তুমি অবিশ্বাস করছো আমায়?”

শারমিন আহমেদ চড়া গলায় বললেন,
“চুপ করো ইরতিজা।”
তিনি উঠে দাঁড়ালেন। বলতে আরম্ভ করলেন,
“তুমি আমাদের বোকা ভাবো? তুমি যা বোঝাবে তাই বুঝবো আমরা? তোমার বিয়ে সাজিদের সাথে ঠিক হয়ে থাকা সত্ত্বেও কীভাবে অন্য কারো সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছো? কীভাবে অন্য কারো আংটি আঙুলে পরেছো? এটা পরার অর্থ কী? তুমি ওই ছেলেকে বিয়ে করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছো?”

ইরতিজা কিছু বললো না। শারমিন ক্ষণকাল তাকিয়ে রইলেন ইরতিজার দিকে। তারপর আজাদ চৌধুরীর দিকে চেয়ে বললেন,
“ও তো তোমার মেয়ে না! তোমার মেয়ে হলে ও কিছুতেই এমন করতে পারতো না। ও তো ওই পাপী লোকটার মেয়ে! ওর শরীরে ওই পাপীর রক্ত বইছে!”

আজাদ চৌধুরী বললেন,
“চুপ করো শারমিন। কীসব বলছো তুমি!”

“না বলতে দাও আমায়। ও ওর নিজের পরিচয়কে ভুলে গেছে একেবারে। ও ভুলে গেছে ও কীভাবে তোমার রক্তের সম্পর্কিত না হয়েও তোমার এত আপন হয়ে উঠেছে, তোমার মেয়ে হয়ে উঠেছে। কী করে ভুলে যেতে পারে এসব? আমি আসলে ভুল করেছি। যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম সেই সিদ্ধান্তেই অটল থাকা উচিত ছিল আমার। উচিত হয়নি তোমার কথা শোনা। উচিত ছিল ও পৃথিবীর আলো দেখার আগেই…”

ইরতিজা আর সহ্য করতে পারলো না। দুই কান চেপে ধরে চিৎকার করে বললো,
“স্টপ…”

ওর চিৎকারে পুরো ঘর কেঁপে উঠলো। পাশের ইউনিটে থাকা মানুষগুলোর কর্ণকুহরও নাড়িয়ে দিলো ওর চিৎকার। ইরতিজা আজাদ চৌধুরীর দিকে চেয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললো,
“আমি তোমার মেয়ে আব্বু। মাকে এসব বলতে নিষেধ করো প্লিজ! কেন বলছে সে এসব কথা? আমি তোমারই মেয়ে। আমি তোমার মেয়ে ছিলাম সেই জন্মকাল থেকে, আছি এবং আমার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার পূর্ব পর্যন্ত আমি তোমার মেয়েই থাকবো। পুরো পৃথিবী যদি একজোটে এসেও বলে আমি তোমার মেয়ে নই, তাও আমার পরিচয় পাল্টে যাবে না। আমি তোমারই মেয়ে থাকবো। আমি তোমারই মেয়ে।”

আজাদ চৌধুরীরও হৃদয়ের পাড় ভাঙছে। লক্ষ করে দেখলে বোঝা যায় তার চোখেও জল এসেছে। সে মাথা নাড়িয়ে বললো,
“হুম, তুমি আমার মেয়ে, যাকে আমি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি।”

ইরতিজা কান্নার মাঝেও একফালি সূর্যের রশ্মির মতো হাসলো। মায়ের দিকে তাকিয়ে জোর গলায় বললো,
“শুনেছো, আমি আব্বুর মেয়ে? এর বাইরে আর কোনো পরিচয় নেই আমার। আর বলবে না এরকম। আমি আব্বুর মেয়ে না এটা শুনলে আমার হৃদয় জ্বালা করে! পৃথিবী ভেঙেচুরে একাকার হয়ে যায় আমার!”

ইরতিজা দৌড়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। বাইরে বৃষ্টি পড়ছে। টিপটিপ বৃষ্টি নয়, ঝুম বৃষ্টি। ইরতিজা যখন বাসায় এসেছিল তখন আকাশের অবস্থা খারাপ ছিল। ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টিও পড়ছিল।
জুহি আর রিশন ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে ইরতিজাদের কলহ শুনছিল। ইরতিজাকে এমন ঝুম বৃষ্টির মাঝে বাইরে নামতে দেখে দুজনই প্রায় উদ্বিগ্ন হয়ে একই সঙ্গে বলে উঠলো,
“টিজা, কোথায় যাচ্ছ?”

ঘটনায় দুজনই বিমূঢ় হয়ে রইল। কী করা উচিত না ভেবে দুজনই ঝাপসা আলো-আঁধারের পথে তাকিয়ে রইল অপলক। ইরতিজা ইতোমধ্যে নিজের দ্রুত বেগের দৌড়ের ফলে চলে গেছে তাদের দৃষ্টির বাইরে। একটু পর দেখলো এই বৃষ্টির মাঝে সাজিদও ব্যস্ত পায়ে দৌড়ে নেমে যাচ্ছে। এবার আর দুই ভাই-বোন জিজ্ঞেসও করতে পারলো না সাজিদকে কিছু। সাজিদও চলে গেল দৃষ্টির বাইরে। পড়ে রইল বৃষ্টিমুখর শূন্য রাস্তা।
এর মাঝে ঘরের ভিতর থেকে নওরিনের কণ্ঠ ভেসে এলো জুহি আর রিশনের কানে।

(চলবে)