এই মনের আঙিনায় পর্ব-০৪

0
323

#এই_মনের_আঙিনায়[৪]
#কুরআতুল_আয়েন

ফারাজ ক্লান্ত শরীর নিয়ে ঘরে এসে প্রবেশ করলো।সবুজ রঙের পাঞ্জাবী’টা খোলে বিছানার উপর ফেলে দিলো।শরীর বেয়ে বেয়ে ঘাম ছুটছে।এতোক্ষণ ধরে ছাঁদে তদারকি করেছে।ঘরের দরজা’য় কড়া নাড়তেই ফারাজ জোরালো কণ্ঠে শুধালো,

‘কে!’

ফারিহা জবাব দিলো,

‘ভাইয়া আমি!’

ফারাজ একবার ঘড়ির কাঁটার দিকে তাকালো।একটা বেজে পনেরো মিনিট!রাত প্রায় অনেকটা’ই বলা চলে!ফারাজ উদোম গা’য়ে একটা টি-শার্ট জড়িয়ে নিলো।দরজা খোলে দিয়ে ফারিহার দিকে একবার তাকালো।ফারিহার শরীরে এখনো গা’য়ে হলুদের শাড়ি,গালে হলুদের ছোঁয়া।ফারাজ তপ্ত নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো,

‘ঘরে আয়।’

ফারিহা নির্দ্বিধায় ঘরে প্রবেশ করলো।ফারাজের দিকে একপ্রকার প্রশ্ন ছুড়ে মেরে বললো,

‘ভাইয়া!আদুরী আমাদের সবার ছোট!ব্যপার’টা বিচ্ছিরি হয়ে যাচ্ছে!’

ফারাজের নির্বিকার জবাব,

‘পছন্দ করি আমি।তাই এতোকিছু দেখার প্রয়োজন মনে করছি না।’

‘ভাইয়া!প্লিজ বোকাসোকা কথা বলবে না।তুমি ব্যপার’টাকে সিরিয়াস নাও।আদুরী সবেমাত্র কলেজে পড়ে।তার আগে ঈশিতাও রয়েছে।ফুফা কখনো আদুরী’কে এতো আগে বিয়েসাদী দিবেন না।আদুরী অনেক আদরের!’

‘আদুরী আমারও অনেক আদরের।তাকে দেখলে আমার শুধু আদর করতে মন চায়।আর রইলো বিয়ে দেওয়ার কথা!সেটা না হয় আমি আরো অপেক্ষা করবো।আদুরী বড় হলেই তাকে আমার ঘরে তুলবো।তবুও আদুরী’কে আমার চাই চাই!’

কি ভাবলেশহীন উত্তর!ফারিহা দম নিলো।তার ভাইয়ের কথায় প্রচন্ড রাগ হলো।আদুরীকে তার বরাবরই বাচ্চা লাগে।চোখে যেনো এখনো ভেসে উঠে আদুরীর পুতুল খেলার সেই দৃশ্য!ছোট ছোট হাত দিয়ে পুতুল’কে শাড়ি পড়িয়ে দেওয়ার দৃশ্যটা’ও ফারিহার মনে পড়ে গেলো।ফারাজ শান্ত গলায় পুনরায় বললো,

‘আরো কিছু বলবি?’

ফারিহা অন্যমনস্ক হয়েই জবাব দিলো,

‘না!’

‘তাহলে এখন যা!খুবই ক্লান্ত আমি।’

ফারিহা চলে গেলো।ফারাজ সময় নষ্ট করলো না।ইজি চেয়ারে গা এলিয়ে দিলো।বিছানার উপর থেকে ফোন’টা হাতে গিয়ে আদুরীর ছবি দেখতে লাগলো।আজকেই তুলেছে!তাও লুকিয়ে!প্রতিটি ছবিই যেনো এলোমেলো,অগোছালো!এই হয়তো শাড়ি ঠিক নেই তো মুখ ঠিক নেই!ফারাজ হাসলো।নিজেকে যেনো বড্ড বেপরোয়া লাগে!ইচ্ছে করে আদুরী’কে নিজের হৃদপিণ্ডে ঢুকিয়ে রাখতে!ফারাজ উষ্ণ নিঃশ্বাস ছাড়লো।চোখ দুটো বন্ধ করে বিড়বিড়িয়ে বললো,
‘আমাকে আরো ধৈর্যশীল হতে হবে!উপযুক্ত সময়ের জন্য অপেক্ষা করতে হবে!কথায় আছে অপেক্ষার ফল মিষ্টি হয়!আচ্ছা!আমার অপেক্ষার ফল কতোটুকু মিষ্টি হবে!একটু বেশি নাকি অনেকটা বেশি!’

সকালের দিকে বৃষ্টি হওয়ায় উঠোনে কাঁদামাটি জমেছে।বাড়ির ভেতরে বাহিরে মানুষের আনাগোনা!শাওন,সীমান্ত মিলে খাবারের ডেকোরেশনের দিকটা দেখছে।আদুরী কলপাড় থেকে গুটিগুটি পা’য়ে উঠোনে আসলো।শরীরের উপর বড়সড় একটা গামছা পেঁচিয়ে রাখা।ছোট ছোট চুলের গোছা গুলো চোখে,মুখে লেপ্টে আছে।শাওনের দৃষ্টি পড়লো আদুরীর উপর।ফুটে উঠলো ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি!শাওন দৌড়ে আসলো আদুরীর কাছে।ঠোঁটের হাসি বিদ্যমান রেখেই বললো,

‘গোসল করে এসেছো।’

আদুরী কিছু বললো না।মুখে হাসি রেখে মাথা নাড়ালো।যার অর্থ হ্যাঁ!শাওন আবারও বললো,

‘আদুরী তোমার ছবি কিন্তু অনেক সুন্দর হয়!’

আদুরী চমকপ্রদ হলো!ভ্রুকুটি কুঁচকে তাকালো শাওনের দিকে।শাওনের ঠোঁটে এখনো হাসি লেগে আছে।আদুরী চমকপ্রদ হয়েই শুধালো,

‘আমার ছবি কোথায় পেলেন শাওন ভাইয়া!’

শাওন মাথা চুলকে জবাবে বললো,

‘তুলেছিলাম আর কি!দাঁড়াও দেখাচ্ছি!’

শাওন ট্রাউজারের পকেট থেকে ফোন’টা বের করে আদুরীর সামনে ধরলো।আদুরীকে ছবি গুলো দেখাচ্ছে আর টুকটাক কথা বলছে।আদুরীও ঠোঁট কাঁমড়ে শাওনের কথার প্রত্যুত্তর করছে।বারান্দায় এসে দাঁড়ালো ফারাজ।টি-শার্ট টা টেনেটুনে একটা চেয়ার নিয়ে উঠোনে বসলো।একদম আদুরী আর শাওনের বরাবর!গম্ভীর মুখের হাবভাব করে একধ্যানে তাকিয়ে আছে আদুরীর দিকে।পলকহীন চাহনি!যে চাহনিতে রয়েছে শুধু রাগ,ক্রোধ!সীমান্ত নিঃশব্দে পাশে বসলো।গালে হাত রেখে আনমনে বললো,

‘ভাই!যেভাবে বসেছো মনে হচ্ছে টিভি সিরিয়ালের নাটক দেখছো’

‘তাই বলা চলে!ভাবছি এই নাটকের ডিরেক্টর হবো!’

সীমান্ত ভ্রুকুঞ্চন করে তাকালো ফারাজের দিকে।কিছুটা ভাবান্তর হয়ে বললো,

‘ভাই!কি টিটকারি করলে!’

‘থা’প্প’ড় খেতে না চাইলে চুপচাপ বস না হলে যা!’

সীমান্ত উঠে গেলো।ফারাজ’কে ঠেস দিয়ে কিছুটা সুরেলা কণ্ঠে বললো,

‘জ্বালা জ্বালা এই বুকে বড় জ্বালা।’

ফারাজ উঠতেই সীমান্ত দৌড়ে চলে গেলো।শাওনের চোখ পড়লো এদিকটা’য়!সাথে আদুরীরও!শাওন জোর গলায় ফারাজের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে মারলো,

‘কিরে!সীমান্ত এভাবে দৌড়ে গেলো কেনো?’

ফারাজ রাগান্বিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তাকালো আদুরীর দিকে।আদুরীর দিকে তাকিয়েই শাওনের কথার পিঠে দৃঢ় গলায় বললো,

‘সীমান্ত’র থেকেই জেনে নিস!’

শাওন যেনো পাত্তা দিলো না।আদুরীর সাথে কথা বলায় মজে উঠলো।ফারাজ যেনো এবার তেঁতে উঠলো।চোয়াল শক্ত করে তাকিয়ে রইলো।সুহানা তড়িঘড়ি করে সদর দরজা’য় এসে দাঁড়ালো।আদুরীকে উঠোনে দেখে সেদিকে ছুটলো।আদুরীর কাছে যেতেই একপ্রকার তাড়া দিয়ে বললো,

‘আদু!তুই এখানে!’

আদুরী একটু নড়েচড়ে উঠলো।বড়আপার চোখে-মুখে রাগের প্রতিচ্ছবি দেখে বললো,

‘কি হয়েছে বড়আপা!’

‘বাবু’কে নিয়ে ঝামেলায় আছি।সকাল থেকে কান্না করছে।পেট খারাপ করেছে।এখন একটু ঘুমিয়েছে।তুই গিয়ে বস তো একটু বাবুর কাছে।’

আদুরী সম্মতি জানিয়ে চলে গেলো।সুহানা শাওনের দিকে তাকিয়ে বললো,

‘শাওন এখানে তোর কাজ আছে?’

‘না!’

সুহানা শাওনের হাতে টাকা ধরিয়ে দিয়ে বললো,

‘একটু বাজারের দিকে যা!বাবুর জন্য পেট খারাপের ওষুধ নিয়ে আসবি।বাবুর বয়স’টা কিন্তু আগে বলে নিবি।’

শাওন দ্বিমত পোষণ করলো না।চলে গেলো বাজারের দিকে।দ্রুত গতিতেই হাঁটছে।বাজার থেকে এসে আবার এদিকে বাকি কাজ গুলো করতে হবে।কিছু কাজ এখনো বাকি রয়ে গিয়েছে।
ফারাজ স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো!মন’টা যেনো ফুরফুরে লাগছে।মনে মনে সুহানা’কে অসংখ্য ধন্যবাদ দিলো।যা সুহানার অজানা।সীমান্ত ঘুরেফিরে আবারও আসলো ফারাজের নিকট!খুকখুক করে কেশে উঠলো।ফারাজ ট্যারাচোখে সীমান্তের দিকে তাকিয়ে বললো,

‘বলে ফেল!কি বলবি!’

সীমান্ত যেনো সাহস পেলো।আর বিলম্ব করলো না।গড়গড় করে বলতে লাগলো,

‘একজোড়া শালিকের মাঝে সুহানা কাক হয়ে এন্ট্রি নিলো।ডিরেক্টর হিসেবে তোমার অনেক কাজে দিবে ভাই!’

ফারাজ চোখ,মুখ কুঁচকে নিলো।তবে মনে মনে হাসলো।বাহিরে প্রকাশ করলো না।আসল কথা হলো সুহানা তার অনেক উপকার করে গিয়েছে।সেটা যেভাবেই হোক না কেনো!

ফারিহার বিদায় পর্ব!কুসুমা বেগম মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলেন।ফারাজ ফারিহা’কে একহাতে জড়িয়ে ধরে রেখেছে আর অন্যহাত দিয়ে মা’কে!ফারাজের মুখটাও থমথমে হয়ে আছে।কষ্ট’টা ভেতরে চাপা দিয়ে রেখেছে।
আদুরী একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে।সুবহান কান্না করছিলো বলে মানুষের কোলাহল ছেড়ে এদিকটা’য় এসেছে।ফারিহার কান্না দেখে আদুরীর চোখ দুটোও ছলছল করে উঠলো।কখন যে তা গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়লো আদুরী টেরই পেলো না!কি অদ্ভুত মেয়েদের জীবন!বাবার বাড়ির রাজকন্যা আজ অন্য বাড়ির বউ!ফারিহার জায়গায় আদুরী নিজেকে কল্পনা করতেই বুকটা যেনো কম্পন দিয়ে উঠলো।অশ্রুসিক্ত চোখ নিয়ে তাকিয়েই রইলো ফারিহার যাওয়ার পানে!

নিস্তব্ধ এক পরিবেশ!বাড়ির বড়’রা কুসুমা বেগমের ঘরে রয়েছেন।ফারিহা যাওয়ার পর থেকে বাকিরা স্বান্ত্বনাই দিয়ে যাচ্ছেন।কুসুমা বেগম যেনো মেয়ে বিদায় দিয়ে দিশেহারা!বুক’টা হাহাকার করে উঠছে।রাহেলা খাতুন আঁচলে চোখ মুছে কুসুমা বেগমের পাশে বসলেন।বড় ভাবির পাশে থাকাই যেনো এখন একমাত্র কাজ।

আদুরী সুবহান’কে নিয়ে ছাদে উঠতেই চোখ পড়লো ফারাজের দিকে।ছাদের দোলনায় চুপটি মেরে বসে আছে।আদুরী এগিয়ে গিয়ে অন্যদিকে দাঁড়িয়েছে!আড়চোখে ফারাজের দিকে তাকালো!মুখের মতিগতি’তে স্পষ্ট ফুটে উঠেছে ফারাজের মন খারাপের রেশ!
ফারাজের মন খারাপের কারণ আদুরী ঠিকই আন্দাজ করতে পারছে।একা থাকতে দেওয়াই শ্রেয়!আদুরী উল্টো ঘুরতে নিলেই ফারাজ বলে উঠলো,

‘চলে যাচ্ছো কেনো!’

আদুরী থামলো!চমকপ্রদ চোখ নিক্ষেপ করলো ফারাজের মুখশ্রীর উপর।ফারাজের ঠোঁটের কোণে হাসি নেই।চোখ দুটো অসম্ভব লাল হয়ে আছে।এদিকে,সুবহান ফারাজ’কে দেখেই কোলে যাওয়ার জন্য হাত বাড়িয়ে দিলো।ফারাজ দোলনা ছেড়ে উঠে আসলো।আদুরীর কোল থেকে সুবহান’কে নিয়ে শব্দ করে চুমু খেলো।সুবহান খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো।ছোট ছোট হাত গুলো দিয়ে ফারাজের মুখে স্পর্শ করতে লাগলো।আদুরী তাকিয়ে আছে।দু’জনের হাবভাব দেখে রেলিঙ ঘেঁষে দাঁড়ালো।চারপাশ অন্ধকার হয়ে আসছে।বাড়ির লাইট গুলো জ্বলজ্বল করে জ্বলছে।ফারাজ ধীর গতিতে আদুরীর পাশে এসে জায়গা করে নিলো।নিশ্চুপ সময় কাটলো দু’জনের।আদুরী অনেক’টা সাহস জুগিয়ে বললো,

‘ফারিহা আপুর জন্য কষ্ট পাচ্ছেন?’

ফারাজ আলতো ঠোঁটে হাসলো।জবাবে বললো,

‘তুমি উপলব্ধি করতে পেরেছো আমার কষ্ট’টা আদুরী!’

আদুরী স্তব্ধ হলো!মৃদু মৃদু বাতাস বইছে!চুলগুলো এলোমেলো হয়ে চোখেমুখে লাগছে।একরাশ মুগ্ধতা এসে ভীড় করলো আদুরীর মাঝে।ফারাজ পলকহীন চাহনি নিক্ষিপ্ত করলো।আচমকাই আদুরীর হাত’টা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নিলো।আদুরী যেনো শীতল হলো!হৃদপিণ্ড ক্রমশ বেগে ছুটছে।মন গহীনে যুক্ত হলো নতুন এক অনুভূতি!আদুরী সরে আসতে নিলেই ফারাজ শান্ত কণ্ঠে শুধালো,

‘সরবে না!’

আদুরী স্থির হলো!ফারাজের কথার অমান্য করার ইচ্ছে হলো না।নিজেও যেনো ফারাজের হাত’টা শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো।ফারাজ নিঃশব্দে হাসলো।আদুরীর এই ক্ষীণ স্পর্শ’টাই যেনো ফারাজের বেসামাল মন’কে শান্ত করে তুললো!

চলবে..