এই মন তোমাকে দিলাম পর্ব-১১+১২

0
196

#এই_মন_তোমাকে_দিলাম
#পর্ব-১১
#আরাদ্ধা_সাদাত_খান
– ব্রো, আব্বু আম্মু বাসার সামনে।
– হঠাৎ?!
সায়নের গলা একটু মিইয়ে আসলো।নিচু গলায় বলল,
– আব্বু গত রাতেই ফোন দিয়ে বলেছিল।আমি তোর জন্য ভুলে গেছি।
রূপন্তীর মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
– কেন রে হা*রা*মি? তোর ব্রেইন রে কি আমি ভুলে যাওয়ার অর্ডার দিয়ে আসছি?
– একদম গালাগালি করবি না।কি পেরেশানিতে ফেলেছিলি তুই নিজেই জানিস না। অযথাই আমাকে এত প্যারা দিলি,বিনিময়ে এত বেশি চেঁচামেচি করলাম।
– এন্ড ইয়্যু আর সরি ফর দ্যাট? নো,রাইট?
সায়ন একটু চুপ থেকে বলল,
– নো,আই এম সরি ফর দ্যাট। পরশুর জন্য আমি গত রাতে খাওয়ার টেবিলে সরি বলতে চাচ্ছিলাম,তার আগেই ফোনটা এসে মেজাজ টা বিগড়ে গেলো।আই এম সরি ফর লাস্ট নাইট অলসো।
– বাহ!এত ভালো হয়ে গেলি?
– এখন এসব কথা ছাড়।আমার আজকে প্রথম একটা ওটি এসিস্ট করতে হবে।বাসায় যেতে পারবো না।
– আমারও আরো আটটা পেশেন্ট দেখা বাকি।আচ্ছা রাখ,দেখি কি করা যায়।

রূপন্তী ফোন রেখে সময় দেখলো।সন্ধ্যা সাতটা বাজে। সে পেশেন্ট রেখে যেতে পারবে না।কম করে হলেও নয়টা বেজে যাবে বাসায় পৌঁছাতে।কিছু একটা ভেবে ফোন দিলো আরাদ্ধাকে।ওর সাথে কিছুক্ষন কথা বলে নিজের শ্বশুরকে ফোন দিলো,
– আসসালামু আলাইকুম বাবা। আপনারা কি আমার বাসার সামনে?
– জ্বী।
– আসলে বাবা সায়ন আমাকে আগে কিছুই বলে নি।মাত্র ফোন করে জানালো।এখন আমাদের দুজনেরই আসতে বেশ দেরি হবে। নয়টার বেশি বাজবে।আপনারা তো এতক্ষন অপেক্ষা করতে পারবেন না।এক কাজ করুন, আরাদ্ধাদের বাসায় চলে যান।
– ও তো মনে হয় হসপিটালে।
-জ্বী। কিন্তু আরহান ভাই বাসায়। তাকে পাবেন।
– হু।আচ্ছা দেখি কি করা যায়। তোমরা চিন্তা করো না।নিজেদের কাজ শেষ করে আসো।
– আচ্ছা।
.
রূপন্তী যখন সব গুছিয়ে বের হবে তখন আরাদ্ধা ফোন দিলো।জানালো সে যাতে তার বাসায় যায়,সেখানে ডিনার করবে। কিত্নু রূপন্তী চিন্তিত হয়ে জানালো এত রাতে সে এত দূর যেতে পারবে না।বিনিময়ে আরাদ্ধা জানালো যে সায়ন ওকে পিক করবে, তার সাথে কথা হয়েছে।
এর মাঝেই ফোনে সায়নের কল ঢুকলো।আরাদ্ধার ফোন কেটে সেটা ধরতেই জানালো নিচে নামতে।
রূপন্তী নিচে নেমে দেখলো সায়ন গাড়ি নিয়ে রাস্তার ও-ই পাড়ে দাড়িয়ে আছে। সে রাস্তা পাড় হয়ে সায়নের পাশের সিটে উঠে বসলো।বসে ছেলেটার দিকে তাকাতেই সেও তাকালো।
বড্ড ক্লান্ত দেখাচ্ছে ছেলেটাকে।একটা ওটি করেই এই অবস্থা?!
নিজের হাত এগিয়ে সায়নের কপালের চুল গুলো গুছিয়ে দিতে দিতে জিজ্ঞেস করলো,
– এত ক্লান্ত কেন তুই?সামনে তো একদিনে তিন চারটা ওটি করা লাগবে।
সায়ন দম ফেলে সিটে মাথা এলিয়ে দিলো।শীতল কণ্ঠে উত্তর দিলো,
– উই ট্রাইড হার্ড, কিন্তু বাচ্চাটা মনে হয় বাঁচবে না।
রূপন্তী ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
– আজকের ওটির কথা বলছিস?
– হুম।সুস্থ বাচ্চাটা বের হয়েছিলো।কোথায় যেনো যাবে।রাস্তায় একটা গাড়ির সাথে ধাক্কা লাগলো।রাস্তার পাশে কিছু রড রাখা ছিলো।মাথাটা গিয়ে পরলো সেখানে।সার্জারি করেও কিছু করা যাচ্ছে না। প্রচুর ইন্টারনাল ব্লিডিং হচ্ছে।
রূপন্তী চুপ হয়ে গেলো।একেকটা মানুষের জীবন যে তাদের জন্য কত মূল্যবান, সেটা শুধু তারা জানে।কিন্তু সেই মানুষটার জীবন বাঁচাতে যখন তারা ব্যার্থ হয় তখন মনে হয় ডাক্তারি পড়াটাই তাদের জন্য বৃথা। নাহলে তারা মানুষটাকে বাঁচাতে পারলো না কেন?

চুলগুলো গুছিয়ে আলতো হাতে ছেলেটার নাকের পাশে জমা তেলটুকু মুছে দিলো।মৃদু গলায় জিজ্ঞেস করলো,
– তুই কি যেতে চাচ্ছিস?
সায়ন এবার সোজা হয়ে বসে গাড়ি স্টার্ট দিলো।স্টিয়ারিং ঘোরাতে ঘোরাতে বলল,
– হুম চল।সবার সাথে দেখা হলে ভালো লাগবে।

পুরাটা রাস্তায় আর কেও কথা বলল না।জ্যাম কম থাকাতে বেশ দ্রুত পৌঁছে গেলো ওরা।গিয়ে দেখলো বাবা-মায়ের সঙ্গে সীমন্তী আর রায়ানও এসেছে।রায়ানের অফিস ছুটি দুদিনের জন্য।
ড্রয়িং রুমে ছেলেরা সবাই আড্ডা দিচ্ছে। মেয়েরা সবাই রান্নাঘরে।রূপন্তী ঢুকে সবার সাথে কথা বলে নগদে আগে হাত ধুলো।তারপর আরহার কোলে খেলতে থাকা পুতুলটাকে নিজের কোলে নিয়ে নিলো।রুহি পিটপিট করে মামনির দিকে তাকালো।ঘাড় এখনো ভালোভাবে শক্ত হয় নাই,তাই একপাশে হেলে পড়তেই রূপন্তী ধরলো।তারপর তার গালে পরপর দুট চুমু খেয়ে জিজ্ঞেস করলো,
– আমার মামনিটা কেমন আছে?!
রুহিকে নিয়ে রান্নাঘরে গেলো সে।সেখানে আরাদ্ধা,জয়া,সীমন্তী,তাফসি সবাই মিলে রাতের খাবারে আয়োজনে ব্যাস্ত।
রূপন্তী শ্বাশুড়ি আর ননদকে সালাম দিলো।তারপর সবার সাথে কথা বলতে বলতে নিজেও কাজে লেগে পরলো। রুহিকে তার বাবা এসে নিয়ে গিয়েছে। রাতের আয়োজন বেশ ভালোই করা হচ্ছে,তাই সময় লাগছে। সীমন্তীর ভাগে রোস্টের দায়িত্ব ছিলো।কিন্তু আরহা ইতিমধ্যে দুবার জানিয়ে গেছে যে রুহি কাঁদতে কাঁদতে হেচকি তুলে ফেলেছ,তাকে খাওয়াতে হবে।
সীমন্তীর না চাইতেও যেতে হলো।এবং তার রেখে যাওয়া দায়িত্বের ভার পড়লো রূপন্তীর উপর।সে খুব সুন্দর করে মশলা মাখিয়ে রোস্ট বসিয়ে দিলো।জয়া একবার মানা করেছিলো।কিন্তু তখন আরাদ্ধা আপত্তি জানিয়ে বলেছিলো,
– থাক না বড়মা!ও খুব ভালো রান্না পারে।আজ খেলেই টের পাবে। তুমি বরং যাও এখন।দেখো গরমে একদম অস্থির হয়ে গেছো।
.
বর্তমানে রান্নাঘরে শুধু রূপন্তী আর আরাদ্ধা অবস্থান করছে। বিগত কিছুক্ষন ধরে আরাদ্ধা এক দৃষ্টিতে রূপন্তীর দিকে তাকিয়ে আছে।রূপন্তী বিরক্ত হলো এবার।খ্যাক কতে জিজ্ঞেস করলো,
– এরকম বেকুবের মতো তাকিয়ে আছিস কেনো?আমাকে আজ নতুন দেখিস?
আরাদ্ধা তীক্ষ্ণ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
-সেদিন রাতে বললি না কেন যে পরেরদিন তোর বিয়ে।।
– জানি না।
-এটা কোনো লজিক না।তোরা দুজনের একজনও বিয়ের আগে একে অপরের ব্যাপারে খোঁজ নিস নাই?
– না।
তারপর একটা দম ফেলে বিয়ে করার কারনটা বললো।
সব শুনে আরাদ্ধা বলল,
– সব বুঝলাম।তাই বলে একটা খোঁজ নিবি না?এখন তো সেটার ফল হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছিস। তোর দুইটাই তো বেয়াদব। সংসার করার চেষ্টাটাও তো তোরা করবি না।ফাহাদের কাছ থেকে তোদের কাহিনী শুনলাম।
রূপন্তী একদম নিচু কণ্ঠে বলল,
– আমি করতে চাই।কিন্তু তোর ভাই মনে হয় এডজাস্ট করতে পারবে না।
আরাদ্ধা এবার শক্ত কণ্ঠে বলল,
– কারন তোর মনে ওকে নিয়ে ছোট করে হলেও একটা ক্ষত আছে, সেজন্য তুই করতে পারবি।ভাবিস না আমাদের স্টুডেন্ট লাইফের কথা আমি ভুলে গিয়েছি।একটু হলেও ওর প্রতি উইক ছিলি। এখন বিয়ের মতো একটা পবিত্র সম্পর্কের জোরে সেটা পাকাপোক্ত হচ্ছে।
– হ্যা তো সেখানে এখন আমি কি কর‍তে পারি?সংসার আমি একা করবো?সায়নের ও তো একই ব্যাপারটা মানতে হবে।
– হ্যা তো ওকে সেটা বুঝা?
রূপন্তী এবার ক্ষেপে গেলো। শ্রাগ করে বলল,
– হোয়াট ড্যু ইউ মিন বায় “ওকে বোঝা”? ও আমাকে ভালোবাসতে না চাইলে আমি জোর করে বাসাবো?
– তো তুই ওকে সেটা ফিল করিয়েছিস?ফার্স্ট ইয়ার নিজে প্রেমে পড়ে ডুবে গেলি।অথচ নিজেদের পরিচয় শুরু করলি ঝগড়াঝাটি দিয়ে। এরপর এখন পর্যন্ত তোরা সেই একই রূপেই আছিস। তোর সায়নের প্রতি সেই প্রেম কোথায় গেলো?!
– আস্তে বল আদ্ধা!
– কি আস্তে বলব?এই যে বিয়ের পর তিন দিন কাটালি, কোন বেলায় তোরা ভালো করে কথা বলেছিস?সায়ন ঝগড়া করেছে, তুইও করেছিস।অথচ নিজে মনে মনে ওর সাথেই সংসার করতে চাচ্ছিস। তো সেটা ওকে ফিল করা।তুই যে ওকে ভালোবাসতে চাস, ওর সাথে থাকতে চাস তাহলে সেটা ওকে জানা।ও তোকে এসে থাপ্পড় মারলে তুই গিয়ে চুমু খা।সেটা তো করবি না।নিজের ইগো নিয়ে থাকা বন্ধ কর।ভালোবাসা রূপ দেখলেই হয়না।তাহলে তো সায়ন তোর প্রেমে সেই কবেই পড়ে যেতো।ভালোবাসা ফিল করাতে হয়।নিজের আচার-ব্যবহার দিয়ে। তুই কখনোই ওর সামনে নরম হোস না।সেদিন এত বছর পর দেখা হলো তোদের,ঠিকই ঝগড়া করলি।নিজেরা নিজেদের জায়গায় অটল।সায়ন ঘাড়ত্যাড়া, সেটা আমি জানি।কিন্তু তুই নিজেও কম না।

একটু থেমে এগিয়ে গিয়ে রূপন্তীর মুখ ধরে নিজের দিকে ফিরালো।চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করলো,
– আজ সকালে তুই সায়নের রুমে গেছিস।গিয়ে পাশে বসে কিছুক্ষন একাধারে তাকিয়ে ছিলি। এরপর কপালে হাত বুলিয়ে একটা চুমুও খেয়েছিস। তাই না?

রূপন্তী চোখ নামিয়ে নিলো।আরাদ্ধাকে মিথ্যা বলেও সে পাড় পাবে না।
আরাদ্ধা এবার নিজেকে শান্ত করে নরম গলায় বলল,
– আমি তোকেও হাড়ে হাড়ে চিনি,আমার ভাইকেও হাড়ে হাড়ে চিনি। তোদের মাঝের পার্থক্যটাও জানি।তুই ভালোবাসবি,কিন্তু নিজের তেজ, ইগো থেকে প্রকাশ করবি না।আর সায়ন যদি একবার ভালোবাসতে পারে, নিজেকে এই পৃথিবীর সামনে তুচ্ছ করে হলেও তোকে বুকের মাঝে আগলে রাখবে।আমার কথা তুই মিলিয়ে নিস।
#চলবে।

#এই_মন_তোমাকে_দিলাম
#পর্ব-১২
#আরাদ্ধা_সাদাত_খান
সবাই মিলে জম্পেশ একটা আড্ডা দিলো।এখন বিদায়ের পালা।রাত প্রায় দেড়টা বাজে।আগামীকাল সরকারি ছুটি থাকায় কারোরই তাড়া নেই।

রূপন্তী চিন্তায় মগ্ন। প্রথমত আরাদ্ধার কথাগুলো তার মাথায় হিট করেছে। সে নিজেকে ডিভোর্সি তকমা থেকে বাঁচাতে সংসার করতে চায়, এটা ভুল কথা। সে মন থেকেই এই সংসারটা করতে চায়। সায়নকে সে মেডিকেলের শুরু থেকেই পছন্দ করতো।কিন্তু খুবই অল্প। যেটাকে মেইনলি ‘ক্রাশ’ বলা হয়। কিন্তু সায়নের সাথে তার প্রথম পরিচয় থেকে ঝগড়া লেগে রয়েছে। সেই যে সাপে-নেউলে হলে সম্পর্ক হল, সায়নেরটা জানে না,তবে তার নিজের সুক্ষ অনুভূতিটুকু রাগ ঝগড়ার আড়ালে চাপা পড়েছিল। মূলত পছন্দ যেহেতু রুপন্তী করেছিল, তারই এপ্রোচ করা লাগতো।তবে তাদের ঝগড়ুটে সম্পর্কের জন্য সেটা আর করা হয়নি। এর মাঝে সায়ন খুব সুন্দর মতো আরেকটা রিলেশনে চলে গিয়েছিল।সে যতটুকু জানে, তাদের ইন্টার্নি শেষ হওয়া পর্যন্ত সায়নের রিলেশনটা ছিল। অর্থাৎ তার রিলেশনশিপের সময়সীমা ছয় বছর। এখন সেই সীমা পেরিয়ে এসে সময় আরো বেড়েছিলো নাকি সেটা রূপন্তী বলতে পারে না। কারন সে ততদিনে আরেকটা শহরে চলে গিয়েছিলো।
একটু আগে আরাদ্ধা বলল যে সে নিজের ইগো পেরিয়ে সায়নকে এই ছোট্ট অনুভূতির কথা বলতে পারবে না।অথচ আরাদ্ধা জানে না যে সায়নের প্রতি তার এই ইগোটা এমনে এমনে তৈরী হয়নি। সায়ন নিজেই করেছে।
তারা স্টুডেন্ট লাইফে যখন আড্ডা দিতে বসতো কিংবা কোথাও ঘুরতে যেতো,সায়ন বরাবরই ওর পিছে পড়ে থাকতো।যখন তখন খোটা দিতো।খোটা দেওয়াটা বড় ব্যাপার না,সে খোটাগুলো যার তার সামনে দিতো।আর যে বিষয়গুলো নিয়ে দিতো সেগুলো বরাবরই রূপন্তীর দূর্বল দিক ছিলো।
রূপন্তী বরাবরই পড়ুয়া স্টুডেন্ট ছিলো।এজন্যই রেজাল্ট ভালো করতো। সে অবশ্য রেজাল্ট ভালো করার জন্য পড়তো না, পড়াশোনা করতে ভালো লাগে বলে পড়তো।তাই স্বাভাবিক ভাবে অন্যান্য বিষয়ের ব্যাপারে সে কম জানতো।সারাদিন রুমে বসে পড়ার কারনে তার নড়াচড়া হতো না।তাই
স্বাভাবিক ভাবে শরীরে মেদ ছিলো।তবে সেটাকে মোটার কাতারে ফেলা যায় না।এখন চোখে আইসিএল করা,আগে চশমা পড়তে হতো।সেসব থেকেই সায়ন মেডিকেলে তার দুইটি নাম রটিয়ে দিলো,’ধুমসি’ আর ‘চাশমিস’।শেষের দিকে নামের অনুকরণ করে ডাকতো মিস ‘চার্ম’।
কোনো কারনে তাদের আড্ডাগুলোর মাঝে সায়নের গার্লফ্রেন্ড আরিশাও থাকতো।এবং তার সামনেই রূপন্তীকে এভাবে হেনস্তা হতে হতো।এমনভাবেই রূপন্তীর সায়নের প্রতি ভালোলাগাটা খতম হয়ে গেলো।কোনো মতে ইন্টার্নি শেষ করে পাড়ি দিলো অন্য শহরে।তবুও সব ভুলে সে শেষবারের মতো সায়নের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলো।ছেলেদের ডর্ম এর নিচে এসে কল দিলো।কি সুন্দর স্পষ্ট জানিয়ে দিলো যে আরিশার সাথে ডেট থেকে মাত্র ফিরেছে তাই আর নিচে নামতে পারবে না, সে ক্লান্ত।রূপন্তী তাকে বলেছিলো যে সে চলে যাচ্ছে।উত্তরে সায়ন খালি বলল,”ভালো থাকিস সুন্দরী।”
সুন্দরী বলুক আর যাই,সায়নের এই রূপ আচরণ সেবার তার মনে একরকম ছোপ ফেলে দিয়েছিলো।খোদার কাছে চেয়েছিলো যাতে ওই নিষ্ঠুর-পাষাণ ছেলেটার সাথে তার আর কখনো দেখা না হয়।কিন্তু ভাগ্যের জোরে নিজের অর্ধাঙ্গী হিসেবে সে এই বেয়াদব ছেলেটাকেই পেলো।এবং এই ছেলেটাই যে আসলে ভালো লাগার নামে তার হৃদপিন্ডে একটি দাগ কেটে গেছে সেটাও টের পেলো বিয়ের পরে।জেগে উঠা অনুভুতিগুলো ইনফ্যাচুয়েশন হিসেবে ধরলেও তা ভুল।কিন্তু সায়নের ব্যাবহারে এটা স্পষ্ট যে রূপন্তী তার বউ হোক আর যাই হোক তার কিছুই যায় আসে না।
এই ছেলেটা নিজেও জানে না যে সে রূপন্তীকে কি পরিমাণ এংজাইটিতে ভুগাতো।
এখন সেই ছেলের কাছে গিয়ে সে কিভাবে বলে যে সে তার সাথে থাকতে চায়।সারজীবনের জন্য আঙুলে আঙুল রাখতে চায়।সে নাহয় সব অপমান ভুলে গিয়ে এগিয়ে যেতো,কিন্তু অপর মানুষটার পক্ষ হতে একটা ইতিবাচক ইঙ্গিত তো লাগবে!
তার ভাবনার অবসান ঘটলো সীমন্তীর ডাকে।সবাই গাড়িতে উঠে গেছে অথচ সে এখনো দাঁড়ানো।তার ভাবনা দেখে সীমন্তী জিজ্ঞেস করলো,
– কোন চিন্তার জগতে হারালে যে এখনো দাঁড়িয়ে আছো?নাকি জামাইকে মিস করছো?

রূপন্তীর লজ্জা পাওয়ার কথা থাকলেও সে পেলো না।এই বেয়াদবটাকে মিস করলেও সে কখনো স্বীকার করবে না।জীবনেও না।সায়ন তার শত্রু। শত্রু মানে শত্রু!
রূপন্তী,তারিফ সাহেব- জয়া,সীমন্তী-রুহি-রায়ান;এই কয়জন মানুষ পনেরো মিনিটের মাঝে রূপন্তীর বাসায় পৌঁছে গেলো।
সায়নের আবার সাড়ে বারোটার দিকে হাসপাতালে যাওয়া লেগেছে। যেই ছেলেটার অপারেশন করেছে সন্ধ্যায়, তার অবস্থা ভালো না।তাই যেতে হয়েছে আবার।
মজার বিষয় হচ্ছে তারিফ চৌধুরী রূপন্তীর বাসার জন্য কিছু ফার্নিচার নিয়ে এসেছে। তার মধ্যে দুটো খাট,একটা আলমারি, একটা শোকেস এবং একটা ড্রেসিং টেবিল আছে।আলমারি আর ড্রেসিং টেবিল রূপন্তীর রুমে রাখা হলো।সে এতদিন একটা ছোট ড্রয়ার আর ব্যাগে নিজের জিনিস রাখতো।আয়না হিসেবে ব্যাবহার করতো বাথরুমের আয়না। ঠিক করেছিলো নিজের জমানো টাকা দিয়ে ধীরে ধীরে সব কিনবে।কিন্তু এখন তার আর প্রয়োজন মনে হচ্ছে না। সব কিছু সেট করলো তারিফ সাহেবের দলের ছেলে পেলেরা।
সব ঠিকঠাক করে ওদের শুতে শুতে তিনটা বাজলো।সায়নের তখনো কোনো খোঁজ নেই। রূপন্তী ফোন দিবে ভেবেও দিলো না।বিছানায় পিঠ ঠেকাতেই চোখ বন্ধ হয়ে এলো।
.
ঘুম ভাঙলো ফজরের আজানের কিছুক্ষন পর।জয়া এসে নামাজের জন্য উঠিয়ে দিয়েছে।সায়ন তখন পর্যন্ত আসেনি।
সে নামাজ পড়ার মধ্যে সায়ন আসলো।ক্লান্ত, বিধ্বস্ত।এসেই কোনো দিকে না তাকিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেলো।রূপন্তী নামাজ শেষ করে সব গুছিয়ে রাখতে রাখতে বের হলো।রূপন্তী তার দিকে তাকাতেই হাল্কাভাবে মনটা দুলে উঠলো।এত বিধ্বস্ত কেন ছেলেটা?
সায়ন কোনো কথা না বলে কাঁথা টেনে শুয়ে পরলো।রূপন্তীও আগ বাড়িয়ে কথা বলল না।এসি ছেড়ে বিছানায় সায়নের পাশে আধশোয়া হয়ে বসলো।সেটা টের পেতেই সায়ন এদিকে ফিরে মাথা তুলে রূপন্তীর দিকে তাকালো।ভারি কণ্ঠে বলল,
– ছেলেটাকে বাঁচাতে পারলাম না।বাবা – মার একমাত্র সন্তান ছিলো।মানুষ দুটো বেঁচে থাকার অবলম্বন হারিয়ে ফেললো।আমরা ব্যার্থ। আমি ব্যার্থ।

রূপন্তীর মন চাইলো মাথাটা বুকে চেপে আদর করে দিতে।বলতে মন চাইলো,”ছেলেটার হায়াত শেষ হয়ে গেছে,এখানে তোর কোনো দোষ নেই।”
অবশ্যই সে কথাগুলো বলতে পারলো না।কি করবে বুঝতে না পেরে হাত গলালো এলোমেলো চুল গুলোর মাঝে। আস্তে আস্তে হাত বুলাতে লাগলো।মৃদু কণ্ঠে বলল,
– বাঁচা-মরা আল্লাহর হাতে।ছেলেটার যাওয়ার সময় হয়ে গেছে, সে চলে গিয়েছে। এখানে কারো দোষ নেই।তুই খামোখা নিজের শরীর খারাপ করিস না।তোর শরীর খারাপ হলে বাকি রোগীদের কে দেখবে?! আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি, তুই ঘুমা।

কিছুক্ষনের মাঝের সায়নের নাক ডাকার আওয়াজ শোনা গেলো।গভীর নিদ্রায় তলিয়ে গেছে সে।কিন্তু সেই ডাকে রূপন্তী আর ঘুমাতে পারলো না।শুয়ে এক নজরে তাকিয়ে রইলো সামনে থাকা সুদর্শন চেহারাটার দিকে, যেখানে এখনো ক্লান্তি এবং বিধ্বস্ততার ছাপ লেপে আছে।
তাকিয়ে থাকতে থাকতে নিষিদ্ধ এক ইচ্ছা মনে হানা দিলো। নিজেকে দমালো না। এগিয়ে গিয়ে কপালে পড়ে থাকা চুলগুলো সরিয়ে গভীরভাবে ঠোঁট চাপলো। সেভাবেই থাকলো।সরলো না।কেন সরবে?মানু্ষটা তো তার ব্যাক্তিগত!

বি:দ্র:- আইসিএল(ICL)চোখের একটা সার্জারি।বিস্তারিত জানতে গুগল করেন।
#চলবে।