একটা বসন্ত বিকেলে পর্ব-২+৩

0
264

#একটা_বসন্ত_বিকেলে
#অরনিশা_সাথী

|২|+/৩/

দুই দিন হলো ঘর থেকে বের হয় না আয়াত। ভার্সিটিতেও যাচ্ছে না। ইরা এসে বার কয়েক বুঝিয়েছে কিন্তু আয়াত বাসা থেকে বের হতে নারাজ। ওর ভালো লাগছে না কিছু, তাই আপাতত কয়েকদিনের জন্য সবকিছু থেকে নিজেকে দূরে রাখতে চায়। আয়াশও আর বোনের উপর জোর খাটায়নি। ছেড়ে দিয়েছে নিজের মতো। বিছানার এককোনে জানালার ধারে বসে আছে আয়াত। হাতদুটো আলতো করে জানালার গ্রীল আকড়ে ধরেছে। নিষ্প্রাণ চোখদুটো দিয়ে তাকিয়ে আছে দূর আকাশের দিকে। একে একে চোখের সামনে ভেসে উঠছে ফারাবীর সাথে কাটানো সময়গুলো। ছেলেটা একসময় কত পাগলামিই না করেছিলো আয়াতের জন্য। ফারাবীর পাগলামি, ভালোবাসাগুলোই বাধ্য করেছিলো আয়াতের মনে ফারাবীকে জায়গা দিতে। ফারাবীকে প্রচন্ড ভালোবাসতো আয়াত৷ ফারাবীও কি কম ভালোবেসেছিলো আয়াতকে? না তো, তাহলে কি করে পারলো রাইতাকে বিয়ে করে নিতে? রাইতা আর ফারাবীর বিয়ের কথা মনে হতেই হাটুতে মুখ গুজে কেঁদে উঠলো আয়াত। ভাবতে চায় না, এসব কিচ্ছু ভাবতে চায় না ও। বিয়ে যেহেতু করেই নিয়েছে তাহলে সুখে থাকুক সে। এটাই আয়াতের চাওয়া।

ফার্স্ট সেমিস্টারের পর ভার্সিটি বন্ধ দিয়েছে কয়েকদিন দিনের জন্য৷ আয়াশ চাচ্ছে এই সময়টা আয়াত কোথাও থেকে ঘুরে আসুক৷ যদিওবা আয়াতের বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই। তাই না করে দেয় ও। বিছানার হেডবোর্ডের সাথে হেলান দিয়ে বসে গল্পের বই পড়ছিলো আয়াত৷ সেসময়ে ঘরে আসে ইরফান এবং আশা। দুজনে মেয়ের দুই পাশে বসে। আয়াত ইরফানের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে। ইরফান মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকেন। এক পর্যায়ে আশা বললো,
–“আয়ু কিছু বলার ছিলো।”

আয়াত বাবার কোলে শুয়ে চোখ বন্ধ রেখেই বললো,
–“বলে ফেলো আম্মু।”

মেয়ের সম্মতি পেয়ে আশা বললো,
–“আমরা চাচ্ছিলাম তুই কয়েকটা দিনের জন্য তোর নানুবাড়ি থেকে ঘুরে আয়।”

চকিত চোখ মেলে তাকায় আয়াত৷ এবার ইরফান মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
–“হ্যাঁ মা, তুমি ঢাকায় তোমার মামাবাড়ি গিয়ে কয়েকটা দিন ঘুরে এসো। তোমার মন ভালো নেই সেটা বুঝি আমরা৷ কোনোকিছুই তো আমাদের অজানা নয়। এখান থেকে কয়েকটা দিনের জন্য দূরে গেলে হাওয়াবদলে তোমারও ভালো লাগবে।”

বাবার কথাগুলো বেশ কিছুক্ষণ ভাবলো আয়াত৷ উনি ঠিকই বলেছেন। এখানে থাকলে ওর আরো দমবন্ধ লাগবে। ফারাবীর কথা মনে হবে বারবার। এখানে আনাচে কানাচে ফারাবীর সাথে ওর স্মৃতি আছে৷ ক্লাস শেষে আয়াত প্রতিদিন অপেক্ষা করতো ফারাবীর জন্য৷ আর ফারাবীও প্রতিদিন লাঞ্চ টাইমে অফিসে না থেকে কোনোরকম লাঞ্চ সেরেই আয়াতকে আনতে যেতো। কখনো কখনো দুজনে একসাথেই কোনো রেস্তোরাঁয় বসে লাঞ্চ করতো। দুজনে একসাথেই কথা বলতে বলতে বাড়ির দিকে ফিরতো। কখনো একটু বেশি সময় কাটানোর জন্য হেঁটেও আসতো দুজনে। প্রায়সময় বাইকেই যাওয়া আসা করতো। আয়াতকে বাড়ির কাছাকাছি নামিয়ে দিয়ে ফারাবী আবার অফিসের দিকে ছুঁটতো। ক্লাস ফাঁকি দিয়ে দেখা করতো, ছুটির দিনগুলোতে কোচিংয়ে আসা-যাওয়ার সময়েও দেখা করতো দুজনে।

ইরফানের ডাকে কল্পনা থেকে বাস্তবে ফিরলো আয়াত। আশা বললো,
–“কি ভাবছিস?”

আয়াত মেকি হাসলো। ভাবলো কয়েকটা দিনের জন্য ঘুরে আসা-ই যায়৷ এতে যদি সব ভুলে নতুন ভাবা বাঁচা যায় ক্ষতি কি? তাই বললো,
–“আচ্ছা যাবো।”

আয়াতের কথায় ইরফান এবং আশার মুখে হাসি ফুটলো। আশা বললো,
–“তাহলে বড় ভাইজানকে জানিয়ে দিচ্ছি আমি। তুই যাচ্ছিস ওখানে।”

আয়াত মুচকি হেসে সম্মতি জানালো। ইরফান মেয়ের মাথায় চুমু খেয়ে বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে। আশা বেরিয়ে যাওয়ার আগে বললো,
–“ডিনার রেডি আছে, খাবি আয়।”

আয়াত মাথা নাড়লো। আশা চলে গেলো ঘর থেকে। সকলে একসাথে খেতে বসেছে। ইরফান বললো,
–“তোমার মামার সাথে কথা হয়েছে, ব্যাগ গুছিয়ে নিও আয়াশ কাল দিয়ে আসবে তোমায়।”

আয়াত খেতে খেতেই বললো,
–“আব্বু আমি ট্রেনে করে যেতে চাচ্ছিলাম।”

আয়াশ বললো,
–“আচ্ছা তাহলে আমি ট্রেনের টিকিটই কেটে রাখছি, তোকে পৌঁছে দিয়ে আমি আবার ব্যাক করবো।”

–“তার দরকার নেই ভাইয়া, আমি একা যাবো।”

এতক্ষণ সবটা চুপচাপ শুনছিলো আশা। এবার বললো,
–“অনেকটা রাস্তা, তুই একা যেতে পারবি? তাছাড়া কখন কি হয় বলা তো যায় না।”

ইরফান সবাইকে থামিয়ে দিয়ে বললো,
–“আয়ু মা একাই যাবে। আমার মেয়ে তো খুব স্ট্রং। ওর তো একা জার্নির করার ইচ্ছে আগে থেকেই। এখন যেহেতু সুযোগ এসেছে তাহলে একাই যাক৷ ওকে নিয়ে চিন্তা করো না, ও আমার মেয়ে। সব পরিস্থিতিতে নিজেকে সামলে নেওয়ার ক্ষমতা আমার আয়ু মায়ের আছে। তাই না মা?”

বাবার কথায় মুচকি হাসলো আয়ু৷ আয়াশ জানালো কাল ভোরে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকার যে ট্রেন ছাড়বে তার টিকিট কেটে রাখবে ও। তারপর সবাই খাওয়া-দাওয়া সেরে ঘুমাতে চলে গেলো।

লাগেজ গোছাচ্ছে আয়াত। কাল সকাল সকাল বেরিয়ে পড়বে৷ খুব এক্সাইটেড আয়াত৷ এই প্রথম একা জার্নি করবে। তাও আবার ট্রেনে করে। আয়াতের এবারই প্রথম ট্রেন জার্নি হবে৷ লাগেজ গোছানো শেষ করে ইরাকে ফোন লাগালো। কিন্তু রিসিভ হলো না। মিনিট দুয়েক বাদে ইরা কল ব্যাক করলো। প্রথমে টুকটাক কথা বলে আয়াত বললো,
–“কাল ঢাকায় নানুবাড়ি যাচ্ছি ইরা, তুইও চল না আমার সাথে?”

–“স্যরি ইয়ার, আম্মু একটু অসুস্থ তা নাহলে যেতাম আমি।”

–“ইট’স ওকে, ব্যাপার না। তুই আন্টির দিকে খেয়াল রাখ।”

–“মিস করে গেলাম ট্রেন জার্নিটা।”

ইরার কথায় মুচকি হাসলো আয়াত৷ বললো,
–“নেক্সট তোকে সাথে নিয়েই যাবো, তখন কোনো কথা শুনবো না আমি।”

–“তখন তুই বলার আগেই আমি দৌড়ে চলে আসবো যাওয়ার জন্য।”

ইরার কথায় খিলখিল করে হেসে উঠলো আয়াত। তা শুনে ইরাও হাসলো। প্রায় মাস দুয়েক পর মেয়েটা প্রানখুলে হাসলো। আরো কিছুক্ষণ কথা বলে ফোন রেখে দেয়। অতঃপর ঘুমানোর প্রস্তুতি নেয় আয়াত।

সকাল সোয়া ছয়টা বাজে। রেলস্টেশনে এসে মাত্রই পৌঁছেছে আয়াত৷ সাথে এসেছে ওর বাবা ইরফান এবং ভাই আয়াশ। অনেক কষ্টে ট্রেনের টিকিট পেয়েছে আয়াশ। লাস্ট মোমেন্টে এসে ট্রেনের টিকিট পাওয়া টাফ ব্যাপার। অনেক কষ্টেই ওয়েন্ডো সিট ম্যানেজ করে দেয় আয়াশ। আয়াত ওর বাবা ভাইকে বিদায় জানিয়ে ট্রেনে উঠে বসলো। আয়াশ অনেক ধরনের স্ন্যাকস কিনে দিয়েছে। যা যা আয়াতের পছন্দ৷ সাড়ে ছয়টা বাজেই ঢাকার উদ্দেশ্যে ট্রেন ছাড়ে। কানে ইয়ারফোন গুজে বাইরের দিকে দৃষ্টি রাখলো আয়াত। কিছুক্ষণ বাদে কেউ একজন আয়াতের কান থেকে ইয়ারফোন খুলে ফেললো। বিরক্তিতে চোখমুখ কুঁচকে সেদিকে তাকালো আয়াত৷ দেখতে পেলো ওর দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে আছে একটা ছেলে। ওর সমবয়সী বা ওর থেকে দুই/এক বছরের বড় হবে। দেখতে লম্বা চওড়া, মোটামুটি ফর্সা বলা চলে। ছেলেটা ভ্রু কুঁচকে বললো,
–“কতক্ষণ ধরে ডাকছি শুনছেন না কেন? এভাবে কানে ইয়ারফোন গুজে কেউ জার্নি করে? আপনার পাশে একজন মারা গেলেও তো মেবি আপনি টের পাবেন না।”

আয়াত ভ্রু কুঁচকে তাকালো। ছেলেটার চোখের দিকে তাকিয়েই কাটকাট গলায় জবাব দিলো,
–“যতদূর মনে পড়ে আমার সাথে আপনার কোনো দরকার থাকতে পারে না। সুতরাং আপনার ডাক শোনার প্রয়োজন বোধ করছি না আমি।”

ছেলেটা আয়াতের পাশের সিটের খাবার প্যাকেটগুলো দেখিয়ে বললো,
–“এই যে, সিটের উপর এত এত খাবারের প্যাকেট রেখে দিয়েছেন এটা তো অন্য একজনের সিট তাই না? এখন সে এসে এখানে খাবারের প্যাকেট দেখলে নিশ্চয়ই ডাকবে আপনাকে?”

আয়াত কিছু না বলে প্যাকেট গুলো সরিয়ে রাখলো। ছেলেটা বিড়বিড় করে বললো,
–“খাদক একটা, জার্নি করার সময় কেউ যে এত খেতে পারে জানা ছিলো না।”

কথাটা আয়াতের কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই রেগেমেগে তাকালো ছেলেটার দিকে। এমন সময় একটা মহিলা ছেলেটার কান টেনে ধরে বললো,
–“আবারো ঝগড়া লাগিয়েছিস মেয়েটার সাথে? আচ্ছা শান তোকে নিয়ে কি করবো আমি বল তো?”

ছেলেটা ব্যাথায় মৃদু আর্তনাদ করে বললো,
–“ওফস আম্মু, ছাড়ো তো লাগছে আমার। তাছাড়া এখানে আমার কোনো দোষ নেই।”

–“পেটে ধরেছি তোকে আমি, সুতরাং আমি খুব ভালো করেই চিনি তোকে।”

কথাটা বলে মহিলাটা শানের কান ছেড়ে দিলো। তারপর আয়াতের মুখোমুখি সিটে বসে পড়লো। শান আয়াতের পাশের সিটে ব্যাগ রেখে ওর মায়ের পাশে বসে পড়লো। একটা সিট ওরা এক্সট্রা নিয়েছে।

শান মেহরাব, সানিয়া মেহরাবের দুইমাত্র ছেলে। দুইমাত্র বলছি তার কারণ শানের বড় একজন ভাই আছে। মা ছেলে মিলে চট্টগ্রামে ঘুরতে এসেছিলো। ঘুরাঘুরি করে আজই ঢাকায় ফিরছে উনারা। শানের বড় ভাই আসেনি সে অফিসের কাজে ব্যস্ত। ওদের বাবা নেই, সানিয়া একা হাতে মানুষ করেছে দুই ছেলেকে। সানিয়ার দুই ছেলেই সেজন্য মা বলতে পাগল।

সানিয়া আয়াতকে লক্ষ্য করছে অনেকটা সময় যাবত। মেয়েটা কেমন চুপচাপ জানালার বাইরে দৃষ্টি রেখে বসে আছে। সানিয়া আয়াতকে উদ্দেশ্য করে বললো,
–“শানের কথায় কিছু মনে করো না মা, ও এরকমই সবার সাথেই মজা করে বেড়ায়। আসলে__”

আয়াত এক পলক তাকালো শানের দিকে। তারপর আবার সানিয়ার দিকে তাকিয়ে বললো,
–“সমস্যা নেই আন্টি।”

–“তুমি কি একা যাচ্ছো? সাথে আর কাউকে দেখছি না যে?”

–“আসলে আন্টি আমি ঢাকায় নানুবাড়ি যাচ্ছি, সাথে ভাইয়া আসতে চেয়েছিলো আমিই বারণ করেছি, একা জার্নি করবো বলে।”

এভাবেই টুকটাক কথা চলতে লাগলো দুজনের। শান এক ধ্যানে ফোনের মাঝেই তাকিয়ে আছে।

লম্বা একটা জার্নি শেষে মাত্রই ঢাকা এসে পৌঁছালো আয়াত। জার্নিটা বেশ ভালো লেগেছে ওর। ইচ্ছে আছে ফেরার পথেও ট্রেনে করেই ফিরবে ও। ট্রেনে এসে যে সব সৌন্দর্য দেখতে পেয়েছে গাড়ি/বাসে করে আসলে সেসব সৌন্দর্য গুলো মিস হয়ে যেতো। আরো ভালো লেগেছে সানিয়া মেহরাবের জন্য। বড্ড মিশুক একজন মানুষ উনি। চট্টগ্রাম ছেড়ে আসার পথে যেসব সুন্দর সুন্দর মনকাড়া জায়গাগুলো চোখে পড়েছে সেগুলোর বর্ণনা খুব ভালো ভাবে করেছে উনি। প্রত্যেকটা জায়গা, জায়গার নাম আয়াতকে বলেছে উনি।

একটা বেঞ্চিতে বসে আয়াত ওর ছোট মামার জন্য অপেক্ষা করছে। উনি এসে নিয়ে যাবে আয়াতকে। ওখান দিয়ে যাওয়ার পথে সানিয়া মেহরাবের চোখ পড়লো আয়াতের উপর। আয়াতকে দেখে ওর কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
–“আয়াত? যাওনি এখনো?”

আয়াত দাঁড়িয়ে বললো,
–“আসলে আন্টি, মামা আসবে নিতে। উনার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।”

–“আচ্ছা তাহলে তোমার মামা না আসা অব্দি আমি থাকি তোমার সাথে? জায়গাটা অপরিচিত তোমার কাছে, নিশ্চয়ই আন-ইজি লাগছে?”

আয়াত সম্মতি জানালো। সানিয়া বসে পড়লো আয়াতের পাশে৷ শান বললো,
–“আম্মু লেট হচ্ছে তো, ওদিকে ড্রাইভার অপেক্ষা করছে।”

–“আর একটু অপেক্ষা করলে কোনো সমস্যা হবে না। মেয়েটাকে এই অচেনা জায়গায় একা রেখে কিভাবে যাই? বিবেকবুদ্ধি কি লোপ পেয়েছে তোর?”

বিরক্তিতে চোখমুখ কুঁচকে অন্যদিকে তাকালো শান৷ একজন ভদ্রলোক এসে আয়াতের সামনে দাঁড়িয়ে বললো,
–“স্যরি মামণি, অনেকটা সময় অপেক্ষা করালাম তাই না? আসলে একটা কাজে আটকে পড়েছিলাম। এখন চলো দ্রুত বাসার সবাই তোমার অপেক্ষায় আছে।”

কথাগুলো শুনে চোখ তুলে তাকালো আয়াত৷ ছোট মামাকে দেখতে পেয়ে খুশিতে চোখ চিকচিক করে উঠলো। আয়াত ওর মামাকে জড়িয়ে ধরে বললো,
–“কেমন আছো মামা?”

–“আলহামদুলিল্লাহ, বাড়িতে গিয়ে বাকী কথা হবে। চলো এবার।”

কথাগুলো বলে আয়াতের মামা ওর লাগেজ ধরতেই পাশ থেকে সানিয়া মেহরাব বললো,
–“আমান ভাই? আয়াত আপনার ভাগ্নী?”

আমান পাশে তাকিয়ে সানিয়াকে দেখতে পেয়ে অবাক হলো। মুখে হাসি টানিয়ে বললো,
–“হ্যাঁ ভাবী, আপনারা এখানে?”

–“আমরা একই ট্রেনে এসেছি।”

–“ওহ আচ্ছা।”

সানিয়া মেহরাব আর আমানদের বাসা পাশাপাশি। দীর্ঘ বছর যাবত উনারা প্রতিবেশী। দুই পরিবারের মধ্যে বেশ ভালো সম্পর্ক। সানিয়া মেহরাব আমান আর আয়াতকে উনাদের সাথে যেতে বললে আমান জানায় গাড়ি নিয়ে এসেছে। অতঃপর দুজনেই দুজনের গাড়ি করে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়।

সবার সাথে দেখা করে শাওয়ার নিতে চলে যায় আয়াত। আয়াতের আম্মুরা দুই ভাই এক বোন। আয়াতের বড় মামা আসিফের এক ছেলে দুই মেয়ে। ছেলে দিহান এবং মেয়ে রাফিয়া, আফিয়া৷ দিহান সবার বড়, আসিফের সাথে বিজনেস দেখছে৷ রাফিয়া আর আয়াত সমবয়সী, আফিয়া এবার ক্লাস এইটে পড়ে। এবং আমানের এক ছেলে আরাফ যে ক্লাস থ্রি তে পড়ে। আয়াতের নানা বেঁচে নেই, শুধুমাত্র নানু জীবিত আছে।

আয়াত লম্বা একটা শাওয়ার নিয়ে বের হতেই দেখলো রাফিয়া ওর বিছানায় বসে আছে৷ আয়াত ব্যালকোনিতে টাওয়াল মেলে দিয়ে ড্রেসিংটেবিলের সামনে দাঁড়ালো। রাফিয়া বিছানায় বসে পা ঝুলাতে ঝুলাতে বললো,
–“কি ব্যাপার আয়ু? হঠাৎ করে আমাদের বাড়ি তোর পায়ের ধূলো ফেলতে ইচ্ছে করলো যে?”

–“কেন আসতে পারিনা?”

–“অবশ্যই পারিস, তবে আগে এত বলার পরও আসিস নি আজ হুট করেই চলে এলি তাই জিজ্ঞেস করলাম।”

আয়াত কিছু বললো না। হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে চুল শুকাচ্ছিলো। রাফিয়া বললো,
–“তা ফারাবী ভাইয়া কেমন আছে? তাকে না দেখে এতদিন থাকতে পারবি তুই? ভাইয়ার জন্যই তো আসতে চাইতি না___”

রাফিয়ার কথায় আয়াতের হাত থেমে গেলো। এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো চোখ থেকে। হেয়ার ড্রায়ার টা রেখে চোখের পানিটুকু মুছে নিলো। গায়ে ওড়না জড়িয়ে রাফিয়ার পাশে বসে মুচকি হেসে বললো,
–“ফারাবীর জন্যই এসেছি।”

রাফিয়া আয়াতের দিকে ঘুরে বসলো। হাসিমুখে বললো,
–“ফারাবী ভাইয়াও ঢাকায় এসেছে? এবার কিন্তু আমার সাথে মিট করাতেই হবে বলে দিলাম।”

–“ফারাবী বিয়ে করে নিয়েছে রাফিয়া, আর ওর স্মৃতিগুলো কাটিয়ে ওঠার জন্যই আমার এখানে আসা।”

–“বুঝলাম না।”

রাফিয়ার অবাক কন্ঠস্বর, অবাক চাহনী। আয়াত মুচকি হেসে বললো সব কথা। সব শুনে রাফিয়া বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো। কি বলবে বুঝতে পারছে না। অনুশোচনা হচ্ছে অনেক। না জেনেই মনে হয় আয়াতকে কষ্ট দিয়ে ফেললো ভাবছে এসব। রাফিয়া আমতা আমতা করে বললো,
–“স্যরি আয়ু, আসলে আমি___আমি তোকে কষ্ট দিয়ে___”

–“ইট’স ওকেহ। ব্যাপার না, তুই তো আর কিছু জানতি না।”

–“আচ্ছা চল খেয়ে নিবি, ভাইয়াও ফিরেছে দুজনে একসাথেই খেয়ে নিবি। বাকী সবার তো খাওয়া শেষ তুই আসার আগেই।”

–“হুম চল।”

রাফিয়া আয়াতকে নিয়ে বেরিয়ে গেলো ডাইনিংয়ে। আয়াত গিয়ে দেখলো দিহান আগে থেকেই বসা। আয়াতকে দেখে মুচকি হেসে বললো,
–“কিরে আয়ু? কেমন আছিস তুই?”

আয়াত চেয়ার টেনে বসে বললো,
–“ভালো ভাইয়া, তুমি?”

–“ভালোই ছিলাম, এখন আরো একটু বেশিই ভালো লাগছে।”

আয়াত ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
–“কেন?”

–“এই যে তোর দেখা মিলেছে, ফাইনালি সাত/আট বছর পর তোর পায়ের ধুলো পড়েছে।”

কথাটা বলেই দিহান উচ্চস্বরে হাসলো। দিহানের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আয়াতও ফিক করে হেসে দিলো।

চলবে~

#একটা_বসন্ত_বিকেলে
#অরনিশা_সাথী

|৩|

ব্যালকোনিতে বসে চায়ের আড্ডা দিচ্ছে আয়াত, দিহান আর রাফিয়া। রাফিয়া দিহান দুজনেই প্রচুর চঞ্চল প্রকৃতির মানুষ। আয়াতও ওদের থেকে কোনো অংশে কম যায় না চঞ্চলতায়। ফারাবীর বিয়ের ঘটনাটাই আয়াতকে নিশ্চুপ করে দিয়েছে। তবে আয়াত যে ধরনের মেয়ে ও এত সহজে ভেঙে পড়বে না৷ একটু সময় লাগবে বাট সবটা আবার আগের মতো করে নিবে। ফারাবী ওর লাইফে আসার আগেও আয়াত একাই ছিলো, তাহলে এখন কেন পারবে না? হ্যাঁ ফারাবীকে ভুলে যাওয়াটা সহজ হবে না। কিন্তু মনে না রাখার চেষ্টা-টাই করতে হবে ওর। ওর বাবা বলে না ও স্ট্রং? হ্যাঁ আয়াত এখন থেকে স্ট্রংই থাকবে৷ কেউ দমাতে পারবে না ওকে। মনে মনে এসব ভাবতে লাগলো আয়াত৷ এমন সময় রাফিয়া আয়াতের কাঁধে হাত রেখে বললো,
–“তুই এত চুপচাপ কেন আয়ু বল তো? কি ভাবছিস?”

আয়াত মুচকি হাসলো। বললো,
–“তোদের কথা শুনছিলাম তো।”

দিহান আয়াতের মাথায় টোকা মেরে বললো,
–“তোকে বড্ড উদাসীন লাগছে রে আয়ু, ছ্যাকা-ট্যাকা খেয়ে ব্যাকা হয়ে গেলি নাকি?”

দিহান কথাটা হাসির ছলে বললেও আয়াতের চেহারার রঙ বদলে গেলো। রাফিয়া আয়াতের হাতে হাত রাখলো। আয়াত ইশারায় বোঝালো ও ঠিক আছে। আয়াত হেসে বললো,
–“মুখ দেখে সবকিছু কবে থেকে বুঝতে শুরু করলে ভাইয়া? কি ব্যাপার? তুমিও কি তাহলে___”

ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলো আয়াত। দিহান একগাল হেসে বললো,
–“আরে ধুর! ওরকম কিছু না। ভেবেছি একেবারে বিয়ে করে ফেলবো, জীবনের সাতাশ-টা বসন্ত তো একাই পার করলাম আর কতো বল?”

আয়াত কিছু বলবে এমন সময় গাড়ির হর্ন বেজে উঠলো। কেউ একজন অনবরত গাড়ির হর্ন বাজাচ্ছে। আয়াত রাফিয়া দিহান তিনজনেই শব্দ অনুসরণ করে রাস্তায় দিকে তাকালো। দেখতে পেলো মেহরাব ম্যানশনের গেটে কেউ গাড়ি নিয়ে অপেক্ষায় আছে। গেট খোলায় লেট হচ্ছে বিধায় সে একের পর এক হর্ন বাজাচ্ছে। দারোয়ান এসে দ্রুত গেট খুলে দিতেই গাড়িটি ভিতরে ঢুকে গেলো। আয়াত তখনো ভ্রু কুঁচকে গাড়িটির দিকে তাকিয়ে আছে। গাড়ির মালিকের উপর ক্ষানিকটা বিরক্ত হয়েছে ও। এভাবে এত হর্ন বাজানোর কি আছে? হয়তো বিজি ছিলো তাই একটু গেট খুলতে লেট হয়েছে। দিহানদের বাসার পাশের বাসাটাই সানিয়া মেহরাবের। সাদা রঙের বিশাল বড় দোতলা ডুপ্লেক্স বাড়ি। দেখলে যে কারো চোখ জুড়িয়ে যাবে। আয়াত বাড়িটির দিক থেকে চোখ সরিয়ে আবারো গাড়িটার দিকে তাকালো। কিছুক্ষণ পরই দেখা গেলো গাড়ির ভিতর থেকে লম্বা চওড়া একটা লোক বের হলো। কালো কোর্ট-প্যান্ট পরিহিত। গাড়ি থেকে বেরিয়ে লোকটা সোজা বাসার ভিতরে চলে গেলো। আয়াত দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো। রাফিয়া বললো,
–“ছেলেটাকে দেখেছিস?”

রাফিয়ার এমন প্রশ্নে ভ্রু কুঁচকালো আয়াত। রাফিয়া হেসে বললো,
–“একটু আগেই যে ওই বাড়ির ভিতরে চলে গেলো সে শ্রাবণ মেহরাব। শানের বড় ভাই। প্রচুর রগচটা, গোমড়ামুখো আর একগুঁয়ে স্বভাবের। আন্টি মাঝে মাঝে এসে বলেন শ্রাবণ ভাইয়ার কপালে কোন মেয়ে আছে আল্লাহ মালুম, মেয়েটা উনার এমন স্বভাব সামলে নিতে পারবে তো? আমার কাছে উনাকে ভালোই লাগে। বিশেষ করে উনার এটিটিউডের জন্য। কি এটিটিউড মাইরি, আমি তো বারে বারে ক্রাশ খাই শ্রাবণ ভাইয়ার উপর।”

গড়গড় করে এসব বলে থামলো রাফিয়া। দিহান রাফিয়ার মাথায় থাপ্পড় মেরে বললো,
–“তোর এই লাস্টের কথাগুলো যদি আমি শ্রাবণের কানে তুলি তাহলে ও নির্ঘাত তোকে ছাদের উপর থেকে নিচে ছুঁড়ে মারবে বেয়াদব, জানিস না ও বোন ভাবে তোকে?”

রাফিয়া মাথা ডলতে ডলতে বললো,
–“উনি বোন ভাবে বলে যে আমারও উনাকে ভাই ভাবতে হবে এমন কোথাও লেখা নেই।”

আয়াত সব শুনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তারপর বললো,
–“তাহলে এসব আমাকে কেন বলছিস? আমি কি কিছু জানতে চেয়েছি তোর কাছে?”

–“আরেহ বলে রাখলাম। বলে রাখা ভালো না? নজর টজর দিস না আবার। শ্রাবণ ভাইয়ার গায়ের রংটা যদিওবা উজ্জ্বল শ্যাম বর্ণ তবুও উনার চেহারায় আলাদা একটা মায়া আছে। ফর্সা ছেলেদেরও হার মানাবে উনি। উনার সারা মুখশ্রীতে যেন এক অন্যরকম মায়া লেপ্টে থাকে সবসময়।”

আয়াত উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
–“তুই ভাবতে থাক তোর শ্রাবণ ভাইয়াকে নিয়ে, আমি গেলাম। আমার এসব শোনার কোনো আগ্রহ নেই এই মূহুর্তে।”

আজ ঘুম থেকে উঠতে লেট হয়ে গেছে আয়াতের। কাল অনেক রাত অব্দি রাফিয়ার সাথে আড্ডা দিতে গিয়েই এই অবস্থা। আয়াত ফ্রেশ হয়ে ডাইনিংয়ে গেলো। দেখলো ওর দুই মামী কাজে ব্যস্ত। রাফিয়াকে দেখা যাচ্ছে না কোথাও। আয়াতের বড় মামী আয়াতকে টেবিলে বসতে বলে বললো,
–“টেবিলে বসে পড়ো আয়ু, খাবার ঢাকা দেওয়া আছে খেয়ে নাও।”

আয়াত টেবিলে বসতে বসতে বললো,
–“রাফু কোথায় মামি?”

–“কোথায় আর যাবে? নিশ্চয়ই শানদের বাড়ি গেছে। সানিয়া ভাবী ডেকে পাঠিয়েছিলো ওকে।”

আয়াত কিছু না বলে খাওয়ায় মনোযোগ দিলো। খেয়ে ঘরে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই রাফিয়া আয়াতের হাত ধরে টেনে বেরিয়ে গেলো বাসা থেকে। আয়াত ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
–“এভাবে টেনে কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস?”

–“শ্রাবণ ভাইয়ার বাড়িতে। কাকিমা যেতে বলেছে।”

আয়াত আর কিছু বললো না। সানিয়া মেহরাবকে আয়াতের বেশ ভালো লেগেছে। বড্ড মিশুক মানুষ। আয়াতের সাথে খুব ফ্রেন্ডলি বিহেভ করেছে উনি। ঢাকায় এসেছে দুদিন হলো। এই দুদিনে উনার সাথে আর দেখা হয়নি। আয়াত ভাবলো এখন দেখা হয়ে যাবে ভালোই। জমিয়ে আড্ডা দেওয়া যাবে উনার সাথে।

সানিয়া মেহরাব কিচেনে রান্না করছিলো। আয়াতকে দেখে গ্যাস অফ করে এগিয়ে এলো। আয়াতকে সোফায় বসিয়ে দিয়ে গাল ধরে বললো,
–“কেমন আছো আয়াত?”

–“আলহামদুলিল্লাহ আন্টি, আপনি?”

–“আমরাও আলহামদুলিল্লাহ। তা কি খাবে বলো? খেতে খেতে আড্ডা দেওয়া যাক?”

–“আমি মাত্রই ব্রেকফাস্ট করে এসেছি, এখন কিছু খাবো না।”

সানিয়া মুচকি হাসলো আয়াতের কথায়। সম্মতি জানিয়ে বললো,
–“আচ্ছা, তাহলে দুপুরে এখান থেকে খেয়ে তারপর যাবে কেমন? বিরিয়ানি রান্না করছি আজ। আমার শানের বিরিয়ানিটা আবার বড্ড পছন্দ, সপ্তাহে দু/তিন দিন ওর বিরিয়ানি চাই-ই চাই।”

বিরিয়ানির কথা শুনে রাফিয়ার জিবে জল চলে এলো। বললো,
–“ও নিয়ে তুমি চিন্তা করো না কাকিমা, বিরিয়ানি তো? ঠিক খেয়ে যাবো আমরা।”

আয়াত চোখ রাঙিয়ে তাকালো রাফিয়ার দিকে। রাফিয়া বোকাসোকা ভাবে হাসলো। এমন সময় শান সেখানে এসে আয়াতকে দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেললো। রসিকতা করে বললো,
–“এমা এটা কি ট্রেনের সেই খাদকটা না? যে কিনা খাবার দিয়ে ট্রেনের এক সিট বুকড করে রাখে?”

শানের কথায় আয়াত চটে গেলো। বললো,
–“দেখুন একদম খাদক বলবেন না, আমায় দেখে কি আপনার খাদক মনে হচ্ছে?”

শান ভালো ভাবে তাকালো আয়াতের দিকে। তারপর বললো,
–“দেখে তো মনে হয় না। আচ্ছা এত যে খাও সেগুলো যায় কোথায়?”

রাফিয়া শানের বাহুতে থাপ্পড় মেরে বললো,
–“যাকে দেখিস তার পেছনে লাগতেই তোর ভালো লাগে তাই না? ভুলেও আয়ুর পেছনে লাগতে আসবি না।”

শান রাফিয়ার চুল ধরে টেনে সোফায় গিয়ে বসলো। বললো,
–“ওর পেছনে লাগতে আমার বয়েই গেছে।”

আয়াত ভেংচি কেটে অন্যদিকে তাকালো। সানিয়া দুটো চকলেট এনে আয়াত আর রাফিয়ার হাতে দিলো। তারপর শানকে উদ্দেশ্য করে বললো,
–“দিনে দিনে বেয়াদব হচ্ছিস তুই। দেখা হয়েছে পর থেকে মেয়েটার পেছনে লাগছিস তুই। অসভ্য একটা।”

–“আম্মু আমি___”

–“শ্রাবণকে জানাতে হবে, তোর এইসকল বাঁদরামির কথা। ও যখন দুই/চার ঘাঁ লাগাবে তখন একদম তীরের মতো সোজা হয়ে যাবি।”

শান করুন চোখে তাকিয়ে বললো,
–“আম্মু, এসবে আবার ভাইয়াকে টানছো কেন? তোমার ছেলেকে দ্রুত বিয়ে করাও তো। বউ পেলে তোমার ওই ঘাড়ত্যাড়া ছেলে সোজা হয়ে যাবে দেখবে৷ আর আমাকেও এত ঝাড়তে পারবে না। তখন আমার পার্টনার চলে আসবে। দ্রুত ভাইয়ার বউ আর আমার ভাবী আনার ব্যবস্থা করো।”

কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলে দম নিলো শান। আয়াত ভ্রু কুঁচকে তাকালো। সানিয়া কিছুক্ষণ ভেবে বললো,
–“এবার তাই করতে হবে। ঘরে বউ নিয়ে আসতে হবে। তবে যদি আমার শ্রাবণটা একটু ঘরমুখো হয়, নয়তো সারাদিন কাজের মধ্যে ডুবে থাকে।”

শান খুশি হয়ে গেলো মায়ের কথায়। হাসিমুখে বললো,
–“আম্মু বলছিলাম কি তাহলে পাত্রী দুইটা দেখো। আমারো তো বিয়ের বয়স হয়েছে তাই না? ঘরে তো বউ দুজনই আনার দরকার।”

শানের কথায় আয়াত, রাফিয়া এবং সানিয়া তিনজনেই ভ্রু কুঁচকে তাকালো। সানিয়া শানের দিকে এগিয়ে গিয়ে ওর কান টেনে ধরলো। বললো,
–“ফাজিল ছেলে, এজন্যই ভাইয়ার বিয়ের এত তাড়া তাই না? যাতে তোর লাইন-ঘাট ক্লিয়ার হয়ে যায়?”

–“উফস আম্মু, দুইটা মেয়ের সামনে এভাবে কান টেনে ধরছো কেন? আমার একটা মান সম্মান আছে তো নাকি?”

–“আহা কি আমার মান সম্মান ওয়ালা ছেলে। কত মান সম্মান আছে তোর সেটা আমার খুব ভালো করেই জানা।

সানিয়া বেগমের কথায় আয়াত আর রাফিয়া ফিক করে হেসে দিলো। সানিয়া মুগ্ধ চোখে তাকালো আয়াতের দিকে। শান কাঁদোকাঁদো চেহারায় বললো,
–“ভাইয়াকে এখনই বলছি আমি ওয়েট, তুমি মেয়েদের সামনে আমার লেগপুল করছো। ভাইয়া নিশ্চয়ই বুঝবে আমায়।”

এমন সময় সিড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসে শ্রাবণ৷ আজ শুক্রবার, অফডে। সে কারণেই বাসায় আছে শ্রাবণ। রাফিয়া খুশিতে গদগদ হয়ে তাকালো শ্রাবণের দিকে৷ শান রাফিয়ার মাথায় চাটি মেরে বললো,
–“একদম ভাইয়ার দিকে ওরকম লুতুপুতু নজরে তাকাবি না বলে দিলাম।”

রাফিয়া মাথা ডলে রাগী চোখে তাকালো শানের দিকে। শান দাত বের করে হাসলো। শ্রাবণ কে দেখে সানিয়া এগিয়ে গেলো। বললো,
–“বোস, আমি খাবার দিচ্ছি।”

এরপর সানিয়া শান, রাফিয়া আর আয়াতকে উদ্দেশ্য করে বললো,
–“তোরাও বসে পড়।”

শান আর রাফিয়া গিয়ে চেয়ার টেনে বসলো। আয়াতের অস্বস্তি হচ্ছে। তাই আগের জায়গায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। সানিয়া মেহরাব একে একে টেবিলে সবকিছু এনে রাখলো। খাবার টেবিলে বসেও শান আর রাফিয়া হাতাহাতি করছে। যা দেখে আয়াত প্রচুর বিরক্ত। শ্রাবণ ওদের দুজনকে ধমক দিয়ে বললো,
–“তোদের দুজনকে বলেছি না আমার সামনে এরকম করবি না? চড়িয়ে গাল লাল করে দিবো বেয়াদব গুলো।”

শ্রাবণের এমন ধমকে রাফিয়া কাচুমাচু হয়ে বসে রইলো। শানও একদম ভদ্র ছেলের মতো বসে রইলো। সানিয়া মেহরাব আয়াতকে দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললো,
–“কি ব্যাপার আয়াত? তুমি ওখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন? এসে বসো।”

সানিয়ার কথায় আয়াত হেসে বললো,
–“আসলে আন্টি, আমি ব্রেকফাস্ট করেছি বেশিক্ষণ হয়নি। এখনই খেতে পারবো না।”

সানিয়া মেহরাব কিছু বলার আগেই শান বললো,
–“আরেহ মিস খাদক ওটা কোনো ব্যাপার না। আপনি খেতে পারবেন, এসে বসে পড়ুন।”

আয়াতের রাগ হলো প্রচুর। এই ছেলে সবসময় এভাবে ওর পেছনে কেন লাগে সেটাই বুঝে না আয়াত। শ্রাবণ চোখ রাঙিয়ে তাকালো শানের দিকে। শান কিছু না বলে চুপচাপ মাথা নিচু করে খাওয়ায় মনোযোগ দিলো। আয়াত এতক্ষণে ভালো করে দৃষ্টি দিলো শ্রাবণের উপর। লোকটার উজ্জ্বল শ্যাম বর্ণের সারা মুখশ্রী জুড়ে সত্যিই অন্যরকম এক মায়া লেপ্টে আছে। গালের খোচাখোচা চাপদাড়ির গুলো যেন সেই সৌন্দর্য আরো বাড়িয়ে তুলেছে। আয়াত দ্রুত চোখ সরিয়ে নিলো। ও রাফিয়ার মতো হতে শুরু করলো কবে থেকে সেটাই ভাবছে। সানিয়া মেহরাব আয়াতের হাত ধরে টেনে নিয়ে এবার টেবিলে বসালেন৷ প্লেটে অল্প করে বিরিয়ানি তুলে দিয়ে বললো,
–“এইটুকুন তো খেতেই পারবে৷ এখন খাও তো।”

আয়াত কিছু না বলে চুপচাপ খেতে শুরু করলো। এ বাড়ির তিনজন তিন মেরুর। শ্রাবণ মেহরাব গুরুগম্ভীর একজন লোক। যার চোখমুখে হাসির ছিঁটেফোঁটাও নেই। অন্যদিকে শান মেহরাব বড় ভাই শ্রাবণ মেহরাবের থেকে সম্পূর্ণ উলটো। মুখে হাসি যেন সবসময় লেগেই থাকে। আর প্রচন্ড কথা বলে। শ্রাবণ যতটাই গম্ভীর শান ততটাই হাসিখুশি আর মিশুক। অন্যদিকে ওদের মা সানিয়া মেহরাব, উনিও ভীষণ মিশুক আর হাসিখুশি একজন মানুষ সবার সাথেই ফ্রেন্ডলি বিহেভিয়ার করে।

রাফিয়া, আফিয়া আর আয়াত রেডি হচ্ছে। দিহান আজ ওদের ঘুরতে নিয়ে যাবে। সাথে আরাফও যাবে৷ শান তো রেডিমেডি হয়ে সেই কখন এসে বসে আছে। রাফিয়া আর আয়াত রেডি হয়ে নিচে নামতেই দেখতে পেলো শান আরাফের সাথে মেতে আছে। রাফিয়া পেছন থেকে শানের চুল টেনে ধরে বললো,
–“এই তুই এখানে কি করছিস? তোকে কে বলেছে যেতে?”

শান রাফিয়ার দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকিয়ে নিজের চুল ঠিক করতে করতে বললো,
–“তুই না বললে কি হবে? দিহান ভাই ঠিকই যেতে বলেছে আমায়।”

রাফিয়ার রাগ হলো দিহানের উপর। শান আয়াতের দিকে তাকালো। কালো চুড়িদারে ভীষণ ভালো লাগছে মেয়েটাকে। শান হাসিমুখে আয়াতের সামনে গিয়ে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
–“ফ্রেন্ডস?”

আয়াত শানের সাথে হাত মিলিয়ে হাসিমুখেই বললো,
–“ওকে ফ্রেন্ডস।”

শান একগাল হেসে বললো,
–“তোমাকে ভীষণ সুন্দর লাগছে, আয়াত অর আয়ু?”

আয়াত মুচকি হেসে বললো,
–“এজ ইউর উইশ। বাই দ্যা ওয়ে আপনাকেও সুন্দর লাগছে।”

–“আচ্ছা তাহলে আয়ু বলছি। আমি তোমার থেকে অতটাও বড় না যে আমায় আপনি বলে সম্বোধন করতে হবে। রাফুর মতো তুই/তুমি বলতে পারো।”

আয়াত একগাল হেসে বললো,
–“আচ্ছা তুমি।”

শান দুষ্টু হেসে বললো,
–“তোমায় সুন্দর লাগছে বলেছি বলে আবার আকাশে উড়ো না। অতটাও সুন্দর লাগছে না। কালো পেত্নীর মতো লাগছে।”

আয়াত চোখ রাঙিয়ে তাকালো শানের দিকে। তারপর আচমকাই ওর চুল ধরে টেনে দিলো। শান নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললো,
–“আরেহ আস্তে, আমি তো মজা করছিলাম এত সিরিয়াস হচ্ছো কেন?”

আয়াত ভেংচি কেটে অন্যদিকে তাকালো। শান উঠে আয়াতের পাশে দাঁড়িয়ে বললো,
–“তোমাকে এই এক ঝলক দেখে তো মনে হলো রাফুর মতোই বড্ড চঞ্চল স্বভাবের তুমি। তাহলে এরকম মুখ ভার করে থাকো কেন সবসময়?”

আয়াত নরম চোখে তাকালো শানের দিকে। রাফিয়া শানকে হুট করেই ফারাবীর কথা বলে দিলো। যাতে আয়াত বড্ড বিরক্ত। এই রাফিয়াটা কি কিচ্ছু বোঝে না? বিরক্তিতে অন্যদিকে তাকালো আয়াত। শান বললো,
–“আরে রিল্যাক্স আয়ু, ওসব ভেবে মন খারাপ করো না তো। আবার আগের মতো হয়ে যাও। একটা ছেলের জন্য এভাবে মনমরা হয়ে থেকো না। লাস্ট কয়েকটা বছর ভুলে থাকার চেষ্টা করো। নিজেকে পড়াশোনায় ব্যস্ত রাখো, লাইফে ফ্রেন্ডস কাজিনদের সাথে এঞ্জয় করো দেখবা জীবনটা অনেক কালারফুল। ওসব মন খারাপের কথা ভুলেও মাথায় এনো না।”

শানের কথায় মুচকি হাসলো আয়াত। ছেলেটা যেমন হাসি ঠাট্টায় ওস্তাদ, তেমন ভাবেই অনেক সুন্দর করে মানুষকে বোঝাতে পারে।

চলবে~