একটি নির্জন প্রহর চাই পর্ব-২৯+৩০+৩১

0
374

#একটি_নির্জন_প্রহর_চাই।
২৯
#WriterঃMousumi_Akter
আরিয়ান ভাইয়ের নামটা শুনে খানিকটা চমকে গেলাম আবার অবাকও হলাম।ওনি আরিয়ান ভাইকে চিনেন!আমি যার কথা ভাবছি ওনি কি তার কথাই বললেন!প্রবল অনুভূতিপ্রবণ মুহূর্তটা নিমিষেই কেমন ঘোলাটে হয়ে গেল!মনে পড়ে গেল জীবনের সব থেকে অপমানিত হওয়া সময়ের কথা।যা চাইলেও আমি ভুলতে পারব না কখনো।জীবনে প্রথমবার অত কেঁদেছিলাম,কেউ আমাকে তুচ্ছ করে দেখেছিল,খুব বাজে ভাবে হেয় করেছিল,করেছিল খুব বাজে ভাবে অপমান!ওই মানুষটার নাম আমি মনে করতেও চাই না,নাহ!কিছুতেই না।না চাইতেও চোখ ঝাপসা হয়ে এলো আমার।ওনি আমার নিঃশব্দের কান্না বুঝতে পারলেন কী-না জানি না।রুমের লাইট অন করে খুব নিরীহ চোখে তাকালেন আমার দিকে।ততক্ষণে আমার চোখ দিয়ে নোনাজল টুপটাপ গড়িয়ে গাল বেয়ে ঠোঁটে এসে পৌঁছিয়েছে।ওনার এই নিরীহ চাহনি দেখে আমার বড্ড মায়া হলো।কী-যে হলো জানি না।ঠোঁট ফুলিয়ে কেঁদে দিলাম।আমি কি আমার অতীত ভেবে কাঁদছি;নাকি এই মানুষটার মায়াবী চাহনীতে মায়ায় আবদ্ধ হয়ে কেঁদে দিলাম!ওনি হঠাৎ কেমন বিচলিত হয়ে পড়লেন।ওনার চোখ কেমন আতঙ্কিত হয়ে পড়ল।আমার দুই বাহুতে হাত রেখে বললেন, ‘এই সারাহ তুমি কাঁদছো কেন?হোয়াট হ্যাপেন্ড?কী হয়েছে?কষ্ট হচ্ছে?কোথায় কষ্ট হচ্ছে বলো আমাকে?’
ওনার এই বিচলিত অবস্থা দেখে আমার কান্না যেন প্রবল বেগে ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো।আমি আরও জোরে কেঁদে দিলাম।ওনি হঠাৎ কেমন থমকে গেলেন।অপরাধী কন্ঠে বললেন, ‘সরি সারাহ!আই এ্যাম রিয়েলি সরি।কিছুক্ষণ আগের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জন্য সরি।প্লিজ কেঁদো না।আমি বুঝতে পারিনি।আমি তোমার সাথে থেকে কেমন ছেলেমানুষ হয়ে গিয়েছি।আমাকে খারাপ ভেবো না।আমি অন্যপুরুষের মতো নই।’
এই মানুষটা কেন এত এক্সপ্লেইন দিচ্ছে নিজের বিরুদ্ধে!মানুষ কিছু মুহূর্তে কষ্ট পেলে কাছের মানুষের বুকে মাথা গুজে শান্তি খোঁজার জন্যও কাঁদে।কেঁদে নিজের সব কষ্ট উড়িয়ে দেয়।অথচ,ওনি তা বুঝতেই চাচ্ছেন না। এই শ্যামসুন্দর মানুষটাকে ইচ্ছে করছে তীব্র আবেগে শক্তকরে জড়িয়ে ধরে বলি, ‘ভালবাসি তোমাকে!ভীষণ ভালবাসি!’কিন্তু চাইলেই কি সব বলা যায়!এই ‘আপনি’ সম্মোধন করা মানুষটা কি কখনো আপনি থেকে তুমি-তে নেমে আসবে!জানিনা আসবে কী-না?চাইলেও কিছু বলতে পারছিনা।চোখের পানি মুছে টেবিলে গিয়ে পড়তে বসলাম।কেমন বাজে একটা অনুভূতি হচ্ছে।আমার কান্নার ভিন্ন মানে খুঁজে ওনি কষ্ট পাচ্ছেন, কারণ আমি কষ্ট পেয়েছি ওনি এটা ভাবছেন।ওনি রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন।কোথায় গেলেন জানিনা।টেবিলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে গেলাম।সম্পূর্ণ অচেতন হইনি।ইন্দ্রিয় শক্তি জাগ্রত,কেননা ওনি বাইরে থেকে কখন আসবেন সেই আতঙ্ক রয়েছে।রাত সাড়ে এগারোটার দিকে ওনি ঘরে প্রবেশ করলেন।আমার চোখে ঘুম,কিন্তু জাগ্রত; তবুও উঠলাম।উনি দরজা লাগিয়ে দিয়ে গায়ের গেঞ্জি খুলে আলনায় মেলে দিলেন।গুটি গুটি পায়ে আমার কাছে এগিয়ে এসে মাথায় রাত রাখলেন।চুলে কিছুক্ষণ হাত বুলিয়ে কোলে তুলে বিছানায় নিয়ে শুইয়ে দিলেন।রুমের লাইট অফ করে এসে নিজেও শুয়ে পড়লেন।

পরেরদিন সকালে ঘুম ভাঙতেই শুনি চারদিকে পাখির কিচিরমিচির শব্দ।চোখ মেলে তাকিয়ে দেখি ওনি মাত্রই গোসল সেরে টাওয়াল পরে ডিভানে বসে ফোন চাপছেন।ঘড়িতে সাতটা বেজে চল্লিশ মিনিট।আমি চোখ মেলতেই উনি ফোনের স্ক্রিন থেকে চোখ সরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘গুড মর্নিং’
আমি ঘুমন্ত কন্ঠেই মৃদু স্বরে বললাম, ‘গুড মর্নিং।’
‘তরীর সার্টিফিকেট আনতে যাবেনা?’
‘আমার ভালো লাগছে না,আপনি নিয়ে আসুন।আমি রোহানকে আনতে যাব।’
‘ওকে, বাট তুমি রেডি হয়ে নাও,আমি তোমাকে পৌঁছে দিয়ে যাব।আর কাল রাতের জন্য স ‘সরি।’
আমি কিছু না বলে বিছানা ছেড়ে উঠে ওয়াশ রুমে গিয়ে গোসল সেরে নিলাম।বাইরে বেরোতে বেরোতেই পেছন থেকে জামার অর্ধেক ভিজে গিয়েছে।ওনি ফোন ডিভানের উপরে রেখে আমার টাওয়ালটা এনে হঠাৎ করেই আমার চুল মুছতে মুছতে বললেন, ‘চুলে টাওয়াল পেঁচিয়ে বেরোতে হয় জানো না?কীভাবে ভিজে গিয়েছ?’
মনে মনে বললাম, ‘ভাগ্যিস পেঁচিয়ে রাখিনি;তাহলে কি এই মুহুর্তটুকু পেতাম!’
হাতে লোশন মাখতে মাখতে বললাম,

‘আরিয়ান ভাই আপনার পরিচিত?’
‘কোন আরিয়ান?’
‘যার কথা গতকাল বললেন’
‘অবশ্যই পরিচিত।পরিচিত না হলে কীভাবে বললাম?’
‘আপনি জানেন ওনি আমার কাজিন?’
‘নাতো।’
‘আপনি চিনেন কীভাবে?’
‘আমার কলেজ ফাংশনে একটা নাটকের অংশ দেখেছিলাম।সেখানে আরিয়ান নামের একজন অভিনেতা ছিল।’
‘ওহ আচ্ছা’।
‘তোমার কাজিনের নাম আরিয়ান?’
‘হু।”
‘পরিচয় করিয়ে দিও’
‘ওনি দেশে থাকেন না।
‘এর-ই মাঝে দাদু আমাকে ডাকলেন।ওড়না ভালোভাবে ঠিক করে নিয়ে দাদুর রুমের দিকে গেলাম।দাদু আমাকে দেখেই ডাকলেন,

‘সারাহ!’
‘জি দাদু।’
‘কাছে আয়তো।’
দাদুর বিছানায় বসে বললাম,
‘বলুন দাদু।’
“পান বেটে দেতো।’
‘দিন দাদু।’
পান বাটতে বাটতে বললাম,
“দাদু দাদি কি খুব সুন্দরী ছিলেন?’
‘তার গায়ের রং অতটা সুন্দর না হলেও সুন্দরের মা থা খে ত।একদম রোশানের মত ছিল।’
‘ওনি কি ওনার দাদির মতো দেখতে?’
‘হ্যাঁ,একদম।তরীর সাথে কথা হচ্ছে তোর?’
‘হচ্ছে তো।আজ রোহানকে আনতে যাব।রোহান বাড়িতে আসবে।”
‘নিয়ে আয়।ওরে একটু পরাণ ভরে দেখব।আবার দিয়ে আসিস। ‘
‘ঠিক আছে দাদু।’
এর-ই মাঝে শাশুড়ি এসে বললেন,
‘তরী একটু ভাত রান্না করবে?আমার কোমরে ব্যাথা।’
আবাক হয়ে বললাম,
‘তরী কই?’
‘সারাহ বলতে গিয়ে তরী হয়ে গিয়েছে।আজ একটু রান্না করবে?’
‘সো সরি আম্মা।আমি এ বাড়িতে তরীর মতো রান্না করতে আসিনি। তাই আমাকে ভুলেও এসব বলবেন না।’
‘তুমি তাহলে কী করতে এসেছ?”
‘আপনার ছেলের মা- থা চি বি য়ে খে তে এসেছি।’
‘তাই তো খাচ্ছো।আমার ছেলে বদলে গিয়েছে।’
‘মাত্র তো ট্রেইলার দেখলেন,বাকি মুভি শেষ হতে দিন।’
শাশুড়ি দাদুর দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে বললেন,
‘বাবা ওরা নাকি ফার্নিচার দিবে বলেছিলেন।কই সেসব?আবার নাকি নগদ টাকাও দিবে?’
‘কেন আমার বাবা দিবে কেন?আমার বাবা কিচ্ছু দিতে পারবে কান খুলে শুনে রাখুন।’
‘আমার অত সুন্দর ছেলের সাথে কি এমনি এমনি আনলাম তোমাকে?অনেক ডাক্তার,ইঞ্জিনিয়ার মেয়েও সেধেছিল;কিন্তু আমি আনিনি।তোমার ফ্যামিলি এই দেবে সেই দেবে বলে আমার মাথা খেল।’
‘এত মেয়ে সেধেছিল খুব-ই গর্বের কথা এটা।আপনার ছেলেকে গোরুর মতো গোরুর হাটে উঠালেন না কেন?তাহলে আরও খদ্দের পেতেন।’
‘মুখ সামলে কথা বলো।অনেক সহ্য করেছি।তোমাকে এনেই আমার সংসার এলোমেলো হয়ে গিয়েছে।তোমার বাবাকে বলে দিও যা যা দেওয়ার কথা দিয়ে যেতে।’
‘কেন? আপনার ছেলেকে কি বিক্রি করেছেন নাকি?আমার বাবা সব দিয়ে যাবে তাহলে আপনিও আপনার ছেলেকে আমার বাবার বাড়িতে পাঠিয়ে দিন কাজ করার জন্য।’
‘বাবা দেখছেন এই মেয়ের মুখ কী!’
দাদু হেসে বললেন, ‘ অনেক দিন পর একটু শান্তি পেলাম!’
আমি আবারও তেজী কন্ঠে বললাম,
‘সুন্দরী,শিক্ষিতা,স্মার্ট, বড়োলোক ঘরের বউ লাগবে আপনাদের?সব কিছুর চাহিদা একসাথে মেটাতে চান তাইনা?’সব চাহিদা মিটিয়ে দেব;দেখে নিবেন।’
এর-ই মাঝে ওশান এসে দাঁড়াল দরজায়।শাশুড়িকে বললাম, ‘ওই যে আপনার ছেলে হাজির। বলুন বিয়ে করে নিয়ে আসতে।বউ পেয়ে যাবেন।’
বলেই রুম থেকে বেরিয়ে এলাম।
_______________________________

কেটে গেল বেশ কয়েকদিন।এর-ই মাঝে তরীকে মৃন্ময়ের বোনের সাথে ছোটো একটা বাসায় উঠিয়ে এলাম।হাতের কাজের একটা ট্রেনিং সেন্টারে ভর্তি করিয়ে দিলাম।রেগুলার ট্রেনিং সেন্টারে যাচ্ছে আসছে,সব কিছু ভালোই চলছে।সেদিন রোহানকে বাড়িতে নিয়ে এসেছিলাম।সারাদিন ঠিক থাকলেও রাতে তরীর জন্য ভীষণ কান্নাকাটি শুরু করে।সেই মধ্যরাতে দিয়ে আসতে হয়।
__________________________
আমাদের পরীক্ষার সময় ঘনিয়ে এসেছে।কলেজে এডমিট কার্ড আনতে গিয়েছি।মৃন্ময়, তন্ময়, দ্বীপ, ছোঁয়া সবার সাথেই দেখা হলো।ওদের দেখেই তেলে-বেগুনে জ্বলে এগিয়ে গেলাম।এর মাঝে কয়েকবার জু* তা মা’ র ‘ ব বলে দেখা করতে বলেছি; কিন্তু করেনি।ওরা জানত আমি ওদের আচ্ছা গা* লি দেব,তাই সামনে আসেনি।আমাকে দেখে মৃন্ময় দ্বীপের পেছনে গিয়ে লুকাল।তন্ময় বলল, ‘সারাহ জু* তা কই?’
আমি রাগী চোখে ওদের দিকে তাকিয়ে বললাম,
‘ওসব যে দিয়েছিস আমার জামাই কেডা জানিস?’
‘কেডা?’
‘যেদিন দেখবি বুঝবি!’

চলবে?

#একটি_নির্জন_প্রহর_চাই
৩০+৩১
#WriterঃMousumi_Akter.
‘আমার কিউরিয়াস মাইন্ড জানতে চাচ্ছে, ‘কোন আবালে তোর জামাই হইছে?তারে দেখে কী বুঝব বল?ফিলিং ব্যাং ইমুজি!’ মৃন্ময় দ্বীপের পেছনে দাঁড়িয়ে কথাটা বলল।
‘কী বললি আমার জামাই আবাল?ওহ মাই গড!’
কথাটা মুখ থেকে বের করতে করতেই দেখি রোশান স্যার ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছেন। উনি মাত্রই পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন ডিপার্টমেন্ট- এর দিকে।আমাদের কথোপকথন শুনে থমকে গেলেন।এক হাত দিয়ে চশমা ঠিক করছেন আর ছোটো ছোটো চোখ করে তাকাচ্ছেন।ওনার দিকে মৃন্ময় আর আমার দৃষ্টি যেতেই আমরা দুজনেই চোখ মুখে আদব-কায়দার ভাব এনে মাথা নিচু করে দাঁড়ালাম।
দ্বীপের দৃষ্টি স্যারের দিকে পড়েনি।তাই বলল,
‘নিশ্চয়ই ভুড়িওয়ালা,ছাদে মাল নেই কোনো ৬০ বছরে বুইড়া। ‘
মনে মনে বলছি থাম ভাই থাম তোরা।আর কত বাঁশ দিবি!এমনি মৃন্ময় আবাল বলেছে তা শুনে ফেলেছে এখন আবার তুই বলছিস ভুড়িওয়ালা টাক।আর ওনাকেই এখন এখান থেকেই যেতে হচ্ছিল,কী আশ্চর্যজনক ঘটনা!
এর-ই মাঝে তন্ময় আদবের সাথে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আসসালামু আলাইকুম স্যার।’
উনি মিহি হেসে উত্তর দিলেন, ‘ওয়ালাইকুমুস সালাম।
কেমন আছো তন্ময়?’
‘জি স্যার আলহামদুলিল্লাহ।’
‘প্রিপারেশন কেমন এবার?’
‘আলহামদুলিল্লাহ স্যার।’
‘শরীর সুস্থ আছে এখন?’
‘আমি তো সুস্থ-ই আছি স্যার।’
‘আমি জানি তুমি অসুস্থ ছিলে,যাক সে কথা; আমরা আশাবাদী তুমি এবারও ডিপার্টমেন্ট ফার্স্ট হওয়ার পাশাপাশি ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির রেকর্ড ভাঙবে।’
‘স্যার আমাকে নিয়ে এত আশা রাখবেন না।’
‘গতবছর তুমি সারা বাংলাদেশের মাঝে ৫ম হয়েছিলে।যদিও প্রচন্ড জ্বর নিয়ে পরীক্ষা দিয়েছিলে।আশা রাখছি এইবার তুমিই প্রথম হবে।’
আল্লাহ’র রহমত থাকলে পারব স্যার।’
এবার উনি আমাদের সবার দিকে চোখ বুলিয়ে কেমন একটা অদ্ভুত চাহনি দিয়ে তন্ময়কে বললেন,
‘তোমার বন্ধুদের দিকেও একটু নজর দাও।তাদের কথবার্তা, লেখাপড়া সব-ই তো দেখছি;দিন দিন অনেক উন্নত হচ্ছে।’
‘জি স্যার দেব।’
‘তুমি ডিপার্টমেন্ট ফার্স্ট,তোমার ফ্রেন্ডরা ডিপার্টমেন্ট লাস্ট খুবই লজ্জাজনক বিষয়। কার জামাই কেমন এসব নিয়ে সারাদিন গবেষণা না করে লেখাপড়ায় মন দিতে বলো। যাওয়ার সময় আমার সাথে দেখা করে যেয়ো তন্ময়।’ বলেই ওনি রওনা দিলেন ডিপার্টমেন্ট-এর দিকে।ওনি তো কোনদিন রাস্তায় দাঁড়িয়ে কোনো স্টুডেন্টের সাথে হেসে এত সময় কথা বলেন না।জীবনে প্রথমবার দেখলাম!যাওয়ার সময় আমার দিকে আড়নজরে তাকিয়ে দৃষ্টি কিছুক্ষণ স্থির রাখলেন।উনি তাকালেই আমার কি হয়ে যায় বুঝিনা।এক অজানা অনুভূতি আর লজ্জার সংমিশ্রণ তৈরি হয়।
মৃন্ময় বলল, ‘সারাহ;তোর জামাই নিয়ে কথা বলেছি ওইটা স্যার শুনে ফেলেছে। স্যারের চোখে কালার হইলাম।এমনি খচ্চর স্যার,আরও নজরে পড়লাম!’
‘দেখ আজেবাজে কথা বলবি না,আমি লাস্ট ওয়ার্নিং দিলাম ওনাকে নিয়ে কিছুই বলবি না,কী হ্যান্ডসাম দেখেছিস!’
‘তুই এখন বিয়াইত্তা এইটা ভুলে যাইস না। নজর দিস না, পা’ প হবে পা’প’
দ্বীপ বলল, ‘আসলেই! স্যার মনে হয় নিজেকে ফিট রাখার ভীষণ চেষ্টা করেন।নইলে এত্ত হ্যান্ডসাম কীভাবে হতে পারে মানুষ!’
ছোঁয়া তন্ময়ের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তুই সারাহকে কী দিয়েছিস তন্ময়?ওদের মতোই কিছু!’
তন্ময় ঘাড় কাত করে একবার তাকাল ছোঁয়ার দিকে;কিন্তু উত্তর দিল না।ইদানিং তন্ময় ছোঁয়ার জন্য আর পা* গ * লা* মি করেনা।সব সময় এড়িয়ে যায়।ছোঁয়া তন্ময়ের সাথে কথা বলার চেষ্টা করেই যাচ্ছে,কিন্তু লাভের লাভ কিছুই হচ্ছেনা।ছোঁয়ার যে মানসিক অবস্থা তাতে এই মুহূর্তে একজন ভালবাসার মানুষ ভীষণ দরকার।আর সেই মানুষটা তন্ময় হলেই বেটার হয়। তন্ময়ের পিছনে দ্বীপ আর মৃন্ময়ও এগিয়ে গেল ।ছোঁয়ার মুখটা মুহুর্তের মাঝে কেমন মলিন হয়ে গেলো।ছোঁয়ার কাঁধে হাত রেখে বললাম,
‘ওশানের জন্য কষ্ট হয় তোর?’
‘ছিঃ!সারাহ। এটা ভাবিস কীভাবে?কেন কষ্ট হবে?কষ্ট তো হয় ভালবাসার মানুষ ছেড়ে গেলে।কিন্তু মিথ্যুক,চরিত্রহীন এদের জন্য কখনো কষ্ট হয় না;ঘৃণা ছাড়া!আমার যেটুকু আছে ওর জন্য সেটুকু ঘৃণা!’
‘তাহলে কী তন্ময়-এর ইগনোর তোকে কষ্ট দেয়?প্লিজ লুকাবিনা।’
‘ হ্যাঁ সারাহ!কষ্ট হচ্ছে,ভীষণ কষ্ট।ওর ভীষণ ভালবাসা আমি পায়ে ঠেলে দিয়েছিলাম।ওশানের থেকে প্রতারিত হয়ে আমি বুঝেছি তন্ময়ের গুরুত্ব। আমার মাথায় সারাক্ষণ তন্ময়ের ভালবাসা ছিল,ওর পা- গ – লা- মি সারাক্ষণ মাথায় ঘুরত।সেটা আজ মাথা থেকে নেমে মনে প্রবেশ করেছে।’
‘তন্ময়কে বল সেটা।কেনাও চেপে রেখেছিস।’
‘আমি পারবনা সারাহ।’
‘কেন?’
‘কীভাবে বলব?যখন-ই অন্য কারো কাছ থেকে প্রতারিত হলাম তখন-ই আমি তন্ময়কে চাইব?আমার বিবেক আমাকে বাঁধা দিচ্ছে।আমি কখনো মুখ উঁচু করে কথা বলতে পারব না তাহলে।’
‘তন্ময় কী বলে?’
‘আমি ডাকলেই ও আমার কাছে আসবে,না হলে আসবেনা।আর আমি ওকে ডাকছি না বলেই ও আমাকে সম্পূর্ণরূপে ইগনোর করে যাচ্ছে।’
‘দেখ তন্ময় তোকে কত ভালবাসে।বলছি যে জীবন থেকে যে দিনটা যাচ্ছে ওটাই ফুরিয়ে যাচ্ছে।তন্ময় কী ভাববে না ভাববে এসব ভাবতে ভাবতে আরও দেরি হয়ে যাচ্ছে।অনেক কিছু হারিয়েছিস,অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে আর নয়।তন্ময়কে ডাক তোর কাছে।’
‘আমি কী আসলেই ভুল করছি?’
‘হুম চরম ভুল,চল এবার।’

ডিপার্টমেন্টের দো’তলায় উঠতে উঠতে বললাম,
‘লিফট দেওয়া উচিত, আমার পা ব্যাথা হয়ে যায়।’
‘তোর জামাই-রে বলিস দিয়ে দিবে।’
‘হ বলব’
‘আচ্ছা তন্ময় তোকে কী গিফট দিয়েছিল?’
‘ফটোফ্রেম।কাপল পিক রাখার জন্য।’
‘তন্ময় সব সময় ইউনিক তাইনা?কী সুন্দর ভাবনা ভেবে একটা ফটোফ্রেম দিয়েছে তোকে!’
‘তাহলে ওর ভালবাসার ধরণও অনেক ইউনিক হবে ছোঁয়া।ইশ!কী লাকি তুই!’
ছোঁয়ার চোখ মুখ যেন কেমন লজ্জামিশ্রিত হলো।আমি খেয়াল করলাম ছোঁয়ার ঠোঁটে তন্ময়ের জন্য হাসি।যে হাসিতে ভালবাসা লেগে আছে।

এডমিট নিতে গেছি অনেক ভীড়।লাইনে ভীড় ঠেলে এডমিট নিতে হচ্ছে।ছোঁয়া ভীড় ঠেলে এগোতেই পারছেনা।তন্ময়ের হাইট অনেক বেশি।৫ ফিট ১০” হবে।সৃষ্টিকর্তা যেন তন্ময়কে সব দিক থেকে সুন্দর করে সৃষ্টি করেছেন।শুধু টাকা পয়সা দেননি।বাকি সবই দিয়েছেন।তন্ময় সবার মাথার উপর দিয়ে ছোঁয়ার দিকে তাকিয়ে ছোঁয়ার রোল বলে বলল, ‘এইটা না তোর?’
ছোঁয়া মাথা নাড়িয়ে বুঝাল-হ্যাঁ।
তন্ময় ছোঁয়ার রোল বলে ওর এডমিট কার্ড নিয়ে সবার উপর দিয়ে ছোঁয়ার হাতে দিল আর বলল ক্লান্ত দেখাচ্ছে তোকে।যা বাসায় চলে যা।’
আগে তন্ময় বলতো ছোঁয়া যাবিনা কিন্তু।আজ আমরা সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘুরব।তুই গেলে কিন্তু তোর বাসায় চলে যাবো। আর আজ বাড়িতে চলে যেতে বলছে ;এটাই ছোঁযাকে দারুণ ভাবে আহত করল।এরই মাঝে আমার কাছে আমার রোল জিজ্ঞেস করল তন্ময় আর মৃন্ময়। বললাম, ‘আমি আসছি। ‘
ভীড় ঠেলে সামনে গিয়ে রোল বললাম ক্লার্ক মাহফুজ আঙ্কেল-কে।আমাকে দেখে রোশান স্যার উঠে এগিয়ে এলেন আর বাকি স্টুডেন্টদের দিকে তাকিয়ে ধমকের সুরে বললেন, ‘সবাই পিছিয়ে যাও।এত ভীড় কেন?তোমরা কী বাচ্চা আছো এখনো?অদ্ভুত! যাও পিছিয়ে যাও।’
এমনি ওনাকে দেখে সবাই ভ* য় পায়!ওনাকে দেখলেই সবাই মাথা নিচু করে থাকে।ওনার ধমকে নিমিষেই জায়গা ফাঁকা হয়ে গেল।যেন ভ্যাপসা গরম খানিক টা দমে ফুরফুরে বাতাস এসে ঘাড়ে লাগল।মাহফুজ আঙ্কেলকে বললাম, ‘আঙ্কেল আমার টা দিন।’
মাহফুজ আঙ্কেল হেসে বললেন, ‘এখন আর তোমাকে রেগুলার দেখিনা কেনো সারাহ?’
‘আঙ্কেল বাসা এখন একটু দূরে হয়ে গিয়েছে তাই রেগুলার একা আসতে পারি না।’
রোশান স্যার আমার দিকে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে তাকিয়ে বললেন, ‘তুমি না ম্যারেড?’
ওনি-যে আমার সাথে এখানে কথা বলবেন আমি ভাবতেও পারিনি!ওনাকে দেখে মনে হচ্ছে যেন কয়েকজনম পর আমাকে দেখলেন।এত স্বাভাবিক ভাবে আছেন কীভাবে ওনি!এইদিকে আমার ওনাকে দেখেই হাসি পাচ্ছে।দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে ধরে রেখেছি হাসি আটকাতে।পায়ের আঙুল কচলাচ্ছি স্বাভাবিক থাকতে।
মাহফুজ আঙ্কেল বললেন, ‘তাই নাকি কবে? কখন?’
রোশান স্যার আবার বললেন, ‘ম্যারেড না তুমি?’
‘জি স্যার।’
‘তাহলে দূরে প্রব্লেম কি?জামাই সাথে নিয়ে আসবা।অসুবিধা কী?জামাই আসেনা সাথে?’
‘না। ‘
‘বলেছো কখনো?আমাকে নিয়ে চলুন।’
আমি ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইলাম উনার দিকে।কী সাংঘাতিক মানুষ ভাবা যায়!আমার সাথে মজা নেওয়া ওয়েট দেখেন, আমি কী করি!
ওনি আবার বললেন,
‘হাজব্যান্ডকে নিয়ে আসবা,আমাদের সাথে পরিচয় করাও,বন্ধুদের সাথে পরিচয় করাও।’
খুব দুঃখী দুঃখী মুখে বললাম,
‘না স্যার, ওনাকে নিয়ে আসা যায় না। ‘
‘কেন?’
‘অনেক কিপ্টা আমার জামাই।সে যেখানে যায় হেঁটে যায়।ভাড়ার টাকা বাঁচাতে পায়ে হেঁটে চলাচল করে।আমাকে একদিন কলেজ পর্যন্ত হাঁটিয়ে নিয়ে এসেছে।তাই তার সাথে কোথায় যাই না।বুঝেছেন রোশান স্যার?’
মাহফুজ আঙ্কেল হেসে বললেন, ‘এমন কিপ্টা মানুষও আছে দুনিয়ায়?’
আমার এবার প্রচুর হাসি পাচ্ছে।দুই ঠোঁট চেপে হাসি আটকে রেখেছি।রোশান স্যার কী সাংঘাতিক ভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন।এই সাংঘাতিক চাহনির মাঝেও মুগ্ধ হলাম।প্যান্টের পকেটে হাত গুজে দ্রুত পায়ে হাঁটা দিলেন।আর আমি ফিক করে হেসে দিলাম।মনে মনে বললাম এমন বউ পাইছেন দিনে দুই চারটা ঘটনা ইতিহাস হয়ে যায়।
____________________________
কলেজ ক্যাম্পাসে বসে বাদাম খাচ্ছি আমরা পাঁচ বন্ধু।জামাই আছে বলে ইদানিং সব বিল আমার-ই দেওয়া লাগে।বাদাম খেতে খেতে আড্ডায় মশগুল আমরা, হাসি আর ঠাট্টায় মুখরিত যেন চারিপাশ।এর-ই মাঝে দ্বীপ খুব জোর দিয়ে ধরেছে আমার জামাই দেখবে।সেই সাথে যোগ দিল মৃন্ময়,তন্ময় আর ছোঁয়া।আমি উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, ‘আমার বার্থডে-তে দেখাব।এর আগে দেখাব না।’
‘সেতো এখনো সাত মাস বাকি।’ মৃন্ময় টেনে বলল কথাটা।
আমি ড্যামকেয়ার ভাব নিয়ে বললাম, ‘তো কিচ্ছে?দারুণ কিছু দেখতে হলে অপেক্ষা তো করতেই হবে।’
মৃন্ময় বলল, ‘আল্লাহ জানে কী দারুণ দেখাবি তুই।’ এ নিয়ে কিছুক্ষণ প্যাচাল হল। আবারও আড্ডায় মেতে উঠলাম আমরা।আমাদের মাঝে ছোঁয়াকে কেমন মনমরা লাগছে দেখতে।আমি বুঝতে পারছি তন্ময়কে কিছু বলতে চাইছে;কিন্তু পারছেনা। এই জন্য আরও বেশি খারাপ লাগছে ওর।আমি মৃন্ময় আর দ্বীপকে চোখের ইশারায় উঠিয়ে পাশে নিয়ে গিয়ে বসলাম।ওরাও বুঝতে পারল ব্যাপারটা।দ্বীপ এই বয়সেই সিগারেট খায়। খুব একটা নেশা তা নয়;তবে প্রায়শই ও সিগারেট খায়।সাথে মৃন্ময়ও মাঝেমধ্যে সঙ্গ দেয়।তবে তন্ময় খায় না।দ্বীপ বলল, মৃন্ময় চল পানি খেয়ে আসি।’
আমি পানির বোতল এগিয়ে দিয়ে বললাম, ‘নে খা।’
‘আমি এ পানি খাব না।’
‘তাহলে কোন পানি?’
মৃন্ময় বলল, ‘এ পানি সে পানি নয়।ও মনে হয় পেট খালি করতে যাবে।’
‘পেট খালি মানে?’
‘মানে পানি ত্যাগ করতে যাবে সাথে ধোঁয়া উড়াতে।’
‘শ* য় * তা* নে র দল দূর হ।’
‘হ দ্রুত নিয়ে যাই।নাহলে আবার সমস্যা করতে পারে।সেদিন বিছানাতেই পানি ত্যাগ করেছে।স্বপ্ন দেখেছে বাইরে করছে সেটা বিছানাতেই সেরেছে।’
দ্বীপ মৃন্ময় কে লা* * থি মে* রে বলল,’শালা ‘ফাউল কোথাকার!’
ওরা দু’জনে চলে গেল।

তাকিয়ে আছি আমার থেকে কিঞ্চিৎ দূরে বসে থাকা দুজনে কপোত-কপোতির দিকে।ছোঁয়া উঠে এসে তন্ময়ের পাশে বসল।কিছু বলবে ঠোঁট কাঁপছে কিন্তু বলতে পারছে না।অনেক্ষণ সে তাকিয়ে আছে।তন্ময় অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে ছোঁয়ার দিকে।তন্ময়ের চোখ জুড়ে মুগ্ধতা,স্নিগ্ধতা।মন ভরে দেখছে ছোঁয়াকে। এ যেন দীর্ঘদিনের পিপাসিত চক্ষু তার তৃষ্ণা নিবারণ করছে!জীবনে প্রথমবার তন্ময়ের অনুভূতিতে সায় দিয়ে ছোঁয়া তার পাশে বসেছে।তন্ময়ের এক জীবনের দূর্বলতা ছোঁয়া,এক জীবনের সাধনা,এক জীবনের ভালবাসা।মানুষ বলে না,সুদর্শন ছেলেরা কখনো এক নারীতে আসক্ত হয় না।তন্ময়কে দেখলে সে ধারণা ভুল প্রমাণিত হবে।ছোঁয়ার গালে তন্ময় হাত রেখে বলল,
‘কিছু বলবি?’
ছোঁয়ার কম্পিত ঠোঁট আরও কেঁপে উঠল।মাথা নাড়িয়ে বুঝাল, হুম বলব।
‘তাহলে বল।দেরি করছিস কেন?আর কত দেরি করবি?’
‘আমি বললেও কি তুই বিলিভ করবি তন্ময়?
‘একবার বলেই দেখ।’
‘আমি পারছিনা তন্ময়।আর পারছিনা।’
‘কি ভেবেছিস তোকে ইগনোর করছি।এইযে ওশানের কারণে কষ্ট পেলি আমি তোর সেই কষ্টটা অনুভব করিনি।তুই যে প্রতিনিয়ত কষ্ট পাচ্ছিস আমি খেয়াল করছিনা! বরং আগের থেকে একটু বেশী খেয়াল রাখি তোর।সারাক্ষণ তোর মলিন মুখ আমাকে যন্ত্রণা দেয়।আমি পুড়ছি ছোঁয়া,প্রতিনিয়ত জ্বলছি তোর কষ্ট দেখে।মৃন্ময়ের যে এক্সট্রা আইডি নিউ খুলেছে ওটা আমার ই আইডি।সারারাত তোকে একা কষ্ট পেতে দেইনি আমি।আমি জানি তোর ঘুম হয়না রাতে।তাই সারারাত তোর সাথে জেগে চ্যাটিং করি।’
‘আমাকে একটা লাস্ট চান্স দিবি তন্ময় তোকে ভালবাসার?একটা চান্স!আমি তোকে ভালবাসি বলার সাহস পাচ্ছিনা।কারণ আমি সময় থাকতে তোকে গুরুত্ব দিইনি।যখন ভীষণ ধাক্কা খেয়েছি,জীবনে তখনি উপলব্ধি করেছি তুই-ই ঠিক আমার জন্য।কিছুদিন একাকি থেকে উপলব্ধি করেছি তুই আমার কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ। তোকে নিয়ে তো আলাদা করে কখনো ভাবিনি তবুও তোর ইগনোর কেন আমাকে কষ্ট দিল?কেন মনে হলো তুই ছাড়া কিছু নেই আমার?আমার পুরো পৃথিবী শূন্য।সারাক্ষণ আমার সাথে সাথে থেকেছিস তাই আমি অনুভব করতে পারিনি তোর অভাব।তুই যদি বহু আগে আমাকে ইগনোর করতি আমি বোধহয় বহু আগেই বুঝে যেতাম আমি তোকে ভালবাসি।তন্ময় আমি শে’ষ হয়ে গিয়েছি!আমি ঠকেছি,ভীষণ আঘাত পেয়েছি!আমি এত বোকা!কে ভালবাসার মানুষ,কে অভিনেতা এটাই বুঝতে পারিনি!

ছোঁয়া অঝরে কাঁদছে,কেঁদেই যাচ্ছে।দীর্ঘ দিনের গ্লানি বোধহয় এবার-ই বেরিয়ে যাবে।

‘আমি তোকে প্রেম করার কোনো সুযোগ দিব না ছোঁয়া।সরি।’
‘তাহলে?’
‘বউ হবি আমার?’
ছোঁয়া হেসে দিল।কান্নাভেজা মুখে হাসির প্রলেপটা দারুণ লাগছে!
‘আপাতত গরিব আছি,পারবি একটা টিনের ঘরের নিচে আমার সাথে থাকতে?’
‘পারব।’
‘পরীক্ষা যেদিন শেষ ওইদিন-ই আমরা বিয়ে করব,মনে থাকে যেন।বাড়িতে গিয়ে জানিয়ে দিবি।তোকে একবার পেয়েছি আর হারানোর রিস্ক নিতে চাচ্ছিনা।’
তন্ময় ছোঁয়ার হাতের উপর হাত রাখল।দুজনের-ই মুখে হাসি।এখন শুধু পরীক্ষা শেষ হওয়ার অপেক্ষা!

______________________________
বাড়িতে ফিরে ফ্রেশ হয়ে পড়তে বসলাম।সন্ধ্যাগড়িয়ে রাত হল।তন্ময়ের দেওয়া ফটোফ্রেমটা ড্রেসিং টেবিলের উপর রাখলাম।খুব ইচ্ছা করছে আমাদের দুজনের একটা ফটো রাখতে!খাটের উপর মাথার দিকে সোজা ওয়ালে একটা ফ্রেমে অনেকগুলো মুখ ক্যামেরায় বন্দি।রোশান স্যার আর তার বন্ধুরা।এটা সাজেক ভ্রমনের পিকচার।সবার মাঝে আমার চোখ আটকাল ওনার দিকে।সন্ধ্যা থেকে একটানা বই পড়ে মাথা ধরেছে।এ বাড়িতে এখন কেমন দমবন্ধ লাগে আমার।আমার গল্প করা বা কথা বলার মতও কেউ নেই।একমাত্র ওনি এলেই মনে হয় চারিদিক মুখরিত।ফোন হাতে নিয়ে ওনার নাম্বার টা ডায়াল করেও কেটে দিলাম।কী বলব ফোন করে!আমার বলতে ইচ্ছা করছে আমার একা ভালো লাগছে না আপনি আসুন।কিন্তু লজ্জায় সেটা পারছিনা।
ফোনটা বিছানায় ফেলে দিলাম।সাথে সাথেই ফোনটা বেজে উঠল তড়িৎ গতিতে।ফোনের দিকে তাকালাম।তাকিয়ে দেখি ওনার নাম্বার টা ভাসছে।দ্রুতই ফোনটা রিসিভ করে কানে দিলাম।ফোনের ওপাশ থেকে মোহনীয় কন্ঠস্বরে ওনি বললেন, ‘বলো।’
‘কী বলব?’
‘মিস কল দিলে।’
‘মিস কল! কখন?’
‘মাত্র-ই তো এসেছে।’
‘মনে হয় হাতের চাপ লেগে গিয়েছে।’
ফোন তো সাথে সাথেই কাটলাম,মিস কল হলো কীভাবে বুঝলাম না!
‘ভাবলাম ইচ্ছা করেই দিয়েছ।’
‘না,মানে।’
‘থাক আর কিছু বলতে হবে না।পড়া শেষ?’
‘হুম শেষ।’
‘সত্যি তো?নাকি তোমার বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছিলে মেসেঞ্জারে?’
‘নাহ! সত্যি পড়েছি।’
‘আমাকে কিপ্টা মনে হয়?’
‘হ্যাঁ মনে হয়।’
‘কোন দিক দিয়ে?’
‘অনেক দিক দিয়ে।বিয়ে করেছেন কখনো কিছু গিফট করেছেন?’
‘গিফট করতে হয় বিয়ে করলে?’
‘অবশ্যই।’
‘ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারে চাবি আছে।চাবি নিয়ে আলমারি খোলো।’
‘কেন?’
‘কেন’র উত্তর ওখানেই আছে।’
ড্রেসিন টেবিলের ড্রয়ার থেকে চাবি নিয়ে আলমারি খুললাম।ওনি লাইনেই আছেন।
‘খুলেছ?’
‘হ্যাঁ।’
‘কতগুলা প্যাকেট আছে দ্যাখো।’
‘এ তো আপনি প্রায়-ই বাসায় ফেরার সময় নিয়ে আসেন।’
‘আনি, কখনো তো খুলে দেখনি।’
‘আপনার দরকারি জিনিসে কি আমার হাত দেওয়া উচিত হবে?’
‘ওখান থেকে একটা শাড়ি পরে রেডি হও আমরা বাইরে ঘুরতে বের হব।’
‘এত রাতে?’
‘ঘোরার জন্য রাত-ই উত্তম।যদি তোমার সমস্যা থাকে তাহলে থাক।’
‘না কীসের সমস্যা?কী বলছেন?’

আলমারিতে পাঁচটা প্যাকেট।প্যাকেট পাঁচটা বের করে দেখি পাঁচটা শাড়ি।প্রতিটা প্যাকেটেই শাড়ির সাথে ম্যাচিং গহনা আর পাথরের চুড়ি।আমি দেখেছি মাঝে মধ্য ওনি প্যাকেট নিয়ে ঘরে ঢোকেন।দু’দিন ওয়্যারড্রোব-এর উপর রেখে তারপর আলমারিতে উঠিয়ে রেখেছেন;অথচ আমাকে বলেননি তোমার জন্য।কিন্তু প্যাকেটের গায়ে ঠিকই লেখা আছে তোমার জন্য।পাঁচটা শাড়ির মাঝে সাদা শাড়িটার দিকে নজর গেল।জরজেট শাড়িটা ভালভাবে পরে নিয়ে দু’হাত ভর্তি স্টোনের সাদা চুড়ি পরলাম।চুড়ি গুলো ভারী তবে দেখতে খুব সুন্দর। মুঠোভর্তি চুড়ি,কাজল,লিপিস্টিক,কপালে ছোট্ট টিপ, খোলা চুলে আমাকে যেন অন্যরকম লাগছে!আয়নায় বারবার নিজেকে দেখছি।বিভিন্ন এঙ্গেলে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখছি।শুধু একটাই কথা উঁকি দিচ্ছে মনে,ওনি কি মুগ্ধ হবেন!রেডি হওয়ার পর ছোট হ্যান্ড পার্স টা নিয়ে উনাকে ফোন দিলাম।
ফোন ধরতেই বললাম, ‘কোথায় আপনি?’
‘রিক্সা নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি,চলে এসো।এক-মিনিট এটুকু আসতে পারবে তো?’
‘পারব বাট বাইক নিবেন না?’
‘বাইক নিয়ে ঘুরে রাতের সৌন্দর্য উপভোগ করা গেলেও; তারটা যাবেনা।’
‘কারটা?’
‘প্রশ্ন না করে এসো।’
তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে গেলাম।আকাশে গোলবৃত্তাকার চাঁদ। চারদিক সোনালি আলোয় ঝিকিমিকি করছে।দু-মিনিটে রাস্তায় পৌঁছালাম।রাস্তায় একটা রিক্সা অপেক্ষা করছে।আমাকে দেখেই ওনি রিক্সা থেকে উঁকি দিয়ে বললেন, ‘এসো।’
রিক্সায় ওঠার সময় হাত এগিয়ে দিলেন ওনি।ওনার হাতের উপর হাত রাখার অনুভূতিটা ছিল চমৎকার।ওনার চোখে চোখ রেখে হাতে হাত রেখে রিক্সায় উঠলাম।আমার ঠোঁটে লজ্জামিশ্রিত হাসি।রিক্সায় বসতেই উনার শরীরের সাথে সম্পূর্ণ মিশে গেলাম।ওনি রিক্সাওয়ালাকে বললেন, ‘মামা চলেন।’
নির্জন রাস্তা, খোলা রিক্সায় আমরা দু’জন।মাথার উপর চাঁদ,চারদিকে চাঁদের আলো।ঝোপ-ঝাড়ে জোনাক পোকা উড়ছে।ফুরফুরে বাতাস বইছে।খোলা চুল উড়ে ওনার চোখে মুখে পড়ছে।সময়টা যেন স্বপ্নের মতো।
মনের মাঝে এমন-ই ভাললাগাময় শিহরণ বইছে!আনন্দে চিৎকার দিয়ে এই নির্জন প্রহরে বলতে ইচ্ছা করছে ধন্যবাদ পৃথিবী, আমাকে এত সুখী করার জন্য।এত সুন্দর একটা রাত উপহার দেওয়ার জন্য,জীবনের শ্রেষ্ট মুহূর্ত উপহার দেওয়ার জন্য।ধন্যবাদ এই শ্যামসুন্দর মানুষটাকে আমার আজকের সময়টা এত স্পেশাল করে তুলবার জন্য।একমাত্র একটা মেয়েই ভালো অনুভব করতে পারবে প্রিয় মানুষের সাথে এমন একটা মুহূর্ত কাটাবার আনন্দ কত ভয়াবহ। লজ্জায় সরে বসার চেষ্টা করছি।ইশ! কী লজ্জা!ওনার সাথে মিশে গেলেই লজ্জা লাগছে।খানিকটা সরে একদম গুটিসুটি মেরে বসতেই ওনি আমার উন্মুক্ত কোমরে হাত রাখলেন।সাথে সাথে শরীর কেমন যেন ঝাড়া মেরে উঠল।সমগ্র তনু জুড়ে শিহরণ বয়ে গেল।ঠিক যেন কারেন্ট শক-এর মতো।তড়িৎ বেগে ওনার দিকে তাকালাম।কোমরে হাত রেখে এক ঝটকায় টান দিলেন ওনার দিকে।মাথা এসে ঠেকল ওনার বক্ষে।চোখ মুখ থেকে চুল সরিয়ে কানের সাথে ওষ্ঠ মিশিয়ে ফিসফিসিয়ে বললেন,
‘দূরে যাচ্ছো কেন?যতই কাছে টানছি তুমি ততই দূরে যাচ্ছো।কেন বলোতো?’
আমি ভীষণ অবাক হয়ে চোখ তুলে তাকালাম ওনার দিকে।লজ্জায় নেত্রযুগল সংকুচিত হয়ে আসছে।এভাবেই মানুষটা আমাকে ফাঁসাচ্ছেন।কী সাংঘাতিক ভাবে আমাকে ফাঁসিয়ে নিলেন!

চলবে?