#একটি_সাঁঝরঙা_গল্প
#তানিয়া_মাহি
#পর্ব_১০
ফালাক খড়েরি রঙের একটা সুন্দর শাড়ি পরে নিশোর জন্য অপেক্ষা করছে। হাতে ঘড়ি, চোখে কাজল, আর লম্বা একটা বেণী। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখল তাকে সুন্দর লাগছে তবে সেদিন একটু বেশিই সুন্দর লাগছিল আজকের তুলনায়। আগামীকাল ফালাকের জন্মদিন। সে মনে মনে ঠিক করেছে আঠারোতম জন্মদিন সে শাড়ি পরে কাটাবে। রাত বারোটায় আজ সে ছাদে যাবে। ছাদে গিয়ে চাঁদ দেখবে। চাঁদ আজ উঠবে তো?
ফালাক দৌঁড়ে জানালার দিকে এসে বাহিরের আকাশ দেখল। আজ আকাশ পরিষ্কার। জানালা দিয়ে চাঁদ দেখা না গেলেও তারা ঠিকই দেখা যাচ্ছে।
টেবিলের দিকে ফিরে এলো সে। ঘড়িতে ছয়টা আটত্রিশ। এখনো অনেকটাই দেরি। অপেক্ষা করতে তার একটুও ভালো লাগছে না।
ফালাক মায়ের রুমের দিকে হাঁটা ধরলো। জাভেদ সাহেব এই কয়েকদিনে অনেকটা সুস্থ হয়ে গিয়েছেন। হাতের সেলাইও গতকাল খুলে এসেছেন। সেদিন ঘটেছে এক ঘটনা৷ ফালাক নিজেই গিয়েছিল বাবার সাথে হাতের সেলাই খোলার সময়। বাবার পাশেই বসে ছিল সে। যখনই সেলাই খুলতে হাত দিল তখনই সে চোখ খিঁচে বন্ধ করে নিল। বলে উঠল,
“বাবা, আমি বাহিরে অপেক্ষা করছি। আমি এসব দেখতে পারব না। আমার ভয় লাগে। তোমার ব্যথা লাগবে আর সেটা আমি চেয়ে চেয়ে দেখব! পারব নায়া আমি।”
ফালাকের কর্মকান্ডে ডাক্তার সাহেব হেসে ফেললেন। কাজ থামিয়ে তিনি ফালাককে বললেন,“ডাক্তার হওয়ার সম্ভাবনা নেই? সেলাই খোলাই যদি সহ্য করতে না পারেন তবে বড় বড় অপারেশন করবেন কীভাবে?”
ফালাক ডাক্তারের দিকে খেয়াল করল। ডাক্তার সুদর্শন যুবক,বয়স অল্প। বয়স আন্দাজ করে দেখল তার ভাইয়ের বয়সই হবে। বিয়ে করতেও পারে আবার না-ও করতে পারে সুতরাং এখানে বেশিক্ষণ থাকা ঠিক হবে না। বোকামি না করে উঠে দাঁড়ালো। বলল,
“আমি মানবিকের স্টুডেন্ট, স্যার। ডাক্তার হওয়ার সম্ভাবনায়া আমার কোনভাবেই নেই। ডাক্তার পছন্দও না। আপনি সেলাই খুলুন, আমি বাবার জন্য বাহিরে অপেক্ষা করছি।”
জাভেদ সাহেব বলে উঠলেন,“ওপাশ ফিরে বসে থাকো,মা। বাহিরে অনেক মানুষ। ”
ফালাককে ওখানেই চেয়ার ঘুরিয়ে উল্টোদিক ফিরে বসে থাকতে হলো। রোগীকে সাথে নিয়ে এসে তারই ভয় পাওয়ায় ডাক্তার বেশ মজা নিল ভেবে গা জ্ব*লে গেল ফালাকের। এরপর দুইদিন বাসায় কল দিয়ে জাভেদ সাহেবের সাথে কথা বলেছে ডাক্তার। লাস্ট সেদিন তো ফালাকের মায়ের সাথেও কথা বলেছে। বিষয়টা একদমই ভালো লাগেনি ফালাকের৷ ভালো লাগার কথাও না।
মায়ের রুমে ঢুকতেই ফালাক দেখল রাবেয়া বেগম কারো সাথে ফোনে কথা বলছেন। একবার ফালাককে খেয়াল করে মৃদু হাসলেন। হাত দিয়ে ইশারা করে বুঝালেন ফালাককে অসম্ভব সুন্দর লাগছে।
মাকে ফোনে ব্যস্ত দেখে ফালাক রুম থেকে বেরিয়ে নিজের রুমে এসে টেবিলে রাখা বইগুলো থেকে হুমায়ুন আহমেদ স্যারের ‘অপেক্ষা’ বইটা হাতে নিল। বিড়বিড় করে বলল,
“অপেক্ষা হাতে নিয়ে তার অপেক্ষা করি, দেখি কতক্ষণে উনি আসেন। ”
নাহ বসে থাকতে তার ভালো লাগছে না। উপন্যাসের বই পড়তে তো একদমই ভালো লাগে না তার। মনে মনে ভাবলো- নিশো ভাইয়া যে এত ধৈর্য্য কোথায় পায়, কে জানে!
ধীরপায়ে রান্নাঘরে চলে গেল ফালাক। ফ্রিজ থেকে দুধ বের করে চা করতে লেগে গেল সে। আজ অন্তত সে নিজে চা করে খাওয়াবে নিশোকে। অন্যদিন পড়ার চাপে নিজের হাতে চা করে খাওয়ানোর সুযোগ পায় না সে।
চা হতে বেশ কিছু সময় পেরিয়ে গেল। চা বানানো শেষ করে মায়ের রুমে গেল সে। রাবেয়া বেগম এখনো ফোনে ব্যস্ত৷ ফালাক নিশ্চিত হলো তার খালামনি কল দিয়েছে৷ দুই বোনের কথা একঘণ্টায়ও শেষ হবে না। মাকে এক কাপ চা দিয়ে নিজের রুমের দরজায় দাঁড়াতেই দেখল নিশো তার দিকে ফিরেই চেয়ারে বসে আছে। নিশো কখন এসেছে বুঝতেই পারেনি সে।
ফালাককে দেখে বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেল নিশো। ফালাক ধীরপায়ে নিশোর দিকে এগিয়ে এলো। চায়ের কাপ এগিয়ে দিয়ে বলল,
“নিন, চা খান।”
নিশো চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে শুধালো,“আজ পড়বে না?”
“পড়ব না কখন বললাম?”
“শাড়ি পরেছ যে!”
“শাড়ি পরলে কি বই পড়া নিষেধ? ”
“এখানে হুমায়ুন আহমেদের অপেক্ষা বই।”
“তো?”
“স্যারের বইয়ের নায়িকারা তো শাড়ি পরে পড়তে বসতে চায় না। আমি ভাবলাম তুমি বইয়ের ওই ঘটনা পড়ে এখন আর পড়তে চাইবে না।”
“আমি আপনার হুমায়ুন স্যারের বইয়ের নায়িকা না। আপনি কখনো বই লিখলে আপনার বইয়ের নায়িকা হতে রাজি আছি৷ আপনি তার বিপরীতে লিখবেন৷ আপনার বইয়ের নায়িকার শাড়ি পরে বই পড়ার ইচ্ছে আছে।”
“শাড়িতে তোমাকে সুন্দর লাগে।”
“অন্যকিছুতে লাগে না?”
“হ্যাঁ সেটাও লাগে তবে শাড়িতে বেশি।”
“ভাবছি বিয়ের পর প্রথম ছয়মাস প্রতিদিন শাড়ি পরব। বরের চোখ ঝল*সে দেব।”
ফালাকের কথায় হেসে ফেলল নিশো। চায়ে চুমুক দিয়ে টেবিলের দিকে ঘুরে বসে বলল,“পড়তে বসো।”
“আজ কত তারিখ?”
“সাত তারিখ। কেন?”
“এমনি জিজ্ঞেস করলাম। চা কেমন হয়েছে?”
“তোমার হাতের চা সুন্দর। ”
“আমার হাতের সবকিছুই সুন্দর।”
“তুমিও।”
নিঃশ্বাসটা কেমন আটকে গেল ফালাকের। চোখাচোখি হলো দুজনের। নিশো তাকাতেই ফালাক চোখ নামিয়ে নিল।
ফালাক আলতো গলায় বলে উঠল,“আমাকে আপনার কেমন লাগে?”
“আলোর মতো লাগে।”
ফালাক ভ্রু কুঁচকালো। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,“আলোর মতো কেন?”
“এই যে, কাছাকাছি থাকলে তাকানো যায় না অথচ কিছু সময় তোমাকে দেখলে মুখে আপনা-আপনি হাসি ফুঁটে যায়।”
“আপনি অনেক কিছুই বোঝেন তাই না?”
“কী বুঝব?”
“আপনি কালকের তারিখ ভুলে গেছেন। ”
“না তো!”
“ভুলেননি?”
“না। তারিখ কেন ভুলব?”
“না এমনি। শাড়ি পরেছি কেন জানতে চাইলেন না?”
নিশো বইয়ের পৃষ্ঠা উল্টাতে উল্টাতে বলল,“কারণ আছে নাকি?”
“হ্যাঁ, আজ রাতে আমি ছাদে উঠব। অনেকদিন রাতে ছাদে যাওয়া হয় না। আজ শাড়ি পরে চন্দ্রবিলাস করব। এখন তাড়াতাড়ি পড়া শেষ করতে হবে।”
“তাড়াতাড়ি কেন?”
“সাড়ে আটটার মধ্যেই তো চলে যাবেন। আপনার উচিৎ পড়ার সময় পিছিয়ে দেয়া যেন পড়িয়ে খেয়ে একেবারে চলে যেতে পারেন।”
“কাল থেকে তাহলে সাড়ে আটটায় আসি।”
“হ্যাঁ আসুন।”
ফালাক পড়ায় মন দিতে পারছে না। হিসেব অনুযায়ী আজকেই নিশোর উপহার দেওয়ার কথা ছিল। নিশো এখনো উপহারের কথা কিছুই বলেনি। নিশোকে অদ্ভুত লাগছে ফালাকের। জন্মদিন, তারিখ বলে দেওয়ার পরও একটা মানুষ কীভাবে ভুলে যেতে পারে? সেদিন হিসেব করে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি টাকা বইয়ের মাঝে রেখেছিল সে। নিশোর থেকে উপহার পেতে ইচ্ছে করছিল এবার৷ দুই বছর আগের পায়েল রঙ উঠে যাওয়ার পরও যত্নে রেখে দিয়েছে সে। দুই বছর আগে ঈদের কেনাকাটা করতে ফালাক আবিরের সাথে মার্কেটে গিয়েছিল। কেনাকাটার শেষের দিকেই নিশোর সাথে দেখা হয়ে গিয়েছিল। ফালাক তখন নিশোর থেকে পায়েলটা কিনে নিয়েছিল। রঙ উঠে যাওয়ার পরও সেটা যত্ন করে গোপন জায়গায় রেখে দিয়েছে সে।
ঘড়িতে সাড়ে আটটা। ফালাক বই বন্ধ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। লজ্জা লাগছে তার। দেড় ঘণ্টায় লোকটা কোনভাবেই অন্যকোন কথাবার্তা বলেনি। প্রিয় মানুষ দূরে থাকলে নিজেকে মানিয়ে গুছিয়ে রাখা যায় কিন্তু সামনে আর এত কাছে থাকলে না দেখে কীভাবে থাকা যায়? পড়া বোঝানোর সময় ফালাক নিশোর দিকে তাকিয়ে থাকলে নিশো কয়েকবার বলে উঠেছে,“ফালাক, পড়া বোঝানোর সময় বই দেখতে হবে, আমাকে না। বই দেখলে পড়া ভালোভাবে বুঝবে। মুখের কথার সাথে বইয়ের ভাষায় মিল পেলে তবেই তো সহজ মনে হবে।”
আগামীকালের পড়া বুঝিয়ে দিয়ে নিশো দাঁড়াবে তখন ফালাক বলে উঠল,“শুনুন, আমি কালকে পড়ব না। কালকে আপনার ছুটি।”
নিশো বিরসমুখে বলল,“ছুটি স্যার দেয়, স্টুডেন্ট না। সামনে পরিক্ষা৷ ভদ্রমেয়ের মতো পড়তে বসবে।”
“আমি অভদ্রতা করেছি আপনার সাথে? কী করেছি আমি? কালকে আমি পড়ব না।”
“না পড়লে ছুটি চাইবে। অসুস্থ থাকলে আমি নিজেই ছুটি দিব সেখানে তুমি আমাকে ছুটি দেওয়ার কে?”
“আপনি এভাবে কেন কথা বলছেন?”
“স্টুডেন্টের সাথে কীভাবে কথা বলব? যার সাথে যেভাবে বলা উচিৎ আমি সেভাবেই বলছি।”
“কঠোর হচ্ছেন।”
“নরম নই আমি। আজকে পড়া পারোনি। কাল যেন এমন না হয়৷ আজ মাফ করেছি, কালকে পারব না। ”
“কী করবেন? মা*রবেন?”
“চাচিকে বলে দিব পড়াশোনা করো না৷ পড়ানোর সময় শুধু মুখের দিকে তাকিয়ে থাকো।”
মাথা নিচু করল ফালাক। ছি! মুখের ওপর এভাবে বলল। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল ফালাক কাল থেকে আর একবারও দেখবে না সে৷ নিশো বেড়িয়ে যেতেই দরজা আটকে বিছানায় এসে বসলো সে। মিনিটের মাথায় নিশোর নম্বর থেকে মেসেজ এলো,“বারোটা পর্যন্ত জেগে থাকবেন। প্রয়োজনীয় কথা আছে। রিপ্লাই করবেন না মেসেজের। আমি যথাসময়ে আবার মেসেজ দিব।”
#চলবে……