একটি সাঁঝরঙা গল্প পর্ব-১১

0
276

#একটি_সাঁঝরঙা_গল্প
#তানিয়া_মাহি
#পর্ব_১১

আবির আজ তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরেছে। সারাদিন তার খুব পরিশ্রম করতে হয়েছে। সন্ধ্যা হওয়ার পর শরীর আর পারেনি তাই তাড়াতাড়ি বাসায় চলে এসেছে। জাভেদ সাহেব এটা ভেবে সন্তুষ্ট আছেন যে, আবির খুব পরিশ্রমী ছেলে।

সবাই একসাথে খেতে বসেছে। আবির যখন বাড়ি ফিরেছিল ততক্ষণে নিশো ফালাককে পড়িয়ে নিজের রুমে চলে গিয়েছিল। আবির ফ্রেশ হয়ে নিশোর বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে নানারকম কথাবার্তা বলে দুজনে একসাথে এসে খেতে বসেছে। জাভেদ সাহেবও এসে বসেছেন তাদের সাথেই। রাবেয়া বেগম সবার প্লেটে ভাত এবং গোরুর মাংস তুলে দিচ্ছেন।

আবির একপিস মুখে দিয়ে বলে উঠল,“ রান্নাটা আজকে অনেক মজা হয়েছে,মা। সারাদিনের এত ছুটাছুটির পর এখন তৃপ্তি সহকারে একটু খেতে পারব।”

নিশোও এক লোকমা ভাত মুখে দিয়ে বলল,“হ্যাঁ চাচি, আজকের রান্নাটা কিন্তু জোশ হয়েছে। আপনার হাতে জাদু আছে।”

রাবেয়া বেগম জাভেদ সাহেবের পাশের চেয়ারে বসতে বসতে বললেন,“রান্নাটা আজ আমি করিনি। ফালাক রান্না করেছে। বিকেলে রান্নাঘরে নিজেই গিয়ে রান্নাটা করল। আজ নাকি তার এভাবে মাংস রান্না খেতে ইচ্ছে করছিল। ”

নিশোর মুখটা উজ্জ্বল হলো। আবির এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে বলল,“কই তোমার মেয়ে কই? সে খাবে বলে এত সুন্দর করে রান্না করল আর তাকেই দেখছি না। কোথায় সে?”

রাবেয়া বেগম পিছের দিকে একটু বাঁকা হয়ে ফালাকের রুমের দিকে দেখে বললেন,“ফোন টিপছে হয়তো বসে বসে।”

আবির গলা উঁচিয়ে ডাকতে শুরু করল,“ফালাক! এই ফালাক। খেতে আয়। জলদি আয়। তোর জন্য পুরষ্কার আছে।”

“আসছি।” বলেই রুম থেকে দৌঁড়ে বাহিরে এলো ফালাক।

টেবিলের চারপাশে সবার দিকে চোখ বুলিয়ে নিতে গিয়ে নিশোর দিকে তাকাতেই নজর যেন স্থির হয়ে গেল। সবকিছুর সমাপ্তি যেন এখানেই। ফালাককে দাঁড়িয়ে যেতে দেখে আবির হাত বাড়িয়ে ফালাককে ডেকে বলল,

“আয়, আমার কাছে আয়।”

ফালাক নিশোর দিক থেকে নজর সরিয়ে আবিরের দিকে তাকালো। মৃদু হেসে ভাইয়ের কাছে পাশের চেয়ারে বসলো সে।

আবির খেতে খেতেই বলল,“তোর রান্নাটা আজকে আমার মন ভালো করে দিয়েছে। বল আজকে কী চাস?”

ফালাক ঠোঁটে আঙুল দিকে ভাবুক ভঙ্গিতে কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে উঠল,“আজকে তোর ওয়ালেটে যত টাকা আছে সব আমার।”

আবির হতভম্ব হয়ে এদিক ওদিক তাকাতে নিশো হো হো করে হেসে উঠল। ঠোঁটে হাসি লেপ্টেই বলল,

“দে এবার। সে তার ইচ্ছেমতোই চেয়েছে। এবার তার ইচ্ছে-পূরণ করার জন্য ওয়ালেটটা ওর হাতে ধরিয়ে দে। ভাইয়ের মতো কাজ কর।”

আবির নিশোকে ধমকে উঠে বলল,“চুপ থাক তুই। আর ফালাক, আমার ওয়ালেটে অনেক টাকা আছে। এত টাকা তোকে দেওয়া যাবে না।” শেষের কথাটা ফালাককে উদ্দেশ্য করে বলল আবির।

রাবেয়া বেগম আর জাভেদ সাহেব খাচ্ছেন আর ওদের তিনজনের কর্মকান্ড দেখছেন। ফালাক এবার ঠোঁট ফুলিয়ে বলে উঠল,

“তুই চাইতে বলেছিস, আমি চেয়েছি। দিবি কি দিবি না সেটা তোর ব্যাপার।”
“দিব বলেই চাইতে বললাম তাই বলে এভাবে চাইবি?”

“আমার চাওয়ার কথা, চেয়েছি।” বলেই নিজের প্লেটে খাবার বেড়ে নিয়ে খেতে থাকলো ফালাক।

আবির খাওয়া শেষ করে বলল,“আচ্ছা মোট টাকার দশ ভাগের এক ভাগ নে। তবুও অনেক টাকা।”

ফালাক কিছুক্ষণ ভেবে বলল,“কত টাকা আছে তোর কাছে?”
“ত্রিশ হাজার টাকা।”
“তাহলে তুই আমাকে পাঁচ হাজার দে। মাফ করে দিব। কালকে আমি তোয়া আপু আর ইনাম আপুকে আসতে বলেছি। ওদের সাথে বের হব কালকে।”

তোয়া আসবে শুনেই নিশো বলে উঠল,“বাবা তোয়াকে আসতে দেবে না হয়তো। আমি এখানে উঠেছি তার জন্য উনি আরও বেশি রেগে আছেন।”

ফালাক নিশোর দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল,“আপনি চাইলে আপনার আম্মাকেও এখানে নিয়ে আসতে পারি।”
“নিয়ে এসো তবে।”
“নিয়ে আসতে পারলে কী দিবেন?”
“পরিবর্তে চাওয়ার অভ্যাস কেন তোমার? আচ্ছা আনতে পারলে কাল পড়া না পারলেও মাফ করে দিব।”
“অ্যাহ আমি সব পড়া কমপ্লিট করেছি।”
“আচ্ছা তাহলে পাবে কিছু একটা।”

“ঠিক আছে অপেক্ষা করুন। ” বলেই ফালাক উঠে দাঁড়ালো। ভাইকে ঠেলে নিয়ে তার রুমে চলে গেল। নিজেই ওয়ালেট থেকে পাঁচ হাজার টাকা নিয়ে বলল,

“ইনাম আপু আসবে কাল। ”

আবির তোয়ালেতে হাত মুছতে মুছতে বলল,“আস্ত একটা ঝামেলা।”
“ঝামেলার জন্য রেডি হয়ে যাও ব্রোহ।”
“বাসায় আনিস না যেন। আমি কাল ছুটি নিয়েছি। আমার দিনটা নষ্ট করিস না। ”
“জ্বালা*বে না সেই কথা দিতে পারছি না।”
“আর কত লাগবে?”

ফালাক মুচকি হেসে বলল,“দুই হাজার। আর দুই হাজার টাকা দিলেই প্রব্লেম সলভ্ করে ফেলব।”

রাত বারোটা বাজতে চলেছে। বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে হয়তো এতক্ষণে। বাড়িতে সবাই সাড়ে নয়টার মধ্যে রাতের খাওয়া শেষ করে দশটা সাড়ে দশটার মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ে। আজও হয়তো সেটার অন্যথা হয়নি৷

রুমে লাইট অন করে দরজা আটকে খাটের ওপর দুই পা ভাজ করে বসে ঘড়ি দেখছে। মিনিটের কাটা যতই ঘড়ির ঘণ্টার কাটার কাছাকাছি হচ্ছে ফালাকের বুকটা ততই কাঁপা-কাঁপি করছে। অবশেষে ঘণ্টার কাটা আর মিনিটের কাটা সংখ্যা বারোতে পৌঁছল। ফালাক অতিরিক্ত এক্সাইটমেন্টে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাসের সাথে চোখ বন্ধ হলো। ফোনে মেসেজের টুংটাং আওয়াজ শুরু হলো। একসাথে কয়েকটা মেসেজ এসে ইনবক্সে জায়গা করে নিল।

ফালাক ধীরে ধীরে চোখ খুলে ফোনটা হাতে নিল। পাওয়ার বাটন টিপে সোজা মেসেঞ্জার ইনবক্সে চলে গেল সে। আবির, তোয়া, ইনামসহ আরও কয়েকজন উইশ মেসেজ পাঠাতেই আছে। সবচেয়ে আগে কে উইশ করেছে সেটা জানতে মেসেজের ওপর দিক থেকে চোখ বুলিয়ে নিচের দিকে তাকালো সে। নামটা দেখতেই আপনা-আপনি ওষ্ঠ প্রসারিত হলো তার।

নিশো জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়েছে। নিশোর মেসেজটা সিন করে রেখে সবার মেসের রিপ্লাই পাঠিয়ে আবার নিশোর ইনবক্সে ফিরে এলো সে৷ রিপ্লাইতে টাপ করল,“ধন্যবাদ, ভাইয়া।”
সাথে সাথে টাইপটা ব্যাকস্পেস চেপে মুছে দিল তারপর আবার লিখল,

“ধন্যবাদ৷ আমার সাথে সাথে আপনার জীবনটাও সুন্দর হোক একদম কাটাবিহীন গোলাপের মতো।”

ওপাশ থেকে কিছুক্ষণের মধ্যেই রিপ্লাই এলো,“এখন ঘুমিয়ে যাও। অনেক রাত হয়েছে।”

ফালাক ভ্রু কুঁচকালো। এতরাত তাকে জাগিয়ে রেখে এখন কোনকিছু না বলে ঘুমিয়ে যেতে বলছে! দ্রুত টাইপ করল ফালাক,

“আপনার কথায় এতরাত অবধি জেগে রইলাম আর আপনি এখন আমাকে ঘুমোতে বলছেন?”

ফালাকের এমন মেসেজে মৃদু হাসলো নিশো। অন্ধকার রুমে ফোনের আলোয়ে হাসি স্পষ্ট হলো। পরক্ষণেই ভাবলো, নাহ এই মেয়ের সাথে বেশি কথা বলা যাবে না। জড়িয়ে যাচ্ছে সে ফালাকের সাথে। তার উচিৎ ফালাককে ছোট বোনের নজরেই দেখা। তাছাড়া তাদের বাবাদের মধ্যে ঝামেলা হয়তো কখনো শেষ হবার নয়। সবচেয়ে বড় সমস্যা বেকারত্ব আর পারিবারিক অসমতা। কোথায় ফালাকের পরিবারের অবস্থান আর কোথায় তাদের!

আর ভাবতে পারছে না সে কিন্তু ফালাক তো প্রতিটা মুহূর্তে বুকে চেপে বসছে। প্রথম প্রেমের বিচ্ছেদের এতগুলো মাস পর আবার কারো সাথে এভাবে জড়িয়ে যাওয়া উচিৎ হবে না। নিজেই নিজেকে বোঝালো, এসব সম্ভব না। আগে ক্যারিয়ারের দিকে ফোকাস করতে হবে।

ফালাক মেসেজের রিপ্লাই না পেয়ে আবারও লিখলো,“কী হলো? কথা বলছেন না কেন?”

মেসেজের শব্দে সৎবিৎ ফিরলো নিশোর। ফোনস্ক্রিনে ফালাকের টেক্সট দেখে মুখের গম্ভীরভাব চলে যেতে থাকলো। মেসেজের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলে উঠল,

“আমি জানি ফালাক, তুমি আমাকে পছন্দ করো হয়তো ভালোও বাসো কিন্তু এক্ষেত্রে তোমাকে স্ক্রিক্টলি ফিরিয়ে দিতে আমি পারব না। তবে তোমাকে ফিরিয়ে দিতেই হবে। পৃথিবীতে অনেককিছুই অসম্ভব।”

নিশো উত্তর পাঠালো,“কী করছো?”
সাথে সাথে জবাব এলো,“আপনি কী বলবেন সেটার অপেক্ষা করছি। তাড়াতাড়ি বলুন।”
“সেরকম কিছু তো বলার নেই। উইশ করব বলেই জেগে থাকতে বলেছিলাম।”
“একটা কথা জিজ্ঞেস করি?”

বুকটা কেঁপে উঠল নিশোর। ফালাক উল্টাপাল্টা কোন প্রশ্ন করবে না তো? নিশোর মনে হলো সবটা ক্লিয়ার হওয়া উচিৎ।

“হ্যাঁ, কী জানতে চাও?”
“আপনার ভবিষ্যৎ নিয়ে কী পরিকল্পনা?”
“আপাতত বিসিএস। জানোই তো।”
”এটা ছাড়া আর কোন কিছু ভাবছেন না?”
”না, আর কিছু ভাবার নেই তো।”
“আসলে আমি বুঝাতে পারছি না।”
“কী বুঝিয়ে বলতে পারছো না?”
“আসলে…”

নিশো এবার ব্যাপারটা সহজ করতে লিখল,“ফালাক, আমি তোমার মাঝে অস্বাভাবিক আচরণ লক্ষ্য করছি। বিষয়টা মোটেও আমার কাছে সুবিধার লাগছে না। তুমি খুব ভালো মেয়ে এখানে কোন সন্দেহ নেই কিন্তু আমি তোমার জন্য সঠিক নই। তুমি তোমার সাথে আমাকে ভেবো না, ফালাক।”

মেসেজটা আসার সাথে সাথে শোয়া থেকে উঠে বসলো ফালাক। চোখ দুটো বড় বড় হলো। হৃৎপিন্ডের গতি বেড়ে গিয়েছে। ভয়ে বুকটা প্রচন্ড কাঁপছে। মনে মনে ভাবলো, নিশো তাহলে সবকিছু বুঝে গিয়েছে?

ফালাক কাঁপা কাঁপা হাতে টাইপ করল,“আমি আপনার অপছন্দের?”

ফোনটা পাশে উলটোদিক করে রেখে দিল। কোন আচরণে বুঝে গেল ফালাকের মনের কথা? আজকের একটু তাকানোতেই? নাকি আগের কোন ব্যবহারে? নিশো তাকে ফিরিয়ে দিবে? ফিরিয়ে দিলে নিশোর মুখোমুখি সে কীভাবে হবে? দেড়টা ঘণ্টা সময় একা একা কীভাবে কাটাবে নিশোর সাথে? দম বন্ধ হয়ে আসবে তো তার।

ফোনটা কেঁপে উঠল। ফালাক তাড়াতাড়ি ফোনটা হাতে নিয়ে নিশোর ইনবক্সে চলে গেল। নিশো লিখেছে,

“দেখো ফালাক, তুমি অপছন্দ করার মতো মেয়ে নও। তুমি অনেক ছোট, অনেক কিছুই তুমি বোঝো না।”
“বুঝিয়ে বলুন আমাকে। আপনি তো কঠিন কঠিন অংক, কঠিন কঠিন গ্রামার, ব্যাকরণ সহজ করে দিচ্ছেন। প্লিজ সবকিছু সহজ করে বলে দিন।”
“তুমি আমাদের পারিবারিক অবস্থাটা জানো। বাবার একটা দোকান আছে শুধু ওটা ছাড়া সংসার চালানোর কোন ওয়ে নেই। তোমার বাপ-ভাই একদিনে যেটা উপার্জন করে আমার বাবা সেটা মাসেও আনতে পারে না। ”
“তারপর?”
“কী তারপর?”
“আমাদের অমিলের কারণ। আর কী কী?”
“তোমার বাবা আর আমার বাবার মাঝে ঝামেলা চলছে আমাদের ছোটবেলা থেকে। তারা দুজন একে অপরের সাথে কতগুলো বছর কথা বলে না। এরকম সংহতির মাঝে তুমি এসব চিন্তা করো কীভাবে?”
“আর কি কোন কারণ আছে?”
“বেকারত্বের কারণে প্রেমিকা ছেড়ে গিয়েছে কয়েকমাস। আমাদের প্রেমটাও খুব ভালোভাবে শুরু হয়েছিল। আমার প্রতি তার কী ভালোবাসা! রেস্টুরেন্টে গেলে বিল সে দিত, রিকশা ভাড়া এমনকি ফোনের ব্যালেন্সও তুলে দিত। সবই সে করত। আশা নিয়ে ছিল যে আমি ভালো কিছু করতে পারব। শেষমেশ বছর শেষে ভালোবাসা কমতে শুরু করল৷ কিছুতেই চাকরি পাচ্ছি না, কিছু হচ্ছে না দেখে সে পরিবারের চাপে ভালো একটা ছেলেকে বিয়ে করে নিল। হৃদয় দুজনেরই ভেঙেছিল কিন্তু সে পেল একটা সংসার আর আমি নিকোটিন।”

ফালাকের কান্না পাচ্ছে। বারবার ফুপিয়ে উঠছে সে। এর আগে কখনো এতটা বোকামি করেনি কোথাও। ভালোবাসার কাছে কঠিন ব্যক্তিত্বও হয়তো কোনভাবে হেরে যায়। মাথা নুইয়ে ফেলে সেই মানুষটার কাছে। খোলা বইয়ের মতো ধরা দিতে শুরু করে। যতটা সহজ হওয়া উচিৎ নয় তার চেয়েও বেশি সহজ হতে শুরু করে।

ফোনের স্ক্রিনে চোখের পানি টপ করে পড়তেই উলটো করে বিছানায় মুছে নিলো সে। ঝাপসা দেখছে সে। টাইপ করল,

“আ’ম স্যরি। ”
“স্যরি কেন? আ’র ইয়্যু ওকে?”

ফালাকের অনেককিছু বলতে ইচ্ছে করছিল। জানাতে ইচ্ছে করছিল, “আমি আপনার জন্য আজীবন অপেক্ষা করতে পারব, নিশো ভাইয়া। পারিবারিক সমস্যা কেউ কখনো মেটানোর চেষ্টা করেনি। আমি আমার বাবার চোখে তার ভাইয়ের জন্য ভালোবাসা দেখেছি। আপনার বাবার মনেও নিশ্চয়ই ভাইয়ের জন্য আছে আর বাকি রইল বেকারত্ব। সেটা আল্লাহ চাইলে খুব তাড়াতাড়ি দূর হবে। আমি তো ছোট খাটো কিছু করছি, আপনার কিছু না হলে এটাই নাহয় দুজন মিলে আরও বড় করব। অনেকে তো এরকম বিজনেস থেকে মাসে লক্ষ লক্ষ টাকা ইনকাম করে। আপনি শুধু আমার ভালোবাসায় হ্যাঁ বলে দিন।”

ফালাক কিছু বলতে পারল না। টাইপ করতে কষ্ট হচ্ছে তার। বারবার ফুঁপিয়ে ওঠায় শব্দ হচ্ছে কান্নার। মাথা এদিক ওদিজ নাড়িয়ে বলতে থাকলো,

“নাহ, উচিৎ হয়নি আমার তাকে কিছু বুঝানো। ভালোই তো চলছিল একপাক্ষিক ভালোবাসা। বছরের পর বছর সেটাই চলতো। মনে শান্তি নিয়ে ভালোবাসা যেত। সে আমাকে চায় না এটা জানার পর কীভাবে ভালো থাকব আমি? তার সামনেই বা কীভাবে যাব?”

ফালাক ফোনটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখটা মুছে নিল। আস্তে করে দরজাটা খুলে পা টিপে টিপে মেইন দরজা খুলে বাহির থেকে আটকে দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে সোজা ছাদে চলে গেল সে।

চিলেকোঠার একপাশে দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠল ফালাক। মুখে দুই হাত চেপে কান্না থামানোর চেষ্টা করছে সে। কিছুতেই কান্না থামছে না। এতদিনের কঠিন, ম্যাচিউর ব্যক্তিত্বের ধ্বং*স হয়ে যাচ্ছে মনে হচ্ছে।

অনেকটা সময় কেটে গিয়েছে। কান্না ধীরে ধীরে নিরবতায় রূপ নিয়েছে। আকাশের দিকে এক পলকে তাকিয়ে আছে সে। চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে।
একসময় বসে থাকতে থাকতে উঠে দাঁড়ালো সে। ছাদের পাশ দিয়ে এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে বেখেয়ালি হাটতে থাকলো।

ওদিকে হাতের ফোনটা বারবার বেজে যাচ্ছে। মেসেজ নয় বারবার কল আসছে কিন্তু রিসিভ করতে ইচ্ছে করছে না ফালাকের৷ হাঁটতে হাঁটতে একপাশে গিয়ে দাঁড়ালো সে।

নিশো এতক্ষণে ফালাককে ফোনে না পেয়ে স্থির থাকতে পারছিল না। পিছনের দরজাটা খুলে সিঁড়িতে এসে বসেছিল সে। হঠাৎ ছাদের দিকে পাশ ফিরে তাকাতেই ফালাককে দেখতে পেল সে। ছাদের ঠিক কর্ণারে ফালাককে দেখেই পিলে চমকে উঠল যেন। ফালাক সু*ইসা*ইড করতে উঠেছে! কিন্তু এতটা বাচ্চামি সে করবে না ভেবেও বসে থাকতে পারল না নিশো। ফালাককে তো সে নিজেও মনে জায়গা দিয়ে বসেছে। এভাবে অন্তত জায়গাটা শূন্য করতে পারবে না সে। হাতের ফোনটা ওখানেই ফেলে দৌঁড়ে গেল ফালাকদের বিল্ডিংয়ের দিকে। সিঁড়ি বাহিরে হওয়ায় সে নিজেও ছাদের দিকে ছুটে চলল। সিঁড়ি থেকে ছাদের লাইটটা বন্ধ করে দিল সে৷

সিঁড়িতে কারো পায়ের শব্দ শুনতে পেল ফালাক। সাথে সাথে তাড়াহুড়ো করে চোখ, গাল মুছে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। মুহূর্তের মধ্যে নিশো এসে ফালাকের বাহু ধরে পিছনের দিকে ঘুরিয়ে নিল।

চিৎকার দিয়ে বলে উঠল,“কী সমস্যা তোমার? কী করছিলে তুমি এসব?”

ফালাক বেশ স্বাভাবিক গলায় বলল, “কী করছিলাম আমি? চন্দ্রবিলাস করছিলাম।”

নিশো বুকে হাত দিয়ে ডলতে ডলতে বলল,“কী? এজন্য এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে? পড়ে গেলে কী হবে ভেবে দেখেছ?”

“আপনি এ সময় এখানে কী করছেন?”
“তোমাকে দেখেই তো দৌঁড়ে আসলাম৷”

ফালাক মেকি হেসে বলল,“কী ভেবেছেন সু*ইসাইড করতে এসেছি? ইশ! আপনাকে সন্ধ্যায় বলেছিলাম আজ চন্দ্রবিলাস করতে ছাদে উঠব। ভুলে গেলেন?”

নিশো নরমকণ্ঠে বলল,“তুমি ঠিক আছ?”
“ঠিক না থাকার কী আছে? কিছু হয়েছে এমন যেটায় ঠিক থাকব না?”

শেষের বাক্যটা বলতেই গলা কেঁপে উঠল ফালাকের। বুঝতে পারল এই লোকটা সামনে আসায় কান্নারা বারবার বেরিয়ে আসছে। ভাগ্যিস ছাদের লাইটটা অফ করে দিয়েছে!

নিশো ধীরপায়ে ফালাকের অতি নিকটে এসে দাঁড়ালো। ফালাক পিছিয়ে যাবে তখনই নিশো অদ্ভুত একটা কাজ করে ফেলল। গা শিউরে উঠল ফালাকের। পুরো শরীর যেন একটা ঝাঁকুনি দিয়ে স্থির হয়ে গেল।

নিশো বুড়ো আঙুলের পিঠ দিয়ে চোখের ছুঁতেই চোখ বন্ধ করে নিল ফালাক। চোখ ভেজা ঠেঁকছে নিশোর কাছে। তার মানে নিশোর ধারণা সঠিক। ফালাক কাঁদছে।

নিশো অবাক চোখে ফালাকের দিকে তাকালো, শুধালো,“আমার মতো মূল্যহীন মানুষটাকে না পেয়েও কেউ কান্না করতে পারে? বাচ্চামেয়ে তুমি। বিশ বাইশ বছরে পা রাখলে আমাকে অপ্রয়োজনীয় লাগবে।”

“আমি বাচ্চামেয়ে নই।”
“বড় হয়ে গেছো?”
“জি। নাউ আ’ম এইটিন।”
“মানে সাবালিকা? ”
“হুম।”
“মানুষকে চিনতে, পরিস্থিতি বুঝতে অন্তত বাইশ বছর বয়সী হতে হবে।”
“আমি আমার ষোলো বছর বয়সেই অনেক কিছু বুঝে গিয়েছি।”
“কী বুঝেছ?”

ফালাক দুই হাত নিজের বুকে গুজে বলতে থাকলো,“এসএসসির আগে বাবা লসে পড়ে যায়। কাজ মিলছিল না, ভাইয়ার পড়া শেষ হয়নি। এই পরিস্থিতির কয়েকমাস আগেই আমি হাজার বিশেক টাকা বাবার থেকে নিয়ে বোরখার বিজনেস শুরু করি। আমার বেডরুমের পাশের ভ্যানিটি রুম আমি ছাড়া কেউ যায় না। তাই আপনিও দেখেননি। এখন আমার ব্যবসা লাখ টাকা ছাড়িয়ে গেছে। ধৈর্য্য ধরে থাকলে সফল হওয়া যায়। এত বোরখার অর্ডার আসে যা আমি নিতে পারি না৷ ভেবেছি দুই একজন মানুষ রাখব যারা স্টিচের কাজ ভালো পারে। আমি দু বছর আগে খুব পরিশ্রম করেছি। মা অসুস্থ হলো, বাবার এই অবস্থা সব মিলিয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয়েছিল। আমার জমানো টাকা বাবাকে দিয়েছিলাম, সংসার চলছিল না বলে। ওই এক ধাক্কায় আমি যতটুকু বড় হয়েছি ততটুকু বড় হয়তো পঁচিশ বছর বয়সী কোন সংসারী মেয়েও হয় না। আর আপনি আমাকে বাচ্চা বলেন।”

নিশো বুঝতে পারল ফালাক স্বাভাবিক হচ্ছে। এই মেয়েটাকে হাসিতেই সুন্দর লাগে। নিশো আনমনে বলে উঠল,
“দুঃখ তোমাকে আর না ছুঁয়ে দিক।”
“আপনি ছুঁলে দুঃখ পালায়।”

নিশো রেলিংয়ে হাত রেখে দাঁড়ালো। আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, “আজকে তোমার চন্দ্রবিলাস স্বার্থক। চাঁদটা সুন্দর আলো ছড়াচ্ছে।”

“আজ আকাশে চাঁদ দেখা দিলেও আমার কাছে আজ অমাবস্যা। সবটা ভয়ংকর অন্ধকারে আচ্ছন্ন।”
“কেন?”
“আপনি ফিরিয়ে দিয়েছেন আমায়। ”
“ আমার দিকে এগুলেই ফিরে যেতে হবে। আমি গন্তব্য বানিয়ো না। আমি কারো গন্তব্য হতে পারব না। আমি ভালো ছেলে, ভালো ভাই, ভালো বন্ধু, ভালো প্রেমিক কোনটাই নই।”

“আমার মনে হয় আমাদের নিজেদের রুমে চলে যাওয়া উচিৎ।”
“টেবিলের নিচে একটা প্যাকেট ছিল দেখেছ?”
“কীসের প্যাকেট? কই খেয়াল করিনি তো! আপনি যেভাবে বারোটা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলেছিলেন আমি অন্যকিছু দেখার সময় পাইনি।”
“আমার থেকে কিছু উপহার চেয়েছিলে। সেটা দিতে না পারলে আমার খারাপ লাগতো।”
“আপনি তো বুঝতে পারেন, আপনাকে চাই তাহলে দিচ্ছেন না কেন?”
“আমার কি তবে আরেকবার কষ্ট পাওয়া উচিৎ? ”
“আপনি কষ্ট পাবেনই বা কেন আর দিচ্ছেই বা কে?”
“তুমি অনেক ছোট, ফালাক৷ তুমি তোমার বাড়ির পরিবেশ বুঝলেও বাহিরটা বুঝো না।”
“আমি শুধু আপনাকে বুঝতে চাই। অংকের মতো কঠিন হবেন না শুধু।”
“যাও রুমে যাও।”
“আমাকে ফিরিয়ে দিলে আমি আর ফিরব না।”
“আমি তোমাকে ফিরিয়ে দিচ্ছি না৷ তোমার মতো মেয়েকে ফিরিয়ে দেওয়া যায় না। তোমাকে যে পাবে সে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ হবে। আমি নিজেকে ফিরিয়ে নিচ্ছি। রুমে যাও, এখন মাঝরাত। তোমার বাবা-মা ভরসা করেন, আমি তাদের ভরসা ভাঙতে পারব না। ”

ফালাক কিছুক্ষণ চুপ করে নিশোর দিকে চেয়ে রইল। অতঃপর সবকিছুর পরিস্কার জবাব সে পেয়ে গেল। মেকি হেসে বলল,

“কালকে পড়াতে আসবেন। ভয় পাবেন না, ভালোবাসা জাহির করব না। আপনি তো আমাকে চিনেন। শুধু এতটুকু নিশ্চয়তা দিন যে সত্যিই আপনার আর আমার কিছু সম্ভব নয়।”

নিশো যেন বুকে পাথর এঁটে বলল,“সম্ভব নয়।”

ফালাক বেশ স্বাভাবিকভাবেই বলল,“ঠিক আছে আমি আসছি। আজকের রাতটা স্পেশাল করার জন্য ধন্যবাদ। শুভরাত্রি।”

ফালাক চিলেকোঠার দরজার দিকে এগিয়ে যেতেই বুঝল কেউ সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে যাচ্ছে। ফালাকের বুকটা কেঁপে উঠল। কেউ শুনে ফেলল না তো তাদের কথাবার্তা! কেউ ছিল এখানে সে নিশ্চিত। কেউ যদি শুনেই নেয় তবে নিশোকে বের করে দেওয়া হবে না তো এ বাড়ি থেকে! কী করে ফেলল সে, আফসোস করতে লাগলো ফালাক। নিশোকে রেখেই তাড়াতাড়ি করে নিচে নামতে থাকলো সে।

#চলবে….