একদিন নববর্ষা -২২
অদ্রিজা আশয়ারী
___________
সন্ধ্যের পর সাভার থেকে বর্ষাদের গাড়ি ধানমন্ডির উদ্দেশ্যে বেরুল। বিকেলেই ফিরে যাবার অভিপ্রায় ছিল নাব্যের। বর্ষার জন্য সময় পেছাতে হয়েছে।
মাগরিবের সালাত শেষ না করে বেরুলে পৌঁছে নিশ্চয়ই কাযা আদায় করতে হবে। তাই বর্ষা চাইছিল সালাত শেষ করে একেবারে নির্ঝঞ্ঝাট হয়ে বেরুতে।
অতঃপর ওদের প্রস্থান লগ্নে। বর্ষা যখন মুখ ঢেকে, হাতমোজা পড়ে, কালো বোরকায় আবৃত হয়ে বেরিয়ে এলো। এসে নাব্যর পাশে দাঁড়িয়ে সবাইকে বিদায় জানালো। নাব্য তখনো বুঝতে পারে নি তার পাশের মেয়েটিই বর্ষা! আদতে নাব্য কখনো বর্ষাকে বোরকা পরিহিতা অবস্থায় দেখেনি। সে ভারি বিভ্রান্ত বোধ করল। ওদের বিদায়বেলা সহসা কে এই অপরিচিতা নারী এসে হাজির হয়েছে। আর ওই মেয়েটাই বা কোথায় হারালো? দেরি হয়ে যাচ্ছে তো!
বর্ষা বাইরে বেরিয়ে যাবার পরও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল নাব্য। একটা সময় পর সকলের আচরণ দেখে সে উপলব্ধি করতে পারল ওই মেয়েটি আর কেউ নয় বর্ষা।
সায়ংকালের পর, সন্ধ্যা ও রাত্রির সন্ধিক্ষণ শেষে যখন আকাশ থেকে আঁধারের নিগূঢ় কালিমা সবে নামতে শুরু করেছে। গাড়িটা মফস্বলের কাঁচা রাস্তা ছেড়ে হাইওয়েতে উঠল তখন। মনোযোগী ছাত্রের মতো দৃষ্টি সামনে সমাহিত করে নাব্য গাড়ি চালাচ্ছে। তার পাশে অস্বস্তিতে নিমিষহারা হয়ে বসে আছে বর্ষা। সে নিশ্বাস টাও ফেলছে খুব ধীর লয়ে, মেপে মেপে। পাছে লোকটা টের পেয়ে যায়! গাড়ির ভেতর এসি চলছে। জানালার কাঁচ তাই ওঠানো ছিল। ভীষণ হাসফাস লাগছিল বর্ষার।
নাব্য চোখের কোণে ব্যাপার টা খেয়াল করে জানালার কাঁচ নামিয়ে দিল। মুহুর্তেই গা জুড়ানো ফুরফুরে বাতাসের দাপাদাপি ওদের উদ্রিত করে তুলল।
আজ হাইওয়েটা অন্য দিনের তুলনায় বেশ ফাঁকা। মাঝে সাঝে দু একটা গাড়ি সাঁই সাঁই করে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে। এর একটা কারণ হতে পারে বোধহয় আজকের আবহাওয়া। আকাশে তখন মেঘের ঘনঘটা। ইতোমধ্যে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। তির্যক বৃষ্টির ছাঁট এসে লাগছে ওদের গায়ে। বর্ষা হঠাৎ একটা কাজ করল। রাতের অন্ধকারে নিকাব খুলে জানালার বাইরে বাতাসের দাপাদাপির মধ্যে মুখ বাড়িয়ে দিল সে। বাইরে মুখ বাড়িয়ে জানালায় হেলে পড়ে মুদিত আঁখিজোড়া বৃষ্টির কোলে মেলে দিয়ে স্থবির হয়ে বসে রইল। বৃষ্টির তোড়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বইতে লাগল বাতাস। গাড়ির ছাদে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ার চিটচিটে শব্দটা কি সুন্দর শোনাচ্ছে! প্রকৃতির এতো আয়োজন দেখে বর্ষা তার পাশে নাব্যর অস্তিত্বের কথাই যেন ভুলে গেল ক্রমশ। কিশোরী মেয়ের মতো উচ্ছ্বাসিত হয়ে বাইরে হাত বাড়িয়ে বৃষ্টি উপভোগ করতে লাগল সে। বৃষ্টি ততক্ষণে গতি বাড়িয়েছে। বর্ষার হাত, মুখ, পোশাকের ঊর্ধ্বাংশ ভিজে একাকার। অথচ সে পরোয়াহীন! নির্বিকার!
একটা সুখ সুখ অনুভবের আবর্তনে ঘিরে আছে তার মন, শরীর সবকিছু…..। বাতাসের প্রবলতায় সামনে তাকানো দায়। তবু সেদিকেই মুখ বাড়িয়ে চেয়ে রইল বর্ষা। তাকিয়ে থাকতে থাকতে এক সময় বর্ষার চোখ সরু হয়ে এলো। দুচোখে নেমে এলো ঘুম….।
নাব্য আড়চোখে দেখছিল পাশে বসা পাগলাটে মেয়েটির ভীষণ উচ্ছ্বাসিত খেয়ালী কর্মকাণ্ড!
এবার সে সামনের দিকে দৃষ্টি নিবিষ্ট করল। রাত বাড়ছে, রাস্তাটা বলতে গেলে প্রায় জনমানবহীন। গাড়ি ৮০ কি.মি ঘন্টাবেগে চলছে। গাছপালা গুলো পাশ কেঁটে যাচ্ছে চোখের নিমিষে। গাড়ি চালাতে চালাতে সহসা নাব্য খেয়াল করল তার বা-পাশের ঘাস ফড়িংয়ের মতো চঞ্চল মানবীটি আর ছটফটাচ্ছে না। ঘাড় বাঁকিয়ে পরখ করার অভিপ্রায়ে সেদিকে তাকাল সে। তারপর সেদিক থেকে চোখ না সরিয়েই গাড়ির গতি কমিয়ে ভ্রু কুঞ্চিত করে একদৃষ্টে চেয়ে রইল কিয়ৎক্ষন।
কিঞ্চিৎ পর বুঝল মেয়েটি গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। তার নির্মল দেহখানি জানালায় সম্পুর্ন ঝুকে রয়েছে বিপদসংকুল ভাবে। একটি হাত তখনো গাড়ির বাইরে। নাব্য কয়েক মুহূর্ত ভাবল। তারপর বা দিকে ঝুকে বর্ষার নিদ্রিত দেহটাকে সন্তর্পণে জানালা থেকে সরিয়ে এনে পুনরায় কাঁচ উঠিয়ে দিল।
গাড়ি যখন বাড়ির সামনে এসে থামল তখনো বর্ষার নিদ্রাভঙ্গ হয়নি। বৃষ্টি থেমেছে। বাড়ির সামনের খোলা জায়গাটার এখানে ওখানে ছিপছিপে পানি। গাড়ির শব্দ পেয়ে রাফিয়া বেরিয়ে এলেন। পেছনে দেখা গেল ধীর পায়ে দাদিও আসছেন। নাব্য নামতে দেরি করছে দেখে রাফিয়াই প্রাঙ্গণে নেমে এলেন। মা কে দেখে নাব্য জানালার কাঁচ নামালো।
-“কিরে, বেরোচ্ছিস না কেনো তোরা। রাস্তায় কোনো অসুবিধে হয়নি তো?”
-” না। কিন্তু….”
বা পাশে ঘুমন্ত বর্ষার ওপর চোখ নির্দেশ করে গম্ভীর স্বরে বলল, ” ও এখনো ঘুমোচ্ছে। ”
-“ঘুমোচ্ছে তো ডাক ওকে!”
-” ডেকেছি। সারা নেই! তুমি দেখো আমি ভেতরে গেলাম।” বলে নাব্য ত্বড়িতে দরজা খুলে বেরিয়ে গেল। বাড়ির সামনে এতক্ষণ রাফিয়াকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে দাদি এবার ভেতর থেকে চেঁচালেন,
-“কি গো রাফু। হইসে ডা কি?”
রাফিয়া বর্ষাকে ডাকছিলেন। মেয়েটার মরা’র ঘুম। কিছুতেই ভাঙ্গছে না। এই অর্বাচীন মেয়েটাকে শুধুমাত্র নিজের ছেলের কথা ভেবেই সহ্য করে যাচ্ছেন তিনি। বিরক্ত গলায় বললেন,
-“তেমন কিছু না আম্মা। আপনার নাতবউ গাড়িতেই ঘুমিয়ে পড়েছে। ডাকছি উঠছে না।
এই বর্ষা…..এই….. ওঠো।”
নাহ! লাভ হচ্ছে না। মেয়েটা বেহু’শের মতো ঘুমোচ্ছে। দাদি এগিয়ে এলেন। পিটপিটে চোখে চেয়ে রইলেন মুহুর্তক্ষণ। সেই চাহনিতে মায়া ঝরে ঝরে পড়ছে। তারপর আপ্লুত গলায় বললেন,
-“আহা গো! ছুডু মানুষ তো। হের ওপর এতক্ষণ জার্নি কইরা আইসে। পেরেশান হয়া গেসে মনে হয়।”
উত্তরে রাফিয়ার বলতে মন চাইল।
-” আপনার ছুডু মানুষ নাতবউ বসে বসে আরাম করে এসেও ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। আর আমার নবু যে গাড়ি চালিয়ে গিয়ে আবার ওকে নিয়ে গাড়ি চালিয়ে কাহিল হয়ে ফিরে এলো। সেটা আপনার চোখে পড়ল না? ”
কিন্তু তিনি শাশুড়ীর মুখের ওপর কিছু না বলে চুপ রইলেন।
দাদি কি যেন ভাবলেন। অতঃপর বললেন
-” রাফু, নবুরে কও আয়া ওরে নিয়া যাইতে।”
-“আশ্চর্য! নবু এসে ওকে কিভাবে নিয়ে যাবে আম্মা?” রাফিয়া অবাক চোখে প্রশ্ন করলেন। কণ্ঠে তার অপ্রসন্নতা।
রাফিয়ার শাশুড়ী সুলভ ঈর্ষা বুঝতে পেরে দাদি মুচকি হেসে উত্তর করলেন,
-“বিয়ার পরে আমার পোলা তোমারে যেমনে লয়া যাইত..।”
শাশুড়ীর এমন রাখঢাকহীন বেশরম কথার বিপরীতে আর কিছু বলা চলে না। রাফিয়া ছেলেকে ডাকতে ভেতরে গেলেন।
বাইরে এসে দাদির কথা শুনে নাব্যের বিরক্তি অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেল। দাঁতে দাঁত চে’পে ক্রোধ টাকে দমিয়ে দাদির আদেশ মান্য করতে সতেজে দরজা টেনে খুলতেই বর্ষা ওর গায়ের ওপর হুড়মুড়িয়ে এসে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে ঘুম ভেঙে লাফিয়ে উঠল বেচারি। কাছাকাছি এতগুলো মুখ দেখে সে হকচকিয়ে গেছে। দাদি এগিয়ে এসে ওকে জড়িয়ে ধরলেন। সোহাগ করে বললেন,
-” বুবু তুমি আইসো। আহো, ভিতরে আহো। চোখে মুখে পানির ছিটা দেও। ঘুমডা কাটুক। নবু তোরে আর লাগবো না তুই ঘরে যা।”
নাব্য যেন এই কথারই অপেক্ষায় ছিল। দাদির কথা শেষ হওয়া মাত্র বাধ্য ছেলের মতো জায়গা ছেড়ে চলে গেল। রাফিয়া শাশুড়ী বউয়ের এসব আহ্লাদী দেখে পানসে মুখে ভেতরে পা বাড়ালেন।
বর্ষার গালে, কপালে টুপটাপ কয়েকটা চুমু দিয়ে ওর হাত ধরে টেনে দাদিও রাফিয়ার পশ্চাদগামী হলেন।
***
দাদির কাছ থেকে ছাড়া পেয়ে রাতে শুতে এসে বর্ষা বিভ্রান্তিকর এক অবস্থায় পড়ল। বিয়ের পর এখানে যে দুদিন ছিল সেসময় নাব্য ঘুমাত লাইব্রেরি রুমে। আজ দেখা গেল সে বিছানাতেই শুয়েছে। তবে এমন ভাবে যে আশেপাশে কারো বসবার স্থানটুকু পাওয়ার সাধ্যি নেই! হাত পা ছড়িয়ে বিছানার মাঝ বরাবর শুয়ে দুপাশে বালিশের বর্ডার বানিয়ে রেখেছে। এখনো ঘুমোয় নি। ফোন স্ক্রল করছে।
শুভ্র সাদা টিশার্ট আর কালো ট্রাউজারে কি সুন্দর দেখাচ্ছে ওকে। অথচ মুখখানা দেখো! করে রেখেছে জলদগম্ভীর!
বর্ষা ঘরে এসে এটা সেটা করার অজুহাতে আড়চোখে দেখছিল ব্যাপার টা। তার মুখজুড়ে কালো মেঘের ঘনঘটা। বৃষ্টির আসন্ন ইঙ্গিত! অভিমানে ফোলা ফোলা গালদুটোর স্ফীতি আরও বর্ধিত হয়েছে। সে এখন কি করে? লোকটা এমন কেন করছে? সে কি জিজ্ঞেস করবে কিছু?
নাহ। ভরসা হলো না যে কিছু বলে। যা রুদ্রমূর্তি লোকটার। যদি বিষম এক ধমক দিয়ে বসে ওকে !
নাকি সে গাড়িতে ঘুমিয়ে পড়েছিল বলেই এভাবে ওকে শাস্তি দিচ্ছে লোকটা। গাড়িতে ঘুমানো কি কোনো অপরাধের পর্যায়ে পরে? জানা নেই বর্ষার।
রাত বাড়ছে। বর্ষা বারান্দার গ্রিলে হাত রেখে ভাবনার অতলে ডুবে যায়। ক্রমশ বিষন্নতার স্রোতে অবগাহন করে তার ছলাকলাহীন অচতুর মন। বৃষ্টির উত্তরকালীন স্বচ্ছ শীতল ঝিরিঝিরি বাতাস তখন বারান্দা জুড়ে। শহরের বাতিগুলো সব নিভে গেছে। রাতের অন্ধকারের ঘনিষ্ঠতা ওকে আরও নিবিড় ভাবে একলা করে তুলছে। ঘরের বাতিটাও তখনি নিভিয়ে দিল নাব্য।
বর্ষা ভেবেছিল এইবার হয়তো সে আসবে। কান খাড়া রেখেছিল সে। না! কেউ আসেনি!
কিয়ৎক্ষন পর পেছন ফিরে দেখল নাব্য নিশ্চিন্তে অঘোরে ঘুমোচ্ছে। রাত্রির কালিমা যেন আঁধারের অমসৃণ প্রলেপ ঢেলে দিয়ে গেল বর্ষার বুকজুড়ে। সে যে কোনোদিন আসবেও না, এই সহজ কথাটা হুট করে বুঝে গেল বর্ষা। সাথে আরও একটা ব্যাপার যেন ভাসা ভাসা বুঝল। কিছু একটার সঙ্গে জড়িয়ে গেছে সে। খুব সন্তর্পণে, মনের অজান্তে….।
একটা অদ্ভুত, অচেনা অনুভূতির সতেজ পরিমল তার নাকে এসে লাগছে। বর্ষা জানে। এই সতেজ-সুগন্ধি পরিমল মানুষের জীবনে খুব অল্প সংখ্যক বার আসে। যখন আসে। আয়োজন করে, একরাশ ঐশ্বরিক আভা নিয়ে, খুব সঙ্গোপনে এসে মনস্য জীবনে বিস্তার লাভ করে। বর্ষাও কি তবে সেই আভার দেখা পেল? তাও এমন ভুল সময়ে!
তবে কি সেও ভালোবাসতে শুরু করেছে? যদি তা নাই হয়, এই অন্তঃকরণ জুড়ে কেন এত তীব্র হাহাকারের নিনাদ? কেন বারবার সেখানে অনুরণিত হচ্ছে একটি নাম? হৃদয়ের ঝরোকা বেয়ে যে যাতনা ক্রমশ সঞ্চারিত হচ্ছে তার রুপ যে এতো ভয়াবহ। কোনোদিন তা জানা ছিল না বর্ষার। এই ভালোবাসা দিয়ে কি হবে? কার জন্য সঞ্চিত রাখবে সে এই অনুরক্তি?
‘ভালোবাসা যে রাত্রির নিগূঢ় আঁধারেরই মতো জীবনে এসে জড়ায়। যেখানে রাত্রি নেই সেখানে ভালোবাসাও নেই! ‘
প্রলম্বিত দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বর্ষা একটা কবিতার পঙক্তিমালা বলে উঠল বিরবির করে –
তুমি বলেছিলে ক্ষমা নেই, ক্ষমা নেই।
অথচ ক্ষমাই আছে।
প্রসন্ন হাতে কে ঢালে জীবন শীতের শীর্ণ গাছে।
অন্তরে তার কোনো ক্ষোভ জমা নেই।
তুমি বলেছিলে, তমিস্রা জয়ী হবে।
তমিস্রা জয়ী হলো না।
দিনের দেবতা ছিন্ন করেছে অমারাত্রির ছলনা;
ভরেছে হৃদয় শিশিরের সৌরভে।
তুমি বলেছিলে, বিচ্ছেদই শেষ কথা।
শেষ কথা কেউ জানে?
কথা যে ছড়িয়ে আছে হৃদয়ের সব গানে, সবখানে;
তারও পরে আছে বাঙময় নীরবতা।
এবং তুষার মৌলি পাহাড়ে কুয়াশা গিয়েছে টুটে,
এবং নীলাভ রৌদ্রকিরণে ঝরে প্রশান্ত ক্ষমা,
এবং পৃথিবী রৌদ্রকে ধরে প্রসন্ন করপুটে।
দ্যাখো, কোনোখানে কো্নো বিচ্ছেদ নেই।
আছে অনন্ত মিলনে অমেয় আনন্দ, প্রিয়তমা।
______নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী
চলবে…….
★অদ্রিজা আশয়ারী।
একদিন নববর্ষা -২৩
অদ্রিজা আশয়ারী
___________
একটি কবিতার মতো মেয়ে সারাদিন বিচরণ করে বেড়ায় আমার ঘরজুড়ে। কবিতার মতোই স্নিগ্ধ তার সকল কথামালা। সে যখন হাটে, কটাক্ষ-বানে নিবদ্ধ করে চারপাশ। তা যেন কবিতার লহু পঙক্তির মতো অসামান্য হয়ে ধরা দেয়। সে যা বলে তাই যেন কবিতা হয়ে ওঠে। আমি অনুভব করি, আমার সাদাকালো ঘরে আজ রাশি রাশি রঙ্গিন কিরণের অপচ্ছায়ার জড়ো হওয়া তার সন্ধানে।
সেই কবিতার মতো মেয়ে। আমার কাগজে কলমে লিখিত স্ত্রী। যাকে আমি ভালোবাসি না। সারাবেলা শুধু অনুভব করি একটা ভীষণ স্নিগ্ধ সুন্দর কবিতার মতো। আমার জীবনের কোনো বাঁকে, কোনো চোরাভূমে ওর অস্তিত্ব নেই। শুধু লেখক বলেই, নিজের তৃতীয় সাহিত্যিক চক্ষু দ্বারা ওকে আমি বিশেষ ভাবে নিরিখ করতে পারি। ওর জন্য চাহনিতে আমার কোনো ভালোবাসা কিংবা মুগ্ধতার স্থান নেই! প্রকৃতির সবুজ যেমন আমাদের চোখকে আরাম দেয়। জঞ্জালে ভরা শহর দেখে অভস্ত্য চোখে, সবুজ দেখলে যে প্রশান্তির পর্যাপ্তি আসে। সেই পর্যাপ্তি আমি বর্ষাকে দেখলে পাই। এর বেশি আর কিছু না। মেয়েলি সৌন্দর্যে পুরুষোচিত যে আর্কষণ তা কখনো বর্ষাকে দেখলে আমার হয় না। সে শুধুই একটি স্নিগ্ধ পঙক্তিমালার কবিতা হয়ে আমার জীবনে কাঁটার মতো আঁটকে রয়েছে।
___________________________
আজকাল আর ব্যাপার গুলো সহজ, অতিক্রমযোগ্য থাকছে না। নিজেকে সম্পুর্ন একজনাতে উজার করে দিয়ে আমি যখন হয়েছি শূন্য, পরাভব। আম্মা তখন নিজের জেদ, দাবি মেনে নিতে বাধ্য করলেন আমায়। ভেঙেচুরে যাওয়া আমাকে নিয়ে খেলায় মত্ত হয়ে জীবনের নতুন এক রঙ্গমঞ্চের দিকে ঠেলে দিলেন তিনি। আমি একজনের ঘোরে আটকে থেকে, স্ত্রীর মর্যাদা দিলাম অন্য আরেকজন কে। পত্রিকায় বড় বড় অক্ষরে ছাপা হলো, “পুরনো বাগদত্তাকে ছেড়ে, এবার পরিবারিক ভাবে অন্য একজনের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলেন সময়ের জনপ্রিয় লেখক নাব্য ইমতিহান! নাব্যর এমন সিদ্ধান্তে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন তার ভক্তকুলের বড় অংশ। অনেকে এটাকে তার প্রাত্তন বাগদত্তার সঙ্গে প্রতারণা হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। ”
চারিদিকে নানান গুঞ্জন উঠতে লাগলো। এসবের মাঝখানে খুব সুক্ষ্ম একটা ব্যাপার সবার নজর এড়িয়ে গেল। আমাদের এই মান অভিমানের গোপন দ্বন্দ্বে সম্পুর্ন নির্দোষী একটি মেয়ে নিবিড় ভাবে জড়িয়ে গেছে। সে কোনো অপরাধ করেনি। অথচ আমাদের সকল ক্ষোভের একমাত্র লক্ষ্যবস্তুতে পরিনত হয়েছে। আমি কখনো এই বর্ষাকে ভালোবাসতে পারবো কিনা জানি না। ওকে দেখলেই আম্মার নেয়া ভুল সিদ্ধান্ত, বর্ষার আমাকে ছেড়ে চলে যাওয়া। এ সবকিছু একসাথে মনে পরে আমার। রাগের তরঙ্গ প্রবাহিত হতে থাকে শরীরের প্রতিটি শিরা-উপশিরায়। তখন মনে হয় মেয়ে মানেই ছলনাময়ী। এই মেয়েটিও নিশ্চয়ই ব্যাতিক্রম নয়! হয়তো সেও জীবনে বহু ছেলেকে নিজের সৌন্দর্যের ফাঁদে ফেলেছে, তারপর ফণিনীর ন্যায় রুপ বদলে ওদের অন্তঃকরণ আঘাতে জর্জরিত করেছে।
কাছের মানুষজন ও নিজের একক আবর্তন ছেড়ে আজকাল আমি যতটা সম্ভব দূরে থাকার চেষ্টা করি। ওদের কাছে এলেই প্রতারণার প্রকট ভেপসা গন্ধ নাকে এসে লাগে। আর একা হলেই মস্তিষ্কে হা’না দেয় বর্ষার স্মৃতি….। এরচেয়ে সারাদিন অফিসে বসে, অচেনা লোকের ভিরে, মায়াহীন সময়ের আবর্তে আমি বেশ আছি। এখানে কারো থেকে কোনো বিশেষ কিছু চাওয়ার নেই, স্মৃতি রোমন্থনের মতো বাজে কাজে ব্যায় করার পর্যাপ্ত সময়ও হাতে নেই। অতএব অফিস হয়ে পড়ল আমার স্বস্থিতে নিশ্বাস ফেলার একমাত্র স্থান!
এর মাঝেও নানান কিছু ঘটতে থাকল। যা বাঁধা দেয়ার ক্ষমতা ছিলনা আমার।
***
বর্ষা মেয়েটি ভীষণ বোকা। হয়তো খুব অভিমানীও। আমরা একঘরে থাকি, ঘুমাই। আমাদের মাঝে কথা হয়না। চোখাচোখি হলে শীঘ্র দুজনে অন্যদিকে চোখ সরিয়ে নেই। কখনো কখনো সে আমাকে নিভৃতে প্রত্যক্ষণ করে। আমি জানি।
হয়তো ভাবে লোকটা এমন অনুভূতি শূন্য পাথর কেন!
কেউ জানে না এক ঘরে থেকেও আমাদের দূরত্ব নিঃসীম! অচেনা লোকের মতো আমাদের বসবাস। একক ঘরে আমরা দুজন ভীষণ দূরের কেউ!
এভাবেই কেটে যাচ্ছিল আমাদের ধূসর সময়। এক দুপুরে, ক্লান্ত থাকায় সেদিন দুপুরের খাবার পর অফিসে না গিয়ে ঘরে বসেই ল্যাপটপে কাজ করছিলাম। বর্ষা হঠাৎ কোথা থেকে উড়ে এল। ঘরে এসে উদ্দেশ্যহীন ভাবে এটাসেটা নাড়াচাড়া করতে লাগলো। একবার আড়চোখে ব্যাপার টা দেখে নিয়ে আমি আবার কাজে মন দিলাম। এমন আচরণ ওর নতুন নয়।
কালো পাড় দেয়া হলুদ মিহি সুতির শাড়ি, অনৃজু কটিদেশ পর্যন্ত ছেয়ে থাকা কোঁকড়া চুল, ঘামে চিকচিকে মুখে দুপুরের রোদ্দুরের লুকোচুরি খেলা। স্নিগ্ধ সেই কবিতার মতো মেয়েটি বিষন্ন, ঝিমধরা দুপুরকে যেন হাজার রঙে রাঙ্গিয়ে তুলল শুধু মাত্র ওর অস্তিত্বের স্নিগ্ধতার রেশে।
তারপর নিরবতা ভেঙে অকস্মাৎ কথা বলে উঠল সে। ঘরে কেউ না থাকার চেয়ে আমরা দুজনেই যখন ঘরে থাকি তখন ঘরটা নিশ্চুপ থাকে বেশি। আমি এলে বর্ষা ঠাই নেয় লাইব্রেরি রুমে। সেখানে বই হাতে বসে থাকে ঘন্টার পর ঘন্টা। জাননামাযেও সময় কাটায় বহুক্ষণ। পারতপক্ষে আমি ওর মুখোমুখি হইনা কখনো।
মুখে আঁধারের ভ্রুলেখা এঁকে মাথা নিচু করে শাড়িতে আঙুল পেচাতে পেচাতে কয়েক হাত দূরে দাঁড়িয়ে বর্ষা বলল,
“আমি বাড়ি চলে যাবো। আমাকে রেখে আসুন।”
আজকের আগে কখনোই সে নিজে থেকে যেচে এভাবে কথা বলেতে আসেনি আমার সঙ্গে। সেই প্রথম থেকে আমি ওকে উপেক্ষা করে আসছি বলেই হয়তো। বলতেই হবে, বোকা হলেও মেয়েটির আত্মসম্মান বোধ প্রবল! আমি ল্যাপটপ থেকে চোখ সরিয়ে ওর দিকে মনযোগী হলাম।
বললাম,
-” কেনো?”
বর্ষা একবার চট করে তির্যক দৃষ্টি হেনে তাকাল আমার দিকে। পরমুহুর্তে চোখ সরিয়ে নিল। তার বিষন্ন মুখে ছায়াপথ ঘটাল অসংখ্য অস্থির শিরার কম্পন। কেন যেন মনে হলো আমার প্রশ্ন ওর মনে ক্রোধের উদ্রেক করেছে। সে মুখ কালো করে দাঁড়িয়ে অস্থির ভাবে হাত কচলাতে লাগল। উত্তর করল না। কিঞ্চিৎ থেমে আমি বললাম,
-“ঠিকাছে। নিয়ে যাবো। ”
প্রায় সঙ্গে সঙ্গে সরোষে বর্ষা বলল,
-” আমি আজকেই চলে যাবো । আমাকে এক্ষুনি রেখে আসুন।”
আমি ওকে ভালো করে খেয়াল করে দেখলাম। বর্ষার মুখজুড়ে ক্রোধের প্রকম্পিত রেখা, পিঙ্গল চোখের কিনারায় জল জমেছে। যেন চোখ ফেটে রক্তবিন্দু হয়ে ঝরে পড়বে এক্ষুনি। এমন উত্তেজিত স্বরে সে আমার সঙ্গে কথা বলতে পারে আমি ভাবতেই পারিনি!
প্রতুত্তরে মুখ গম্ভীর করে বললাম,
“আজ আমার সময় হবে না। কাল নিয়ে যাবো।”
-“থাক! আপনাকে নিয়ে যেতে হবে না। আমি একাই চলে যাবো।” বলে মুহুর্তে ঘুরে দরজায় দড়াম শব্দ করে ঘরছেড়ে বেরিয়ে গেল সে। আমি কিয়ৎক্ষন স্তব্ধ হয়ে বোঝার চেষ্টা করলাম ঠিক কি কারণে আজ ও এমন মরিয়া হয়ে চলে যেতে চাইছে।
আচমকা কাল রাতের ঘটনা টা মনে পড়ল। বর্ষা কি কাল অপমানিত বোধ করেছিল আমার আচরণে?
___________________________
জীবনে করা কোন পাপের মাশুল গুনছে আজকের এই অভিশপ্ত সময়ে এসে জানা নেই বর্ষার। তপ্ত দুপুরে, চিল গুলো যখন মধ্যাকাশে লক্ষ্যহীন ভাবে উড়ে বেড়ায়, দলছুট সাদা মেঘেরা নেমে এসেছে পৃথিবীর খুব কাছে। নাব্যদের দিতল বাড়ির ছাদে নিবিড় হয়ে বসে বর্ষা তখন জীবনের হিসেব কষে। এইমাত্র সে নাব্যর ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে। রাগে, দুঃখে, অপমানে বর্ষার চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরছে অবিরত। বারবার চোখ ফেরাচ্ছে সে ছাদের কার্নিশে। ওখান থেকে লাফিয়ে পড়লেই তো হয়, জীবনের সব জ্বালা চিরতরে জুড়িয়ে যায়। কিন্তু এটা সে কখনো করতে পারে না। যে জীবনের মালিক সে নিজে নয়। রবের পক্ষ থেকে মাত্র কিছুদিনের জন্য আত্মাটা তাকে সপে দেয়া হয়েছে শুধু। সেই জীবন নিয়ে যা খুশি তা করতে পারে না সে। প্রতিটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ব্যাপারের হিসেব যখন দিতে হবে, সেই সময়ের ভয় করে বর্ষা!
বর্ষা আকাশের দিকে অভিমানী চোখে তাকায়।
মনে পড়ে পবিত্র কুরআনের একটি আয়াত।
“আকাশের দিকে তোমার বারবার তাকানোকে আমি অবশ্যই লক্ষ্য করি। ”
আকাশের বিশালতার পানে একদৃষ্টে চেয়ে মনে মনে সে বলে,”হে আল্লাহ, আমি আপনার অতি দুর্বল, গাফেলের চেয়েও গাফেল বান্দা। আপনি আমাকে পরীক্ষায় ফেললে আমি নিঃশেষ হয়ে যাবো। আপনি আমাকে অনুগ্রহ করুন। আপনার অপরিসীম ক্ষমা ও রহমত দ্বারা আবৃত করুন। আপনি আমার জন্য সহজ করে দিন সকল পরিস্থিতি। আর আমাকে সবর করার তাওফিক দিন। ”
বলে বর্ষা আকাশের পানে চুপচাপ চেয়ে থাকে। জল গড়িয়ে পড়তে থাকে গাল বেয়ে। চোখে ভেসে ওঠে গতরাত্রির ঘটনা –
আগের দিন দুপুরে। সকলে যখন ডাইনিংয়ে খাওয়া-দাওয়ায় ব্যস্ত। বর্ষাও এসে দাড়িয়েছে। সেদিকে একবার তাকিয়ে রাফিয়া নাব্যকে উদ্দেশ্য করে বললেন -“নবু বিকেলে বর্ষা কে নিয়ে একটু ঘুরে আয়। বিয়ের এতদিন হয়ে গেল কোথাও গেলি না তোরা। আজ যা।”
নাব্য হ্যাঁ-না কিছু না বলে মাথা নিচু করে খেতে লাগলো। ওপাশ থেকে দাদি আর নিতিন একযোগে মাথা নেড়ে এই রায়ের পক্ষে সায় দিলো। রাফিয়া বর্ষার দিকে একবার তাকিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে আপন মনে বললেন -“বিকেলে তৈরি থেকো।”
নাব্য উত্তর করল,
“বিকেলে আমার অন্য কাজ আছে। কোথাও যেতে হলে সন্ধ্যের পর যেতে হবে। ”
রাফিয়া বললেন,
“আচ্ছা তোর যখন ইচ্ছা। রাতে তাহলে বাইরেই ডিনার করবি তো। নাকি?”
নাব্য অনিচ্ছা সত্ত্বেও বলল,
“হ্যাঁ। ”
-” বর্ষা শুনেছো তো? তৈরি থেকো কিন্তু। ”
শাশুড়ী মার কথা শুনে বর্ষা কেবল ওপর নিচ মাথা নাড়লো।
সেদিন সারা বিকেল বর্ষা ঘরজুড়ে অস্থির পায়চারি করে নানান কথা ভাবল। নাব্যর তাকে নিয়ে ঘুরতে যেতে রাজি হওয়ার কোন কারণ নেই। তাই তৈরি হওয়ার কোনো প্রশ্নই আসে না।অথচ শাশুড়ী মার অবাধ্য হতেও তার মন সায় দিচ্ছে না।
রাতে এশার আজান কানে আসতেই লাফিয়ে উঠে বসলো বর্ষা। মাগরিবের সালাতের পর ভাবতে ভাবতে কখন চোখ লেগে এসেছিল বুঝতে পারে নি। আযানের পর ইকামতের সময় দো’আ করাটা বর্ষার অভ্যেসে পরিনত হয়েছে। আজকাল ওর দো’আর একটা বড় অংশ বাধিত থাকে নাব্যর জন্য। আজও সে অনেক সময় নিয়ে দো’আ করল নাব্যর জন্য, নাব্যর হিদায়াতের জন্য, সার্বক্ষণিক সুস্থতার জন্য। তারপর ওযু করে এসে সে সালাতে দাড়ালো। সালাত শেষে হওয়ার পরও অনেকক্ষণ জায়নামাযে বসে রইল।
-“ভাবি তুমি এখনো তৈরি হও নি? আম্মা আমাকে দেখতে পাঠালো তোমরা বেড়িয়েছ কিনা।” নিতিন দরজায় কড়া নেড়ে মুখ বাড়িয়ে বলল।
বর্ষা কি বলবে ভেবে পেল না। তৈরি হয়ে বসে থেকে হবেটা কি? নাব্য আদৌও আসবে কিনা সেটারই তো নিশ্চয়তা দেয়নি ওকে।
-“হচ্ছি, এখনি তৈরি হচ্ছি।” বলে সে চুপ করে গেল। একবার ভাবলো নিতিন কে জিজ্ঞেস করে তার ভাই কোথায়। সে আদৌ যাবে কি না। কিন্তু এই প্রশ্ন টা যে নিতান্তই অযৌক্তিক সাথে সাথেই বুঝতে পারলো সে।
-“ভাবি দেরি করো না। দাভাই কিন্তু কারো জন্য অপেক্ষা করে বসে থাকা একদম পছন্দ করে না। ”
বর্ষা মনে মনে ভেংচি কেটে বললো -“তোমার দাভাই শুধু এটা কেন আরও একটা জিনিস ভীষণ অপছন্দ করে। সেটা হলো আমি। হ্যাঁ আমাকেই তো সবচেয়ে বেশি অপছন্দ করে তোমার দা ভাই!”
নিতিনের আজকাল একটু একটু ভাব জমতে শুরু করেছে বর্ষার সাথে। সে উৎসুক হয়ে বলল -“আচ্ছা! আজ কোন ড্রেসটা পড়বে তুমি আমাকে দেখাও তো!”
-“বোরকাই তো!” বর্ষা দায়সারা উত্তর দিল।
-“আজকেও বোরকা পড়বে ভাবি? সিরিয়াসলি! এই কালো পোশাক টা একদম মানাবে না আজকের উপলক্ষের সাথে। অন্তত একটু সাজগোছ তো করতে পারো।”
বর্ষা মুচকি হাসল -” হুমম….আচ্ছা তুমিই বলো তো রবের সন্তুষ্টির জন্য যে সবসময় নিজেকে আবৃত রাখে। প্রচন্ড গরমে ঘেমে একাকার হলেও শুধু আল্লাহর আদেশ পালনের জন্যই এই কালো কাপড় গায়ে জড়িয়ে রাখে। তারপর সে যদি কোনো কারণে একদিনের জন্য নিজেকে অনাবৃত করে ফেলে। সেটা কি ডাবল স্ট্যান্ডার্ড হয়ে গেল না?
আল্লাহর সমস্ত বিধান আমাদের ভালোর জন্যই। একটি মেয়ে আটসাট কাপড়ে, সেজেগুজে রাস্তায় বেরোলে মানুষ রুপি হায়নারা কি জঘন্য দৃষ্টিতে তাদের দেখে তুমি খেয়াল করেছো কখনো? আমরা কি এতোই ঠুনকো! ইসলামে মেয়েদের তুলনা করা হয়েছে রানীর সাথে। আমরা তাই রানীর বেশেই থাকব। রাস্তার ওসব মশা-মাছি আমাদের দেখবে, মন্দ কল্পনা করবে আমাদের নিয়ে। এতো সস্তা আমরা কেনো হবো? আরেকটা ব্যাপার কি জানো? সবাইকে সবার নিয়তের ওপরেই প্রতিদান দেয়া হবে পরকালে। পর্দাকে আমরা যদি নিজের সুবিধা অনুযায়ী ব্যাবহার সামগ্রী করে তুলি সেটা হাশরের ময়দানে আমাদের বিরুদ্ধেই কথা বলবে। ”
নিতিন ভাবুক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। মনে হচ্ছে বর্ষা কোনো ভুল কথা বলেনি।
কিঞ্চিৎ থেমে সে বলল, “পুরোপুরি ভুল বলনি ভাবি। আচ্ছা তুমি বোরকাই পড়ো।”
বর্ষা তৈরি হয়ে বসে রইল। মুখ থমথমে। চিন্তায় অস্থির। আজ বোধহয় বাড়ির সকলের সামনে তাকে অপমানিত হতে হবে। নাব্য তো তাকে নিয়ে যাবেই না। মাঝখান থেকে সবার অসংখ্য প্রশ্নের সম্মুখীন হবে সে। আনমনে এসব ভাবতে ভাবতে বর্ষা চোখের কোণ দিয়ে সিড়ির দিকে তাকাতেই দেখল নাব্য শার্টের হাতা ফোল্ড করতে করতে নামছে। আকাশি রঙা মেন্ডারিন কলার শার্টে ওকে সুন্দর দেখাচ্ছিল। সেদিকে তাকিয়ে বর্ষার মন আদ্র হয়ে এল। মনের কোণে কোথায় যেন একটা কথা অনুরণিত হতে লাগলো।
– এই সুন্দর, সুপুরুষ বরটি শুধু আমার! ”
_______________
গাড়িটা জিয়া উদ্যানের রাস্তা ধরে এগিয়ে চলেছে। ওদের গন্তব্য কোথায় এখনো জানে না বর্ষা। সে জানালায় হেলান দিয়ে বসে বাইরে তাকিয়ে আছে। প্রচন্ড বাতাস বারবার নাব্যর গোছানো চুল এলোমেলো করে দিচ্ছে। বর্ষা খানিক পর পর আড় চোখে সেদিকে তাকাচ্ছে।
শুক্লপক্ষের মস্ত রুপোলী চাঁদটা ওদের সঙ্গে সঙ্গে চলেছে। রাস্তার পাশের কৃষ্ণচূড়া গাছগুলোর ফাঁকে ফাঁকে চাঁদের আলোর উজ্জ্বল রেখা।
সহসা নাব্যর ফোনে কল এলো। গাড়ি থামিয়ে ফোনটা রিসিভ করলো সে। অনেকক্ষণ ধরে রিং হচ্ছিল। রিসিভ করে সে গাড়ি থেকে বেরিয়ে কিছুটা দূরে গেল কথা বলার জন্য। বর্ষা দেখলো কিছুক্ষণ পর রাস্তার পাশে ওদের ঠিক সামনেই আরেকটা গাড়ি এসে থামলো। গাড়ি থেকে এক দম্পতি বেরিয়ে সোজা এগিয়ে গেল নাব্যর দিকে। জানালায় মুখ রেখে পুরো ব্যাপারটাই বর্ষা প্রত্যক্ষ করছিল। সে স্পষ্ট দেখল সেই লোকটি ও তার পাশের মেয়েটিকে দেখে নাব্যর মুখের রেখা কেমন মুহুর্তে পালটে যেতে। মনে হলো যেন কি ভয়ানক, দুঃসহ এক ছবি ভেসে উঠেছে ওর সামনে। লোকটি অনেক কথা বলে গেল। কিন্তু তার পাশের মেয়েটি কিংবা নাব্য কেউ কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না। একসময় তারা বিদায় নিয়ে চলে গেল। যেতে যেতে সেই মেয়েটি আড়চোখে তাকালো গাড়ির ভেতর বসে থাকা বর্ষার চোখে। তার চোখের চাহনি অস্বাভাবিক। এই দৃষ্টির মানে কি বর্ষা জানে না!
প্রায় বিশ মিনিট পেড়িয়ে গেল। নাব্য ফিরছে না। বর্ষার অস্থিরতা বাড়ছে। কি এত কথা! কার সঙ্গে এত কথা বলে লোকটা ফোনে?
আর এভাবে বসে থাকা সম্ভব হচ্ছে না। বর্ষা ডানে ঝুকে নাব্যর সিটের দরজাটা ধা’ক্কা দিতেই সেটা খুলে গেল। বর্ষা বেরিয়ে এল গাড়ি থেকে। নাব্য দূরে দাঁড়িয়ে ছিল। বর্ষা সেদিকে এগিয়ে গেল। পেছনে কারো অস্তিত্ব টের পেয়ে নাব্য ঘুরতেই বর্ষা অবাক হয়ে দেখল মুখভর্তি ধোঁয়া ছেড়ে সিগারেট ফুঁকছে নাব্য। মুখের রঙ ভীষণ ফ্যাকাসে। চোখদয় রক্তিম।
বর্ষা কিয়ৎক্ষন হা করে তাকিয়ে থেকে আহত স্বরে বলল,
-“আপনি স্মোক করেন?”
নাব্য প্রতুত্তর দেয়ার প্রয়োজন বোধ করল না। হাটতে আরম্ভ করল গাড়ির দিকে। বর্ষা তার পশ্চাদপসরণ করল৷ কিন্তু নাব্যর সঙ্গে তাল মিলিয়ে হাটা অসম্ভব। রীতিমতো দৌড়ে তার নাগাল পেতে হলো বর্ষাকে। গাড়ির সামনে গিয়ে সজোরে দরজা খুলে বর্ষাকে একপ্রকার জোর করে টেনে ভেতরে বসিয়ে দিল নাব্য। ঘটনার আকষ্মিকতায় হতভম্ব হয়ে পড়ল বর্ষা। কিছু বুঝে উঠবার আগেই সুইচ টিপে গাড়ির কাচ নামিয়ে, চাবি পকেটে পুরে অন্যপাশের দরজাটা লাগিয়ে উল্টো পথে হাটাল ধরল নাব্য। বর্ষা গাড়িতে বসে হতবুদ্ধি হয়ে তাকিয়ে রইল। তার সামনে দিয়ে নাব্য হেটে চলে গেল। সে প্রথমটায় কিছু বুঝে উঠতে পারলো না। জানালার বন্ধ কাচে দুহাতে আঘাত করে বলতে লাগল,
-” শুনছেন, আপনি কোথায় চলে যাচ্ছেন? আমাকে একা ফেলে এভাবে চলে যাচ্ছেন কেন? বিদুৎ চমকাচ্ছে। খানিক বাদেই যে বৃষ্টি নামবে। আমার খুব ভয় করছে। আপনি যাবেন না। প্লিজ… ”
বোকা মেয়েটা জানে না বদ্ধ কাচের ভেতর থেকে বাইরের পৃথিবীকে দেখা গেলেও ভেতরের মানুষটিকে দেখেনা কেউ। ডাকলে সেই ডাক পৌছায় না কারোর কানে।
চলবে……..।
একদিন নববর্ষা -২৪
অদ্রিজা আশয়ারী
____________
রাত বাড়ছে। বাইরে প্রকৃতি জুড়ে ঝড়ের প্রলয় হুংকার। গাড়ির গায়ে বৃষ্টির সুচ্যগ্র বিন্দু ভীতিকর শূন্যতার সঞ্চার করছে মনে। বর্ষা মতিচ্ছন্ন হয়ে একলা বসে আছে সেই নিবিড় বদ্ধস্থানে। সে যেন চিন্তাশক্তি হারিয়ে ফেলেছে। মাথাটা সম্পুর্ন ফাঁকা লাগছে ওর। সে কি আবারও খানিক কাঁদবে? কাঁদলে কি এই দুর্বোধ্য সময়ের জাল থেকে বের হতে পারবে সে? কি অপরাধে, কোন দুঃসাহসের পরিণামে আজ এসব ঘটছে তার সঙ্গে! জানা নেই এর কোনো বিশ্লেষণ!
জন্মের পর বাবা শখ করে নাম রেখেছিলেন বর্ষা। অথচ সেই বর্ষা নামের মেয়েটি কোনো এক অজানা কারণে ছোট কাল থেকেই বৃষ্টিকে ভয় পেতে শিখল। আকাশ ভেঙে বৃষ্টি পড়তে আরম্ভ করলেই ওর আত্মা খাঁচাছাড়া পাখির মতো ছটফট করত! ভয়ে বাবা-মায়ের শিয়রে গিয়ে বসতো সে।
আজকের রাত্রির এই বৃষ্টি ভয়ের সাথে সাথে ডানায় ভর করে বর্ষার জন্য নিয়ে এসেছে একরাশ যাতনা আর হৃদয় খা খা করা শূন্যতার ভেজা অসুখ! আতঙ্ক আর বিষাদের জটিল মিশ্রণে বুদ হয়ে, গাড়ির এক কোণে জড়োসড়ো, সিটে গা হেলিয়ে বসে রইল বর্ষা। এভাবে বসে আছে সে নাব্য চলে যাওয়ার পর থেকেই। কতক্ষণ কাটল কে জানে! সময়ের হিসেব রাখেনি সে। শীতল ভেজা চোখে মাঝে মাঝে সে দেখল সাঁইসাঁই করে গাড়িগুলো পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে ওকে। সবার যে ঘরে ফেরার তাড়া ভীষণ। এমন বৃষ্টির রাত্রিতে একক এবং নিঃসঙ্গ হয়ে কে বা বাইরে থাকতে চায়!
কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে কান্না থামিয়ে দিল সে। দিশেহারা চোখদুটো জানালায় রেখে বসে রইল নির্নিমেষ। বৃষ্টি থামার কোনো লক্ষন নেই তখনো। আচমকা ছাতা মাথায় গাড়ির বাইরে কাউকে এসে দাঁড়াতে দেখল বর্ষা। লোকটা গাড়ির চারপাশে চক্কর কাটল একবার। তারপর এসে দাঁড়াল দরজার কাছে। না, কখনোই এটা নাব্য নয়। নাব্যর প্রতিটি পদক্ষেপ পর্যন্ত বর্ষার মুখস্থ!
মুহুর্তে শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোত নেমে গেল বর্ষার। যাওয়ার সময় গাড়িটা বাইরে থেকে লক করে গেছিলো নাব্য। অতএব চুপচাপ দেখে যাওয়া ছাড়া কিছু করার নেই ওর। তার এবং সেই আগন্তুকের মাঝে এখন কেবল একটি সিট ও একটা দরজার দুরত্ব। সে আরও গুটিসুটি মেরে বসল। বৃষ্টির সময় দো’আ করলে তা কবুল হয়। তাই সে মনে মনে বারবার আল্লাহর কাছে সাহায্য চেয়ে দো’আ করতে লাগল৷
লোকটা চাবি ঘুরিয়ে গাড়ির দরজা খুলতেই বর্ষা ভীষণ চিৎকা’র করে উঠল।
সঙ্গে সঙ্গে রশু নম্র স্বরে বলল,
–“ভাবি আমি রশু। নবুদা আমাকে পাঠিয়েছেন। আপনাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য।”
বলে ছাতা হাতে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল গাড়ির বাইরে।
বর্ষা তখনো কুঁকড়ে বসে আছে। এখনো ঠিক ঠাওর করতে পারছে না সে ব্যাপার টা।
অন্যপাশ নিশ্চুপ দেখে বিরতি নিয়ে রশু ফের বলল,
-” ভাবি, আমি দরজা খুলে দিচ্ছি। আপনি একটু কষ্ট করে পেছনের সিটে এসে বসুন।” বলে সে নিজেই হেটে বর্ষার পাশের দরজা খুলে ছাতা বাড়িয়ে দিল বর্ষার দিকে। বর্ষা আড়ষ্টভাবে বেরিয়ে গিয়ে পেছনের সিটে বসল।
তুলনামূলক কম সময়েই গাড়ি পৌঁছে গেল ধানমন্ডি। একেই বর্ধিত রাত, তার ওপর বৃষ্টি। পুরোটা সময় বর্ষা তমসাছন্ন হয়ে বসে রইল। নিজেকে তার মনে হতে লাগলো কোনো পুরনো বাড়ির অকেজো হয়ে যাওয়া আসবাব! স্বামীর কাছে তার মূল্য এতটা অর্থহীন যে বিনা অপরাধে ওকে এভাবে আধরাতে রাস্তায় একা ফেলে চলে যেতেও ওই লোকটির বাধে নি। নূন্যতম বিবেক বোধ দেখাতেই বোধহয় এখন সেক্রেটারিকে পাঠিয়েছে ওকে বাড়ি নিয়ে আসার জন্য।
গাড়ি থামলে স্থবির পা দুটোকে কোনো মতে টেনে নিয়ে তুলল বর্ষা ওপরে। ঘরে গিয়ে দেখল লোকটা তখনো ফেরেনি।
দরজাটা বন্ধ করে বর্ষা ওখানেই বসে পড়ল ধপ করে। নাব্য ঘরে থাকলে এঘরে তাই ঠাই মেলে না। চলে যায় সে লাইব্রেরি রুমে। সেখানেই ছোট-খাট একটা আপনা-ভূমি গড়ে নিয়েছে সে নিজের জন্য। আজ নাব্য নেই। তাই সেসব নিয়ে ভাবনাও নেই।
জীবনে এমন চরমভাবে অপমানিত এর আগে কখনো হয়নি সে। রশুও নিশ্চয়ই জানে নাব্য ওকে মাঝ রাস্তায় ফেলে চলে গেছিল। কাল নিতিন জানবে, শাশুড়ী মা জানবে। এবাড়িতে একমাত্র দাদিই ওকে সত্যিকার ভালোবাসে। সেই দাদিও নিশ্চয়ই জানবে! ভেবে অনুভূতি শূন্য মনে বিদ্রোহের ঝড় ওঠে বর্ষার৷ ভেজা শরীর নিয়ে মেঝেতে বসে সে চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করে। আর কিছুই ভাববার মতো শক্তি নেই ওর। জীবনের বাস্তবতার তিক্ত স্বাদের উপলব্ধি না পাওয়া আনকোরা মনে অকস্মাৎ এতো ঝড় নিতে পারছে না সে। এসব কি হচ্ছে, কেন হচ্ছে….. কাকে সে প্রশ্ন করে? কে দিতে পারবে এর জবাব….?
নাব্যর ভালো না বাসার কারণ……?
________________________
বৃথা মনোরথে, আশু অভিসারে, পড়িলাম সুনীল বেশ;
কাতর নয়ানে, সলাজ মুখানে, ফুলেতে সাজাই বেনি-কেশ।
আমি আবার চলি মোহন অভিসারে;
বলো আমি এতো দুঃখ পাই কোথায়ে রে…
বর্ষা আয়নার সামনে দাড়িয়ে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে নিজের প্রতিচ্ছবির দিকে।
গাঢ় বাদামি রঙা করমচা চোখ। সেই চোখে মোটা করে কাজল আঁকা। হালকা পুরু লাল ঠোঁট, ঠোঁটের কোণে একটা ছোট্ট তিল, ঠিক নাকের ডগায় আরও একটা। খোপায় লাগানো শুভ্র নাগচাঁপা ফুল।
গায়ে একরঙা খয়েরী সুতির শাড়ি। হাতে একই রঙের রেশমি চুড়ি। আয়নায় যে মেয়েটিকে দেখা যাচ্ছে সেই মেয়েটি কি সুন্দরী নয়? এমন মেয়েকে কি ভালোবাসা যায় না?
তবে ওই লোকটা কেন একবার ফিরেও তাকায় না! সে কি দেখতে এতটা বাজে? এখন যদি সে এভাবে রাস্তায় বেরিয়ে যায় কেউ কি মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকাবে না ওর দিকে? কেউ কি বলবে না, ‘শোনো কাজল চোখের মেয়ে, এই আমি হাত বাড়িয়ে দিলাম, শুধু একবার ভরসা করে দেখো!’
বর্ষা যদি তখন সেই বাড়ানো হাতে হাত রাখে তবুও কি ওই লোকটা চুপ করে থাকবে। তখনো কি তার একটুও হিংসে করবে না?
বর্ষার হঠাৎ চোখ ভিজে ওঠে। সে তো চায় ওই লোকটা হিংসে করুক। চোখে অজস্র ক্ষোভ নিয়ে কঠিন স্বরে বলুক,
-‘বর্ষা, তোমার এতো সাহস! তুমি এভাবে সেজেগুজে রাস্তায় বেড়িয়ে এলে? তুমি জানো না, কেউ তোমার দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকালে আমার কষ্ট হয়!’
বর্ষার চোখ বেয়ে বড় বড় ফোটায় অশ্রু ঝরতে থাকে। সে নাক টেনে দৃঢ় চোখে আয়নার দিকে তাকায়। সেদিকে তাকিয়ে হঠাৎ কেমন মরিয়া হয়ে ওঠে। দুহাতে ঘষে লেপ্টে দেয় চোখের কাজল। হাতের উল্টো পিঠে মুছে ফেলে লিপস্টিক। কাঁচের চুড়ি গুলো খুলে ছুড়ে ফেলতেই সেগুলো ঝনঝন শব্দে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে। যত্ন করে বাঁধা খোপাটাও সজোরে টেনে খুলে দেয় সে। খুলতেই একরাশ কোঁকড়ানো চুল ওর পিঠময় ছড়িয়ে পড়ে। দীঘল সে চুল গিয়ে ঠেকে কোমরে। বর্ষা কাঁদতে কাঁদতে বাথরুমের দিকে পা বাড়ায়। সেখানে গিয়ে ঝরনা ছেড়ে বসে থাকে অনেকক্ষণ। মনের কোনে তার আলপনা এঁকে যায় অজস্র বিক্ষিপ্ত কল্পনা। থেকে থেকে তার মনে হয় সে বুঝি কোনোদিন আর খানিক ভালো সময়ের দেখা পাবে না।
__________________________
বাবা হীন পৃথিবী টা আজকাল ভীষণ রুক্ষ লাগে নিতিনের৷ ছোট কাল থেকে বাবা ওকে একটা ডানা ভাঙ্গা পাখির মতো আগলে বড় করেছেন। বাবাময় সেই পৃথিবীতে দুঃখ নামক কোনো শব্দের উপস্থিতি ছিল না। নিতিনের আবদার যত অযৌক্তিকই হোক। সেটা পূরণে বদ্ধ পরিকর ছিলেন এমদাদ সাহেব।
নিতিনের বর্তমান বয়সটা বিপজ্জনক। ভিকারুননিসা নূন স্কুলের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী সে। ওর ক্লাসের সিংহভাগ মেয়ে যেখানে প্রেম নামক অসুখে আক্রান্ত হয়ে অহর্নিশি দিবাস্বপ্ন দেখায় ব্যাস্ত। সেখানে নিতিনের চিন্তার স্রোত এখনো সম্পুর্ন অন্য দিকে প্রবাহিত । তার আকাশ জুড়ে এখনো কেবল বাবার স্মৃতি, বাবাকে একটু ছোঁয়ার আকুতি, বাবার মুখটা খানিকের জন্য হলেও দেখতে পাবার তীব্র আকাঙ্খা।
আজকাল মা শাসন করলে তাই নিতিনের আকাশ ভেঙে অঝোর ধারায় বৃষ্টি নামে। এতো বেশি কষ্ট অনুভূত হয় যে সব ছেড়ে ছুড়ে অসীমে, তারাদের মাঝে হারিয়ে যেতে ইচ্ছে হয় ওর।
মানুষ এভাবে হুট করে চিরতরে হারিয়ে যায়! অস্তিত্বের কোনো চিহ্ন পর্যন্ত আর অবশিষ্ট থাকে না। এত নির্দয় কেন এই পৃথিবীর নিয়ম! তবুও নিতিন সয়ে যায়। এই ভেবে যে পরকালে তো নিশ্চিত ভাবে বাবার সঙ্গে ওর ফের সাক্ষাৎ হবে। সেই সাক্ষাতের পর তারা একে অপরের থেকে আর কখনো আলাদা হবে না এক মুহুর্তের জন্য। পরকালে আবার সবাই একসাথে হওয়ার ব্যাবস্থা যদি না থাকত। তাহলে হয়তো কেউই তাদের প্রিয়জন দের মৃত্যু এত অনায়েসে মেনে নিতে পারতো না।
একটা সময় পর সবার চোখের জল শুকায়। ওপারে মিলিত হওয়ার আশায়, এপাড়ে থেকেও বুকে স্বপ্ন জমায় কতো লোক। সদ্য জন্মানোর পরই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া নিষ্পাপ শিশুটির মা, স্বামী হারানো শোকাভিভূত স্ত্রী, পিতা-মাতা হারানো কত এতিম সন্তান….। তারা সবাই স্বপ্ন বোনে। ওপাড়ে একদিন নিশ্চিত ভাবে দেখা হবে এপাড়ে হারিয়ে ফেলা প্রিয় মানুষ গুলোর সঙ্গে। নিতিনও তাদের একজন। নিতিনের জানতে ইচ্ছে করে বাবা কেমন আছে ওই পৃথিবীতে। যেখানে জীবন ফুরাবার নয়।
এসব ভেবে নিতিনের চোখ ভিজে ওঠে। নিজের ঘরে বসে কাঁদতে থাকে সে। শাশুড়ীর আদেশে নিতিনকে ডাকতে এসে বর্ষা হতবাক হয়ে যায়। রাফিয়া আজ মেয়েকে একটু শাসন করেছিলেন। পিতৃসোহাগী মেয়ে। রাফিয়ার অপরাধবোধ হচ্ছিল। তাই বর্ষাকে নিতিনের খোঁজে পাঠিয়েছিলেন তিনি।
বর্ষা দৌড়ে এসে নিতিনের পাশে বসে ওকে জড়িয়ে ধরে। কোমল গলায় বলে,
-“কি হয়েছে আপু? তুমি কাঁদছো কেন? বলো আমাকে।”
নিতিন চোখ মুছে মরিয়া হয়ে বলে,
-” ভাবি, তুমি তো অনেক কথাই বলো। আমাকে একটা কথা বলো তো। যারা চিরতরে ওপাড়ে চলে যায় তারা কেমন আছে, ভালো আছে কিনা..সেসব জানার কই কোনো উপায় আছে ? বাবা কেমন আছে আমি জানতে চাই।”
বর্ষা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। শান্ত স্বরে বলে,
-“সেখানে কে কেমন আছে সেটা একমাত্র আমাদের রব-ই সবচেয়ে ভালো জানেন গো আপু। তবে পরকালে নিজের বাবা-মায়ের ভালো থাকার পথটা কিছুটা হলেও যেন ত্বরান্বিত হয় সন্তান হিসেবে সেই চেষ্টা আমরা অবশ্যই করতে পারি। বাবা-মা পৃথিবীতে নিজেদের জন্য সবচেয়ে উপকারী যে জিনিস টা রেখে যায় সেটা হলো একজন ভালো সন্তান। তোমার বাবাও মারা গেছেন। আমলের পথ বন্ধ হয়ে গেছে ওনার৷ এখন কিছু নেকি অর্জনের জন্য তিনি তোমাদের পথ চেয়ে আছেন। তোমার নফল রোজা, নফল সালাত, সাদকা, উত্তম কাজ, কুরআন পাঠ সমস্ত কিছুই ওনার শান্তি, নেকি অর্জনের অছিলা হতে পারে যদি তুমি চাও!”
অনেকক্ষণ পর এইবার নিতিনের মুখে একটু স্বস্থির চিহ্ন দেখা যায়। সে উদগ্রীব হয়ে বলে,
-“সত্যি ভাবি? তাহলে আজ থেকেই আমি সেসব কিছু করবো যা করলে বাবা ওখানে খুব ভালো থাকবে।”
বর্ষা ইষৎ হাসে।
-“একদম সত্যি। তুমি যদি এই সময়ে বাবার জন্য কিছু করতে পার তাহলেই তুমি হবে বাবার শ্রেষ্ঠ সন্তান। ”
বর্ষার মুখে তাকিয়ে নিতিনের হঠাৎ ভীষণ খা খা করে ওঠে ভেতর টা। বর্ষার জন্য সহসা একরাশ মায়া সঞ্চার হয় তার শহুরে, কঠিন মনে। এই নিরপরাধী মেয়েটিকে ভয়ংকর কষ্টের মাঝে দিনাতিপাতে বাধ্য করছে ওর প্রিয় দা-ভাই। ভেবে খারাপ লাগে ওর।
চলবে…….
★অদ্রিজা আশয়ারী।