একদিন নববর্ষা পর্ব-২৫+২৬+২৭

0
134

একদিন নববর্ষা -২৫
অদ্রিজা আশয়ারী

___________

তোমাকে বরং কাছ থেকে আজ দেখি।
জটিল দু’চোখে ক’খানা সরলরেখা,
তুমি বাচলেও ভালোবাসা বাচবে কি?
এসব প্রশ্ন পরাজয় থেকে শেখা।

সে’রাতে রাহিলের পাশে বর্ষাকে দেখার পর প্রথম যে কথাটা মাথায় এসেছিল,’ওরা কি একে অপরকে ভালোবেসে একসঙ্গে থাকছে ?’

চিরকাল আমি জেনে এসেছি ভালোবাসা হলো এক জটিল সমীকরণ। কালির প্রলেপের মতো। একবার যেথায় পড়ে, চিরকাল তার দাগ রয়ে যায়। আমি বর্ষাকে সে কথা জেনেই ভালোবেসেছিলাম। এখনো বোধহয় বাসি। অথচ স্পষ্ট বুঝি ‘ও আমায় ভালোবাসেনি । অসীম এ ভালোবাসা ও বোঝেনি..’
তবু স্মৃতিরা ঊর্ণাজাল হয়ে বারংবার ফিরে ফিরে আসে। কি দোষ করেছিলাম আমি? কি ভুল ছিল আমার ভালোবাসায়?

আমার একপেশে মন কখনো কখনো বর্ষাকে নির্দোষ ভাবতে চায়। একটি গ্রাম্য, অপরিনত বয়সের মেয়ে, কিইবা তার ক্ষমতা! সে হয়তো সত্যিই ভালোবেসেছিল আমায় কোনো এককালে। হয়তো সেদিন বিয়ে বন্ধের শেষ চেষ্টাটুকু করেছিল সে। কিন্তু ওর সেসব দুর্বিষহ দিনে আমি তো পাশে থাকিনি। বর্ষা হয়তো হার মেনেছিল। বাধ্য হয়েছিল শেষটায় সবকিছু মাথা পেতে মেনে নিতে।

কিন্তু সেদিন বাংলোয় রাহিলের পাশে দাঁড়ানো ওর হাস্যজ্বল মুখের আভায় কোনো কৃত্রিমতা তো ছিল না। ভালো থাকার অভিনয় ছিল না সেটা। ওকে সেদিন সত্যিই সুখী দেখাচ্ছিল। ‘মানিয়ে নিতে হবে’ এই সহজ সত্যটা বুঝতে পেরেই হয়তো সে সবকিছু স্বীকার করে নিয়েছিল।

এখন আমারও সে সময় এসেছে। এই কথার অনুবন্ধে আমারও উচিত সবকিছু মেনে নিয়ে আমার স্ত্রীর সঙ্গে সুন্দর একটা সম্পর্ক গড়ে তোলা।
অথচ আমি পারছি না। প্রতিবার ভীষণ রুক্ষ একটা রোষাবেশের দেয়াল বাঁধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে আমাদের মাঝে। বুঝতে পারছি এখনো ভালোবাসা না কি যেন একটা বিষাক্ত আস্বাদনে ছেয়ে আছে আমার ভেতর টা পুরনো সেই বর্ষার জন্য। এ অন্যায্য, ন্যায়বিরুদ্ধ জানি! তবুও আমার অন্তঃকরণ আমার অনিয়ন্ত্রণাধীন হয়ে পড়েছে…।

দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে চোখ বুঝলাম। এখন বোধহয় শেষরাত্রি। চুপচাপ জেগে শুয়ে থেকে মনে মনে হাজার কথা আওড়াচ্ছি। ঘুম ভেঙেছে একটা বাজে স্বপ্নের সমাপ্তির মধ্য দিয়ে। তারপর থেকে কতশত বিক্ষিপ্ত কল্পনার আঁকিবুঁকি করে যাচ্ছে মস্তিষ্ক। ক্লান্ত চোখে তবুও নিদ্রা হেলেনি। ভীষণ এক অস্থিরতা আঁকড়ে ধরেছে আমায়। কোথাও যেন কিছু নেই। সবকিছু থেকেও ভয়াবহ নিঃসঙ্গ আমি।

মানুষের জীবনে আধ্যাত্মিকতার অপরিহার্যতা অসীম। একটা সময়ের পর সেটা বুঝতে পেরেছি। যখন থেকে পরিণত হতে শুরু করেছিল আমার মস্তিষ্ক। আমার বাবা সাধারণ ভাবে মানুষ হিসেবে ধার্মিক ছিলেন। বাবার এত বড় ব্যাবসা সত্ত্বেও তাই ঢাকা শহরে আমাদের অগণিত বাড়ি/ গাড়ি হয়ে ওঠেনি। বাবা সারাজীবন প্রচুর পরিশ্রম করেছেন। সুসম্পর্ক রেখে চলার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন আল্লাহর সাথে। ছোট বেলায় আমাদের ভাইবোনের ইসলামি শিক্ষায় যথেষ্ট সচেষ্ট ছিলেন তিনি।

তারপর একটা সময় আমার দিক থেকে মনোযোগ সরিয়ে নিলেন। সুযোগ পেয়ে আমি আমার নিজের মতো একটা আলাদা জগৎ তৈরি করে নিলাম। যেখানে সালাত-সিয়াম বা আল্লাহর জন্য কোনো সময় নির্ধারিত ছিল না। ছিল না পরিবারের কোনো স্থান। অথচ প্রতিটি মানুষ মাত্রই তাকে কোনো কিছুর দাসত্ব বরণ করে নিতে হবে। সেক্ষেত্রে কেউ বেছে নেয় তার প্রতিপালকের দাসত্ব। আর কেউ বেছে নেয় নিজের নফসের দাসত্ব। আমি দ্বিতীয় টাকে বেছে নিলাম। যখন যা মন চাইত তাই করতাম। এরপর আমার ভালো না থাকার কোনো কারণ ছিল না। অথচ আমি ভালো থাকিনি। দেহ-মন জুড়ে কোথায় যেন সার্বক্ষণিক অস্থিরতা। এই অস্থিরতার হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য কোথায় কোথায় না গিয়েছি আমি। পাহাড়, সমুদ্র, অরণ্য। স্বস্তি মেলেনি কোথাও। সেই অস্বস্তি আজও রয়ে গেছে। মাঝে মাঝেই মাথাচারা দিয়ে ওঠে ভেতরের সেই অজানা অধীরতা।

ঠিক আজ যেমন হচ্ছে । মুসলিম হিসেবে চিরায়ত ভাবেই আল্লাহর নৈকট্য অর্জনে ব্যার্থ হৃদয়ে আফসোসের সুর বাজে মাঝেমধ্যে। মালাকুল মউত এসে হাজির হওয়া মাত্রই দুনিয়ার রঙ্গমঞ্চ নিষ্ফল প্রতিপন্ন হবে। এই ভাবনা যে আমার মধ্যেও কখনো উদয় হয়নি এমন নয়। এই মুহুর্তেও ঠিক এই চিন্তাই করছি আমি। ভেতরে ভয়ানক হাসফাস, নিশ্বাসের উষ্ম রেশ দেহের সবটুকু জুড়ে।

ঠিক সেই মুহুর্তে আমার চিন্তার সাথে সন্ধি রেখেই যেন কুরআন তিলাওয়াতের একটা মৃদু সুর কানে এসে প্রবেশ করল। সঙ্গে সঙ্গে ভেতরে এক অদ্ভুত চাঞ্চল্য অনুভব করলাম। স্থবির দেহটাকে টেনে বিছানা থেকে নামিয়ে শব্দের উৎস অনুসরণ করে গিয়ে পৌঁছালাম লাইব্রেরি রুমে। বাইরে সবে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। তখনো আবছা অন্ধকার। পাখিদের কুহুরবে নিস্তব্ধ আঁধার ভেঙে সূর্যের উদয় হবে ক্ষানিক পরে। রক্তিম আকাশ তারই জানান দিচ্ছে। জানালার সামনে জায়নামাজ বিছিয়ে বসে নিমগ্ন হয়ে কুরআন তিলাওয়াত করছে বর্ষা। এমন সম্মোহনী সুর বুঝি আমি কতকাল শুনি নি! কিছু না ভেবে আমি ওর থেকে কিঞ্চিৎ দূরে মেঝেতে বসে পড়লাম। অনুভব করলাম ধীরে ধীরে আমার ভেতরের অস্থিরতা ক্রমশ বিলীন হয়ে আসছে। এতো ভালোবেসে, দিব্য আভা মিশিয়ে, একাগ্রভাবে কেউ কুরআন পড়তে পারে জানা ছিল না আমার!

খেয়াল করলাম পড়তে পড়তেই হঠাৎ হঠাৎ বর্ষার গলা কাঁপছে। সে নিশব্দে কাঁদছে। কুরআন পড়ে কেউ এভাবে কাঁদতে পারে! দেখে আমি অবাক হলাম।

হঠাৎ বর্ষা পড়া থামিয়ে পেছন ফিরল। ভোরের নির্মল আবছা আলোয় ওর পেলব মুখ শিশিরের ফোঁটার মতো শুদ্ধ দেখাচ্ছিল। ওর ঘুমভাঙা ফোলা ফোলা চোখ বিস্ময়ে কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসার উপক্রম হলো। ভুত দেখার মতো চমকে কিঞ্চিৎ সময় তাকিয়ে রইল সে আমার দিকে। মুহুর্তের জন্য আমিও কেমন অপ্রতিভ হয়ে পড়লাম। খুব দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম,
-“ফজরের সালাতের সময় কি শেষ? ”

বর্ষার উত্তর করতে কিছুটা বিলম্ব হলো । ওর বুঝি বিশ্বাস করতেই কষ্ট হচ্ছিল।
বলল, ” না, তবে বেশি সময় বাকি নেই। সালাতের হারাম সময় শুরু হয়ে যাবে একটু পরেই।”

দীর্ঘদিনের বিরতির পর আমি সেদিন সালাতে, আমার রবের মুখোমুখি হলাম। মনে এত স্নিগ্ধ অনুভুতি সঞ্চারনের ঘন সন্নিবেশ বোধহয় একযুগ পর পেলাম। স্বীকার করতেই হবে এর পেছনে অবদান অনেকটাই বর্ষার।

মনে হতে লাগল, সে যেন আমার পাপের সাম্রাজ্যে, পুন্যময়ী সম্রাজ্ঞীর আসনে অধীন, কোনো আকাশ লোক থেকে নামা নারী হয়ে এসেছে!

***

দাদি ডেকে পাঠিয়েছেন। ঘরের সামনে গিয়ে দরজায় কড়া নাড়তেই ভেতর থেকে ডেকে বললেন,
-” কেডা, নবু? আয়। ”

আমি ভেতরে পা বাড়ালাম। বরাবরের মতো দাদি পালঙ্কের ওপর পানের বাটা নিয়ে বসে আছেন। আমি আসতেই ভাজ পড়ে যাওয়া মুখে চওড়া হাসি ফুটল। পাশে বসিয়ে দু-একটা সৌজন্য কথাবার্তার পর দাদি সোজা আমার চোখের দিকে তাকালেন। কিয়ৎক্ষন পর কেমন লীন হয়ে আসা গলায় বললেন, ” নবু, তুই সত্যি ভালো আছোস তো? আমার লগে মিছা কথা কইস না দাদু। তোর লাইগা আমার পরাণডা দিনরাইত পোড়ে। ”
দাদির আদ্র প্রকম্পিত স্বরে কান্নার অনুরক্তি খুব স্পষ্ট ভাবে টের পেলাম।
দাদির ঘরে এলে একটা অদ্ভুত প্রশান্তি পাওয়া যায়। যান্ত্রিকতা হীন, প্রাচীন ভেজা ভেজা একটা গন্ধ নাকে এসে লাগে। আমি কিছু না বলে দাদির কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লাম। একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলাম সামনের দেয়ালে।
দাদি চুপচাপ আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। প্রলম্বিত দীর্ঘশ্বাস ফেলে একসময় নিজ থেকেই বললেন,
-“বিশ্বাস কর রে দাদু। পরের বউরে কাইরা আনা যদি গুনার কাম না হইত সেই কবেই আমি ওই মাইয়ারে তোর কাছে আইনা দিতাম!
কিন্তু এইডা তো আর সম্ভব না। মাইয়া মানুষ হইল মায়ার কাঙ্গাল। যেইহানে একটু মায়া, ভালোবাসা পাইব সেইহানেই নিজের শিকড় ছড়ায়া গাছের মতো সবাইরে ছায়া দিতে শুরু করবো। কিন্তু গাছ একবার শিকড় বিছাইলে যে আর কখনো উঠতে পারে না। তহন তারে সরাইতে গেলে পুরা গাছটাই কাইটা ফেলতে হয়। ওই মাইয়াও মায়ায় আটকাইছে। বিয়া যার লগেই হোক। ভালোবাসা কম-বেশি যাই হোক! একসঙ্গে থাকতে থাকতেই মাইয়া মানুষের শিকড় ডালপালা মেইলা আরও বিস্তৃত হয়। আজ তুই ওই মাইয়ার লাইগা দুনিয়া উজার কইরা দিলেও সে আর ফিরব না। সে এহন ওই সংসারের মায়ায় পড়ছে। সেইটা আর ছাড়তে পারব না। ”

আমি টের পেলাম আমি চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। দাদির একটু প্রশ্রয়ের আভাস পেয়ে লাগামহীন হয়ে পড়েছে ভেতরের পলকা হৃদয়! রক্তক্ষরণ শুরু হয়েছে সে হৃদয়ের ডহর বিরহকোণ থেকে।

দাদি উদাস চোখে সামনে তাকিয়ে আবারো বললেন,
” মায়া বড় কঠিন জিনিস রে দাদু। ভালোবাসলে সেই ভালোবাসা একসময় ঘৃণায় পরিনত হইতে পারে। কিন্তু একবার মায়ায় জড়াইলে সেই মায়া আর কহনো কাটানো যায় না। সারাজীবন বুকে আগুন নিয়া কষ্ট পাইতে হয়৷ কারণ মায়া এমন এক জিনিস যার বিপরীতে কোনোদিন ঘৃণা আসে না।
তুই তারে ভুলবার পারস নাই জানি। এই বাড়ির সবাই জানে। নাতবউয়ের প্রতি তোর আচরণে সেইডা অহরহ প্রকাশ পায়। সেই বেচারি আরও মহা মুসিবতে পড়ছে। তোরে সে ভালোবাসে, তোর জন্য তার মায়াও হয়। এতো কষ্টের পরও তাই সে যাওয়ার নাম করে না। দুঃখের কথা কাউরে কিছু কইতেও পারে না। একা একা লুকায়া কাঁন্দে। ওর কান্দোন আমার সহ্য হয় না। বুক ফাইটা যায়। কেন যায় তুই জানোস? ”

এবারেও সম্পুর্ন নিরুত্তর রইলাম আমি। দাদি সন্তর্পণে আমার মাথাটা কোল থেকে নামিয়ে আলমিরার কাছে চলে গেলেন।
একটা ছবি উল্টো করে বুকে চেপে ধরে ফিরে এসে আবার বসলেন পূর্বের স্থানে। বালিশের নিচ থেকে আরও একটা ছবি বের করলেন দাদি। ছবি দুটো একসঙ্গে হাতে নিয়ে গভীর বিষন্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন সেই ছবির দিকে। তার মধ্যে একটা ছবি আমার স্ত্রী বর্ষার। ফুলহাতা গোল জামা পড়নে, লম্বা বেণী একপাশে দুলিয়ে হাস্যজ্বল মুখে দাঁড়িয়ে আছে সে। অন্য ছবিটি দেখে আমি অবাক না হয়ে পাড়লাম না। সেই ছবিটিতে থাকা মেয়েটির মুখের আদল হুবহু বর্ষার মতো। তবে ছবিটি সাদাকালো। সাদাকালো ছবির সেই মেয়েটির পড়নে ডুরে শাড়ি। কাঁধের দুপাশে দুই বেণি ঝুলিয়ে সে দাঁড়িয়ে আছে আরক্তিম মুখে। দাদি হঠাৎ বললেন,
-” তোর ইরির কথা মনে আছে? অবশ্য মনে না থাকবারই কথা। তুই যহন জন্মাইছস তহন সে আঠারো বছরের মাইয়া। তোরে সারাদিন কোলে নিয়া পাখির মতো ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ ঘুইরা বেড়াইতো। নিমিষেই চোখে হারাইত তোরে। আমারে কইত,
“আম্মা, তোমার নাতি তো আমার কলিজার ভিতরে ঢুইকা পরছে। কিছুতেই বাইর করতে পারতাছি না৷ ও সামনে না থাকলেও আমি খালি দুই চোখে ওরেই দেখি। শোনো আম্মা, তোমার সাথে আগেই কথা ফুরায়া রাখি। আমার যখন মেয়ে হইব তখন ভাইয়ার ছেলের সাথেই ওরে বিয়া দিমু আমি। আমার নবু বাবারে আমার থেকে দূরে হারাইতে দিমু না৷
নাব্যর সাথে মিলায়া আমার মেয়ের নাম রাখমু বর্ষা। দুইজনই প্রকৃতির অনন্য দুই রুপ। ঠিকাছে না আম্মা?”

দাদি দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বললেন
-“ইরি তোরে কি যে ভালোবাসতো! মাঝে মাঝে রাফিয়া পর্যন্ত বিরক্ত হইত তোর প্রতি ইরির টান দেইখা। ”

কিন্তু ইরির মনের আশা আর পুরন করা হইলো না। তার অনেক আগেই সে আমগোরে রাইখা ওইপাড়ে গিয়া পাড়ি জমাইল। সেই আঠারো বছরের ইরি একদিন হুট কইরা অসুখে ভুইগা মৃত্যুর কোলে ঢইলা পড়ল। যাওয়ার আগেও শেষবার তোরে একটু কাছ থাইকা দেখার লাইগা, ছোঁয়ার লাইগা কি ছটফট করতাছিল। সে জানতো তার হাতে আর সময় বেশি নাই। তুই ছিলি রাফিয়ার সঙ্গে নানার বাড়ি। শেষ দেখা হইল না।

ইরি আছিল ওর বাপের কলিজার টুকরা। বাপ মারা যাওয়ার মাত্র তিনবছর পর ইরিও চইলা গেল। কি এক অসুখ করল মাইয়াডার। মরণ রোগে ধরল। নাইলে তুই ক, এত কম বয়সে কেউ মরে? এহন তোর বাপও গেল গা। বাপ, ভাই-বোন সব আমারে ফালায়া ওইপাড়ে গিয়া ঘর বানছে। শুধু আমি রয়া গেছি। আমারে কেউ সাথে নেয় নাই ওরা। ”

দাদির গাল ভিজে যাচ্ছে চোখের উষ্ণ স্রোতে। সত্যিই! কত একা হয়ে গেছে দাদি। স্বামী, সন্তানের মৃত্যু চোখের সামনে দেখার অভিজ্ঞতা নিশ্চয়ই ভয়াবহ ব্যাপার! নিজের প্রিয় মানুষ গুলোকে একে একে হারিয়ে যেতে দেখেছে দাদি চোখের সামনে৷
আমি দাদির হাত চেপে ধরলাম।
-“কেঁদোনা দাদি৷ আমরা আছি তো। আমাদের ছেড়ে কোথাও যেবে দেব নাকি তোমাকে? নিতিন কত ভালোবাসে তোমায়। আমিও তো খুব ভালোবাসি। সেসবের কি কোনো মূল্য নেই? তুমি আর কাঁদবে না দাদি। কেমন?”

দাদি চোখ মুছে সাদাকালো ছবিটা দেখিয়ে বললেন,
-” এই হইলো তোর ফুফু ইরি। ওর ছবিডা বহুদিন আমার সিন্দুকে তোলা আছিল। দেখতে মন চাইলেও কহনো বাইর করতাম না। কষ্ট হইত। বর্ষা আওনের পর বাইর করছি সিন্দুক থাইকা। নাতবউ যহন হাসে, কথা কয়, মনে হয় যেন আমার ইরি ফিরা আইসে। ইরির ছবি দেখলে তহন আর জ্বালাপোড়া হয়না অন্তরে।”

আমি ছবিদুটোর দিকে তাকিয়ে রইলাম। সত্যিই আশ্চর্য মিল দুটো মানুষের মাঝে। দাদি ফের বললেন,
-“নবু, নাতবউরে কহনো কষ্ট দেইস না তুই। ওর কষ্ট হইলে আমারও কষ্ট হয়। ইরির কথা মনে পড়ে….।

তোরে একটা ব্যাপার জানানোর কথা। রাফিয়া কইবার সাহস পাইতাসে না। আমারে দায়িত্ব দিসে। সেই কথা কইবার লাইগা ডাকছিলাম তোরে। অথচ দেখ হাবিজাবি কত কিছু কয়া ফালাইলাম! ”

আমি উৎসুক হয়ে বললাম,
-“কি ব্যাপার দাদি?”

দাদি কিছুটা বিরতি নিয়ে বললেন,
-“তোর বড়মামা কক্সবাজারে রিসোর্ট না কি জানি বুক করছে তোগর লাইগা। বিয়ার পর এহনো তোরা কোনোখানে ঘুরতে গেলি না…সেইজন্য।
রাফিয়া আমারে অনুরোধ কইরা কইসে, যেভাবেই হোক তোরে রাজি করাইতে। নাইলে ভাইয়ের সামনে ওর মান সম্মান কিছু থাকবো না৷
নবু, আমিও কই, তুই যা নাতবউরে নিয়া। তোর বড়মামা কেমন একরোখা তুই তো জানোস! সে যেভাবেই হোক তোরে নিয়াই ছাড়বো।
বউডার কথাও একটু ভাব। বিয়া কইরা সেই বেচারি যেন পিঞ্জিরাবদ্ধ পাখি হয়া গেসে। ওর মুখে হাসি নাই। তোরা ঘুইরা আয়। অন্তত আমার কথা ভাইবাই যা তুই।”

আমাকে নিশ্চুপ থাকতে দেখে দাদি ফের তাড়া দিলেন। -“কি রে, যাবি না? বল? ”
উত্তরে কি বলব ভেবে পেলাম না। আর কতবার অন্যের ইচ্ছায় নিজেকে সোপর্দ করব আমি? জানা নেই! নিশ্বাস ফেলে, ” যাবো। ” বলেই বেরিয়ে এলাম ঘর ছেড়ে।

চলবে…

একদিন নববর্ষা -২৬
অদ্রিজা আশয়ারী

____________

সমুদ্রে যাবার আয়োজন সম্পন্ন হয়ে এল। যথাক্রমে গম্ভীর ও অভিমানিনী কপোত-কপোতীদয় চুম্বকের সমমেরুর মতো পরস্পর বিকর্ষিত হয়ে সম্মত হলো সমুদ্রে যাওয়ার এই মহাসমোরোহ পূর্ণ ব্যাপারটিতে!

নাব্যর দুচোখ জীবনে বহুবার সমুদ্রের স্বাদ আস্বাদন করে ধন্য হয়েছে। অথচ বর্ষা একজীবনে কখনো ঢাকার বাইরে পা -ই ফেলেনি। স্বভাবতই সে অধিক উৎফুল্ল। উন্মত্ততার আনন্দ হিল্লোল বয়ে গেল ওর সারা মন জুড়ে। দুপুরে নিতিন এসে যখন খবরটা জানালো। তারপর থেকে বর্ষার পিঠে যেন অদৃশ্য ডানা গজালো দুটো! সেই ডানায় ভর করে উড়ে বেড়াতে লাগলো ওর কল্পনাবিভোর মন! সমুদ্রে, বালুচরে, নোনা জল ঘেঁষা সবুজ বন্ধুর পাহাড়ে…।

কখনো কখনো ওর মনে আঁধারও নামল ঝুপ করে। ভেবে যে ওই গোমড়া মুখো মেঘবরের সঙ্গে সমুদ্রে যেতে হবে তাকে। লোকটা নাকি উপন্যাস লেখে! এমন কংক্রিটের মতো মন নিয়ে আবার সাহিত্য! ভেবে ভারি অবাক হয় বর্ষা। ওই পাথর কঠিন মনে তখন কোথা থেকে আসে এত অনুরাগের ফুলঝুরি?

এমন মূর্তিমান কংক্রিটের বস্তা নিয়ে সমুদ্দুরে যেয়ে হবে টাই বা কি! না সে নিজে আনন্দ করবে। আর না বর্ষাকে আনন্দে সময় টা উপভোগ করতে দেবে। এসব ভাবার সঙ্গে সঙ্গে আনন্দের আতিশয্যে অধীর হয়ে নাব্যকে একটু বকেও দেয় সে একলা ঘরে।
সদর্পে গাল ফুলিয়ে ঠোঁট বাঁকিয়ে বলে,”গোমড়া মুখো আষাঢ়ে মেঘ কোথাকার! তোমায় আমি একদিন ঠিক শরতের শুভ্র মেঘখণ্ড করে ছাড়বো। হুহ!”

সেই বর্ষাই নাব্যকে নিয়ে বিকেলে একটা অদ্ভুত কান্ড করে। সমুদ্রে যাবে শোনার পর থেকে বর্ষার মন, মস্তিষ্ক লাগাম ছাড়া ঘোড়া হয়ে গেছে। যেন বহুদিন পর, উনিশ বছরের ভীষণ অস্থিরমতি, প্রাণোচ্ছল, খেপাটে মাথার মেয়েটির মনের ভেতর তারুণ্যের স্নিগ্ধ ছবি পূর্ণ একক জানালাটির আগল খুলে দিয়েছে কেউ! এবার যা খুশি সে করতে পারে। কোনো কিছুর পরোয়া নেই আর।

কাল দুপুরে ওদের ফ্লাইট কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে। কাজ এগিয়ে রাখতে বিকেলে বর্ষা লাগেজে জামা-কাপড় গুছিয়ে রাখছিল। কি নেবে, কি নেবেনা এই নিয়ে এক মহা বিপাকে পড়েছে সে। অবশেষে নিজের কাপড় গোছানো শেষ হলো।
এখন কি ওই কংক্রিট সাহেবের পোশাকও গোছাতে হবে তাকে? আপত্তি নেই! তবে কংক্রিট সাহেব আবার রেগে আগুন হবে না তো! যা হবার হোক! বলে মুখে ভেঙচি কেঁটে বর্ষা আলমিরার দিকে এগোয়। আলমিরা লকড ছিল না। থাকে না কখনো। তাই টান দিতেই খুলে যায় ডালা। সঙ্গে সঙ্গে দামি বিদেশি পারফিউমের মিষ্টি সুগন্ধে ছেয়ে যায় চারপাশ।
নাব্যর প্রামান সাইজের আলমিরার একপাশে বাহারি রঙের অসংখ্য শার্ট। অন্যপাশে পাঞ্জাবি। এককোণে একটা ছোট পারফিউমারি। ছোট ছোট অসংখ্য কাঁচের কৌটোয় পারফিউম রাখা সেখানে।
বর্ষা হা হয়ে তাকিয়ে থাকে কিঞ্চিৎ সময়। এতো কাপড়-চোপড় লোকটার! একজীবনে এসব পড়ে শেষ করতে পারবে তো! এত পোশাক থেকে সে কোনগুলো বাছাই করে এখন? এরচেয়ে বরং কংক্রিট সাহেব নিজেই গুছিয়ে নিক! ভেবে বর্ষা আলমিরা বন্ধ করতে উদ্যত হয়। তারপর কি ভেবে আবার থেমে যায়।

এককোণে যত্নে ভাজ করে রাখা গাঢ় চকলেট কালারের একটা শার্টের ওপর নজর পরে বর্ষার। কিছু না ভেবেই টেনে বের করে সে শার্টটা। দুহাতে মেলে ধরে মুখের সম্মুখে। ভ্রু কুচকে তাকিয়ে রয় কিছুক্ষণ। যেন নাব্যর শার্ট নয়। আসলে নাব্যকেই সে দেখছে । সাথে সাথে অজস্র না বলা অভিযোগ, ক্ষোভ, অব্যক্ত আকুতির কথা একে একে বর্ষার মস্তিষ্কে হা’না দিতে থাকে। মনে হয় সম্মুখের লোকটির বুকে একশো তীরের ফলা বি’ধিয়ে দিয়ে মনের জ্বালা জুরোয় সে।

ক্ষোভিত হয়ে সে এমনি কিছু একটা করে। হাতে থাকা নাব্যর শার্ট দু’হাতে দু’মড়ে মুচ’ড়ে ফেলে। পরমুহূর্তেই সচকিত হয়ে নিজেকে তি’রস্কার করে এই কর্মের জন্য। এবং নিমিষেই মনোভাব সম্পুর্ন বদলে ফেলে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে হাতে থাকা সেই প্রাণহীন বস্তুটাকে। ভ্রুর কুঞ্চন অদৃশ্য হয়, সঙ্গিন ঠোঁটের কিনারায় হাসির আভাস দেখা দেয়। বর্ষা অনুচ্চারিত স্বরে কিছু একটা বলে। এতো মন্থর ভাবে যে সে নিজেও বোধহয় শুনতে পায় না স্পষ্ট করে। তবে কথাটা কর্ণকুহরে প্রবেশের ফলেই কিনা, একটা নিষ্পাপ আরক্তিম আভার লালিমায় ছেয়ে যায় ওর মুখ।

বর্ষার লাগামহীন বেপরোয়া, চঞ্চল মন তখন আরও একটা সাহসী কাজে ওকে ইন্ধন দেয়। যার ফলস্বরূপ গোলাপি মিহি সুতির শাড়ির ওপরেই নাব্যর শার্ট টা গায়ে জড়ায় সে। কলার শুকে ঘ্রাণ নেয়। পারফিউমের কড়া সুবাস, আর নাব্যময় ঘ্রাণে মিশে একাকার হয়ে, চনমনে স্নিগ্ধতার রেশে ডুবে যায় ওর মন! পিঠের অদৃশ্য ডানাদুটো তখনি আবার দৃশ্যমান হয়। সেই ডানায় ভর করে বর্ষার মন ফের উড়তে শুরু করে। অরণ্যে, সমুদ্রে, অন্তঃরীক্ষে….।

____________________________

মেয়েটি বড় ঘুমকাতুরে। বিছানায় শুলেই চোখ জুড়ে নিদ্রার ভরাডুবি শুরু হয়। আজও তাই হলো। উৎফুল্লতার আতিশয্যে নাব্যর শার্ট গায়ে জড়িয়েই বিছানায় শুয়ে পড়েছিল সে। তবুও আবার নাব্যর বিছানাতেই! কংক্রিট সাহেব ঘরে না থাকার পূর্ণ সুযোগ আজ ব্যাবহার করেছে সে। শুতে শুতেই ঘুম জড়িয়ে এল চোখে। নাব্যময় সমুদ্রে অবগাহনরত হয়েই ঘুমের দেশে পাড়ি জমাল বর্ষা।

নাব্য সন্ধ্যার পর ফিরে, ঘরে এসে কিঞ্চিৎ অবাক। রাত্রি নেমেছে সেই কখন অথচ এখনো ঘর আলোহীন! বর্ষা মেয়েটি এমন করে না তো কখনো। সন্ধ্যে নামতেই সে রোজ “বিসমিল্লাহ” বলে সকল জানালা দরজা বন্ধ করে দেয়।

কেন যেন আজ নাব্যর ও মন চাইল না বাতি জ্বালতে। আরবি মাসের মাঝামাঝি সময়। আকাশে মস্ত ধূসর আবর্তে ঘেরা চাঁদ। সায়ংকাল পেড়িয়েছে মাত্র কিছুক্ষণ আগে। ধূসর বলয় থেকে বেরিয়ে রুপোলী ছটায় চারদিক উজ্জ্বল করে মধ্যাকাশে যাবার পায়তারা খুঁজছে মস্ত চাঁদটা! সেই চাঁদের আলো বারান্দা ঘেষা কাচের দরজা পেরিয়ে এসে পড়ছে ঘরে। নরম, আবছা আলোয় ঘরটা অনুজ্জ্বল অথচ চোখে স্বস্তিবোধক লাগছে।

নাব্য টাওয়েল নিয়ে সোজা ওয়াশরুমে চলে যায় ফ্রেশ হতে। ওয়াশরুমের দরজা বন্ধের শব্দে ঘুম ভাঙে বর্ষার। মাথাটা ফাঁকা লাগছে ওর। এতো অন্ধকার দেখে প্রথমে সে ভরকে যায় কিছুটা। কিন্তু কয়েক মুহূর্ত পর, অন্ধকার টা চোখে সয়ে যাবার পর সম্বিত ফিরতেই বর্ষা লাফিয়ে নামে বিছানা থেকে। মাগরিবের ওয়াক্ত শেষ হয়ে যাচ্ছে, এখনো সে সালাত শেষ করে নি। এদিকে নাব্য চলে এসেছে। বর্ষার গায়ে নিজের পোশাক জড়ানো দেখলে নাব্য খুশি হয়ে লাফাবে না নিশ্চয়ই!
বর্ষা দৌড়ে লাইব্রেরি রুমে যেতে গিয়ে শাড়িতে বেঝে ধপ করে পড়ে যায়। যন্ত্রণায় কাঁকিয়ে উঠলেও অপেক্ষা করে না। পায়ে ব্যাথা নিয়েই উঠে লাইব্রেরি রুমে গিয়ে শার্ট গা থেকে খুলে বালিশের নিচে লুকিয়ে ফেলে সে। আপাতত এটা এখানেই পড়ে থাক। পরে একে জায়গামত রেখে দেয়া যাবে।

যেখানে বাঘের ভয়, সেখানে সন্ধ্যে হয়। এই কথার সত্যতা নিশ্চিত করতেই যেন রাতে আরেকবার ফ্যাক্টরিতে ঢু মেরে আসার উদ্দেশ্যে বাইরে বের হবার সময় নাব্য সব ফেলে ওই চকলেট রঙা শার্ট টাই খুঁজতে লাগল। বর্ষা জানতো না ওটা ছিল নাব্যর অন্যতম প্রিয় রঙ। পাশের ঘরে বসে নাব্যর আলমিরা তন্ন তন্ন করে খোঁজার উদ্দেশ্য উপলব্ধি করতে পেরে বর্ষার মুখ পাংশু বর্ণ ধারণ করল। এই সামান্য ব্যাপারে চিন্তিত হয়েই বেচারির গলা শুকিয়ে কাঠ, হৃৎপিণ্ড কেঁপে, শ্বাস প্রশ্বাস থমকে যাওয়ার উপক্রম!

এখন সে কি করে! কিভাবে এই বিপদ থেকে উদ্ধার পায়! বর্ষা মনে মনে বলতে লাগল,
‘লা ইলাহা ইল্লা আনতা সুবহানাকা ইন্নি কুনতু মিনাজ জোয়ালিমিন।’
ইয়া আল্লাহ, আপনি আমাকে এবারের মতো বিপদ থেকে উদ্ধার করুন। আমি আর কখনো ওই কংক্রিট সাহেবের আলমিরায় হাত দেব না প্রমিজ। প্লিজ প্লিজ।’

বর্ষার দোয়ায় বুঝি কাজ হলো। সহসা নাব্য শার্ট খোঁজা বাদ দিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল কিছুক্ষণের জন্য। সুযোগ পাওয়া মাত্রই কোনো রকমে শার্ট টা ভাজ করে ছুটে গিয়ে যথাস্থানে রেখে উড়ে চলে এলো বর্ষা। এসে হাফ ছেড়ে বাচল।

মিনিট পাঁচেক পর কফির মগ নিয়ে ঘরে ফিরল নাব্য। তবে শার্ট না পেয়ে এবার আস্তে আস্তে ওর মেজাজ খারাপের দিকে চলে যাচ্ছে বুঝতে পেরে বর্ষা লাইব্রেরি রুম থেকে বেরিয়ে এল। আমতা আমতা করে বলল, ” কি হয়েছে? ”
নাব্য হতাশ গলায় বলল
-” একটা কফি রঙা শার্ট। খুঁজে পাচ্ছি না কোথাও। ”

বর্ষা ঢোক গিলে আলমিরা খুলতেই সবার প্রথমে নজরে পড়ল কোণে গুটিসুটি মেরে পড়ে থাকা ওই শার্টের ওপর। তবুও কিছুক্ষণ শার্ট খোঁজার মিথ্যে অভিনয় চালিয়ে গেল সে। তারপর হঠাৎ উদাস কন্ঠে বলল
-” এটা নয়তো? ”

নাব্য কিছু না বলে অবাক চোখে তাকিয়ে বর্ষার হাত থেকে টেনে নিল শার্ট টা। মনোযোগ দিয়ে দেখল কিয়ৎক্ষন। তারপর নাকের কাছে নিয়ে ঘ্রাণ শুকে ভ্রু কুচকে আপন মনে বলল,
” এটা থেকে লেডিস পারফিউমের ঘ্রাণ আসছে কেন?” বলে তির্যক দৃষ্টিতে তাকাল বর্ষার দিকে।

-” আ…আম্মা বোধহয় ডাকছেন আমায়। দাদিকে চা দেয়া হয়নি এখনো। আমি আসছি…..” বলে আর এক মুহুর্ত অপেক্ষা করল না বর্ষা। উড়াল দিয়ে বেরিয়ে এল ঘর ছেড়ে।

বাইরে এসে মাথায় গা’ট্টা মে’রে নিজেকে শাসনের সুরে বলল,
-” এবার শিক্ষা হয়েছে তো? আর কখনো ওই কংক্রিট সাহেবের জিনিসে হাত দিবি? ” তারপর দু হাত জড়ো করে ওপরে তুলে বলল,
-“ইয়া আল্লাহ, আপনার কাছে হাজার হাজার শুকরিয়া। আজ ওই কংক্রিটের হাত থেকে আমাকে সহি সালামতে রেহাই দেয়ার জন্য। ”

___________________________

সমুদ্র দেখার পাশাপাশি বিমানে ওঠার অভিজ্ঞতাও বর্ষার প্রথম। জানালার পাশে সিটে বসে সে অনবরত দোয়া – দুরুদ পড়ে যাচ্ছিল। শেষে ফের একবার আয়তুল কুরসি পড়ে ফু দিল নিজের গায়ে। নাব্যকে বুঝতে না দিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে ওর গায়েও তিনবার ফু দিয়ে নিশ্চিত হলো সে। বিমান টেক অফ করার সঙ্গে সঙ্গে আতঙ্কে নাব্যর হাত খাম’চে ধরল অতঃপর!

দুরন্ত ভাবে লাফাতে থাকা হৃদয় টাকে সুস্থির করবার বৃথা চেষ্টা করে সে আড়চোখে তাকাল নাব্যর দিকে। নাব্যর ভাবান্তর নেই। নির্বিকার, গাম্ভীর্য পূর্ণ মুখের সবটুকু মনোযোগ জড়ো করে একটা ম্যাগাজিনের পাতায় ডুবে আছে সে। কোনো কালহরণে, এই মনোযোগটুকু কি বর্ষা পাওয়ার কথা ছিল না? বর্ষা উদাস চোখজোড়া নাব্যর মুখের ওপর নিবদ্ধ রেখে ভাবে।

কি নিখুঁত সুন্দর নাব্যর মুখের প্রতিটি রেখা। ওর পরিপাটি করে আঁচড়ানো বড় চুলগুলো হাত দিয়ে এলোমেলো করে দিতে মন চায় বর্ষার। শুভ্র সাদা ফুলহাতা শার্টে কি সুন্দর দেখাচ্ছে নাব্যকে। নাব্যকে দেখার পর থেকেই বর্ষার কাছে মনে হয় পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ গাত্রবর্ণ হলো তামাটে !
নাব্যর সবকিছু এতো সুন্দর। নাব্যর সঙ্গে পৃথিবীর আর কোনো পুরুষের তুলনা চলে না কখনো!

বর্ষা অনুভব করছিল। আশেপাশের সিটের মেয়ে যাত্রীদের দৃষ্টি ঘনঘন ফিরছে নাব্যর দিকে। এটা কি নাব্যর জনপ্রিয়তার কারণ নাকি ওর পুরুষালি সৌন্দর্যের আকর্ষণ!
ওর বর হলো আকাশের চাঁদ। দূর থেকে সবাই তাকে ছোঁয়ার স্বপ্ন দেখে। বর্ষা কি সেই আকাশের একক নক্ষত্র হতে পেরেছে? পারবে কখনো? কি দিয়ে বাঁধবে সে নাব্যকে? তার না আছে ভুবনভোলানো, মনোহরিণী রূপ৷ আর না আছে যোগ্যতা। ভেবে বর্ষার মুখভার হয়। বুকে নেমে আসে একরাশ জড় অনুভূতির ঘনঘটা।

চলবে…..

একদিন নববর্ষা -২৭
অদ্রিজা আশয়ারী
____________

ওরা যখন প্রথমবার কাছ থেকে সমুদ্রের গর্জন শুনলো তখনো বিকেল ফুরিয়ে যায়নি। সায়াহ্ন নামেনি সমুদ্রের দিগন্তজোড়া বিস্তৃত জলরাশীর ওপারে। রাস্তার ওপর থেকেই বর্ষা প্রথমবারের মতো ওদের গন্তব্যে তাকাল। বড় বড় গাছের ফাঁকে নজরে পরে ছোট বড় বাহারি আকৃতির কুটির।
একপাশে ঝাউবন। তার পেছন থেকে শুরু হয়েছে সমুদ্র। অন্যপাশে পাহাড়। মধ্যভাগ দিয়ে বয়ে গেছে মেরিন ড্রাইভ রোড। ঢাল বেয়ে রিসোর্টের নিকটবর্তী হতেই ঝিকিমিকি রোদ্দুরে কুটির গুলোর আকর্ষণীয় স্ফূর্তি মনোযোগ কেড়ে নেয়।
নাব্যর পেছন পেছন অভ্যর্থনা কক্ষে এসে পৌঁছাল বর্ষা। সেখানে ওদেরকে স্বাগত জানানো হলো নাম না জানা বুনোফুল ও ডাবের পানি দিয়ে। ন-দশ বছরের একটি মেয়ে হাস্যজ্বল মুখে এগিয়ে এসে এক তোড়া ফুল তুলে দিল বর্ষার হাতে।

বর্ষা যত দেখছিল তত অবাক হচ্ছিল। ভেবেছিল হয়তো কোনো বহুতল ভবনের বেশ নামি হোটেলে ওদের থাকার ব্যাবস্থা হয়েছে। কিন্তু এমন নৈশব্দ সবুজের দ্বীপে, গৈরিক ছাউনির কাছে ওকে নিয়ে আসবে নাব্য। সে ভাবেই নি! ওদের জন্য বরাদ্ধ করে রাখা বিচ ভিউ ভিলায় পৌঁছে বর্ষার বিস্ময় চরমে পৌছাল! ভিলার দরজার ওপর বড় বড় অক্ষরে লেখা “ব্লু রেডিও”। বাইরে থেকে ভেতরের যা কিছু নজরে পরে তার বেশিরভাগের রঙ গাঢ় নীল! আর সবচেয়ে আকর্ষণীয় ব্যাপার হলো ভিলার ভেতর পা রাখতেই নজরে পড়ে দূরের উত্তাল সমুদ্রের ঢেউ!

প্রতিটি পদক্ষেপে যেন বিস্ময় অপেক্ষা করছিল বর্ষার জন্য। করিডরে একটা বাঁক নিয়ে ওরা ভিলার সামনের মূল প্রাঙ্গণে এসে পৌঁছাল। সেখানে ভিলার ডানপাশে রোদ্দুরে পাতা সানবেড, পেছনে আউটডোর শাওয়ার। একবারে সামনের দিকটায় সারিবদ্ধ গাছ, বা-পাশে একটা ছোট পুল। মধ্যাহ্ন শেষের রোদ্দুরে ঝিলিক দিচ্ছে তার ভেতরের পানি। পুলের কাছে বসবার জায়গা। কাঠের তাকে গোসলের যাবতীয় সরঞ্জাম সাজানো, তার সামনেই মস্ত আয়না। এসব কিছুর পেছনে বিশাল প্রাচীর। সেখানেও নীলের আধিক্য! প্রাঙ্গণের একেবারে সামনে, সমুদ্রের দিকে ফেরানো কাঠের নিচু প্রাচীর। সেখানে আছে সমুদ্র মুখী দরজা। যেখানে দাঁড়ালে দূর সমুদ্রের বুকে ভেসে চলা সাম্পান দেখা যায়। অবিরত মৃদুভাবে কানে আসে সমুদ্রের ঢেউয়ের গর্জন। চাইলে আবার উদ্দেশ্য হীন ভাবে হাটতে শুরু করা যায় ওই আকাশের ন্যায় বিশাল সাগরকে সামনে রেখে। সবচেয়ে ভালো ব্যাপার হলো এখানে বাইরের কারো প্রবেশাধিকার নেই। ওপরে ছাউনি আবৃত এত বড় বাংলোয় ওদের মাঝে নেই কোনো তৃতীয় পক্ষ !

সমুদ্রের আচ্ছনতা থেকে জোর করে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বর্ষা এবার নাব্যকে অনুসরণ করে ভিলার ভেতর দিকে পা বাড়াল। কাঁচের দরজা ঠেলে প্রবেশ করল বিচ ভিউ লিভিং রুমে। যার পাশেই বিশাল বেডরুম।

বর্ষা মুগ্ধতার ঘোর ছেড়ে বেরোতে পারছিল না। স্নিগ্ধতার এই প্রগাঢ় ঘন সন্নিবেশে একলা হয়ে ওর মন চাইছিল অনুভূতি গুলো কারো সাথে ভাগ করে নিতে। কিন্তু সে পথ বন্ধ। নাব্য এসেই নিজেকে নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে পরেছে। লোকটার বোধহয় শুচিবাই বা ওরকম কিছু আছে। ফ্রেশ হওয়ার নামে বাথরুমে গেলেও ঘন্টার আগে কখনো ফেরে না। রোজ তিনবার গা ধোয়। এখানে এসেও সেই একই ব্যাপার। তাছাড়া ওর দুচোখে বর্ষার মতো আবিস্কারের মুগ্ধতা নেই। ওর অনুভুতির প্রকাশ গুলোও নয় বর্ষার মতো অর্বাচীন। এসব ছবি যেন ওর চোখে সওয়া!

কিন্তু বর্ষা কিছুতেই স্বাভাবিক হতে পারছিল না। এত এত সুন্দরের দেখা একসঙ্গে পেয়ে ওর মন, মস্তিষ্ক ইতোমধ্যে এলোমেলো আচরণ শুরু করে দিয়েছে। জড়তা ভুলে নাব্যর সামনেই তিড়িংবিড়িং করে লাফাচ্ছে সে। পুরো বাংলোয় এক চক্কর দিয়ে কাঁচের দরজা ঠেলে ফের একবার প্রাঙ্গণে নেমে এলো। গাছের সারি, বসার স্থান, পুল… সব পেরিয়ে ছুটে গেল সমুদ্রের দিকে মুখ ফেরানো সেই নিচু প্রাচীরের কাছে। যেখান থেকে তখন পড়ন্ত বিকেলের, পিঙ্গল আকাশের চাঁদোয়ার পটভুমিতে শান্ত, নীলাভ সমুদ্দুর দেখা যাচ্ছে।

***

রাত্রি নামল। বর্ষা অধৈর্য হয়ে অপেক্ষা করছিল কখন সমুদ্রের জলে পা ভেজাবে। কাছ থেকে অনুভব করবে সাগরের বড় বড় ঢেউয়ের তীরে উপচে পড়ার শব্দ। কিন্তু নাব্যর মতিগতি ক্রমশ দ্বিধা সঞ্চার করল ওর মনে। যখন দেখল ওকে কিছু না বলে সে একাই তৈরি হয়ে বেরোবার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
লিভিং রুমের সোফায় থম মেরে বসে বর্ষা আড়চোখে লক্ষ্য করছিল ওকে৷ সে উদগ্রীব হয়ে তাকিয়ে ছিল। এই অপেক্ষায় যে কখন নাব্য ওকে বলে,
-” দ্রুত তৈরি হয়ে নাও। এক্ষুনি বেরোচ্ছি আমরা!”

কিন্তু নাব্য সেসবের ধার দিয়েও গেল না।
শার্টের হাতা ভাজ করতে করতে সহসা ওকে উদ্দেশ্য করে বলল,
-” দরজা ভেতর থেকে লক করে রাখো। কেউ এলেও খোলার প্রয়োজন নেই। চাবি সঙ্গে নিচ্ছি আমি। ”

-“আপনি একাই চলে যাচ্ছেন? আমি বুঝি সমুদ্র দেখবো না? ” কথাটা বলতে চেয়েও বলা হলো না বর্ষার। ও টের পেল। মনের ভেতর কোথায় যেন একটা দেয়াল ভেঙে পড়ার শব্দ হচ্ছে। ক্ষ’তবিক্ষত হয়ে যাচ্ছে ওর হৃদয়ের শুভ্র মানসপট!

নাব্য চলে গেল। প্রতিবারের মতো এবারো নাব্য ওকে প্রকাশ্যে অবজ্ঞা করেছে। একদৃষ্টে ওর গমন পথে তাকিয়ে রইল বর্ষা। সমুদ্রে আসাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা ওর সমস্ত উচ্ছ্বাস, উদ্দিপনা, রোমাঞ্চ এক লহমায় ছুটে পালিয়ে গেল। নাব্যর ওই একটুখানি উপেক্ষায় ব্যাথিত হয়ে। আর তার স্থান দখল করে নিল একবুক উষ্ণ অভিমানের স্রোত।

তারপর কি ভেবে হঠাৎ জায়গা ছেড়ে উঠে পড়ল সে। কাঁচের দরজা খুলে নেমে গেল সেই ‘আকাশ-রঙ্গী’ প্রাঙ্গণে। যাওয়ার আগে ভেতরের ও প্রাঙ্গণের বাতিগুলো সব নিভিয়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে ঝুপ করে আঁধার নামল চারিদিকে। রাত্রির সেই অন্ধকারও যেন সর্গীয় কোনো আভার অংশ!

আকাশে পূর্ণচন্দ্র। পুলের স্বচ্ছ টলমলে জলে পড়ছে জোৎস্নার ছায়া। শীতল বাতাসের ঝাপটায় সমুদ্রের সতেজ, নোনা গন্ধ নাকে এসে লাগছে। কানে অবিরত বাড়ি খাচ্ছে সাগরের নিশিত গর্জন! সামনে যতদূর চোখ যায়, সেখানেও আদিগন্ত বিস্তৃত সাগরের ছাইরঙা জলরাশি ছাড়া আর কিছু নেই। জনমানবহীন এই বিধুর প্রান্তরে। বাতাসে নারকেল পাতার খসখসানি আওয়াজ আর সমুদ্রের সো সো গর্জন ছাড়া চারপাশ যেখানে নিদারুণ সঙ্গিন, নিস্তব্ধতায় আচ্ছন্ন। সেই নিচু প্রাচীরের গা ঘেঁষে, চোখ জোড়া আকাশে স্থির রেখে, সম্মোহীতের ন্যায় দাঁড়িয়ে রইল বর্ষা।

সমুদ্রেরও নিজস্ব ভাষা আছে। যদিও সে ভাষা অনুধাবনের যথাযথ বোধ সকলের থাকে না। প্রকৃতিকে অনুভবের এই অতিন্দ্রী ক্ষমতা যার থাকে নিসন্দেহে সে পৃথিবীর বুকে ভীষণ একাকী হয়। অসহ্য নিস্তব্ধতার অতলে অবগাহনে যোগ্যতাপূর্ণ অন্তঃকরণ কেবল সমুদ্রের সে ভাষা বোঝে।

সমুদ্রকে অনুভবের সে ভাষা বর্ষা জানে। তাই দূরবাসী হয়েও, সমুদ্রের জলে পা না ভিজিয়েও। সেই রাত্রির নিগূঢ় লগ্নে অন্যন্য এক বিবশতায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে সে। নক্ষত্রে ছেঁয়ে থাকা আকাশের নিচে, একক এবং নিঃসঙ্গ হয়ে, সেথায় দাঁড়িয়ে কেবল সমুদ্র কে অনুভব করতে থাকে প্রগাঢ় ভাবে। হিমধরা সমুদ্র সমীরণে উড়তে থাকে ওর খোলা চুল, আসমানী রঙা শাড়ির অবাধ্য আঁচল। ওর দুই কান, চোখ ভাসতে থাকে কেবল সবকিছুকে তুচ্ছ করা সমুদ্রের শাণিত গর্জনে। বর্ষা বিষাদ ক্লিষ্ট, উন্মনা, সুরহীন স্বরে বলে ওঠে ,

যদি সে না’ও আসে তুমি এসো চাঁদ
জানালায় রেখেছি বিষাদ
দেখে যেয়ো কতো সুখে আছি ।
তুমিও তো সেই তার মতোই –
পরিযায়ী পাখি
ক্ষণকাল থাকো ভরে জানালা আমার ……

___________________________

রাত্রিটা নিদারুণ মর্মবেদনায় পাড়ি দিলেও পরদিন একটা অভাবনীয় ব্যাপারের মধ্য দিয়ে সকালটা শুরু হয় বর্ষার। অভাবনীয় এজন্যে যে অতটাও সে ভাবেনি কোনোদিন।
শেষ রাতে এলার্মের শব্দে ঘুম ভাঙে ওর। লিভিং রুমের সোফা ছেড়ে উঠে ফজরের সালাত আদায় শেষে সে গিয়ে দাঁড়ায় সমুদ্রমুখী কাঁচের জানালার পাশে। সেখানে দাঁড়িয়ে শান্ত – ধূসর, রাত্রি শেষের সমুদ্র দেখতে থাকে স্তব্ধ চোখে। গায়ে একরঙা মিহি গোলাপি জামা। মাথায় সফেদ ওড়না জড়ানো। নিদ্রাভঙ্গ স্বচ্ছ, টলোমলো দুটি চোখ জানালায় স্থির। জানালার দুল্যমান পর্দার ফাঁক গলে তিরতির করে আসছে সুবাহ সাদিকের শীতল বেহেশতী বাতাস। সঙ্গে সমুদ্রের নিকটবর্তী বালুচরের ঝাউবন আর নোনা জলের প্রচুর গন্ধ নিয়ে। বর্ষার মন চাইছিল ভারহীন মুক্ত বিহঙ্গের মতো উড়ে-ফুঁড়ে মুহুর্তে এই রুদ্ধ কাঁচের দেয়াল পেড়িয়ে ওই দূর সমুদ্রে চলে যেতে।

তবে মনের সে ইচ্ছে মনেই রয়। দু-হাতে জানালা ধরে, মাথা ঠেকিয়ে সে দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে আনমনে। বিরাগানুভূতির এক অপরিচিত রূপে আচ্ছন্ন হয় বর্ষার মন!

তখনি আচমকা পেছন থেকে ঘুমাদ্র, ভারি স্বরে থেমে থেমে নাব্য বলে ওঠে,
-“সমুদ্রে যাবে? সূর্যদয় দেখতে? ”

নাব্যের স্বরে বর্ষা এতটা চমকিত হল যে প্রায় চিৎকার বেরিয়ে আসছিল ওর মুখ দিয়ে। তবে সেটাকে দমিয়ে, চোখ মুদে, বুকে হাত রেখে বার দুয়েক ঘনঘন নিশ্বাস নেয় সে। হৃৎপিণ্ড টাকে শান্ত করে ঘুরে তাকায় নাব্যর দিকে। বেচারা মাথা থেকে টুপি নামিয়ে তখন দু’হাতে ভাজ করছে। ও কি তাহলে সালাত শেষ করেই এখানে এসেছে? হয়তো!
সারারাত দুঘরে ছিল দুজন। তাই বর্ষা অতটা নিশ্চিত হতে পারে না৷ তবুও দৃশ্যটা ভীষণ মনে ধরে ওর। আহা…. লোকটা যদি আদতেই সবসময় এমন হতো তাহলে ক্ষতি কি ছিল? ওকে খুব ভালো নাই-বা বাসলো। সবসময় ওর আঁচল ধরে নাই-বা ঘুরল। কিন্তু বরাবর এরকম শুদ্ধ থাকত! অন্তত রবের হকের ব্যাপারে।
আর মাঝে মাঝে একটু যত্ন নিত, পরিচর্যা করতো ওর মনের। ছোট ছোট শখ, আহ্লাদ গুলো পূরণ করে…। তাতেই তো বর্ষা ভীষণ খুশি। ভালোবাসার ক্ষেত্রে সে লোভী তো নয়। ছিলও না কোনোকালে। তাছাড়া সে কি জানে না? পুরুষেরা নিজের ভালোবাসার প্রতিও সর্বদা বেখেয়াল। ভালোবাসলে যে তার যত্ন নিতে হয়, পরিচর্যা করতে হয় ফুলগাছের মতো। অন্তত মাঝে মধ্যে গাছে জল ঢালতে হয়, আগাছা সরিয়ে সাফ রাখতে হয়। নাহলে যে সেই গাছ একেবারে শেকড় থেকে শুকিয়ে, মরে যায়। কিন্তু ওরা, পুরুষেরা সেকথা বোঝে না। সেকথা বোঝার ক্ষমতাই দেয়া হয়নি ওদের। তাই বর্ষার অতশত আকাঙ্ক্ষা ছিল না। ভালোবাসা কম হোক। কিন্তু যেটুকু হোক, ভালো মানুষের দারা হোক। নাব্য কবে হয়ে উঠবে বর্ষার মনের মতো ভালো মানুষ?
নাকি আজই রোপিত হলো তার প্রথম সোপান? নাব্য কি তবে এবার সত্যিই হয়ে উঠবে বর্ষার মনের মতো মানুষ? ভেবে আনমনে নিশ্বাস ফেলে বর্ষা।

তবে সকালটা সেদিন সত্যিই স্বপ্নের মতো শুরু হয় বর্ষার। নাব্যর সঙ্গে ও যখন প্রথম বালুকাবেলায় পা রাখে তখনো সূর্য ওঠেনি। হুটোপুটি করে ছুটে পালানো লাল কাঁকড়ার দল দেখতে দেখতে ওরা সমুদ্রের নিকটবর্তী হয়। তবে যত কাছে যাচ্ছিল। সমুদ্রের বিশালতা দেখে তত বিস্ময় আর একটা অজানা ভয় বাড়ছিল বর্ষার। অবাক হয়ে ভাবছিল ও। সমুদ্র এতো বিশাল হয়!

ধীরে ধীরে আকাশ রাঙানো পিঙ্গল সূর্যের রঙে রঙিন হতে থাকল সমুদ্রের জলরাশি। তার মধ্যে দিয়ে মাথা বের করে সকালের তেজহীন রক্তিম সূর্য। সমুদ্রের বুকে নেমে আসা বাহারি মেঘপূর্ণ রক্তিম আকাশ, আকাশের সেই রঙে রাঙানো দিগন্ত বিস্তৃত জলরাশি, সৈকতের ঝিনুক পূর্ণ ছোট বড় প্রবাল, যার গায়ে অবিরাম আছড়ে পড়ছে ফেণাযুক্ত নোনা ঢেউ। বর্ষার কাছে অপার্থিব হয়ে পুরো দৃশ্যটা ধরা দিল। রবের নিয়ামাহ এতো সুন্দর, এতো মনোমুগ্ধকর হতে পারে এর আগে এভাবে উপলব্ধি করেনি সে কোনোদিন! ওর মুখ দিয়ে আপনাতেই বারবার উচ্চারিত হতে থাকে, ‘ সুবাহানাল্লাহ! সুবাহানাল্লাহ! ‘

ওরা সেদিন অনেক বেলা পর্যন্ত থাকে সাগর তীরে। বর্ষা কতবার দুরুদুরু বুক নিয়ে সমুদ্র জলে পা ভেজায়। অন্য দিনের চেয়ে নাব্য যে সেদিন ওর প্রতি বিশেষ যত্নবান হয় তা নয়। সেদিনও সে অকারণ গাম্ভীর্য ধরে রাখে মুখের প্রতিটি রেখায়। প্রয়োজন হীন একটা বাড়তি কথাও বলে না বর্ষার সঙ্গে।
বর্ষা যতবার আছড়ে পড়া ঢেউয়ের কাছে ছুটে গিয়ে দাঁড়ায়। নাব্য ততবার গম্ভীর স্বরে হুশিয়ারি দেয়, সমুদ্রের অত কাছে না যেতে। তবে বর্ষা আজ পরোয়ানাবিহীন! নির্বিকার!

নাব্যর কোনো বারণ ওর কর্ণকুহরে প্রবেশ করে বলে মনে হয় না। অন্তত ওর আচরণে তেমনটাই বোধ হয়!
নির্জন বালুচরে, সমুদ্রের নীল ফেণাযুক্ত জলরাশীর সঙ্গে খেলায় মেতে ওঠে সে। মহীসোপানে দাঁড়িয়ে উৎসুক দৃষ্টি মেলে চেয়ে থাকে সাগরের দিকে। বড় বড় ঢেউ আছড়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ছুট দেয় তীরের দিকে। তবে প্রতিবারই সমুদ্রের কাছে হার মানে সে। ফেনীল জলরাশী ওকে প্রতিবার ভিজিয়ে দেয় আগের বারের চেয়েও বেশি। সেদিন বর্ষা নাব্যর দেয়া সমস্ত দুঃখ, অবহেলাকে সমুদ্রে ভাসিয়ে দিয়ে হালকা হয়। ওর মনে আর কোনো দুঃখবোধ নতুন করে স্থান নিতে পারে না।

চলবে……..