একদিন নববর্ষা -২৮
অদ্রিজা আশয়ারী
____________
সমুদ্রের বুকে নামে আরেকটি নিঝুম রাত্রি। নিম্নচাপের ফলে সৃষ্ট বৃষ্টি ও ঝোড়ো আবহাওয়ায় প্রাদুর্ভূত হয়ে পরে গোটা সমুদ্রঅঞ্চল।
সেই দেখে, সমুদ্রের মোহে সমাচ্ছন্ন বর্ষার মন ছেয়ে যায় পরিতোষের তৃপ্তিতে। রাত্রির কালো ঢেউ, ক্রুদ্ধ গর্জন আর তার বুকে আকাশ থেকে নেমে আসা বারিধারা মিলে যেন এক অতীন্দ্রি আবহ সৃষ্টিতে মত্ত হয়। আবহাওয়ার এই বিক্ষিপ্ত গতিকে ক্রমশ মাতাল হয়ে পরে বর্ষার দুরন্ত মন! তবে শীগ্রই বর্ষা ঘোর ছেড়ে বাস্তবতার নিঠুর ভূমে ফিরতে বাধ্য হয়।
রাত তখন প্রায় পৌনে এক। বাইরে পৃথিবী আঁধার করে নেমেছে বৃষ্টি। আকাশে বিদ্যুতের ঘনঘন ঝলকানি। চারপাশে তার ত্রাহিত্রাহি নিনাদ। বৃষ্টির প্রকোপে আবহাওয়া তখন ভারি শীতল হয়ে এসেছে। পাশের ঘরে নাব্য বেঘোরে ঘুমোচ্ছে। ঝড় বৃষ্টি শুরুর আগে লিভিং রুমের সোফায় শুয়ে প্রকৃতির মাতালতাকে বর্ষাও উপভোগ করছিল বেশ। কিন্তু সহসা বাইরে শুরু হওয়া এই তা’ন্ডবলী’লার প্রচন্ড ঝড়-বৃষ্টি ক্রমশ ভীতি সঞ্চার করল ওর মনে। বিদ্যুতের প্রতিটি ঝলকানির সাথে সাথে কেঁপে উঠছিল ভিলার মূল কাঁচের দরজাটি। বাইরের সারিবদ্ধ গাছগুলো ও দূরের সমুদ্র তটের নারকেল গাছেরা একে অন্যের গায়ে বা’ড়ি খাচ্ছিল জোড়ালো ভাবে। আকাশের চমকিত আলোয় ফর্সা হয়ে পড়ছিল ঝড় -বৃষ্টিতে মত্ত, রাত্রির সমুদ্র উপকূল। কি ভয়ংকর দেখাচ্ছিল তখন প্রলয়ঙ্কারী ঝড়ে সমাসন্ন সমুদ্র ও তার বালুকাবেলার রূপ! মুগ্ধতার ঘোর উবে গিয়ে, সহসাই বর্ষার চিন্তাধারার সবটুকু দখল করে নিল একরাশ নিদারুণ ভীতি! হঠাৎই ওর খেয়াল হয় ঝড় বৃষ্টিকে ওর চিরকালের ভয়!
মধ্যরাত্রি। ঘুমানোর সব আয়োজন তখন সম্পুর্ন। ঘরের বাতিগুলো নেভানো। পাশের ঘরে টিমটিম করে জ্বলছে কেবল একটি ডিম লাইট। সোফায় কাঠের পুতুলের মতো স্থবির হয়ে বসে রইল বর্ষা। ওর হৃৎস্পন্দন এত জোড়ালো হলো যে ও নিজেই শুনে ঘাবড়ে গেল। বর্ষার মনে হলো এভাবে আরও কিছুক্ষণ কাটলে অবিলম্বে সে হার্ট অ্যা’টাক করে বসবে। এদিকে বাইরের প্রলয় হুং’কার তখন আরও বেড়েছে। অবিরত ভাবে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। কাচের দরজায় শব্দ বাড়ছে। বর্ষার মনে হলো দরজা ফুঁড়ে এখনি একটি কালো হাত এসে ওকে গ্রা’স করে নেবে। টেনে নিয়ে যাবে উত্তাল সমুদ্রের কাছে, প্রল’য়ঙ্কারী ঝড়ে….। তখনি প্রথমবারের মতো কেঁদে উঠল বর্ষা। ভয়ে, আতঙ্কে জমে গিয়ে চি’ৎকার করে কান্না বেরিয়ে এল ওর মুখ থেকে। একবার ভাবল দৌড়ে নাব্যর কাছে চলে যায়। তাহলে হয়তো এই আতঙ্ক থেকে মুক্তি মিলবে। কিন্তু পরমুহূর্তেই ওর মনে হতে লাগল ঘরের প্রতিটি আসবাবে যেন প্রাণ সঞ্চারিত হয়েছে। প্রেতের মতো ধে’য়ে আসছে ওরা সবাই তার দিকে। ওর আর বাঁচবার কোনো আশা নেই! যতটা সম্ভব সোফায় গা সেঁদিয়ে মনে মনে কালিমা শাহাদাত পড়তে পড়তে কাঁদতে লাগল বর্ষা।
ছাউনি আবৃত বাংলোয় বৃষ্টির শব্দ বারবার ছাপিয়ে উঠছে বর্ষার কান্নার আওয়াজ কে। তবুও কোনো একফাঁকে সেই কান্নার শব্দ গিয়ে পৌঁছাল নাব্যর কানে। ভয়ানক কিছু ঘটেছে ভেবে ঘুম ভেঙে, লাফিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে, লিভিং রুমে ছুটে এল নাব্য। ঘুরঘুট্টি অন্ধকারে প্রথমটায় প্রায় কিছুই বোঝা গেল না। কান্নার উৎস অনুসরণ করেই তাই এগোতে হলো ওকে। সোফায় কাছাকাছি এসে দাঁড়াতেই সামনের টি টেবিলের সঙ্গে বেঝে প্রায় পড়ে যেতে চলেছিল সে। তবে নিজেকে সামলে নিল। কিন্তু এতে আরও আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ল বর্ষা। নাব্যর আগমন টের পায়নি সে। তাই যখন ওর খুব কাছেই, টি টেবিলে একটা ধুপ শব্দ হলো আর তারপর সামনে একটা দীর্ঘাঙ্গ অবয়ব দৃশ্যমান হলো আর কিছু ভাববার মতো রইল না বর্ষার। সে চোখ বন্ধ করে, ‘ভূউউউউউত, ভূউউউউউউত ‘ বলে বিষম চি’ৎকার শুরু করল।
নাব্য হতভম্ব! উত্তেজিত গলায় বলল,
–‘ চুউউউপ। থামো। কোথায় ভূত? ভূত আসবে কোথা থেকে? এটা আমি! এইযে দেখো!’
বর্ষার কর্ণকুহরে ওর কথা প্রবেশ করেছে বলে মনে হলো না। সে চেঁচিয়েই যাচ্ছে। এমন চলতে থাকলে রিসোর্টের লোক জড়ো হতে বেশি সময় লাগবে না। ভাবল নাব্য।
–‘ এই মেয়ে চুউউপ। থামো বলছি।’ বলে অধৈর্য হয়ে দু পা এগিয়ে সে নিজেই এবার দু’হাতে বর্ষার মুখ চে’পে ধরল।
ভীতস’ন্ত্রস্ত বর্ষার অক্ষি, কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসবার জোগার। কিন্তু মুহুর্ত কাল পরেই ওর ভুল ভাঙ্গল। বুঝল যাকে ভূত ভেবে চেঁচাচ্ছিল সে আদতে ভূত নয়। আস্ত একটা রাক্ষস! মিস্টার কংক্রিট!
বর্ষা চেঁচানো বন্ধ করল। সাথে সাথেই ওর মুখ ছেড়ে দিল নাব্য। বিরস মুখে বলল, ‘এই মাঝরাতে এভাবে চি’ৎকার করে কাঁদার মানে টা কি? আর আমাকে দেখেই বা এভাবে ভূত ভূত বলে চেঁচাচ্ছিলে কেন?’
প্রতুত্তরে কি বলবে ভেবে পেল না বর্ষা। ওকে আমতাআমতা করতে দেখে বিরক্ত হয়ে বিরবির করে কিছু একটা বলে নাব্য ফিরে যাচ্ছিল নিজের ঘরে। নাব্যকে চলে যেতে দেখে ফের একবার চেঁ’চিয়ে উঠল বর্ষা।
–‘যাবেন না। প্লিজ। আমি….আমি এখানে একা একদম থাকতে পারব না। খুব ভয় করছে আমার..।’
নাব্যর মে’জাজ বি’গড়ে গেল। একে তো ঘরটা বানিয়ে রেখেছে ঘুরঘুট্টি অন্ধকার। ন্যাকা মেয়েটার মুখ পর্যন্ত ভালো করে দেখা যায় না। তার ওপর বাইরে এমন ঝড়বৃষ্টি। বেডরুম থেকে চুইয়ে যেটুকু আলো আসছে সেটুকুই ভরসা। তার মধ্যে এই মাঝরাতে মেয়েটা এখন কিসব নখড়া শুরু করেছে! নাব্য কঠিন গলায় বলল,
–‘ এখন তাহলে কি করতে হবে? ঘুম ছেড়ে সারারাত তোমার সঙ্গে সোফায় বসে বাইরের ঝড়বৃষ্টি দেখতে হবে? তাহলেই ভয় কাটবে?’
বর্ষার ফের কান্না পাচ্ছে। লোকটা এইভাবে কথা বলে কেন ওর সঙ্গে সবসময় ? সে কি একটু ভালো ব্যাবহারও পাওয়ার অধিকার রাখে না? ওর ঘুমকাতুরে চোখ দুটোয় সেই কখন থেকে রাজ্যের ঘুম আসি আসি করছে। ভয়ের চোটে এতক্ষণ ঘুমটা টের পায়নি। কিন্তু নাব্য আসার পর ভয় একটু কমতেই এখন আবার অত্যাচার শুরু হয়েছে। দুচোখের পাতা ভার হয়ে নেমে আসতে চাইছে। এখানে-সেখানে, কোথাও একটু কাত হতে পারলেই এবার সে ঘুমের অতল রাজ্যে ডুবে যাবে। কিন্তু লোকটা এভাবে কথা বলছে কেন? এত রূঢ় স্বরে কেন সে সবসময় কথা বলে বর্ষার সঙ্গে?
বর্ষাকে চুপ করে থাকতে দেখে এবার মৃদু ধ’মকের সুরে নাব্য বলল,
–‘ কি হলো? কথা বলছ না কেন?’
যদিও নাব্য ওকে দেখতে পাচ্ছে না। তবুও কথাটা বলবার আগে বর্ষা মুখ নিচু করল।
মিনমিনে স্বরে বলল, ‘আপনি বিছানায় ঘুমান। আমি মাটিতে শুয়ে পড়ব। কিন্তু এই ঘরে একা… একদম থাকতে পারবো না আমি….’
অন্ধকারে বর্ষার মুখটা ঠিক কোথায় তার আন্দাজ পাচ্ছে না নাব্য। তবুও অন্ধকারেই অনুমানে কয়েক মুহুর্ত তাকিয়ে রইল সে। তারপর গম্ভীর গলায় বলল, ‘আচ্ছা এসো।’
ঠিক তখনি অতর্কিতে ঘটল বিদ্যুৎ বিভ্রাট! যা পুরোপুরি অপ্রত্যাশিত ছিল দুজনের কাছেই। বর্ষা কিছু না ভেবে সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার দিয়ে নাব্যর বাহু খা’মচে ধ’রল। নাব্য দু পা এগিয়ে বিরক্ত হয়ে ওর হাত ছাড়াতে চাইতেই আরও স্কচটেপের মতো সেঁটে গেল সে নাব্যর সঙ্গে।
লিভিং রুম থেকে কয়েক পা এগিয়ে বেডরুমে যেতেই ভয়ে বর্ষার এহেন অবস্থা দেখে, ঘরে গিয়ে ফোনের ফ্ল্যাশলাইট জ্বেলে নাব্য পানসে গলায় বলল, ‘নিচে শোওয়ার দরকার নেই। ওপরেই শুতে পারো তুমি। ‘
নাব্যর বদান্যতায় বর্ষা খুশি না হয়ে পারল না৷ বলতে নেই, নিচে শুতেও ওর ভীষণ ভয় হচ্ছিল। কিন্তু এছাড়া আর উপায়ও নেই। সেই ভেবেই বলেছিল নিচে শোবার কথাটা। সঙ্গে সঙ্গে বাধ্য মেয়ের মতো মাথা দুলিয়ে ‘আচ্ছা’ বলল সে। নাব্য দায়সারা গোছের একটা চাহনি দিয়ে ফ্ল্যাশ বন্ধ করে বিপরীত মুখী হয়ে শুয়ে পড়ল।
___________________________
অপরাহ্নের সমুদ্রে ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে বেড়াচ্ছে এক প্রজাতির পাখি। নামটা ভারি মিষ্টি। ‘গঙ্গা কৈতর’। মেঘমেদুর আকাশের গাঢ় ধূসর রঙে রাঙানো পাখির শরীর। কখনো সমুদ্রের ফেনীল জলরাশীতে, কখনো ঢেউয়ের ভাঁজে ভাঁজে ওরা নেচে বেড়াচ্ছে। পাখিগুলো বেজায় ছটফটে। কালো মেঘে মেঘে ছেয়ে থাকা আকাশে আসন্ন ঝড়ের ইঙ্গিত। ঝড়ের আগের উত্তাল সাগরে গঙ্গা কৈতরেরা খেলায় মেতেছে। খুশিতে ধাতব-সুরেলা কণ্ঠে ‘ক্রিম ক্রিম’ শব্দে ওরা ডেকে চলেছে অবিরাম। সেন্ট মার্টিনে পাখির অভাব নেই। শেষ বিকেলের সমুদ্র তট জুড়ে হাজারো পাখির মেলা এখানে। বর্ষা সাগরের কিনারায় দাঁড়িয়ে দেখছিল। সমুদ্রের রঙ ক্রমশ নীল থেকে পালটে কিভাবে ছাইবর্ণে পরিনত হচ্ছে।
আজকের আবহাওয়া গতকালের চেয়ে বেজায় খারাপ। আর বিষাদভারাতুর। জলীয়বাষ্প পূর্ণ ভারি ধূসর মেঘেরা আকাশের কিনারায় এসে জড়ো হয়েছে, সমুদের একেবারে গা ঘেঁষে! উত্তাল কালো জলরাশি আর মেঘ মিলেমিশে একাকার, আদিগন্ত বিস্তৃত সমুদ্রের ওপারে। দূর থেকে সেদিকে তাকালে মনে কেমন ভয় হয়! এভাবে সমুদ্রের ঢেউয়ের সামনে স্থির দাঁড়িয়ে থাকাটায় একটা সম্মোহনী আকর্ষণ খুঁজে পায় বর্ষা। প্রতিবার সমুদ্রের বুকে এসে ওর মন অন্যন্য এক বিবশতায় আচ্ছন্ন হয়। মনের ভেতর অদম্য এক শক্তি আসে। দুঃসা’হসিক কিছু একটা ঘটাতে মন চায়!
আজও তাই হচ্ছে! বর্ষার মনের বিক্ষিপ্ত ভাবনায় ছেদ পড়ে নাব্যর অতর্কিত আগমনে। কাল রাতের এমন প্রল’য়ঙ্কারী ঝড়ের পরও আজ খুব ভোরেই রোদ্দুরের দেখা মেলে। তাই সকালেই ওরা বেরিয়েছিল সেন্ট মার্টিনের উদ্দেশ্যে।
-‘ এবার চলো। আবহাওয়া খারাপ। ঝড় নামার আগেই কক্সবাজার ফিরতে হবে।’ নাব্য ভাবলেশহীন গলায় বলে।
বর্ষার সম্বিত ফেরে। নাব্যর পেছন পেছন হাটতে শুরু করে সে।
সেন্ট মার্টিন থেকে সন্ধ্যের মুখে যাত্রা শুরু করলেও কক্সবাজারে, সৈকতে ওদের নির্দিষ্ট ভিলায় ফিরতে ফিরতে সেদিন অনেক রাত হয়। বর্ষা হাতে একটা কাঁচের বোয়াম নিয়ে ফেরে। বোয়ামের ভেতর বাহারি রঙের ও আকৃতির অসংখ্য ঝিনুক। মেরিন ড্রাইভ রোডে গাড়ি থেকে নেমে ওরা ভিলার দিকে হাটতে শুরু করে। পুরোটা সময় বর্ষা বোয়ামটা বুকের কাছে খুব যত্নে জড়িয়ে রাখে। এই কাঁচের বোয়ামে বন্দি ঝিনুক গুলো ওর কাছে বিশেষ! নাব্য ওগুলো কুড়িয়ে দিয়েছিল সেন্ট মার্টিনের সমুদ্র সৈকত থেকে। সেই ছবি মনে ভেসে উঠতেই বর্ষা মিটিমিটি হেসে ওঠে। ভিলার দরজা খুলতে খুলতে নাব্য সহসা আড়চোখে ওর দিকে তাকায়। সঙ্গে সঙ্গে হাসি থামিয়ে গম্ভীর হয়ে যায় বর্ষা।
রাতে শাওয়ার নিয়ে, বর্ষা সাদার ওপর বাহারি রঙের ফুল-পাতার হ্যান্ড প্রিন্ট করা, দামি সুতির একটা শাড়ি গায়ে জড়ায়। ঘর ছেঁয়ে যায় শ্যাম্পুর কড়া সুবাসে! মেঘের মতো দীঘল কালো, ভেজা কোঁকড়ানো চুলগুলো পিঠময় ছড়িয়ে ধোঁয়া ওঠা কফিতে সে চুমুক দেয়। মুহুর্তে চনমনে হয়ে ওঠে ওর মন! আজকের দিনটা এতো বেশি বিশেষ ছিল বর্ষার জন্য। যে সারাদিনে কাটানো মুহুর্ত গুলো এলোমেলো খন্ড চিত্র হয়ে এখনো বারবার ফিরে আসতে থাকে ওর মনে ।
বাইরে থেকে এসেই বেডরুম সংলগ্ন বাথরুমে ফ্রেশ হতে চলে গেছিল বর্ষা, অগত্যা নাব্যকে বাধ্য হয়ে আউটডোর শাওয়ারে যেতে হয়েছিল গোসল করতে। নাব্যবিহীন একলা ঘরে বর্ষা চড়ুইয়ের মতো তিড়িং তিড়িং করে ঘুরে বেড়াতে থাকে। ওর মনে বারবার অনুরণিত হতে থাকে পুরো দিনের সুখময় স্মৃতিচারণ।
হঠাৎ কাঁচের বোয়ামে থাকা ঝিনুক গুলোর কথা স্মরণ হয় ওর। ছুটে গিয়ে ওগুলো নিয়ে ফিরে আসে সে আলমিরার কাছে। ওগুলোকে সযত্নে আলমিরায় তুলে রাখার অভিপ্রায়ে। আলমিরার দ্বার খুলতেই নাব্যর এলোমেলো করে রাখা জামাকাপড় গুলো হুড়মু’ড়িয়ে পড়ে মেঝেতে। একহাতে বোয়াম নিয়ে ঝুঁকে বর্ষা ব্যাস্ত হয়ে অন্যহাতে কাপড় তুলে রাখতে শুরু করে আলমিরার তাকে। কাপড় গোছানো শেষ হতেই বর্ষার খেয়াল হয় মেঝেতে কিছু একটা রয়ে গেছে তখনো। একটা খাম। আলগোছে তুলতে যেতেই খামের ফাঁকে নজরে পরে গোটাগোটা অক্ষরে কাগজে লেখা দুটো শব্দ।
‘প্রিয় বর্ষা’
বর্ষার ভ্রু কুঞ্চিত হয়ে আসে। এই হাতের লেখাটা সে চেনে! নাব্য লেখে এইভাবে। কিন্তু ‘প্রিয় বর্ষা’ বলতে নাব্য কাকে সম্মোধন করেছে? ওকেই নিশ্চয়ই! তা না হলে আর কে! ভেতরে কি আছে জানার জন্য উদগ্রীব হয়ে ওঠে ওর চঞ্চল মন! আর কিছু না ভেবেই সে খাম থেকে বের করে চিঠি টা। মেলে পড়তে শুরু করে। অন্যহাতে তখনো তার কাঁচের বোয়ামটা রয়ে যায়।
বোকা মেয়েটা তখনো জানেনা জীবনের কি ভয়ানক, নিষ্ঠুর সত্যের মুখোমুখি আজ সে হতে যাচ্ছে। এই চিঠি টা পড়ার পর থেকে ওর জীবন আর এরকম শান্ত পালতোলা নাওয়ের মতো থাকবে না। আজ থেকেই শুরু হবে ওর অনুক্ষণ যাতনার অনলে জ্বলে’পুড়ে ছাই হওয়ার বিষাক্ত প্রহর। ম’র্মঘা’তে জর্জ’রিত হওয়ার সেই নিদারুণ ভী’তিকর সময়…….।
চলবে…..
(অনেক লম্বা একটা পর্ব। ধীরে সুস্থে মনোযোগ দিয়ে পড়বেন সবাই।)
একদিন নববর্ষা -২৯
অদ্রিজা আশয়ারী
___________
চিঠি টা পড়তে পড়তেই বর্ষা গায়ে ঈষৎ কম্পন টের পায়। ওর হাতদুটো ধীরে ধীরে স্থবির হয়ে আসতে থাকে। যদিও তখনো সে একহাতে জড়িয়ে রেখেছিল কাঁচের বোয়াম টাকে। চিঠি পড়ে, স্থবির হয়ে যাওয়া অপর হাতটি দ্বারা খাম থেকে টেনে বের করে একটা ছবি। ঝকঝকে রঙিন চিত্রপট। যার পুরোটা জুড়েই নাব্যর পাশে একটি অচেনা মেয়ের উপস্থিতি!
সঙ্গে সঙ্গে কাঁচের বোয়াম টা হাত থেকে পড়ে যায় ওর। ঝনঝন শব্দ তুলে, কাঁচগুলো টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়ে পুরো ঘরের মেঝেতে। বাহারি রঙের ঝিনুক গুলো মেঝেতে অসহায় হয়ে লুটিয়ে পরে, মুখ চাওয়াচাওয়ি করে একে অন্যের। বর্ষা অনুভব করে ওর দৃষ্টি ক্রমশ ঝাপসা হয়ে আসছে, ও হঠাৎ বেশি ঘামছে, কান দিয়ে উষ্মা বেরুচ্ছে, সারা গা কাঁপছে ভয়ানক ভাবে। জড় পা দুটো জায়গায় জমে স্থির। নিশ্বাস নিতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে বর্ষার। একটু অক্সিজেন পাওয়ার আশায় সে হা করে শ্বাস টানতে থাকে।
অপ্রতিশ্রুত অশ্রুজলেরা ইতোমধ্যে গাল গড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। ওদের বাঁধা দেয়ার ক্ষমতা আর নেই ওর। সে আলমিরার হাতল ধরে নিজেকে সামলায়।
তখনি ঘরে প্রবেশ করে নাব্য। টাওয়েলে চুল মুছতে মুছতে বেডরুমের মেঝেতে ছড়িয়ে থাকা কাঁচের টুকরো ও ঝিনুক আর সামনে বর্ষার এই অস্বা’ভাবিক স্থিতি দেখে সে দাঁড়িয়ে যায়। ভ্রু কুঁচকে বলে,
–‘কি হয়েছে? ‘
ওর কণ্ঠস্বরে বর্ষা ঘুরে তাকায়। বর্ষার জ্বলজ্বলে শিখার মতো চোখ দেখে অবাক না হয়ে পারে না নাব্য। মেয়েটির সারা গা এপিলেপসি রোগীর মতো থরথরিয়ে কাঁপছে। হাত – পা কেমন জড়ো, কঠিন দেখাচ্ছে।
বর্ষা চিঠি সমেত ছবিটা নাব্যর দিকে বাড়িয়ে ধরে। কম্পিত, ভাঙা ভাঙা স্বরে, হাল ছেড়ে দেয়া গলায় জিজ্ঞেস করে,
–‘কে ও?’
নাব্য হাত বাড়িয়ে ওগুলো নেয়। কুঞ্চিত ভ্রু নিয়ে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে হাতে থাকা জড় বস্তুদয়ের ওপর। পুরো ব্যাপারটা বোধগম্য হতে ওর কয়েক মুহূর্ত সময় লাগে। তারপরই নাব্য বুঝতে পারে ওর চারপাশের আবহাওয়াটা হঠাৎ ভীষণ গুমোট হয়ে এসেছে। একটা পিন পতনের শব্দও বোধহয় এবার জোড়ালো হয়ে কানে ঠেকবে। চোখে অজস্র কৌতুহল আর সংশয় নিয়ে নত মাথাটা ওপরে তোলে সে। সামনের মানবীটির অমর্ষিত, খেপা চাহনি দেখে ও ভারি বিস্মিত হয়!
চিরকাল অন্যের কাছে যারা সরল বলে পরিচিত। তেজহীন, সদাসর্বদা শীতল মেজাজের জন্য খ্যাত। তারাও কখনো রাগতে পারে। রাগ, জেদ তো মানুষের স্বভাবগত। যারা সর্বদা রাগহীন। ওরাও এই নিয়মের বাইরে নয়। তাই কখনো কখনো ওরাও রাগে। ওদেরও কখনো কখনো সবকিছু ভে’ঙেচু’রে, গুড়িয়ে দেয়ার মতো জেদ হয়। বর্ষা সেই ধাঁচের মেয়ে। যে জীবনে কখনো রাগে না। ওর রাগের উষ্মায় আহ’ত হয়নি কেউ কোনোদিন। তাই বলে মাটি চা’পা জে’দটা দেহ ছেড়ে চিরতরে বেরিয়ে যায় নি। অন্তত আজকের দিনে এসে, সেটুকু প্রমাণ হয়ে যায়। পুরো ব্যাপারটায় বর্ষা এত বেশি ব্যথিত আর ক্রো’ধান্ধ হয়। যা ছিল নাব্যর ভাবনারও অতীত!
ওদের মধ্যে কোনো আত্মিক বন্ধন গড়ে না উঠলেও নাব্য বোঝে এই ব্যাপারে বর্ষার আ’ঘাত পাওয়া আর ক্রো’ধান্বিত হওয়াটা শতভাগ যৌক্তিক।
নাব্য এগিয়ে যায় বর্ষার দিকে। পায়ে স্পঞ্জের স্যান্ডেল থাকায় অনায়াসে, ছড়ানো কাঁচের ওপর পা ফেলে সে। বর্ষার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কয়েক মুহুর্তের জন্য মাথা নত করে। তারপর একটা প্রলম্বিত নিশ্বাস ফেলে চোখ স্থির করে বর্ষার দুচোখে। স্বর যতটা সম্ভব কোমল করে বলে,
–‘ আমি সবকিছু খুলে বলছি তোমায়। বাট ফার্স্ট! প্লিজ কাম ডাউন। মাথাটা ঠান্ডা করো আগে। ‘
নাব্যর এসব অর্থহীন সংলাপ, বর্ষার কানে কাটা ঘায়ে নুনের ছিটার মতো অসহ্য শোনায়। সে তখন ক্রো’ধে অন্ধ। মাথা স্বাভাবিক ভাবে কাজ করা থামিয়ে দিয়েছে বহু আগেই। র’ক্ত চক্ষু নিয়ে ম’রিয়া হয়ে সে বলে,
–‘কি শুনব আমি? এতসব প্রমাণের বিপরীতে কি বলার আছে আপনার?
বলতে পারবেন ও আপনার কেউ হয় না। এই কাগজে আর ছবিতে যা কিছু আছে সব মিথ্যে, বানোয়াট?’
উত্তরের অপেক্ষায় নাব্যর মুখে তাকিয়ে রয় বর্ষা।
নাব্য নিরুত্তর। তারপর হঠাৎ একসময় বলতে শুরু করে,
–‘ না। এসব কিছু মিথ্যে নয়! সবই সত্যি! বর্ষাকে সত্যিই আমি ভালোবেসেছিলাম। হয়তো সেও বেসেছিল। কিন্তু তারপর…… ‘
–‘তারপর কি?’
–‘বর্ষার অন্যত্র বিয়ে হয়ে যায়। ‘
–‘কিন্তু আপনি সেই ভালোবাসার কথা ভুলতে পারেন নি আজও । এখনো ওর ভালোবাসাতেই মত্ত হয়ে আছে আপনার সমস্ত চেতন। তাই না?’
পুরো ঘরজুড়ে পিনপতন নীরবতা। বর্ষার কোনো প্রশ্নের জবাব জানা নেই নাব্যর। সে আজ স্বীকার করে নিয়েছে ওর বিরু’দ্ধে করা বর্ষার সমস্ত অভিযোগ সত্য! কথাটা মেনে নিয়ে, হতাশায় বুদ হয়ে দু’হাতে মুখ ঢেকে ফেলে সে। বুকের বদ্ধ পিঞ্জরে তীব্র অসহায়ত্বের ঝড় চলতে থাকে। নাব্য বোঝে, এমন একটা দিন ওর জীবনে আসবার কথাই ছিল। আজকের এই পরিণতির সোপান তো সে নিজেই সেদিন গে’ড়েছিল। যেদিন পুরনো বর্ষার ভালোবাসায় আকণ্ঠ ডুবে থেকে, নবীনতম বর্ষাকে জীবনে ঠাই দিয়েছিল সে।
তবুও বর্ষার নির্নিমেষ চাহনি ওকে ঘিরে থাকে। বর্ষা স্থির দৃষ্টি মেলে ওর দিকে তাকিয়ে রয় অনেকক্ষণ। যখন বোঝে ওর অনুমান মিথ্যে নয়। তখন আরও একবার বজ্রা’হত হয় সে। ফের একবার আঘা’তে নির্ম’ম ভাবে জর্জ’রিত হয় ওর মনের অন্তঃস্থ কোণ!
ওর বিদীর্ণ বক্ষ থেকে চিৎ’কার বেরিয়ে আসতে চায়। স্তম্ভিত হতবাক গলায় বর্ষা বলে,
–‘ছিঃ! এতো নীচ আপনি! নিজের বিবাহিত স্ত্রীর সাথে কথা বলতে আজও আপনার বাঁধে। অথচ একটা অ’বৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে, সেই মেয়েটির ছল’নার যাতাকলে পিষ্ঠ হয়ে এখনো আপনি ওকেই ভালোবাসেন! যে নিজে থেকে ছেড়ে চলে গেছে, সে আদতে এক মুহুর্তের জন্যও বেরিয়ে যায়নি আপনার সমস্ত মনন, চিন্তার ব্যাপ্তি থেকে। অথচ যে আছে, তাকে আপনি কোনোদিন একটু অনুরাগের আসঞ্জন ভরে দেখবার চেষ্টাও করেননি। এই দ্বিমুখিতা নিয়েও আপনি বেশ আছেন! অনুশোচনার ছিটেফোঁটাও নেই আপনার মাঝে!’
বর্ষার প্রতিটি কথা বি’ষাক্ত ব্যাক্যবাণের ন্যায় ক্রমাগত নাব্যর অন্তঃস্থিত বক্ষ বিদীর্ণ করতে থাকে। জীবনে হয়তো এই প্রথম, এমন নিরবে, আপন সত্ত্বার প্রতি নিক্ষি’প্ত অবিরত অভিযোগের তীর নাব্য এমন নিশব্দে গ্রহণ করে!
তবে বর্ষা আর স্থির থাকতে পারে না। কথা শেষ করে মাথা নুইয়ে আলমিরায় হেলে পড়ে। দু’হাতে নিজের চুল হিং’স্র ভাবে খা’মচে ধরে ডুকরে কেঁদে ওঠে সে। ওভাবে অবিরত কাঁদতেই থাকে।
ক্রমে ক্রমে ঘরের এই বৈরী পরিস্থিতি অসহনীয় মনে হয় নাব্যর। কিন্তু বর্ষাকে যেন আজ বাতুলতায় পেয়েছে। উত্তরোত্তর বাড়তে থাকে ওর অস্বা’ভাবিক কার্যকলাপ। দেখে একসময় নাব্যর মায়া হয়। সে এগিয়ে যায় বর্ষার খুব কাছে।
–‘ বর্ষা, আমার কথাটা একবার শোন….’ বলে ওকে ছুঁতে যেতেই বর্ষা ছিটকে দূরে সরে যায়।
আসু’রিক গলায় বলে,
–‘খব’রদার! আপনি আমাকে স্পর্শ করবেন না। কেন এভাবে ঠকালেন আমায়? যাকে ভালোবাসতেন তাকে পাননি। তাই বলে আমার জীবন টা কেন নষ্ট করলেন? ‘
নাব্য হাত গুটিয়ে নেয়। বর্ষা আপন মনে বলতেই থাকে,
-‘কেন সবসময় আমিই বারবার ঠকে যাই? ছোট বেলায় যাদের সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতাম, বিশ্বাস করতাম নিজের চেয়েও বেশি। বড় হয়ে বুঝলাম ওরা কেউ কোনোদিন আমায় ভালোবাসেনি। আমি ছিলাম ওদের নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের চিরকালের বোঝা! আমি দূরে সরে গেলেই বরং ওরা বেশ থাকবে। তারপর আপনাকে ভালোবাসলাম সবার চেয়ে বেশি। বিশ্বাস করলাম অন্ধের মতো। এতটা যে আপনার একের পর এক করা ভুলগুলো কখনো ভুল হিসেবে ধরাই পড়েনি আমার চোখে। অথচ আপনার কাছেও আমি ওদের মতোই! একটা আস্তাকুড়ের জঞ্জাল ছাড়া কিচ্ছু না। কতো বোকা ছিলাম আমি!
আসলে আমার রব ছাড়া কেউ কোনোকালে ভালোই বাসেনি আমায়। হয়তো মানুষের ভালোবাসা গ্রহণের অধিকার-ই রাখি না আমি !’ বলে হাউমা’উ করে কাঁদতে কাঁদতে বর্ষা হঠাৎ উন্মা’দিনীর মতো ছুটে বেরিয়ে যায় ঘর ছেড়ে, ছড়ানো কাঁচে পা ফেলে। ভাঙা কাঁচের টুকরো আর ঝিনুকে ক্ষ’তবিক্ষ’ত হয়ে যায় ওর পা। বর্ষা নির্বিকার। লিভিং রুম সংলগ্ন ডাইনিং স্পেসে ছুটে গিয়ে ফল কা’টার ছু’রিটা হাতে নেয় সে। তখনো এপিলেপসি রোগীর মতো থরথরিয়ে কাঁপছে ওর সারা দেহ। ক্রো’ধের উষ্মায় উপস্থিত জ্ঞান লোপ পেয়েছে অনেক আগেই। কিছু না ভেবে বর্ষা আচমকা ছু’রিটা হাতের শি’রায় চে’পে ধরে। পেছন থেকে এই দৃশ্য দেখে নাব্য থমকে যায় কিঞ্চিৎ সময়ের জন্য। সম্বিত ফিরতেই দৌড়ে গিয়ে বর্ষার হাত টেনে ধরে। বর্ষার গায়ে যেন আসু’রিক শক্তি নেমে এসেছে। নাব্যর হাত ছাড়িয়ে সে ফের হাতের শিরায় ছু’রি ধরতে চেষ্টা করে। হুশ’জ্ঞান হারিয়ে চিৎ’কার করে বলতে থাকে,
-‘ ছাড়ুন আমাকে। আজ আমি ম’রবই। কাউকে প্রয়োজন নেই আমার। দূরে সরে যান আমার থেকে। আপনি একটা প্রতা’রক। জো’চ্চর। মেয়েলোভী পি’শাচ! আমি আপনাকে ঘৃ’ণা করি।’
আর সহ্য করা সম্ভব হয়না নাব্যর দ্বারা। অযাচিত ক্রো’ধটা এবার প্রকাশিত হয়েই পরে। ছুরিটা কেড়ে নিয়ে দূরে ছুড়ে ফেলে দিয়ে, সে প্র’চন্ড এক চ’ড় ক’ষায় বর্ষার গালে। চ’ড়টা এতো জোড়াল হয়ে বর্ষার গালে লাগে যে ওর মাথা ভোঁ ভোঁ করে ঘুরতে শুরু করে। দুচোখে অন্ধকার ঠেকে চারপাশ। ব্যাথায় গালে হাত চেপে, মৃদু আর্তনাদে মাটিতে বসে পড়তে বাধ্য হয় সে। বর্ষার বিদ্ধ’স্থ মনে এর একটা গুরুতর বাজে প্রভাব পরে তৎক্ষনাৎ।
নাব্যর দিক থেকে ওর প্রতি প্রথম স্পর্শ টা ভালোবাসার ছিল না। ছিল আ’ঘাতের। এই ব্যাপার টা চিরতরে গেঁথে যায় বর্ষার মনে। এত প্রচন্ড শারীরিক আ’ঘাত নাব্য ওকে করতে পারল! ভেবে সঙ্গে সঙ্গে চোখ ফেটে জল গড়িয়ে পড়ে ওর। তবে সেই জল দেখার জন্য নাব্য তখন সেখানে ছিল না। পাশের ঘরে গিয়ে প্রকট শব্দে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে সে ততক্ষণে।
মাটি থেকে উঠে ডাইনিংয়ের চেয়ারে গা এলিয়ে, অসার দেহটাকে কিঞ্চিৎ সময় ধরে ধাতস্থ করে বর্ষা। নির্দয় পৃথিবীর বুকে ভয়ানক নিঃসঙ্গ আর অসহায় মনে হয় ওর নিজেকে। বাচ্চা মেয়ের মতো নাক টেনে টেনে কাঁদতে থাকে সে ক্রমাগত। নাব্যর প্রতি ওর অভিমানের অভিযোগে, প্রলেপ আরও প্রগাঢ় হয়। তখনি হিতাহিতজ্ঞানশূন্য, জড় মস্তিষ্কে। আরও একবার দুঃসাহসিক কিছু করে বসবার ঝোঁক চাপে ছন্নছাড়া, ভীষণ পাগলাটে, অভিমানিনী মেয়েটির। খোলা চুল, মাটিতে লুণ্ঠিত আঁচল আর আলুথালু বেশ নিয়ে… ক্ষতবিক্ষত নগ্ন পায়ে ভিলা ছেড়ে বেরিয়ে যায় সে ঝড়ের রাতে। মুহুর্তেই ওকে গ্রা’স করে নেয় প্রদাহপূর্ণ প্রলয়ে মত্ত, নিগূঢ় আঁধার রাত্রি….।
___________________________
প্রায় ঘন্টা পেরোনোর পর দরজা খুলল নাব্য।
-‘ দেখো বর্ষা, আমি সত্যিই দুঃখীত। তোমার জে’দ করার যথেষ্ট কারণ ছিল। তা জানা সত্ত্বেও তখন ওভাবে রিয়েক্ট করে ফেলাটা আমার একদমই উচিত হয়নি। নিজের আচরণের জন্য আমি সত্যিই…..’ সঙ্গিন স্বরে কথা গুলো বলতে বলতে সে লিভিং রুমে পা ফেলল। কিন্তু তারপরের কথাটুকু ওর মুখেই রয়ে গেল। হাট করে খোলা সদর দরজা আর ডাইনিং স্পেস থেকে শুরু হয়ে সেই দরজার বাইরে অদৃশ্য হয়ে যাওয়া ছোপ ছোপ র’ক্তমাখা পায়ের ছাপ দেখে সে নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল কিয়ৎক্ষণ! কি ঘটনা ঘটেছে সঙ্গে সঙ্গে আঁচ করতে পারল ওর মস্তিষ্ক!
মুহুর্ত মধ্যে ওর হৃদয়কোণ ছেয়ে গেল একটা অপ্রত্যাশিত হাহাকারের অনুরণনে! হঠাৎ ভীষণ শূন্য মনে হল চারপাশ! কি যেন নেই… কে একজন যেন চলে গেছে বহু দূরে…….
যে মেয়েটা কিছুক্ষণ আগে পর্যন্ত এখানেই গুমরে গুমরে কাঁদছিল। এখন, এই দুর্যোগপূর্ণ বিপজ্জনক রাত্রিতে সে কোথায় আছে জানা নেই নাব্যর!
তখনো বাইরে গগন বিদারী শব্দে বজ্রপাত হচ্ছে। প্রবল হাওয়ায় প্রাঙ্গণের গাছগুলো একে অন্যের গায়ে বাড়ি খাচ্ছে সজোরে। ছোট্ট পুলের টলমলে জলে বৃষ্টির ঝুম ঝুম শব্দ! নাব্যর এখনো বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে যে, জে’দের বশে মেয়েটা এমন উত্তাল ঝড়ের রাত্রিতে কোথাও বেরিয়ে যেতে পারে! মেয়েটার নাকি ঝড়বৃষ্টি তে ভীষণ ভয়। সে তবে কোথায় আছে ? কিভাবে আছে এতক্ষণ!
নাব্য বর্ষার মতো অস্থিরচিত্ত নয়। সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষেত্রে অবশ্যই আগে পিছে ভেবে নেয় সে। কিন্তু বর্ষার এভাবে হুট করে গুম হয়ে যাওয়ার পর ওর পক্ষেও আজ সম্ভব হলো না প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের পরিচয় দেবার। কিছু না ভেবেই ভিলার সামনের বালুকাবেলায় নেমে পড়ল সে। কোথা থেকে খোঁজ শুরু করবে, কোনদিকে আগে এগোবে…..। ভেবে মস্তিষ্ক ফাঁকা লাগছে ওর। বুকের ভেতর দ্রিমদ্রিম শব্দে কে যেন হা’তুড়ি পে’টাচ্ছে অবিরত! ওই বোকা, সারশূন্য, জড় বুদ্ধির মেয়েটার জন্য ওর এত কষ্ট কেন হচ্ছে কে জানে!
সাগরের ফেনীল জলরাশীতে বইছে একের পর এক উত্তাল তরঙ্গ। জলোচ্ছ্বাসে ফুলেফেঁপে উঠেছে রাত্রির সমুদ্রের কালো জল। পুরো সমুদ্রতট জুড়ে প্রবল বায়ুর ঘুর্ণি। সৈকত পুরোপুরি ফাঁকা। এমন দুর্যোগপূর্ণ রাতে, সমুদ্রের বুকে এই জনমানবহীন বিধুর প্রান্তরে বর্ষাকে কোথায় খুঁজবে নাব্য? এমন রাত্রিকে যে চিরকালের সমুদ্র উপকূল বাসীরাও ভয় পায়।
নাব্য সমুদ্রের তীরে পাগলের মতো খুঁজে বেড়াচ্ছে বর্ষাকে। থেকে থেকে ওর মনে ভয়ানক কিছু চিন্তা উঁকি দিয়ে যাচ্ছে। বর্ষার সঙ্গে বাজে কিছু ঘটেনি তো? ওর আদৌও সাঁতার টা জানা আছে তো? বলা তো যায় না! কি অবস্থায় আছে ওই বোকা আর প্রচন্ড জে’দি মেয়েটা কে জানে!
পুরো চল্লিশ মিনিট কাছে-পিঠের সব স্থানে বর্ষাকে খুঁজেও যখন ওর অস্তিত্বের কোনো চিহ্ন পর্যন্ত নাব্যর নজরে পড়ল না তখন নাব্যর শংকাটা বিশ্বাসে রূপ নেয়। নাব্য অবাক হয়ে লক্ষ্য করে ওর বুকের বা-পাশে ভয়ানক চিনচিনে ব্যাথা। নিশ্বাসের উষ্ম রেশে কাউকে ফিরে পাবার আকুতি! ভেতর থেকে একটি অপরিচিত সত্ত্বা বারবার তীব্র নিনাদে অনুযোগের স্বরে বলতে থাকে , ‘ওকে ফিরিয়ে নিয়ে এসো। এবার ও চলে গেলে তুমি সত্যিই নিঃশেষ হয়ে যাবে। নিঃসঙ্গ হয়ে যাবে চিরকালের মতো। কারণ যারা বারবার মানুষ হারায়। জীবনের শেষ অধ্যায় পর্যন্ত ওরা কেবল হারাতেই থাকে। ওদের আর কখনো ভালোবাসা হয়ে ওঠে না। ‘
তরঙ্গায়িত সমুদ্রের তীর ঘেঁষে বর্ষার নাম ধরে চিৎকার করে ডেকে ওকে খোঁজার শেষ চেষ্টা চালায় নাব্য। ততক্ষণে ওর হৃদ প্রকোষ্ঠের রুদ্ধ কারা’গারে ভা’ঙচুর চুড়ান্ত রূপ নিয়েছে। হঠাৎ দূরে একঝাঁক প্রবালের ওপর, সাগরের স্ফীত কালো ঢেউ যেখানে আছড়ে পড়ছে অবিরাম। সেখানে একটা মনস্য অবয়ব নজরে পরে ওর। এ যেন ধূসর আশাহীন প্রান্তরে হঠাৎ মরিচীকার দেখা। অবয়ব টা আদতেই মানুষের কিনা, সে বিষয়ে নাব্য পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারে না। কারণ এর আগেও কয়েকবার এরকম কিছু দেখে মানুষ ভেবে কাছে গিয়ে দেখেছে জোয়ারে ভেসে আসা বস্তু কিংবা বালির বস্তা। তবুও নাব্য পরাভূত হয়না। ছুটে যায় সেই মরিচীকার দিকে। যত কাছে এগোতে থাকে তত নিশ্বাস দ্রুত হতে থাকে ওর। একেবারে কাছে গিয়ে সে থমকে দাঁড়ায়।
তুফান রাত্রির উদ্বেলিত কালো সমুদ্রের বুকে, কালো প্রবালের ওপর এক মানবীর পরিহিত, সফেদ সাদা শাড়ির অবাধ্য আঁচলের দাপাদাপি বড় অপার্থিব ঠেকে ওর চোখে।
সেই মানবীর পরিচয় নিয়ে সন্দেহ রাখার প্রশ্ন নেই, কথাটা বোঝবার সঙ্গে সঙ্গে একছুটে কাছে গিয়ে ওকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে নাব্য। তড়পাতে থাকা অন্তঃকরণটাতে এতক্ষণে যেন প্রাণ ফিরে আসে ওর!
বুকে চেপে মাথায় এলোমেলো চুমু খেয়ে সে অধৈর্য স্বরে বলে,
–‘ বর্ষা… বর্ষা….। তুমি ঠিক আছো তো? আমি আর কক্ষনো তোমায় কষ্ট দেব না, হারাতে দেব না দূরে। এই কান মুলছি। তুমি ফিরে চলো।’
প্রচন্ড মানসিক আ’ঘাত, শরীরি যাতনা আর তার মাঝে নিগূঢ় তমসা চিরে বয়ে চলা সামুদ্রি ঝড়ে বিপর্যস্ত বর্ষার হতবিহ্বলতা কাটাতে কিঞ্চিৎ সময় নেয়। সমুদ্রের নোনা জল আর বৃষ্টিতে ভিজে, প্রচন্ড শীতে সারা গা ঠকঠক করে কাঁপছে ওর। কিন্তু নাব্যর কথার অর্থোদ্ধার করা মাত্রই সে আবারো বেঁকে বসে। শরীরের অবশিষ্ট শক্তি’টুকু একত্র করে দু’হাতের ধা’ক্কায় দূরে সরিয়ে দেয় নাব্যকে। এরপরও নাব্য ফের ওর সন্নিকটে আসছে দেখে প্রবাল ছেড়ে উঠে উল্টো পথে হাটতে শুরু করে চাপা শব্দে গু’ঙিয়ে উঠে বালিতেই হাটু গেড়ে বসে পড়ে বর্ষা। নাব্য দৌড়ে ওর কাছে পৌঁছায়। এভাবে হঠাৎ বর্ষার গুঙিয়ে ওঠার কারণ অনুসন্ধান করতেই প্রথম বারের মতো ওর নজরে পরে পায়ের তলায় বিদ্ধ কাঁচের টুকরো গুলো। অন্ধকারে ঝাপসা আলোয় বেশিকিছু করা সম্ভব হয় না। প্রবালের ওপর বসিয়ে কাঁচের টুকরো গুলো টেনে বের করে নাব্য। ফিন’কি দিয়ে র’ক্ত ছোটে পা থেকে।
নাব্য অনুনয়ের চোখে বর্ষার মুখ চেয়ে বলে,
-‘এবার চলো আমরা ফিরি। আমি অনুরোধ করছি।
তোমার পায়ের দ্রুত ফার্স্ট এইড প্রয়োজন। ‘
-‘আপনি চলে যান। আমি ফিরছি না। ‘ বর্ষা হিম গলায় উত্তর দেয়।
-‘ তাহলে আমিও ফিরছি না।’
-‘ আপনি ফিরে যান। নাহয় আমি সমুদ্রে ঝা’প দেব!’
-‘আমিও ঝা’প দেব। এসো আমরা এই ঝড়ের সমুদ্রে একসঙ্গে ঝা’পিয়ে পড়ি।’ নাব্য আরম্বিক গলায় উত্তর করে।
বর্ষার চোখে অবিশ্বাসের চাহনি। সে কিছু না বলে আগের মতো স্থির হয়ে বসে থাকে। বুঝতে পারে ওর বেহায়া, নির্বোধ মন আবারও জালে জড়িয়ে যাচ্ছে। আরও একবার ফাঁদে পা দিচ্ছে সে। কিন্তু না চাইতেও বর্ষার চোখ বেয়ে এবার জল গড়িয়ে পড়ে। সমুদ্রে মুখ করে, প্রবালে বসে থাকা মেয়েটির সামনে হাটু গেড়ে বসে, নাব্য ওর বা-গালে, পাঁচ আঙ্গুলের ছাপ বসে যাওয়া চ’ড়ের দাগটার ওপর হাত রেখে সঙ্গিন স্বরে বলে,
-‘ খুব বেশি ব্যাথা পেয়েছিলে না? এক হাজার বার সরি। এবার প্লিজ ফিরে চলো।’
উত্তরে বর্ষা মাথা নিচু করে নাক টেনে কাঁদতে থাকে অনুচ্চ স্বরে। ওর মধ্যে বাঁধা দেয়ার আর কোনো লক্ষন প্রকাশ পায় না। পায়ের আ’ঘাতের কথা ভেবে অনুমতি প্রার্থনা না করেই বর্ষাকে পাজাকোলে নিয়ে নাব্য হাটতে শুরু করে ভিলার দিকে।
বর্ষা একদিন চেয়েছিল নাব্যর পুরো সময়ের আবর্ত ওকে ঘিরে থাকুক। এই কালহরণে তাই ঘটে। সময়ের আবর্ত ওদের নিয়ে আসে খুব কাছে। এতটা কাছে। যতটা হলে ভালোবাসার উপস্থিতি আছে কিনা তা নিয়ে সংশয় দূর হয়। অন্তত আজকের রাত্রির জন্য হলেও নাব্য পুরোপুরি ভুলে যায় পুরনো বর্ষাকে। বাকি সময় তার অস্তিত্ব জুড়ে শুধুই নবীনতম বর্ষার আধিপত্য বিরাজমান হয়।
[বারাকাল্লাহু ফিক]
চলবে……।