#একদিন_বিকালে_সকাল_হয়েছিলো
লেখকঃ শারমিন আক্তার সাথী
পর্বঃ২১
নওশীনের মেসেজটা দেখে শিহাব দ্রুত ডিলিট করে ফেলল, যাতে রেনু কোনোভাবে না দেখে। দেখলে রেনু সন্দেহ করবে, কষ্ট পাবে। রেনু শিহাবকে জিজ্ঞস করল,
‘মেয়েটা কে? অভদ্র! আমি কেমন আছেন জিজ্ঞেস করলাম, অথচ ভদ্রতার খাতিরেও উত্তর দেয়ার প্রয়োজন মনে করল না!’
শিহাব মলিন হেসে বলল,
‘ও এমন-ই।’
রেনু নাক ফুলিয়ে বলল,
‘বেয়াদপ।’
শিহাব হাসল শুধু। যেতে যেতে শিহাব ভাবছিলো,
‘কীভাবে রেনুকে সবটা বলবে। ও বলার আগে যদি নওশীন বলে দেয়, তাহলে তো বিষয়টা হিতে বিপরীত হবে। এখন রেনুকে বুঝিয়ে বললে বুঝবে। কিন্তু অন্য কারো কাছ থেকে শুনলে তখন ওকে বোঝানো যাবে না।’
বাসায় পৌঁছে ফ্রেশ হয়ে শিহাব, রেনুর জন্য অপেক্ষা করছিলো আর মনে কথাগুলো গুছিয়ে নিচ্ছিলো। শিহাব মনে মনে বলল,
’এ কথাগুলো আমি রেনুকে এখন বলতাম না। ও আগে সম্পূর্ণ সুস্থ হতো তারপর বলতাম কিন্তু এখন আমার কাছে কোনো অপশন-ই নেই। আমি নওশীনকে ভালো করে চিনি। ও যা বলবে তা-ই করবে। প্রচন্ড ঘাড়ত্যাড়া আর জেদি মেয়ে।’
রেনু এসে শিহাবের পাশে বসল। রেনুর চোখ দুটো টকটকে লাল হয়ে গেছে। শিহাব রেনুকে বলল,
‘কী হলো তোমার চোখ এমন লাল কেন?’
‘জানি না। শরীরটা আবার প্রচন্ড খারাপ লাগছে। মাথাটা বড্ড ব্যথা করছে। মনে হচ্ছে যন্ত্রণায় মাথা ছিঁড়ে যাবে।’
শিহাব রেনুর গায়ে হাত দিয়ে বলল,
‘ও মাই গড তোমার শরীর তো আবার প্রচন্ড গরম হয়েছে। ওষুধগুলো খেয়েছো?’
‘হ্যাঁ। শিহাব আমি শুয়ে পড়ছি আমার শরীরটা বড্ড খারাপ লাগছে। মাথা যন্ত্রনায় বমি পাচ্ছে খুব।’
শিহাব চিন্তিত হয়ে বলল,
‘আচ্ছা ঘুমিয়ে পড়ো।’
রেনু শুয়ে বলল,
‘আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিন।’
শিহাব রেনুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ভাবল,
‘এখন রেনুকে বলা মোটেও ঠিক হবে না। ওর শরীরটা এখন বড্ড খারাপ। বললে কিছু হয়তো বুঝবে না, উল্টো আরও অসুস্থ হয়ে পড়বে।’
রেনু বলল,
‘শিহাব।’
‘হুঁ।’
‘আপনাকে একবার মামা ডাকব?’
শিহাব রাগ করে বলল,
‘জ্বর, অসুস্থতার মাঝেও তোমার বাদরামি কমে না?’
‘আরে একবার ডাকি?’
‘না।’
‘বিয়ের আগে তো কত ডাকতাম।’
‘বিয়ের আগে যখন, কথায় কথায় মামা মামা ডাকতা, আমার মনে হতো কেউ আমার কানে গলিত শীশা ঢেলে দিচ্ছে।’
রেনু শিহাবের দিকে ঘুরে ভেংচি কেটে বলল,
‘মা…!’
বাকিটা বলার আগে শিহাব রেনুর ঠোঁটদুটো নিজের দখলে নিয়ে নিলো। কিছু সময় পর রেনু বলল,
‘লজ্জা করে না একটা অসুস্থ মেয়ের সাথে এমন করতে মা…!’
শিহাব আবারও একই কাজ করল। কিছু মুহূর্ত পর রেনু নিজের ঠোঁট মুছতে মুছতে বলল,
‘আরে বা*ল কথা তো কমপ্লিট করতে দিবেন? মা…!’
শিহাব পুনরায় একই কাজ করল। এবার রেনু হাত পা ছুড়তে লাগল। তারপর হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,
‘ফাজিল লোক রুম থেকে বের হোন।’
‘তুমি আর একবার আমাকে ঐ ডাকে ডাকতে পারবে না।’
‘আরে পুরো কথা না শুনেই খালি উল্টা পাল্টা কাজ করলেন? আমি বলতে চেয়েছিলাম ছোটো মামা কল করেছিলেন, আপনার সাথে কী যেনো বলবেন। আপনাকে কল করতে বলছেন।’
শিহাব হেসে বলল,
‘ওহ আচ্ছা।’
রেনু উঠে বসে শিহাবকে মারতে মারতে বলল,
‘ফাজিল লোক, আমার ঠোঁট জ্বালা করছে। এই দেখেন এখান থেকে চামরা ছিলে গেছে। নেহাৎ মাথা ব্যথা করছে নয়তো আপনাকে দেখে নিতাম।’
শিহাব রেনুকে জড়িয়ে ধরে বলল,
‘আচ্ছা সুস্থ হয়ে নাহয় দেখো। তখন অনেক সময় নিয়ে অনেক ভাবে দেখে নিয়ো। আমি সময় নিয়ে সবটা দেখাবো, দেখবো।’
শিহাবের কথায় রেনু ভয়াবহ লজ্জা পেয়ে বলল,
‘আপনি আসলেই ফাজিল।’
শিহাব হাসল শুধু।
২৮!!
রাযীন আর শশীর পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত প্রায় দশটা বেজে গেল। শশীর মাথা বড্ড ব্যথা করছে। চট্রগ্রামে এত জ্যাম তা শশী জানত না। অবশ্য ওরা আজকে প্রথমে চট্টগ্রাম থাকার কথা থাকলেও, পরে পরিকল্পনা বদলে কক্সবাজারে এসেছে। যেখানে থাকবে সেখান থেকে সমুদ্রে যেতে মোটামুটি আধাঘন্টা সময় লাগে। আর চট্টগ্রাম টু কক্সবাজার অনেক পথ। তারমধ্যে এ পথে জ্যাম তো ডালভাত।
শশীর মাথার মধ্যে দপদপ করছে। সারাটা পথ ঘুমিয়ে কাটালেও মাথা যন্ত্রনায় শশী এখন চোখে ঝাপসা দেখছে বারবার। ওরা গিয়ে উঠল রাযীনের চাচাতো বোন সুমির ফ্ল্যাটে। সেই বিল্ডিংয়েরই সাত তলায় রাযীন-শশী থাকবে। রাযীনের চাচাতো বোন সুমি থাকে ছয় তলায়। ওরা বসার রুমে বসে সুমি আর ওর বর রাসেলের সাথে কথা বলছিলো। শশী জোর করে নিজের মুখভঙ্গি ঠিক রাখার চেষ্টা করছে। রাযীন বুঝতে পারল মাথা ব্যথায় শশী খুব কষ্ট পাচ্ছে।
তাই ও সুমিকে বলল,
‘আপু আমরা বরং আমাদের ফ্ল্যাটে যাই।’
‘কী বলিস? কেবল আসলি। ফ্রেশ হয়ে, এখন নাস্তা করবি নয়তো রাতের খাবার খাবি তারপর তোদের ফ্লাটে যাবি।’
‘না আপু আমরা বরং ফ্ল্যাটে গিয়েই ফ্রেশ হবো। তুমি আমাদের খাবারটা ফ্ল্যাটে পাঠিয়ে দাও। এত লম্বা জার্নিতে শরীরটা খুব খারাপ লাগছে। তাছাড়া শশীর প্রচন্ড মাথা ব্যথা করছে।’
সুমি আর কথা বাড়ালো না। বু্ঝল ওরা সত্যি-ই খুব ক্লান্ত। সুমি বলল,
‘আচ্ছা যা। ফ্ল্যাট আমি ভালো করে পরিষ্কার করে রেখেছি। আর হ্যাঁ তোদের জন্য ছোট্ট একটা সারপ্রাইজ আছে।’
রাযীন বলল,
‘কী সারপ্রাইজ?’
‘ফ্ল্যাটে গেলেই দেখতে পারবি।’
রাযীন, শশী তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে ফ্লাটে আসল। দরজা খোলা পর ফ্ল্যাটটা দেখে শশী বলল,
‘বাহ দেখতে তো দারুণ। বেড রুম কোনটা?’
রাযীন আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো। শশী-রাযীন বেড রুমের দরজা খুলতেই হা হয়ে গেল। কারণ বেডরুমটা সুন্দর করে বাসর ঘরের মতো সাজানো হয়েছে।
শশী হাত থেকে ব্যাগ ফেলে রাযীনের বুকে মাথা এলিয়ে দিয়ে, কান্না করার ভঙ্গিতে বলল,
‘তোমাকে বিয়ে করার পর থেকে বাসর ঘর আমার পিছু ছাড়ছে-ই না। যেখানে যাই খালি বাসর আর বাসর।’
রাযীন শব্দ করে হেসে বলল,
‘সবাই চায় তুমি শুধু রাযীনের হও।’
‘তো এখন কী আমি আরেক ব্যাডার বউ?’
‘আরে বোঝোনি তুমি?’
শশী ধমক দিয়ে বলল,
‘চুপ করো তো! যন্ত্রনায় আমার মাথা ছিড়ে যাচ্ছে। কিছু ভাবতে পারছি না, আর কিছু ভাবতেও চাই না। আমি এখন গোসল করব বেশি করে।’
‘এত রাতে গোসল করলে তো ঠান্ডা লাগবে।’
‘লাগুক, তা-ও করব।’
শশী লাগেজ থেকে সুতির থ্রী-পিচ বের করে নিয়ে গোসল করতে ঢুকল। অনেক্ষণ ঠান্ডা পানি দিয়ে গোসল করার ফলে মাথাটা একটু হালকা লাগছে ওর। কিন্তু মাথা ব্যথাটা কমেনি। শশী গোসল সেরে বের হয়ে দেখল খাবার দিয়ে গেছে। রাযীন, শশীকে দেখে মুগ্ধ হলো। কারণ পূর্বে কখনও ও শশীকে গোসলের পর দেখেনি। শশীর চুলগুলো তোয়ালে দিয়ে পেচানো। কানের কাছ থেকে কয়েকগোছা চুল বেরিয়ে রয়েছে, তা থেকে চুইয়ে চুইয়ে পানি শশীর কাঁধে পড়ছে। রাযীন, শশীতে এত মগ্ন হলো যে, মনে মনে নিজেকে বলল,
‘রাযীন নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখো। এ মেয়ে তোমাকে বার বার মুগ্ধ করে মারবে। নেহাৎ ওর মাথা যন্ত্রণা করছে নয়তো এখন একটু পাগলামি করেই বসতাম।’
শশীর কথায় ধ্যান ভাঙল। শশী, রাযীনকে জিজ্ঞেস করল,
‘গোসল করবে?’
‘হ্যাঁ। সারা শরীরে ধুলো বালির আস্তরণ পড়েছে। গোসল না করলে শান্তি পাব না।’
‘আচ্ছা যাও।’
রাযীন গোসল করতে গেলে শশী মাথা ব্যথার দুটো ওষুধ খেয়ে শুয়ে পড়ল।’
রাযীন গোসল করে এসে দেখল, শশী চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। রাযীন আবারও শশীর দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ হলো। শশীর ভেজা চুলগুলো বালিশে ছড়ানো। শশীর চোখ বন্ধ। রাযীন মনে মনে বলল,
‘কোনো রকম সাজ গোজ ছাড়া কী মোহময়ী লাগছে! এ মেয়ে আমাকে আধা পাগল তো করছেই, এখন পুরা পাগল করবে।’
তারপর শশীর কাছে গিয়ে বসল। মাথা ব্যথার কারণে চোখের নিচটা একটু কালো হয়ে গেছে, কিন্তু তাতে ওর সৌন্দর্য্য মোটেও কমেনি। রাযীন, শশীর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
‘শশী!’
‘হুঁ।’
‘খাবে না?’
‘না মাথা খুব ব্যথা করছে।’
‘আমি খাইয়ে দি।’
‘না ইচ্ছা করছে না।’
রাযীন, শশীকে জোর করেই খাইয়ে দিলো। তারপর রুমের লাইট অফ করে শশীর পাশে শুতেই শশী উঠে রাযীনের বুকে মাথা রাখল।’
রাযীন আপন মনে হেসে শশীর কপালে ভালোবাসার পরশ দিয়ে ওকে জড়িয়ে নিজের বুকের মাঝে নিলো। শশী বিড়াল ছানার মতো রাযীনের বুকে নাক ঘষে ঘুমিয়ে পড়ল। রাযীন মনে মনে বলল,
‘ভালোবাসার মানুষটাকে নিজের বুকে মাঝে জড়িয়ে ঘুমানোর যে শান্তি, সে শান্তি কিছুতে নেই।’
রাযীনও শশীকে বুকে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।’
চাঁদনী, রাতে চাঁদের নরম আর আদর আদর আলোতে ভালোবাসায় ভাসছে হাজারো প্রাণ। তাদের মধ্যে শশী-রাযীনও আছে।
২৯!!
রাত বারোটা,
সাজ্জাত লিপিকে বলল,
‘তোমার সমস্যা কী বলবে?’
‘কী সমস্যা?’
‘সবসময় রেনুর পিছনে পড়ে থাকো কেন? মেয়েটা তোমার কী ক্ষতি করছে?’
‘তুমি সবসময় ওর প্রশংসায় মত্ত থাকো কেন? ও তোমায় কী জাদু করেছে?’
‘যে ভালো তাকে ভালো বলাতে সমস্যা কোথায়? এর জন্য জাদু করার প্রয়োজন নেই।’
‘এটাই আমার সমস্যা ও প্রয়োজনের চেয়ে বেশি ভালো সাজে, আর নিজের রূপ, গুণ দেখিয়ে পুরুষদের আকর্ষিত করার চেষ্টা করে।’
সাজ্জাত বেশ রাগ করে বলল,
‘ছি লিপি! তোমার চিন্তা ভাবনা এতটা নিচে নেমে গেছে কবে?’
‘মিথ্যা কী বললাম? সবসময় ঐ অপয়া, বিধবাটার প্রশংসায় পঞ্চমুখ থাকো তুমি। কেন কী জাদু করছে ও তোমাকে? নাকি শিহাবের মতো তোমাকেও বশ করেছে?’
সাজ্জাত লিপির দিকে কঠিন চোখে তাকিয়ে বলল,
‘লিপি আমাদের পরিবারে মেয়েদের গায়ে হাত উঠানোর রেওয়াজ নেই। বাবা আমাদের সেই শিক্ষা দেননি। নয়তো এমন কথা বলার জন্য আমি তোমাকে কষে একটা চড় মারতাম। আমার হাঁটুর বয়সী একটা মেয়েকে জড়িয়ে তুমি এসব কথা বলছো? তাও যে কিনা আমার ছোটো ভাইয়ের বউ? যাকে কিনা আমি সেই নজরে দেখি, যে নজরে শশীকে দেখি। আর তুমি তাকে জড়িয়ে এমন কথা বলতে পারলে? ছি লিপি তোমার চিন্তাধারা এত নীচু?’
লিপি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
‘তোমাদের শিক্ষা আমি ভালো করে জানি! আমার মুখ খুলিও না সাজ্জাত। তাহলে এমন সব কথা সবাই জানতে পারবে যা কিনা শুধু আমাদের রুমের মধ্যে-ই সীমাবদ্ধ আছে। বছর চারেক আগে তুমি কী করেছিলে ভুলে গেছো? অতীত ভুলে যেও না সাজ্জাত।’
সাজ্জাত হঠাৎ চুপ হয়ে গেল। তখন লিপি আবার বলল,
‘আর হ্যাঁ তুমি-ই আমাকে নিচে নামতে বাধ্য করছো? যেদিন থেকে রেনু এ বাড়ি এসেছে, তোমার মুখে ওর গুনগান শুনতে শুনতে বিরক্ত আমি। আর তুমি সবচেয়ে খারাপ যে কাজ করছো, তা হলো কথায় কথায় আমাকে রেনুর সাথে তুলনা করা। ভালো রান্না করলে বলতে, রেনুর রান্নাটা বেশি ভালো হয়। ওর কাছ থেকে রেসিপি জেনে নিও। রেনুর মতো সবসময় সুন্দর পরিপাটি থাকতে পারো না? রেনুর কণ্ঠ সুন্দর, তোমার কণ্ঠ মোটা। রেনুকে সব রঙে মানায়, তোমাকে কেন মানায় না? সবকিছুতে আমাদের মাঝে তুমি রেনুকে টেনেছো। তো ওকে আমি কেন পছন্দ করব? আমি কী দেখতে খারাপ? নাকি চরিত্র খারাপ? আমার সাথে রেনুর তুলনা করো, অথচ রেনুর চেয়ে আমি হাজার গুন বেটার মনে করি নিজেকে। রেনুর মতো আমার দুই বিয়ে না। বিয়ের এক সপ্তাহের মাথায় নিজের স্বামীকে খাইনি। ঐ রকম একটা মেয়েকে তুমি আমার সাথে তুলনা করো? ও আমার সাথে যায়? খালি দেখতে সুন্দর হলেই হয় না? চরিএও- ভালো হতে হয়।’
লিপির কথাগুলো শুনে সাজ্জাদ বাকরুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল কতক্ষণ। তারপর টেবিলে থাকা জগটাকে ফ্লোরে ছুড়ে মেরে চলে গেল রুম থেকে। লিপি ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল,
‘হুঁহ আমাকে নীচু দেখাতে এসেছে। অথচ নিজে যে কত বড় নীচু কাজ করেছে তা ভুলে গেছে। বেইমান একটা!’
৩০!!
সকালের সূর্য কিরণ রাযীনের মুখে পড়তেই ঘুম ভাঙল ওর। শশী এখনও ওকে আষ্টে পিষ্টে জড়িয়ে ধরে আছে। রাযীন, শশীর মুখপানে চেয়ে ওর কপালে চুমো খেলো। তারপর শশীর কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল,
‘উঠবা না।’
শশী আরও গভীরভাবে রাযীনের বুকের মধ্যে ঢুকে রাযীনের গলায় নাক ঘসে বলল,
‘আর একটু।’
প্রশান্তিময় হাসি হেসে রাযীন বলল,
‘মাথা ব্যথা কমেছে?’
ঘুম ঘুম কণ্ঠে বলল,
‘হ্যাঁ।’
রাযীন দুষ্টু হেসে শশীর ঠোঁটে আলত করে ঠোঁট স্পর্শ করালো। শশীর ঘুম যেনো একেবারে গায়েব হয়ে গেল। চোখ বড় বড় করে বলল,
‘এটা কী করলে?’
রাযীন শব্দ করে হেসে বলল,
‘এবার বেহুশ হওনি বরং হুশ ফিরেছে।’
শশী ভয়ানক লজ্জা পেয়ে ওপর দিকে ঘুরে শুলো। রাযীন পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে, মাথাটা একটা উঁচু করে শশীর গালে নিজের গাল স্পর্শ করে বলল,
‘শশী তুমি কি জানো তুমি যখন লজ্জা পাও তোমার নাকটা খুব লাল হয়ে যায়। তোমার চোখের পাঁপড়ি গুলো নিচের দিকে নুয়ে যায়। আর ঠোঁটের কোণে একটু হাসি লেগে থাকে। তখন তোমাকে দেখতে চেরি ব্লসম এর মতো লাগে।’
শশী আরও লজ্জা পেয়ে বলল,
‘তুমি ব্লসম সরাসরি দেখেছো?’
‘হ্যাঁ। লাস্ট ইয়ার এপ্রিলে আমি জাপান গিয়েছিলাম। তখন সাকুরা ফুলের সিজন ছিলো বিধায় দেখেছিলাম।’
‘সাকুরা ফুল?’
‘চেরি ব্লসল মানে, চেরি তো ইংরেজী প্রতিশব্দ। জাপানের জাতীয় ফুল সাকুরা। তুমি লজ্জা পেলে ঠিক গোলাপি রঙের চেরি ফুলের মতো হয়ে যাও।’
‘বাহ্! তুমি দেখছি বিদেশেও ভ্রমন করেছো?’
‘হ্যাঁ। ভারত, জাপান, সিঙ্গাপুর, দুবাই, মালদ্বীপ, নেপাল এসব দেশ আমি ঘুরে দেখেছি।’
শশী অবাক হয়ে বলল,
‘এতটুকু বয়সে এত দেশ ঘুরেছো?’
‘বয়সের সাথে ঘোরাফেরার কী সম্পর্ক? এখানে দুটো ছিলো ফেমিলি ট্যুর, একটা বিজনেস ট্রিপ, বাকিগুলো বন্ধুদের সাথে ঘুরেছি।’
শশী বিরস কণ্ঠে বলল,
‘আর আমি বাংলাদেশে থেকে, নিজ শহরের বাইরে, এই প্রথম চট্টগ্রামে এলাম। একবার অবশ্য কলেজ ট্যুরে কুয়াকাটা গিয়েছিলাম। তাও সকালে গিয়ে পরেরদিন বিকালে ফিরে এসেছি।’
রাযীন বলল,
‘নো প্রবলেম মাই লাভ। তোমার বর একজন ভ্রমন পিপাসু মানুষ। তুমি যখন তার জীবনে এসেছো, তারমানে তুমিও এখন থেকে তার সাথে বহুদেশ, বহু জায়গায় ঘুরতে পারবে। এখন ওঠো, নাস্তা করে আমাকে বের হতে হবে। আমার কাজ আছে।’
‘আমি সমুদ্র দেখব।’
‘ঠিক আছে বিকালে নিয়ে যাব। তাছাড়া দুই মাস তো আছি এখানে। দুই মাসে চট্টগ্রামের কোণা কোণা তোমাকে ঘুরিয়ে দেখাব।’
শশী বেশ খুশি হয়ে রাযীনের গলা ধরে বলল,
‘আমি পাহাড়ে উঠব। সমুদ্রে ভাসব, মেঘ ধরব।’
রাযীন শশীর নাকে নাক ঘষে বলল,
‘পাহাড়, সমুদ্র তো সহজে পেয়ে যাবে। তবে মেঘ ধরতে চাইলে তোমাকে নীলগিরি যেতে হবে, সেটা বান্দরবান। তবে সময় করে তোমাকে সেখানেও নিয়ে যাব।’
শশী বাচ্চাদের উচ্ছ্বাসিত হয়ে রাযীনকে জড়িয়ে ধরে বলল,
‘থ্যাংক ইউ।’
রাযীনও জড়িয়ে ধরল শশীকে।
সকালের নাস্তাও সুমি বাসা থেকে পাঠিয়ে দিলো। রাযীন নাস্তা খেয়েই তাড়াহুড়ো করে বের হলো। রাযীন বেরিয়ে যাবার পর শশী ভাবল কী করবে?
শশী ওর মাকে কল করে তার সাথে কথা বলল। তারপর লিপির সাথে অনেকক্ষণ কথা বলে, কল কেটে রেনুকে কল করল। শশীর কল দেখে রেনু খুব অবাক হলো। শশী রেনুকে বিয়ের পর মাত্র একবার কল করেছিলো, তা-ও শশী কলেজে বসে ওর মাকে ফোনে না পেয়ে রেনুকে কল করেছিলো। তখন লিপিও ও বাবার বাড়ি ছিলো।
রেনু কল রিসিভ করেই বলল,
‘কী নববধূ কেমন আছো?’
‘খুব ভালো। ভাবি তুমি?’
রেনু অবাক হলো, কারণ শশী সবসময় ওকে আপনি করে সম্বোধন করলেও আজ তুমি করে করছে। রেনু বলল,
‘ভালো।’
‘তোমার জ্বর কমেছে?’
‘হ্যাঁ মোটামুটি কমেছে।’
‘ভাবি আমি আজ তোমার কাছে ক্ষমা চাইতে কল করেছি।’
‘ক্ষমা কেন?’
‘ভাবি লজ্জা দিও না। তুমি ভালো করেই জানো ক্ষমা কেন? এতদিন তোমার সাথে যে ব্যবহার করেছি তার জন্য আমি লজ্জিত ভাবি, অনুতপ্ত খুব।’
রেনু মনে মনে বলল,
‘এ মেয়ের আবার কী হলো? সব ঠিক আছে তো?’
শশী বলল,
‘জানি অবাক হচ্ছো, ভূতের মুখে প্রভুর নাম শুনে। আসলে ভাবি তোমাকে সত্যিটা খুলেই বলি।’
‘বলো?’
‘প্রথম সত্যিটা হচ্ছে, আমি শিহাব ভাইকে অতিরিক্ত ভালোবাসি। শিহাব ভাইয়ের জন্য তোমার মতোই সুন্দর কাউকে চাইতাম কিন্তু যখন তোমার অতীত শুনলাম তখন আমার ভিতরের শয়তানটা জেগে উঠল। কোনো কারণ ছাড়াই, আমার মনের শয়তানটা আমাকে তোমার বিরুদ্ধে উষ্কে দিচ্ছিল। তাছাড়া বিগত কিছু মাস যাবত আমি খুব চিন্তায় দিন পার করছিলাম। মাথা ঠিক থাকত না তখন।’
‘কী হয়েছিলো?’
‘ভাবি তুমি বুঝেছিলে আমি প্রেমে ব্যর্থ। সেটা সঠিক। যে মানুষটাকে চারটা বছর পাগলের মতো ভালোবাসলাম সে মাঝপথে আমার হাতটা ছেড়ে দিলো। কিছুমাস যাবত তাকে নিয়ে টেনশনে ছিলাম, তারপর ভাইয়া তোমাকে বিয়ে করে আনল, যা আমাদের কারও পছন্দ ছিলো না। সে কারণে তোমার উপর রাগ বেশি ঝাড়তাম। নিজের সমস্যার সমাধান করতে না পেরে, সবসময় মন মেজাজ খারাপ থাকত। যার ফলটা তোমাকে ভোগ করতে হলো।
তোমার মিসক্যারেজের পর থেকে আমার ভিতর এত অপরাধবোধ তৈরী হলো যে, নিজে নিজে শান্তি পেতাম না। বার বার মনে হচ্ছিল, আমাদের দেয়া র্দু্ব্যহারে টেনশনে তোমার মিসক্যারেজ হয়েছে। তোমার কাছে কোন মুখে ক্ষমা চাইতাম! ক্ষমা চাইবার সাহস-ই হচ্ছিল না। আজ রাযীন যদি, আমাকে না বোঝাতো তবে হয়তো সাহস করতে পারতাম না।’
রেনু মনে মনে বলল,
‘লোকে ঠিক বলে, সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ।’
তারপর মুখে বলল,
‘সমস্যা নেই শশী। তুমি নিজের ভুল বুঝতে পেরেছো তাতেই অনেক। তা রাযীন সাহেব কী বলল?’
‘আজ সকালে নাস্তা করার সময় রাযীন বলল, শশী তোমার সবকিছুই আমার কাছে ভালো লাগে, শুধু রেনু ভাবির সাথে করা ব্যবহার ভালো লাগেনি।’
রেনু শশীকে থামিয়ে বলল,
‘রাযীন ভাই কী করে জানল, তুমি আমার সাথে মিসবিহেব করতে?’
‘তুমি জানো না, ভাবি রাযীন আমাকে কতটা ভালোবাসে। আমার জন্য ওর পাগলামী শুনে আমি নিজেই চূড়ান্ত অবাক! রাযীন আমার বিষয়ে যত কথা জানে, তা হয়তো আমার পরিবারের লোকও জানে না। কিন্তু কীভাবে জানে, তা জিজ্ঞেস করিনি।’
রেনু বলল,
‘আচ্ছা এখন বলো রাযীন সাহেব কী বলছিলো?’
‘রাযীন বলল, তোমার সাথে করা, আমার ব্যবহার ওর ভালো লাগেনি। আমি বললাম, আমি জানি আমি ভাবির সাথে খুব অন্যায় করেছি। কিন্তু এখন না পারছি লজ্জায় ক্ষমা চাইতে, না পারছি নিজের মনের ভার কমাতে। রাযীন আমাকে অনেকভাবে বুঝালো। তারপর বলল, নিজের লজ্জা সাইডে রেখে ভাবির কাছে ক্ষমা চাও। ক্ষমা চাইলে কেউ ছোটো হয় না বরং মনে শান্তি আসে। তারপর আরেকটা কথা বলল।’
রেনু বলল,
‘কী বলল।’
শশী বেশ লজ্জা পেলো। রেনু বুঝতে পেরে বলল,
‘শশী তুমি কী লজ্জা পাচ্ছো কথাটা বলতে? গোপন কিছু হলে থাক।’
শশী বলল,
‘আচ্ছা ভাবি তুমি আমাকে ক্ষমা করেছো?’
‘দূর পাগলী এসব কথা মনে রাখতে হয় নাকি? ননদ ভাবির মধ্যে ঠোকাঠুকির সম্পর্ক তো সেই পুরানো আমল থেকে। ওসব মনে রাখলে কী চলে? আমার, তোমার প্রতি কোনো রাগ নেই। মনে যা-ও একটু দুঃখ ছিলো, তাও তুমি কথা বলে ঠিক করে দিলে। তুমি বরং তোমার নতুন জীবনে মনোযোগী হও। তোমার কথায় মনে হলো, রাযীন সাহেব খুব ভালো মানুষ। তাকে আগলে রেখো। নিজেকেও সামলে রেখো। দোয়া রইল তোমাদের জন্য।’
‘ধন্যবাদ ভাবি। ভাবি তোমাকে একটা কথা বহুদিন যাবত বলতে চাচ্ছিলাম কিন্তু বলতে পারিনি।’
‘কী কথা?’
‘ভাবি তুমি দেখতে মানুষের চিন্তার বাইরে সুন্দর। তোমার মতো সুন্দর মেয়ে আমি কখনও দেখিনি।’
রেনু লজ্জাময় কণ্ঠে বলল,
‘ধন্যবাদ।’
‘আই লাভ ইউ ভাবি।’
‘লাভ ইউ টু শশী।’
রেনুর সাথে কথা বলার পর শশীর মনটা সত্যি হালকা লাগছে। মাফ চাইবার পর যে, মন এত হালকা হয় শশীর জানা ছিলো না! শশী মনে মনে রাযীনের বলা কথাটা ভাবলো। রাযীন বলেছিলো,
‘শশী তোমার সব কিছু সুন্দর, মোহময়ী। আমি চাই না আমার শশীর কোনো খারাপ দিক থাকুক। যে শশীকে আমি ভালোবাসি তার সব কিছু অনিন্দ্য, স্বচ্ছ, মায়াবী। আমি চাই না ছোটো কোনো বিষয়েও কেউ এই মেয়েটাকে খারাপ ভাবুক। সে যেমন আমার কাছে সেরা, সবার কাছে তেমন সেরা হোক আমি সেটা চাই। আমি যেমন তোমাকে ভালোবাসি, তোমার প্রতি মনে বিন্দু মাত্র সংসয় নেই। আমি চাই বাকি সবাইও তেমন ভালোবাসুক। আমার শশী সবার কাছে চাঁদের মতোই পবিত্র থাকুক।’
রাযীনের কথাগুলো শুনে শশীর এত ভালো লাগল যে, শশী সাথে সাথে রাযীনকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমো খেলো।’
হুট করে নিজের অজান্তে করা কাজটার জন্য শশী লজ্জায় পালাতে চাইলে, রাযীন শশীকে খপ করে ধরে ফেলে বলল,
‘পালাতে চাইলেই কী পালানো যাবে? শশী তোমার কাছ থেকে পাওয়া এটা আমার প্রথম উপহার। এ মুহূর্তটা আমার সারা জীবন মনে থাকবে। নিজের ভালোবাসার মানুষের কাছ থেকে পাওয়া প্রথম স্পর্শ যে, এত ভালোলাগার হয় আমার জানা ছিলো না।’
শশী লজ্জায় তখন নিচের দিকে-ই তাকিয়ে ছিলো।
৩১!!
সজল, শশীর নতুন ফোন নাম্বার পেলো। পেয়েই সজল শশীকে কল করল।
চলবে….
#একদিন_বিকালে_সকাল_হয়েছিলো
লেখকঃ শারমিন আক্তার সাথী
পর্বঃ২২
৩১!!
সজল, শশীর নতুন ফোন নাম্বার পেল। পেয়েই সজল শশীকে কল করল। এর আগেও অবশ্য শশীর আরেকটা নাম্বারে সজল কয়েকবার কল করেছিলো কিন্তু শশী সজলের নাম্বার ব্লক করে রেখেছিলো। পরে সজল অন্য নাম্বার দিয়ে কল করলে শশী, সজলের কণ্ঠ শুনেই কেটে নাম্বারটা ব্লক করে দিতো। কিন্তু সজল বিভিন্ন নাম্বার থেকে কল করত দেখে শশী, রাযীনের কাছে থাকা ওর পুরাতন একটা সিম নিয়ে ব্যবহার করা শুরু করল। শশী এ ফোন নাম্বারটা ওর বন্ধু-বান্ধব কাউকে দেয়নি। কিন্তু তবুও সজল ফোন নাম্বারটা পেয়ে গেল।
শশী, সজলকে ফেইসবুক থেকে শুরু করে সকল সোস্যাল মিডিয়া থেকে ব্লক করে রেখেছে। সজল যখন বুঝতে পারল শশী ওর নাম্বার ব্লক করে রেখেছে। তখন সোস্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে যোগাযোগ করার চেষ্টা করল। কিন্তু তাও ব্যর্থ হলো। শেষে কোনো উপায় না পেয়ে সজল অনেক কষ্টে শশীর ফোন নাম্বার জোগার করে ফেলে। খুব গোপন একজনার কাছ থেকে শশীর ফোন নাম্বারটা পেলো সজল।
সজল, শশীকে কল করতে নিয়ে থামল কিছুক্ষণ তারপর নিজের ফোন থেকে ওর পুরাতন সিমটা বের করে, নতুন সিম ঢুকিয়ে শশীকে কল করল। নিজের নাম্বার থেকে নয় বরং অন্য একটা নাম্বার থেকে কল করল। কারণ সজল জানে, ওর নাম্বার দেখলে শশী কল রিসিভ করবে না।
কিছুক্ষণ ফোনে রিং হবার পর, শশী কল রিসিভ করতেই সজল বলল,
‘প্লিজ কলটা কেটো না। আমি জাস্ট দুই মিনিট তোমার সাথে কথা বলবো। প্লিজ শশী।’
কিছুক্ষণ চুপ থেকে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে শশী বলল,
‘বলো?’
‘শশী আমি কত বড় ভুল করেছি তা আমি এখন বুঝতে পারছি।’
তারপর শশীর সাথে সজলের অনেক কথা হলো।
রাত দশটা।
শশীর সাথে সজলের সাথে কথা হবার ঘন্টা দুই পর।
কান্না করতে করতে বিধ্বস্ত শশী। চোখ মুখ ফুলে লাল হয়ে, গেছে। রাগে, দুঃখে, হতাশায় জিনিসপত্র এলোমেলো করে নিচে ফেলে। নিজেও ফ্লোরে শুয়ে রইল শশী।
রাযীন বাসায় ফিরে, কয়েকবার ডোর বেল বাজিয়ে শশীর কোনো সাড়া না পেয়ে নিজের কাছে থাকা চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল।
বেডরুমে ঢুকে দেখল, বেডরুম এলোমেলো, বিছানার চাদর, বালিশ সব ফ্লোরে পড়ে আছে। শশীও রুমের এক কোণায় ফ্লোরে পড়ে আছে। রাযীনের চোখে মুখে ভয়ের স্পষ্ট ছাপ। দ্রুত শশীর কাছে গিয়ে ওর গায়ে হাত দিলো। শশী হিচকি দিয়ে কাঁদছে। হিচকির কারণে ওর শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে।
রাযীন, শশীকে তুলে বসিয়ে, নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলল,
‘কী হয়েছে শশী? তুমি এমন করছো কেন?’
‘রাযীন আমি আর এ কষ্ট নিতে পারছি না! আমার কলিজাটা ছিড়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে এখনই দম বন্ধ হয়ে মরে যাব।’
রাযীন বেশ চিন্তিত গলায় বলল,
‘কী হয়েছে শশী?’
‘আজ সজল কল করেছিলো। আমি ওকে খুব মিস করছি। ও কান্না করছিলো খুব। ওর কান্না আমি সহ্য করতে পারি না। আমার কাছে খুব করে ক্ষমা চাইছিলো। বলছিলো আমি চাইলে এখনও ওর কাছে যেতে পারি। ও সমাজ, পৃথিবী কিছুর পরোয়া করে না।’
শশীর মুখ থেকে কথাগুলো শুনে রাযীনের খুব কষ্ট হচ্ছিল। নিজের কষ্ট চেপে বলল,
‘তো তুমি কী বললে?’
‘আমি কিছু বলিনি।’
রাযীন শান্ত কণ্ঠে শশীর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
‘শশী, তুমি কি সজলের কাছে যেতে চাও।’
শশী কাঁদতে কাঁদতে বলল,
‘হ্যাঁ।’
রাযীন দপ করে ফ্লোরে বসে পড়ল। ও ভাবেনি শশী এমন উত্তর দিবে। কষ্টে রাযীনের বুকটা ফেটে যাচ্ছে। মনে মনে বলল,
‘হয়তো আমার ভালোবাসায়-ই কোনো কমতি ছিলো যে, আমি ওকে আমার ভালোবাসার মায়ায় বাঁধতে পারলাম না।’
শশী বলল,
‘আপনি প্লিজ আমাকে একবার সজলের সাথে দেখা করিয়ে দিন। তার বিনিময়ে আপনি আমার সাথে যা খুশি করতে পারেন।’
রাযীন খেয়াল করল, শশী ওকে আবার আপনি করে সম্বোধন করছে। শশী ওর কথাগুলো বলে একটা অদ্ভুত কান্ড করল। টান মেরে নিজের, ওড়নাটা ফেলে, কামিজটা খুলে ফেলল, সাথে সাথে কাচুলির হুকটাও খুলে ফেলল। রাযীন ভীষণ চমকে গেলো। শশী কান্না করতে করতে বলল,
‘সজল যেমন-ই হোক না কেন আমার ভালোবাসার মানুষ। তাকে ঘৃণা করা, কিংবা তাকে ভুলে যাওয়া আমার জন্য সহজ নয়। আপনি আপনার স্বামীর অধিকার বুঝে নিন। তার বিনিময়ে আমাকে প্লিজ একবার সজলের সাথে দেখা করিয়ে দিন।’
শশীর কথা শুনে ওর কান্ড কারখানা দেখে কষ্টে রাযীনের বুকটা ভেঙে যাচ্ছিল। রাযীন এগিয়ে শশীর কাছে গেল। ওর কাচুলির হুক আটকে কামিজটা পরিয়ে দিয়ে বলল,
‘শশী, স্বামীর প্রধান অধিকার স্ত্রীর শরীর ছুঁয়ে দেওয়া নয়, বরং তার মন ছুঁয়ে দেওয়া। স্বামীর অধিকার কেবল স্ত্রী শরীরে দখল নেয় নয়, বরং তার মন দখলে নিয়ে সেখানে রাজত্ব করা। স্বামীর অধিকার কেবল স্ত্রীর শরীরের ভাঁজ গোনা নয়, বরং তার মনের সকল পারদ সরিয়ে মনের গভীরে প্রবেশ করা।
যদি শারীরিক সম্পর্ক দিয়ে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের মাপকাঠি করা যেতো, তবে পতিতা পারায় থাকা পতিতা আর তার কাছে যাওয়া পুরুষ তারা স্বামী-স্ত্রী হতো। সমাজ তাদের সম্পর্কটাকে নোংরা বলে অভিহীত করতো না।
শশী মানুষের শরীরের চাহিদা একটা বয়স পর আর থাকে না, তবে মনের চাহিদা, সম্পর্কের প্রতি ভালোবাসা, মায়া থাকে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত।
যদি শরীরের চাহিদা মুখ্য হতো তবে বুড়ো বয়সের দম্পত্তিরা একে অপরের সাথে থাকত না। আমি বলছি না শারীরিক চাহিদা জরুরি নয়। জরুরি, খুব জরুরি। তবে যেখানে মনের চাহিদা থাকে না, সেখানে শরীর একটা সে*ক্সটয় ব্যতিত কিছু নয়! আর তুমি আমার জন্য কোনো সে*ক্স টয় নও। তুমি আমার অন্তরের অন্তর। আমার হৃদয়ের রাণী। যে আমার হৃদয়ে রাজত্ব করে। আমার মনের সিংহাসনে শুধু তোমার অবস্থান। আমি আজ ব্যর্থ! কারণ তোমাকে আমার ভালোবাসার গভীরতা বু্ঝাতে পারিনি।
শশী জানো গত সাতমাস আগে তুমি যখন ফোন করে বয়ফ্রেন্ড এর কথা বলে বিয়ে ভেঙে দিয়েছিলে, তখন আমার খুব কষ্ট হয়েছিলো, কিন্তু তোমার কথা ভেবে আমি সরে যাই। কিন্তু তোমার পিছনে সবসময় আমার একজন না একজন লোক থাকতো। যারা তোমার সব খবর আমাকে দিতো। মাস দুই আগে একদিন খবর পেলাম সজলের সাথে তোমার কিছু প্রবলেম চলছে। আমি সজলের বিষয়ে পুরো খোঁজ খবর নিয়ে যা জানলাম তা আমাকে চূড়ান্ত হতাশ করল। তা-ও আমি তোমাদের দুজনকে তোমাদের মতো ছেড়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু মাস খানিক আগে যে খবর পেলাম তাতে সজলকে তোমার জন্য একদম সঠিক মনে হয়নি।
শশী তোমার জন্য এমন কাউকে দরকার যে কেবল তোমাকে ভালোই বাসবে না বরং তোমার মূল্যায়নও করবে। তাই তো আমি দ্রুত বিয়ের প্রস্তাব পাঠালাম এবং খুব দ্রুতি বিয়ের সবকিছু ঠিক করে ফেললাম, তোমার পরীক্ষা শেষ হবারও অপেক্ষা করলাম না। আমি শুধু তোমাকে নিজের করে পেতেই চাইনি বরং তোমার প্রাপ্য সম্মান দিতে চেয়েছিলাম, তোমার ইচ্ছা অনিচ্ছা মূল্যায়ন করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমার-ই ভুল ছিলো। নিজের ভালোবাসার মানু্ষটাকে কাছে পাবার আনন্দে ভুলে গেছিলাম তুমি সজলকে ভালোবাসো। আমি যেমন তোমাকে ভালোবাসি বলে তোমাকে পেতে চাইতাম, তেমন তুমিও সজলকে ভালোবাসো বলে ওকে পেতে চাইতে।
ভালোবাসা এবং ভালোবাসার মানুষকে ভুলে যাওয়া সহজ কাজ নয়, দুটোই অসম্ভব কাজ। আমার জন্য যেমন অসম্ভব তেমনি তোমার জন্যও।’
রাযীন তারপর শশীর গালে হাত দিয়ে বলল,
‘তুমি চিন্তা করো না, তুমি যখন বলবে, তখন তোমাকে সজলের কাছে নিয়ে যাবো। তারপর বাকিটা তুমি সিদ্ধান্ত নিবে। তুমি সজলের কাছে যাবে নাকি…!’
এখন যাও ঘুমাও রাত অনেক হয়েছে।’
কথাগুলো বলে রাযীন অন্যরুমে চলে গেল। আজ নিজেকে ওর বড্ড হেরে যাওয়া মানুষ মনে হচ্ছে। নিজের ভালোবাসার মানুষটার কাছে হেরে যাওয়া মানে, অনেকটা জীবনে হেরে যাওয়ার মতো, জীবনকে হারিয়ে ফেলার মতো।
৩২!!
রেনু লিপির কাছে গিয়ে দাঁড়াল। লিপি রেনুর দিকে তাকিয়ে বলল,
‘কিছু বলবে?’
রেনু, লিপিকে জড়িয়ে ধরল। লিপি চূড়ান্ত পর্যায়ে অবাক হলো। রেনু, লিপিকে জড়িয়ে ধরেই বলল,
‘ভাবি গত তিনমাসে আপনাকে একটা কথা বলব বলব করেও বলা হয়নি।’
লিপি নরম সুরে বলল,
‘কী বলবে বলো?’
‘আপনার চেহারা, আমার মায়ের সাথে খানিকটা মিলে। আর আপনার শরীর থেকেও সবসময় একটা মা মা ঘ্রাণ আসে। ভাবি আমি তো আপনার মাঝে নিজের মায়ের প্রতিচ্ছবি দেখি তবে আপনি কেন আমাকে অপছন্দ করেন?’
লিপি, রেনুকে নিজ থেকে ছাড়িয়ে বলল,
‘এখন এসব বলা জরুরি? তুমি অসুস্থ।’
‘না আজ আমি পণ করে এসেছি আপনার সাথে সম্পর্ক ভালো করবই।’
‘বসো। তারপর বলছি।’
রেনু বসল। লিপি কাপড় গোছাতে গোছাতে বলল,
‘রেনু আমি তোমাকে অপছন্দ করি সে কথা পুরোপুরি ঠিক নয়। তবে তোমাকে হিংসা করি এটা ঠিক। তাও দুটো কারণে।’
‘কেন ভাবি?’
‘প্রথম কারণ আমার স্বামী তোমাকে ভয়াবহ মাত্রায় পছন্দ করে।’
‘সেটা তো ছোট বোন হিসাবে।’
‘আগে আমার কথা শেষ করতে দাও।’
‘হ্যাঁ আমি জানি। সাজ্জাদ তোমাকে ছোটো বোনের চোখে দেখে। আর ছোট বোন সন্তান সমতুল্য। কিন্তু তুমি কি জানো কিছু বছর আগে তোমার সাজ্জাদ ভাইয়া একটা পরকীয়ায় জড়িয়ে ছিলেন, যেটা এক বিধবা যুবতী নারীর সাথে। তারপর থেকেই যুবতী বিধবাদের আমি পছন্দ করতাম না। বিশেষ করে সাজ্জাদের আশে পাশে সহ্য করতে পারি না। সাজ্জাদের সে, সম্পর্কের বিষয়ে আমি জানার পর প্রথমে-ই সাজ্জাদের সাথে কথা বলি। সে তখন তার ভুল বু্ঝতে পারে। পরে আমি নিজেই সেই বিধবা মহিলার বিয়ে ব্যবস্থা করেছিলাম। তোমার সাজ্জাদ ভাই-ও ওয়াদা করলেন এমন ভুল আর করবেন না। তবে ওর প্রতি আমার আর ভরসা রইল না। তখন যদি সাহির না থাকত আমি সাজ্জাদকে ছেড়ে চলে যেতাম। সাহিরের ভবিষ্যতের কথা ভেবে ওর সংসারে পড়ে রইলাম। এ কথা এ পরিবারের কেউ জানে না, তুমি-ই প্রথম ব্যক্তি। আশাকরি তৃতীয় কেউ এ কথা জানবে না। তোমাকে পছন্দ না করলেও, ভরসা করি তোমার কিছু আচরণে।
দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে, শিহাব তোমাকে যতটা ভালোবাসে,ততটা ভালো সাজ্জাদ আমাকে বাসে না। আমি সবসময় চাইতাম সাজ্জাদ আমাকে নিজের সবটা দিয়ে ভালোবাসুক। কিন্তু সে ভালোবাসা ওর কাছ থেকে আমি কখনও পাইনি। বর্তমানে আমাদের সম্পর্কটা শুধু নাম মাত্র স্বামী-স্ত্রীর। এখানে একে অপরের দেখাশোনা করা, খেয়াল রাখা, এক বিছানায় ঘুমানো, শারীরিক সম্পর্ক করা সব-ই আছে কিন্তু নেই গভীর ভালোবাসা বা মুগ্ধতা। যেটা প্রতিটা স্ত্রী তার স্বামীর কাছ থেকে চায়।
কিন্তু চোখের সামনে যখন তোমাকে এত বেশি ভালোবাসা পেতে দেখছি, তোমার প্রতি শিহাবের এত মুগ্ধতা দেখছি, তখন না চাইতেও আমার মনে হিংসার জন্ম হয়েছে। কী করব বলো? অসুস্থ সমাজের অসুস্থ মানসিকতার লোক কিনা আমরা! না চাইতেও মনে হিংসার জন্ম হয়ে যায়।’
রেনু, লিপিকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে করতে বলল,
‘ভাবি আপনার মাঝে এত কষ্ট ছিলো! আপনাকে দেখে তো আমরা কখনও বুঝতে-ই পারিনি, এত হাসিখুশি থাকা লিপি ভাবির মাঝে এত কষ্ট! আর আমি এ পরিবারের বউ হয়ে এসে আপনার কষ্টটাতে ঘি ঢালার কাজ করেছি।’
‘না রেনু, তেমন কিছু না। তুমি কিছুই করোনি। বরং আমার অসুস্থ চিন্তার কারণে আমি তোমাকে বারংবার কষ্ট দিয়েছি। আমি নিজেও বুঝতাম তোমাকে কষ্ট দিচ্ছি কিন্তু নিজের কষ্টের আড়ালে তোমার কষ্টটা অনুভব করতে পারিনি। আমি সর্বদা সাজ্জাদকে নিয়ে ইনসিকিওর ফিল করি। নিজেকে ব্যর্থ মনে হয় তখন, যখন ভাবি সাজ্জাদ কেন আমাকে ছেড়ে পরকীয়ায় মাতল? তখন নিজের কষ্ট রাগ কন্ট্রোল করতে পারি না। নিজের রাগ, কষ্ট, ব্যর্থতা ঢাকতে তোমার সাথে প্রতিনিয়ত খারাপ ব্যবহার করেছি। মনে করতাম তোমার উপর রাগ ঝাড়লে বুঝি আমার কষ্ট কমবে।’
রেনু মনে মনে বলল,
‘আমি কি ঢোল নাকি যে, যে কেউ তার রাগ কমাতে আমাকে পিটায়? শশীও সেইম কাজ করেছে। অবশ্য শশীকে, লিপি ভাবি পেলেপুশে বড় করেছে, তো তার গুনাগুন কিছু তো শশীর মাঝে থাকবে।’
লিপি বলল,
‘শশী যখন আজ ফোন করে তোমার কাছে ক্ষমা চাইবার কথা বলছিলো, তখন অবাক হলেও শশীর কথায় বুঝেছিলাম আমরা তোমার সাথে কত অন্যায় করেছি।,
রেনু মৃদু হেসে বলল,
‘ভালো কাজ বা খারাপ কাজ ছোঁয়াচে মহামারির মতো একজনার হলে, তার সংস্পর্শে গেলে বাকিদেরও হয়। কাল শশী নিজের ভুল বুঝল আজ আপনি।’
লিপি বলল,
‘সরি রেনু।’
রেনু, লিপিকে জড়িয়ে ধরে বলল,
‘সরি বলতে হবে না ভাবি, আপনি শুধু আমাকে একটু স্নেহের নজরে দেখলেই হবে।’
চলবে…