#একদিন_বিকালে_সকাল_হয়েছিলো
লেখাঃ শারমিন আক্তার সাথী
পর্বঃ১৭
২৩!!
দুপুরে খাবার পর শশীকে নিয়ে রাযীনরা ওদের বাড়ি চলে গেল। যদিও এটা আনুষ্ঠানিকভাবে কনে বিদায় নয়, তবুও আমাদের সমাজের রীতি অনুসারে মেয়ে বিয়ে দেওয়া মানেই সে পর হয়ে যাওয়া। যার দরুন হাসি বেগম, শশী, লিপিসহ সবাই খুব কাঁদল। রেনুর চোখেও জল। তবে তাদের মতো ও কাঁদতে পারছে না। কারণ রেনু শশীকে ভালোবাসলেও, রেনুর সাথে শশীর তেমন ভালো স্মৃতি নেই বললেই চলে। যা স্মৃতি আছে তার বেশির ভাগই তিক্ত। সে কারণে শশীর চলে যাওয়ায় রেনু তেমন একটা দুঃখি নয়।
রেনু মনে মনে বলল,
‘যদিও এমন ভাবাটা অন্যায়। তবুও আমার কেন জানি আজ অনেকটা রিলাক্স লাগছে। মনে একটা চাপা ভালো লাগা কাজ করছে। মনে হচ্ছে, আজকের পর কেউ কথায় কথায় আমাকে মনে করিয়ে দিবে না, আমি বিধবা ছিলাম। কেউ তার ছোটো ভাইয়ের বউ নিয়ে একগাদা আফসুস করবে না! তার মধ্যবয়স্ক ভাই, বেটার কোনো কচি নিব্বি টাইপ কাউকে ডিজার্ভ করত এরকম খোঁচাও কেউ মারবে না! কথায় কথায় অপয়াও কেউ বলবে না। সত্যি বলতে আমার ভালোই লাগছে। লিপি ভাবি আর শশী-ই সবসময় আমার অতীত নিয়ে পড়ে থাকত। কথায় কথায় আমার অতীত টেনে আনত। আমাকে আমার অতীত নিয়ে তারা অনেক কটু কথা বলেছেন।
তাদের কথা শুনতে শুনতে মনটা আমার তেতো হয়ে গেছে। সে কারণে তাদের দুজনার প্রতি আমার মনোভাবও ইতিবাচক নয়। আর আছেন আমার শাশুড়ি মা। তিনি আমাকে পছন্দ না করলেও, আমাকে আমার অতীত নিয়ে খোঁচান না। অবশ্য তিনি তো আমার সাথে কথাই বলেন না। তাকে আর কী বলব? তবে আমি মন থেকে চাই শশী রাযীনের সাথে সুখী হোক। আরেকটা জিনিস চাই শশীর ননদ শশীকে একটু জ্বালাক, বেশি না জাস্ট একটু জ্বালাক, যাতে শশী আমার সাথে করা ব্যবহারগুলো উপলব্ধি করতে পারে।’
লিপি শশীকে জড়িয়ে ধরে বলল,
‘নতুন জীবনে পা দিয়েছিস, এখন আর অতীত ধরে ঝুলে থাকবি না, তাহলে কিন্তু কোনো দিকের থাকবি না তুই। নিজের খেয়াল রাখিস।’
যাবার সময় শশী রেনুকেও জড়িয়ে ধরে বলল,
‘ভাবি মা-বাবার দিকে খেয়াল রেখো।’
শশী চলে যেতেই ঘরটা কেমন নিস্তব্ধ হয়ে গেল। কন্যা হচ্ছে ঘরের নপুরের মতো। নুপুর যেমন, যতক্ষণ পায়ে থাকে, ছমছম মিষ্টি ছন্দে সারাঘর মাতিয়ে রাখে। তেমনি কন্যা যখন ঘরে থাকে ঘর মেতে থাকে।
অথবা কন্যা হচ্ছে পূর্ণিমার চাঁদের মতো, যতক্ষণ ঘরে থাকে ঘর আলোকিত করে রাখে। চলে গেলেই অমাবস্যার মতো অন্ধকার!
তেমন-ই শশী চলে যাওয়ায় ঘরটাও নিস্তব্ধ নিরিবিলি হয়ে গেল। হাসি বেগম অস্থির হয়ে নূর ইসলামকে বললেন,
‘কেন যে মেয়েটাকে বিয়ে দিলে? আমার ঘর এখন শূণ্য।’
নূর ইসলাম বললেন,
‘শূণ্য কোথায়? তোমার এক মেয়ে চলে গেছে ঠিক-ই তবে দুই মেয়েকে যে ঘরে এনেছো?’
হাসি বেগম, লিপির হাত ধরে বলল,
‘এটা আমার বড় মেয়ের মতো। কত বছর যাবত আমার সংসারটাকে আগলে রেখেছে। বড় লক্ষীমন্ত। আমার শশীকে তো ও-ই বড় করেছে। নয়তো কত মেয়ে আছে জন্ম অলক্ষী, অপয়া। শুধু অন্যের ঘরে অশান্তি লাগাতে জানে। ঘর বাঁধতে নয় ভাঙতে জানে।’
কথাগুলো হাসি রেনুকে উদ্দেশ্য করেই বলল।
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রেনু বলল,
‘ঠিক বলছেন মা। আবার কত ছেলের সংসার তাদের মায়ের কারণেও ভাঙে। কত পূত্রবধূ শাশুড়ির অত্যাচারে আত্মহত্যা করে! কত শাশুড়ি ঘরে প্যাচ লাগায়। অনেকটা দেয়াশলাই কাঠির মতো তারা, যখন তখন জ্বলে ওঠে। অবশ্য তারা দেয়াশলাইয়ের কাঠির থেকে একটু ভিন্ন। দেয়াশলাই কাঠি তো বারুদ পেলে জ্বলে কিন্তু তারা যখন তখন যেখানে সেখানে আপনশক্তিতে জ্বলে ওঠে। ঠিক রবি সিমের মতো। কত শাশুড়ি আবার বউদের উপর অত্যাচার করার দায়ে জেলে যায়।’
রেনুর কথা শুনে হাসি আর লিপি চোখ বড় বড় করে ওর দিকে তাকিয়ে রইল। নূর ইসলাম মুখ টিপে হাসছেন। রেনুর জবাবটা তার কাছে বেশ মজার লেগেছে। তিনি বললেন,
‘যাও তোমরা যে যার ঘরে যাও। সাজ্জাত, শিহাব আর সাহিরও এখনই চলে আসবে হয়তো। মাগরিবের আযান দিলো বলে। যাবার সময় নূর ইসলাম রেনুর কাছে এসে চুপি চুপি বললেন,
‘দারুণ দিয়েছিস। একেবারে নো বলে ছক্কা। একদম কাউকে ছাড় দিবি না। যোগ্য জবাব দিবি।’
তারপর গলা খাকরি দিয়ে বললেন,
‘রেনু, যা তো মা এক গ্লাস শরবত করে নিয়ে আয়। শরবতটা খেয়ে নামাজে যাব।’
রেনু মুখ টিপে হেসে রান্না ঘরের দিকে চলে গেলো।
রেনু চলে যেতেই লিপি, হাসিকে বলল,
‘দেখলেন মা কথার ধরণ? ও কিন্তু ইনডাইরেক্টলি আপনাকে পুলিশের হুমকি দিয়ে গেল।’
হাসি বেশ রাগ করেই বলল,
‘আসুক শিহাব, ওর হুমকি দেয়া আমি বের করছি।’
মাগরিবের নামাজের পর শিহাব আসতেই হাসি বেগম কেঁদে কেটে পুরো ঘর মাথায় তুললেন। তার কান্না দেখে শিহাব বেশ বিচলিত হয়ে বলল,
‘কী হয়েছে মা? কাঁদছো কেন?’
‘তোর বউকে জিজ্ঞেস কর।’
‘আরে ওকে জিজ্ঞেস করার কী আছে? তুমিই বলো?’
হাসি বেগম কান্না করতে করতেই বললেন,
‘আমার মেয়েটা বিদায় নিলো দুই ঘন্টা হলো না, অথচ তোর বউ আমাকেও তাড়াবে। আমাকে নাকি জেলে দিবে।’
শিহাব বেশ অবাক হয়ে বলল,
‘কী! রেনু এ কথা বলছে?’
‘তোর বউকেই জিজ্ঞেস কর বলছে কিনা? আমি বউদের অত্যাচার করি, সে কারণে আমাকে জেলে দিবে।’
শিহাব অনেক অবাকই হয়েছে। তবুও হাসির মন রাখতে রেনুকে ডাকল। রেনু তখন কাপড় গোচ্ছাছিলো। শিহাবের ডাক শুনে রেনু সামনে এলো। শিহাব রেনুকে দেখে বলল,
‘রেনু?’
‘হ্যাঁ।’
‘তুমি মাকে কী বলেছো আজ?’
‘কখন?’
‘আযানের আগে।’
রেনু বেশ অবাক হয়ে বলল,
‘কী বলেছি?’
‘মা নাকি তোমার উপর অত্যাচার করেন। তাকে নাকি তুমি পুলিশে দিবে?’
‘এ কথা মা বলেছেন?’
শিহাব কিছু বলার আগেই হাসি বেগম কান্নার বেগ আরও বাড়িয়ে দিয়ে বললেন,
‘থাক বাবা তোরা এ নিয়ে নিজেরা ঝগড়া করিস না! আমাকে রেনু কিছু বললে তাতে আমি কিছু মনে করিনি। রেনু ছোটো মানুষ না বুঝে হয়তো বলে ফেলছে।’
রেনু চূড়ান্ত অবাক হলো! একটা মানুষ এত নিখুঁত অভিনয় কী করে করেন? রেনুর রাগ উঠে গেল। রাগি কন্ঠে বলল,
‘মা আমি আপনাকে কী বলেছি?’
শিহাব বেশ রাগ করেই বলল,
‘যা-ই বলো না কেন, তা তোমার মাকে বলা উচিত হয়নি। মা কষ্ট পেয়েছেন। এখনি মায়ের কাছে ক্ষমা চাও?’
রেনুর চোখ ফেটে কান্না বেরিয়ে আসতে চাইছে। সবার ব্যবহার মেনে নিতে পারলেও শিহাবেরটা পারছে না। শিহাবের প্রতি প্রচন্ড অভিমান থেকে রেনু হাসি বেগমের কাছে গিয়ে বলল,
‘আমার ভুল হয়ে গেছে মা। মাফ করে দিন।’
হাসি বেগম বেশ নাটক করেই বলল,
‘আরে না না তুমি কেন মাফ চাইবে, আমার-ই হয়তো ভুল হয়েছে। তোমরা ভালো থাকো আমি সেটাই চাই।’
রেনু মনে মনে বলল,
‘ইয়া আল্লাহ! মানুষ এত নাটক কী করে করতে পারে?’
রেনু আর একমুহূর্তও সেখানে দাঁড়াল না। রুমে গিয়ে সোজা বাথরুমে ঢুকে পড়ল। রেনু যখন প্রচন্ড কষ্ট পায় তখন বাথরুমে ঢুকে কাঁদে। শিহাব অসহায় চোখে রেনুর যাবার পানে তাকিয়ে রইল। মনে মনে বলল,
‘আমি জানি রেনু আজ আমি তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলছি।’
রেনু বাথরুমে ঢুকে, পানির ট্যাপ ছেড়ে ডুকরে কাঁদতে লাগল। আর মনে মনে বলল,
‘হে আল্লাহ আমাকে কি আপরি একটুও ভালোবাসেন না? নয়তো আমার সুখ কেন আপনার সহ্য হয় না? যখন-ই একটু সুখী হতে চাই তখন-ই কোথা থেকে কষ্টেরা এসে ঘিরে ধরে।
২৪!!
রাযীনদের বাড়ি দেখে শশী রীতিমতো অবাক! এটাকে বাড়ি না বলে, ছোটো খাটো মহল বলা চলে। চারদিকটা কত পরিপাটি সুন্দর, সাজানো গোছানো। শশী শুনেছিলো, রাযীনরা বেশ ধনী, তবে এতটা তা ভাবেনি শশী। শশী মনে মনে বলল,
‘আমরা তো উচ্চ মধ্যবিত্ত। কিন্তু রাযীনদের বাড়িঘর দেখে তো বেশ বিত্তবান মনে হচ্ছে। তবে রাযীন নিজেদের মতো বিত্তবান পরিবারে বিয়ে না করে আমাকে বিয়ে করল কেন? পরক্ষণে নিজ মনে নিজে উত্তর দিলো, প্রেমে পড়লে পেত্নিকেও শ্রেষ্ঠ সুন্দরী মনে হয়। তো রাযীন নিজের থেকে একটু কম অবস্থা সম্পন্ন মেয়েকে বিয়ে করছে তাতে কী হয়েছে? তাছাড়া আমাদের অবস্থাও তেমন খারাপ না। দুই ভাই মিলে মাসে লাখের উপরে ইনকাম করে, বাবার মোটা অংকের পেনশন আছে। বাবার প্রচুর ধানী জমি, উঁচু জমি আছে। শহরে মধ্যে তিনটা ফ্ল্যাট আছে। যা থেকে মোটা অংকের টাকা ভাড়া পাই। আমরাও রাযীনদের থেকে কম না কোনো অংশে।’
ভাবনার ঘোর কাটল রোমিসার ডাকে। রোমিসা, শশীকে ওর রুমে নিয়ে বসিয়ে বলল,
‘ভাবি তোমাদের রুম সাজানো হচ্ছে। আজকে এ বাড়িতেও তোমার বাসর ঘর সাজানো হচ্ছে। যতক্ষণ না সাজানো শেষ হয় তুমি আমার রুমে বিশ্রাম করো।’
শশী মনে মনে বলল,
‘শালার বাসর ঘর আমার পিছু ছাড়ছে-ই না।’
রোমিসা আবার বলল,
‘চাইলে কাপড় বদলে নিতে হালকা কিছু পরতে পারো। তবে মা বলেছেন কিছুক্ষণ পর কিছু আত্মীয় আর তার বান্ধবীরা আসবেন, তুমি তাদের সামনে একটু সেজেগুজে যাবে। সে জন্য এই তোমার শাড়ি, এই সাজার প্রসাধনী। তুমি আমার ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে তৈরী হয়ে নাও।’
রোমিসা রুম থেকে বের হতেই শশী যেনো হাপ ছেড়ে বাঁচল। মেয়েটা এত কথা বলে যে, মাথা খারাপ করে দেয়। শশী রোমিসার রুমটায় ভালো করে চোখ বুলালো। অনেকটা প্রিন্সেসের রুমের মতো সাজানো। পুরো রুম গোলাপি রঙের ফার্নিচার আর আসবাবপত্র দিয়ে ঘেরা। গোলাপি দেয়ালে বিভিন্ন রকম থ্রীডি ওয়ালপেপার দিয়ে সুন্দর করে সাজানো। মনে হয় কোনো গোলাপি রাজ্যে এসে পড়েছি। গোলাপি রঙটা গাঢ় নয়, বরং হালকা গোলাপি।
বিছানাটায় গোলাপি রঙের চাদর বিছানো। বিছানাটা অনেক নরম। বসলে মনে হবে নরম মেঘের পালকে বসেছি। বিছানার পাশে একগুচ্ছ তাজা টকটকে লাল আর ধবধবে সাদা গোলাপ। গোলাপি রঙের সবকিছুর মধ্যে লাল আর সাদা গোলাপগুলো যেনো শোভা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। রুমটা এত সুন্দর করে সাজানো যে, দেখলেই মন ভালো হয়ে যাবে।
শশী, রোমিসার দেওয়া শাড়িটা হাতে নিল। হালকা নীল রঙের শাড়িটা দেখতে অসাধারণ। নীল রঙের জরজেট শাড়িটায়
সাদা সুতার কাজ করা। আর কাপড়টা এতো নরম মোলায়েম যে শশী গালে ছুঁয়ে দেখল। মনে মনে বলল,
‘বাহ! শাশুড়ি মায়ের চয়েজ আছে বলতে হয়। অবশ্য তিনি নিজেও দেখতে হিন্দি সিরিয়ালের মায়েদের মতো। সম্পর্কে মা কিন্তু দেখতে লাগে বোন। রাযীন, রোমিসা আর ওদের মা এক সাথে এক জায়গায় দাঁড়ালে সবাই নিশ্চিত ভাই-বোন ভেবে ভুল করবে।’
কিছুক্ষণ পর,
শশী তখন তৈরী হয়ে আয়নার সামনে দাঁড়াল। নিজেই নিজেকে দেখে মুগ্ধ হলো। তখন একজোড়া হাত ওকে পিছন দিয়ে জড়িয়ে ধরল। প্রথমে শশী কিছুটা চমকালেও, পরমুহূর্তে আয়নার রাযীনের প্রতিচ্ছবি দেখে স্বাভাবি থাকল। রাযীন শশীর কাঁদে থুতুনী রেখে বলল,
‘উফ আজ কী গরম?’
শশী খানিক রাগ দেখিয়ে বলল,
‘তাহলে ফেবিকলের মতো আমার সাথে চিপকে আছেন কেন? দূরে যান।’
‘উফ বুঝতে পারছো না, তোমাকে এত হট লাগছে যে, আমার পুরো বাড়ি গরম হয়ে গেছে।’
শশী লজ্জায় চোখ নামিয়ে ফেলল। রাযীনের একটা হাত সরাসরি শশীর নগ্ন কোমর ছুঁয়ে পেট স্পর্শ করল। শশী পুরো বরফের মতো জমে গেল। রাযীন শশীর ঘাড়ে নাক ঘসতে ঘসতে বলল,
‘শশী, তোমাকে দেখতে নীল রঙের চাঁদের মতো লাগছে। শুনেছি আমাদের গ্ল্যাক্সির বাইরে, কোনো গ্ল্যাক্সিতে রেড মুন, ব্লু মুন ওঠে। তোমাকে সেসব প্লানেটে রাখলে তারা নিশ্চিত তোমাকে ব্লু মুন ডাকত।’
‘আচ্ছা জানতাম না। বিজ্ঞান নিয়ে আমার জ্ঞান সীমিত।’
রাযীন শশীর গালে চুমো খেয়ে বলল,
‘তুমি কবে আমার প্রেমে পড়বে?’
‘কেন?’
‘আমাকে কতদিন এত সুন্দর বউটাকে শুধু দূর থেকে দেখতে হবে?’
শশী রাযীনের হাত সরানোর চেষ্টা করে বলল,
‘দূরে কোথায়? জোঁকের মতো চিপকে আছেন আমার সাথে।’
রাযীন আরও শক্ত করে শশীকে জড়িয়ে ধরে বলল,
‘তুমি কি সত্যি বুঝতে পারোনি আমি কী বলছি?’
হঠাৎ শশীর মেজাজটা কেন জানি খারাপ হয়ে গেল। ঝটকা মেয়ে রাযীনকে সরিয়ে বেশ রাগ করে বলল,
‘আমি তো আপনাকে সেসব করতে নিষেধ করিনি। আপনি নিজেই ভালোবাসার দোহাই দিচ্ছেন। ঢঙ দেখাচ্ছেন। আবার নিজেই কথায় কথায় আমাকে বাজে ভাবে স্পর্শ করেন।’
শশী এমন ব্যবহার করবে রাযীন ভাবতে পারেনি। নিজের কাছেই নিজেই রাযীন লজ্জা পেলো। তা-ও বলল,
‘স্বামীর ভালোবাসাময় স্পর্শকে বুঝি বাজে ভাবে স্পর্শ করা বলে?’
চলবে…..
#একদিন_বিকালে_সকাল_হয়েছিলো
লেখাঃ শারমিন আক্তার সাথী
পর্বঃ১৮
‘স্বামীর ভালোবাসাময় স্পর্শকে বুঝি বাজেভাবে স্পর্শ করা বলে?’
শশী কী বলবে ভেবে পেল না। হঠাৎ সবকিছু খুব বিরক্ত লাগছে। প্রচন্ড বিরক্ত! মেজাজটা খিটখিটে লাগছে। চেষ্টা করেও রাগ কন্ট্রোল করতে পারছে না। রাগ করেই বলল,
‘বাজে ভাবে নয়তো কী? কখনও হুটহাট চুমো খান, কখনও জড়িয়ে ধরেন, এখন তো পুরো লিমিট ক্রস করে গেলেন। নিজেই বলেন আমার ভালোবাসা হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করবেন, তাহলে এগুলো কী? আমার এসব বিরক্ত লাগছে।’
রাযীন এবার সত্যি শশীর ব্যবহারে খুব কষ্ট পেলো। নিজেকে সামলে বলল,
‘আমার ভুল হয়ে গেছে। এরপর যতদিন না তুমি নিজে থেকে আমার কাছে আসবে ততদিন আমি ভুলেও তোমায় স্পর্শ করব না।’
কথাগুলো বলে রাযীন রুম থেকে বের হয়ে গেল। শশী চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। কেমন যেনো সবকিছু ওর বিরক্ত লাগছে। কষ্ট হচ্ছে খুব। সজলের স্মৃতিগুলো ওর মনে বার বার ভেসে উঠছে। সজলকে খুব মনে পড়ছে ওর। কষ্টে বুকটা ফেটে যাবে মনে হচ্ছে। কষ্টগুলো পানির ফোয়ারা হয়ে চোখ থেকে নিঃসৃত হতে লাগল আর শশী বিড়বিড় করে বলল,
‘সজল কেন বুঝলে না আমাকে? কেন ভরসা করলে না আমার কথা? তাহলে হয়তো আজ নিজ স্বামীর স্পর্শে আমি বিরক্ত হতাম না। বরং ভালোবাসায় ভাসতাম। কারণ তখন স্বামী নামক মানুষটা তুমি হতে। তখন তোমার ভালোবাসায় আমি বিরক্তি বোধ করতাম না, তোমাকে ফিরিয়ে দিতাম না, বরং পরম আবেশে তোমার ভালোবাসায় মুগ্ধ হয়ে, তোমার ভালোবাসাময় ডাকে সাড়া দিতাম।
পরক্ষণে নিজের চোখ মুছতে মুছতে বলল, আমি কেন ওর জন্য কাঁদছি? ও হয়তো আমার কথা ভাবছেও না। ওর জীবন থেকে তো, ওর প্রতিষ্ঠিত হবার বাঁধা কেটে গেল। ও এখন খুব ভালো থাকবে। আমি ভাববো না ওর কথা। কেন ভাবব? ও কী আমার কথা ভেবেছিলো? এত বছর ভালোবেসে মাঝপথে ছেড়ে দিলো আমার হাত। বেইমান একটা। নিজের ভালোবাসার মানুষের সাথে প্রেম করবে কিন্তু বিয়ে করার সময় যত বাহানা। যে তার ভালোবাসার মানুষের হাতটা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত শক্ত করে ধরে রাখতে পারে না সে আবার কেমন পুরুষ! ভাববো না আমি বেইমানটার কথা। বাসবো না ওকে আর ভালো। ভুলে যাব ওকে। ওকে ভুলে নিজ সংসারে মন দিব।’
চোখ থেকে ঝরা অবাধ্য অশ্রুগুলোকে মুছে নিজেকে আবার স্বাভাবিক করার চেষ্টা করল। নিজেকে আবার পরিপাটি করে, সজলের কথা ভাবতে ভাবতে, চুপচাপ রোমিসার রুমেই বসে রইল শশী।
কিছুক্ষণ পর রোমিসা আর ওর মা মিতু রোমিসার রুমে আসলো। মিতু শশীর দিকে তাকিয়ে বলল,
‘মাশাআল্লাহ। এ যে, আমার ঘরে আজ চাঁদ এসেছে। নীল শাড়িতে তোমায় কী সুন্দর মানিয়েছে শশী! যিনি তোমার নাম শশী রেখেছিলেন, তিনি খুব ভেবে চিন্তা করে রেখেছিলেন বোধ হয়। নামের সাথে সৌন্দর্যের কী অদ্ভুত মিল!’
শশী বেশ লজ্জা পেলো। তা দেখে মিতু আবার বললেন,
‘আর লজ্জা পেতে হবে না, এবার চলো তো নিচে, আমার সব বান্ধুবীরা আসছে। শোনো আমার অগোচরে কেউ যদি তোমাকে ইনিয়ে বিনিয়ে কোনো কটু কথা বলে, এমন কোনো কথা যা তোমার ভালো লাগছে না, তবে সরাসরি আমাকে বলবে। বাকি তাদের আমি দেখে নিব। আর আমার সামনে বসে তো একদমই বলতে পারবে না।’
শশী মৃদু হাসল। মনে মনে বলল,
‘বাহ্! শাশুড়ি মা দেখছি দেখতে শুধু মডেলের মতো দেখতেই নন, চিন্তাধারাও উন্নত খুব।’
আত্মীয়-স্বজন শশীকে দেখে চলে যেতে যেতে রাত এগারোটা বেজে গেল। শশী বেশ কয়েকবার চারদিকে তাকিয়ে রাযীনকে খুঁজেছে কিন্তু পায়নি। খাবার সময় মিতু রোমিসাকে জিজ্ঞেস করল,
‘কিরে রোমিসা, তোর ভাইয়া কোথায়?’
‘মা, ভাইয়ার নাকি কী জরুরি কাজ আছে সেটা সারতে গেছেন?’
‘আজ ওর কী জরুরি কাজ?’
‘ভাইয়া তো বলল, পরশু চট্টগ্রাম যাবে, তার আগে নাকি তার কিছু কাজ গুছিয়ে রেখে যেতে হবে। সে কারণে। আসতে নাকি অনেক দেরী হবে।’
মিতু বেশ বিরক্তি নিয়ে, রাযীনের বাবা রায়হান রহমানের দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘দেখলে তোমার ছেলের কান্ড? এই ছেলেটা নিয়ে আর পারলাম না! আরে বিয়ে করলি মাত্র দু’দিন হলো, এখন কোথায় বউকে সময় দিবে, তা না করে কাজ করে একেবারে দুনিয়া উদ্ধার করে ফেলবে। সব তোমার দোষ।’
রায়হান মুখ কাচুমাচু করে বললেন,
‘আমি কী করলাম?’
‘আবার বলছো কী করলাম ? ছেলেটা গ্রাজুয়েশন শেষ করতে না করতেই ব্যবসার ভার দিয়ে দিলে। কেন ওকে কয়টা বছর নিজের মতো কাটাতে দিতে পারতে না?’
রায়হান হেসে বলল,
‘তোমার ছেলেই নাচতে নাচতে এসে বলেছিলো, বাবা তোমার বয়স হয়েছে এখন থেকে তোমার বিশ্রাম। ব্যবসা আমি সামলাবো। ও আমার বয়স নিয়ে বলার কে? কেন আমার কত বয়স হলো? মাত্র তো বায়ান্ন বছর। সেটা কি বেশি? বজ্জাত ছেলেটা আমাকে অল্পতে বুড়ো বানিয়ে দিলো।’
মিতু বলল,
‘হয়েছে এখন খাও। তোমার রাজপুত্রের তো আসতে দেরী আছে শুনলে।’
সবাই যে যার মতো খেলেও শশী খাবার নিয়ে নাড়াচাড়া করছিলো। কেউ কিছু না বুঝলেও শশী বুঝেছে রাযীন ওর কথায় কষ্ট পেয়ে গেছে। শশীকে মিতু খাওয়ার জন্য কয়েকবার জোর করলেও শশী খেলো না। বলল মাথা ব্যথা করছে। পরে খাবে। মিতু বুদ্ধিমতি। তিনি বুঝলেন শশী, রাযীনের সাথে খেতে চায়। তিনিও আর জোর করল না।
খাবার শেষে মিতু নিজেই শশীকে রাযীনের রুমে নিয়ে গিয়ে বলল,
‘এটা তোমাদের রুম।’
শশীর রুমটার চারপাশে চোখ বুলালো। কি সুন্দর পরিপাটি করে সাজানো! আজকে বাসর ঘরে সাজ খুব সিম্পল। শুধু সাদা আর লাল গোলাপে ভরা সারা রুম। গোলাপের গন্ধে ঘরটায় আলাদা মোহময়তা ছড়িয়ে গেছে। মিতু শশীকে বলল,
‘জানি বাসর ঘরে শাশুড়ি নয় বরং ননদ, জা’য়েরা নিয়ে আসে। কিন্তু তোমার ননদ তো দেখছোই ছোটো আর জা নেই, কারণ রাযীন একাই। তোমার অবশ্য জা একজন আছেন। রাজিনের চাচাতো ভাইয়ের বউ। কিন্তু সে আটমাসের প্রেগনেন্ট। তারপক্ষে রাতে আসা সম্ভব না।
মিতু, শশীকে বিছানায় বসতে বলল। শশী বসতেই মিতু বললেন,
‘তোমাকে রাযীন সম্পর্কে কিছু কথা বলি, রাযীনের মতো লক্ষীমন্ত ছেলে পাওয়া খুব কঠিন। তুমি জীবনে খুব ভালো মনের একজন মানুষ পেয়েছো। রাযীনের একটা ভয়াবহ খারাপ অভ্যাস বলি। রাযীন প্রচন্ড রাগী। কি বিশ্বাস হচ্ছে না? ওকে দেখলে বোঝা যায় না যে, ও রাগী। অবশ্য ও সহজে রাগ করেও না কিন্তু যখন রাগ করে তখন ধারণার বাইরে কান্ড করে। ঘরের জিনিসপত্র ভেঙে চুরমার করে ফেলে। ওর রাগ খুব ভয়াবহ। রাগ করলে কাউকে বকবে না, মারবে না শুধু ঘরের দুই তৃতীয়াংশ জিনিস ভেঙে ফেলবে। ওর রুমের এই টিভি, কাঁচের বুকসেলফ, কাঁচের টেবিল, ড্রেসিং টেবিলের আয়না এগুলো গত মাসের কেনা। নবাবজাদা গতমাসে রাগ করে এগুলো ভেঙে ফেলেছিলো। রাগ কেন করেছিলো তা শুনবে না?’
শশী শান্ত গলায় বলল,
‘কেন?’
‘তোমার জন্য।’
শশী বেশ অবাক হয়ে বলল,
‘আমি কী করেছি? এক মাস আগে তো তাকে আমি চিনতামও না।’
‘তুমি চিনতে না কিন্তু আমার গাধাটা তো তোমাকে চিনতো?’
‘তা কী কারণে রাগ করেছিলেন?’
‘গতমাসে একদিন বিকালে এসে তোমার ছবি আর পুরো ডিটেইলস দিয়ে বলল, মা আমি শশীকে-ই বিয়ে করব। যত দ্রুত সম্ভব তুমি আর বাবা ওর পরিবারের সাথে কথা বলো।’
এবার ওর কথায় আমি তেমন গুরুত্ব দিলাম না।’
‘কেন?’
‘কারণ ছয় কি সাত মাস আগেও একবার ও তোমার ছবি আর ডিটেইলস দিয়ে বলেছিলো তোমাকে বিয়ে করবে। তোমার বাসায় যেনো প্রস্তাব পাঠাই। আমরা তো ওকে এত দ্রুত বিয়ে করাতে চাইনি। ভাবছিলাম আর দু-তিন বছর পর। তা-ও রাযীন বিয়ে করতে চাইলো বলে আমরা তোমাদের বাসায় প্রস্তাব পাঠালাম। কিন্তু ক’দিন পর রাযীনের কী হলো কে জানে? নিজেই বিয়েটা ভেঙে দিলো।’
শশী বুঝল রাযীনকে যে, ও ফোন করে বিয়ে ভাঙতে বলেছিলো রাযীন সে কারণেই সাত মাস আগে বিয়েটা ভেঙে দিয়েছিলো। শশী বলল,
‘তারপর কী হলো মা?’
‘আমরা ঐ কারণে ভাবলাম আবার না, ও মত বদলে ফেলে, সে কারণে তোমাদের বাসায় প্রস্তাব পাঠাইনি। কিন্তু তিন-চারদিন পর এসে জানতে চাইল বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছি কিনা? যেই না বললাম ওমনি বাবুর মাথায় রক্ত উঠে গেলো। তারপর জিনিসগুলো তো ভাঙল সাথে দামি দামি কিছু ফুলদানি, শোপিচও ভাঙল।’
শশী বেশ অবাক হয়ে বলল,
‘এত রাগ করে আপনারা কিছু বলেন না?’
‘না কারণ রাগ করে তো আমাদের কারও সাথে খারাপ ব্যবহার করে না কিংবা বাজে ভাষায় কথা বলে না, এমনকি আমাদের কাউকে কোনো কথা বলে না, শুধু জিনিস পত্র ভাঙে। তারপর মাথা ঠান্ডা হলে, নিজেই আবার সব জিনিস কিনে আনে।’
শশী মুখ বাঁকিয়ে বলল,
‘দেখতে তো খুব শান্ত মনে হয়।’
‘এমনিও শান্ত, লক্ষী বাচ্চা আমার। খালি মাঝে মাঝে রাগ উঠলে, মাথা কাজ করে না। তাও ও সহজে রাগ করে না। ওর এমন রাগ বছরে দুই একবার দেখা যায়। বাকি সময় ভদ্রতা ওর কাছ থেকে শেখা যায়।’
শশী হাসল। শশীর হাসি দেখে মিতু বললেন,
‘তবে ও তোমাকে প্রচন্ড ভালোবাসে। বলতে পারো তোমার ধারনার বাইরে।’
শশী লজ্জা পেয়ে বলল,
‘আপনি কী করে জানলেন?’
‘বিগত কিছু মাসে ওর মুখ থেকে তোমার কথা শুনতে শুনতে আমাদের কানের পোকা মরে গেছে। তোমার পছন্দ অপছন্দ শুধু ওর-ই নয় আমাদেরও মুখস্ত। কারণ রাযীন এত বার বলেছে যে, না চাইতেও মুখস্ত হয়ে গেছে। তোমার পছন্দের রং সাদা আর নীল। সে কারণে ও নিজের রুমের দেয়াল নীল রঙের করে দিয়েছে। বলেছিলো রুমটা যেনো সাদা আর নীল গোলাপ দিয়ে সাজানো হয়। কিন্তু নীল গোলাপ পাওয়া তো সহজ নয়। চেয়ে দেখো এ রুমে তোমার অপছন্দের কিছু পাবে না।’
শশী রুমটা আবার ভালো করে দেখল। মনে মনে বলল,
‘সত্যি তো এখানে আমার অপছন্দের তো কিছু নেই। ফার্নিচার থেকে শুরু করে বিছানার চাদর পর্যন্ত আমার পছন্দের। এতকিছু রাযীন জানল কী করে?’
মিতু বললেন,
‘তুমি ঝাল খেতে পারো না, রসগোল্লা, জিলাপি তোমার খুব প্রিয়। গান শুনতে পছন্দ করো, তবে স্যাড সং। তুমি সাইকেল চালাতে ভালোবাসো। তোমার খুব শখ একটা গাছের নার্সারি দেয়ার। কিন্তু তোমার বাবার ভয়ে দিতে পারোনি। তুমি দু’হাত ভরে মেহেদী পরতে পছন্দ করো। বেলী ফুলের ঘ্রাণে তোমার এলার্জি। তুমি চিংড়ি মাছ খেতে পারো না, চোখ চুলকায় তোমার। রুই মাছ তোমার ফেবারিট। তুমি খালি পায়ে হাঁটতে পারো না, তোমার পায়ে ব্যথা হয়। শক্ত জুতাও পরতে পারো না। সাদা রঙ তোমার ভয়াভব প্রিয়। রাযীন সাদা রঙের বেনারসি কিনতে চেয়েছিলো কিন্তু বিয়েতে লাল রঙই সুন্দর বলে আমি জোর করে লাল রঙের কিনিয়েছি, তবে সাদা ও নীল রঙের বেনারসি, জরজেট শাড়ি, তাতের শাড়ি, সুতির শাড়ি, থ্রি পিচ, সব কিনে কেবিনেট ভর্তি করে রেখেছে। আরও কিছু শুনবে?’
শশী চূড়ান্ত অবাক হয়ে বলল,
‘মা আপনারা এত সব জানেন? কীভাবে জানলেন?’
‘আমার পাগল ছেলেটা বলেছে। তোমার সবকিছু ওর মুখস্ত। তুমি চিন্তাও করতে পারবে না, ঠিক কতটা ভালোবাসে ও তোমাকে।’
শশী ফুপিয়ে কাঁদতে লাগল। মনে মনে বলতে লাগল,
‘যে মানুষটা আমায় এত ভালোবাসে। আমি কেবল তাকে কষ্ট-ই দিচ্ছি। আর যে আমার ভালোবাসা বুঝল না, আমাকে বুঝল না তাকে নিজের হৃদয় উজার করা ভালোবাসা দিয়েছি। অপাত্রে নিজের মূল্যবান ভালোবাসা দিয়েছি।’
শশীর কান্না দেখে মিতু বলল,
‘কী হয়েছে মা? কাঁদছিস কেন?’
‘মা এত ভালোবাসা আমি সামলে রাখতে পারব?’
‘কেন পারবি না? আমরা আছি না? রোমিসা তোকে বলেছিলো না, তুই রাযীনের প্রাণ? সত্যি তাই। তুই রাযীনের প্রাণ আর রাযীন আমাদের প্রাণ। সে কারণে তুইও আমাদের প্রাণ।’
শশী, মিতুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল। আর বলল,
‘মা দেখবেন, আপনাদের এই অমূল্য ভালোবাসার সম্মান আমি সবসময় বজায় রাখব।’
‘হুঁ বুঝেছি। এখন তুই শুয়ে পড়। আমি গাধাটাকে কল করে দেখি আর কতক্ষণ লাগে আসতে।’
মিতু রাযীনকে কল করল,
‘কিরে কোথায় তুই?’
‘অফিসে মা।’
‘এখনও আফিসে। রাত সাড়ে বারোটা বাজে। আসবি কখন?’
‘সরি মা, একটু কাজে আটকে পড়েছি। ঘন্টাখানিক লাগবে আসতে।’
‘জলদি আয়। শশী কতক্ষণ জেগে থাকবে?’
‘ওকে ঘুমিয়ে যেতে বলো।’
মিতু কল কেটে বলল,
‘ইডিয়েট। মা হয়ে ছেলেকে কী করে বলি, নতুন বউ বাসর ঘরে অপেক্ষা করছে, স্টুপিড তুই চলে আয়। একদম বাবার মতো হাদারাম।’
শশী মুখ টিপে হেসে বলল,
‘মা কিছু বলছেন?’
‘না না তুই বরং ঘুমা। এইরে শশী তোমাকে কতক্ষণ যাবত তুই তুকারি করছি মাইন্ড করোনি তো?’
‘মা আপনি আমাকে আপন মানেন দেখেই না তুই বলেছেন। যদি আপন না মানেন তবে তুমি ডাকবেন।’
মিতু, শশীর কপােলে চুমো খেয়ে বলল,
‘লক্ষী বাচ্চাটা আমার।’
মিতু চলে গেল আর শশী একা একা বসে বসে ভাবছে,
‘বাপরে রাযীন সাহেবের ভালোবাসা দেখছি ভয়ানক। আমার সবকিছু তার মুখস্ত। কিন্তু এত খবর পেলো কী করে? জানতে হবে?’
বসে বসে অপেক্ষা করতে করতে শশী বিছানায় হেলান দিয়েই ঘুমিয়ে পড়ল। ঘন্টাখানিক বোধ হয় ঘুমালো শশী। হঠাৎ ঘুমটা কেমন যেনো হালকা হয়ে গেল।
ঘুম ভাঙতেই অনেকটা চমকে উঠল শশী। রাযীন ওর সামনে বসে এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। শশী তাড়াহুড়ো করে উঠে ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বলল,
‘এভাবে কী দেখছেন?’
‘তোমাকে স্পর্শ করা নিষেধ, দেখা তো নয়! আর তোমাকে আগেই বলেছি তোমাকে দেখতে আমার ভালোলাগে। মনে শান্তি লাগে খুব।’
ঘুম জড়ানো কন্ঠে শশী মুচকে হেসে বলল,
‘কখন আসলেন?’
রাযীন দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
‘উফ তোমার ঘুম জড়ানো কন্ঠটা নেশা হবার মতো সুন্দর।’
শশী লজ্জা পেয়ে আবার বলল,
‘কখন আসলেন?’
‘আধাঘন্টার মতো।’
‘খেয়েছেন?’
‘না। মা বলল তুমিও খাওনি। চলো খাবে।’
শশী ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল পৌনে তিনটা বাজে। শশী হেসে বলল,
‘এখন কী রোজা রাখার সেহেরী খাব?’
রাযীন হাসল। তারপর বলল,
‘ভাত খাবে?’
‘না।’
‘হালকা কিছু?’
‘হ্যাঁ।’
‘আচ্ছা পাঁচ মিনিট বসো নিয়ে আসছি।’
রাযীন ট্রেতে করে পেস্টি, আইসক্রিম আর রসোগোল্লা নিয়ে আসল। তা দেখে শশী বলল,
‘রাতে এত মিষ্টি আইটেম খাব? কদিন পর তো তাহলে ড্রাম হয়ে যাব।’
রাযীন হেসে বলল,
‘একদিনে কিছু হবে না।’
খাবার পর রাযীন বলল,
‘শুয়ে পড়ো।’
‘আপনি?’
রাযীন দুষ্টুমি করে বলল,
‘নিচে শোব। বলা তো যায় না আবার তোমাকে স্পর্শ করে বসি কিনা?’
শশী মন খারাপ করে বলল,
‘উপরে আসুন। পাশে শুয়ে পড়ুন।’
‘নাহ।’
‘আরে জরুরি কথা আছে, পাশে শুয়ে পড়ুন তারপর বলব।’
দুষ্টু হেসে রাযীন বলল,
‘পাশে না শুলে বলা যাবে না?’
শশী হেসে বলল,
‘না।’
রাযীন পাশে গিয়ে শুতেই শশী, রাযীনের বুকে মাথা রাখল। রাযীনের মনে হলো ওর শরীরে কারেন্ট শক লেগেছে। নিজেকে বহু কষ্টে নিয়ন্ত্রণ করে বলল,
‘এটা কী হলো?’
‘তখন বললেন না আমি স্পর্শ না করলে আপনি আমায় স্পর্শ করবেন না। সে কারণে আপনার পণ ভঙ্গ করলাম।’
হাসল রাযীন। শশী বলল,
‘রাযীন খেয়াল করে শুনুন আমার কথা। আর আমার সত্যি কথাগুলো শুনে প্লিজ মন খারাপ করবেন না। প্রথমত সন্ধ্যার ব্যবহারের জন্য সত্যি-ই অনেক অনেক দু্ঃখিত। আমি ওমনটা করতে চাইনি। কিছুদিন যাবত আমার খুব মুড সুইং হচ্ছে। কেন হচ্ছে তা পরে বলব। আর পরের কথা হচ্ছে, আমার সজলের সাথে ব্রেকাপ হয়েছে সাত দিনও হয়নি। যেদিন ব্রেকাপ হয়েছে তার পরের দিনের পরের দিন আমাদের বিয়ে হয়েছে। আর সত্যি বলতে আমার আর সজলের তো কোনো ব্রেকাপ হয়নি! সজলের অবস্থা দেখে আমি নিজে থেকে সম্পর্ক, আমার মনে শেষ করেছি। সজলকে বলিওনি পর্যন্ত। সজলে সাথে আমার চার বছরের সম্পর্ক ছিলো। তো চার বছরের সম্পর্ক কী চারদিনে ভোলা পসিবল? কখনও-ই না। চারদিন কেন, প্রথম প্রেম চার জন্মেও ভোলা হয়তো সম্ভব নয়!
রাযীন আমাদের বিয়ে হয়েছে মাত্র তিনদিন। আমাকে স্বাভাবিক হতে, আপনাকে এবং এই বিয়েটাকে মেনে নিতে একটু সময় দিতে। আপনি নিঃসন্দেহে একজন ভালো মানুষ। এবং আমি এ-ও জানি আপনি আমাকে কতটা ভালোবাসেন। সজলের সাথে দেখা হওয়ার পূর্বে আমার, আপনার সাথে দেখা হলে নিশ্চিত আমি আপনার প্রেমে পড়তাম। তাতে কোনো ভুল ছিলো না! তবে এখন আমার সময় লাগবে। সব কিছু সাজিয়ে, নিজেকে গোছাতে আমার সময় লাগবে। ততদিন পারবেন না সময় দিতে।’
রাযীন, শশীর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
‘তোমার সরল স্বীকারক্তি আমাকে সত্যি মুগ্ধ করেছে। শশী তুমি সময় নাও। তোমার যতখুশি সময় নাও।’
শশী আবার রাযীনের বুকে মাথা দিয়ে বলল,
‘রাযীন একটা কথা বলি?’
শশীকে গভীরভাবে জড়িয়ে ধরে রাযীন বলল,
‘বলো।’
‘আগে বলেন হাসবেন না।’
‘আচ্ছা।’
‘বিগত কিছু বছর যাবত আমাকে মনে ক্ষুদ্র একটা ইচ্ছা ছিলো।’
‘কী?’
‘বিয়ের পর আমি যখন ঘুমাবো আমার মাথাটা আমার স্বামীর বুকে থাকবে।’
রাযীন মুখ টিপে হেসে বলল,
‘তাহলে রাখো। এই বুকটা শুধু তোমার। তুমি যেভাবে খুশি ঘুমাও।’
‘কিন্তু তখন কল্পনায় অন্য কাউকে নয়….
শশীর কথা পুরো হবার আগে রাযীন বলল
‘বরং সজলকে দেখতে।’
‘হ্যাঁ।’
‘তবে এখন থেকে আমাকে দেখো। এখন থেকে তুমি আর কল্পনায়ও সজলকে দেখতে পারবে না। তোমার কল্পনাও আমি আমার দখলে নিয়ে নিব। সেদিন বেশি দূরে নয়, যেদিন তোমার পুরো সত্ত্বায় রাযীনের বসবাস হবে।’
শশী নিশ্চুপ থেকে মনে মনে বলল,
‘আমিও তাই চাই। নতুন করে নিজের জীবনটা, আপনাকে নিয়ে সাজাতে চাই। আপনার এত ভালোবাসা উপেক্ষা করার মতো কঠিন হৃদয় আমার নেই।’
শশী চুপ করে রাযীনের বুকে শুয়ে রইল। রাযীন বলল,
‘শশী।’
‘হুঁ।’
‘আমার বুকে তোমার কেমন লাগছে?’
‘সত্যি বলতে আমার মনটা এখন শান্ত লাগছে। নিজেকে হালকা লাগছে। এক অদ্ভুত প্রশান্তি লাগছে আপনার বুকে। আমি কী এভাবে ঘুমাব?’
‘আজব! অনুমতি নেয়ার কী আছে?’
চলবে…………