এক আকাশ অভিমান পর্ব-১৪+১৫

0
231

#এক_আকাশ_অভিমান
#মার্জিয়া_জাহান_চাঁদনী
#পর্ব : ১৪

আজ পহেলা ফাল্গুন।
প্রকৃতি সেজেছে এক নতুন রূপে।
গাছে গাছে নতুন পাতা, সাথে ফুটেছে বাহারি রঙের ফুল। এতে যেনো প্রকৃতির সৌন্দর্য্য দ্বিগুণ ফুটে উঠেছে। চারিদিকে নরম দূর্বা ঘাস, শিমুল ফুল , কোকিলের ডাক, হালকা শীত শীত ভাব যেনো পরিবেশ টা রোমাঞ্চকর করে তুলেছে। এই জন্যই হয়তো ফাল্গুন মাস ভালোবাসার মাস হিসাবে পরিচিত। ফাল্গুনের প্রতিটা লগ্ন যেনো প্রেমময় উপন্যাস রচনা করে।

একটু দূরের মাঠে বসন্ত বরণ অনুষ্ঠান করা হচ্ছে।
ছোট থেকে কিশোরী ছাত্রী রা বাসন্তী রঙের শাড়ি পরেছে। মাথায় হাতে দিয়েছে ফুলের গাজরা। ছেলেরা ও পাঞ্জাবি পড়েছে।ঝাঁক বেঁধে মাঠের দিকে চলছে সবাই। প্যান্ডেল থেকে গান ভেসে এলো

~ বাতাসে বহিছে প্রেম
নয়নে লাগিল নেশা
কারা যে ডাকিল পিছে বসন্ত এসে গেছে
মধুর অমৃত বাণী
বেলা গেলো সহজেই
মরমে উঠিল বাজি বসন্ত এসে গেছে…

সকাল থেকে বিয়ের আমেজ শুরু হয়েছে।
আজ রিনি শামীমের বিয়ে। বাড়িতে মেহমান দের আনাগোনা। তরী একা হাতে সামলাচ্ছে সব দিক।তাহেরা বেগম যেনো কাজ করেও কুল পাচ্ছেন না।
পাবার কথা ও না। বিয়ে বাড়ির কাজ যতই করো ততই কাজ বাড়ে।চাঁদকে রাখার দায়িত্ব রাবেয়া বেগমের তবুও তিনি যথাসাধ্য চেষ্টা করছেন।

রিনির বিয়েটা সিরাজুল সাহেবের বাড়ি থেকে হবে।বড় ভাইয়ের কথার অন্যথা করেন নি রমিজুল সাহেব।

সকাল থেকে বমি বমি ভাব হচ্ছে তরীর। খাওয়া দাওয়ার অনিয়ম কাজের চাপ বলে এড়িয়ে গেলো।
সকাল প্রায় নয়টা। গ্রামের মেয়ে বউদের নিয়ে তরী ছুটেছে ঘাট থেকে জল আনতে। কলসি নিয়ে গান গাইতে গাইতে পুকুর পারে গেলেন। শ্রাবণের এক ভাগ্নি সেজেছে মেয়ের মা। শাড়ি পরে মাথায় নিয়েছে কুলো। ধান ,দূর্বা , পান , সুপারি নিয়ে পুকুর থেকে জল তুলে ফিরে এলেন সবাই।
হলুদ মাখিয়ে গোসল করানো হলো রিনি কে।
মেয়ে বউরা হলুদ খেলায় ব্যাস্ত।

রিনিকে সাজতে গ্রামের পার্লার থেকে মেয়ে এসেছে।
বউয়ের সাজে সজ্জিত হলো এক শ্যামকন্যা।

তরী আজ শাড়ি পড়েছে। তাহেরা বেগম বার বার বলেছেন শাড়ি পরার কথা।
গাঢ় সবুজ রঙের শাড়ি, খোঁপায় তাজা গোলাপ অল্প সাজে তরীর রূপ যেনো দ্বিগুণ ফুটে উঠেছে।
চাঁদকে পড়িয়েছে সবুজ রঙের বেবি ফ্রক।

শ্রাবণ একটা কাজে এসেছে রুমে।
তরীকে দেখে একমুহুর্তের জন্য থমকে গেছে। চোখের সামনে যেনো এক মাধবীলতা দাড়িয়ে আছে। সবুজ রঙে কাউকে এত সুন্দর লাগতে পারে ভাবে নি শ্রাবণ।কিন্তু তরী তো সবুজ রঙ পছন্দ করতো না।
এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল তরীর দিকে।
শ্রাবণের দৃষ্টি লক্ষ্য করে লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেললো তরী।

চাঁদ দৌড়ে গিয়ে শ্রাবণের পা জড়িয়ে ধরলো। চাঁদ কে দেখে হাসি মুখে কোলে তুলে নিলো। এই কদিনে বেশ ভালই ভাব হয়েছে চাঁদ শ্রাবণের। চাঁদের গালে চুমু খেয়ে বললো

” ওহ ! মা মেয়ে তাহলে মেচিং করে পড়েছো? আমাকে বাদ দিয়েই তাই না। দাড়াও আমিও মেচিং জামা পড়বো।”

চাঁদ খিল খিল করে হেসে উঠলো। শ্রাবণ সত্যি সত্যি একটা সবুজ পাঞ্জাবি পড়ে নিলো।

তরীর সামনে গিয়ে বললো

” সবুজ কবে থেকে পরা শুরু করলে আগে তো কখনো দেখিনি সবুজ পড়তে ?”

” যেদিন থেকে জানতে পেরেছি অনিকের পছন্দের রঙ সবুজ সে দিন থেকে মনে প্রাণে সবুজ পছন্দ করি।”

” যাক জেনে খুশি হলাম আমার সাথে প্রতারণা করলেও আমার ভাইয়া কে ভালোবাসো।”

” সে আমার অর্ধাঙ্গ ছিল। তাকে ভালো না বেসে থাকা যায় না।”


নদী এসেছে রিনির বিয়েতে।
আসার পর থেকে শ্রাবণকে খুজেই চলেছে।কিন্তু এখনও দেখা পায় নি।
একজন কে জিজ্ঞেস করে শ্রাবণের রুমের দিকে। রুমে ঢুকেই অবাকের শীর্ষে পৌঁছালো।

শ্রাবণ তরী বেশ হাসি মুখেই কথা বলছে। শ্রাবণের কোলে চাঁদ। তিন জনই একই রঙের পোশাক পড়েছে।
দেখে মনে হচ্ছে তারা একসাথে খুব সুখেই আছে।
নদীর অন্তর কেপে উঠলো।
তার মানে কি শ্রাবণকে হারিয়ে ফেললো সে ?
যার জন্য এত নাটক, এত অন্যায় করলো , যাকে পাওয়ার জন্য তরীর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করল। তাকেই পেয়ে হারিয়ে ফেলবে ভাবতে পারে নি।
বুকের ভেতর ভয়ের দানা বেঁধেছে। অল্প অল্প করে ভিতরটা পুড়ে যাচ্ছে। মানুষ তো ভালোবাসার জন্য কত কিছুই করে,মরতে পর্যন্ত পারে। সে তো যা করেছে ভালোবাসা কে কাছে পাওয়ার জন্য করেছে। যার জন্য এই সাজ সজ্জা, পছন্দের রঙের শাড়ি পরা, সেই তো অন্য কারো রূপে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে আছে।
তাহলে কি সে ব্যার্থ ভালোবাসার খেলায়?
কি করবে সে? নিঃশব্দে ওদের জীবন থেকে চলে যাবে ? হ্যা চলে যাবে।ওরা সুখী হোক। অনেক চেষ্টাই তো হলো, চারটা বছর ধরে যার জন্য এত কিছু তাকেই যদি বেধে রাখতে না পারি তাহলে এত আয়োজনের কি মানে? কিন্তু আমার কি হবে ? আমি কি নিয়ে থাকবো?

চোখ মুছে তরীকে উদ্দেশ্য করে বলল

” কেমন আছিস তরী ?”

দরজার দিকে তাকিয়ে দেখলো নদী দাড়িয়ে আছে।
তরী হাসি মুখে বললো

” আলহাদুলিল্লাহ ভালো আছি। তুই কেমন আছিস? বাইরে কেনো ভিতরে আয়।”

নদী মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল তরীর দিকে।মেয়েটার সাথে কত অন্যায় করেছি তবুও মেয়েটা কি সুন্দর তার সাথে হেসে কথা বলছে। অথচ নদী তাকে হিংসা করে সেই ছোট থেকেই। এটাই হয়তো তরী আর নদীর মধ্যে পার্থক্য!! এই জন্যই হয়তো শ্রাবণ আজও তরীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ। না হলে চার বছরেও শ্রাবণের মনে জায়গা করে নিতে পারে নি। একবারের জন্যও এই ভাবে তাকায় নি।
নদীকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে তরী আবার বললো

” কি রে আয় ।”

নদী চাঁদ কে কোলে নিলো। কপালে চুমু একে বললো “কেমন আছো খালামণি?”

চাঁদ আদো আদো ভাষায় বললো
” আলহাদুলিল্লাহ”

শ্রাবণ তাকিয়ে দেখলো নদী আজ তার পছন্দের রঙের শাড়ি পরেছে। অথচ মেয়েটার দিকে একবারও তাকাতে ইচ্চা করছে না। বেহায়া আঁখি দুটি ঘুরে ফিরে তরীর দিকেই নিবদ্ধ।

শামীম রিনি বিয়ে শেষ। বরযাত্রী কনে নিয়ে রওনা দিয়েছে। বিষণ্ণ মন নিয়ে সবাই যার যার কাজে লেগে পড়েছে।

সব কিছু গুছিয়ে নিতে বেশ রাত হয়ে গেলো। মেহমান রা সবাই চলে গেছে। কেউ কেউ থেকে গেছেন।
চাঁদ ঘুমে ঢুলছে। তবুও ঘুমাবে না মাকে ছাড়া। মেয়েকে নিয়ে রুমে গেলো তরী। ঘুম পাড়িয়ে উঠতে যাবে তখনই মাথা টা ঘুরে উঠলো। সেই সাথে প্রচন্ড বমি পাচ্ছে।
মনে সন্দেহের দানা বেঁধেছে।

নতুন সকাল।
সবকিছু আবার নতুন করে শুরু হবে।
তরীর ঘুম ভাঙলো মেয়ের ডাকে। বেশ বেলা হয়ে গেছে। চাঁদের খিদে পেয়েছে। পাশে তাকিয়ে দেখলো শ্রাবণ ঘুমে মগ্ন। রাতে কখন রুমে এসেছে ঠের পায় নি তরী। মেয়েকে ফ্রেশ করিয়ে রান্না ঘরে গেলো। ক্লান্ত থাকায় এখনো কেউ উঠে নি। সবার জন্য নাস্তা বানিয়ে নিলো। সালমা বেগম কাগজে মুড়িয়ে কিছু একটা দিলেন তরীর হাতে। তরী সালমা বেগমকে নিষেধ করে দিলো এখনই যেনো কাউকে কিছু না জানান।


ব্যাগ রেডি করছে শ্রাবণ। তরী সেই সময় ঘরে ডুকে। মনে মনে দোয়া দুরুদ পরে নেয়। কি করে বলবে কথা টা। শ্রাবণ কি। ভাবে নিবে ? যদি মেনে না নেয়?
শ্রাবণ কে ব্যাগ রেডি করতে দেখে অবাক হয়ে বললো

” আপনি কোথাও যাচ্ছেন নাকি?”

” হুম। রাজশাহী যাচ্ছি। একটা ট্রেনিং আছে।”

” কত দিন লাগবে ?”

” দুই মাসের মতো।”

” কখন যাবেন ?”

” এই তো বেরিয়ে যাবো আধ ঘণ্টার মধ্যে। তুমি চাঁদের আর সবার খেয়াল রেখো।”

তরী মাথা নাড়ায়। শ্রাবণ সবাইকে বলে বেরিয়ে যায়।
তরী বিষণ্ণ মন নিয়ে দাড়িয়ে থাকে। শ্রাবণ কে বলতে পারলো না সে বাবা হতে যাচ্ছে। এখন কি করবে?
সবাইকে জানাবে? হ্যা সেটাই ভালো।

খুশির সংবাদ শুনে রাবেয়া বেগম অনেক খুশি হয়েছেন। শুকরিয়া জানালেন আল্লাহর দরবারে ছেলে মেয়ে দুটো একে অপরকে মেনে নিয়েছে এর থেকে বড় পাওয়া আর কি হতে পারে। তাহেরা বেগমকে জানালে তিনি খুশিতে জড়িয়ে ধরেন তরী কে। যেখানে ছেলে মেনে নিয়েছে সেখানে তিনি রাগ পুষে রেখে কি করবেন। তিনি দাদী হবেন এতেই খুশি।

#চলবে ইনশা আল্লাহ..!

#এক_আকাশ_অভিমান
#মার্জিয়া_জাহান_চাঁদনী
#পর্ব : ১৫

শ্রাবণ রাজশাহী গেছে আজ দুই মাস হলো।
বাড়িতে যোগাযোগ নেই বললেই চলে। গত দুইমাসে হাতে গুনে ৩ বার ফোন করেছিলো তাহেরা বেগমের কাছে। এক দুই মিনিট কথা বলে রেখে দিয়েছে। কাজের ব্যস্ততায় কারো সাথে কথা হয়নি। শ্রাবণ যে বাবা হতে যাবে সেই কথা জানানোর সুযোগ টা পান নি তাহেরা বেগম।

তরীর প্রেগনেন্সির চার মাস চলছে।
শরীরে মাতৃত্বের আভা স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। পেট খানিকটা উচু হয়েছে। নিজের ভিতর একটা ছোট্ট প্রাণের অস্তিত্ব অনুভব করে প্রতিনিয়ত।

চাঁদ তো মহা খুশি।
ভাই বোন আসবে তার। রাবেয়া বেগম তরীকে পা ফেলতে দেন না। তাহেরা বেগমের প্রতিটা সময় এখন তরীর সাথেই কাটে। চাঁদকে ও তিনি ভালোবাসতে শুরু করেছেন।
রিনি এসে থেকে গেছে কয়েক দিন।

নদীও এখন আর শ্রাবণের সাথে যোগাযোগ করে না।
মাঝে মাঝে এসে তরী কে দেখে যায়। নদীর বাবা মা মেয়ের জন্য ছেলে দেখছেন। নদীও মত দিয়েছে।
অনেক তো হলো এইবার না হয় নিজের জীবনটা গুছিয়ে নেওয়া যাক। সুখী হতে কে না চায়।
কেউ সুখী হয় আর কেউ দুঃখের অনলে জ্বলে পুড়ে বিলীন হয়ে যায়।নিজের ওপর বড্ডো করুণা হয় নদীর। কেনো এতো দিন মরীচিকার পিছনে ছুটলো।
শ্রাবণ কে পাওয়ার আশায় কত কিছুই সহ্য করেছে।
গ্রামের মেয়ে , বয়স উনিশ বা বিশ হয়ে গেলে মানুষ কটু কথা শুনতে ছাড়ে না। নদী কে ও কত কিছু শুনতে হয়েছে। কেনো বিয়ে করে না নাকি কেউ বিয়ে করতে চায় না।
ভিতর ছিঁড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো নদীর।
মনে পড়লো সেই প্রথম দিনের কথা। যেদিন শ্রাবণকে প্রথম বার দেখেছিল। একদেখাতেই মানুষটার প্রেমে পড়েছিল। তার পর নানা বাহানায় মানুষটা কথা বলতো, ঘুরতে নিয়ে যেতো একমুহুর্তের জন্য নদীর মনে হতো শ্রাবণ বুজি তাকেই ভালোবাসে। নিজের অনুভূতি গুলো আরো তাজা হয়ে উঠলো।
যখন জানতে পারলো শ্রাবন তাকে না তরী কে ভালোবাসে তখন মৃত্যু সমান কষ্ট হয়েছিল।
ঈর্ষা জন্মালো তরীর প্রতি। তরী খুব সহজেই সবকিছু পেয়ে যায় কিন্তু নদী পায় না। তার পছন্দের জিনিস গুলো অন্যকারো হয়ে যায়।
ভালোবাসা পাওয়ার লোভ মানুষকে বিবেকহীন পশুতে পরিণত করে। ঠিক ভুল বিচার করার শক্তি লোপ পায়। মানুষ ভুলে যায় জোর করে ভালোবাসা পাওয়া যায় না।
চোখের জল মুছে গায়ের উড়না টা একটু ভালোভাবে জড়িয়ে নিলো। বেশ শীত লাগছে। হিমেল বাতাস বইছে, এক স্নিগ্ধ সুগন্ধ হৃদপিণ্ড স্পর্শ করছে।

শ্রাবণ কিছুক্ষণ আগে বাড়ি ফিরেছে। হাতে তার প্রমোশন লেটার। কাল অফিসে গিয়ে এটা জমা দিলেই প্রমোশন পাক্কা। সবাইকে দেখাবে বলে খুশি মনে হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

শ্রাবণ কফি চেয়েছিল বেশ কিছুক্ষণ আগে। চাঁদকে ঘুম পাড়াতে গিয়ে দেরি হয়ে গেল। তাই তাড়াহুড়া করে কফিটা বানিয়ে চললো কক্ষের উদ্দেশে।
যে করেই হোক প্রে*গ*নে*ন্সি*র খবর টা শ্রাবণকে জানাতেই হবে। মনে মনে ভয় পাচ্ছে তরী।

তরীর আসতে দেরি হচ্ছে বলে লেটার টা হাতে নিয়ে রুম থেকে বের হতে যাবে তখনই প্রবেশ করে তরী। তাড়াহুড়ায় তাল সামলাতে না পেরে ধাক্কা খায়। ফলস্বরূপ কফিটা প্রমোশন লেটারে পরে ভিজে নষ্ট হয়ে যায়।

তরতর করে রাগ মাথায় উঠে যায় শ্রাবণের। যেই কাগজটার জন্য দুইটা মাস গাধার মতো পরিশ্রম করেছে আজ সেই কাগজটা এক নিমিষেই নষ্ট করে দিলো। তরীর বাহু শক্ত করে ধরে বললো

” চোখে দেখো না তুমি ? দিকে তো আমার সমস্ত পরিশ্রম জল ফেলে। সব দিক থেকে জীবন টা নরক করে দিয়েছো আমার।”

রাগে ধাক্কা দিয়ে তরী কে সামনে থেকে সরিয়ে দিয়ে বাইরে দিকে পা বাড়ায়।
ধাক্কা সামলাতে না পেরে কফিতে স্লিপ খেয়ে উবুর হয়ে পড়ে যায় তরী। পেটে চাপ খেয়ে মুহূর্তেই এক আকাশ পাতাল কাপিয়ে চিৎকার দেয়। চিৎকার শুনে শ্রাবণ পিছনে তাকিয়ে দেখে ফ্লোর র *ক্তে ভেসে যাচ্ছে।
ব্যাথায় গলা কাটা মুরগীর মতো চটফট করছে।

স্তব্ধ হয়ে গেলো শ্রাবণ। ছুটে গিয়ে তরীর মাথা টা কোলে নিলো। তরী চোখ ভর্তি জল নিয়ে বললো

” আমি প্রে*গ*নে*ন্ট ছিলাম শ্রাবণ। তুমি নিজ হাতে আমার সন্তান কে খু*ন করলে।”

চিৎকার শুনে তাহেরা বেগম আর রাবেয়া বেগম ছুটে আসেন। তরী কে এই অবস্থায় দেখে মুহূর্তেই দুজন হতবাক হয়ে যান। তরীর কাছে গেলেন দুজন। তরী শুধু একটা কথাই বলছে ” আপনি আমার সন্তান কে খু*ন করেছেন।”

তাহেরা বেগম কষিয়ে এক তাপ্পর বসিয়ে দিলেন ছেলের গালে।

” নিজের সন্তানকে শেষ করে দিলি?”

তাহেরা বেগমকে চুপ করিয়ে দিলেন রাবেয়া বেগম।

” তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নিতে হবে।”

শ্রাবণের হুস ফিরল। দ্রুত তরীকে কোলে নিয়ে ছুটল হাসপাতালের উদ্দেশ্যে।

ব্যাথায় কাতরাচ্ছে তরী। চোখ দিয়ে অনবরত অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে।

হাসপাতালে পৌঁছালে সেখানকার ডাক্তার রা জানিয়ে দেয় তারা ট্রিটমেন্ট করতে পারবে না এখানে।

” প্রসেন্টের অবস্থা ক্রিটিকাল। তাছাড়া উনার লাইফ রিস্ক আছে। আমরা ঝুঁকি নিতে পারবো না আপনারা দ্রুত ঢাকায় নিয়ে যান।”

রমিজুল ও সিরাজুল সাহেব ইতিমধ্যেই পৌঁছেছেন। তাহেরা বেগমকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়ে সবাই রওনা দিলো ঢাকার উদ্দেশে।

সেখানকার ডাক্তার ও জানায়

” পেশেন্টের প্রচুর ব্লাড লস হয়েছে, তাছাড়া বেবিটা মিস্কারেজ হয়ে গেছে। উনি চার মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন স্বাভাবিক ভাবেই বেবিটা বেড়ে উঠছিল। ব্লাড লস হলেও বেবির কিছু অংশ পেটে রয়ে গেছে সেটা দ্রুত অপারেশন করতে হবে। আপনারা বন্ডে সাইন করুন। রোগীর লাইফ রিস্ক আছে। যেকোনো সময় যা কিছু হয়ে যেতে পারে। ”

” সিরাজুল সাহেব কান্না করে দিলেন। ডাক্তারের সামনে হাত জোড় করে বললেন যে করেই হোক ডাক্তার আমার মেয়েটাকে সুস্থ করে দিন।”

” আপনারা আল্লাহ কে ডাকুন। আর উনার হাজবেন্ড কে ? প্লিজ তাড়াতাড়ি সই টা করুন। হাতে সময় খুব কম।”

কাপাকাপা হাতে সাইন করলো শ্রাবণ। চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। নিজেকে পাপী মনে হচ্ছে। নিজ হাতে সন্তান কে খু*ন করেছে। তার মতো নিকৃষ্ট বাবা হয়তো পৃথিবীর বুকে নেই।


টানা ৩ ঘণ্টা অপারেশনের পর কেবিনে শিফট করা হলো তরীকে। ডাক্তার বের হয়ে বললেন

” আল্লাহর রহমতে পেশেন্ট ঠিক আছে। তবে তিনি আর কখনো কনসিভ করতে পারবেন না। আপনারা উনার প্রতি একটু খেয়াল রাখবেন। তিনি মানসিক ভেবে অসুস্থ থাকবেন বেশ কিছুদিন।”

তরী আর কখনো মা হতে পারবে না শুনে সবার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো।
রাবেয়া বেগম শ্রাবণের কাছে গেলেন।মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেন

” তুমি খুশি তো শ্রাবণ ?”

শ্রাবণ কিছু বলতে যাবে তিনি হাতের ইশারায় বললেন চুপ থাকতে।

” তুমি আর কিছু বলো না শ্রাবণ। তোমাদের বিয়ের পর থেকে আমি সব কিছুই খেয়াল করেছি। তোমার উগ্র ব্যাবহার, গায়ে হাত তোলা তোমার বান্ধবী। সব কিছুই আমার নজরে এসেছে। কিছু বলি নি তোমাদের সময় দিতে চেয়েছিলাম। যেই পরিস্তিতি তে তোমাদের বিয়েটা হয়েছে তোমার এই ব্যাবহার টা স্বাভাবিক হিসাবেই মেনে নিয়েছিলাম। কিন্তু আজ তুমি যা করলে সেটা কি করে মেনে নেই বলো। নিজ হাতে একটা প্রাণ কে হত্যা করেছো।মেয়েটা তোমাকে খুশির সংবাদটা বলার জন্য অনেক চেষ্টা করেছিল কিন্তু হতভাগী পারে নি। আজও কফি নিয়ে তোমাকেই বলতে গেছিলো। চাঁদের বাবা দরকার ছিল তাই তোমার সাথে তরীর জীবনটা জুড়ে দেওয়া হয়েছিল।তুমি চাঁদের ও বাবা হয়ে উঠতে পারো নি।
বাদ দাও সেসব। আমার মেয়েটা প্রাণে বেঁচে গেছে এটাই অনেক। চিন্তা করো না বাড়ি যাও। আমার মেয়ে একটু সুস্থ হয়ে গেলেই তোমাদের বিচ্ছেদ টা করিয়ে দিবো। তখন তুমি তোমার সেই বান্ধবী কে বিয়ে করে নিও। যাও তাকে সেই সুসংবাদ টা দিয়ে আসো। দুজনে মিলে আনন্দ করো।”

শ্রাবণ কে কিছু বলতে না দিয়ে দ্রুত স্থান ত্যাগ করেন তিনি।


আজ তিন দিন হলো তরী হাসপাতালে। কোনো রকম মরার মতো করে পরে আছে। কারো সাথে কথা পর্যন্ত বলছে না। শুধু দেয়ালের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। চাঁদকে দেখলে কিছুটা স্বাভাবিক হবে ভেবে শ্রাবণকে পাঠিয়ে দিলেন চাঁদকে আনতে।

বাড়ি এসে চাঁদ কে রেডি করে নিলো। চাঁদের জামা নিতে গিয়ে আলমারি খুলে একটা ডাইরি পেলো।
সুন্দর করে মলাট করা। দেখেই মনে হচ্ছে বেশ পুরনো। কভার পেজে সুন্দর করে ” তরিত্রি তরী ” লেখা।
কিছু একটা ভেবে ডাইরি টা নিয়ে গেল সাথে করে।

মেয়েকে দেখে তরী হুহু করে কেঁদে উঠলো। বুকে জড়িয়ে ধরে বললো ” আমি পারলাম না তোর পুতুল ভাই বোন এনে দিতে।”

চাঁদ ও মায়ের বুকে লেপ্টে রয়েছে। শ্রাবণ অপরাধীর মতো কেবিন থেকে বের হয়ে গেলো।

#চলবে ইনশা আল্লাহ…!!