এক খণ্ড কালো মেঘ পর্ব-১১+১২

0
226

#এক_খণ্ড_কালো_মেঘ
#পর্ব_১১
#নিশাত_জাহান_নিশি

“আরে ভাই জিজ্ঞেসটা করছিস কী? শিওর না হয়েই আমরা নিশ্চয় এই ছেলেটাকে ধরিনি! তোর গার্লফ্রেন্ডকে ডিস্টার্ব করেছে সে। এবার এর পরিণাম তাকে বুঝিয়ে দে।”

মুখে হাত দিয়ে স্তব্ধ হয়ে বসে রইল আলিজা এবং অয়ন্তী। ঘোর যেন তাদের কিছুতেই কাটছে না। দিনের বেলাতেও ভূত দেখার মত অদ্ভুত পরিণতি তাদের। পরিস্থিতি সামলে ওঠে অয়ন্তী মাথা ঝাঁকালো। রসগোল্লার মত দৃষ্টি তার আলিজার নিশ্চল দৃষ্টিতে নিক্ষেপ করল। মনে মনে আওড়ালো,,

“লা’ফা’ঙার আরিফের সাথে সাথে কী ঐ মা’স্তা’ন রাফায়াতটারও মাথা টাথা খারাপ হয়ে গেছে? কোনোভাবে এই রাফায়াত আবার আরিফকে ফুসলাচ্ছে না তো?”

বেশিক্ষণ একই জায়গায় বসে থাকতে পারলনা আলিজা। কারণ ক্যান্টিনে এতক্ষণে ছেলে- মেয়েদের ভীড় জমে গেছে। কেউ বিষয়টাকে নিয়ে হাসাহাসি করছে তো কেউ নানান রকম গসিপ তৈরী করছে। কম্পিত শরীর নিয়ে আলিজা বসা থেকে ওঠে দাঁড়ালো। বিক্ষুব্ধ আরিফের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে বলল,,

“কী হইছে আরিফ? ক্যান্টিনে এসে এভাবে সিনক্রিয়েট করছ কেন? আর কত ক্ষতি করবা তুমি আমার হ্যাঁ? আর কত?”

আলিজার রাগে রাঙা মুখমণ্ডল দেখে রাফায়াত ইশারায় আরিফকে বলল ছেলেটিকে ছেড়ে দিতে! আলিজা যেহেতু এসব পছন্দ করছেনা তাই এই মুহূর্তে তার পছন্দকে প্রাধান্য দেওয়া উচিৎ। পরে না হয় সুযোগ বুঝে ছেলেটিকে সাইজ করা যাবে! রাফায়াতের ইশারা বুঝে মুহূর্তের মধ্যেই আরিফ ছেলেটির শার্টের কলার ছেড়ে দিলো। ভয়ে কাঁপতে থাকা ছেলেটির দিকে তেজী দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। দাঁতে দাঁত চেপে ছেলেটির কার বরাবর ফিসফিসিয়ে বলল,,

“তোকে আমি পরে দেখে নিব! এখান থেকে যা এখন।”

ছাড়া পেয়ে ছেলেটি জান নিয়ে দৌঁড়ে পালালো ক্যান্টিন থেকে। প্রতিবাদ করার একরত্তি সাহসও দেখালো না। মূলত ছেলেটি এখানে হোস্টেলে থেকে লেখাপড়া করে। তাই তার দাপটও আরিফের তুলনায় কম। আশেপাশে চোখ তুলে তাকালো রাফায়াত। তার গরম চোখের অগ্নিঝরা চাহনি দেখে ক্যান্টিনের সম্পূর্ণ ফাঁকা হয়ে গেল! একটা অচেনা অজানা ছেলেকে এত ভয় পাওয়ার কী হলো? জায়গা থেকে ওঠে এলো অয়ন্তী। দু’কদম বাড়িয়ে এসে রাফায়াতের মুখোমুখি দাঁড়ালো। আঙুল উঁচিয়ে প্রশ্ন তুলল,,

“আপনি আমাদের ভার্সিটিতে কী করছেন হ্যাঁ? এখানেও চলে এসেছেন গু’ন্ডা’মি করতে। নিজে তো এক মহাগু’ন্ডা সাথে আরেক চ্যালা নিয়ে এসেছেন?”

চ্যালা শব্দটা শুনতে আরিফের মাথাটা ফট করে গরম হয়ে গেল। মাথা চুলকে সে অয়ন্তীকে কিছু না বলে বেশ ভাবশূণ্য হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা রাফায়াতকে উগ্র গলায় বলল,,

“ভাই? ভাবিকে কিছু বলুন প্লিজ! আমাকে আপনার চ্যালা বলছে!”

আরিফের বোকামো দেখে অবিলম্বেই রাফায়াতের মাথায় হাত চলে গেল। ভয়ঙ্কর রাগী দৃষ্টিতে সে আরিফের দিকে তাকালো। ভয়ে আরিফ চুপসে গেল। মুখে হাত রেখে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। অয়ন্তী পূর্বের তুলনায় আরও অধিক ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। আরিফের দিকে তেড়ে এসে বলল,,

“এই কী বললা তুমি হ্যাঁ? কী বললা? ভাবি মানে? আমি তোমার কোনো ভাইয়ের ভাবি লাগি?”

আরিফকে সামনে থেকে সরিয়ে রাফায়াত ক্ষিপ্র অয়ন্তীর মুখোমুখি দাঁড়ালো। মুখ থেকে মাক্সটা সরিয়ে গরম শ্বাস ছাড়ল। রাফায়াতের সম্পূর্ণ মুখটা অয়ন্তীর দৃষ্টির সীমানায় স্পষ্ট হতেই অয়ন্তী সমস্ত রাগ ভুলে শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল! মাক্স পড়ে থাকার দরুন রাফায়াতের শুভ্র মুখের আদলটি লাল রঙ ধারণ করেছে। দেখতে অদ্ভুত লক সুন্দর দেখাচ্ছে। মুখের মাক্সটি রাফায়াত মুখে পড়ে নিলো। ট্যাড়া চাহনিতে অয়ন্তীর দিকে তাকালো। হেয়ালি স্বরে বলল,,

“আরে বুঝলা না? আরিফ কোন ভাইয়ের কথা বলেছে? অভেয়সলি অনিকের কথা বলেছে! তাইনা আরিফ?”

আরিফের দিকে আগ্রাসিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রাফায়াত দাঁতে দাঁত চেপে তাকে সায় জানাতে বলল। সামনের চুলগুলো টেনে ধরে আরিফ অপরাধী দৃষ্টিতে অয়ন্তীর দিকে তাকালো। শুকনো ঢোঁক গিলে বলল,,

“হ্যাঁ ভাবি। আমি অনিক ভাইয়ার কথা বলছিলাম।”

যদিও আরিফের মুখের কথা বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল অয়ন্তীর তবে এই মুহূর্তে আরিফের মুখের কথা বিশ্বাস করতে বাধ্য হলো সে। অয়ন্তীর আশ্বস্ত ভাব দেখে রাফায়াত শার্টের কলারটা জাঁকালো। আরিফের কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল,,

“যা ক্যালো করার করেছিস। এখন আলিজাকে নিয়ে ফুট এখান থেকে।”

রাফায়াতের মুখের কথা শেষ হতে না হতেই আরিফ আলিজার হাত ধরে হেঁচকা টান দিলো! বাকরুদ্ধ আলিজাকে নিয়ে দ্রুত পায়ে হেঁটে জায়গা পরিত্যাগ করল। আলিজা পিছু ঘুরে অয়ন্তীর দিকে তাকালো। শুকনো গলায় বলল,,

“এসব কী হচ্ছে কী অয়ন্তী। প্লিজ আরিফকে থামতে বল।”

হন্ন হয়ে অয়ন্তী আলিজার পিছু নিতেই রাফায়াত পেছন থেকে অয়ন্তীর ডান হাতটি টেনে ধরল। বাঁকা চাহনিতে অয়ন্তীর দিকে তাকালো। রসিক গলায় বলল,,

“হেই সুইটি! কাবাব মে হাড্ডি হতে যাচ্ছে নাকি?”

রাগে ফোঁস করে পিছু ফিরে তাকালো অয়ন্তী। এক ঝটকায় রাফায়াতের হাতটি তার হাত থেকে ছাড়িয়ে নিলো। চোয়াল উঁচিয়ে বলল,,

“ইউ জাস্ট শাট আপ। একটা মা’স্তা’ন ছেলের সাথে আমি আমার বেস্টফ্রেন্ডকে একা ছাড়তে পারিনা।”

আলিজার পিছু নিলো অয়ন্তী। রাফায়াতও অয়ন্তীর পিছু পিছু ছুটল। পেছন থেকে চ্যাচিয়ে বলল,,

“আরেহ্ অয়ন্তী দাঁড়াও। আরিফ সত্যিই এখন ভালো হয়ে গেছে। তাছাড়া আলিজা আমার বোন। ভাই হয়ে আমি নিশ্চয়ই আলিজাকে কোনো ক্ষতির দিতে ঠেলে দিতে পারিনা।”

রাফায়াতের কোনো কথাই কানে তুললনা অয়ন্তী। ছুটে চলল ভার্সিটির পেছনের দিকের ফাঁকা এরিয়াটিতে। বাউন্ডারির পেছনের দিকটায় দৌঁড়ে যেতেই অয়ন্তী মুখে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল! লজ্জায় মাথা নিচু হয়ে এলো তার। আলিজা স্ব-ইচ্ছায় আরিফকে জড়িয়ে ধরে সবেমাত্রই কাঁদতে কাঁদতে আরিফের বুকে মাথা রাখল। তাদের এই অন্তরঙ্গ মুহূর্তে অয়ন্তী তার উপস্থিতিতে বড্ড লজ্জা পেয়ে গেল। ঝট করে পেছনের দিকে মোড় নিতেই সে রাফায়াতের বলিষ্ঠ বুকে লেপ্টে গেল! ব্যগ্র হাসল রাফায়াত। দুষ্টু চাহনিতে অয়ন্তীর দিকে তাকালো। নাক টেনে বলল,,

“কী মিস সুইটি? করলেন তো তাদের প্রাইভেট টাইমে ডিস্টার্ব?”

বেশ জোর খাঁটিয়ে অয়ন্তী রাফায়াতের বুকের পাঁজর থেকে নিজেকে ছাড়াতে নিলেই ঘটনার আকস্মিকতায় রাফায়াতের হাত থেকে তার সেলফোনটি পড়ে গেল। হকচকিয়ে উঠল অয়ন্তী। জিভ কেটে উবু হয়ে বসে পড়ল নিচে। রাফায়াতের সেল ফোনটি হাতে তুলতেই ফোনের স্ক্রীণ জ্বলে উঠল। তৎক্ষনাৎ মেসেজের একটি নোটিফিকেশন তার চোখে পড়ল। মেসেজটিতে লিখাঃ

“এই কী খবর তোর? অয়ন্তীকে ভাগে আনতে পারলি? আর অনিক? অনিক তো তোকে হায়েনাদের মত খুঁজছে!”

মেসেজটি এক নজর দেখামাত্রই অয়ন্তীর চক্ষু জোড়া বিস্ফোরিত হয়ে উঠল। ফোনটি হাতে নিয়ে সে চোখ উঠিয়ে পকেটে হাত গুজে দাঁড়িয়ে থাকা রাফায়াতের দিকে তাকালো। রাফায়াত এখনও কিছু টের পায়নি! তাই তার ঠোঁটে এখনও লেগে আছে ব্যগ্র হাসির রেখা। টালমাটাল শরীর নিয়ে ফোনটি হাতে নিয়ে অয়ন্তী বসা থেকে ওঠে দাঁড়ালো। চোখের কোণে তার জল চিকচিক করে উঠল। ফোনটি রাফায়াতের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,,

“আপনি আমার ক্ষতি করতে এসেছেন তাইনা?”

ক্ষণিকের মধ্যেই কপাল কুঁচকে নিলো রাফায়াত। মুখশ্রীতে তাজ্জব ভাব ফুটে উঠল। তাড়াহুড়ো করে অয়ন্তীর হাত থেকে ফোনটি কেড়ে নিলো। ফোনের স্ক্রীনে চোখ বুলিয়ে দেখল চঞ্চলের নাম্বার থেকে এসএমএস এসেছে! বুঝতে বেশি বেগ পেতে হলোনা অয়ন্তী সেই মেসেজ পড়ে নিয়েছে! আতঙ্কে বুকটা কেঁপে উঠল রাফায়াতের। শুষ্ক গলায় অয়ন্তীকে কিছু বলার পূর্বেই অয়ন্তী কাঁদতে কাঁদতে জায়গা পরিত্যাগ করল। ক্ষোভে চেঁচিয়ে বলল,,

“আমি প্রথম থেকেই বুঝতে পেরেছিলাম আপনি আমার ক্ষতি করতে এসেছেন। আমি এক্ষণি অনিককে সব বলব। অনিক জানত আপনি আমার ক্ষতি করবেন। তাই সে আপনাকে খুঁজছে। আমি এক্ষণি অনিককে সব ইনফর্ম করছি!”

মাথায় হাত চলে গেল রাফায়াতের। পুনরায় অয়ন্তীর পেছনে ছুটল সে। পেছন থেকে অয়ন্তীকে ডেকে বলল,,

“অয়ন্তী প্লিজ থামো। আমার কথা শোনো। পুরোপুরি ঘটনাটা না জেনে তুমি আমাকে ভুল বুঝতে পারো না।”

#চলবে…?

#এক_খণ্ড_কালো_মেঘ
#পর্ব_১২
#নিশাত_জাহান_নিশি

“অয়ন্তী প্লিজ থামো। আমার কথা শোনো। পুরোপুরি ঘটনাটা না জেনে তুমি আমাকে এভাবে ভুল বুঝতে পারো না।”

দৌঁড়ানোর গতি আরও দ্বিগুন বাড়িয়ে দিলো অয়ন্তী। রাফায়াতকে তার প্রথম থেকেই সন্দেহ। সেই সন্দেহ এখন যেন অগাধ বিশ্বাসে পরিণত হলো! নিজের চোখকে সে অবিশ্বাস করবে কীভাবে? তাই বিশ্বাস করতে বেশী বেগ পেতে হলো না যে, রাফায়াত সত্যি সত্যি তার ক্ষতি করতে এসেছে! এই মুহূর্তে সে অনিককে তার পাশে চাইছে, তাকে ভরসা করছে, তাকে বিশ্বাস করতে চাইছে। কোনোভাবে এই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি বের হতে পারলেই সে প্রথমে অনিকের সাথে যোগাযোগ করবে। মূল ঘটনা অনিককে সব খুলে বলবে। সেই ভাবনা মাথায় রেখেই ভার্সিটির মেইন গেট পাড় হয়ে অয়ন্তী রাস্তায় উঠল। অমনি পেছন থেকে রাফায়াত তার হাতটা খপ করে টেনে ধরল। অয়ন্তীকে তার সম্মুখে দাঁড় করিয়ে পর পর কয়েক দফা রুদ্ধশ্বাস ছাড়ল। মৃদু আওয়াজে বলল,,

“বলেছিলাম না আমার সম্পূর্ণ কথাটা শুনতে? কথার আগেই এত দৌঁড়াও কেন? পিচ্চি বাচ্চা তুমি হ্যাঁ? ছোটো আছো এখনো?”

রাফায়াতের দিকে আঙুল তাক করল অয়ন্তী। তুখোড় রাগে ক্ষিপ্ত হয়ে বলল,,

“কারণ আপনি ডেঞ্জারাস। টু মাচ ডেঞ্জারাস। প্রথম দেখাতেই আপনি আমার গলা চেপে ধরেছিলেন। আর এখন তো আমি সব জেনে গেছি। আই ডোন্ট নো এখন আপনি আমার সাথে ঠিক কী কী করবেন!”

আগপাছ না ভেবে পিছু ঘুরে অয়ন্তী পুনরায় দৌঁড় দিলো। কখন সে রাস্তার মাঝখানে চলে এলো আঁচ করতে পারলনা! ঢাকা শহরের রাস্তাঘাট। বিশাল জ্যামে ভরপুর। জ্যাম কিছুটা ছাড়তেই গাড়ি ঘোড়া সব ঝড়ের বেগে ছুটতে লাগল। তক্ষুণি অয়ন্তী দৌঁড়ে এসে একটি পিক-আপের সামনে পড়ল! ভাগ্যিস পিক-আপটি সঙ্গে সঙ্গেই ব্রেক ধরতে পেরেছিল! চক্ষুজোড়া দুর্নিবার ভয় নিয়ে থ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল অয়ন্তী৷ পিক-আপ ড্রাইভার গাড়ির মধ্যে থেকেই অয়ন্তীকে হুমকি-ধমকি দিচ্ছিল! বেশ বকাঝকা করছিল। ইতোমধ্যেই তীব্র আতঙ্ক নিয়ে দৌঁড়ে এলো রাফায়াত। অয়ন্তীকে টেনে রাস্তার ধারে নিয়ে এলো। তৎক্ষণাৎ অয়ন্তীর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সে ক্ষোভে চোয়াল শক্ত করল। মাথায় প্রচণ্ড জেদ চেপে বসতেই সে ঠাস করে অয়ন্তীর গালে এক চড় বসিয়ে দিলো! একে তো অয়ন্তী ভয়ে জীর্ণশীর্ণ। মৃত্যুর মুখ থেকে সবেমাত্র ফিরে এসেছে সে। দ্বিতীয়ত রাফায়াতকে নিয়ে কৌতূহল, আতঙ্ক। গাঁ থেকে দড়দড়িয়ে ঘাম ঝড়ছিল তার। তৃতীয়ত, রাফায়াতের শক্ত হাতের চড়। সব মিলিয়ে অয়ন্তীর মাথা ঘুরে এলো। ধীরভাবে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিলনা সে। শরীরের সমস্ত শক্তি ছেড়ে অয়ন্তী যেইনা মাটিতে লুটিয়ে পড়বে অমনি রাফায়াত অয়ন্তীকে তার বাহুডোরে আঁকড়ে ধরল। অয়ন্তীর জ্ঞানশূণ্য মুখমণ্ডলে তাকালো। দু’চোখে ঝাপসা জল নিয়ে ভরাট গলায় বলল,,

“সরি অয়ন্তী। এছাড়া আমার হাতে আর কোনো অপশন ছিলনা! খেলা শুরু করার আগে খেলাটা মাঝপথে এসে এভাবে শেষ হয়ে যাক আমি চাইনা। অনিকের মুখোশ খোলা এখনো বাকি আছে।”

,
,

গভীর রাত। আনুমানিক দুইটা কী তিনটা বাজবে তখন ঘড়িতে। ঠাণ্ডায় অয়ন্তীর গাঁ শিরশিরিয়ে উঠল। গাঁয়ের সমস্ত লোম পর পর দাঁড়িয়ে গেল। সহ্য করা যাচ্ছেনা এমন তীব্র শীতের প্রকোপ। চোখ বুজে অয়ন্তী ঘুমের ঘোরেই তার আশেপাশে কম্বল খুঁজছে। তার আইডিয়া অনুযায়ী কম্বলটা তার বালিশের পাশেই থাকবে। কারণ রাতে তার হুট করেই ঠাণ্ডা লেগে যায়। আর তখনি সে বিনা পরিশ্রমে হাতড়ে তার বালিশের পাশ থেকে কম্বলটা হাতিয়ে নেয়৷ আজও ঠিক তাই করল৷ কিন্তু কম্বলটা সে হাতড়েও খুঁজে পেলনা। মিনিট পাঁচেক সে অন্ধকারে হাতড়ালো। পরক্ষণে বিরক্ত হয়ে সে ঝট করে ঘুম জড়ানো চোখ জোড়া মেলল। অমনি তার চিরশত্রু অন্ধকারকে সে তার চোখের সামনে উপলব্ধি করতে পারল৷ রাতে ঘুমানোর সময় সে সচরাচর রুমের ড্রিমলাইট অন করে রাখে। তবে আজ সম্পূর্ণ রুমটা অন্ধকারাচ্ছন্ন! ভয়ে আঁতকে উঠল অয়ন্তী। ক্রমাগত রুদ্ধশ্বাস ফেলতে লাগল সে। চোখ দুটো অবিলম্বেই তার ভয়ার্ত রূপ ধারণ করল। ঠাণ্ডার প্রকোপ হ্রাস পেয়ে তার শরীরে গরম ভাবের উদয় হলো। গাঁয়ের লোমগুলো তার আতঙ্কে পুনরায় দাঁড়িয়ে গেল। মুখে হাত চেপে ধরে সে চিৎকার করে বলল,,

“আম্মুওওও। আমার রুমের লাইট অফ কেন?”

আচম্বিতেই অয়ন্তীর চোখের সামনে ফোনের ফ্ল্যাশ লাইট জ্বলে উঠল। ভয়াল চাহনিতে অয়ন্তী ফ্ল্যাশ লাইটের ঐ প্রান্তে তাকাতেই উন্মুক্ত শরীরে বসে থাকা রাফায়াতের শান্ত, স্নিগ্ধ মুখটি আবিষ্কার করল! আতঙ্ক যেন দ্বিগুন বেড়ে গেল অয়ন্তীর৷ জায়গা থেকে সরে এসে সে খাটের কার্ণিশের সাথে চিপকে বসল। শুকনো ঢোঁক গিলে বলল,,

“আআআপনি? আআআপনি আআআমার রুমে কী করছেন?”

ভাবশূণ্য ভঙ্গিতে রাফায়াত অয়ন্তীর দিকে তাকালো। ফোনটা কিঞ্চিৎ ঘেঁটে দেখল। তেমন কিছুই ঘটেনি ঠিক এমন একটা ভাব নিলো। নিতান্তই স্বাভাবিক স্বরে বলল,,

“আমরা এখন তোমার রুমে না। অন্য কোথাও আছি। কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ ঘুমিয়ে পড়ো। এই অন্ধকার ঘর থেকে তোমার মুক্তি নেই!”

ঘাবড়ে উঠল অয়ন্তী। ফ্ল্যাশ লাইটের মিটিমিটি আলোতে সে পুরো রুমটিতে একবার করে চোখ বুলালো। সম্পূর্ণ স্যাতস্যাঁতে একটি রুম। নেই কোনো আসবাবপত্র, নেই কোনো ফার্ণিচার, নেই কোনো পাখার ব্যবস্থা, নেই কোনো আলোর ব্যবস্থা। দেখেই বুঝা যাচ্ছে ইলেকট্রিসিটির কোনো ব্যবস্থা নেই এই রুমটিতে। তবে বিশাল বড়ো এই রুমটি৷ রুমটির পাশে আবার ছোটো করে দেখতে একটি ওয়াশরুমও আছে। দেখলেই কেমন গাঁ গুলিয়ে আসছে! ব্যবহারযোগ্য নয় এই ওয়াশ রুমটি। তবে রুমটি যেমনই হোক না কেন দরোজা-জানালা সব শক্তপোক্ত-ই আছে! এক ঝলকে পুরো রুমটি দেখে অয়ন্তী শান্ত রাফায়াতের দিকে তাকালো। দাঁতে দাঁত চেপে বিক্ষুব্ধ গলায় বলল,,

“এই? আপনি আমাকে কি’ড’ন্যা’প করেছেন?”

অবিলম্বেই রাফায়াতের শান্ত মুখশ্রীতে বাঁকা হাসির রেখা ফুটে উঠল! ভ্রু উঁচিয়ে সে অয়ন্তীর দিকে এক পলক তাকালো৷ অয়ন্তীর দিকে কিঞ্চিৎ ঝুঁকে গেল সে। ফিচেল স্বরে বলল,,

“অতি চালাকের গলায় দড়ি বুঝলা? বেশি চালাকি করতে চেয়েছিলে না? দেখলে তো এর ফল? শেষমেশ কি’ড’ন্যা’প হতে হলো তো আমার হাতে? ভালো লাগছে তো এখন? অনুভূতিটা একটু শেয়ার করো!”

প্রচণ্ড ক্ষীপ্ত হয়ে উঠল অয়ন্তী। চোখে যেন তার আগুনের ফুলকি। দাঁত কিড়মিড়িয়ে সে রাফায়াতের মুখোমুখি এসে বসল। অবিশ্বাস্য ভাবেই রাফায়াতের গলার টুটি চেপে ধরল সে! বিস্ফোরিত গলায় বলল,,

“কু**র বাচ্চা! তুই কোন সাহসে আমাকে কি’ড’ন্যা’প করেছিস বল? তুই তো আমাকে বাড়ি অবধি পৌঁছে দিয়েছিলি। আমার সেন্সও ফিরেছিল। আম্মুর সাথে কথাও বলেছিলাম আমি। কিন্তু অনিকের সাথে কথা বলার আগেই কিছু একটা হয়ে গিয়েছিল আমার। এরপর থেকে আর কিছু মনে নেই। বল কী করেছিস তুই আমার সাথে বল?”

হু হা শব্দে হেসে উঠল রাফায়াত! ক্ষিপ্র অয়ন্তীর দিকে ব্যগ্র দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,,

“কীভাবে গলা চেপে ধরতে হয় তা ও তো শিখলা না এখনো! মনে হচ্ছে যেন তুমি আমাকে আদর করান জন্য গলায় শুড়শুড়ি দিচ্ছ! সিরিয়াসলি আমার খুব ফিলিংস হচ্ছে অয়ন্তী! ভুলভাল কিছু করতে উস্কে দিওনা আমায়!”

“এই তুই এত লু’চ্চা কেন হ্যাঁ? এত লু’চ্চা কেন? তুই সত্যি সত্যিই আমার কোনো ক্ষতি করে দেসনি তো?”

কথাগুলো অনর্গল বলেই রাফায়াতের গলাটা এবার ছেড়ে দিলো অয়ন্তী। নিজের সমস্ত শরীরে এবার সে হাত বুলাতে লাগল। রাফায়াত তার কোনো ক্ষতি করল কীনা তা বুঝার চেষ্টা করল! অয়ন্তীর হযবরল অবস্থা দেখে রাফায়াত মনে মনে হেসে কুটিকুটি। নির্বোধ অয়ন্তীকে আরও ক্ষেপিয়ে দেওয়ার ভূত চেপে বসল তার মাথায়! ঠোঁটের কোণে রসাত্নক হাসি ফুটিয়ে তুলল সে। নির্লজ্জ গলায় বলল,,

“উফফফস! কী হ’ট তুমি! মানে আমার তো তখন মাথা-ই ঠিক ছিলনা। বেসামাল হয়ে পড়েছিলাম আমি। শুধু যে আমিই বেসামাল ছিলাম তা কিন্তু নয়, সাথে তুমিও! মানে আমাকে খালি গাঁয়ে দেখে তখন তো তোমার মাথা-ই ঠিক ছিলনা!”

ফ্যাসফ্যাস করে কেঁদে দিলো অয়ন্তী। কাঁদতে কাঁদতে হাঁটুতে মুখ লুকিয়ে বসল। কান্নায় জর্জরিত হয়ে সে আর্ত গলায় বলল,,

“আমি আপনাকে কখনো ক্ষমা করব না রাফায়াত। কখনো না। আপনি হলেন মানুষরূপী জা’নো’য়া’র! আপনাকে চিনতে আর বাকী নেই আমার।”

,
,

বিকেল থেকেই পুলিশ স্টেশানে দৌঁড়োদৌঁড়ি করছেন অয়ন্তীর বাবা এবং মা। জানে পানি নেই তাদের। বড়ো মেয়েকে হারানোর পর এখন ছোটো মেয়েকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে আছেন তারা! অয়ন্তীই তাদের একমাত্র বেঁচে থাকার সম্বল। সেই শেষ সম্বলটাকেও এখন তারা নিজেদের বাড়ি থেকে খুঁজে পাচ্ছেনা! আশ্চর্য কাহিনী যতসব। বাড়ি থেকে অসুস্থ অয়ন্তীকে কে কোথায় নিয়ে যাবে? তাছাড়া অয়ন্তী নিশ্চয়ই একা অসুস্থ শরীর নিয়ে বাড়ি থেকে বের হবেনা? আর বের হলেও অন্তত তার মাকে জানিয়ে যাবে। তাহলে অয়ন্তীকে কে বাসা থেকে তুলে নিয়ে যাবে? কার এত বড়ো সাহস হতে পারে?

আলিজা যদিও প্রথমে রাফায়াতকে সন্দেহ করেছিল তবে অয়ন্তীর নিঁখোজের সময় রাফায়াত বাড়িতে-ই ছিল! একসাথে তারা বিকেলের নাশতা করেছিল। সেই জায়গায় রাফায়াতকে সন্দেহ করার মত কোনো কারণ-ই থাকতে পারেনা!

অয়ন্তীর নিঁখোজের খবরটা পেয়ে-ই অনিক তার সমস্ত কাজকর্ম ছেড়ে ঢাকায় ছুটে এসেছে। সেও নিজের মত করে অয়ন্তীকে পাগলের মত খুঁজে বেড়াচ্ছে। আলিজাকে নানানভাবে জেরা করছে। ভার্সিটিতে অয়ন্তীকে কেউ বিরক্ত করত কীনা বা অয়ন্তী কারো সাথে কোনো সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিল কীনা সব খবরাখবর সে এই মাঝরাতে আলিজার থেকে নিচ্ছে। ঘুম টুম যেন তার হারাম হয়ে গেছে!

#চলবে…?