এক খণ্ড কালো মেঘ পর্ব-১৫+১৬

0
230

#এক_খণ্ড_কালো_মেঘ
#পর্ব_১৫
#নিশাত_জাহান_নিশি

“বলেছিলাম না সিনক্রিয়েট না করতে? আই সোয়ার, যদি আশেপাশের মানুষজন খারাপ কিছু আঁচ করতে পারেনা? তবে কিন্তু তোমার পরিবারের ক্ষতি করতে আমার বেশী সময় লাগবেনা!”

আতঙ্কে চোখে-মুখে প্রখর উদ্বিগ্নতা কাজ করতে লাগল অয়ন্তীর। ভয়ার্ত আঁখিযুগল সে রাফায়াতের শিকারী দৃষ্টিতে ফেলল। আচমকাই পুরো শরীরময় যেন কাঁটা দিয়ে উঠল তার। বড়ো বোনকে হারিয়েছে খুব বেশিদিন হয়নি! তার শোক কাটিয়ে উঠতে এখনও তারা পুরোপুরি স্টেবল নয়। এই দুঃসময়ে আবার তার গোটা পরিবারের উপর রাফায়াতের শকুনের নজর! তা ভাবতেই যেন অয়ন্তীর ভেতরে তুমুল ব্যাকুলতার সৃষ্টি হলো। কেমন যেন পালপিটিশান শুরু হতে লাগল। যেকোনো ক্রমেই হোক তার পরিবারকে সুরক্ষিত রাখার তাড়না চেপে বসল তার মাথায়। রাফায়াত তার গরম দৃষ্টিতে ইশারায় অয়ন্তীকে বুঝালো স্বাভাবিক হতে। কারণ সি.এন.জি ড্রাইভার অনেকক্ষণ যাবত তাদের লক্ষ্য করছে। তাদের সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখছে। ইশারা বুঝে অয়ন্তী এবার রাফায়াতের থেকে বিস্ফোরক দৃষ্টি সরালো। মিরর গ্লাসের দিকে তার উচ্ছ্বাসী দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। অমনি দেখতে পেল সি.এন.জি ড্রাইভার সি.এন.জি যদিও চালিয়ে যাচ্ছে ঠিকই তবে তার আঁড়চোখা দৃষ্টি পেছনের সিটে নিবদ্ধ! ব্যাপারটা বুঝতে পারা মাত্রই অয়ন্তী তার নির্জীব ঠোঁটে মিষ্টি হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলল। কিছু বুঝে ওঠার পূর্বেই সে রাফায়াতের বুকে মাথা এলিয়ে দিলো! দু’পাশ থেকে রাফায়াতকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে সন্তপর্ণে চক্ষুজোড়া বুজে নিলো! পরম আবেশে মধুর স্বরে বলল,,

“উফফফ জান! তুমি যে কী করো না। কী দরকার ছিল বলো? এই ভরদুপুরে আমাকে টেনে-হেছড়ে বাড়ি থেকে বাইরে নিয়ে আসার? তুমি তো তোমার অফিসের কাজে-ই ঢাকার বাহিরে যাচ্ছ তাইনা? সাথে আবার আমাকে নিয়ে যাওয়ার কী দরকার বলো? কেমন বউ পাগল ছেলে তুমি বলো তো? বউকে ছাড়া একটা মুহূর্তও চলেনা তোমার! দেখলা তো আমার জ্বর। কেমন যেন শীত শীতও করছে। এরপরেও তোমার হুডি পড়িয়ে আমাকে তোমার সাথে প্যাকিং করে নিয়ে যেতে-ই হবে?”

রাফায়াত যেন তাজ্জব বনে গেল। চোখদুটো তার কোটর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম হলো! অয়ন্তী তার বুকের সাথে এতটাই সূক্ষ্মভাবে লেপ্টে আছে যে তার কেমন যেন উত্তেজনাময় অনুভূতি হতে লাগল! আবার কিছুটা বিরক্তিকর অনুভূতিও হতে লাগল। তিক্ততায় চোখ-মুখ খিঁচে নিলো রাফায়াত। অয়ন্তীকে তার শরীর থেকে উঠানোর চেষ্টা করল। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,,

“এই ওঠো বলছি। এ আবার কী নতুন নাটক শুরু করেছ তুমি?”

কে শুনে কার কথা? অয়ন্তী তার অবস্থানেই অটল রইল! যত যাই কিছু হয়ে যাক সে তার অবস্থান থেকে একচুলও হটবেনা। বেশ স্বাভাবিক গলাতে অয়ন্তী বিড়বিড় করে বলল,,

“চুপচাপ বসে থাকুন। ড্রাইভারের সন্দেহ কাটানোর জন্য-ই এই সস্তা নাটকটা করতে হচ্ছে! এমনিতেও আমার শখ নেই আপনার মত মা’স্তা’ন টাইপ ছেলের বুকে নিজেকে সমপর্ণ করার! ওয়াক! কেমন যেন গাঁ গোলাচ্ছে আমার!”

প্রথম কথাগুলো রাফায়াতের বেশ পছন্দের হলেও শেষের কথাগুলো রাফায়াতের বড্ড অপমানের ঠেকল! তবুও ভেতরের ক্ষোভ সে ভেতরেই মজিয়ে রাখল। সঠিক সময়ে সেই ক্ষোভ ঝাড়বে বলে পণ করে নিলো। কিছু কাজ সয়ে রয়ে করতে হয়। কিছু না ভেবেই হুটহাট করে বসলে এর জন্য পরে পস্তাতে হয়। মিরর গ্লাসের দিকে রাফায়াত এবার তার রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। ড্রাইভার তার সন্দেহের দৃষ্টি সরিয়ে এবার অশালীন দৃষ্টিতে রাফায়াতের বুকে লেপ্টে থাকা অয়ন্তীকে ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগল! মুহূর্তের মধ্যেই যেন মেজাজটা চড়ে বসল রাফায়াতের। দাঁতে দাঁত চাপল সে। ড্রাইভারকে উদ্দেশ্য করে ঝাঁজালো গলায় বলল,,

“এই মিয়া গাড়ি থামান! গাড়ি থামান বলছি। আপনার সমস্যা কী বলুন? গাড়িতে ওঠার পর থেকে-ই লক্ষ্য করছি আপনার কটু নজর প্যাসেঞ্জারদের দিকে। পেছনে কী হ্যাঁ? সব প্যাসেঞ্জারদের সাথে-ই কী এমন করেন? ঘুরে ঘুরে দেখেন তাদের?”

থতমত খেয়ে গেল ড্রাইভার। মুহূর্তের মধ্যেই মিরর গ্লাস থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। ড্রাইভিংয়ে মনোযোগ দিয়ে ক্ষীণ গলায় বলল,,

“সরি ভাই। ভুল হয়ে গেছে। আর হবেনা।”

“আপনার এই ভুলের জন্যই রাস্তাঘাটে যখন তখন যেকোনো এক্সিডেন্ট হয়ে যেতে পারে। ড্রাইভিংয়ে মনোযোগ দিন। পিছনের দিকে না তাকিয়ে বরং সামনের দিকে তাকিয়ে ড্রাইভিংটা করুন। আর একবার যদি পেছনে ঘুরে তাকিয়েছেন না? তবে কিন্তু এবার আপনি রাম ধোলাই খাবেন আমার হাতে!”

“না ভাই না। আর ভুল হবেনা!”

ড্রাইভার এবার যথেষ্ট সতর্ক হয়ে গেল। রাফায়াতের কথামতো ড্রাইভিংয়ে মনোযোগ দিলো। এদিকে রাফায়াতের হুমকি-ধমকি দেখে অয়ন্তীও কেমন যেন চুপসে গেল! ভেজা বিড়ালের মত সে নিশ্চুপ হয়ে গেল। রাফায়াতের বুক থেকে ওঠে এসে কিঞ্চিৎ দূরে গিয়ে গুটিশুটি হয়ে বসে রইল! তার উপর ইচঁড়ে পড়া ক্ষোভ যে রাফায়াত ড্রাইভারের উপর ঝেড়েছে বুঝতে বেশী বেগ পেতে হলোনা অয়ন্তীর! ভয়ে তার গলাটাও কেমন যেন শুকিয়ে উঠল। অমনি রাগে গটগট করে অয়ন্তীর কানের কাছে মুখ ঠেকালো রাফায়াত। গিজগিজিয়ে বলল,,

“কথায় কথায় আমাকে মা’স্তা’ন বলা না? ওকে ফাইন! ঠিক সময়ে আমিও বুঝিয়ে দিব আমাকে মা’স্তা’ন বলার ফল কতটা ভ’য়ঙ্কর। পরিস্থিতির কারণে সব হজম করে যাচ্ছি।”

অস্থির দৃষ্টিতে অয়ন্তী চোখ তুলে তাকালো রাফায়াতের দিকে। শীঘ্রই অয়ন্তীর পাশ থেকে সরে এলো রকফায়াত। শার্টের প্রথম দুটো বোতাম খুলে সে ভেতর থেকে তপ্ত শ্বাস ছাড়ল। মাক্সটা কিছুক্ষণের জন্য মুখ থেকে খুলে ভেতরে ঠাণ্ডা শ্বাস সঞ্চয় করল। মিনিট কয়েক বাদে পুনরায় মাক্সটি পড়ে মাথায় হাত রেখে সে সি.এন.জির পেছনের গদিতে পিঠ ঠেকিয়ে দিলো। দুঃশ্চিন্তায় তার মাথা ফেটে যাচ্ছিল। ঢাকা পাড় হয়ে বিকেলের মধ্যে-ই চট্টগ্রাম পৌঁছানোটা তার জন্য রীতিমত চ্যালেঞ্জিং হয়ে দাঁড়াচ্ছে! তার প্রধান এবং অন্যতম কারণ হলো অনিক! আরিফের সাথেও যোগাযোগ করা সম্ভব হচ্ছেনা। অনিক যদি এখনও আরিফের সাথে-ই থেকে থাকে তাহলে তো আরিফের সাথে এই মুহূর্তে কানেক্ট হওয়াটা খুবই অসম্ভব। কোনোভাবে-ই আরিফকে কল করা যাবেনা। ভোরের দিকে পাঠানো ম্যাসেজের এখনও কোনো রিপ্লাই আসেনি। আচ্ছা আরিফ ভালো আছে তো?

আধঘণ্টার মধ্যেই সি.এন.জি এসে বাসস্টপ থামল। অয়ন্তীকে নিয়ে রাফায়াত সি.এন.জি থেকে নেমে পড়ল। ড্রাইভারের ভাড়া পরিশোধ করে রাফায়াত টিকিট কাউন্টারে ঢুকার পূর্বেই অয়ন্তী ন্যাকা কান্না জুড়ে দিলো! জেদ ধরে বলল,,

“আমি এই হুডিটা আর পড়ে থাকতে পারবনা! খুব অস্বস্তি ফিল হচ্ছে। ছেলেদের হুডি আবার মেয়েরা পড়তে পারে নাকি?”

অয়ন্তীর হাতটা শক্তভাবে চেপে ধরল রাফায়াত। অয়ন্তীকে টিকেট কাউন্টারের দিকে জোর করে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে গেল। বেশ শাসিয়ে বলল,,

“নাটক করো না। এখন আমাদের হাতে একদম সময় নেই। কোনোভাবে ম্যানেজ করে নাও। ঢাকা পাড় হতে পারলেই আমরা কোনো একটা শপিং কমপ্লেক্সে ঢুকব। তখন তুমি তোমার ইচ্ছে মত যেকোনো একটা ড্রেস কিনে নিও!”

তবুও অয়ন্তী ঘ্যান ঘ্যান করে কাঁদতে লাগল। সত্যিই তার এই পোশাকে চরম অস্বস্তি হচ্ছে। একে তো আবহাওয়া গরম। দ্বিতীয়ত, হুডিটা কেমন যেন খসখসে। কাপড়টা ঠিক মসৃণ নয়। কিছুক্ষণ পর পর তার শরীরের এদিক-ওদিক চুলকাতে হচ্ছে। অয়ন্তীর অসুবিধা হচ্ছে বিষয়টা টের পেয়েও রাফায়াত চুপ হয়ে রইল। কারণ, এখন অয়ন্তীর সুবিধার কথা ভাবতে গেলে-ই তাদের দুজনের লাইফ রিস্ক হয়ে যেতে পারে। ক্ষণিকের সুখের চেয়ে ভবিষ্যৎটাকে সিকিউর করার কথা এই মুহূর্তে গুরুত্বের সাথে ভাবছে রাফায়াত! বাসের টিকিট কেটে অয়ন্তীকে নিয়ে রাফায়াত বাসের ভেতর ঢুকে পড়ল। তাদের সিট বাসের একদম শেষে ডান পাশের সিট দুটিতে পড়ল। অয়ন্তীকে জানালার পাশে বসিয়ে রাফায়াত জানালাটা ভালো করে লাগিয়ে দিলো! যেন বাইরে থেকে ভেতরের কিছু দেখা না যায় সেই ব্যবস্থাটাই করল। অয়ন্তী ঠোঁট উল্টিয়ে রাফায়াতের দিকে তাকালো। পুনরায় ন্যাকা কান্না করে বলল,,

“জানালাটা আবার লাগালেন কেন?”

ধুম করে অয়ন্তীর পাশের সিটে বসে পড়ল রাফায়াত। যাত্রীরা সব এতক্ষণে নিজেদের জায়গায় বসে গেছে। এবার শুধু বাস ছেড়ে দেওয়ার অপেক্ষা। মাথার অগোছালো চুলগুলো ঠিক করল রাফায়াত। স্বাভাবিক স্বরেই বলল,,

“সেইফটির জন্য। আর প্লিজ এসব ন্যাকা কান্না বন্ধ করো। মেয়েদের এসব ন্যাকা কান্না আমার একদম পছন্দ নয়। ইচ্ছে হয় তখন কানে গালে মিলিয়ে দুটো দিই!”

মুখ বাঁকালো অয়ন্তী। রাফায়াতের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। হুট করেই তার রাদিফের কথা মনে পড়ে গেল! রাদিফও অয়ন্তীকে সবসময় বলত মেয়েদের ন্যাকা কান্না তার পছন্দ নয়! ফট করে অয়ন্তীর কৌতূহলী দৃষ্টি জোড়া পুনরায় চিন্তিত রাফায়াতের দিকে পড়ল। শক্ত গলায় সে রাফায়াতকে শুধালো,,

“রাদিফ ভাইয়ারও যে মেয়েদের ন্যাকা কান্না পছন্দ ছিলনা আপনি জানেন?”

ইতোমধ্যেই বাসটা ছেড়ে দিলো। রাফায়াত অধীর দৃষ্টিতে অয়ন্তীর দিকে তাকালো। মাথা থেকে খুলে রাখা অয়ন্তীর হুডির টুপিটা রাফায়াত পুনরায় অয়ন্তীর মাথায় পড়িয়ে ভালোভাবে পড়িয়ে দিলো। ধীর গলায় বলল,,

“প্রশ্ন পরে। আগে নিজেকে ঠিক করো। যেন কেউ কোনোভাবে-ই আঁচ করতে না পারে যে তুমি-ই অয়ন্তী। বাসে উঠেছি যেহেতু জায়গায় জায়গায় চেক পোস্ট থাকতে পারে। সো বি কেয়ারফুল।”

চুপ হয়ে গেল অয়ন্তী। মাথা দুলিয়ে হ্যাঁ সূচক সম্মতি জানালো। রাফায়াতের থেকে মুখ ঘুরিয়ে সে বদ্ধ জানালায় দৃষ্টি মিলালো। দীর্ঘ এক শ্বাস ফেলে ব্যথিত গলায় বলল,,

“আই মিস ইউ রাদিফ ভাই!”

অয়ন্তীর পড়া দীর্ঘশ্বাস রাফায়াতের জীবনে যেন অভিশাপের দাগ হয়ে রইল! অব্যক্ত কিছু আলাপন একদিন মন খুলে বলার অপেক্ষাতে-ই রইল রাফায়াত! এরমধ্যেই রাফায়াতের ফোনে একটি ম্যাসেজ এলো। তাড়াহুড়ো রাফায়াত পকেট থেকে ফোনটি তার হাতে তুলে নিলো। আরিফের নাম্বার থেকে ম্যাসেজ এসেছে। ম্যাসেজটিতে লিখাঃ

“রাফায়াত ভাই আপনি এখন যেখানেই থাকুন না কেন যত দ্রুত সম্ভব ভাবিকে নিয়ে ঢাকা ত্যাগ করুন। অনিক ভাই কোনোভাবে জেনে গিয়েছে আপনি অয়ন্তী ভাবিকে কোন ড্যারায় লুকিয়ে রেখেছিলেন। আমরা এখন সেখানেই যাচ্ছি। আই হোপ সো আপনারা এখন এই ড্যারাতে নেই। তবে যেখানেই থাকুন না কেন অতিসত্বর ঢাকা ত্যাগ করুন।”

আরিফের ম্যাসেজটি পেয়ে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল রাফায়াত! স্বস্তির শ্বাস ফেলে সে বাসের সিটে হেলান দিলো। কপালে জমে থাকা বিন্দু বিন্দু ঘাম গুলো মুছে সে অয়ন্তীকে উদ্দেশ্য করে বলল,,

“থ্যাংক গড আমরা বেঁচে গেছি।”

“বাঁচলাম কই? আপনি তো আমাকে মে”রে ফেলার জন্য-ই চট্টগ্রাম নিয়ে যাচ্ছেন!”

“বেশী বুঝো তুমি তাইনা?”

“যা বুঝেছি বেশ বুঝেছি।”

“বেশ বুঝো বলেই তো আজ তোমার এই অবস্থা। বন্ধু কে, শত্রু কে তার ডিফারেন্স আজও খুঁজে বের করতে পারলে না। শত্রুর সাথে থেকে বলো শত্রুই তোমার পরম মিত্র!”

“কে বলল আমি ডিফরেন্স খুঁজে বের করতে পারিনি? শত্রু চিনতে আমি কোনো ভুল করিনি। আপনি-ই হলেন আমার সেই পরম শত্রু। যার প্রমাণ আপনি প্রতি পদে পদে দিচ্ছেন! নিজের ইচ্ছে মতো আমাকে লঘু লঞ্চনা দিচ্ছেন।”

অয়ন্তীর চোখের কোণে অবাধ্য জল টইটম্বুর! ঘৃণায় রাফায়াতের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলো সে। জানালায় আহত দৃষ্টি ফেলে অঝরে চোখের জল ছাড়তে লাগল। রাফায়াত যেন নিস্তব্ধ, নির্বিকার! অয়ন্তীকে কোন ভাষায় সে শান্তনা দিবে বা অয়ন্তীর ভালোটা কী করে তাকে বুঝাবে তা ভেবেই তার চোখের কোণ ঝাপসা হয়ে এলো! প্রশ্রয় দিলোনা সেই বেহায়া জলকে সে। চোখের ভেতরেই ঢুকিয়ে নিলো। ছেলেদের কাঁদতে হয়না। ভেতরে সব কান্না জমিয়ে রাখতে হয়। দীর্ঘ একটা শ্বাস ফেলে সেই চাপা কান্নারও অবসান ঘটাতে হয়। বাসের সিটে পিঠ ঠেকালো রাফায়াত। নিরাপদে চট্টগ্রাম পৌঁছানোর অপেক্ষায় রইল।

,
,

গৌধূলী বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা নেমে এলো তপ্ত ধরণীর বুকে। ঘন কালো অন্ধকার যেন রাশি রাশি হিমেল হাওয়া নিয়ে জড় হলো রাতের আকাশে। সন্ধ্যা তখন সাতটা চলমান ঘড়িতে। থানা থেকে সবেই বাড়ি ফিরেছে রাফায়াত। চঞ্চলসহ আরও তিনজন ক্লোজ ফ্রেন্ড তার সাথে। থানার সমস্ত ঝামেলা সেরে তার বাড়ি ফেরা। ক্লান্ত এবং অবসন্ন শরীর নিয়ে বাড়ির চৌ-কাঠে পা রাখতে-ই রাফায়াতের মা মিসেস শায়লা মির্জা ঘরে প্রবেশে রাফায়াতকে বাঁধা দিলেন! আঁচলে মুখ লুকিয়ে কেঁদে তিনি মাথা নুইয়ে রাফায়াতকে বললেন,,

“বাইরে-ই থাক তুই। ঘরে ঢুকবিনা!”

হতভম্ব হয়ে গেল রাফায়াত। সাথে রাফায়াতের ভাই, ভাবি এবং তার বন্ধুরাও! রাফায়াতের বড়ো ভাই রায়হান তো বেশ রাশভারী গলাতেই তার মাকে প্রশ্ন ছুড়ল,,

“মানে? এসব তুমি কী বলছ মা? ঘরে ঢুকতে পারবেনা কেন?”

“কারণ, এখন তাকে দুধে পানিতে মিশিয়ে গোসল করাতে হবে!”

বিব্রতকর গলায় রাফায়াত তার মায়ের দিকে প্রশ্ন ছুড়ল,,

“এবার তো আমি থানায় ছিলাম না মা। একটা কাজে গিয়েছি জাস্ট। তাছাড়া এর আগেও আমি অনেকবার থানায় থেকে ছিলাম। কই কখনো তো এই নিয়ম দেখাওনি!”

“এই নিয়মটা দেখাইনি বলেই তো তুই দুদিন পর পর থানায় থানায় দৌঁড়োদৌঁড়ি করছিস। ভাগ্যিস ঐ মেয়েটি বলেছিল না হয় তো আমি বার বার-ই একই ভুল করতাম! আর তুই বার বার থানায় গণ্ডি কেটে আসতিস।”

কোমড়ে হাত গুজল রাফায়াত। ভ্রু যুগল খরতর ভাবে কুঁচকালো। রূঢ় গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,

“ওয়েট ওয়েট। কোন মেয়েটা?”

“কোন মেয়েটা আবার? যাকে তুই কি’ড’ন্যা’প করে এনেছিস সেই মেয়েটা!”

প্রতিউত্তর করার সময়টাও অবধি দেওয়া হলোনা রাফায়াতকে। অয়ন্তী যেন বালতি হাতে নিয়ে ঝড়ের বেগে ছুটে এলো রাফায়াতের দিকে! কোনো দিকে কালক্ষেপণ না করেই সে দাঁতে দাঁত চেপে বালতি ভরা দুধপানি ছিটিয়ে দিলো রাফায়াতের গাঁয়ে!

#চলবে….?

#এক_খণ্ড_কালো_মেঘ
#পর্ব_১৬
#নিশাত_জাহান_নিশি

প্রতিউত্তর করার সময়টাও অবধি দেওয়া হলোনা রাফায়াতকে। অয়ন্তী যেন বালতি হাতে নিয়ে ঝড়ের বেগে ছুটে এলো রাফায়াতের দিকে! কোনো দিকে কালক্ষেপণ না করেই সে দাঁতে দাঁত চেপে বালতি ভরা দুধপানি ছিটিয়ে দিলো রাফায়াতের গাঁয়ে!

উপস্থিত সবার চক্ষু হয়ে গেল চড়কগাছ! এ কী অনর্থ করে বসল অয়ন্তী? হিতাহিতজ্ঞান কী লোপ পেয়েছে তার? না জানি আজ কী কী ঝড়-ঝঞ্ঝা বয়ে যায় তার উপর দিয়ে! সেই খবর কী অয়ন্তীর আছে? আদোতে ক্ষুব্ধ রাফায়াতকে আজ শান্ত করা যাবে তো? সেই অবিসম্ভাব্য ভয়ে সবাই কাতর হয়ে থাকলেও রাফায়াতের ভাবি ‘সুমা’ মুখ চেপে হেসে দিলো! হাসি বেশিক্ষণ চেপে রাখতে পারল না সে। রাখবেই বা কী করে? তার ঘাড়ত্যাড়া দেবরটাকে কেউ এই প্রথম এভাবে নাকানি চুবানী খওয়াবে আর সে শুধু মুখ চেপে হাসবে তা কী আবার ইহকালে সম্ভব হবে? রাফায়াতের মা মিসেস শায়লা মির্জা তো ভীষণ খুশি। পুরোপুরি গোসল না করে রাফায়াত নিশ্চয়-ই এখন এই ভেজা শরীর নিয়ে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করবেনা। যা খুঁতখুঁতে স্বভাবের রাফায়াত। চিনতে বাকী আছে নাকি রাফায়াতকে উনার?

এদিকে তো রাফায়াত জ্বলছে, পুড়ছে আর লুচির মত ফুলছে! রাগ যেন তার ফারেনহাইটের পারদের ন্যায় উঠা-নামা করছে। পারছেনা সে এক্ষুণি অয়ন্তীর গ’লা টি’পে ধরতে! সমস্ত শরীর তার জ্বলে পুঁড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। দুই হাতের কোষে পাঁচ থেকে ছয়বার পানি ছিটানোর পর অয়ন্তী তার ক্ষোভ থেকে বেরিয়ে এলো! রাগী ভাবটা যেন মুহূর্তের মধ্যেই নিশ্চিহ্ন হয়ে তা পৈশাচিক হাসিতে পরিণত হলো। অচিরেই মনস্কামনা পূরণ হয়ে গেল তার। রাফায়াতের অগ্নিঝরা দৃষ্টিতে সে সাবলীল দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। হাত দু’খানি ঝেড়ে স্বাভাবিক স্বরেই বলল,,

“যান যান। এবার ওয়াশরুমে যান। পুরো বালতি দুধপানি ঢেলে গোসল করে আসুন। আপনার অর্ধেক কাজ-ই তো আমি কমিয়ে দিলাম বলুন? এতে তো আপনার খুশি হওয়ার কথা তাইনা? কিন্তু খুশি হওয়ার বদলে আপনি মুখটাকে অমন বাংলার পাঁচের মত করে রেখেছেন কেন?”

না এবার আর চুপ করে থাকা যাচ্ছেনা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণাধীন হয়ে উঠছে। ভেতরের সব ক্ষোভ এবার বাইরে বের করতে-ই হবে। না হয় পেট ফেটেফুটে সব বাইরে বের হয়ে আসবে। তৎক্ষণাৎ দাঁতে দাঁত গিজগিজিয়ে রাফায়াত তার আধভেজা শার্ট এবং প্যান্টটিকে ঝেড়েঝুড়ে অয়ন্তীর সম্মুখস্থ হয়ে দাঁড়ালো। চোঁয়াল উঁচিয়ে বিড়বিড়িয়ে বলল,,

“রিভেঞ্জ নিলা তাইনা?”

অবিশ্বাস্যভাবে-ই অয়ন্তী চোখ মেরে দিলো রাফায়াতকে! বুকের উপর দু’হাত গুজে বড়ো রকমের ভাবসাব নিলো। মজার ছলে বলল,,

“কেঁচি লাগি মেরি পেহেলি রিভেঞ্জ? আচ্ছি হে না? বোলো বোলো আচ্ছি হে না?”

রাগটা যেন তড়তড় করে মাথায় চেপে বসল রাফায়াতের। অয়ন্তীর ভাবসাব দেখে তার মাথায় চেপে থাকা সেই মারাত্নক রাগটা যেন বেগতিক ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করল! হাত বাড়িয়ে সে অয়ন্তীর বুকের পাঁজর থেকে হাত দু’খানা টেনে সরালো। ঝাঁজালো গলায় বলল,,

“নেক্সট টাইম যেন না দেখি আমার সামনে এভাবে বুকের উপর হাত গুজে না দাঁড়াতে। বড়োদের মত এসব ভাবওয়ালা গেট আপ না নিতে।”

হঠাৎ-ই তাদের মধ্যখানে এসে মিসেস শায়লা মির্জা ফোরণ কাটলেন। কারণ, তিনি বুঝতে পারছিলেন বদরাগী ছেলে উনার ভীষণ তেঁতে গেছে। কখন সেই গলন্ত লোহা এসে অয়ন্তীর গাঁয়ে ছিঁটকে পড়ে তা বলা ভারী মুশকিল। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে তিনি দ্রুত গলায় রাফায়াতকে বললেন,,

“হয়েছে হয়েছে। এবার যা গোসল করে আয়। মেয়েটা একদম ঠিক কাজ করেছে। তোকে এভাবে ভিজিয়ে না দিলে তুই কখনোই এই দুধ পানিটা দিয়ে গোসল করতে রাজি হতিসনা। তুই আমার ছেলে আর আমি তোকে চিনব না? যা হওয়ার হয়ে গেছে বাবু। যা এবার আর্লি গোসলটা সেরে আয়। খাবার বাড়ছি আমি। দুপুর থেকে সবাই না খেয়ে আছে। নিশ্চয়ই ইঁদুর দৌঁড়োচ্ছে সবার পেটে।”

ছেলের বউকে নিয়ে মিসেস শায়লা মির্জা চলে গেলেন রান্নাঘরের দিকে। রাফায়াতের বড়ো ভাই রায়হান উপর থেকে নিচ অবধি রাফায়াতকে খুব সূক্ষ্মভাবে প্রত্যক্ষণ করলেন। অতঃপর তিনি আচমকাই মুখ চেপে হেসে বললেন,,

“যা ভাই তাড়াতাড়ি শাওয়ারটা নিয়ে আয়। এই লুকে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে বলা যায়না কিন্তু মেয়ে মানুষদের নজর আবার বেসামাল হয়ে যেতে পারে!”

চটে গেল রাফায়াত। রুষ্ট গলায় বলল,,

“জাস্ট শাট আপ ভাইয়া! যে যেভাবে পারছ আমার মজা নিচ্ছ। আমি কিন্তু এসব টলারেট করতে পারছিনা একদম।”

হা হা শব্দে হাসতে হাসতে রায়হান জায়গা থেকে প্রস্থান নিলো। চঞ্চলসহ বাকী সবাই মুখ লুকিয়ে জায়গা থেকে পালালো! যদিও চঞ্চলের মুখে আগে থেকেই মাক্স পড়া ছিল। অয়ন্তী যেন কোনোভাবেই চঞ্চলকে চিনতে না পারে সেজন্যই রাফায়াতের কথায় চঞ্চলের এই বাড়িতে মাক্স পড়ে আসা! অয়ন্তীর প্রথম থেকেই রাফায়াতের বন্ধুদের দিকে তেমন একটা নজর ছিলনা। তার সম্পূর্ণ নজর নিবদ্ধ ছিল শুধু রাফায়াতের দিকে। কখন সে সবার সামনে রাফায়াতকে দুধে পানিতে ভেজাতে পারবে সেই প্রতিশোধের তাড়নায় মত্ত হয়েছিল।

বুকে হাত রাখার প্রসঙ্গে রাফায়াত স্পষ্ট ভাষায় অয়ন্তীকে বারণ করে দিলেও অয়ন্তী এই কাজটিই পুনরায় করল! ইচ্ছে করে আবারও বুকের পাঁজরে হাত গুজে দাঁড়ালো! রাফায়াত আবারও ক্ষুব্ধ হয়ে অয়ন্তীর বুক থেকে হাত দুটি সরিয়ে দিলো। খিঁচ খেয়ে অয়ন্তী আবারও একই কাজ রিপিট করল। রাফায়াতও তার জেদে অটুট থেকে আবারও সেই সেইম কাজটি করল। এভাবে-ই দুজন প্রায় পাঁচ থেকে ছয়বার এই একই কাজে লিপ্ত রইল। সপ্তম বারের বেলায় রাফায়াতের মাথায় এবার র’ক্ত ওঠে গেল! ধৈর্য্যের বাঁধও পুরোপুরি ভেঙে গেল৷ অয়ন্তীকে টানতে টানতে সে বাড়ির স্টোররুমে নিয়ে গেল। ধপাস করে মেঝেতে ছিটকে ফেলল। বদ্ধ জানালার ফিনকি দিয়ে হুড়মুড়িয়ে আসা এক ফালি রোদের আলোতে অয়ন্তীর উদ্ভ্রান্ত মুখের দিকে তাকালো রাফায়াত। মৃদু চিৎকার করে বলল,,

“তুমি ভালো কথার মানুষ না বুঝলে? ভেবেছিলাম বাড়ির সবার মাঝে তোমাকে রাখব। কিন্তু তুমি সবার সাথে থাকার যোগ্য নও। স্টোররুমে বন্ধী থাকবে না হয় কালই তোমাকে শুনশান একটা গেস্ট হাউজে নিয়ে ফেলে রেখে আসব। ওখানে তুমি একা পঁ’চ’বে, গ’ল’বে, ম’র’বে!”

ভাবশূণ্য ভঙ্গিতে অয়ন্তী ঠোঁট উল্টালো। স্বাভাবিক স্বরে-ই বলল,,

“এজ ইউর উইশ! আমি তো আমার বাঁচার আশা পুরোপুরিই ছেড়ে দিয়েছি। শুধু আমার পরিবার সুরক্ষিত থাকলেই চলবে। তাই আমার এই বদ্ধ স্টোররুমে বা শুনশান কোনো গেস্ট হাউজে থাকতেও কোনো অসুবিধে নেই।”

মেঝেতে উল্টো পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল অয়ন্তী। মুখ লুকিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল সে। অয়ন্তীর আচরণে রাফায়াত বেশ অবাক হলো। এত সহজে অয়ন্তী হার মেনে নিলো? নিজেকে বাঁচানোর কথা চিন্তা করলনা অবধি? অয়ন্তীকে দেখে মনে হচ্ছে যেন এভাবে সে আরও অনেকবার নিজেকে ত্যাগ করে এসেছে! যেকোনো পরিস্থিতিতে নিজেকে জোর পূর্বক মানিয়ে নিয়েছে। কিন্তু সবক্ষেত্রে তো নিজেকে এমন জোর করা ঠিক নয়। এভাবে অন্য কাউকে জিতিয়ে দিয়ে নিজে হেরে যাওয়া মোটেও উচিৎ নয়। মৃত্যুর আগ অবধি নিজেকে বাঁচিয়ে যাওয়ার লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। হার মানা যাবেনা কারো কাছে-ই। অয়ন্তীকে খুব শক্ত হতে হবে। রাগী ভাব ঝেড়ে ফেলল রাফায়াত। কণ্ঠে কোমলতা নিয়ে এলো। মলিন স্বরে বলল,,

“দেখি ওঠো।”

নাছোড়বান্দা অয়ন্তী নিজেকে আরও গুটিয়ে শুটিয়ে শুয়ে পড়ল। ভরাট গলায় জবাবে বলল,,

“আপনি যান এখান থেকে। আমাকে একটু একা থাকতে দিন।”

“উঠতে বলেছি উঠো। ঠিক জায়গায় তো রাগ দেখাতে পারো না। বেহুদা জায়গায় রাগ দেখাতে আসো।”

“আমার এখন কারো সাথে কথা বলতে ভালো লাগছে না। প্লিজ আপনি যান।”

“আচ্ছা কী করতে ভালো লাগছে বলো?”

“বললাম তো একা থাকতে ভালো লাগছে।”

গাঁ ছাড়া ভাব নিলো রাফায়াত। ভেজা চুলগুলো পেছনের দিকে টেনে ধরল। ভাবশূণ্য গলায় বলল,,

“ওকে ফাইন। তাহলে একা-ই থাকো। তবে তোমার সাথে একটা টপ সিক্রেট শেয়ার করার ছিল! শুনতে চাইলে শুনবে। না হয় চলে যাচ্ছি ওকে?”

নাক টানল অয়ন্তী। আগ্রহ থেকে বেশ উৎসুক গলায় শুধালো,,

“কী সিক্রেট?”

“আগে বলো ভয় পাবে না তো?”

“উঁহু। আমি ভয়-টয় পাইনা। যা বলার বলে ফেলুন।”

“ওকে বলছি তাহলে। এই রুমে না? কালো দেখতে একটা ভূ”ত আছে!”

দম নেওয়ারও সময়টা পেলনা রাফায়াত। এর অতিপূর্বেই অয়ন্তী দৌঁড়ে এসে রাফায়াতের ডান হাতটা জড়িয়ে ধরল। রাফায়াতের ঠিক পেছনে লুকিয়ে যাওয়ার মত উপক্রম হলো তার। ভয়ে তার শরীর থরথর করে কাঁপতে লাগল। জবান প্রায় বন্ধ হয়ে এলো। হাত দুটো ঘামে ভিজে রাফায়াতের কব্জির সাথে মিশে যাচ্ছিল। কাঠ কাঠ গলায় বলল,,

“আমাকে প্লিজ আপনাদের সাথে থাকতে দিন না? আমি আর কখনও আপনার কথার অবাধ্য হবনা!”

ঠোঁট টিপে হাসি চাপল রাফায়াত। কণ্ঠে বেমালুম কঠোরতা এনে বলল,,

“শিওর?”

“হুম।”

“ভেবেচিন্তে বলছ তো?”

“হুম।”

“আমি যা করতে বলব তাই করবে?”

“হ্যাঁ তো। প্লিজ চলুন না এই গস্টরুম থেকে।”

“বুকের উপর আর হাত গুজে দাঁড়াবে না শিওর তো?”

“হ্যাঁ শিওর।”

“আমি যা বলব তাই শুনবে?”

“শুনব তো!”

“ওকে। তাহলে ঠিক আছে। আর একটা কথা।তোমাকে থাকার জন্য যে রুমটা দেওয়া হয়েছে তুমি সেই রুমটিতেই থাকবে। খবরদার আমি বলার আগে ঐ রুম থেকে এক পা ও বের করবেনা ওকে?”

“ওকে! এবার তো চলুন প্লিজ।”

রাফায়াতের বাহুতে শক্তভাব চেপে ধরা অয়ন্তীর হাত জোড়ায় ভরসার হাত রাখল রাফায়াত! অনেকক্ষণ যাবত গাঁ ভেজা থাকার দরুন হঠাৎ তার ঠাণ্ডা লেগে গেল। বিরামহীনভাবে হাচ্চি দিতে লাগল সে। অনর্গল ছয়টা হাচ্চি একসাথে দেওয়ার পর রাফায়াত একটু ক্ষান্ত হলো। এর ফাঁকেই অয়ন্তী রাফায়াতকে টেনে হেঁচড়ে স্টোররুম থেকে বের করল। আচমকাই রাফায়াতের কনুইতে জোরে এক চিমটি কেটে দিলো! তড়িঘড়ি করে রাফায়াতের হাতটি ছেড়ে সে তার বরাদ্দ করা রুমটির দিকে দ্রুত পায়ে হাঁটা ধরল। উত্তেজিত গলায় রাফায়াতকে ডেকে বলল,,

“ব’জ্জা’ত বেটা। ভূতের ভয় দেখাও আমারে? একদম ঠিক হয়েছে ঠাণ্ডা লেগেছে। আর একটা কথা। আমি ভুলেও আপনার কথামত চলব না। যখন যা মনে হবে তখন ঠিক তাই করব। যেটা না করতে বলবেন সেটাই আরও বেশি করে করব!”

অয়ন্তীর বড়ো নখের আঁচড়ে যদিও রাফায়াতের কনুইটা বেশ অনেকখানিই কেটে গেছে তবুও সে কোনো রকম উহ্ আহ্ শব্দটুকুও করলনা। ব্যথাকে তার ব্যথাই মনে হলোনা! প্রাণপনে দৌঁড়োতে থাকা অয়ন্তীর যাওয়ার পথে তাকিয়ে সে স্মিত হাসল। অয়ন্তীর একটু আগের করা নাটক ধরতে তার আর বাকী রইলনা! মাথা চুলকে সে বিভোর গলায় বলল,,

“ইশশ! আমার হারানো অয়ন্তীটাকে আবারও ফিরে পেলাম!”

ইতোমধ্যেই পেছন থেকে চঞ্চল এসে উদ্বিগ্ন গলায় রাফায়াতকে ডাকল। অনর্গল বলল,,

“একটা প্রবলেম হয়ে গেছে রাফায়াত!”

তড়িঘড়ি করে পেছনে ঘুরে তাকালো রাফায়াত। কপালের ভাঁজে নিগূঢ় দুঃশ্চিন্তার ছাপ ফুটিয়ে তুলল। শুষ্ক গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,

“কী প্রবলেম?”

“প্রিয়া ফোন করেছিল। তোর ফেরার খবরটা সে পেয়ে গেছে! আমাকে বলছিল কিছুক্ষণের মধ্যেই নাকি এই বাড়িতে আসছে!”

মাথায় হাত চলে গেল রাফায়াতের। চরম সংকটে ভুগতে লাগল। খারাপ কিছুর আঁচ করতে পেরে আতঙ্কগ্রস্ত গলায় বলল,,

“কী বলছিস তুই বুঝতে পারতিস তো চঞ্চল? প্রিয়া এখন এই বাড়িতে আসলে পরিস্থিতি সব উল্টে পাল্টে যাবে।”

“হ্যাঁ। এজন্যই তো আর্জেন্ট তোকে কথাটা বলা। যা করার আমাদের কিছুক্ষণের মধ্যেই করতে হবে।”

“যা মনে হচ্ছে অয়ন্তীকে এই বাড়িতে রাখাটা সেইফ নয়! হতে পারে প্রিয়ার সাথে অনিকও আসতে পারে। অনিক কিন্তু আমাকে পাগলের মত খুঁজছে!”

#চলবে…?