এক খণ্ড কালো মেঘ পর্ব-৪৮+৪৯

0
171

#এক_খণ্ড_কালো_মেঘ
#পর্ব_৪৮
#নিশাত_জাহান_নিশি

এই রাতে অয়ন্তী যা যা খেতে চাইল, যা যা করতে চাইল তার সব ইচ্ছে পূরণ করে দিলো রাফায়াত! ব্রীজের উপর ওঠে চাঁদ দেখা থেকে শুরু করে আইসক্রীম খাওয়া, ভাগ্যক্রমে মাহফিলের এরিয়া থেকে ফুচকা খাওয়া, ভেলপুরি খাওয়া, চাপ, গ্রিল, চিপস, চকোলেট, বার্গার এমনকি অয়ন্তীর যত ধরনের পছন্দের খাবার আছে সব খাওয়ালো! আজকের রাতটা হয়ে উঠল অয়ন্তীর ইচ্ছা পূরণের রাত!

এই করতে করতে প্রায় মাঝরাতের দিকে তারা বাড়ি ফিরে এলো। অয়ন্তীকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে রাফায়াত খুশি মনে তার বাড়ি ফিরে গেল। যদিও প্রথমে অয়ন্তী ছাড়তে চাইছিলনা রাফায়াতকে! আরও কিছুক্ষণ একসাথে সময় কাটানোর জন্য বড্ড জেদ ধরেছিল। হাত-পায়ে ধরার বাকী ছিল প্রায়। কিন্তু রাফায়াত তো চিনতে পেরে গেছে অয়ন্তীর বাবাকে! বিয়ের আগেই এত বেশী বাড়াবাড়ি করতে গেলে হীতে হয়ত তার অয়ন্তীকে হারাতে হবে! এমনি প্রচণ্ড ক্ষেপে আছে অয়ন্তীর বাবা তার উপর। এখন পান থেকে সামান্য চুন খসলেই মহা বিপদ। সেই আগাম বিপদের ভয়ে-ই রাফায়াত অয়ন্তীর জেদকে তেমন গুরুত্বের সাথে নেয়নি। ঠাণ্ডা মাথায় অয়ন্তীকে বিষয়টা বুঝিয়ে বরং ফুরফুরা মেজাজ নিয়ে-ই বাড়ি ফিরে গেছে। বিছানায় উবুড় হয়ে শুতেই রাফায়াতের দু’চোখে তব শান্তির ঘুম ভর করল। অন্যদিকে অয়ন্তীর বাবা বড্ড অসন্তুষ্ট অয়ন্তীর এহেন আপত্তিকর চালচলনে! এত রাত অবধি রাফায়াতের সাথে অয়ন্তীর বাড়ির বাহিরে থাকাটা তিনি সুদৃষ্টিতে দেখলেন না! এমনকি মেয়েকেও কিছু বললেন না। ভেতরের রাগ কেবল ভেতরেই মজালেন! মেয়ের রাগকে তিনি এখন মাত্রাতিরিক্ত ভয় পান। আগের বার তো এই সর্বনাশা রাগের জন্যই তিনি তার মেয়েকে হারাতে বসেছিলেন! এই বার আর একই ভুল করতে চাননা তিনি। মনে মনে মেয়েকে নিয়ে অসন্তুষ্ট থাকলেও উপরে তা প্রকাশ করতে চাইলেন না।

বিছানায় শুয়ে অয়ন্তী কেবল ছটফট করছে। মূলত গ্যাসের সমস্যা হচ্ছে তার! আজ এত এত বাইরের তেল এবং মসলাযুক্ত অস্বাস্থ্যকর খাবার খেয়েছে যে তার এখন বদহজম হচ্ছে! মুহূর্তের মধ্যেই প্রায় একবার করে বাথরুমে যেতে হচ্ছে। বমি করেও সব প্রায় উল্টে ফেলছে প্রায়। রাফায়াত বলেছিল বাড়ি পৌঁছেই প্রথমেই তাকে গ্যাস্ট্রিকের ঔষধটা খেয়ে নিতে। অয়ন্তী শুনেনি তার কথা। বরং ক্লান্ত শরীর নিয়ে কোনো রকমে বিছানায় গাঁ এলিয়ে দিয়েছিল। এরপর ঘুমের মধ্যেই হঠাৎ অসুস্থ হয়ে উঠল। এখন কেবল বাথরুমে যাওয়া আসা করতে করতেই তার রাত পেরিয়ে ভোর নেমে এলো! যদিও গ্যাস্ট্রিকের ঔষধ পরে খেয়েছিল সে তবুও সঠিক সময়ে ঔষধ না খাওয়ায় সেই ঔষধ কাজ করেনি তার। উল্টো টক ঢেকুর হতে লাগল! যা পৃথিবীর সবচেয়ে বাজে ফিলিংস!

সারারাত আহাজারি করতে করতে অবশেষে ভোরের দিকে অয়ন্তীর চোখ লেগে এলো। পেটের মধ্যে বালিশ চাপা দিয়ে সে এচিডিটির যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে এক পর্যায়ে ঘুমিয়ে পড়ল। এই রাতটা ছিল তার জীবনের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর রাত! শরীর এতটাই বা’জে’ভা’বে অ’সু’স্থ হয়ে পড়েছিল যে তার ম’র’ণদশা হয়ে গিয়েছিল প্রায়! সেই বি’ষা’দম’য় রাত ফুরিয়ে অয়ন্তীর ঘুম ভাঙল সকাল নয়টার কাছাকাছিতে। অর্ধ খোলা অ’সু’স্থ চোখেই সে রাফায়াতকে ফরমাল লুকে আবিষ্কার করল তার চোখের সামনে। এত সকাল সকাল রাফায়াতকে এমন সুদর্শনীয় রূপে প্রদর্শনে করবে তা ঘুনাক্ষরেও ভাবতে পারেনি অয়ন্তী। শরীরের সমস্ত অসুস্থতা যেন তার কেটে গেল! শরীর ঝরঝরা হয়ে উঠল। আমোদিত হয়ে সে লাফিয়ে শোয়া থেকে উঠে বসল। অমনি রাফায়াত বসা থেকে ওঠে দাঁড়ালো। প্যান্টের পকেট থেকে ইনুর একটি প্যাকেট বের করল সে। গ্লাসভর্তি পানিতে ইনুটি গুলতে লাগল। চমকে থাকা অয়ন্তীকে উদ্দেশ্য করে সে শান্ত গলায় বলল,,

“যাও। আগে ফ্রেশ হয়ে এসো।”

চোখ কচলালো অয়ন্তী। ঘুমের ঘোর থেকে বের হয়ে এলো সে। কৌতূহলী গলায় পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ল,,

“আপনি হঠাৎ ফরমাল লুকে?”

“হুম ইন্টারভিউ আছে।”

“কোথায়?”

“বাবার অফিসে!”

ভড়কে উঠল অয়ন্তী। কয়েক দফা অবাক হয়ে ভীরু গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,

“মানে? চট্টগ্রামে?”

“না। ঢাকায়ও একটা ব্রাঞ্চ আছে।”

স্বস্তির শ্বাস ফেলল অয়ন্তী। বুকে হাত রেখে চোখ জোড়া বুজল। প্রশান্তিময় গলায় বলল,,

“ওহ্ আচ্ছা।”

ইনুটা গুলে রাফায়াত ভ’য়’ঙ্ক’র রাগী দৃষ্টিতে শান্তশিষ্ট অয়ন্তীর দিকে তাকালো! দাঁত কপাটি চেপে তিরিক্ষিপূর্ণ গলায় বলল,,

“কথা কানে যায়না? ফ্রেশ হয়ে আসতে বলিনি?”

রাফায়াতের এহেন ভ’য়’ঙ্ক’র রাগের কারণ বুঝতে পারলনা অয়ন্তী। নিতান্তই হতবাক হয়ে সে ফ্যাল ফ্যাল দৃষ্টিতে রাফায়াতের দিকে তাকালো। কৌতূহল এড়াতে হঠকারি গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,

“এমন করছেন কেন হ্যাঁ? কী হইছে আপনার? সকাল সকাল ঝাঁড়ি ঝুড়ি দেওয়া শুরু করছেন কেন?”

“কাল রাতে বারণ করেছিলাম না? এত ফাস্ট ফুড না খেতে? রাতে যে কতবার বাথরুমে আপ ডাউন করেছ তা তা তোমার লণ্ডভণ্ড হয়ে থাকা রুম আর তোমার মলিন হয়ে থাকা ফেস দেখে-ই বুঝা যাচ্ছে। কথা শোনো তুমি আমার?”

ভয়ে তৎক্ষনাৎ মাথা নুইয়ে নিলো অয়ন্তী। শুকনো ঢোঁক গিলে ঘন ঘন মাথা চুলকাতে লাগল। নিজের ভুল সে বুঝতে পারল। রাফায়াতের মন মেজাজ বড্ড খারাপ তা দেখেই বুঝা যাচ্ছে। আজ হয়ত তার খবর আছে! গ’র্দা’নও যেতে পারে। মানে মানে করে এখান থেকে কেটে পড়া ভালো! কে হাতে ধরে নিজের সর্বনাশ করতে চাইবে? সময় অপচয় না করে অয়ন্তী তড়িঘড়ি করে শোয়া থেকে ওঠে এক প্রকার দৌঁড়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ল! মাথা মুথা গরম হয়ে গেল রাফায়াতের। যেখানে কিনা তাকে ইন্টারভিউ দিতে যেতে হবে ঠাণ্ডা মাথায়, বি কনফিডেন্ট হয়ে সেখানে অয়ন্তীর কার্যকলাপে তার মাথা রীতিমত গরম হয়ে যাচ্ছে! এসব দেখে গেলে ইন্টারভিউটা ভালো হবে কী করে?

দশ থেকে পনেরো মিনিটের মধ্যেই অয়ন্তী ফ্রেশ হয়ে ওয়াশরুম বের হয়ে এলো। অয়ন্তীর জন্য রূঢ়তা নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকা রাফায়াত তক্ষণি ইনুর গ্লাসটা বিনাশব্দ প্রয়োগে অয়ন্তীর দিকে এগিয়ে দিলো। কাঁপা কাঁপা হাতে অয়ন্তী ইনুর গ্লাসটি হাতে তুলে নিলো। ঢকঢক করে গ্লাসভর্তি ইনু শেষ করল। ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে সে বদরাগী রাফায়াতের দিকে কম্পিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। অমনি রাফায়াত চটে গেল! মেজাজ হারিয়ে সে মাথার চুল টানল। চোঁয়াল উঁচিয়ে প্রশ্ন ছুড়ল,,

“রাতে যে শরীর খারাপ হয়েছিল একবারও জানিয়েছিলে আমাকে?”

ভয়ে কেঁপে ওঠে অয়ন্তী মাথা নুইয়ে নিলো। ভীতু গলায় সে প্রত্যত্তুরে বলল,,

“ভেবেছিলাম ঘুমাচ্ছিলেন তাই!”

“একটা বার কল করা যায়নি?”

“সরি।”

“কীসের সরি হ্যাঁ? আমি তোমার কাছ থেকে সরি শুনতে চেয়েছি?”

“না। মনে হলো ভুল করেছি। তাই সরি বললাম।”

“তোমার এই অসুস্থ মুখ দেখে আমি ইন্টারভিউ দিতে যাব? প্রতিবার আমাকে বাঁধা দিতেই হবে?”

“আমি তো ইচ্ছে করে করিনি রাদিফ।”

“ইচ্ছে করেই করেছ। বার বার বারণ করেছিলাম না? একসাথে এত ফাস্ট ফুড না খেতে। শোনোনি আমার কথা। বরং ঘা’ড়’ত্যা’ড়া’মো করে খেয়েছ। বেশী বেশী করে খেয়েছ।”

“আচ্ছা হইছে তো। বাদ দিন না। আমি সুস্থ আছি তো এখন। মাথা ঠাণ্ডা করুন। অল্পতে কেন এত রেগে যান বলুন তো?”

“না। আমার মাথা ঠাণ্ডা করার কোনো প্রয়োজন নেই। গরম মাথা নিয়েই আজ ইন্টারভিউ দিতে যাব। ইন্টারভিউ খারাপ হলে সম্পূর্ণ দোষ তোমার! বিয়ে আরও একবছর পিছাবে! বিয়ে কবে করবে বিয়ে করবে বলে তখন মাথা খেয়ো না আমার!”

কিছুতেই যেন অশান্ত রাফায়াতকে শান্ত করা গেলনা। রেগেমেগে গরম হয়ে সে অয়ন্তীর সাথে একপ্রকার ক্ষিপ্ত হয়েই বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল! যাত্রাপথে অয়ন্তীও রাফায়াতকে বাঁধা দিলোনা। ক্ষুব্ধতা নিয়ে যেতে দিলো রাফায়াতকে। ইন্টারভিউ আজ ভালো হবেনা মনে মনেই জানা ছিল রাফায়াতের। ভেতরে ভেতরে একপ্রকার অশান্তি কাজ করছিল তার। অয়ন্তীর সামান্য অসুস্থতাও সে এখন মানতে পারেনা! অস্থির হয়ে ওঠে। মাথা কাজ করেনা তখন। সবথেকে বেশী তখন খারাপ লাগে যখন অয়ন্তী তার কথা শুনেনা!

ভাগ্যক্রমে ইন্টারভিউ রাফায়াতের চরম লেবেলের ভালো হলো! প্রতিটা প্রশ্নের উত্তর সে এতটাই স্মার্টলি এবং ভেবেচিন্তে দিলো যে ইন্টারভিউ ভালো না হয়ে কোনো উপায় ছিলনা! তাছাড়া রাফায়াতের বাবা এই বীমা কোম্পানির সাথে প্রায় পঁচিশ বৎসর যাবত যুক্ত ছিলেন! সেই সুবাদে এত ভালো ইন্টারভিউয়ের পর রাফায়াতের চাকুরী পাওয়াটা অনিশ্চিত কিছু ছিলনা। বরং সবাই আশাবাদী ছিল। এখন শুধু রেজাল্টের অপেক্ষা। এক সপ্তাহের মধ্যেই হয়ত কোম্পানি থেকে তার ডাক আসতে পারে। অয়ন্তীর সাথে রাগারাগি করাটা এভাবে তার লাকি চান্স হয়ে দাঁড়াবে তা ইন্টারভিউ ভালো হওয়ার আগ অবধিও ভাবতে পারেনি রাফায়াত! বাড়ি পৌঁছে রাফায়াত প্রথমে তার মা-বাবার সাথে দেখা করল। সবার আদর এবং ভালোবাসা নিলো। এরপর সোজা চলে এলো অয়ন্তীর বাসায়। অয়ন্তীর সাথে দেখা করতে। খুশির খবরটা অয়ন্তীকে জানাতে। দুপুরের এই কড়া রোদে অয়ন্তী ছাদের উপর ওঠে দোলনায় দুলছে আর জলপাইয়ের আচার খাচ্ছে! বিষয়টা আমাদের কাছে রীতিমত অস্বাভাবিক ঠেকলেও অসুস্থ শরীরে অয়ন্তীর কাছে বেশ ভালোই লাগছে। রাফায়াতকে মনে মনে বেশ বকাঝকাও করছে সে! কেন সে আজ অয়ন্তীর সাথে ঝগড়া করে বাড়ি থেকে বের হলো? ইন্টারভিউ যদি আজ ভালো না হয় তো দোষটা তো তার ঘাড়েই পড়বে! আচারটা তৃপ্তিভরে চু’ষে অয়ন্তী বিরক্তি ভরা গলায় বলল,,

“ধ্যাত বিয়েটাও পিছিয়ে যাবে এবার! কী দরকার ছিল আমার সাথে ঝগড়া করে বের হওয়ার? পেটের ভাত হজম হয়না বোধ হয় আমার সাথে ঝগড়া না করলে। কী সুন্দর বাচ্চা কাচ্চার প্ল্যানিং করে রেখেছিলাম আমি! সব প্ল্যানিংয়ে পানি ঢেলে দিলো আমার। ভাল্লাগেনা আর। জামাইয়ের অ’ভা’বে দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছি! শ’য়’তা’ন রাদিফটা তা বুঝলোনা।”

পেছনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রাফায়াত সব শুনছিল! কোনোমতে হাসি চেপে রেখেছিল প্রায়। অমনি পেছন থেকে রাফায়াত গাড্ডা মারল অয়ন্তীর মাথায়! নাকমুখ কুঁচকে অয়ন্তী পেছনে ঘুরে তাকানোর আগ মুহূর্তেই কেমন যেন বিব্রতকর গলায় বলল,,

“কে রে?”

পিছু ফিরে তাকাতেই অয়ন্তী টাস্কি খেয়ে গেল! সঙ্গে সঙ্গেই রাফায়াত ব্যগ্র অয়ন্তীর দিকে তাকালো। ঠোঁট কামড়ে রসালো গলায় বলল,,

“আসো বাচ্চা দিই!”

তাৎক্ষণিক লজ্জায় রাফায়াতের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলো অয়ন্তী! মাথা নুইয়ে নিজেই নিজের মাথায় গাড্ডা মেরে মৃদু স্বরে বলল,,

“ধ্যাত! এই লোকটা আবার সব শুনে নিলো না তো?”

কদাচিৎ হেসে রাফায়াত ডানপিটে ভাব নিলো৷ ঠোঁট কামড়ে পুনরায় লজ্জাহীন গলায় বলল,,

“আসো পরাণ। জামাইয়ের অভাব মিটিয়ে দিই!”

ঝট করে অয়ন্তী বসা থেকে ওঠে দাঁড়ালো। রাফায়াতের উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে সে লজ্জায় রাঙা হয়ে ওড়না দ্বারা সমস্ত মুখ ঢেকে নিলো। কম্পিত ঠোঁটে অস্ফুটে গলায় বলল,,

“ধ্যাত। আমি তো মজা করে বলেছি।”

পা বাড়িয়ে অয়ন্তীর দিকে হেঁটে এলো রাফায়াত। মোহে সিক্ত হয়ে পেছন থেকে অয়ন্তীকে জাপটে ধরার পূর্বেই অয়ন্তী লজ্জায় আরও একটু খানি দূরে সরে গেল। শয়তানি হেসে রাফায়াত পুনরায় অয়ন্তীকে বলল,,

“আরে আসো। আমি সত্যিই তোমার অভাব পূরণ করতে চাই!”

রাফায়াত আবারও অয়ন্তীর দিকে এগিয়ে যেতেই অয়ন্তী আবারও রাফায়াতের থেকে দৌঁড়ে পালালো। পুরো ছাদ জুড়ে দুজনের ছুটোছুটি শুরু হয়ে গেল! রাফায়াত যেন কিছুতেই অয়ন্তীকে ধরতে পারছেনা। রোদের তাপে দুজনই ঘেমে নেয়ে একাকার৷ তবুও কারো ক্ষান্ত নেই৷ দৌঁড়োতে দৌঁড়োতে অয়ন্তী এক পর্যায়ে ক্লান্ত হয়ে এলো। শরীরের শক্তি হারিয়ে সে সোজা দাঁড়িয়ে পড়ল। অমনি সুযোগ বুঝে রাফায়াত ছুটে গিয়ে অয়ন্তীকে এবার পেছন থেকে শক্তভাবে জড়িয়ে ধরল। হাঁপিয়ে ওঠা গলায় বলল,,

“এই বছরই আমাদের বিয়েটা হবে পরাণ। চাকুরীটা হয়ত এবার আমি পেয়ে যাব। যদি আল্লাহ্ তা’য়ালার রহমত থাকে তো!”

খুশিতে উচ্ছ্বাসিত হয়ে উঠল অয়ন্তী। হাঁপিয়ে ওঠা গলায় বলল,,

“সত্যি রাদিফ? ইন্টারভিউ ভালো হয়েছে আপনার?”

“আলহামদুলিল্লাহ্ অনেক ভালো হয়েছে। ভাবতে পারিনি এতটা ভালো হবে।”

“আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছেনা রাদিফ! আ’ম সো সারপ্রাইজড!”

“এবার আদর দাও!”

“এ্যাহ্!”

“এ্যাহ্ না হ্যাঁ! ইন্টারভিউ ভালো হইছে না আমার? আদর তো একটু প্রাপ্যই।”

“ছাদ থেকে সবাই দেখছে! নিচে আসুন।”

“দেখুক। আই জাস্ট ডোন্ট কেয়ার। দিবা কিনা বলো? আর ওয়েট করতে পারছিনা।”

উচ্ছ্বাসে এক ধাক্কা মেরে অয়ন্তী রাফায়াতকে তার গাঁ থেকে সরিয়ে নিলো। দৌঁড়ে ছাদ থেকে প্রস্থান নিতে নিতে বলল,,

“দিব না! আগে বিয়ে তারপর যা চাইবেন তা!”

সামনের চুলগুলো টেনে ধরে রাফায়াত মৃদু হাসল। প্রফুল্লিত গলায় বলল,,

“অপেক্ষা!”

অমনি রাফায়াতের দৃষ্টি পড়ল আশেপাশের ছাদ গুলোতে। অয়ন্তী ভুল কিছু বলেনি। সবাই ছাদ থেকে ড্যাব ড্যাব করে তাদের দেখছে। বিষয়টায় অস্বস্তি বোধ করল রাফায়াত। পাশাপাশি ছাদে সিসি টিভি ক্যামেরার মত দাঁড়িয়ে থাকা দুজন মহিলাকে সে উদ্দেশ্য করে বলল,,

“এই? আপনাদের কী খেয়ে দেয়ে কাজ নেই? অন্যের বাড়ির ছাদে নজর দেন কেন হ্যাঁ? কাজ করতে এসেছেন কাজ করে চলে যান। এভাবে বড়ো বড়ো চোখ করে তাকিয়ে আছেন কেন?”

মহিলাগুলো আর কথা বাড়াল না। চ্যালচ্যালিয়ে হেঁটে ছাদ থেকে নেমে গেল! রাফায়াতও অয়ন্তীকে ধাওয়া করতে করতে ছাদ থেকে প্রস্থান নিলো।

_______________________________

মাসখানেকের মধ্যে সত্যিই রাফায়াতের চাকুরীটা হয়ে গেল! যথারীতি সে তার নতুন চাকরীতে জয়েনও হয়ে গেল। মাসিক বেতন প্রায় পঁচিশ হাজারের মত। কাজের ধরণ দেখে কিছু মাস পর বেতনের সংখ্যা আরও বাড়বে। এবার শুধু শুভ দিনক্ষণ দেখে বিয়ের কাজটা সেরে নেওয়ার পালা!

#চলবে…?

#এক_খণ্ড_কালো_মেঘ
#পর্ব_৪৯
#নিশাত_জাহান_নিশি

মাসখানেকের মধ্যে সত্যিই রাফায়াতের চাকুরীটা হয়ে গেল! যথারীতি সে তার নতুন চাকরীতে জয়েনও হয়ে গেল। মাসিক বেতন প্রায় পঁচিশ হাজারের মত। কাজের ধরণ বুঝে কিছু মাস পর বেতনের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। এবার শুধু শুভ দিনক্ষণ দেখে বিয়ের কাজটা সেরে নেওয়ার পালা!

নীল পাড়ের শাড়ি পড়ে হুবহু নীলাঞ্জনা সেজে অয়ন্তী তৈরী আজ রাফায়াতের সাথে ডিনারে যেতে! চাকরী পাওয়ার পর থেকেই অয়ন্তী কেবল ঘ্যান ঘ্যান করছে বড়ো সড়ো একটি ট্রিট দিতে। কিন্তু যথেষ্ট সময় এবং সুযোগের অভাবে রাফায়াত তার সুবিধামত কোনো ডেইট ফিক্সড করতে পারছেনা। যেহেতু আজ তার অফিসে কাজের চাপ অনেকাংশে-ই কম তাই সে আজকের দিনটি-ই সিলেক্ট করল অয়ন্তীকে ট্রিট দেওয়ার জন্যে। তাছাড়া বিয়ের আগে আর হয়ত তাদের একসাথে বের হওয়া হবেনা। দুই পরিবার থেকেই নিষেধাজ্ঞা আছে। বড়োদের নিষেধ অমান্য করে রাফায়াত কিছুতেই তাদের নতুন জীবন শুরু করতে চায়না।

সন্ধ্যা সাতটা থেকেই অয়ন্তুী বেশ তোড়জোড়েই সেজেগুজে তৈরী হচ্ছে। দশ রকমের শাড়ি বের করে সে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ এই শাড়ি ট্রাই করছে তো কিছুক্ষণ ঐ শাড়ি! সমস্ত ঘর লণ্ডভণ্ড করে ফেলেছে সে এই এক প্রকার শাড়ি সিলেক্ট করতে করতে! কোন শাড়িতে তাকে সবথেকে বেশী মানাবে তাই যেন সে কিছুতেই সিলেক্ট করতে পারছেনা। সবশেষে রাফায়াতের ভাবির পছন্দমত অয়ন্তী নীল পাড়ের শাড়িটিকেই সিলেক্ট করল। ব্যস, তার ইচ্ছেমত সেজেগুজে তৈরী হয়ে গেল।

রাত নয়টা নাগাদ রাফায়াতের বাড়ি ফেরার কথা ছিল। অয়ন্তীকে সাথে নিয়ে তাদের কাঙ্ক্ষিত রেস্টুরেন্টটিতে যাওয়ার কথা ছিল। সেই সময় ধরে অয়ন্তী ঠিক সাড়ে আটটা নাগাদ রেডি হয়ে বসে আছে। কারেক্ট নয়টা বাজার সাথে সাথেই সে কল করতে শুরু করল রাফায়াতকে। আর ঠিক তখনি রাফায়াত কোনো কারণে কলটি তুলছিলনা। তবুও ক্ষান্ত হলোনা অয়ন্তী। রাত ঠিক দশটা নাগাদ সে একনাগাড়ে রাফায়াতকে কল করতেই লাগল! এক পর্যায়ে ফোনটি বন্ধ এলো রাফায়াতের। বিরক্ত হতে হতে অয়ন্তী এবার রাগে-দুঃখে-ক্ষোভে অবিশ্রান্ত হয়ে কাঁদতে শুরু করল! রেডি হয়ে এতক্ষণ অপেক্ষা করা যায় নাকি? অয়ন্তীর কান্না দেখে রাফায়াতের ভাবিও এবার মন খারাপ করে রাফায়াতের নাম্বারে কল করতে লাগল। রীতিমত ফোনটি বন্ধ আসছিল। ফোনের চার্জ শেষ হয়ে গেল নাকি অফিসের কোনো জরুরী কাজে আটকে পড়ল কে জানে?

কাঁদতে কাঁদতে অয়ন্তী এক পর্যায়ে তার বাড়ি ফিরে এলো! রুমে ঢুকে প্রথমে সে একটানে তার গাঁ থেকে শাড়িটি খুলে ফেলল। সমস্ত অরনামেন্টস খুলে সারাঘরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফেলল। মুখের সব সাজ সে দু’হাত দ্বারা লেপ্টে দিলো। সম্পূর্ণ অগোছালো হয়ে সে বিছানার উপর উবুড় হয়ে শুয়ে পড়ল। হেঁচকি তুলে অনবরত কাঁদতে লাগল। রাফায়াতের প্রতি মনে মনে তার ক্ষোভ জন্মাতে লাগল! কাজে আটকে গেলে সে অন্তত একটি বার অয়ন্তীকে কল করে খবরটা জানাতে পারত। কিন্তু না, কল তো করলই না। বরং উল্টো অয়ন্তীর কলটিও রিসিভ করছিলনা।

কাঁদতে কাঁদতে এভাবে আরও একঘণ্টা অতিবাহিত হয়ে গেল। চোখমুখ ফুলে অয়ন্তীর ঢোল হয়ে গেল। সমস্ত শরীর ক্লান্ত হয়ে কেমন যেন অসাড় হয়ে এলো। ঘুম ঘুমও পেয়ে গেল। ব্যথাযুক্ত চোখ দুটো অয়ন্তী যেইনা বুজতে যাবে অমনি মনে হলো কেউ তার পায়ে শুড়শুড়ি দিচ্ছে! ঘাবড়ে উঠল অয়ন্তী। বিস্ফোরিত দৃষ্টি ফেলে সে পিছু ফিরে তাকাতেই হঠাৎ ক্লান্ত এবং অবিশ্রান্ত হয়ে ভোলাভালা ফেইস নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা রাফায়াতকে দেখতে পেল! অমনি অয়ন্তী ক্ষেপে গেল। অভিমান আত্নচিৎকার হয়ে বের হতে লাগল। হুড়মুড়িয়ে শোয়া থেকে ওঠে সে রাফায়াতকে ধা’ক্কা’তে ধা’ক্কা’তে রুম থেকে বের করে দিলো! রাফায়াতের মুখের উপর দরজা বন্ধ করার প্রস্তুতি নিয়ে সে চোখের জল ফেলে ঝাঁজালো গলায় বলল,,

“গেট লস্ট ফ্রম হেয়ার। বিয়েটা ক্যান্সেল করলাম আমি! আপনার মুখটাও আমি দেখতে চাইনা আর।”

মুখের উপর অয়ন্তী যেইনা ঠাস করে দরজাটি বন্ধ করতে যাবে অমনি রাফায়াত তার শক্তিশালী হাত দ্বারা দরজাটিকে চেপে ধরল। অনুশোচিত হয়ে কাতর গলায় বলল,,

“প্লিজ লিসেন টু মি অয়ন্তী। বিলিভ মি, আমি বুঝতে পারিনি এভাবে কাজে হঠাৎ আটকে যাব। প্লিজ ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড।”

অয়ন্তীও নাছোড়বান্দা। সে তার শরীরের সমস্ত শক্তি দ্বারা চেষ্টা করছে দরজাটিকে লাগানোর তবে রাফায়াতের অঢেল শক্তির সাথে সে মূলত পেরে উঠছেনা। ক্লান্ত এবং দুর্বল হয়ে উঠলেও সে তবুও হাল ছাড়ছেনা। অয়ন্তীর মুর্ছে যাওয়া অবস্থা দেখে রাফায়াত বিমর্ষ হয়ে উঠল। পুনরায় ভাবুক স্বরে বলল,,

“ব্যথা পাবা তো পরাণ। কষ্ট হচ্ছে না তোমার? এত জেদ দেখাচ্ছ কেন বলো তো? আ’ম সরি না?”

“দেখি সরুন সামনে থেকে। আপনার সাথে কথা বলার রুচি নেই আমার।”

“আচ্ছা বাদ দাও, কথা বলতে হবেনা। শুধু ভেতরে ঢুকতে দাও।”

“একটা অবিবাহিত মেয়ের রুমে আপনার রাত বিরাতে ঢুকার কোনো অধিকার নেই। কোথায় পেয়েছেন এই ব’দ’মা’ই’শি?”

“হ্যাঁ আমি ব’দ’মা’ইশ! অধিকার আছে বলেই বলছি রুমে ঢুকতে দাও আমায়।”

“না। দিবনা। আপনি আমার চোখের সামনে থেকে দূর হয়ে যান রাদিফ। আপনাকে দেখলেই আমার গাঁ জ্বলে উঠছে। লিভ মি এলোন প্লিজ।”

রাফায়াত বুঝতে পেরে গেল মিষ্টি কথায় আর চিঁড়ে ভিজবেনা। তাকে এবার রুড হতে হবে। এতক্ষণ হালকাভাবে দরজাটা আটকে রাখলেও রাফায়াত এবার তার সর্বশক্তি দিয়ে দরজায় সজোরে এক ধা’ক্কা মারল। অমনি অয়ন্তী দরজা থেকে ছিটকে সরে গেল প্রায় অনেকখানি দূরে। তড়িঘড়ি করে রাফায়াত রুমে ঢুকে প্রথমেই ভেতর থেকে দরজাটির খিল আটকে দিলো। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে অয়ন্তী ক্ষুব্ধ রাফায়াতের দিকে তাকাতেই রাফায়াত তেড়েফুড়ে এলো অয়ন্তীর দিকে। হেলে পড়া শার্টের কলারটি ঝেড়ে সে হিংস্র দৃষ্টিতে অয়ন্তীর দিকে তাকালো। ধ’ম’কের স্বরে প্রশ্ন ছুড়ল,

“কী বলছিলা তুমি হ্যাঁ? বিয়ে ক্যান্সেল করবা? আমার মুখটাও দেখতে চাওনা তুমি? একা থাকতে চাও তুমি?”

ভয়ে সিঁটিয়ে গেল অয়ন্তী! পরিস্থিতি যেন ষাট ডিগ্রি এঙ্গেলে ঘুরে গেল। কোথায় অয়ন্তীর জেদ দেখানোর কথা ছিল আর কোথায় এসে রাফায়াত তার সাথে অবাঞ্ছিতভাবে ফাপর নিচ্ছে! হচ্ছেটা কী এসব? ভীরু দৃষ্টিতে রাফায়াতের দিকে তাকিয়ে অয়ন্তী শুকনো ঢোঁক গিলল। কাঁপা কাঁপা গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,

“ঝাড়ি দিচ্ছেন কেন আমাকে?”

“আমাকে বিয়ে করবা না বললা কেন? লেট মি আনসার?”

“আপনি এত লেইট করে আসলেন কেন হ্যাঁ? রাগ হবেনা আমার?”

“বলেছিলাম না কাজে আটকে গিয়েছিলাম?”

“ফোনটা একবার তুললে কী হত?”

“মিটিংয়ে ছিলাম কীভাবে ফোনটা তুলব?”

“মিটিংয়ে যাওয়ার আগে মনে হয়নি খবরটা একবার আমাকে জানানো উচিৎ?”

“আমি কী জ্যোতিষ? যে আগে থেকেই জানতাম মিটিং শেষ হতে এতটা লেইট হয়ে যাবে?”

রাফায়াতের থেকে সূচালো দৃষ্টি সরিয়ে নিলো অয়ন্তী। মাথা নুইয়ে কিছুক্ষণ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল৷ বহু ভেবে রাগ, জেদ সব সংবরণ করল। অতঃপর নাক টেনে মলিন স্বরে বলল,,

“ওকে। বাড়ি যান৷ আমি এখন ঘুমাব।”

“বাড়ি যাওয়ার জন্য আসিনি!”

“তো কেন এসেছেন?”

“রেডি হও।”

আচম্বিত দৃষ্টিতে অয়ন্তী চোখ তুলে রাফায়াতের দিকে তাকালো। বিদ্রুপাত্নক হেসে মিহি স্বরে বলল,,

“কয়টা বাজে এখন?”

“যতটাই বাজুক।”

“পাগলামী করবেন না। বাড়ি ফিরে যান।”

“তুমি নিজে রেডি হবা নাকি আমি রেডি করিয়ে দিব?”

“আরেহ্! পাগল হইছেন আপনি? সাড়ে এগারোটা বাজছে এখন। এত রাতে কোন রেস্টুরেন্ট আমাদের জন্য খোলা থাকবে?”

“সেই ব্যবস্থা আমার করা আছে৷ তোমার এত ভাবতে হবেনা। কুইকলি রেডি হয়ে নাও। আমি ওয়েট করছি।”

“পারব না আমি এখন আবার রেডি হতে। সারাদিন শুধু রেডিই হব নাকি?”

“ওকে ফাইন। আমিই রেডি করিয়ে দিচ্ছি।”

অয়ন্তীকে অবাক করে দিয়ে রাফায়াত মেঝেতে পড়ে থাকা শাড়িটিকে হাতে তুলে নিলো। খুবই সুনিপুণভাবে শাড়িটি অয়ন্তীকে পড়িয়ে দিলো৷ শাড়ির দু’একটা কুঁচি যদিও একটু এদিক থেকে ওদিক হয়েছে তবুও শাড়িটা পড়ানো তার মন্দ হয়নি। সাদা দেখতে একটি রুমাল ভিজিয়ে এনে রাফায়াত অয়ন্তীর লেপ্টে যাওয়া কাজল এবং লিপস্টিকগুলো সযত্নে মুছে দিলো। মুখে হালকা পাউডার মেখে পুনরায় অদক্ষ হাতে অয়ন্তীকে কাজল এবং লিপস্টিক পড়িয়ে দিলো। মনমরা অয়ন্তীর ঠোঁটে এবার মৃদু হাসির রেখা ফুটে উঠল৷ অবিলম্বেই রাফায়াতকে জড়িয়ে ধরে মিটিমিটি হেসে বলল,,

“ইশশশ! কত ভালোবাসে আমাকে।”

স্মিত হেসে রাফায়াত আকুল হয়ে অয়ন্তীকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরল। অভিমান দেখিয়ে বলল,,

“তবুও তো কত রাগ দেখাও আমার সাথে।”

“অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছিলাম তো। তাই রাগ হচ্ছিল বেশী।”

“এখন কমেছে?”

“হুম।”

“তাহলে চলো।”

“আপনাকে ছাড়তে মন চাচ্ছেনা।”

“ওকে, তাহলে ছেড়োনা! আমরা বরং আজ ফার্স্ট নাইটটা সেরে ফেলি!”

তাৎক্ষণিক রাফায়াতকে ছেড়ে দাঁড়ালো অয়ন্তী। এদিকে হেসে কুটিকুটি রাফায়াত! অয়ন্তীকে কীভাবে কন্ট্রোল করতে হয় তার ভালোভাবেই জানা আছে। চুল ঠিক করতে করতে রাফায়াত হাসিখুশি মুখে অয়ন্তীকে বলল,,

“লেটস গো। দেরি হয়ে যাচ্ছে।”

অয়ন্তীর চোখে কেমন যেন নেশা লেগে গেল! রাফায়াতকে পাওয়ার ঘোরে সে আচ্ছ্বাদিত হয়ে উঠল। দ্বিধাদ্বন্দ ভুলে এক’পা দু’পা করে সে রাফায়াতের দিকে এগিয়ে গেল। কোনো দিকে কালক্ষেপণ না করেই সে টুপ করে রাফায়াতের গালে চু’মু খেয়ে দিলো। হিতাহিতজ্ঞান ফিরে পেতেই অয়ন্তী মাথা নুইয়ে নিলো। লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠল। অমনি রাফায়াত উত্তেজিত হয়ে অয়ন্তীর মুখটা উপরে তুলে নিলো। অয়ন্তীর লাজে রাঙা মুখখানির দিকে তাকিয়ে সে অজানায় ডুবে গেল। ভুল করেই অয়ন্তীর কম্পিত ঠোঁট খানা সে দখল করে নিলো! মিনিট পাচেক বাদে দুজনই তাদের ঘোর থেকে বের হয়ে এলো! আর দেরি না করে রেস্টুরেন্টের উদ্দেশ্যে রওনা হলো।

_______________________________

ঘরোয়াভাবে অয়ন্তী এবং রাফায়াতের গাঁয়ে হলুদ সম্পন্ন হলো! যদিও বিশাল বড়ো অনুষ্ঠান করে পূর্ণ জাঁকজমকভাবে অয়ন্তী এবং রাফায়াতের হলুদ থেকে শুরু করে বিয়ে হওয়ার কথা ছিল! তবে হলুদের দিন সকালে-ই একটি লুকায়িত সত্য অয়ন্তীর পরিবারের সামনে এলো! যে সত্যটি জানার পর নড়বড়ে হয়ে ওঠে অয়ন্তীসহ অয়ন্তীর গোটা পরিবার। বিয়ের এলাহি কাণ্ড যেহেতু, তাই পুরোনো স্টোর রুম পরিষ্কার করতে গিয়ে একটি স্যাঁতস্যাতে ডায়েরী খুঁজে পায় অয়ন্তীদের বাড়ির কাজের মহিলা। প্রয়োজনীয় কোনো ডায়েরী মনে করে মহিলাটি খুব যত্ন সহকারে ডায়েরীটি মুছে অয়ন্তীর হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল। আগ্রহ নিয়ে অয়ন্তীও সম্পূর্ণ ডাযেরীটি এক বসাতে পড়ে শেষ করল। ডায়েরীটি শেষ পর্যন্ত পড়ে তার ম’রি ম’রি অবস্থা হয়ে গিয়েছিল! কারণ ডায়েরীটি ছিল অয়ন্তীর বড়ো বোন অনামিকার সু’ই’সা’ই’ডের মূল কারণ সম্পর্কে লিখা!

অনিকের সাথে দীর্ঘ একবছর ধরে প্রেমের সম্পর্ক ছিল অনামিকার! অনিকের মিথ্যে ভালোবাসার ফাঁদে পড়ে অনামিকা ফি’জি’ক্যাল রিলেশানে জড়িয়ে পড়েছিল! চাহিদা মিটে যাওয়ার পর একসময় অনিক অনামিকাকে অস্বীকার করতে শুরু করে! অয়ন্তীর উপর আকৃষ্ট হতে থাকে। অনামিকা কাউকেই এই সত্যিটা তখন মুখ ফুটে বলতেও পারেনি আবার সইতেও পারেনি। আর এসব মানসিক অ’ত্যা’চার সহ্য করতে না পেরেই অনামিকা সু’ই’সা’ই’ড করতে বাধ্য হয়! ডায়েরীতে স্পষ্টভাবে লিখা ছিলঃ “আমার মৃ’ত্যু’র জন্য অনিক দায়ী!” কিন্তু ঘটনাস্থলে সেদিন ডায়েরীটির অস্তিত্ব বিশেষ কোথাও পাওয়া যায়নি। হয়ত অনিক সুযোগ বুঝে ডায়েরীটি স্টোররুমে লুকিয়ে রেখেছিল। পরে হয়ত বা ডায়েরীটি এই স্থান থেকে লো’পা’ট করতে ভুলে গিয়েছিল! যার জন্য সৌভাগ্যক্রমে ডায়েরীটি এখন অয়ন্তীর হাতে পড়ে গেল।

সত্যিটা জানার পরেও অবশ্য এখন কিছু করার নেই। অয়ন্তীর পরিবার অনিককে সা’জা দেওয়ার পূর্বেই স্বয়ং আল্লা’হ তা’আলা তার পা’পের খড়া পূর্ণ করে দিয়েছেন! তবুও বিষয়টি যেন মন থেকে ভুলতে পারছেনা অয়ন্তী এবং অয়ন্তীর পরিবার। শো’কে’র ছায়া নেমে পড়েছে তাদের পরিবারে। মুহূর্তেই বিয়ে বাড়ি যেন ম’রা বাড়িতে পরিণত হয়েছে। একপাশে অয়ন্তী হাউমাউ করে কাঁদছে তো অন্যপাশে অয়ন্তীর মা এবং বাবা। অনিকের মা-বাবাও এখন দেশে নেই! দেশ ছেড়ে তারা আরও একমাস আগেই ভীনদেশে পাড়ি জমিয়েছে। তাছাড়া তারা এখানে থেকেই বা কী করবে? দিনের পর দিন যেভাবে ছেলের কুকীর্তি বের হচ্ছে দেশে থাকলে তো তাদের বেঁচে থেকেও লজ্জায় এবং অনুশোচনায় ম’রে যেতে হত।

রাফায়াত এবং রাফায়াতের পরিবারও অনামিকার বিষয়টা নিয়ে বেশ শো’কা’হ’ত। তাই হলুদের অনুষ্ঠানটি তারা সাদামাটা পালন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। নিয়ম অনুযায়ী বর কনে’কে তো একটু হলুদ মেহেদী পড়াতেই হবে। না হয় বিয়েটা অসম্পূর্ণ দেখাবে। তাছাড়া আত্নীয় স্বজনদেরও দাওয়াত দেওয়া শেষ। সেই জায়গায় বিয়েটা পিছিয়ে দেওয়ারও কোনো অপশন হাতে নেই। তাই এক প্রকার বাধ্য হয়েই রাফায়াত এবং অয়ন্তীকে হলুদ পড়ানো হলো।

রাত তখন গভীর। দুইটার কাছাকাছি প্রায়। ছাদে বসে শোকে নি’থর’ভাবে কাতরাচ্ছে অয়ন্তী! অনামিকার কথা বড্ড মনে পড়ছে তার। অন্যায় করা হয়েছিল সেদিন অনামিকার সাথে। কতটা কষ্ট পেয়ে অনামিকা আ*ত্ন*হ*ত্যা করতে বাধ্য হয়েছিল। সেই কষ্টের কথা মনে পড়লেই অয়ন্তীর গাঁয়ের লোম কাটা দিয়ে ওঠে। অন্তত একটিবারের জন্যে হলেও অনামিকাকে তার দেখতে ইচ্ছে করছে! প্রায় আড়াই বছর হতে চলল অনামিকাকে সে দেখতে পায়না।বড়ো বোনের আদর ভালোবাসা পায়না। ঠুনকো বিষয় নিয়েও এখন খুঁনসুটি হয়না। ঝ’গ’ড়া করে একে অপরের মুখ দেখাদেখিও বন্ধ হয়ে যায়না। কারণ, এখন তো অনামিকা সত্যি সত্যিই তার মুখ দেখানো বন্ধ করে দিয়েছে!

গাঁয়ে কাঁচা হলুদ নিয়েই অয়ন্তী খোলা চুলে হাঁটু ভাজ করে বসে আছে ছাদে। হেঁচকি তুলে অনবরত কাঁদছে আর কাতর গলায় অনামিকাকে ডাকছে! রাফায়াতও গাঁয়ে হলুদের বেশে অয়ন্তীকে খুঁজতে খুঁজতে ছাদে চলে এসেছে৷ অয়ন্তীর এই বি’ধ্ব’স্ত অবস্থা সে দু’চোখে দেখতে পারছেনা। বুঝালেও অয়ন্তী যেন বুঝতে চাইছেনা। দু’বছর আগের ক্ষত তার অতি সূক্ষ্মভাবে তাজা হয়ে উঠেছে। খুব সহজে এই ক্ষত সারবেনা। নীরব হয়ে অয়ন্তীর পাশাপাশি মেঝেতে হাঁটু ভাজ করে বসল রাফায়াত। অয়ন্তীর নুইয়ে রাখা মুখের দিকে সে নিশ্চল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। এইভাবে প্রায় মিনিট পনেরো ধরে রাফায়াত একই দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ক্রন্দনরত অয়ন্তীর দিকে। মেয়েটা এখনও কাঁদছে। কাজল কালো মায়াবী ঐ দু’চোখে কী বিষাদের রঙ মানায়? চারিদিকে তখন থমথমে পরিবেশ বিরাজ করছে। মাঝে মাঝে হিমেল হাওয়ার সাথে পাল্লা দিয়ে অয়ন্তীর শাড়ির আঁচল উড়ে এসে রাফায়াতের সমস্ত মুখে ছিটকে পড়ছে। চুল গুলোকে এলোমেলো করে তুলছে। রীতিমত বেখবর করে তুলছে নিশ্চুপ রাফায়াতকে।

এক পর্যায়ে রাফায়াত অনুভূতিশূণ্য হয়ে অয়ন্তীর মাথায় হাত বুলালো! ছোটো আওয়াজে বলল,,

“আর কত কাঁদবে?”

পাশে রাফায়াতের উপস্থিতি টের পাওয়া মাত্রই যেন অয়ন্তীর কান্নার ঢেউ দ্বিগুন বেড়ে গেল! ডুকরে কেঁদে ওঠে সে ভরসার মানুষটিকে পেয়ে পাশ ফিরল। মুহূর্তেই রাফায়াতকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরল। অস্পষ্ট গলায় কাঁদতে কাঁদতে বলল,,

“ভেতরটা আমার চিঁড়ে যাচ্ছে রাদিফ। যদি আপনাকে দেখাতে পারতাম! আপুর সাথে অন্যায় করা হয়েছে। আমরা করেছি সেই অন্যায়৷ আপুকে কখনও বুঝতে চাইনি আমরা। আপু কী বলতে চায় কখনো শুনতে চাইনি। যদি আপুকে একটা সুযোগ দেওয়া হত তবে হয়ত আপু নিজের ভেতরের কষ্টটা আমাদের শেয়ার করতে পারত। ভেতরটা হালকা হত। আমরাও সেই অনুযায়ী কোনো একটা ব্যবস্থা নিতে পারতাম। অনিক জা’নো’য়া’রটাকে চূড়ান্ত একটা শা’স্তি দিতে পারতাম। আপুকেও তখন এভাবে অকালে ঝড়ে যেতে হত না।”

দীর্ঘশ্বাস ফেলল রাফায়াত। অয়ন্তীর মাথায় শান্তনার হাত বুলালো। স্পষ্ট গলায় বলল,,

“অনিক তার পা’পে’র শা’স্তি পেয়ে গেছে অয়ন্তী। সবাই তার কর্ম অনুযায়ী ফল পাবে এটাই স্বাভাবিক। অনামিকাও কিন্তু তার ব্যতিক্রম নয়! জীবনে যাই হয়ে যাক না কেন কখনো আমাদের আ’ত্ন’হ’ত্যার পথ বেছে নেওয়া উচিৎ নয়৷ তওবা করে আল্লাহ’র কাছে ফিরে যাওয়া উচিৎ। অনামিকা চাইলেই তার খারাপ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে পারত। যেমনটা আমি পেরেছিলাম! এমন তো নয় যে অনামিকাকে কেউ মন থেকে চাইত না। অনামিকার কোনো ভরসার হাত ছিল না। আমি শুনেছিলাম অনামিকাকে তার ব্যাচমেট এক ছেলে পাগলের মত ভালোবাসত। অনামিকা চাইলেই হয়ত পারত তার হাত থেকে অন্ধকার জগৎ থেকে বের হয়ে আসতে। ভুল থেকে শিক্ষা পেতে। অনামিকার অতীত জানার পরেও ছেলেটি বীরদর্পে অনামিকাকে গ্রহণ করত সে বিষয়েও আমার কোনো সন্দেহ ছিলনা। চাইলেই অনামিকা নতুনভাবে তার জীবনটাকে শুরু করতে পারত। অ’প’রাধীকে এভাবে জিতিয়ে দিত না। অনামিকা যা করেছে ভুল করেছে অয়ন্তী। সরি টু সে অয়ন্তী, এক্ষেত্রে আমি অনামিকাকে একটুও সাপোর্ট করতে পারছিনা!”

“এভাবে বলবেন না রাদিফ। আপুর জন্য দো’য়া করুন প্লিজ। আল্লাহ যেন আমার আপুকে কবরের আজাব থেকে মুক্ত করে। একটু স্বস্তি দেয়। প্রশান্তি দেয়।”

“একটা কথা বলব অয়ন্তী?”

“বলুন?”

“ধরো। যদি কখনও এমন দিন আসে আমি নেই তোমার পাশে। হারিয়ে গেলাম এই পৃথিবী থেকে! তখন কী তুমি অনামিকার মতই এই ভুল কাজটি করবে?”

আতঙ্কে সঙ্গে সঙ্গেই কেঁপে উঠল অয়ন্তী। বিপুল ভয়ার্ত হয়ে সে রাফায়াতের গাঁ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো। বি’স্ফো’রিত দৃষ্টিতে টলমল চোখে তাকিয়ে থাকা রাফায়াতের দিকে তাকালো! কম্পিত গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,

“আপনি কোথায় যাবেন রাদিফ?”

হুট করে কেন যেন রাফায়াতের গলা শুকিয়ে এলো! চোখের কোণে অবাধ্য জলেরা চিকচিক করে উঠল। আচমকাই সে আবেগ আপ্লুত হয়ে উঠল। অয়ন্তীর ভীতিকর মুখের দিকে তাকাতেই তার কষ্টের মাত্রাটা যেন অতিরিক্ত বেড়ে গেল!

#চলবে…?