এক চিলতে সিঁদুর পর্ব-১৯

0
363

#এক_চিলতে_সিঁদুর
#পর্ব_১৯
#অধির_রায়

ডক্টর রিপোর্ট গুলো নির্বণের দিকে এগিয়ে দেন। নিয়তির করুণ চাহনি ডক্টরের দিকে৷ ভয়ে হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে৷ ডক্টরের মুখ গুরুগম্ভীর হয়ে আছে৷ ডক্টর মলিন কন্ঠে,
“মিসেস নিয়তি আপনার লাইফ রিস্ক আছে৷ আমি চাই, আপনি সন্তানকে এবোরশান করে নেন৷”
.
ডক্টরের কথা শুনে নির্বণ, নিয়তি দুই জনই আকাশ থেকে পড়ে৷ নিয়তি ভাবতেই পারেনি এমন কোন আশঙ্কা ৷ নিয়তি চোখ মুখ শুকিয়ে কাট হয়ে গেছে৷ দু’জনেই কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে৷ নির্বণ ভয়ে ভয়ে বলে উঠেন,
“ডক্টর আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে৷ আপনি ভালো করে আবার রিপোর্ট গুলো দেখেন৷”
.
“আমি কিছু ভুল বলিনি৷ গতকাল নিয়তির রিপোর্ট দেখে আমিও বিশ্বাস করতে পারিনি৷ সেজন্য আজ নিজে দাঁড়িয়ে থেকে নিয়তির সবগুলো চেক আপ করিয়েছি৷”
.
নির্বণ ভাঙা ভাঙা কন্ঠে বলে উঠে,
“রিপোর্টে কি আসছে৷ প্লিজ আমাদের একটু বুঝিয়ে বলেন!”
.
ডক্টর দীর্ঘ একটা শ্বাস নিয়ে বলে উঠেন,
“নিয়তির দেহে হিমোগ্লোবিনের উৎপন্ন পরিমাণ খুব কম। যার ফলে প্রয়োজনের তুলনায় কম ব্লাড উৎপন্ন হয়৷ এমন অবস্থায় আপনার স্ত্রী সন্তান নিলে আপনার স্ত্রী এবং সন্তান উভয়ের জীবন সংকট আছে৷ সেজন্য বলবো আগে আপনার স্ত্রীকে সুস্থ করে তুলেন৷ তারপর আপনারা সন্তান নেওয়ার চিন্তা করেন৷”
.
নিয়তি চিৎকার করে বলে উঠে,
“আমি কিছুতেই আমার সন্তানকে হত্যা করতে পারবো না৷ আমি তাকে এই পৃথিবীতে নিয়ে আসবো৷”
.
ডক্টর নিয়তির দিকে তাকিয়ে দু’জনকেই উদ্দেশ্য করে বলেন,
“আপনারা বুঝার চেষ্টা করেন৷ আপনার গর্ভে এখনো সন্তান আসেনি৷ এখনও ভ্রুণ রয়েছে৷ এমন অবস্থায় এবোরশান করলে কিছুই হবে না৷”
.
নিয়তি ডক্টরের দিকে অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে,
“আপনি সব মিথ্যা বলছেন৷ আমি কিছুই বিশ্বাস করিনা৷”
.
নিয়তি দৌড়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে যায়৷ নির্বণ নিয়তির পিছন পিছন দৌড়ে চলে আসে৷ এক দৌড়ে বাহিরে গাড়ির কাছে আসে৷ গাড়ির দ্বার খোলে গাড়িতে বসে কান্না শুরু করে। নির্বণ নিয়তির কাঁধে হাত রাখে৷
.
নিয়তি কান্না করতে করতে,
“আমি বাড়িতে যাব এখনই৷ আমি আর এক মিনিটও লেট করতে চাইনা৷”
.
নির্বণ নিয়তির মুখের দিকে তাকিয়ে আর কিছু বললো না৷ ডক্টরের সাথে আর কিছু না বলেই নিয়তিকে বাড়িতে নিয়ে আসে৷
__________

নিয়তি চুপচাপ রুমে এসে দরজা বন্ধ করে দেয়৷ নিজেকে আর আটকিয়ে রাখতে পারলো না৷ পেটে হাত রেখে কান্না করতে থাকে। নির্বণ দরজার বাহির থেকে নিয়তিকে হাঁক দিয়ে যাচ্ছে৷ নিয়তি কান্না করেই যাচ্ছে। নির্বণের কোন কথা নিয়তির কান অব্ধি পৌঁছাচ্ছে না৷ নির্বণের চিৎকারের শব্দ শুনে নির্বণের মা তাদের রুমের সামনে আসে৷ নির্বণের পীঠে হাত রেখে বলে উঠেন,
“নিয়তিকে কিছু সময়ের জন্য একা ছেড়ে দাও৷ সে কান্না করে নিজের কষ্ট কমানোর চেষ্টা করছে৷ কান্না করলে কষ্ট অনেকটা কমে যায়। ”
.
নির্বণ তাঁর মাকে নিয়ে তার মায়ের রুমে আসে৷ মায়ের কোলে মাথা রেখে নির্বণও কান্না করতে থাকে৷ নির্বণের মা নির্বণ মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে৷ ছেলের কান্না দেখে মায়ের চোখও ছলছল করছে৷ চোখ থেকে না চাইতেও অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে৷
.
কিছু সময় পর নির্বণের মা নির্বণের দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন। নির্বণের মাথায় বিলি দিয়ে,
“কি হয়েছে? তোমরা দু’জনেই এভাবে ভেঙে পড়ছো কেন?”
.
নির্বণ কান্না জড়িত কন্ঠে বলে উঠে,
“মা ডক্টর যা বলেছে সব ভুল বলেছে৷ নিয়তির কিছু হয়নি৷ সব রিপোর্ট ভুল এসেছে৷”
.
আভয় বানী দিয়ে বলেন,
“কি হয়েছে? আমাকে একটু খোলে বলো৷”
.
“আমাদের বাচ্চাকে এবোরশান করাতে বলে৷ নিয়তি তার সন্তানকে এবোরশান করাবে না৷ সে পৃথিবীতে নিয়ে আসতে চায়।”
.
“এবোরশানের পিছনে নিশ্চয় কোন কারণ আছে৷ কারণ ছাড়া ডক্টর এবোরশানের কথা বলতে পারতো না৷”
.
“নিয়তির দেহে ব্লাডের পরিমাণ খুব কম৷ ডক্টর বলেছে এমন অবস্থায় সন্তান নিলে লাইফ রিস্ক আছে৷ পরবর্তীতে সন্তান নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন৷”
.
“ডক্টরের কথা মেনে নেওয়াই ভালো। আমি কাউকে আর হারাতে পারবো না৷ হারানোর কষ্ট আমি জানি৷ তুমি নিয়তিকে বুঝিয়ে বলো৷ সন্তান পরে নিতে পারবে৷ এখনো ভ্রুণ আছে৷ এবোরশান করলে তেমন কষ্ট হবে না৷”
.
“কিন্তু নিয়তি…”
.
নির্বণকে থামিয়ে দিয়ে,
“আমার কাছে নিয়তির জীবনের মূল্য অনেক বেশি৷ আমি চাইনা অকালে কেউ মৃত্যুর কোলে ঢেলে পুড়ুক।”
.
নির্বণ মাথা নিচু করে,
“ওকে মা৷ আমি নিয়তিকে বুঝানোর চেষ্টা করবো৷ এবোরশান একমাত্র রাস্তা তাকে বুঝাবো আমি।”
.
“তোমাকে প্রয়োজন হতে পারে৷ তুমি নিয়তির কাছে যাও৷”
_________

নিয়তি কান্না করতে করতে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছে৷ নির্বণের ডাক শুনে নিয়তি দরজা খোলে। নির্বণকে দেখেই নিয়তি জড়িয়ে ধরে৷ কান্না করতে থাকে৷ মাথায় হাত ভুলিয়ে নিয়তিকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করে৷
.
রাতে না খেয়ে নিয়তি নির্বণকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়ে৷ নিয়তি ঘুমিয়ে পড়লেও নির্বণের চোখে ঘুম নেই৷ বার বার নিয়তির ইনোসেন্ট মুখটা দিকে তাকাচ্ছে। একদম ছোট বাচ্চার মতো ঘুমিয়ে আছে৷
.
নির্বণ নিয়তির দিকে তাকিয়ে থেকে কখন ঘুমিয়ে পড়ে জানা নেই৷ জীবন চলার পথে কতো বাঁধা কতো বিপদ আসে৷ এখন ধীরে ধীরে জীবন চলার পথের বাঁধা বিপত্তি গুলো জানতে পারছে৷
.

মাঝ রাতে নিয়তির ঘুম ভেঙে যায়৷ নিয়তি ঘুম থেকে উঠে ডক্টরের কথাগুলো কানে বাজাতে থাকে৷ সব সময় এক কথা কানে বাজে এবোরশান৷ নিয়তি উঠে বসে৷ পেটে হাত দিয়ে,
“আমি তোমার কিছু হতে দিব না৷ আমি আমার সমস্ত শক্তি দিয়ে তোমাকে বাঁচাবো৷ তুমি কোন চিন্তা করো না৷ ডক্টরগুলো টাকার লোভে মিথ্যা কথা বলে৷”
.
নিজেকে নানা ভাবে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছে৷ শুকানো কথায় চিঁড়া ভিজে না৷ তেমনি যতই নিজেকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করুক না কেন বারং বার এবোরশানের কথা কানে আসে৷
.
নির্বণের পায়ের কাছে বসে কান্না করে দেয়৷ কান্নার শব্দ পেয়ে নির্বণের ঘুম ভেঙে যায়৷ নির্বণ ঘুম থেকে উঠে দেখে নিয়তি আবারও কান্না করছে৷ নির্বণ নিয়তির কাছে আসে৷ নিয়তিকে বিছানায় বসিয়ে বলে উঠে,
“তুমি কি চাও? তুমি যা চাইবে তাই হবে! তোমার কথার কোন অমান্য করবো না৷”

কথাগুলো বলার সময় বার বার চোখে জল এসে পড়েছিল৷
.
নিয়তি নিজের উদরে হাত রেখে,
“আমি আমার বাচ্চার সাথে কোন অন্যায় করতে পারবো না৷ আমি আমার বাচ্চাকে পৃথিবীর আলো দেখাতে চাই৷”
.
নিয়তির চোখের জল মুছে দিয়ে,
“তুমি কোন চিন্তা করো না৷ তোমাকে এবং আমাদের ভালোবাসার কিছু হতে দিব না৷ আমি অন্য ডক্টরের কাছে নিয়ে যাব তোমাকে৷”
.
নিয়তি হতভম্ব হয়ে বলে উঠে,
“আমি আর ডক্টরের কাছে যাব না৷ আমি ডক্টরদের বিশ্বাস করি না৷”
.
নির্বণ ভারী শ্বাস ফেলে গম্ভীর কণ্ঠে,
“আমি তোমার কথা রেখেছি৷ তুমি আমার কথা মতো চলবে এখন৷”
.
নিয়তি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়৷ নিয়তির চোখ থেকে আবার অনবরত অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। নির্বণ নিয়তির চোখের জল মুছে দেয়৷ নিয়তিকে বুকে জড়িয়ে শুয়ে পড়ে৷
_____

পরের দিন সকাল বেলা নির্বণ নিয়তি অন্য ডক্টরের কাছে যায়। ডক্টর কিছু বলার আগেই নির্বণ বলে উঠে,
“আমি আগে আপনাকে কিছু কথা বলতে চাই৷”
.
ডক্টর হাসি মুখে বলে উঠে,
“কোন কিছু লুকানোর প্রয়োজন নেই৷ আপনাদের কথা শুনে খুশি হলাম৷ অন্যরা তো লজ্জার কারণে বলতে পারে না৷”
.
নির্বণ মাথা নিচু করে,
“আমরা চাই আমাদের সন্তানকে পৃথিবীতে নিয়ে আসতে৷ কিন্তু নিয়তির দেহে হিমোগ্লোবিন উৎপন্ন হয় কম৷ এবোরশান ছাড়া এর থেকে মুক্তি পাওয়ার কোন উপায় নেই৷”
.
ডক্টর নির্বণ কথা শুনে কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে বলে উঠেন,
“আমি আপনার কাছ থেকে কিছু লুকাতে চাইনা৷ আপনি যে সমস্যার কথা বললেন৷ সে সমস্যা থাকলে এবোরশান করাই ভালো৷ যদি এবোরশান না করে বাচ্চাকে পৃথিবীর আলো দেখাতে চান তাহলে একটা উপায় আছে৷”
.
নিয়তি আনন্দের সাথে বলে উঠে,
“কি উপায় ডক্টর? যতই কষ্ট হোক না কেন, আমি সব সহ্য করে নিব৷”
.
“আপনাকে প্রচুর পরিমাণ সবুজ শাকসবজি, ফলমূল খেতে হবে৷ মেডিসিন রেগুলার খেয়ে যেতে হবে৷ সব থেকে বড় কথা হলো…”
.
নির্বণ অতি আগ্রহ নিয়ে,
“কি হলো থেমে গেলেন কেন? আমরা সব কিছু করতে প্রস্তুত৷ নিয়তিও ভালো থাকবে তো৷ আমি মা, বাচ্চা দুই জনকেই চাই৷”
.
ডক্টর মলিন কন্ঠে,
“আপনার স্ত্রীর বাচ্চা নরমালে হওয়ার সম্ভাবনা নেই৷ রিপোর্ট দেখে যা বুঝতে পারলাম৷ অপারেশনের সময় আপনার স্ত্রীর প্রচুর পরিমাণের রক্ত ক্ষরণ হবে৷ তখন উনার জীবন সংকটে পড়তে পারে যদি পর্যাপ্ত পরিমাণ ব্লাড না পাওয়া যায়।”
.
নির্বণ নিয়তির দিকে তাকিয়ে,
“আপনাকে ব্লাড নিয়ে কোন চিন্তা করতে হবে না৷ আমি ব্লাডের ব্যবস্থা করে নিব।”
.
নিয়তিও মনে ভয় নিয়ে মুখে সাহস দেখিয়ে বলে উঠে,
“আপনাকে ব্লাড নিয়ে কোন চিন্তা করতে হবে৷ আপনি আমার সন্তানকে ভালোভাবে পৃথিবীতে নিয়ে আসেন৷ সবকিছু সৃষ্টি কর্তার হাতে আমি অর্পণ করলাম৷ আমি জানি উনি আমাদের সাথে খারাপ কিছু করবেন না৷”
.
ডক্টর মুচকি হেঁসে,
“আপনাদের মনে সব সময় এমন সাহস বজায় রাখবেন৷ দেখবেন সৃষ্টি কর্তা আপনাদের নিরাশ করবেন না৷”
.
নিয়তিকে উদ্দেশ্য করে,
“আপনাকে প্রতি মাসে চেক আপ করতে হবে৷ মেডিসিন মিস দেওয়া কোন ভাবেই চলবে না৷ আমার কথামতো সব সময় চলতে হবে৷ আমি আপনাকে একটা রুটিন করে দিব চব্বিশ ঘণ্টার৷”
.
নিয়তি দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে উঠে,
“কোন চিন্তা করতে হবে না৷ আমি সব সময় আপনার কথা মতো চলবো৷ আমি আমার সন্তানের গায়ে কোন প্রকার আঁচ লাগতে দিব না৷”
.
পৃথিবীতে মা জাতীর কোন তুলনা হয়না৷ নিজের জীবন নিশ্চিত সংকটে জেনেও সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখাতে ব্যস্ত। পৃথিবীর সকল মা জাতীর প্রতি সম্মান ও ভালোবাসা রইল।

চলবে…..