এক টুকরো মেঘ পর্ব-২৬

0
650

#এক_টুকরো_মেঘ ☁️
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব::২৬

চোখের কোনে জমে এলে অশ্রু। না চাইতেও দুফোটা গড়িয়ে পড়লো নিচে ।। এই অশ্রু কষ্টের নয় বরং আনন্দের ।। আমার ঠিক সামনে হাজার হাজার জনশ্রতার মাঝে এককোণে চুপটি করে দাঁড়িয়ে আছে ,, আমার প্রিয় মানুষটি ,, অরিশ।।যার চাওনি স্থীর হয়ে আছে আমার চোখে।। আমি সত্যিই ভাবতে পারিনি ,,সে আসবে।।চোখ ফিরিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে আবার তার দিকে তাকালাম।। কিন্তু দেখতে পেলাম না।। অরিশকে সবসময় খুব করে মিস করি তাই হয়তো,, তিনি শুধু আমার কল্পনা হয়েই এখানে এসেছিলো।।বুক চিড়ে বেরিয়ে এলো দীর্ঘ হাহাকার ।। আমারই হয়তো ভুল হয়েছিলো ,, কল্পনা আর বাস্তবের মানুষ দুটিকে মিলাতে ।। সুর ধরার আগ মুহূর্ত আমার চোখ গিয়ে আটকে গেল বাহিরে থাকা বাইকটার দিকে ।। সেখানে অরিশ বাইকের সাথে হেলান দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।। বাইকটা তার নিজের।। এটাও কি আমার সাজানো কল্পনা ,, নাকি বাস্তব ভাবতে ভাবতে হাতের মধ্যমা আর বুড়ো আঙুল দিয়ে কানের পেছনে চিমটি কাটতেই আহহ করে উঠলাম।। সামনে অরিশকে হাসতে দেখে বুঝতে পারলাম ,, অরিশ আমার সাজানো কল্পনা ,, জল্পনা নয় ।। ইশারায় গান ধরতে বললো।। আমিও একটা মুচকি হাসি দিয়ে প্রোগ্ৰামে মন দিলাম।।

_________________

কিছুক্ষণ আগে প্রোগ্ৰাম শেষ হয়েছে।।প্রতিটা সময় বারবার আড় চোখে অরিশের দিকে তাকিয়ে ছিলাম।। আর তিনিও মুগ্ধ হয়ে গান শুনছিলেন।। শুধু তিনি নয় ,,,সেখানে সবাই মুগ্ধ হয়ে শুনছিলো ।। গান শেষে আমার অনেক প্রশংসাও করছিলো ।।অটোগ্ৰাম ,,সেলফি ইত্যাদি করতে করতেই ১২ টার বেশি বেজে গেছে।। আসার সময় খেয়ে আসতে বলেছিলো ,, কিন্তু আমি যে অরিশে বিভোর তাই না খেয়েই চলে এসেছি।। বাইকের সাথে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে আছে অরিশ।। ঠোঁটের কোনে রয়েছে মৃদু হাসি।। আমি ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে গা থেকে ওরনাটা খুলে অরিশের তৈলাক্ত মুখটা মুছিয়ে দিয়ে আবার শরীরে পেঁচিয়ে নিলাম।। তিনি তার শক্তপোক্ত পুরুষনালি হাতটা এগিয়ে দিয়ে আমার হাতটায় আলতো চুমু খেয়ে বাইকে উঠে বসলেন।।।দৃষ্টি তার দিকে স্থির রেখে শান্ত গলায় বললাম।…..

— আপনি তো অফিসে গিয়েছিলে ।।তাহলে হঠাৎ এই ক্লান্তমাখা শরীর নিয়ে এখানে কেন আস্তে গেলে ?? তাছাড়া তোমাকে কে বলেছে ,, আমরা এখানে এসেছি !!এখানে এসে শুধু শুধু তোমার সময় নষ্ট হলো ,, কালকে আবার তাড়াতাড়ি অফিসে যেতে হবে‌। এমন করলে তোমার শরীর অসুস্থ হয়ে যাবে।।

আমার একহাত ধরে টান মেরে বাইকের সামনের সিটে বসিয়ে দিলেন।। পেছন থেকে জরিয়ে ধরে কাঁধে থুতনিটা রেখে ক্লান্তিমাখা কন্ঠ বললো….

— কে বলেছে তোমার প্রিয়শ্রী ।।তুমি আমার ক্লান্তি ।।তোমায় দেখলে ,,আমার একটুকুও ক্লান্তি লাগে না বরং আমার যতটুকু ক্লান্তি থাকে তা এক নিমেষেই কেটে যায় ।। আবার তোমার এই মুখটা না দেখলে আগের থেকে যেন দশ গুণ ক্লান্তি এসে আমার দেহে ভীর করে ।। (মাতাল করা সিদ্ধ হাসি দিয়ে)

— ভাইয়া তুমি কখন এলে তোমাকে তো দেখতে পেলাম না।। যদি বলতে একসাথেই আসতে পারতাম ।। একসাথে আসলেই কতো মজা হতো ।।(আরশি)

ইতিমধ্যে আরশি আর ফারহান এসেও হাজির হয়েছে ।। আরশি কথা শুনে একবার ওদের দিকে তাকিয়ে দুচোখ বুলিয়ে আবার আমার দিকে নজর দিয়ে বললো

— আসার কোনো ইচ্ছে ছিলো না।সারাদিন অফিসে প্রচুর কাজ ছিলো ।।আর কাল অফিসের কোনো আজও থাকবে না ,,ছুটি নিয়েছি ।। সারপ্রাইজ আছে ,, তারজন্যই আজকে ঘুড়বো আর কালকে ঘুমাবো।।

— কি সারপ্রাইজ ভাইয়া বল,, বল।।(আরশি)

— সেটা কালকে দেখতে পারবি।।(ফারহানকে উদ্দেশ্য করে অরিশ)আরশিকে একটু বাড়িতে পৌঁছে দিও ।।আমার আর তরীর ফিরতে দেরী হবে।।

নিচের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়লাম ফারহান ।
যার অর্থ হ্যা।। তারপর অরিশ বাইক চালাতে মন দিলেন।।পিছন থেকে আরশি আহমকের মতো আমাদের দিকে তাকিয়ে ছিলো ,, হয়তো কিছুই বুঝে উঠতে পারে নি।। শুধু আরশি কেন আমিও তো কিছুই বুঝতে পারি নি।।
অরিশের বুকে মাথা রেখে পেছন থেকে তার গলা জরিয়ে ধরে রেখেছি।। আর তিনি আমার কাজে মুচকি হেঁসে ড্রাইভ করছে ।। আচ্ছা ছেলেটা এতো আন রোমান্টিক কেন?? দেখতে পারছেন আমি তাকে জরিয়ে ধরে আছি ,, সেও তো জরিয়ে ধরতে পারে।। গালে দুটো চুমু খেতে পারে ।। কিংবা বাইকটা কোথাও থামিয়ে প্রেম করতে পারে ।। কি সুন্দর একটা রাত ,, কালকে তো অফ আছে ,, তাহলে সমস্যা কোথায়।। এইরকম আরো উদ্ভর করে ভেবে মুখ ফুলিয়ে বসে আছি আমি ।।
কিছুক্ষণ পর বাইক এসে থামলো একটা ছোট টং এর দোকানে।। কিন্তু আমি তো চা ছোটবেলা থেকেই খাই না ,, তাহলে এখানে থামানোর মানেটা খুঁজে পাচ্ছিনা।। তিনি বাইক থেকে নেমে ,, আমার হাত ধরেও নিচে নামালেন।।।তারপর গাড়িটা একপাশে সাইড করে রেখে ,,, আমার আঙ্গুলের ফাঁকে নিজের আঙ্গুল ঢুকিয়ে দিয়ে টং এর দোকানের দিকে এগুতে লাগলেন।
দোকানের সামনে পড়ে থাকা একটা বেঞ্চিতে বসে আমাকেও টেনে তার পাশে বসিয়ে দিলেন।। তারপর সামনের ছেলেটাকে উদ্দেশ্য করে বললো…..

— সজল এখানে দুই কাপ চা দে ।।

সজল নামের ছেলেটা আমার দিকে তাকিয়ে একটা রহস্যময় হাসি দিয়ে বললেন…

— আসসালামুয়ালাইকুম ভাবী সাহেবা?? কেমন আছেন ভাবী সাহেবা??

— অলাইকুম আসসালাম ।।জি ভাইয়া আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি ?? আপনি কেমন আছেন??

— আমিও ভালো আছি ।। আপনি এখানে এসেছেন আমি খুব খুশি হয়েছি ।।ভাইতো প্রায় প্রায় আসে ,, কখন আপনাকে নিয়ে আসে না !!! আপনার কথা প্রায়ই জিজ্ঞাসা করতাম কেন নিয়ে আসে না ।। আজকে জানতে পারলাম আপনি একজন বড় মাপের সেলিব্রেটি ,, আমার দোকানে বসার জায়গা নেই তাই আনে না।।

— কে বলেছে আপনার দোকানে বসার জায়গা নেই।।এইতো আমি বসেছি ,, আবার কতো জায়গা ফাঁকাও রয়ে গেছে।।

এক কথা দুই কথা বলতো বলতে ছেলেটা হাজার কথা শুরু করে দিয়েছে ,, যাতে আমি রিরক্ত ছাড়া আর কিছু হতে পারছি না।।আমার কথা হয়তো অরিশ বুজতে পেরেছে ,, তাই সজলকে একটা ঝাড়ি দিয়ে চা আনতে বলেছে ।। সামান্য কিছু সময় পর চা এসে হাজির হলো ,, আমি চায়ের দিকে তাকিয়ে থেকে অরিশের দিকে তাকিয়ে বললাম…

— তুমি তো জানো আমি চা খাই না।। তারপরও এখানে এনে কেন চা অর্ডার করলে ।। করেছো যখন করেছোই ,, এবার একা একা খাও ‌।

— চা খেলে কি হয় ,, যাতে তুই চা খাস না।।

— কারন ,, চা খেলে ঠোঁট পুড়িয়ে যায়।। আর আমি চাই
না চা খেয়ে আমার এতো সুন্দর ঠোটটা পুড়িয়ে ফেলতে ।।(অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে আমি)

— লাইক সিরিয়াসলি চা খেলে ঠোঁট পুড়ে যায়।।হাউ ফানি তাই না।।আমি তো স্কুল লাইফ থেকে এখানে এসে ফ্রেন্ডদের চা খেয়ে যেতাম ।।তারপর ভার্সিটি লাইফে চা খেতাম।। এখন অফিস লাইফে একা এসে খেয়ে যায় ।। কিছুদিন পর বিয়ে হলে ,, বউ নিয়ে এসে চা খাবো।। তারপর বাচ্চা ,, নাতি নাতনি নিয়ে এসে খাবো।।

হাতে চায়ের কাপ তুলে নিয়ে আমার দিকে এগিয়ে দিলো ।। শত অনিচ্ছা থাকার সত্ত্বেও চায়ের কাপে চুমুক দিলাম।। এতেই বাজলো ঘোর বিপওি।। আমার ঠোঁটে ছেকা খেয়ে হাত থেকে কাপটা পড়ে গেল।। আমি হাত দিয়ে ঠোঁট দুটি হালকা হালকা ঘসছি।।

— গাধা একটা সামান্য একটা চায়ের কাপও কন্টোল করতে পারে না ।।

বলেই নিজের হাতে থাকা চায়ের কাপে ফু দিয়ে আমার সামনে ধরলেন। আমিও কাপে চুমুক দিলাম।। সত্যি চা টা অনেক টেস্টি হয়েছে ।। এটা তেঁতুল চা ,, যেটা আমি প্রথমবার খেয়েছি।।এভাবে কেটে গেল বেশ কিছুক্ষণ।। একটা চায়ের কাপ থেকে চা খাওয়ার মুহুর্ত টা অসাধারন ছিলো।।তারপর বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে এলাম।। পুরোটা রাস্তায় অরিশের হাত ধরে হেঁটেছি ।। আর তিনি একহাতে বাইক সামলেছে আর অন্য হাতে আমার হাত ধরে ছিলেন ।

_____________________

লাল রঙের শাড়ি পড়েছি আমি।। সাথে মেচিং করা হালকা জুয়েলারি ।। তার মধ্যে রয়েছে ,, কানের একজোড়া ঝুমকো ,, হাতে বালা।। নাকে ছোট এক পাথরের নথ ।। গলায় তেমন কিছু নেই।। ঠোঁটে হালকা গোলাপি রঙের লিপস্টিক,, চোখে গাঢ় কালো কাজল।। আমি অবশ্য এগুলো পড়তে চাইনি ,,,অরিশ এগুলো দিয়ে গেছে ।।‌ কোথায় একটা যাওয়ার আছে তাই।

সবাই রেডি হয়ে বেরিয়ে গেছে।। কিন্তু কোথায় যাচ্ছি কেউ বলছে না।। আরশির পড়নেও সেইম ডিজাইনের শাড়ি ,, কিন্তু সাজটা অনেক গর্জিয়াস।।কোথায় যাচ্ছি সেও জানে না।। দুপুরের কাঠফাটা রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে এইসব চিন্তা করতে বিরক্তি লাগছে।।মনের মধ্যে চরম বিরক্তি নিয়ে গাড়ির দরজা খুলে বসে পড়লাম।। কোথা থেকে রাফি এসে গাড়িতে বসে ড্রাইভ করতে লাগলো ।। কোথায় যাচ্ছি জিজ্ঞাসা করতে কোনো উত্তর দিলো না।। প্রথমে রাফিকে দেখে ভালো লাগলেও ,, বর্তমানে ওর চুপ করে থাকা দেখে বিরক্তি লাগছে ।।এই গাড়িতে পেছনে আমি আর আরশি ,,, অন্য গাড়িতে সবাই।।হয়তো আমার রাগারাগিতে অন্য গাড়িতে আসছে।।
গাড়ি এসে থামতেই সবাই গাড়ি থেকে নেমে ভেতরে চলে গেলো ।। আমি আর আরশি ইতিমধ্যে কয়েকটা সেলফি তুলে নিয়েছি ,, এফবিতে আপ দিবো বলে।।

_________________

বর্তমানে চুপ করে সবাই বসে আছি ফারহানদের ড্রয়িং
রুমে।। একটু আগে জানতে পেরেছি আজকে আরশি আর ফারহানের ইনগেস্ট ।। ওদের সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্যই ব্যাপারটা লুকানো হয়েছে ।। কিন্তু আমাকে কেন জানালো না ‌।।আমি মাথা নিচু করে মুখ ফুলিয়ে বসে আছি।। অরিশ একটা রিং করে আরশির হাতে দিয়ে ফারহানকে পড়িয়ে দিতে বললো ।। আরশি রিংটা তুলে নিয়ে ফারহানের হাতে পড়িয়ে দিলো।। ফারহানও তার বাবার হাত থেকে একটা রিং তুলে নিয়ে রাশির অনামিকা আঙ্গুলে পড়িয়ে দিলো‌।। মুচকি হাসি দিয়ে সেও মাথা আমার মতো নিচু করে নিলো।। আমার মনটাও নিমিষেই খারাপ হয়ে গেল ।। আজ যদি আরশি আর ফারহানের সাথে আমার আর অরিশের ইনগেস্টটাও হয়ে যেত তাহলে কি বড্ড খারাপ হতো‌।। আমার ভাবনার মাঝেই অরিশ এসে আমার সামনে হাঁটু গেঁড়ে বসে পড়লো!!!!!

চলবে…🎀