এক টুকরো মেঘ পর্ব-২৮

0
488

#এক_টুকরো_মেঘ ☁️
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব::২৮

বিয়ের আসর থেকে পালিয়ে এসেছি আমি প্রিয় মানুষটির খোঁজে।। আরশি আর ফারহানের বিয়ের পরও অরিশ ফিরে এলো না ।। একটু আগে একটা আননোন নাম্বার থেকে ফোন এসেছে।। রিসিভ করার পর জানতে পারি অরিশকে কিডন্যাপ করা হয়েছে।। তখন পাপা নিজের সম্মান বাঁচাতে তার ছেলেবেলার বন্ধুর ছেলের সাথে আমার বিয়ে ঠিক করে।। একদিকে নিজের ভালোবাসার মানুষটির বিপদ অন্যদিকে পাপার জোর করে অন্যছেলের সাথে বিয়ে দেওয়া ।।মেনে নিতে না পেরে বেলকেনির সাথে শাড়ি বেঁধে পালিয়ে এসেছি আমি।। নির্জন,,অন্ধকার রাস্তা ।।আসে পাশে কাউকে দেখা যাচ্ছে না,, যার কাছে অরিশের খবর জানতে পারবো ।।কিন্তু মনের মাঝে একটা কথাই বিরল ,, যেভাবেই হোক অরিশের খবর আমাকে জানতে হবে।। অরিশের ভাবনায় বিভোর হয়ে যখন এদিক ওদিক তাকে খুঁজছিলাম ,, তখন কেউ এসে আমার মুখে স্প্রে ছিটিয়ে দিলো।। হাজারবার চোখ খোলা রাখার চেষ্টা করেও খোলা রাখতে পারলাম না ।। নুইড়ে পড়লাম নির্জন রাস্তায়।। মনের মাঝে তখন একটা কথাই বাজছিলো ,, যেভাবেই হোক অরিশের খবর চাই ।।

_________________

পিটপিট করে চোখ খুলে তাকালো আমি।।চোখজোড়া গিয়ে আটকে গেল সামনে থাকা অরিশের দিকে।। তিনি এক ধ্যানে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।।হয়তো আমার চোখ খোলার অপেক্ষায় প্রহর গুনছিলো।।আমি আস্তে আস্তে বেড থেকে নেমে অরিশের সামনে গিয়ে ,, তাকে ঝাপটে ধরে কুপিয়ে কুপিয়ে কেঁদে দিলাম।। হঠাৎ একসময় অরিশের কিডন্যাপ হওয়ার কথাটা মাথায় আসতেই মুখ তুলে তাকালাম তার দিকে ।।অরিশের মাথা ফেটে রক্ত বের হচ্ছে।। যাতে তার পরনের টি শার্টটা ভিজে গেছে।।চোখ মুখ একদম শুকিয়ে গেছে,,,দেখে মনে হচ্ছে সকাল থেকে কিছুই খায়নি।।হাত পা পেঁচিয়ে একটা শিকল দিয়ে বেঁধে রেখেছে ।। আমি তাকে ছেড়ে দিয়ে শিকল খুলতে ব্যস্ত হয়ে গেলাম।। কিন্তু খুলতে পারলাম না ,,কারন শিকল দিয়ে বেঁধে তালা দিয়ে রেখেছে।। আমার ক্লান্ত শরীর নিয়ে অরিশের বুকে মাথা রেখে দীর্ঘ শ্বাস নিলাম।। হঠাৎ দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলো ৩ জন।।মুখে বিচ্ছিরি হাসি।। রুমে ঢুকে চেয়ারে বসে বলতে লাগলো….

— কি সোনামনি শিকল খুলতে পারলেই না তো।।আমি না চাইলে এই শিকল এই জীবনেও খুলবে না।।আর অরিশ আর তুমি এখান থেকে একপাও বাহিরে ফেলতে পারবে না।।(তাদের মধ্যে একজন)

এদের আমার খুব চেনা চেনা লাগছে।। কিন্তু কোথায় দেখেছি ঠিক বলতে পারবো না ।।এখন মনেও পড়ছে না।। শুধু এইটুকু জানি এদের আমি চিনি ,, দেখেছি ।।।আমি যখন তাদের চিনতে ব্যস্ত তখনই আরেকজন বলে উঠলো…

— কি শোনামনি চিনতে পারলে না।। এতো সহজে আমাদের ভুলে যাবে বুঝতে পারিনি ।।তবে চিন্তা করো না আমি মনে করিয়ে দিচ্ছি ।। তুমি তোমার পেটের দিকে তাকাও।। দেখো কি কিছু দেখতে পারছো কিনা ।।
ছেলেটার কথা শেষ করার আগেই আমি একটু ঝুঁকে আমার পেটের দিকে তাকালাম।। যেখানে আমার পেটের উপর টেটুটা জ্বলজ্বল করছে।।আমি তো আমার পেটে সিগারেটের দাগটা লুকাতে টেটু করেছিলাম।। তাহলে কি তারা।। ভাবতে ভাবতেই মুখ থেকে আপনাআপনি বের হয়ে গেল,,”” আপনারা তারা””

— নাহিদ ।।আমি নাহিদ ।। যে তোমাকে গত কয়েক বছর ধরে পাগলের মতো খুঁজছে।। সামান্য একটু সিগারেট চেপে ধরেছিলাম বলে আমার একটা চোখ নষ্ট করে দিয়েছে ,, উম্মাদের মতো মেরেছিলো ।। তারপর আবার পুলিশে দিয়েছিলো।। সেদিনের পর থেকে তোদের খুঁজছি।। আজকে অনেক কষ্টে অরিশকে এখানে নিয়ে এসেছি।।এখন তোর এই দেহের এমন অবস্থা করবো যে ,, পৃথিবীর কোনো টেটু দিয়ে মুছতে সেই কলঙ্গ মুছতে পারবি না।।(নাহিদ)

— তোদের এই অবস্থা করার জন্য সম্পূর্ণ আমি দায়ী ।।যা করার আমাকে কর তবুও আমার কলিজাটার কোনো‌ ক্ষতি করিস না।। প্লিজ ওকে ছেড়ে দে!!( করুন সুরে অরিশ)

আমি অরিশের টি শার্টের কিছু অংশ শক্ত করে চেপে ধরে আছি,, পারলে তো অরিশের বুকের ভেতরে ঢুকে যাই ।।খুব ভয় করছে।।ওরা আমাকে অরিশের কাছে থেকে টেনে এনে একটা মোটা লাঠি দিয়ে আঘাত করলো অরিশের মাথায়।। তারপর সেলোটিপ লাগিয়ে দিলো ।। সাথে সাথে মাথা বেয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়লো।।আমি মাথায় হাত দিয়ে চিৎকার করে নিচে বসে পড়লাম।। নিজের ভালোবাসার মানুষটির এমন অবস্থা দুচোখে সহ্য করতে পারছি না।।বুকের ভেতরে যেন দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে।।।।

___________________
রাত ::৪টা

এলোমেলো হয়ে বেডে শুয়ে আছি আমি।।চোখের দৃষ্টি স্থীর হয়ে আছে অরিশের দিকে ।। তিনি চোখজোড়া বন্ধ করে আছে।। পরনের ছেঁড়া শাড়িটা কোথাও একটা পড়ে আছে।। ব্লাজের হাতাটা ছিঁড়ে আছে।।মাঝে মাঝে জমে আছে রক্তের বিন্দু।। চোখের ও ঠোঁটের কাজল লিপস্টিক লেপ্টে আছে পুরো মুখে ।। একটু আগে নিজের সতিত্ব নামক জিনিসটা হারিয়ে বসে আছি ।। তারা নিজেদের লালসার চাহিদা মিটায়েছে আমাকে দিয়ে ।। শুধুমাত্র আর্তনাদ,, চিৎকার করা ছাড়া কোনো উপায় ছিলো না আমায়।। ছোটবেলা থেকেই অরিশের মুখের দিকে তাকালে আমার সব কষ্ট মুছে যেত,,আজও অরিশের মুখের দিকে তাকিয়ে সব সহ্য করেছি।।আর অরিশ আমার আর্তনাদ সহ্য করতে না পেরে নিজের মাথায় আঘাত করেছে ।। আর হম হম করেছে ।।
কয়েকঘণ্টার ব্যবধানে জীবনের মোড় এতোটা পাল্টে যাবে ভাবতে পারিনি ।।ইচ্ছেটা যে এভাবে উড়াল দিয়ে পালিয়ে যাবে ভাবতে পারি নি।। এই সময়ে অরিশের সাথে বিয়ে হয়ে ওর বুকে মাথা রেখে গুটিসুটি মেরে ঘুমানোর কথা।। কিন্তু সেটা আর সম্ভব নয়।।
আমি ধীর পায়ে হেঁটে অরিশের কাছে গিয়ে ওর বুকে মাথা রাখলাম ।। নিজের বুকে আপন কাউকে অনুভব করতে চোখ মেলে তাকালো তিনি।। চোখ দিয়ে আমার মাথা থেকে পা পর্যন্ত পরখ করে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন।। চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়লো কয়েক ফোঁটা অশ্রু।। দেশের বাহিরে থাকা সময় শুনেছিলাম,, অরিশ আমার জন্য কেঁদে ভাসিয়েছে ।। কিন্তু তা আমার দ্ধারা দেখা সম্ভব নয়।।না দেখাটাই ভালো ছিলো ‌।এতো কষ্ট হতো না।।আমি অরিশের থেকে একটু দূরে স্বরে নিজের দিকে তাকালাম।।
একসময় যেই চোখে আমার জন্য অপরিসীম ভালোবাসা খুঁজে পেয়েছিলাম।। সেই চোখে আজ করুনা,, সহানুভূতি ,, ভালোবাসা একসাথে দেখতে পারছি।।

— অরিশ তুমি আমাকে ওদের হাত থেকে বাঁচাতে পারলে না।।কেন পারলে না ,, প্লিজ বলো।। তুমি ভয় পেয়েছো না ,, এইসব কিছুর দোষ আমি একদম তোমায় দিবো না।। এটা আমার ভাগ্যে হয়তো ছিলো ।। শুধু একটা বলবে ,, সেদিন কেন এতোবড় কথাটা বললে তুমি ।।কেন আমাকে পতিতালয়ে গিয়ে টাকা উপার্জন করতে বললে ।।আজ আমার অনেক টাকা পয়সা আছে‌,,, তবুও আজ আমি আর একজন পতিতার মতো কোনো পার্থক্য নেই।। কেন এমন হলো অরিশ ।কেন তোমার আগে ওদের বাজে হাত আমায় স্পর্শ করলো ,, কেন আমাকে সমাজের চোখে ছোট করে দিলো ।। একটু আগে কতো স্বপ্ন নিয়ে আমি বউ সেজে বসে ছিলাম তুমি আসবে বলে আর এখন দেখো সব নষ্ট হয়ে গেছে।।কতোটা খুশি ছিলাম যানো,, যতোটা হলে একজন বিয়ের কনে সবার সামনে নাচতে পারে ততটা।। একটু আগে সোস্যাল মিডিয়ায় আমার বিয়ে নিয়ে হইচই ছিলো ,, এখন হয়তো আমার নিখোঁজ হওয়ার নিয়ে হইচই।।আর কিছুক্ষণ পর আমার এই অবস্থা নিয়ে হইচই পড়ে যাবে।। সত্যি বলছি অরিশ আমি এইসব সহ্য করতে পারবো না।।আমি মুক্তি চাই আমার এই জীবন থেকে ।।বেঁচে থাকলে সকলের বাজে কথা আমাকে সহ্য করতে হবে ,, তারচেয়ে বরং মরে যাই।।এইসব আর সহ্য করতে হবে না।।একটা কথা জানবো ,, ভালোবাসার মানুষটির জন্য নাহয় আমিও পৃথিবী ছাড়লাম।। ভালো থাকো ,, সুখে থাকো । সুন্দর দেখে একটা মেয়েকে বিয়ে করে নিও।।আর দেখো তোমরা খুব সুখী হবে।।একটা কথা মনে রাখবে ,, তোমার আর আমার মাঝে যে #এক_টুকরো_মেঘ ☁️ বিদ্যমান ।।সেটা এই জীবনে কখনো সরবে নয়।। সারাজীবন আঁকড়ে ধরে থাকবে।।।

অরিশ শুধু হম হম করেছে ।।কিছুই বলতে পারছে না।।খুব কষ্ট হচ্ছে,, নিজের মানুষটাকে অন্য আরেকজনের
সাথে বিয়ে করে সুখী হতে বলায়।। কিন্তু আমি যে নিরুপায়।। চারপাশে খুজে আমার বউ সাজার ওরনাটা খুজে পেলাম।। আর পাশে একটা টুল খুঁজে পেলাম।।এনে বেডের উপর রেখে তার উপর দাঁড়িয়ে গেলাম।। তারপর হাতের ওরনাটা ফ্যানের সাথে ভালোভাবে বেঁধে নিয়ে ,, গলায় পেঁচিয়ে পায়ের নিচ থেকে টুলটা ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলাম।। বুঝতে পারছি মৃত্যুর কোলে ঢুলে পরছি ।।কখনো ভাবিনি আমার জীবনেও এমন কিছু হবে।। পাপা সবসময় বাঁচতে শিখিয়েছে।। কিন্তু বাঁচা যে আমার ভাগ্য লেখা নেই।। রেডিও ,, টিভি চ্যানেল,, সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেক আত্মহত্যার কথা শুনেছি ,, বুঝতে পারিনি ,, সেই লিস্টে আমারও নাম চলে আসবে।।বুঝতে পারিনি যেই ওরনাটা পরে বিয়ের স্বপ্ন দেখেছিলাম,, সেটাই আমার মৃত্যু কারন হবে।।। হঠাৎ এক সময় বুজতে পারলাম,,চোখ জোড়া চেয়েও খুলে রাখতে পারছি না,, তখন খুব করে বুজতে পারলাম আমার জীবনের সমাপ্তি হয়তো এখানেই ঘটবে ।।অরিশের দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে চোখজোড়া বন্ধ করে নিলাম।।

— প্লিজ তরী ।।আমাকে এভাবে নিঃশ্ব করে দিয়ে তুই চলে যাস না বাঁচবো না আমি।। আমার জন্য তো নিজের সবকিছু দিয়ে দিলি ।। অন্তত আমার জন্য তোর জীবনটা বাঁচিয়ে রাখ।।আমি তোকে কথা দিচ্ছি ,, যে হাত দিয়ে ওরা তোর পবিত্র শরীরটা অপবিত্র করেছে ,, ওদের কাউকে আমি ছাড়বো না।।রাস্তায় কুকুরের মতো ফেলে মারবো।। প্লিজ তরী ফিরে আয় ।।গোটা সমাজের বিরুদ্ধে গিয়ে আগলে রাখবো আমি তোকে সারাজীবন ।। সেদিন বলেছিলাম না ,, দরকার পরলে তোকে নিয়ে অজানা রাজ্যে পাড়ি দিয়ে ,,আজও তাই বলছি ,, চলে যাবো তোকে নিয়ে অজানা ,, অচেনা কোথাও ।।ফিরে আয়।। (মনে‌ মনে চিৎকার দিয়ে কথাগুলো বললো অরিশ)

নিচের দিকে তাকিয়ে আছে অরিশ ।।কারন তার কথা আর ভালোবাসার মানুষটির কাছে পৌছাচ্ছে না।।আর তার মৃত দেহ দেখার ক্ষমতা অরিশের নেই।। আজ সে অপারক তার ভালোবাসার কাছে।।

চলবে…🎀🎀