#এক_টুকরো_মেঘ ☁️
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব::২৭
আমার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে ,,নিজের হাতটা মেলে এগিয়ে দিলো আমার দিকে।। আমি ছলছল চোখে অরিশের দিকে তাকিয়ে নিজের বাম হাতটা তার মেলে দেওয়া হাতটার উপর রাখলাম।। তিনি একহাতে আমার হাতটা শক্ত করে ধরে অন্যহাতে পকেট থেকে একটা জুয়েলারি বক্স বের করল ।। খুলতেই দুটো ডায়মন্ডের রিং চকচক করে উঠলো।।সেখান থেকে একটা রিং তুলে অরিশ আমার হাতের অনামিকা আঙ্গুলে পড়িয়ে দিলেন।। আমার হাতটা একটু উপরে তুলে নিজের উষ্ণ ঠোঁটের পরশ ছুঁয়ে দিলো।। সাথে সাথে একটু কেঁপে উঠলাম আমি।। সারা শরীরে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল।। চোখজোড়া বন্ধ করে নিলাম ।।অরিশ আমাকে ছুতেই অদ্ভুত একধরনের অনুভূতি ফিল হলো।। চোখ জোড়া খুলেতেই অন্য একটা রিং এগিয়ে দিলো অরিশ।। রিং টা হাতে তুলে নিয়ে অরিশের মধ্যমা আঙ্গুলের ডগা ধরে আলতো হাতে রিংটা পড়িয়ে দিয়ে ,, লজ্জায় মাথাটা নিচু করে নিলাম।। পরক্ষনেই হাতে তালির শব্দ শুনতে পেলাম।।
যতবারই আঙুলের ফাকে থাকা রিংটার দিকে নজর যায় ঠিক ততবারই বুকের ভেতর এক অদ্ভুত অনুভূতি কাজ করে ।। একটু আগেও ভেবেছিলাম,, যদি আরশি আর ফারহানের মতো আমার আর অরিশের সাথে আজ,, এখানে ইনগেস্ট টা হয়ে যেত ,, তাহলে কতোটা ভালো হতো ।। আমার ইচ্ছেটা যে চোখের পলকে বাস্তবে রুপ নিবে ,, সেটা আমার কল্পনার বাহিরে ছিলো।
___________________
গাড়ি ছুটেছে নিজের আপন গতিতে,, ছুটছে সময় ।। আমার পাশে অরিশ শান্তমনে ড্রাইভ করছে,, আর আমি লজ্জায় মাথা নিচু করে আছি।। জানি না ,, এতো লজ্জা কোথা থেকে এসে আমার কাছে দানা বেঁধেছে।। ড্রাইনিং টেবিলের সবার সাথে বসে যখন ডিনার করছিলাম ,, তখনও কারো দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারিনি।। আমার এতো লজ্জা পাওয়া দেখে তো প্রথমে ফারহানের মা ধরেই নিয়েছিলো ,,যে আমিই তার পুত্রবধূ ।। তখন আরশির মুখটা দেখার জন্য ছিলো।। বেচারীর দিকে একদম তাকানো যায় নি।। আমি অরিশের হাতের বাজে হাত ঢুকিয়ে দিয়ে ,, একসাথে দুজনের হাতে থাকা রিং দুটোর দিকে তাকিয়ে আছি।। রিং দুটো পাশাপাশি অনেক সুন্দর লাগছে।। তিনি শক্ত করে হাতের মুঠো ধরে আমাকে তার বুকে টেনে নিলেন।। একহাতে আমাকে জরিয়ে ধরে আছে ,, অন্যহাতে ড্রাইভ করছে।। আর আমি তার বুক থেকে মাথা তুলে ,, তার বুকে আঁকি ঝুঁকি করছি।।
কিছুক্ষণ পর গাড়ি এসে থামলো একটা পার্কের সামনে।। তিনি গাড়ি থেকে নেমে আমার হাত ধরে নামিয়ে ভেতরের উদ্দেশ্য এ হাঁটা দিলাম ।। কোথাও বিন্দুমাত্র আলোর দেখা নেই ,,, সবকিছু ঘোলাটে অন্ধকার।।চাঁদের স্নিগ্ধ আলোয় চারপাশটা আবছা আবছা দেখা যাচ্ছে।। কিছুটা দূরে গিয়ে আমাকে দাড় করিয়ে ,, তার পকেট থেকে একটা রুমাল বের করে ,, চোখজোড়া বেঁধে দিলেন।।। তারপর আবার হাঁটতে লাগলেন।। এতোক্ষণ যা একটু আবছা আবছা দেখতে পারছিলাম,, এখন একদম অন্ধকার ছাড়া কিছু দেখা যাচ্ছে না।। দু’পা আস্তে আস্তে এগিয়ে পরের পা ফেলতেই শাড়িতে বেঁধে পড়ে গেলাম আমি ।। তিনি আমাকে নিচ থেকে তুলে দাঁড় করিয়ে হঠাৎ করেই কোলে তুলে নিলেন।।
পিটপিট করে চোখ খুলে তাকালাম আমি।।অনেকক্ষন চোখজোড়া বন্ধ থাকাতে সামনে কিছুই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না।। ঘোলাটে অন্ধকার।। সামনের সবকিছু পরিস্কার হয়ে আসতেই ,, থমকে গেলাম আমি।। আমার সামনে অসংখ্য প্রদীপ দিয়ে ভালোবাসি কথাটি লেখা আছে ,, আজ পর্যন্ত কেউ আমাকে এভাবে ভালোবাসি বলে জানান দেই নি।। মুহুর্তেই ছলছল করে উঠলো আমার চোখজোড়া ।। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছি না।আজ একটার পর একটা সারপ্রাইজ পাবো ভাবতে পারি নি।। পাশে অরিশের দিকে তাকালে ,, তাকে খুঁজে পেলাম না,, এতোবড় একটা পার্কে আমাকে একা রেখে কোথায় গেল।। হঠাৎ একটা শীতল কন্ঠের স্বর শুনে শান্ত হলাম আমি।। কন্ঠস্বরটা আমার ঠিক পেছন থেকে আসছে ,, একটা পেছনে ফিরে পরখ করে নিয়ে শান্ত হলাম আমি।। পেছনে থাকা মানুষটি আমার দুগালে হাত রেখে শান্ত দৃষ্টিতে বলতে লাগলো…
— ভালোবাসি প্রিয় ।খুব ভালোবাসি !! জানি তোমার মতো এতোটা বাসি না,, কিন্তু বাসি।। ছোটবেলা থেকে তোমার প্রতি আমার একটা অদ্ভুত অনুভুতি হতো,, সেটা ভালোবাসা নাকি মোহ জানতাম না ।।আর আজও জানি না।।জানতেও চাই না।।যদি তুমি আমার মোহ হও ,, তাহলে বারবার ,, হাজার বার তোমার মোহে আমি আসক্ত হতে চাই ।।(একটু থেমে আবার),যখন তুমি আমার কাছে ছিলে না ,,তখন বুঝতে পেরেছি ,, তুমি ছাড়া আমি অচল ।।আজ পর্যন্ত কখনো তোমাকে
আমার ভালোবাসা সম্পর্কে জানাই নি।। কখনো দেখিনি তোমার চমকে যাওয়া লজ্জাত্র মুখটা ।তাই আজকে একেরপর এক চমক দিয়ে ,, তোমার মুখটা দেখছি ,, থাকবে সারাজীবন আমার পাশে ,, তোমার রঙিন ভালোবাসা দিয়ে রাঙিয়ে দেবে আমার জীবনটা ।।
— আচ্ছা অরিশ ।।জীবনে যদি কখনো এমন পরিস্থিতি আসে,, যখন সমাজের চোখে ,,প্রতিটি মানুষের চোখে আমি বাজে হয়ে গেছি।। তোমার ভালোবাসার অযোগ্য হয়ে গেছি ।।তখন তুমি পারবেনা তোমার এই সামান্য ভালোবাসা দিয়ে গোটা সমাজটাকে বদলে দিতে।।পারবে না তোমার এই বুকে শক্ত করে আমাকে আগলে রাখতে।।(আমার গালে থাকা অরিশের হাতের উপর হাত রেখে)
— জানি না আদও তা সম্ভব কিনা ।।তবে কথা দিচ্ছি যদি সমাজটাকে বদলাতে না পারি ,, তখন তোমাকে নিয়ে পাড়ি জমানো অজানার রাজ্য ,,, যেখানে আমি আর তুমি ছাড়া সব বিরল।।(আমার কপালে নিজের ঠোঁট দুটি ছুইয়ে দিয়ে অরিশ)
আমি অরিশের হাতের থেকে হাত সরিয়ে দিয়ে ,, তাকে খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম।। তিনি আমাকে ছাড়িয়ে সামনে দিকে হাঁটা দিলেন।। দুপাশে প্রদীপ দিয়ে সাজানো আর মাঝখানে বিভিন্ন ফুলের পাপড়ি দিয়ে সাজানো রাস্তা ।। সেখান দিয়ে আমরা হেঁটে যাচ্ছি।। একটু হেঁটে সামনে যেতেই একটা ছোটপুল দেখতে পেলাম ।।পুলের ভেতরের পানিগুলো নীল রঙের ,, ভেতরে বরফের টুকরো আর পিটপিট করে জ্বলা কিছু প্রদীপ ভাসছে ।। ভেতরে ছোট একটা নৌকাও রয়েছে ।।আমার হাত ধরে নৌকায় বসিয়ে দিয়ে তিনিও আমার পাশে বসে ,, নৌকা চালিয়ে মাঝ বরাবর এনে থামলেন ।। তারপর পকেট থেকে একটা লকেট বের করে আমার গলায় পড়িয়ে দিলেন ।। আমি অরিশের কোলে উঠে বসে আলতো হাতে তার গলা জরিয়ে ধরে পুলের ঠান্ডা পানিতে পা ভেজালাম।। আমার সাথে অরিশও নিজের পা ভেজালো।। অনেকদিন দিন পর এভাবে একটা মুহূর্ত কাটালাম ।।জানি না আবার কবে একসাথে কাটাবো।।সাক্ষী হয়ে রইলো ও দূর আকাশের চাঁদ আর হাজারও তারারা।।।।।
______________
বউ সেজে বসে আছি আমি ,, আরশি ।। আজ একসাথে আমাদের বিয়ে হবে।। আমার রুমে বসে আছি ।।একটু আগে পার্লারের মেয়েরা এসে আমাদের দুজনকে সাজিয়ে দিয়ে গেছে।।
সময় খুবই বহমান ।।কখন চলে যায় তার হিসেব নেই , সেদিনও অরিশের সাথে সারারাত একসাথে কাটালাম।। তারপর বিয়ের শপিং ,, সাজগোজ,,গায়ে হলুদ সব ছিলো অন্যরকম অনুভূতি ।। আর আজকে বিয়ের কনে সেজে অরিশের আসার জন্য অপেক্ষা করছি ।। কখন সে আসবে আর আমাকে তরী থেকে তার তরীরানী করে নিয়ে যাবে ।।মনটা বারবার ছটফট করছে তাকে দেখার জন্য,, নিশ্চিই বরবেসে তাকে একদম রাজকুমারের মতো লাগছে ।। আমার রাজ্যের রাজকুমার।। আমার ভাবনার ছেদ ঘটালো সামিরা…
— এতো লজ্জা পেতে নেই বোন ।।অরিশ ভাই এক নিমেষেই তোর লজ্জা দূর করে দেবে দেখিস !!
বর্তমান যুগের ছেলে মেয়েগুলো এমন কেন ?? দেখতে পারছে লজ্জায় মরছি ,, তবুও আরো লজ্জা দিচ্ছে ।। ভেতরে ভেতরে আনন্দও হচ্ছে ।।ইচ্ছেতো করছে লুঙ্গি ডান্স দেই।।নিজের এই ইচ্ছেটা আর দমিয়ে রাখতে পারলাম না।।বেডের উপর উঠে দাঁড়িয়ে শাড়ি ধরে ডান্স শুরু করে দিলাম।।।
— ও ছেরী তোর বিয়ে হবে ঘোমটা মাথায় দিয়ে হবে ।। ও ছেরী তোর বিয়ে হবে সাজনা তলায় গিয়ে হবে।।ও ছেরী তোর বিয়ে হবে রে ,, বিয়ে হবে রে ,, বিয়ে হবে রে !!!
আমি তো ইচ্ছে মতো ডান্স করছি ।।হঠাৎ দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো কয়েকজন জার্নালিস্ট।।তাদের দেখে আস্তে করে ডান্স থামিয়ে দিয়ে নিচে বসে পড়ি ।।
— ম্যাম আপনি যদি কিছু মনে না করেন কিছু কথা জিজ্ঞাসা করতে পারি !!
— কেন নয়।। বলুন আপনারা কি জানতে চান সব উত্তর দিবো।
— ম্যাম আপনি তো আপনার বিয়ে নিয়ে অনেক এক্সাইটেড ।।শুনেছি আপনার ভালোবাসার মানুষের সাথেই বিয়ে হচ্ছে।। অনেক জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানের মাঝে একসাথে দুই বান্ধুবীর বিয়ে হচ্ছে।।এখন আপনার অনুভূতি গুলো যদি সেয়ার করেন ??যার জন্য দেশ ছেড়ে ছিলেন তাকেই আবার বিয়ে করলেন কেন??
— প্রথমে আসা যাক এক্সাইটেড কথাটায়।।আপনারা তো নিজের চোখেই দেখলেন ,, আমি এতো আনন্দিত যে, নিজের বিয়েতে নিজেই ডান্স করছে ।। মানুষ তার ভালোবাসার সবচেয়ে বেশী সুখী থাকে ।।হ্যা আমি ৫ বছর তাকে ছেড়ে দূরে চলে গিয়েছিলাম ।। কিন্তু আজও আমি তাকে ছাড়া অপূর্ণ ।।সে তার ভুলগুলো স্বীকার করে নিয়েছে আর আমিও তাকে ছাড়া অন্য কারো সাথে সুখী হতে পারবো না।।তাই অরিশের জীবনে আবার ফিরে এসেছি ।। মানুষকে একবার হলেও তো সুযোগ দেওয়া উচিত যাতে সে তার ভুল সুরে নেয়।।বাকি রইলো অনুভুতি,,, সেটা বলে বোঝানো যাবে না,, একদিকে ভালোবাসার মানুষটির সাথে নতুন জীবন শুরু করা ,, অন্যদিকে আমার বেস্ট ফ্রেন্ডের ভাবী হওয়ার।। দুই বান্ধুবী একসাথে বউ সেজেছি।। সব মিলিয়ে বলে শেষ করা যাবে না।। ছোটবেলা থেকে আমাদের সবকিছু একসাথে ,, বিয়েটাও যে একসাথে হবে ভাবতে পারি নি।।তাই একটা কথা বলতে পারি সবদিক থেকে লাকি আমি ।।( একটা স্নিগ্ধ হাসি দিয়ে আমি)
পরক্ষনেই একটা কথা কানে আসতেই আমি একবারে স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছি ।। মুখ থাকা স্নিগ্ধ হাসিটা যেন এক নিমেষেই উধাও হয়ে ,, নিঃশ্বাস ভারী হয়ে এলো ।।অরিশকে সকাল থেকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।। সকালে আমার জন্য কিছু একটা কেনার কথা বলে বাড়ি থেকে বেড়িয়েছে ,, এখন সন্ধ্যা ৭ টার বেশি বাজছে,, তবুও তার ফেরার নাম নেই।।কাজি সাহেব এসে ইতিমধ্যে ফারহান আর আরশির বিয়ে পড়ানোর কাজ শুরু করে দিয়েছে।। কি করবো কিছুই বুঝতে পারছি না।। মাথায় হাত দিয়ে ,, ঢুকড়ে ঢুকড়ে কেঁদে উঠছি আমি।। হঠাৎ ফোনের রিংটোন বাজতেই রিসিভ করে নিলাম ।। পরক্ষনেই বাজ পড়লো আমার মাথায়।।
চলবে….🎀