এক ফালি সুখ পর্ব-২১+২২

0
345

#এক_ফালি_সুখ🌼 |২১| [অতীত উন্মোচন]
#তাসনিম_জাহান_মৌরিন
রুবেল সায় জানালো,অর্থাৎ সে বলে দেবে সবাইকে। তবে এই চিরকুট মৌরিন এর ব্যাগে কে রেখেছে সেটা বুঝতে পারলো না মৌরিন। এক কথায় বোঝার চেষ্টাই করলো না, এসব নিয়ে মাথা ঘামানোর কোনো ইচ্ছে নেই মৌরিন এর। তবে সেই আগন্তুক যে এই বাড়িতেই আছে সেটা আর বোঝার বাকি রইলো না।
শুটিং শেষ হলো আজকের মতোন, সকলে নিজেদের ড্রেস চেঞ্জ করে স্থান ত্যাগ করলো। মৌরিনও একই ধারায় বেরিয়ে এলো বাড়ি থেকে। কাল অন্য যায়গায় শুটিং হবে, আবারো শেষের দিনের শুটিং হবে এই বাড়িতে।

আজ আর রিক্সায় উঠলোনা মৌরিন, ঢাকায় আসার পর থেকে শুটিং সেট আর বাড়ি ব্যাতীত অন্য কোথাও যাওয়াই হয়নি। সিলেটে থাকতে ভীষণ ভ্রমণপ্রেমী ছিলো সে, ছোটবেলা থেকে স্বাধীনচেতা মৌরিন। নিজের মতোই চলাফেরা করতো, বিভিন্ন যায়গায় ঘুরতে যেতো। আজও একটু ঘুরতে ইচ্ছে হলো মৌরিন এর, ঢাকা শহরের একটা যায়গায় যাওয়ার ইচ্ছে ছিলো তার,সেটা হলো নীলক্ষেত। আর দেড়ি করলোনা মৌরিন, নিজের ইচ্ছেকে প্রাধান্য দিয়েই চলে গেলো সেই বইয়ের রাজ্যে। মন শান্ত রাখার জন্য এমন এক জায়গায় চলে আসার বুদ্ধিটা বেশ ভালোই কাজ করে।
প্রায় ত্রিশ মিনিট এর মতো ঘোরাঘুরি করে দুটো বেশ পুরনো বই নিলো মৌরিন, পড়ার জন্য নিয়েছে নাকি এমনিতেই সেটা জানা নেই তার। হয়তো সেই পুরনো বইয়ের কাটা মলাট তার ভালোলেগেছিল,তাই নিয়েছে। ঘড়িতে তখন সময় দুপুর তিনটের কাছাকাছি। তাই আর বেশিক্ষণ রইলো না সেখানে, বাসে উঠে চলে এলো নিজের বাসায়।
বইদুটো ব্যাগে রাখতে গিয়েই দেখলো ফোনটা বাজছে। মৌরিন হাতে নিলো ফোনটা। নাহিদ এখন পর্যন্ত আরো বারোবার কল করেছে, এবার সত্যিই বিরক্ত হলো মৌরিন। দু সেকেন্ড ও অপেক্ষা না করে নম্বরটা সযত্নে ব্লাকলিস্ট এ রেখে দিলো। জীবনের কালো অধ্যায়ে আসা মানুষগুলোর স্থান এখানেই হওয়া উচিৎ, তাই করেছে মৌরিন।

ফোনের কভার পিকচার এ থাকা ফ্যামিলি ফটোটার দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে রইলো মৌরিন। বাবা নামক ব্যক্তির উপর তার অনেক রাগ থাকা উচিৎ, তবুও যেন রাগ করতে পারেনা। নিজেকে বোঝায়, বাবা তাকে আরো স্ট্রং হতে সাহায্য করেছে। মৌরিন যদিও ছোটবেলা থেকেই সাহসী,প্রতিবাদী। কখনো কোনো বিষয়ে সে দূর্বল হয়নি, বাবাই তাকে শিখিয়েছে এগুলো। তবে সেই ব্যক্তির কারণেই যে প্রথমবার দূর্বল হতে হয়েছিল মৌরিন কে। বাবার অনুরোধ কে প্রাধান্য না দিলে হয়তো আজ তার নামের পাশে ‘ডিভোর্সি’ ট্যাগ টা লেগে যেতোনা।

ঘটনাটা আরো ছয়মাস আগের। তখনো সবকিছু ঠিকভাবেই চলছিল। মা,বাবা,মেয়ে তিনজনের ছোট পরিবার বেশ আনন্দেই সময় কাটাচ্ছিল। বিপত্তি হয়ে দাঁড়ায় মৌরিন এর বাবা মনির এর অসুস্থতা। অনেকদিন ধরেই বুকে ব্যাথা টের পাচ্ছিলেন তিনি,তবে পাত্তা দেয়নি। যা পরবর্তীতে ভয়াবহ রূপ নেয়। একপর্যায় অত্যাধিক বুকে ব্যাথা শুরু হলে ডাক্তারের শরণাপন্ন হন তিনি, তবে ততক্ষণে অনেক দেড়ি হয়ে গেছিলো। হার্টে বেশ কয়েকটা ব্লক ধরা পরে মনির সাহেবের। রিং পরানো হয় তাকে, তবে তাকে খুব একটা সুস্থ করা সম্ভব হয়নি। যদিও মৌরিন আর মারুফা তাকে যথেষ্ট মনের জোর দেওয়ার চেষ্টা করেছিলো। তবে তিনি হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন বেশিদিন সময় আর তার হাতে নেই, ফলে মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার জন্য তড়িঘড়ি শুরু করেন তিনি।

মনির সাহেব আর নাহিদের বাবা একই সঙ্গে ব্যাবসা করতেন, দুজনের ই ইনভেস্ট ছিলো সেখানে। তাই নিজেদের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে তারা আগে থেকেই ঠিক করেছিলেন মৌরিন আর নাহিদ এর বিয়ে দেবেন। নাহিদ তখন ক্যানাডা তে ছিলো, কথা হয়েছিল নাহিদ দেশে ফিরলেই বিয়েটা দিয়ে দেওয়া হবে। তবে মনির সাহেব অসুস্থ হয়ে পরায় তিনি আর কোনোভাবে অপেক্ষা করতে চাননি, তারই জোরাজোরিতে ভিডিও কলেই বিয়ে পরানো হয় নাহিদ এবং মৌরিন এর।
জীবনে ঐ একবারই বাবার কারণে দূর্বল হয়ে পরেছিল মৌরিন, ফলে এই বিয়েতে সে আর আপত্তি করেনি। ভেবেছে নিজের বাবার কথা, এতে যদি সে খুশি থাকে তবে তাই হোক।
তবে তার এই সিদ্ধান্ত ভুল প্রমাণিত হয় চারমাস পরেই। পৃথিবী ছেড়ে চলে যান মনির সাহেব। কাছের লোকেরাও যে কতটা নিকৃষ্ট হতে পারে তা এর এক সপ্তাহ পরেই টের পায় মৌরিন এবং মারুফা। নাহিদের বাবা নাজিম শেখ, যিনি কিনা যেকোনো সমস্যায় মনিরের পাশে থেকেছেন, তিনিই অন্য কথা বলে বসলেন বন্ধুর মৃত্যুর সাতদিনের মাথায়।
মৌরিন যেহেতু মনির সাহেবের একমাত্র মেয়ে, তাই তার সম্পত্তির অধিকাংশই মৌরিন এর পাওয়ার কথা। সেই সুযোগটাই নিলেন নাজিম শেখ। বাবা হারানোর শোকে কাতর মা আর মেয়ের অসহায়ত্বের সুযোগ নিলেন তিনি। গোপনে কাগজপত্র তৈরি করলেন, ব্যাবসার অর্ধেক নয় বরং পুরো মালিকানাই নিজের এবং তার ছেলের নামে করে নিলেন। মৌরিন আর মারুফা তখন নিজেদের মধ্যে ছিলোনা,থাকার কথাও নয়। সেই সুযোগেই তাদের মিথ্যে কথা বলে কাগজে সই করিয়ে নেন নাজিম শেখ। নাহিদ তখনো ক্যানাডাতেই ছিল, যদিও তাকে এই প্ল্যান সম্পর্কে জানানো হয়েছিল। বাবার সঙ্গে সেও লোভ সামলাতে পারেনি, রাজী ছিলো সে নিজেও।

কেটে যায় আরো কয়েকটা দিন,কিছুটা স্বাভাবিক হয় মৌরিন। হতেই হবে, এটাই যে পৃথিবীর নিয়ম। হারিয়ে যাওয়া মানুষের স্মৃতি আঁকড়ে ধরেই বেঁচে থাকতে হয়। প্রায় পনেরো দিন বাদেই নাজিমের এই জঘন্য কাজের খবর ফাস হয়ে যায়, সবটা জানতে পেরে যায় মৌরিন। নাজিম,নাহিদ এবং তাদের পরিবার ভালোভাবে বুঝিয়েছিল মৌরিন কে, এই পরিবার তো তার নিজের। যা তার তা নাহিদের ও, সেই হিসেবে এই সম্পত্তি নাহিদের ই হওয়া উচিৎ। মেনে নেয়নি মৌরিন,সে এর প্রতিবাদ করে। বাবার শোক একপাশে রেখে সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে থাকে ব্যাবসায় মনিরের ভাগটুকু ফিরিয়ে আনার, সেটা মারুফার নামে করতে চেয়েছিল সে। এই ব্যাবসা থেকেই বেরিয়ে আসবে প্রয়োজনে, তবে তার বাবার অধিকার অন্য কাউকে নিতে দেবেনা।
ক্ষিপ্ত হন নাজিম শেখ এবং তাদের পরিবার, তালাকের ভয় দেখান মৌরিন কে। মৌরিন বিপরীতে হাসে কেবল, এমন এক লোভী পরিবারের বউ হয়ে সে থাকবে এটা ভাবাই তো ভুল। তবে মৌরিন মেনে নিতো, যদি নাহিদ এসবকে সাপোর্ট না করতো। নাহিদ বরাবরেই পরিবারভক্ত ছেলে, সকলে যেভাবে তার ব্রেইন ওয়াশ করেছে সেও ঠিক তেমনটাই বুঝেছে। পরিবার এর সঙ্গে সে নিজেও তালাকের ভয় দেখায় মৌরিন কে, মৌরিন মোটেই ভয় পায়নি। বরং সে নিজেই তালাক দিতে চাইলো নাহিদকে, এবার আরো বেশি তেতে উঠলো সকলে। রেজিস্ট্রি হয়নি ওদের, কেবল ইসলামিক ভাবেই বিয়ে পরানো হয়েছিল তাও ভিডিও কলে। একইভাবে তালাক ও হয়ে গেলো তাদের সেই ভিডিও কলেই, এতে মৌরিনের বিন্দুমাত্র কষ্ট হয়নি।
তবে খারাপ লেগেছিল ব্যাবসার অংশটুকু আর ফিরিয়ে আনতে না পারায়। নাজিম শেখ এত বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে কাগজপত্র তৈরি করেছিলেন যে আইনি সহায়তা নিয়েও কোনো লাভ হয়ন।

বিয়ের ব্যাপারে পরিবার ব্যাতীত কেউই তেমন কিছু জানতো না। পরিবার বলতে মৌরিন এর দুই চাচা। তবে তারাও এবার বিপক্ষে চলে গেলেন, বরং মৌরিনকে দুষলেন তালাক এর বিষয়ে রাজী হওয়ার জন্য। ভালোভাবে সংসার করলেই পারতো, সবকিছু ঠিক থাকতো তাহলে। অবাক হয় মৌরিন, পৃথিবীতে “আত্মীয়, কাছের মানুষ” শব্দগুলোর উপর থেকে মন উঠে যায় তার।

সিলেটে নিজেদের ফ্লাট ছিলো মনির এর,সেখানেই থাকতো সে পরিবার নিয়ে। আর ছিলো কিছু জমিজমা, যেখানে ততদিনে ভাগ বসাতে হাজির হয়েছে তার দুই ভাইয়ের ছেলেরা। হায়রে সমাজ! একটা মানুষ পৃথিবী ত্যাগ করার একমাস পূর্ণ হওয়ার আগেই এই লোভী মানুষগুলো সম্পদের লোভে পাগল হয়ে যাচ্ছে, এদের সাথেই নাকি আবার রক্তের সম্পর্ক!
হাসি পায় মৌরিন এর, টাকা-পয়সার প্রতি তার লোভ নেই এতটুকুও। ইসলামিক দৃষ্টিতে ছেলে না থাকায় যতটুকু অংশ ভাইয়ের ছেলেরা পায় তা থেকে সেই লোভী লোকগুলোকে বঞ্চিত করেনি মৌরিন। ব্যাবসায় যে টাকা আটকে ছিলো, তা তো আগেই নাজিম শেখ নিয়ে নিয়েছে। বাকি রইলো এই ফ্লাটটা।
এতকিছুর পর নিজেকে শক্ত রাখাটা কঠিন হয়ে পরছিল মৌরিন এর জন্য, ডিভোর্স এর জন্য নয় বরং আত্মীয় নামক ব্যাক্তিগুলোর জন্য। এই শহরটাই অপ্রিয় হয়ে ওঠে মৌরিন এর কাছে। অনেক ভেবেচিন্তে সে এই শহর ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেয়, কোনো লোভী আত্মীয়ের তার প্রয়োজন নেই।
ফ্লাটটা বিক্রি করে দেয় মৌরিন,সঙ্গে ঘরের কিছু আসবাবপত্র ও। যে টাকা পাওয়া যায়, তার অধিকাংশ টাই মাদ্রাসায় দান করে দেয় মৌরিন। কিছুদিন চলার জন্য, নতুন শহরে একটা থাকার জায়গা জোগাড় করার জন্য কিছু টাকা রেখে দেয় সে। এরপরই চলে আসে ঢাকায়, নতুনভাবে জীবনটা শুরু করার জন্য,নিজের চিরচেনা কঠিন রূপটাকে ধরে রাখার জন্য।

______
পরেরদিনও সঠিক সময়েই শুটিং সেটে এসে পৌঁছায় মৌরিন। শরীরটা তার খুব একটা ভালো নয়, গলা ভেঙে গেছে সঙ্গে জ্বর জ্বর লাগছে কিছুটা। আজকে শুটিংটা শহর থেকে একটু ভিতরের দিকে,কিছুটা শুনশান জায়গায় হচ্ছে।

দুজন বাচ্চা থাকবে আজকের শুটিং এ। তাদের মধ্যে একজন খুবই ছোট, পাঁচ বছর হবে বয়স। মৌরিন নিজে একটা চেয়ারে বসে পাশের চেয়ারে সেই মেয়েটাকে বসিয়ে তার সংলাপগুলো কিছুটা বুঝিয়ে বলতে থাকে। গলা ভাঙা যেহেতু,তাই কণ্ঠস্বর কিছুটা অন্যরকম শোনায় মৌরিন এর। বাচ্চা মেয়েটা মৌরিন এর উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করে,
_”আপু? তোমার গলায় কি ব্যাঙ ঢুকেছে?”

দু সেকেন্ড মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বেশ মনখুলে হাসতে লাগলো মৌরিন,এভাবে সে শেষ কবে হেসেছে মনে পরলোনা। কিছুক্ষন বাদে নিজের হাসি থামিয়ে মেয়েটার গাল টেনে বললো,
_”হ্যা গো, তাই হয়েছে বোধ হয়।”

রুবেল এর ডাক পড়তেই মেয়েটাকে নিয়ে তার দিকে চলে যায় মৌরিন। একই যায়গায় ফিরে আসে প্রায় দশমিনিট পর। এখন শুটিং চলবে,মৌরিন এর কাজ নেই তেমন। পাশের চেয়ার থেকে নিজের ব্যাগটা তুলে হাতে নেয় মৌরিন, তখনি তার চোখ পরে ব্যাগের নিচে রাখা এক ছোট ভাজ করা কাগজের দিকে। উপর থেকেই কিছু লেখা আছে। চিরকুট টা হাতে তুললো মৌরিন। ভাজের উপরেই সেই কমলা রঙের কালি দিয়ে লেখা,
“ব্যাগে রাখা বারণ,ব্যাগের নিচে রাখা অবশ্যই বারণ নয়”

চিরকুট টা খোলে মৌরিন, অনেকটা আগের দিনের মতোই লেখা,

“মৌরিফুল,

হাসলে যে তোমার গালে সামান্য টোল পরে জানতাম না তো। তবে তুমি হেসোনা,তোমার জন্য গম্ভীর থাকাটাই বেটার। ওটাই যায় তোমার সঙ্গে। তুমি তো সুন্দর নও, এককথায় অসুন্দর বলা চলে। তবুও তোমার গালের সেই সামান্য টোল পরা দেখে অদ্ভুত লাগছে আমার। কারণটা অজানা, তবে মারাত্মক অস্থির লাগছে..

ইতি
সেই আগন্তুক ”

#চলবে?

#এক_ফালি_সুখ🌼 |২২| [বোনাস পর্ব]
#তাসনিম_জাহান_মৌরিন
বরাবরের ন্যায় শান্তই রইলো মৌরিন। কেবল তার ভ্রুযুগল ইষৎ সঙ্কুচিত হলো, চক্ষুদ্বয় কিছুটা ছোটছোট করে আরো একবার পড়লো চিরকুট টা। এরপর চেয়ারে বসে সামনের দিকে তাকিয়েই ভাজ করলো সেটা। রুবেল কে একবার বলেছে, বারবার তাকে বিরক্ত করাটা ভালো দেখায় না। ফলস্বরূপ এই চিরকুট কে পাত্তাই দিলো না মৌরিন। কোনো বিষয় থেকে বেরিয়ে আসার সবচেয়ে ভালো উপায় হলো সেই বিষয়টাকেই অবহেলা করা। এই চিরকুট যে পাঠিয়েছে, সে নিশ্চই মৌরিন এর গতিবিধি লক্ষ্য করছে, দু তিনদিন তাকে শান্ত দেখে নিশ্চই ছেড়ে দেবে এসব।

হাটুতে কনুই ঠেকিয়ে মাথা কিছুটা ঝুকিয়ে নিলো মৌরিন। দুহাতে মাথা চেপে ধরে ওভাবেই বসে রইলো খানিকক্ষণ। চোখ বন্ধ করতেই চোখে গরম অনুভূত হলো,জ্বরটাও বোধ হয় বাড়ছে ধীরেধীরে।

_”কাজ না করতে পারলে আসার কি দরকার?”

কণ্ঠ শুনেই মৌরিন বুঝতে পারলো তূর্য তার সামনে এসে বলছে কথাটা। মাথা থেকে হাত সরিয়ে সোজা হয়ে বসলো মৌরিন। তাকালো সামনের দিকে, তূর্য কিছুটা সামনে এক চেয়ারে বসে ফোন ঘাটছে। মৌরিন কিছুক্ষন চুপ থেকে বলে,
_”আমি যতটা জানি, এই সময়ে আমার কোনো কাজ নেই। নিজের যতটুকু কাজ,তা আমি করেই এসেছি আর পরবর্তীতেও করতে পারবো। একান্ত না পারলে অবশ্যই আসতাম না।”

তূর্য তাকালো মৌরিন এর দিকে। চেয়ার থেকে উঠে পাশে থাকা টেবিলের উপরের স্ক্রিপ্ট হাতে নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখলো কিছুক্ষন। হুট করেই সেগুলো বন্ধ করে পাশ ফিরে মৌরিন এর দিকে তাকালো সে। নিজের একহাতের দিকে তাকিয়ে আবারো মৌরিন এর দিকে তাকায় সে। মৌরিন তাকায়নি সেদিকে,তার দৃষ্টি নিচের দিকেই আবদ্ধ। তূর্য খানিকক্ষণ সেভাবে স্থির থেকে পা বাড়িয়ে মৌরিন এর সামনে দাঁড়ায়। নিজের ডানহাতে থাকা ওষুধটা হুট করেই মৌরিন এর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে,
_”খেয়ে নিও এটা।”

কথাটা বলেই আবারো সেই চেয়ারে গিয়ে বসে পরে তূর্য।মৌরিন কয়েক সেকেন্ড নিজের হাতে থাকা ওষুধটার দিকে তাকিয়ে থাকে। এরপর নিজের ব্যাগ থেকে পানির বোতলটা বের করে খেয়ে নেয় ওষুধটা। বোতলটা পুনরায় ব্যাগ এ রেখে তূর্যের উদ্দেশ্যে বলে,
_”ধন্যবাদ”

অবাক হয় তূর্য। ধীর কণ্ঠে বলে,
_”স্ট্রেঞ্জ! ত্যাড়ামি করলে না?”

মৃদু হাসে মৌরিন। তূর্যের দিকে তাকিয়ে বলে,
_”আমি তো আর অকৃতজ্ঞ নই। উপকার করলেন তাই ধন্যবাদ বললাম। এখানে ত্যাড়ামি করতে যাবো কেন?”

_”কি ওষুধ দিলাম দেখে নিয়েছো?”

_”হুম,আগেও খেয়েছি।”

_”মাইগ্রেন এর প্রবলেম?”

_”অল্পস্বল্প”

_”আমারো। ছিলো আমার কাছে,তাই দিলাম।”

বিপরীতে আর কিছু বলেনা মৌরিন। এরই মধ্যে ডাক পরে তূর্যের, সে নিজেও চলে যায় শুটিং এর জায়গায়। মৌরিন জানে এখন তার ঘুম পাবে,এই ঔষধটা খেলে ঘুম পায়। তাই আগেভাগেই ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করে স্ক্রোল করতে লাগলো। ইনবক্স এ অনেক বন্ধুরা মেসেজ দিয়ে রেখেছে, রিপ্লাই দিতে ইচ্ছে করেনা। ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট এ গিয়ে পরপর অনেকগুলো ডিলেট করলো মৌরিন। অপরিচিত ব্যক্তির রিকুয়েস্ট সে খুব একটা এক্সেপ্ট করেনা। আগেও করতো না, আর এখন নিশ্চিত নাহিদও পাঁচ ছয় টা ফেইক আইডি খুলে রিকুয়েস্ট দিয়ে রেখেছে।
মাঝেসাঝে এগুলো ভেবে আপনাআপনি হাসি পায় মৌরিন এর। হুট করে যেন নাহিদের সুবুদ্ধি হয়েছে, সে মনে করছে সে যা করেছে ভুল করেছে। এখন তারা যায়, মৌরিনকে আবার বাড়ির বউ করে নিয়ে যেতে, বিনিময়ে ব্যাবসার অংশটুকু ফিরিয়ে দেবে। রাজি হয়নি মৌরিন, ম’রে গেলেও তো অমন লোভী লোককে সে দ্বিতীয়বার বিয়ে করবে না, আর ইসলামিক দৃষ্টিতে তা সম্ভব ও নয়।

শুটিং শেষ হওয়ার কিছুক্ষন আগেই রুবেল এর থেকে অনুমতি নিয়ে বেরিয়ে আসে মৌরিন। এখন তার কাজও নেই তেমন,যা ছিলো তা গুছিয়েই এসেছে।
দিনটা বুধবার, মৌরিনদের বাসায় যাওয়ার রাস্তায় সব দোকান বন্ধ থাকে এইদিন। মৌরিন আশেপাশে তাকালো না, কেবল সামনের দিকে তাকিয়ে হেটে গেলো। পিছন থেকে মেয়েলী কণ্ঠে কেউ ডাক দিতেই থেমে যায় মৌরিন। পিছন ঘুরতেই জ্যোতিকে হাটুতে হাত রেখে হাপাতে দেখে সে। জ্যোতির সঙ্গে মৌরিন এর আলাপ হয়েছিল ভার্সিটি তে। ট্রান্সফার এর কিছু কাজে কয়েকদিন যেতে হয়েছে ভার্সিটি তে,সেখানেই জ্যোতির সঙ্গে কথা হয়েছিল,আরো দুজনেই সিলেটের মানুষ। সখ্যতা জমেছে ভালোই, তবে ফোন নম্বরটা নেওয়া হয়ে ওঠেনি।

জ্যোতি কিছুক্ষন বাদে স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়ে বলে,
_”কতক্ষন ধরে ডাকছি তোমায়,শুনতে পাও নি?”

মৌরিন সামান্য হেসে উত্তর দেয়,
_”খেয়াল করিনি বোধ হয়।”

_”এদিকেই বাসা তোমার?”

_”হ্যা এই একটু সামনেই। তোমাকে তো আগে দেখিনি।”

_”না না,আমার বাসা এখানে না তো। এক ফ্রেন্ড এর বাসায় এসেছিলাম।”

জ্যোতি আর মৌরিন একসঙ্গেই সামনে হাটতে শুরু করে। জ্যোতি হাটতে হাটতেই বলে,
_”কি ডেঞ্জারাস গো এই রাস্তাটা! এই ভর দুপুরে কতগুলো ছেলে ওপেন প্লেস এ টিজ করছিলো আমায়।”

কিছুক্ষন চুপ থেকে জ্যোতি জিজ্ঞেস করে,
_”তুমিও তো ওদিক থেকেই এলে, দেখোনি?”

_”উম হু,খেয়াল করিনি।”

_”তোমায় কিছু বলেনি ওরা?”

মুচকি হাসে মৌরিন। জ্যোতির দিকে তাকিয়ে বলে,
_”দিনের বেলায় কখনোই আমায় ইভটিজিং এর স্বিকার হতে হয়নি। যা দুয়েকবার হয়েছে, তা সন্ধ্যার পর। তবে আমি এগুলো নিয়ে খুব একটা ভাবিনা।”

_”বাহ,বেশ সাহসী তো তুমি!”

একইভাবে হাসে মৌরিন,প্রতিত্তর করেনা। সে জানে সে সাহসী, নিজের প্রতিটা গুণ তার চেনা,জানা। অহংকার করা উচিৎ এই নিয়ে,তবে সেটা ভিতর থেকে আসেনা। হয়তো সেটাও একপ্রকার গুণের অন্তর্ভুক্ত।

_______
সন্ধ্যার পর নির্ঝর কে ফোন করে ইমেডিয়েটলি দেখা করতে বলেছে জ্যোতি। তার এত জরুরী কথা শোনার উদ্দেশ্যে নির্ঝর ও তড়িঘড়ি করে হাজির হয়েছে তার বাড়ির ছাঁদে। সেখানে গিয়ে দেখতে পায় জ্যোতি ছাঁদের রেলিং এ হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে। নির্ঝর দ্রুতপায়ে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে,
_”আমাকে এতো জলদি আসতে বলে নিজে হাওয়া খাচ্ছিস? সিরিয়াসলি? আমি ভাবলাম..”

_”কি ভাবলে? বিয়ে ঠিক হয়েছে আমার?”

পাশ ফিরে কথাটা বলে জ্যোতি,তার মুখভঙ্গি গম্ভীর। নির্ঝর আরাম করে দাঁড়িয়ে বলে,
_”সেটা হলে তো ভালোই হতো। ছাড়,কেন ডেকেছিস সেটা বল। এমন কি কথা যে ফোনে বলা যাবেনা?”

_”বেশি ডিসটার্ব করলাম?”

ভ্রু কুঁচকে তাকায় নির্ঝর,কিছুটা ধমকের সুরে বলে,
_”সিনেমার ডায়লগ দিবিনা একদম। কি বলবি বল।”

_”আমার বিয়ে করা উচিৎ তাইনা?”

নির্ঝর মজা করে বললো,
_”একদম,অনেকদিন বিয়ের দাওয়াত পাইনা।”

_”হুম, কিন্তু আমার বিয়ে খেতে চাইলে তোমায় অনেএএএক দূরে যেতে হবে।”

_”কেন?” (অবাক হয়ে বলে নির্ঝর)

_”কারণ আমি স্কলারশিপ নিয়ে ইটালি পড়তে যাচ্ছি। তো এদেশি ছেলে বিয়ে করার প্রশ্নই আসেনা, সেখানেই একটা ছেলে পছন্দ করে বিয়ে করে নেবো।”

গা ছাড়া ভাব নিয়ে বললো জ্যোতি। নির্ঝর কিছুক্ষন চুপ থেকে বললো,
_”আসলেই?”

_”তো কি নকল?”

_”বিশ্বাস হচ্ছে না।”

সন্দেহজনকভাবে বললো নির্ঝর। জ্যোতি তাতে পাত্তা না দিয়ে বললো,
_”অভিনন্দন জানাও আমাকে।”

নির্ঝর বিরক্তির ভাব নিয়ে বলে,
_”এটা তোর জরুরী কথা? এটা ফোনে বলা যেতো না? শুধুশুধু টাইম নষ্ট করলাম।”

অবাক হয় জ্যোতি, সে চলে যাবে জেনেও নির্ঝর কিছু বলছেনা? এটা মেনে নিতে কষ্ট হলো জ্যোতির। অন্যদিকে ঘুরে কেবল ক্ষীণ স্বরে বললো,
_”সরি।”

কথাটা বলেই নিচে চলে যায় জ্যোতি। নির্ঝর ও এবার কিঞ্চিত অবাক হয়, হয়েছে টা কি জ্যোতির? নিজে থেকে কিনা সরি বলছে! ঝগড়া না করে? স্ট্রেঞ্জ!..

______
তিন নম্বর চিরকুটটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মৌরিন। পরপর দিনদিন সেই একই কমলা রঙের কালি দিয়ে চিরকুট লেখা হচ্ছে। আজকেও ব্যাগ এর নিচেই রাখা ছিলো। তাতে লেখা,

“মৌরিফুল,

মুখে বলার চেয়ে চিরকুট এর মাধ্যমে কথা বলার বিষয়টা কিন্তু মন্দ নয়। আদিকালের ভাইবস পাওয়া যাচ্ছে কিছুটা। এক্ষেত্রে কথাটা হচ্ছে একপাক্ষিক,হোক। তবে তোমার মুখে এতটুকু বিরক্তিভাব নেই কেন? ভালো লাগছে এই আগন্তুক এর থেকে চিরকুট পেতে? নাকি তুমি অনুভূতি শূন্য, কোনটা? উত্তরের প্রয়োজন নেই, তবে নিজের অনুভূতি জাগ্রত করো। হয় বিরক্ত হও, নাহয় মুচকি হাসো। আমি মনোবিজ্ঞানী তো নই, যে তোমার শান্ত মুখশ্রী দেখেই মনের কথা বুঝতে পেরে যাবো!

ইতি
প্রিয় অথবা অপ্রিয় আগন্তুক”

মুখভঙ্গি পরিবর্তন করলো না মৌরিন। আগের ন্যায় চিরকুট টা ভাজ করে মন দিলো নিজের কাজে। এই চিরকুটদাতা কে হয়তোবা আবারো হতাশ করলো মৌরিন। স্পষ্টভাবে উল্লেখ করার পরও শান্ত রইলো মৌরিন, যেন সে অমন কিছু পড়েই নি!

#চলবে?