এক ফালি সুখ পর্ব-৩৪ এবং শেষ পর্ব

0
101

#এক_ফালি_সুখ🌼 |৩৪+অন্তিম পর্ব|
#তাসনিম_জাহান_মৌরিন
মৌরিন এর সম্মুখে সেজেগুজে দাঁড়িয়ে আছে তন্নি,জ্যোতি,রাতুল,নির্ঝর,তূর্য,ইলমা,মারুফা, সঙ্গে তূর্যর বাবা ইরশাদ। মৌরিন এর পরনে হলুদ রঙের শাড়ি, যদিও খুব বেশি সাজগোজ নেই। বর্তমানে তারা অবস্থান করছে কাজি অফিসে। পরিবেশ বুঝতে খুব বেশি সময় লাগলোনা মৌরিন এর। সকাল বেলা জ্যোতিই তাকে ফোন করে এখানে আসতে বললো, বলেছিলো এক বান্ধবীর বিয়ে। সকলে হলুদ শাড়ি পরবে তাই মৌরিন কেও হলুদ পরতে হবে।
মৌরিন শান্ত দৃষ্টিতেই তাকালো সকলের দিকে। তূর্য এবার নিজের পাঞ্জাবীটা টানটান করে মৌরিন এর কাছে এসে বলে,
_”হালাল সম্পর্কে দেরি করাটা আমার পছন্দ নয়। তবে আমি জোর করবোনা আজও, যদি আমাকে নিজের সুখের সঙ্গি করতে রাজি থাকো। তাহলেই…”

এইটুকু বলেই সরে যায় তূর্য। মারুফা মৌরিন এর কাছে এসে বলে,
_”তোর জীবন,তোরই সিদ্ধান্ত। তবুও বলবো, না করিস না।”

তূর্য আগেই গিয়ে একটা চেয়ারে বসে মৌরিন এর দিকে তাকিয়ে ছিলো। মৌরিন কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে পাশের চেয়ারে এসে বসলো,একনজর তূর্যের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো সে। সকলে একসঙ্গে “হুররেহ” বলে চেঁচিয়ে উঠলো। ছোট্ট তরি ও হাসলো তাদের দেখে। আর তূর্য কেবল ই তাকিয়ে রইলো তার প্রেয়সীর পানে। মৌরিনের কানের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বললো,
_”ধন্যবাদ মৌরিফুল।”

বিয়ে পরানো হলো দুজনের, আর এর মাধ্যমেই সূচনা হলো আরো একটি হালাল সম্পর্কের। যেই সম্পর্কে থাকেনা কোনো দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, লুকোচুরি। থাকে কেবলই পবিত্রতা,ভালোবাসা,যথাযথ বিশ্বাস।

গতকাল মৌরিনের থেকে সম্মতি পেয়ে আর বিয়েতে দেরি করতে চায়নি তূর্য। তাই আজই কাছের কিছু মানুষদের নিয়ে কাজি অফিসে গিয়ে বিয়েটা সেড়ে ফেললো সে। রিসেপশন টা হবে কিছুদিন পরে। বিয়ে পরানো শেষ হতেই তন্নি আর জ্যোতি আয়না নিয়ে হাজির হয় দুজনের সামনে। আয়নাটা তাদের মুখের সামনে ধরে প্রথমে মৌরিনকে জিজ্ঞেস করে,
_”কাকে দেখতে পাও মৌরি?”

_”সুখের সঙ্গি,উদযাপনের অংশীদার।”

নির্দিধায় উত্তর দেয় মৌরিন,সকলে হাততালি দেয়। এবার তন্নি তূর্যকে জিজ্ঞেস করে,
_”তুই কাকে দেখিস তূর্য?”

_”দ্যা মোস্ট ইউনিক পারসোন।”

তূর্যও উত্তর দেয় সরাসরি। সকলের মাঝেই খুশির আলোড়ন। ইলমা আর ইরশাদ ছেলের বিয়েতে খুশি, মারুফা নিজের মেয়ের নতুন জীবন শুরু করা দেখে খুশি, আর বাকিরা বন্ধুর বিয়েতে খুশি। সবার জীবন যেন এখন পুরোপুরি সুখে পরিপূর্ণ।

সকল কাগজপত্র গুছিয়ে খাওয়া দাওয়ার পর্ব শেষ করে বেরোতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেলো। তবে মৌরিন এখন নিজের বাড়িতেই থাকবে, রিসেপশন এর পর ও তূর্যের বাড়িতে যাবে এই কথাই ঠিক হলো। সকলে নিজেদের পথে চলে গেলেও তূর্য আর মৌরিন বাড়ি ফিরলো না। তূর্যের কথা, সে আজ যেদিক দুচোখ যায় সেদিকে ঘুরবে। মিডিয়ার ও ভয় নেই,লুকোবে না কিছু। কেউ সামনে পরলে বিয়ের কথা স্বিকার করে নেবে সে, চুরি তো আর করেনি যে লুকিয়ে রাখবে।

অজানায় হারাবে বললেও তূর্য এলো এক পরিচিত জায়গায়, এই জায়গায় বোধ হয় প্রথম কেউ বউ নিয়ে ঘুরতে এলো। জায়গাটা আর কিছুই নয় বরং সেই নির্জন অন্ধকার রাস্তা। এখন পুরোপুরি অন্ধকার বলা চলেনা, একটা লাইটের সামান্য আলো রয়েছে। গাড়ি থামিয়েই তূর্য মৌরিন এর দিকে তাকালো। নাহ, তার মধ্যে অবাক হওয়ার কোনো রেশ নেই। তূর্য তার দিকে ঘুরে বলে,
_”একদিন একটুখানি অবাক হওয়ার নাটক করবে প্লিজ?”

মৌরিন অবাক হয়ে তাকায় তূর্যের দিকে। তূর্য সঙ্গে সঙ্গে হেসে তুড়ি বাজিয়ে বলে,
_”ব্যাস, একবার অন্তত তোমায় অবাক হতে দেখে নিলাম।”

মৌরিন গাড়ি থেকে নামতে নামতে বললো,
_”আমাকে দেখার জন্য সারাজীবন পরে আছি।”

মৌরিন সামনে এসে গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়ায়। তূর্যও এসে দাঁড়ায় তার পাশে। মৌরিন সামনের দিকে তাকিয়েই বলে,
_”তবে তুমি এখনো আমার অনেক কিছুই দেখোনি। ফ্রেন্ড সার্কেল বা বাড়িতে কিন্তু আমি এমন গম্ভীর থাকিনা। বেশ দুষ্টু আমি। এজ মাই হাজবেন্ড,তোমার এগুলো জানা উচিৎ।”

_”বাহ বাহ, এত তাড়াতাড়ি তুমি তে শিফট করে গেলে?”

_”তো? নিজের বর কে আপনি আজ্ঞে করার মতো বাধ্য মেয়ে কিন্তু আমি না। তবে হ্যা, মাঝেমধ্যে উল্টোপাল্টা বলতে পারি। অনেক সময় এমন হয়, এই ভালো এই খারাপ।”

তূর্য হাত বারিয়ে মৌরিনকে নিজের সামনে এনে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে তাকে। আকাশের দিকে তাকিয়ে কিছুটা সুর করে গায়,
_”এই ভালো এই খারাপ
ও প্রেম মানে মিষ্টি পাপ,
চলো মানেমানে দিয়ে ফেলি ডুব
তুমি আমি মিলে..”

মৌরিন ও তাল মিলিয়ে গাইলো,
_”দুজনেই মনটাকে
ও.. বেধে ফেলি সাতপাকে
চলো ছোটখাটো করি ভুলচুক
তুমি আমি মিলে..”

এবার দুজনে একসঙ্গে গাইলো,
_”সাজিয়েছি ছোট্ট এক ফালি সুখ
রাজি আছি আজকে বৃষ্টি নামুক
তুমি আমি ভিজবো দুজনে খুব
ভরসা দিলে..”

তূর্য এবার মৌরিনকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে তার কোমড় জড়িয়ে ধরে বলে,
_”ভালোই তো গান গাও।”

_”ঐ টুকটাক।”

দু এক ফোটা বৃষ্টির পানি এসে চোখেমুখে পরতেই আকাশের দিকে তাকায় দুজন। তূর্য হেসে বলে,
_”তোমার আমার সাথে এই বৃষ্টির কানেকশন টা কিন্তু দারুণ।”

তূর্য এবার স্থির দৃষ্টিতে তাকায় মৌরিনের দিকে। তার টিপ কিছুটা সরে গেছে, সযত্নে তা ঠিক করে দেয় তূর্য। ধীর কণ্ঠে বলে,
_”এমন কোনো রাতের কথা মনে পরে মৌরিফুল?”

_”স্মৃতিশক্তি খারাপ নয় আমার। সেই রাতের সঙ্গে পরবর্তী কিছু কথাও মনে আছে।”

_”ছবিগুলো ভাবছি নতুন করে পোস্ট করবো, এবার নিজের আইডি থেকে। ভালো হবে না?”

পাশের দিকে মুখ ঘুরিয়ে সামান্য হাসে মৌরিন। তূর্য তার মুখটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে তার দিকে এগোতে গেলেই মৌরিন থামিয়ে দেয় তাকে। তূর্যের চোখে চোখ রেখে বলে,
_”এটা পাবলিক প্লেস তূর্য।”

মৌরিন এর হাতটা সরিয়ে দেয় তূর্য। বাকি দূরত্বটুকু মিটিয়ে তার ঠোঁটের পাশে অধর ছোঁয়ায় তূর্য, কানের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বলে,
_”আর এটা আমারই বউ।”

মৌরিন ও এবার নিজের হাতের দ্বারা আলতো করে তূর্যের গাল স্পর্ষ করে বলে,
_”তুমি না ঝুম বর্ষায় আমার মাথার উপরের ছাতা হবে?”

এবার বেশ শক্তভাবে নিজের প্রেয়সী কে জড়িয়ে ধরে তূর্য। মৌরিনের গালে নিজের গাল ঘষে বলে,
_”এ যে প্রেমের বর্ষণ প্রিয়। প্রকৃতিও আনন্দে মেতেছে আমাদের প্রণয়ে, আজ আর ছাতার দরকার নেই। জ্বর এলে আসুক,তবুও একটু ভিজি দুজন মিলে। আর তোমার তো বৃষ্টিবিলাশ পছন্দ?”

উত্তর দেয়না মৌরিন। কিছু সময় ওভাবেই বৃষ্টি উপভোগ করে তারা,এরপর মৌরিন এর কথাতেই পুনরায় গাড়িতে এসে বসে দুজন। মৌরিন ফোনটা হাতে নিতেই দেখে মারুফা দুবার কল করেছেন, সঙ্গে সঙ্গে কলব্যাক করে তার সঙ্গে কথা বলে মৌরিন। ততক্ষনে তূর্য গাড়ি স্টার্ট দিয়েছে, মৌরিন ফোনটা কাটতেই সে জিজ্ঞেস করে,
_”এনি প্রবলেম?”

_”নাহ, মা বলছিল তোমাকে বাসায় নিয়ে যেতে। জামাই আদর করার বড় শখ হয়েছে তার।”

_”শাশুড়ি মা যেতে বলছে নাকি তুমিও যেতে বলছো? বাই এনি চান্স..”

মৌরিন এর দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচিয়ে কথাটা বলে তূর্য, মূলত তার লক্ষ্য মোরিনকে লজ্জায় ফেলা। তবে তেমনটা হলোনা, মৌরিন চুপচাপ সামনের দিকে তাকিয়ে রইলো। তূর্য কপালে ভাজ এনে বলে,
_”একটু তো লজ্জা পান ম্যাডাম। অল টাইম এমন কঠিন ভাব নিয়ে থাকো কেনো? সিরিয়াসলি, আ’ম সো এক্সাইটেড টু সি ইউ ব্লাশ। আফটার অল, লজ্জা নারীর ভূষণ..”

মৌরিন নিজ অবস্থানে স্থির থেকেই বললো,
_”লজ্জা নারীর ভূষণ আর কঠিনতা নারীর অহংকার।”

_”তার মানে তুমি লজ্জা পাবেনা?”

_”মনে তো হচ্ছেনা”

_”সবই আমার কপাল”

ঠোঁট চেপে হাসে মৌরিন। তূর্যও মুচকি হেসে গাড়ি চালানোতে মনোযোগ দিয়ে বলে,
_”আজ আর যাচ্ছিনা। আন্টিকে বলে দিও, জামাই আদর অন্যদিন করবে। আর তুমি, সকাল আটটার মধ্যে তৈরি হয়ে থাকবে।”

_”কেন?”

_”ওমা,বিয়ে করলাম হানিমুনে যাবোনা?”

_”আচ্ছা,তা কোথায় যাচ্ছি?”

_”সিলেট… তবে কোনো রিসোর্ট এ থাকবো না। কোনো এক পাহাড়ে তাবু টাঙিয়ে থাকবো। আই থিংক ইউ লাইক ইট..”

_”শুধু আমরাই যাচ্ছি?”

_”উম হু, রাতুল ভাইয়া-তন্নি, নির্ঝর-জ্যোতি ওরাও যাচ্ছে। বাট নিউলি ম্যারিড কাপল শুধু আমরাই।”

আর কিছু বললোনা মৌরিন। সিলেটে এখন আর খুব একটা যাওয়া হয়না,নিত্য ভ্রমণের জায়গাগুলোতে এখন বছরে দু তিনবার ও যাওয়া হয়না। মৌরিনের এখন কেবল একটাই আফসোস, বাবার ব্যাবসার অংশটুকু আর ফিরিয়ে আনতে পারলোনা। নাজেম শেখ এত সূক্ষ্মতার সঙ্গে সব দখল করেছেন যে পরবর্তীতে মৌরিন অনেক চেষ্টা করেও লাভ হয়নি।
রুবেল আর দিয়ার সংসার ও বেশ ভালোই চলছে। তবে তাদের ঘরে এখনো কোনো তৃতীয় সদস্য আসেনি। এটা দিয়ার ইচ্ছে,সে নিজের ফিটনেস নিয়ে খুবই সচেতন। তাই এত তাড়াতাড়িই বাচ্চাকাচ্চা চায়না সে।

______
সকালে ঠিক সময়ে সিলেটের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পরলো তিন জুটি। তূর্য-মৌরিন, রাতুল-তন্নি আলাদা গাড়িতে করে আসছে, আর নির্ঝর-জ্যোতি করছে বাইক রাইড। তন্নির ও ইচ্ছে ছিলো বাইকে আসার তবে ছোট্ট মেয়েকে নিয়ে বাইকে এতটা পথ আসতে সমস্যা হতে পারে ভেবে আর জোর করেনি। তবে এদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরো এক ব্যক্তি,তার নাম আবরাজ শাহ। মিঙ্গেল মানুষদের মাঝে সে একাই যাচ্ছে, তবে তার সাফ কথা, এই তার শেষ সিঙ্গেল টুর।

তূর্য বরাবরেই মতোই তার পছন্দের ব্লাক শার্ট পরেছে, হাতে রিচ ওয়াচ আর চোখে সানগ্লাস। আর মৌরিন পরেছে শুভ্র সেলোয়ার কামিজ, এটাও তূর্যের ইচ্ছেতে। সচরাচর সাদা কিংবা কালো খুব একটা পরেনা মৌরিন, আজ পরলো তবুও।
আঁকাবাঁকা পথে ছুটছে গাড়ি, মৌরিন জানালার দিকে মুখ ঘুরিয়ে বাতাস উপভোগ করছে। তূর্য সামনের দিকে নজর রেখেই বললো,
_”প্রায় দু ঘন্টা তো হলো। মেয়েরা তো দেখি জার্নির শুরুতেই ঘুমিয়ে পরে। এখনো অনেক সময় লাগবে, চাইলে একটু ঘুমিয়ে নিতে পারো। আমার কাঁধ আপনার জন্য অল টাইম উন্মুক্ত।”

মৌরিন একইভাবে বসে থেকেই বললো,
_”দিনের আলোয় আমার ঘুম পায়না।”

তূর্য দুষ্টু হেসে বলে,
_”রাতের আধারেও যে তুমি ঘুমোতে পারবে,তার কোনো গ্যারিন্টি আছে কি? আফটার অল, সন্যাস জীবন পাড় করার উদ্দেশ্যে আমি বিয়ে করিনি অভিয়াসলি..”

এবারেও বিপরীতে কিছু বলেনা মৌরিন। খানিক বাদে তূর্য হেচকা টানে নিজের কাছে নিয়ে আসে মৌরিনকে, একহাতে জড়িয়ে ধরে বলে,
_”করোনার তিন হাত ডিস্টেন্স মেইনটেইন করছো নাকি?”

মৌরিনের মাথা গিয়ে ঠেকলো তূর্যের বুকে,খুব একটা নড়াচড়াও করলোনা সে। কিছুক্ষন বাদে তূর্য বললো,
_”এভাবেই থাকো,একটা রোম্যান্টিক ভাইবস পাওয়া যায়।”

_”কোথায়? আমিতো পাচ্ছিনা।”

সরাসরি উত্তর দিলো মৌরিন। সঙ্গে সঙ্গে ব্রেক কষলো তূর্য। মৌরিনের দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে বললো,
_”একটুও না?”

মাথা উঁচু করে তূর্যের দিকে তাকিয়ে না সূচক মাথা নাড়ে মৌরিন। আকস্মিকভাবে উভয়ের ওষ্ঠাধর একত্রিত করে তূর্য। মিনিট দুয়েক অতিবাহিত হতেই কিঞ্চিত সরে এসে বলে,
_”এবারেও না? তাহলে বলতে পারো, রোম্যান্টিক ভাইবস ক্রিয়েট করতে আমার কোনো প্রবলেম নেই।”

হঠাৎ লুকিং গ্লাস এর দিকে নজর যেতেই মৌরিন খেয়াল করে বাইক নিয়ে একটা ছেলে এদিকেই আসছে,আর হাতের ইশারা করছে। হালকা বল প্রয়োগে তূর্যের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয় মৌরিন। সেই ছেলে এতক্ষনে গাড়ির পাশে চলে এসেছে,হেলমেট দেখে মনে হচ্ছে ক্যামেরা সেট করা। তূর্যও তাকালো ছেলেটার দিকে। জানালা খোলাই ছিলো,ছেলেটা খুশিতে হাত বারিয়ে দিয়ে বলে,
_”আমি আপনার অনেক বড় ফ্যান ভাইয়া,একটা সেলফি প্লিজ?”

তূর্য হাসে সামান্য,ছেলেটা ফোন বের করে ছবি তোলে ওর সঙ্গে। এরপর মৌরিন এর দিকে খেয়াল করে বলে,
_”ভাইয়া কোথাও ঘুরতে যাচ্ছিলেন নাকি?”

তূর্য একনজর মৌরিনের দিকে তাকিয়ে পুনরায় ছেলেটার উদ্দেশ্যে বলে,
_”ক্যামেরা কি অন করা?”

_”হ্যা ভাইয়া,টুকটাক মটোভ্লগ করি আরকি।”

তূর্য নিজের সানগ্লাস টা খুলে একহাতে মৌরিনের কাধ জড়িয়ে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে বলে,
_”বউকে নিয়ে যাচ্ছি মধুচন্দ্রিমায়। ঠিকানা বলবো না, তবে অন্তত চারদিন নেটওয়ার্ক এর বাহিরে থাকবো। যতখুশি নিউজ বের করে নিন এ কদিনে। এন্ড অভিয়াসলি, প্রে ফর আস।”

ছেলেটার থেকে বিদায় নিয়ে পুনরায় গাড়ি নিয়ে এগিয়ে যায় তূর্য। সে জানে এবার মিডিয়ায় তোলপাড় শুরু হবে এই নিয়ে, চারবছর আগের সেই ছবি পুনরায় সামনে আসবে এই সূত্রে। এখন ই আসুক, চার পাঁচদিন এ পরিবেশ ঠান্ডা হোক। ততদিনে সেও সোশাল মিডিয়ার বাহিরের জগতটাকে একটু উপভোগ করে নিক।

______
সন্ধ্যার আগেই সবাই কাঙ্ক্ষিত স্থানে এসে পৌঁছেছে। এরপর অনেকটা সময় ধরে তাবু ঠিক করেছে, খড়কুটো জ্বালিয়ে খানিকক্ষণ আড্ডাও দিয়েছে সবাই একসঙ্গে। এরপর খাওয়া দাওয়া শেষ করে সবাই নিজেদের তাবুতে চলে গেছে। সবাই কাপল নিয়ে থাকলেও আবরাজ রয়েছে একা, তার সঙ্গী হলো ফোন। সবাই ভেবেছিল নেটওয়ার্ক পাওয়া যাবেনা,তবে নেটওয়ার্ক বেশ ভালোই পাওয়া যাচ্ছে এখানে।
অনেকদিন বাদে নিজের আইডির মেসেজ রিকুয়েস্ট এ ঢুকলো আবরাজ,সচরাচর কারোর মেসেজের রিপ্লাই সে করেনা। আজ কিছু মেসেজ চেক করতেই উপরের দিকের দু নম্বর মেসেজটাতে চোখ আটকে যায় তার। ক্লিক করে পুরো মেসেজটা দেখে আবরাজ,
_”এইযে রাজ সাহেব, মেসেজ এর রিপ্লাই কি দিবেন? অপেক্ষা করতে করতে তো ঘুম চলে এলো আমার।”

আইডি টা একটা মেয়ের,নাম দেওয়া মেঘবতী। যদিও ফেইক আইডি কিনা জানা নেই, তবে সম্মোধন টা ভালো লাগলো আবরাজের। ফলে ছোট করে রিপ্লাই দিলো,
_”দিলাম রিপ্লাই।”

মেসেজ সিন হলো দু সেকেন্ড এর মধ্যে। কয়েকটা অবাক এর ইমোজি দিয়ে রিপ্লাই এলো,
_”আয়হায়! আপনি সত্যিই রিপ্লাই দিয়েছেন? আল্লাহ আমি বোধ হয় আসলেই ঘুমিয়ে গেছি,ঘুমের মধ্যে এই স্বপ্ন দেখছি।”

আপনমনে হাসলো আবরাজ,রিপ্লাই দিলো আবারো। মেয়েটি তার অচেনা, তবুও টাইম পাসের জন্য দু একটা কথা বলাই যায়।
তাদের মধ্যে কথোপকথন চললো এক ঘন্টার বেশি সময় ধরে,কেবলই মেসেজ এ। এমনটা অনেক সময় হয়ে যায়, অপরিচিত ব্যক্তি মুহূর্তের মাঝে অনেক আপন হয়ে যায়, যেন ব্যক্তিটি অনেক দিনের চেনা। তবে এই কথোপকথন বাঁধা পরে যায় সামান্য সময়ের মাঝেই।
তেমনি পরবর্তীতে হয়তো এই মেয়েটির সঙ্গে আর কথাই হবেনা আবরাজের। নিজে থেকে সে মেসেজ দেবেনা, ভুলেই যাবে হয়তো। আবার যদি মেয়েটি নিজে থেকে মেসেজ দেয়,তাহলে কথা হলেও হতে পারে। হুটহাট তৈরি হওয়া বন্ধুত্ব অধিকাংশ সময় ক্ষনিকের হয়, তবে কিছুকিছু ক্ষেত্রে তা থেকে যায় অনেক দিন, চিরকাল।

_____
_”এটা আমাদের কততম হানিমুন?”

জ্যোতির কোলে মাথা রেখে তার কোমড় জড়িয়ে ধরে প্রশ্নটা করলো নির্ঝর। জ্যোতি কিছুক্ষন ভেবে ফিক করে হেসে বললো,
_”মেবি সপ্তম।”

_”এন্ড লাস্ট টাইম, শুধু আমরা দুজন। অষ্টম বার আরেকজনকে সঙ্গে নিয়ে আসতে হবে তাইনা?”

নির্ঝর এর চুলের মাঝে হাত ডুবিয়ে কিছুটা নিচু স্বরে বললো,
_”সত্যি তো?”

তার মুখের দিকে তাকালো নির্ঝর। তৎক্ষণাৎ উঠে বসে জ্যোতির দু’গালে হাত রেখে বলে,
_”ভয় পাচ্ছিস?”

জ্যোতি মাথা নাড়িয়ে বলে,
_”একটু একটু।”

জ্যোতির কপালের সঙ্গে নিজের কপাল ঠেকালো নির্ঝর, নাকে নাক ঘষে বললো,
_”এমন ভীতুর ডিম এর মা হওয়ার শখ হয়েছিলো কেন শুনি?”

_”আমি ভীতু নই, একটু আকটু ভয় তো সবারই লাগে।”

নির্ঝর বেশ ভালোই বুঝতে পারলো, জ্যোতি মুখে না বললেও মনে মনে ভালোই ভয় পাচ্ছে। জ্যোতির চিন্তা অন্যদিকে নেওয়ার জন্য নির্ঝর ফোনটা হাতে নিলো। এরপর গুগল থেকে অনেকগুলো বাচ্চার ছবি,নাম ইত্যাদি বের করলো। অনেকটা সময় ধরে এগুলো দেখালো জ্যোতিকে, দুজনে মিলে পঞ্চাশ টার উপরে ছেলে মেয়ের নাম ভেবে নিলো। ভয়টাও খানিকটা কাটলো জ্যোতির, একসময় নির্ঝর এর কাঁধে মাথা রেখেই ঘুমিয়ে পরলো সে।
নির্ঝর তা লক্ষ্য করেই সাবধানতার সাথে শুইয়ে দিলো তাকে,যেন তার ঘুম না ভেঙে যায়। তবে নির্ঝর বসেই রইলো। একটা বালিশ কোলে নিয়ে হাতে থুঁতনি ঠেকিয়ে তাকিয়ে রইলো তার প্রিয়তমার দিকে। ভালোবাসার কথা সে সচরাচর বলেনা, বলতে ভালো লাগেনা তার। সে তো সর্বদা জ্যোতিকে বিরক্ত করতে ব্যস্ত, তবে মুখে বলেনা বলে যে ভালোবাসে না তেমনটাও নয়। একটা কথা সচরাচর শোনা যায়, “ভালোবাসা গোপনেই সুন্দর”, এই কথায় ভীষণ বিশ্বাস করে নির্ঝর।
বালিশটা পাশে রেখে কিছুটা এগিয়ে এলো নির্ঝর, জ্যোতির মুখের উপর এসে পরা চুলগুলো সরিয়ে ঠোঁট ছোঁয়ালো তার গালে। অতি ক্ষীণ স্বরে বললো,
_”ভালোবাসি..”

_____
নিজেদের তাবুর একটু সামনেই গায়ে চাদর জড়িয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো তন্নি। একজোড়া হাত তাকে পিছন থেকে জাপটে ধরতেই মুচকি হাসে সে, এই ব্যক্তি তার চিরচেনা। তরির কথা মাথায় আসতেই তন্নি বলে ওঠে,
_”তরি একা আছে? উঠে কাঁদবে তো।”

তন্নির কাঁধে মুখ ডুবিয়ে রাতুল ধীর কণ্ঠে বললো,
_”হুশ.. আমার মেয়ে কি অমন নাকি? ও উঠবে একদম সকালে, তাই চুপ করে থাকো।”

_”তারপর ও..”

_”তুমি বড্ড আনরোম্যান্টিক হয়ে যাচ্ছো দিনদিন।”

ভ্রু কুঁচকে সামান্য ঘাড় ঘুরালো তন্নি। গম্ভীর স্বরে বললো,
_”আচ্ছা? আর আপনি বুঝি সবসময় রোম্যান্টিক ছিলেন?”

উত্তর দিলোনা রাতুল। কথা ঘুরিয়ে বললো,
_”এই আপনি টা আর কতকাল পরে তুমিতে রূপ নেবে শুনি?”

_”এখনো বলা যাচ্ছে না।”

কথাটা বলেই হাসলো তন্নি। রাতুল ওকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে গলা জড়িয়ে বললো,
_”থাক,আপনি ডাকটাও খারাপ না।”

একটু একটু শীত লাগছিলো রাতুলের। তন্নির গায়ে থাকা চাদরটা সরিয়ে প্রথমে নিজের শরীরে জড়ালো সেটা, এরপর তন্নিকে সামনে এনে একই চাদরে জড়িয়ে নিলো তাকে। আজকের চাঁদটা খুব সুন্দর,প্রেয়সীর সঙ্গে খানিকক্ষণ এভাবেই দাঁড়িয়ে রইলো রাতুল। টুকটাক প্রেমালাপ,সঙ্গে চন্দ্রবিলাশ, মুহূর্তটা মনে থাকবে হয়তো তাদের। কয়েক মাস,কয়েক বছর। বুড়োবয়সে একসঙ্গে বসে এমন মুহূর্তের স্মৃতিচারণ করবে তারা।

______
ঘড়িতে সময় ভোর চারটে, আলোর আভা এখনো ফোটেনি আকাশে। অনেক অনেক তারার মাঝে চাঁদটা এখনো জ্বলজ্বল করছে।
তাবুর চেইনটা অর্ধেক খুলে রাখা। তূর্যের একহাত বিচরণ করছে মৌরিনের উন্মুক্ত পেটে, অন্যহাতের দ্বারা তারই একটি হাত নিজের গালের সঙ্গে মিশিয়ে মৌরিনের কাঁধে মুখ ডুবিয়ে বসে আছে তূর্য। তার চক্ষুদ্বয় তখন বন্ধ অবস্থাতে। দুজনের শরীরে একই সঙ্গে কমফোর্ট জড়িয়ে রাখা, শীতল বাতাসে মৌরিনের খোলা চুল কিছুটা উড়ছে, তার চোখ তখনো খোলা। আকাশের দিকে তাকিয়েই আজ অনেক কথা বলছে তূর্যকে,আর তূর্য তার সব কথা কান পেতে শুনছে। বৃষ্টি পরছে সামান্য, তার দিকে লক্ষ্য করেই মৌরিন বললো,
_”জানো তূর্য,তোমায় একটা মিথ্যে কথা বলেছিলাম। শুনছো?”

_”হুম..”

চোখ বন্ধ অবস্থাতেই উত্তর দেয় তূর্য। মৌরিন আকাশের দিকে তাকিয়েই বলে,
_”বৃষ্টিতে ভেজা আমার খুব বেশি পছন্দ নয়। তবে আমার পছন্দ বৃষ্টি দেখা। বারান্দায় চেয়ারে বসে, এক কাপ চা সঙ্গে গল্পের বই, বাহিরে বৃষ্টি পরবে। দু এক ফোটা বৃষ্টির কণা শরীর ছুঁইয়ে দেবে। এমনভাবে বৃষ্টি উপভোগ আমার সবচেয়ে বেশি পছন্দের।”

কোনো উত্তর এলোনা তূর্যের থেকে। মৌরিন ঘাড় বাকিয়ে দেখলো তূর্য ঘুমে টলছে, তা দেখে মুচকি হাসে সে। নিজের যে হাতটা তূর্য তার গালে মিশিয়ে রেখেছিল তার দ্বারাই তূর্যের খোঁচা খোঁচা দাড়িতে হাত বুলিয়ে মৌরিন বললো,
_”ঘুম পেয়েছে তোমার?”

চোখ না খুলেই তূর্য বললো,
_”হুম? নাহ নাহ, তুমি বলো। শুনছি তো আমি..”

হাসি চওড়া হলো মৌরিন এর, ধীর কণ্ঠে পুনরায় বললো,
_”পরে শুনবে আমার কথা, এখন ঘুমোও।”

চোখ খুললো তূর্য, মৌরিন এর কোমড় আরো শক্ত করে আঁকড়ে বললো,
_”ঘুমোনোর জন্যও অনেক সময় পরে আছে, আজকে শুধুই তোমার কথা শুনবো। বুঝতে পেরেছো?”

সামনের দিকে চোখ সরিয়ে নেয় মৌরিন। শান্ত স্বরে বলে,
_”জীবন কেমন তূর্য?”

মৌরিনের ঘাড়ে আলতো করে ঠোঁট ছোঁয়ালো তূর্য, উত্তরে বললো,
_”তোমার ভাষ্যমতে,জীবন সুন্দর। আমার ক্ষেত্রে,বাকি সময়ের কথা বলতে পারছিনা। তবে বর্তমানে জীবন অসম্ভব সুন্দর।”

_”বর্তমানের কথা যদি আমায় জিজ্ঞেস করো,তাহলে বলতে হয়, বর্তমানে আমার জীবনে ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে খুজে দুঃখ বের করতে হবে। কারণ দু একটা দুঃখ ব্যাতীত প্রায় পুরোটাই সুখে পরিপূর্ণ।”

তূর্য মৃদু হেসে বলে,
_”ক্রেডিট আমার?”

_”একদমই না। আগেও বলেছি, নিজের সুখ নিজেকেই অর্জন করে নিতে হয়। আমিও তা অর্জন করেছি..”

কপাল কুঁচকে নেয় তূর্য,গম্ভীর স্বরে বলে,
_”তার মানে? আমি কোথাও নেই?”

স্মিত হাসলো মৌরিন। তূর্যর দিকে মুখ ঘুরিয়ে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলো, এগিয়ে এসে ঠোঁট ছোঁয়ালো তার গালে। ক্ষীণ স্বরে বললো,
_”ধরে নাও, এই পুরোটার মাঝে তুমি এক বিশেষ যায়গায় আছো। আরো ভালোভাবে বলা যায়, জীবনের শতভাগ সুখের মাঝে তুমি আমার এক ফালি সুখ।”

_”ধন্য এই পুরুষ, মৌরিফুল…”

কপালে কপাল ঠেকালো দুজনে, উভয়ের ঠোঁটে হাসির রেখা স্পষ্ট। তাদের উপর কারো নজর না লাগুক, এই সুখ স্থায়ী হোক চিরকালের জন্য। বেঁচে থাকুক তারা, একে অপরের এক ফালি সুখের কারণ হয়ে।…

#সমাপ্ত

[অবশেষে… সমাপ্তি টানলাম গল্পের। আপনাদের অনুভূতি জানিনা,তবে নিজের অনুভূতি আমি এই মুহূর্তে প্রকাশ করতে ব্যার্থ। চাইলে আমি বিশাল এক রচনা লিখে রাখতে পারি,তবে থাক.. আজ আর রচনা না লিখি।
ছোট করে বলি, এটা ছিলো আমার প্রথম গল্প, স্বাভাবিক ভাবেই আশার তুলনায় শতগুণ বেশি রিসপন্স পেয়েছি। আমি নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা করেছি সুন্দর এক ইতি টানার,চেষ্টা করেছি গল্পের অধিকাংশ চরিত্রকে শেষ পর্বে উল্লেখ করার। বাকিটা আপনারা বলবেন।

নতুন গল্প নিয়ে আসবো খুব দ্রুত,হয়তো কালই, ইনশাল্লাহ। দোয়া করবেন আমার জন্য, আসসালামু আলাইকুম।]