এক ফোঁটা প্রেমের বিষ পর্ব-১৭

0
377

#এক ফোঁটা প্রেমের বিষ
#Tahmina_Akhter

১৭.

শোয়েব ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে আসে। রুমে এসে দেখে ওর দুবোন আর মিলি কি নিয়ে আলাপ করছে? শোয়েব সেই সবে কান না দিয়ে টাওয়াল দিয়ে ভেজা চুল মুছতে মুছতে বারান্দায় চলে যায়। বারান্দায় এসে বাইরের পরিবেশের দিকে তাকিয়ে শোয়েব জোরে শ্বাস নিয়ে আল্লাহর নেয়ামতের প্রতি অংসখ্য শুকরিয়া আদায় করে।

— এই যে শুনছেন???

মিলির ডাক শুনে শোয়েব ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো মিলি বারান্দার দরজায় এসে দাঁড়িয়ে আছে। গোলাপি রঙের সুতির শাড়ি, আর ভেজা চুলে মিলিকে আজ সত্যি সত্যি বৌ লাগছে। কিন্তু, নতুন বৌকে তো বর ছাড়া থাকতে নেই। তাই শোয়েব মুচকি হেসে মিলির সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। তারপর, বারান্দার কাচের দরজা ভেদ করে রুমের ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখে। ওর বোনেরা কেউ আছে নাকি এই ভেবে। কিন্তু, রুমের ভেতর কেউ নেই। হয়তো, শোয়েব যখন বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়েছিল ঠিক তখনি হয়তো ওরা দুজন চলে গিয়েছে।

— একটা কথা বলব??

মিলির কথায় শোয়েব সোজা হয়ে দাঁড়ায়। শোয়েব মিলির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মিলির দুকাঁধে হাত রেখে বললো,

— বলো।

— শুনলাম আজ নাকি আমরা ঢাকায় চলে যাব। সবাইকে ছেড়ে ঢাকায় গিয়ে থাকব ব্যাপারটা কেমন দেখাবে?

মিলির কথা শুনে শোয়েব একগালে হেসে মিলির নাকে টোকা দিয়ে বললো,

— আরে বোকা মেয়ে! তুমি আমি ঢাকায় গিয়ে না থাকলে কোথায় থাকব? তোমাকে নারায়ণগঞ্জ রেখে আমি ঢাকায় গিয়ে হসপিটালে ডিউটি করতে পারব না এক মূহুর্তের জন্যেও। অতএব, তোমাকে আমার সাথে ঢাকায় গিয়ে থাকতে হবে।

কথাটি শেষ করে মিলিকে কোলে তুলে নেয় শোয়েব। মিলি লজ্জা পেয়ে শোয়েবের বুকে মুখ লুকায়। শোয়েব মিলিকে কোলে নিয়ে বারান্দা থেকে ঘরে চলে আসে। তারপর, মিলিকে খাটের উপর বসিয়ে টুপ করে মিলির গালে চুমু একেঁ দেয়।শোয়েবের কান্ড দেখে মিলি ভুল করেও আর ঘাড় উঁচু করে তাকায়নি।

শোয়েব মিলির কোলে মাথা রেখে শুয়ে পরে। মিলির ডানহাত টেনে এনে নিজের বুকের ওপর রেখে দেয়। আর বামহাত টেনে এনে নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে শোয়েব ধীর গলায় মিলিকে উদ্দেশ্য করে বললো,

— রাতের ঘটনার জন্য তুমি রেগে আছো, মন?

শোয়েবের মুখ থেকে এই কথা শোনার পর মিলির গতকাল রাতের কথা মনে পরে যায়। মিলি লজ্জা পেয়ে আরেকদিকে তাকিয়ে আছে। শোয়েব জানে মিলিকে এখন হাজারবার অনুরোধ করলেও ওর মুখ দিয়ে একটি শব্দও উচ্চারিত হবে না।

গতকাল রাতে বেশ সময় ধরে তাদের মাঝে বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন রকমের গল্প-গুজব চলতেই থাকে। এরই ফাঁকে হুট করে শোয়েবের চোখ পরে মিলির মুখশ্রীর পানে।

অন্ধকার ঘর। খাটের ওপর গন্ধরাজ ফুল আর গোলাপ দিয়ে সাজানো বলে দুই ফুলের মিশ্রিত সুবাস। জানালার কাচ গলিয়ে চাঁদের আলো এসে মিলির মুখের ওপর পরছে। সাধারণ সাজেও আজ শোয়েবের কাছে মিলি অতুলনীয় সুন্দরী।

শোয়েব নিজের বালিশ থেকে সরে এসে মিলির বালিশে মাথা পেতে শুয়ে পরে। মিলি সরে যেতে চায় কিন্তু শোয়েব মিলিকে নিজের বাহুডোরে আবদ্ধ করে নেয়। মিলিকে বুকে জরিয়ে নিতেই শোয়েবের বুকে যেন এক শীতল বাতাস বয়ে যায়। হৃদয়ে এতটা শীতল অনুভব এর আগে কখনো হয়নি শোয়েবের। নিজের অর্ধাঙ্গী এবং ভালোবাসার মানুষকে বুকে জরিয়ে নেয়ার শান্তিটুকু বুঝতে পারে শোয়েব। মিলি বিড়াল ছানার মতো চুপটি করে শোয়েবের বুকের সাথে মিশে আছে। হয়তো, শোয়েবের হৃদয়ের এক একটি শব্দ শুনছে মিলি।

—- মিলি???

শোয়েবের শীতল কন্ঠের ডাক শুনে মিলির পুরো শরীরে কাঁপন ধরে যাচ্ছে। এতটাই কাঁপন ধরেছে যে শোয়েব পর্যন্ত টের পেয়ে যাচ্ছে। শোয়েব ফের ডাক দিলে মিলি শোয়েবের ডাকে সাড়া দেয়। তখনি শোয়েব মিলিকে উদ্দেশ্য করে বললো,

— আমি আজ তোমাতে বিলীন হতে চাই। আমার ভালোবাসার রাজ্য তোমার আগমনের বার্তায় আমি যতটা আনন্দিত ঠিক ততটাই আমি আহত তোমাকে স্পর্শ করার পর থেকে। আমার হৃদয়ে যেই ভালোবাসার জোয়ার তুমি নিয়ে এসেছো। আজ সেই তোমার স্পর্শে আমার হৃদয়ে আজ ভালোবাসার ভাটা আসুক।

মিলি কোনো উত্তর দেয়নি কিন্তু আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে শোয়েবের শরীরের সঙ্গে মিশে যায়। আর শোয়েব নিজের উত্তর পেয়ে যায়।

সেই রাতে শোয়েব আর মিলির আরও একধাপ সম্পর্ক এগিয়ে যায়।

অতিক্রম হয়ে যাওয়া সেই সময়ের মূহুর্তটুকু মনে পরতেই মিলি লজ্জায় লাল হয়ে যায়। শোয়েব মিলির মুখের দিকে তাকিয়ে আছে পলকহীন চোখে। এই যে তার মনের চেহারায় রাগের কোনো আভাস দেখতে পাচ্ছে না। বাকি যা আছে সবই লজ্জা। তাই শোয়েব মিলিকে আর অস্বস্তিতে না ফেলে বললো,

— থাক তোমার উত্তর আর চাই না আমার। এখন জলদি করে খেতে চলো। দশটার দিকে হয়তো পার্লার থেকে দুজন মেয়ে আসবে।

কথাটি বলে মিলির হাত ধরে রুম থেকে বের সোজা চলে যায় ডাইনিংটেবিলে। সেখানে যেতেই মিলি দেখলো এক এলাহি আয়োজন। শোয়েবের ছয়বোন এবং ওদের পাঁচবোনের স্বামী , মা-বাবা সবাই ডাইনিং টেবিলে বসে অপেক্ষা করছে।

শোয়েব এবং মিলিকে একসাথে আসতে দেখে ইরাবতী ডাইনিংটেবিলের চেয়ার ছেড়ে একদৌঁড়ে চলে যায় মিলির কাছে। শোয়েব নিজের বোনকে দেখে মিলির হাত ছেড়ে দিয়ে চেয়ারে গিয়ে বসে পরে। ইরাবতী মিলির হাত ধরে টেনে এনে শোয়েবের পাশের চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে নিজেও বসে পরে।

শোয়েবের মা নিজের ছেলে এবং ছেলের বৌকে একসাথে দেখে বললো,

— শোয়েব, তুই ডাক্তারি পাশ করেছিস শুনেও এতটা খুশি হয়নি। আজ যতটা তোকে আর মিলিকে পাশাপাশি দেখে খুশি হয়েছি। বাপ তুই আমার ঘরে এক ফালি জোছনার আলো এনেছিস।

শোয়েব নিজের মায়ের দিকে তাকিয়ে হাসি বিনিময় করে । আর মিলি মাথা নীচু করে শ্বাশুড়ির কথা শুনে মনে মনে শান্তি পায়।

তারপর, সবাই একসাথে বসে সকালের নাশতা শেষ করে। খাওয়াদাওয়া শেষ হবার পর শোয়েব সবার আগে ঘরে চলে যায়। দশমিনিট পর ইরাবতীর ফোনে কল করে শোয়েব জানায় মিলিকে নিয়ে যে তাড়াতাড়ি ঘরে চলে আসে। ইরাবতী শোয়েবের কথা শুনে মিলিকে টিপ্পনী কেটে বললো,

— আমার ভাই দেখি তার মনকে ছাড়া দশমিনিটও থাকতে পারে না।

কথাটি বলতেই বাকি পাঁচ বোন উচ্চ স্বরে হেসে উঠলো। মিলি তো লজ্জায় শেষ। মনে মনে শোয়েবকে অসংখ্য বকা দিচ্ছে আর লজ্জায় মাথা নীচু করে রেখেছে।

ইরাবতী মিলিকে শোয়েবের ঘরে দিয়ে নিজের ঘরের দিকে চলে যায়। মিলি ধীরপায়ে ঢুকতেই দেখলো শোয়েব কার সাথে যেন মোবাইলে কথা বলছে। মিলির পায়ের পদধ্বনি শুনে শোয়েব ঘাড় ফিরিয়ে পেছনে তাকিয়ে দেখলো। মিলিকে একনজর দেখে শোয়েব আবারও মোবাইলে কথা বলতে ব্যস্ত হয়ে যায়।

শোয়েবের কথাগুলো শুনে মিলির ধারণা হয় যে শোয়েব হয়তো কাউকে আসার জন্য অনেক অনুরোধ করছে। কিন্তু, অপর প্রান্তে থাকা ব্যক্তি হয়তো আসতে চাইছে না। তাই শেষ মেষ শোয়েব না পেরে মিলির দিকে মোবাইল এগিয়ে দিয়ে বললো,

— নে তোর ভাবির সাথে কথা বল।

মিলি চোখ বড়ো বড়ো করে তাকায় শোয়েবের দিকে। শোয়েব চোখের ইশারায় মিলিকে অনুরোধ করে বলছে যেন তার বন্ধুকে আজ রিসিপশনে আসার জন্য অনুরোধ করে। তাই উপায়ন্তর না পেয়ে মিলি মোবাইল কানে ঠেকিয়ে সালাম দেয়। অপরপাশ থেকে সালামের উত্তর শুনতে পায় মিলি। অতঃপর, মিলি বললো,

— আপনি এলে আমি এবং আপনার বন্ধু অনেক খুশি হবো। প্লিজ, আপনি আজ দুপুরে চলে আসবেন।

— হা হা হা পাগলটা আপনার কাছে পর্যন্ত মোবাইল ধরিয়ে দিয়েছে! আচ্ছা, এতই যেহেতু অনুরোধ করা হচ্ছে তাহলে আমি আসব। কারণ, শোয়েবের কোনো কথা সাইফ আজও ফেলতে পারেনি।

কথা শেষ হলে মিলি শোয়েবের দিকে মোবাইল এগিয়ে দেয়। শোয়েব মিলিকে ধন্যবাদ জানিয়ে বললো,

— সাইফ আমার জানে-জিগার দোস্ত। ওকে ছাড়া বিয়ে করেছি বলে ভীষণ রেগে আছে। তাই আজ ওকে এত অনুরোধ করছি, বুঝলে।

— আপনারা কি কলিগ নাকি ফ্রেন্ড?

— ফ্রেন্ড। বলতে পারো প্রাইমারী পর্যায়ে যখন ছিলাম ঠিক তখন থেকে ওর সাথে আমার বন্ধুত্ব। কিন্তু, মাঝের দু’বছর ওর সাথে আমার কোনো যোগাযোগ ছিল না। আজ একমাস হলো ওর সাথে সেই আগের মতো যোগাযোগ হচ্ছে।

এমন সময় কে যেন দরজায় নক করে। শোয়েব উঠে গিয়ে দরজা খুলতেই দেখতে পায় ইরাবতী আর পাশে অচেনা দু’জন মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হয়তো, অচেনা দু’জন পার্লার থেকে এসেছে।

— ভাই তুমি এখন ঘর থেকে বের হয়ে সোজা মেহের আপার ঘরে চলে যাও। আমরা তিনজন মিলে ভাবিকে সাজাব, ঠিক আছে?

ইরাবতীর কথা শুনে শোয়েব একপলক মিলির দিকে তাকিয়ে রুম থেকে বের হয়ে যায়।

এদিকে পার্লার থেকে আসা দুজন মেয়ে মিলিকে সাজাতে শুরু করে। আর ইরাবতী বসে বসে কতক্ষণ মিলির সাথে বসে ছবি তুলছে তো কিছুক্ষণ পর পর শোয়েবকে ভিডিওকলে মিলির সাজ দেখাচ্ছে। মিলি ভেবে কূল পায় না যে পাশাপাশি ঘরে বসে কিভাবে একটা মানুষ ভিডিওকলে মিলিকে দেখতে পারে!

#চলবে