এক ফোঁটা প্রেমের বিষ পর্ব-২৫

0
435

#এক ফোঁটা প্রেমের বিষ
#Tahmina_Akther

২৫.

এরইমাঝে কেটে যায় একমাস । শরৎের কাছ থেকে কোনো জবাব আসে না। তাই মিলি আবারও একটি চিঠি লিখে,

অপ্রিয় ভালোবাসা,

কেমন আছেন আপনি? ভালো আছেন নিশ্চয়ই? কিন্তু, আমি একটুও ভালো নেই জানেন। ইদানীং আমি ঠিকমতো খেতে পারি না। ঘুমাতে পারি না। আমার মস্তিষ্কের শত ভাবনা জুড়ে শুধু আপনি বিরাজমান। এর আগে আরও একটি ট্যাক্সট দিলাম আপনাকে। কিন্তু, আপনি রিপ্লাই দেননি এমন কি দেখেননি অব্দি।

আপনার জন্য শত মেয়েরা মুখিয়ে থাকে। সবাই হয়তো আপনি সেলেব্রিটি বলে আপনাকে পছন্দ করে। কিন্তু, আমি আপনাকে ভালোবাসি। বলতে পারেন আপনার জন্য আমি জীবন দিতেও পারব। আবার জীবন কেড়ে নিতেও পারব।

আপনি যদি এবার আমার মেসেজের রিপ্লাই না করেন তবে আমি বিষ খাব। আর আপনি জানতেও অব্দি পারবেন না কেউ একজন আপনাকে ভালোবেসে, আপনার কাছ থেকে আমার ভালোবাসার প্রত্যাখান পেয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছে।

ইতি,
হৃদয়েশরী.

মিলি মেসেজটি সেন্ড করে পুরো এক সপ্তাহ অপেক্ষা করে। কিন্তু, শরৎ মেসেজ সিন করে না। অভিমানী মিলির এক আকাশ সমান অভিমান জমে শরৎের ওপর। প্রথম ভালোবাসা এভাবে হারিয়ে যাবে। এই ভাবনা থেকে মিলি সত্যি সত্যি আত্মহননের পথ বেছে নেয়। তবে, আত্মহত্যা করার আগে সে নিজের একটি ছবি এবং মোবাইল নাম্বার শরৎের মেসেঞ্জারে সেন্ড করে দেয়। এবং, নাম্বারের নীচে লিখে দেয়,

“যদি কখনো আমাকে ফিরে পেতে চান তবে এই নাম্বারে কল দিলে আপনি আপনার হৃদয়েশ্বরীকে খুঁজে পাবেন”

সেই রাতে মিলি বিষ পান করে। কিন্তু, ভাগ্য সহায় ছিল বলে মাহিম মিলিকে বিষ পান করার সময় দেখে ফেলে। পরে তিনভাই মিলে মিলিকে হসপিটালে নিয়ে যায়। দুইদিন মৃত্যুর সাথে লড়াই করে আল্লাহর অশেষ মেহেরবানীতে সবার কাছে বেঁচে ফিরে আসে।

আমি সুস্থ হবার পর বাবা আমাকে বুঝালেন কাউকে নিজের করে পাওয়ার জন্য জীবনকে তুচ্ছ করা ঠিক নয়। “হৃদয়েশ্বরী” নামের ফেসবুক
এক্যাউন্ট ডিলিট করে দিলাম। পড়াশোনায় মনোযোগী হলাম। ধীরে ধীরে “শরৎ” নামক মানুষটাকে ভুলে যাওয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছি আমি। জানি না ঠিক কবে আমি এই মানুষটাকে ভুলতে পারব।

ডায়েরিতে এতটুকু পর্যন্ত লেখা। তারপরের, অনেক পৃষ্ঠা ফাঁকা। এরপর, ডায়েরিতে আবারও লেখা দেখতে পায় শোয়েব। এই লেখাগুলো তখনের যখন মিলি আটমাসের অন্তঃসত্ত্বা। হয়তো, অজানা অব্যক্ত কথাগুলো শোয়েবকে জানাবে বলেই সেই পুরনো ডায়েরিতে নতুন করে কালির প্রলেপ ঢেলেছে শব্দের আকারে।

আজ আমি আমার পুরনো ভালোবাসার মানুষ “শরৎকে” খুঁজে পেয়েছি। কিন্তু, সবচেয়ে দুঃখের বিষয় হলো, “শরৎ” আমার স্বামীর অনেক ভালো বন্ধু। আমার স্বামী শোয়েব আমাকে অনেক ভালোবাসে। কিন্তু, শরৎ যখন থেকে আমার চোখের সামনে এসেছে ঠিক তখন থেকে আমার আর শোয়েবকে সহ্য হচ্ছে না। মনে হচ্ছে ওর জন্য আমি আমার শরৎকে ফিরে পাব না।

পরের পাতায়..

আজ সাহস করে শোয়েবকে আমার ভালোবাসার মানুষের কথা বলে চলে এসেছি শরৎের কাছে। তবে ফিরে আসার আগে শোয়েবকে তালাক দিয়ে এসেছি।

পরের পাতায়…

আজ আমার আর শরৎের গায়ে হলদু। বাবা আর আমার তিনভাইয়েরা আমাদের বিয়েতে রাজি নয়। তবুও আমার মুখের দিকে তাকিয়ে ওরা বিয়ের সকল আয়োজন করেছে ছোট্ট পরিসরে।

কিন্তু, হলুদের দিন এসে আমি পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিনতম সত্য জানতে পেরেছি। আর তা হলো সাইফ আমার ভালোবাসার মানুষ শরৎ নয়। শরৎ অন্য একজন।

— তুমি যাকে ভালোবাসতে তার সাথে আমার জনম জনমের শত্রুতা। সে জানে না যে আমি ওকে শত্রু ভাবি। ও আমাকে ওর সবচেয়ে ভালো বন্ধু হিসেবে জানে। ওর কারণে আমি আমার ডান চোখ হারিয়েছি। আমার জীবন সকল স্বপ্ন ওর জন্য ভাঙা আয়নার মতো চুরমার হয়ে গেছে।

— এই জন্যই কি আপনি সবসময় সানগ্লাস পরে থাকেন?

— হুম। দুষ্টমির ছলে ও আমাকে বড়ই গাছ থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিল। এতেই আমার মস্তিষ্কে ক্ষতি হয় যার দরুন আমার একটি চোখের দৃষ্টি শক্তি কমে যায়। ও আমাকে বারবার সরি বলেছে। কিন্তু, ওর সরি দিয়ে আমি কি করব? এতে কি আমার চোখের দৃষ্টি ফিরে আসবে? আসবে না। তাই আমি সেদিনের পর থেকে অপেক্ষা করতে থাকলাম কবে ওর কাছ থেকে আমি প্রতিশোধ নেব। সময়টা খুব তাড়াতাড়ি চলে এলো আমার জীবনে। একদিন তোমার শরৎ এসে আমাদের কাছে ভারাক্রান্ত মন নিয়ে হৃদয়েশ্বরী নামের একটি মেয়ের লেখাগুলো দেখায়। এবং লাস্টে লেখা ছিল সেই মেয়েটি নাকি সুইসাইড করবে। শরৎ নাকি আজ দুদিন হলো মেয়েটার সঙ্গে অনেকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু পারছে না ওর সেই সাহসটুকুও নেই। যদি জানতে পারে মেয়েটি আত্মহত্যা করেছে সেই ভয়ে। শরৎ সেদিন প্রথমবারের মতো কেঁদেছিল। মেয়েটিকে হারানোর ভয়ে। আমি ওকে মিথ্যা সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিলাম, তোর আইডির পাসওয়ার্ড আমাকে দে। আমি ওই মেয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করব৷ আমার বোকা বন্ধু তার পাসওয়ার্ড আমাকে দিয়ে দিলো। সেই রাতে আমি ওর আইডিতে লগইন করতেই মেসেঞ্জারে দুইটা মেসেজ এলো। আমি মেসেজ দুটো চেক করার জন্য সেই আইডিতে ঢুকলাম। সুন্দর একটি মেয়ের ছবি। হলুদ শাড়ি গায়ে, ফর্সা দেবীর মতো দেখতে আনুমানিক অষ্টাদশী এক কন্যা। আমি মুগ্ধ হয়ে সেই মেয়েটির ছবির দিকে তাকিয়ে রইলাম। হুট করে মনে পরলো যদি শরৎ এই মেয়ের ছবি দেখে ফেলে। তাই আমি নিজের গ্যালারিতে ছবিটি সেইভ করে ডিলিট করে দিলাম সাথে নাম্বারটি আমার মোবাইলে সেইভ করে কেটে দিলাম। ব্যস, শরৎের আর কখনোই “হৃদয়েশ্বরী” নামক মেয়েটিকে খুঁজে পাবে না। প্রচুর হিংসা করতাম আমি শরৎের ভাগ্যকে ভেবে। শরৎ দিনকে দিন ছন্ন ছাড়া হয়ে ঘুরছিল। কিন্তু, “হৃদয়েশরী” নামক মেয়েটির সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করতে পারছিল না। বন্ধুমহলে খবর ছড়িয়ে যায় শরৎ ওরফে তোমার প্রাক্তন স্বামী শোয়েব “হৃদয়েশরীকে” ভালোবেসে দেউলিয়া হয়ে ঘুরছে।
কিন্তু, ভাগ্যের ফেরে তুমি আর শোয়েব এক হয়েছো। তোমাকে সেদিন বধু বেশে শোয়েবের পাশে দেখে আমি ভীষন অবাক হয়েছিলাম। এই ভেবে যে তোমরা একে অপরকে খুঁজে পেয়েছো। মনের খচখচানিটা কমানোর জন্য আমি তোমাকে জিজ্ঞেসও করি। কিন্তু তুমি বললে তোমাদের এরেন্জড ম্যারেজ। আমি তখনি নিশ্চিত হই। বাসায় ফিরে যাই। শোয়েবকে তো আর এত বেশি সুখী হতে দেয়া যায় না। তাই আমি আমার পরিকল্পনা অনুযায়ী কল দেই তোমার কাছে এন্ড তুমি আমার পাতা ফাঁদে পা রেখে তোমার সত্যিকারের শরৎকে ফেলে আমার কাছে ফিরে এসেছো। এন্ড আমার মনের এতদিনের পুষে রাখা প্রতিশোধের জ্বলন্ত আগুন ধীরে ধীরে শীতল হয়ে আসছে। কারণ, আমি আমার প্রতিশোধ নিতে পেরেছি।

এতক্ষণ, নিশ্চুপ হয়ে আমি সাইফের সকল কথা শুনছিলাম। ওর সব কথা শোনার পর আমি ওর গালে চপাটে চারপাঁচটা থাপ্পড় মেরে বসি। আমার চিৎকার চেচামেচি শুনে আমার বড়োভাই এগিয়ে এসে আমাকে শান্ত করার চেষ্টা করে। জানতে চায় কেন আমি এমন করছি? আমি ভাইয়াকে সেদিন প্রথমবারের মতো জানাই শরৎকে আমি ভালোবাসি। কিন্তু, সাইফ বলছে সে আসল শরৎ নয়। শরৎ অন্য একজন।
ভাইয়া আমার কথা শুনে রেগে ফেটে পরলো।আমার গালে দুটো থাপ্পড় মেরে বলে,

— তুই কি একবারও আমাকে জানিয়েছিস যে তুই শরৎকে ভালোবাসিস। আরে শরৎ হচ্ছে তোর প্রাক্তন স্বামী। শোয়েব একবার আমাদের বাড়িতে এসেছিল। আর আমিই তোকে বলেছিলাম “শরৎ”
নিজের পরিচয় লুকিয়ে এই ভার্চূয়াল জগতে আছে।

আমি হাঁটু গেড়ে মাটিতে বসে পরি। যাকে এত এত ভালোবাসি। যার বুকের কাছাকাছি মাথা পেতে রাতে অঘোরে ঘুমিয়েছি। যেই শরৎকে ভালোবেসে একদিন মরতে চেয়েছিলাম। আজ সেই শরৎকে আমি একজন ভন্ডের কথা শুনে এই ভাবে হারিয়ে ফেলেছি!

সেই রাতে আমি পাগলের মতো কেঁদেছি। শরৎকে হারানোর ভয়ে নয় শোয়েবের ভালোবাসা হারিয়ে। যার বিশ্বাস এবং ভালোবাসাকে আমি সাইফের মতো লোকের কথায় বিশ্বাস করে পায়ে ঠেলে চলে এসেছি।

বাবা প্যারালইজড হবার পর থেকে কথা বলতে পারেন না। কিন্তু, সন্তানের দুঃখে চোখের পানি ফেলতে পারেন। আমি সকাল ভোরে সাইফকে কল দিয়ে বললাম,

— আমি আপনাকেই বিয়ে করব।

সাইফ আমার কথা শুনে খুশিতে আত্মহারা হয়ে যায়। কিন্তু, ওর এই খুশি বেশিক্ষণ টিকে না। সাইফ ডায়াবেটিসের রোগী। গতকাল, রাতে ও আমাদের বাড়িতে আসার সময় ওর ইনসুলিন নিয়ে আসে। কল করে বারবার বলে দিয়েছে যেন সেন্টারে মনে করে ওর ইনসুলিন নিয়ে যাই।

আমি ওর ইনসুলিন নিয়ে যাই ঠিকই কিন্তু বিষ ভরে। সেন্টারে পৌঁছানোর পর ও ওয়াশরুমে গিয়ে ইনসুলিন দিয়ে আসে। তখনও ওর শরীরে কোনো বিষক্রিয়া ঘটে না। কারণ, এটা সময় নিয়ে বিষক্রিয়া ঘটায় শরীরে।

আমি তখন একটি রুমে বসে সাইফের মৃত্যুর প্রহর গুনছিলাম। এমন সময় সাইফ কল করে জানায় ওর রুমে যেতে। আমি বধু বেশে ওর জন্য বরাদ্দকৃত রুমে যাই। সেখানে যেতেই ও আমাকে বলে,

— তোমাকে আমি বিয়ে করতে পারব না।

— কিন্তু, কেন???

—কারণ, অন্যের সাথে ঘর-সংসার করে আসা মেয়েকে আমার মতো ছেলে বিয়ে করবে। আনপসিবল।

কথাটি শেষ করার পরপরই সাইফের প্রচন্ড কাশি শুরু হয়। আমি হতদন্ত হয়ে ওকে টেবিলের উপরে রাখা পানিভর্তি গ্লাসটি দিয়ে দেই। পানি খাওয়ার মিনিট পাঁচেক পর সাইফ আমার সামনে মৃত্যুর কোলে ঢলে পরে। আমি তখন ভেবেছিলাম হয়তো আমার দেয়া বিষাক্ত ইনসুলিনের প্রভাবে সে মারা গেছে। কিন্তু, সে যে পুনরায় বিষ খেয়ে মারা যায় আমি জানতাম না।

মনে মনে পৈশাচিক আনন্দ অনুভব করছিলাম আমি। কারণ, একবার আমি বলেছিলাম, আপনার জন্য আমি জীবন দিতেও পারব। আবার জীবন কেড়ে নিতেও পারব।

কিন্তু, শোয়েব আপনি ডিপার্টমেন্টে টাকা খাইয়ে রিপোর্টে দেখালেন যে, সাইফ তার নিজের বানানো বিষের পানি পান করে মৃত্যুবরণ করেছে। নয়তো, রিপোর্টে ইনসুলিনের মধ্যে যে বিষ ছিল তা স্পষ্ট হতো। আমার মতো মেয়েকে বাঁচাতে আপনি কত কিছু করলেন। কিন্তু, বিনিময়ে আমি আপনাকে কিছুই দিতে পারিনি শুধুমাত্র দুঃখ ছাড়া।

ডায়েরীর শেষ পাতায়…

হয়তো, ভাবছেন এত কথা কেন এই ডায়েরিতে লিখে রেখেছি? সেই ঘটনার পর আপনার সামনে দাঁড়িয়ে কখনো মাথা উঁচু করে তাকিয়ে আপনার সাথে কথা বলতে পারিনি। ইদানীং মনে হচ্ছে আমি মরে যাব। তাই পুরনো সেই শরৎের জন্য আমার লেখা এই ডায়েরিতে এই ঘটনা গুলো লিখে রাখলাম। আমি জীবিত থাকতে হয়তো আপনি এই লেখাগুলো আপনি পড়তে পারবেন না। কারণ, আমি জীবিত থাকলে আপনি এই কথাগুলো জানতে পারলে লজ্জায় আমি আপনার চোখের দিকে তাকাতে পারব না। আমি বলব না যে আমাকে ভালোবাসুন। কিন্তু, আমার মরণের পরে হলেও একটিবার আমার কানের কাছে “হৃদয়েশ্বরী” বলে ডাক দিলে আমার অন্তরে শান্তি আসবে।

আমাদের দুইটা মেয়ে হলে নাম মেহনুবা-মাহি রাখবেন। আর যদি ছেলে হয় তবে মাশহুদ- ফায়রাজ রাখবেন। আপনার কাছে আমার শেষ আবদার রইলো।

#চলবে