এক ফোঁটা প্রেমের বিষ পর্ব-১৯

0
368

#এক ফোঁটা প্রেমের বিষ
#Tahmina_Akhter

১৯.

তখন শোয়েব আর মিলির বিয়ের পনেরোতম দিন। সকাল আটটার আগে শোয়েব বের হয়ে যায় হসপিটালের উদ্দেশ্য। শোয়েব চলে যাওয়ার পর মিলি পড়তে বসে। কারণ, সামনে এইচএসসি পরীক্ষা।

টেবিলে বসে বইয়ের পাতা খুলে দৃষ্টি রাখবে তার আগে মিলির মোবাইলে কল আসে। মিলি উঠে এসে খাটের ওপর থেকে মোবাইল ফোন হাতে নিয়ে দেখলো অচেনা নাম্বার থেকে কল এসেছে। মিলি কল রিসিভ করে সালাম জানায়। ওপাশ থেকে কোনো জবাব এলো না। শুধুই নীরবতা। মিলি বিরক্তবোধ করলো। কল কেটে দিয়ে বইয়ের পাতায় চোখ রাখার আগে আবারও কল এলো সেই অচেনা নাম্বার থেকে।

মিলি বিরক্তি লুকিয়ে রাখতে না পেরে কল রিসিভ করে বললো,

— সমস্যা কি? কল দিয়ে কথা বলছেন না কেন?

— হৃদয়েশ্বরী???

কিছু সময় পর ওপর প্রান্তে থাকা লোকটার মুখ থেকে “হৃদয়েশ্বরী” নামটি শুনে মিলি স্তব্ধ হয়ে যায়। চিরচেনা বহু অপরিচিত মানুষ শরৎের দেয়া নামটি কারো কন্ঠ থেকে শুনতে পেয়ে মিলি বাকরূদ্ধ।

— কথা বলবে না আমার সঙ্গে? আমি তোমার শরৎ।

মিলি দুচোখ বন্ধ করে চোখের কোলে জমে থাকা জল গুলো গড়িয়ে দেয়। গালদুটো ভিজে যাচ্ছে চোখের জলে। অস্বাভাবিকভাবে মিলির পুরো শরীর কাঁপছে। তাই মিলি কল কেটে দেয়। কি জবাব দেবে সে?

কল কেটে দেয়ার পর মিলি সারাঘরে পাগলের মতো পায়চারি করছে। একদিকে শোয়েব অন্যদিকে মিলির হারিয়ে যাওয়া সেই শরৎ মানব। যাকে অদেখায় ভালোবেসে মিলি আজ ভালোবাসার কাঙাল। ফিরে যখন এসেছে তবে এতবছর পরই কেন? একমাস আগে ফিরে এলে কি হতো?

আবারও কল আসছে। মিলি এবার স্বাভাবিকভাবেই কল রিসিভ করে। ওপাশ থেকে একের পর এক প্রশ্ন আসছে। মিলি কোনো প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে নিজে প্রশ্ন করে।

— এত বছর পর কেন আমাকেই আপনার মনে পরলো? আর আমার নাম্বার কোত্থেকে পেলেন, আপনি?

— উপযুক্ত সময় আসেনি তাই তোমার সামনে আসিনি। আর তুমি নিশ্চয়ই ভুলে গেছো আমাদের যেবার শেষ কথা হয়েছিল তুমি কিন্তু তোমার ছবি আর মোবাইল আমাকে দিয়েছিলে।

— আমি কোনো বাহানা শুনতে চাই না। প্লিজ আপনি আর আমার কাছে কল দিয়ে যোগাযোগ করার চেষ্টা করবেন না। আমি বিবাহিত। আমার স্বামী আমাকে অনেক ভালোবাসে।

মিলির কথা শুনে ফোনের অপ্রান্তে লোকটা ঠাট্টা সুরে হাসি দিয়ে বললো,

— তুমি তোমার স্বামীকে ভালোবাসো তো?

মিলি চুপ হয়ে যায়। সত্যিই তো শোয়েবকে তো মিলি ভালোবাসে না। শোয়েবের প্রতি মিলির যেই অনুভূতি অনুভব হয় তা শুধুমাত্র মায়া এবং সম্মানের দিক থেকে আসে।

— আপনাকে বলতে হবে কেন আমি আমার স্বামীকে ভালোবাসি কি-না?

কথাটি বলে কল কেটে দেয় মিলি। মোবাইল সুইচ অফ করে খাটের ওপর উপুর হয়ে শুয়ে জোর গলায় কেঁদে ওঠে।

সন্ধ্যা সাতটার পর শোয়েব ফ্ল্যাটে ফিরে আসে। ফ্ল্যাটের দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করতেই দেখলো পুরো ঘুর অন্ধকার হয়ে আছে। শোয়েব মিলির নাম ধরে কয়েকবার ডাক দেয়ার পরও যখন মিলি সাড়া দিচ্ছিল না ঠিক তখনি শোয়েবের মনে অজানা আতংক বাসা বাঁধে।

এক দৌঁড়ে নিজেদের রুমের দরজা খুলে লাইট অন করতেই শোয়েব দেখলো, মিলি জানালার দিকে তাকিয়ে আছে। কোনো হেলদুল নেই। মনে হচ্ছে যেন মিলি এখানে স্বশরীরের উপস্থিত থাকলেও মিলির মন অন্য কোনো দেশে চলে গিয়েছে।

শোয়েব যেন নিজের প্রাণ ফিরে পায়। দৌঁড়ে গিয়ে মিলিকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে।

হুট করে নিজের শরীরে কারো স্পর্শ পেয়ে মিলি আঁতকে ওঠে। কিন্তু, চিরচেনা শরীরের সুবাস পেতেই মিলি চুপ হয়ে যায়। ফের শরৎের কথা মনে পরতেই চোখের পানি গড়িয়ে পরতে থাকে মিলির।

মিলির কান্নার দমকে গা কাঁপার কারণে শোয়েব বুঝতে পারে কোনো এক কারণে মিলির মন খারাপ। তাই মিলিকে ছেড়ে নিজের দিকে ঘুরিয়ে মিলির মুখখানি দুহাতের আজলায় ভরে মিলির ভেজা অশ্রুশিক্ত চোখের দিকে তাকিয়ে শোয়েব জিজ্ঞেস করে,

— কি হয়েছে মন?

শোয়েবের মুখ থেকে আদুরে ডাকটা শুনে মিলি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। শোয়েবের বুকে মাথা গুঁজে ফুপিয়ে কেঁদে ওঠে। শোয়েব আতংকগ্রস্থ হয়ে যায় মিলিকে এভাবে কাঁদতে দেখে। শোয়েব মিলিকে শক্ত করে নিজের বুকের মাঝে চেপে ধরে। মিলির চোখের পানি সহ্য হচ্ছে না শোয়েবের। তার মন এভাবে কাঁদছে কেন?

— আমাকে বলো না কি হয়েছে? আমার কিন্তু দুশ্চিন্তা হচ্ছে। টেল মি ড্যাম এট? ওয়াই ইউ আর ক্রায়িং?

শোয়েবের কাছ থেকে প্রথমবারের মতো এমন ধমক শুনে মিলিকে চমকে উঠে। শোয়েব মিলির দুগালে হাত রেখে শান্ত কন্ঠে আবারও জিজ্ঞেস করে,

—বলবে না কি হয়েছে?

মিলি হটাৎ করে চিৎকার দিয়ে বলল,

— আমি একটু একা থাকতে চাই। যদি আমাকে একা থাকতে দিতে না পারেন। তবে, কুমিল্লায় দিয়ে আসুন আমাকে।

শোয়েব মিলির কাছ থেকে এমন আচরণ আশা করেনি। তবুও, মিলিকে এই মূহুর্তে একা থাকতে দেয়া প্রয়োজন। হয়তো, কোনো কারণে মিলি ডিপ্রেসড। শোয়েব হাল ছেড়ে দিয়ে মিলিকে একা রেখে রুম থেকে বের হয়ে যায়।

রাতের খাবারের সময় মিলিকে হাজারবার ডাক দিয়েও রুম থেকে বের করে যায়নি। শোয়েব বিয়ের পর থেকে কখনোই রাতের খাবার মিলিকে ছাড়া খায়নি তবে আজ কি করে পারবে? শোয়েব পাশের খালি ঘরটায় গিয়ে শুয়ে পরে। সারারাত দুই ঘরের দুটি মানুষ ঘুমাতে পারেনি। কেউ ভাবছে তার মনের কথা। আর কেউ ভাবছে শরৎের কথা।

টানা একসপ্তাহ শোয়েবের সাথে বসে মিলির একমিনিটও কথা হয়নি। কারণ, শোয়েব হসপিটালে যাওয়ার আগ পর্যন্ত মিলি দরজা আঁটকে ঘুমিয়ে থাকত। আবার রাতে শোয়েব ফিরে আসার আগে খাওয়াদাওয়া করে শুয়ে পরতো। এভাবে ঠিক কতদিন একটা মানুষ এইসব আচরণ সহ্য করতে পারে?

শোয়েব আজ হসপিটালে যায়নি। মিলির সাথে বসে এই ব্যাপার নিয়ে আলোচনা করা জরুরি। মিলি ভেবেছে এতক্ষণে হয়তো শোয়েব হসপিটালে চলে গেছে। মিলি আস্তে করে রুমের দরজা খুলে বের হয়ে আসতেই দেখলো শোয়েব ড্রইংরুমের সোফায় মাথা এলিয়ে দিয়ে সিলিংফ্যানের দিকে তাকিয়ে আছে। মিলি পেছনে ঘুরে রুমে ঢোকার আগে শোয়েব ডাক দেয় মিলিকে। মিলি দাঁড়িয়ে যায়।

— তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে।

শোয়েবের কাছ থেকে এই কথা শুনে মিলি আর রুমে না যেয়ে শোয়েবের কাছ থেকে কিছুটা দূরত্বে গিয়ে বসে পরে।

শোয়েব মিলির মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। ঠিক সাতদিন পর এভাবে সামন-সামনি বসে তার মনকে দেখতে পাচ্ছে। শোয়েব আরও খেয়াল করে দেখলো মিলি শুকিয়ে গেছে, চোখের নীচে যেন কালির প্রলেপ দেয়। ঠোঁট কেমন শুষ্ক হয়ে আছে। শোয়েব এমন রুপের মিলির সঙ্গে পরিচিত নয়।

— কি হয়েছে তোমার? আমার সাথে কথা বলছো না। রুম থেকো বের হও না। দিন-রাত দরজা লক করে ঘরে একা বসে থাকো। তোমার বাবা-ভাইয়েরা কল দিলে কথা বলছো না। সমস্যা কি আমাদের খুলে বলো?

মিলি মাথা নিচু করে সবটা শুনছে। মনে সাহস সঞ্চয় করছে। আজ করেই হোক শোয়েবকে সবটা জানানো উচিত। নয়তো বড্ড দেরি হয়ে যাবে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে মিলি শোয়েবকে উদ্দেশ্য করে বলে,

— আমি আপনার সাথে সংসার করতো চাই না। আমি একজনকে ভালোবাসি এবং তার কাছে ফিরে যেতে চাই। আজ একসপ্তাহ ধরে আমি আমার মনকে নানান ভাবে বোঝাতে চেয়েছি। কিন্তু আমার মন মানছে না। আমি ডিভোর্স পেপারে সাইন করে দিয়েছি আজ সকালে। আশা করছি আপনিপ সাইন করে দিবেন। আমি আগামীকাল সকালে আমার ভালোবাসার মানুষের কাছে ফিরে যাব।

এক নিশ্বাসে সবগুলো কথা বলে দম ফেললো মিলি। শোয়েব মিলির মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে যে ওর মন ওরই সামনে বসে অন্য একজনকে ভালোবাসে কথাটা কতটা অকপটে স্বীকারও করছে! অথচ, মিলি একবার বলছিল, মিলির চোখের দিকে তাকালে নাকি শোয়েব নিজের ভালোবাসাকে দেখতে পাবে। কই আজ যে মিলির চোখের দিকে তাকালে অন্যকারো ভালোবাসা দেখতে পাচ্ছে শোয়েব।

বুকে এত ব্যাথা অনুভব হচ্ছে কেন শোয়েবের? প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসে বলেছিল বলেই কি মিলি আজ এই প্রতিদান দিয়েছে?

— কথা বলছেন না কেন?

মিলির কথায় শোয়েব রক্তচক্ষু নিয়ে মিলির চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,

— ভালোবাসা কি বিয়ের আগে ছিল নাকি বিয়ের পরে?

— বিয়ের আগে। আমি তখন দশম শ্রেণির ছাত্রী।

— এতই যেহেতু ভালোবাসাবাসি ছিল তবে কেন আমার জীবনে এসেছো তুমি? এসেই যখন পরেছো তবে কেন পুরনো ভালোবাসার কাছে ফিরে যেতে চাইছো?

— সংসার করতে গেলে ভালোবাসা লাগে। আমি তো আপনাকে ভালোবাসি না। তবে, কি করে আপনার সংসার করব?

— হাহ্ হাসালে আমায় মিলি। অথচ একসপ্তাহ আগে আমাদের ঘনিষ্ঠ মূহুর্তের সময় তুমি আমার কত কাছাকাছি ছিলে! আমাদের দুজনের মাঝে ঠিক যতবার ঘনিষ্ঠ মূহুর্ত এসেছে ঠিক তখনও কি তোমার সেই ভালোবাসার মানুষের কথা মনে পরেনি?

চিৎকার দিয়ে কথাগুলো বলে হাতে একটি ফুলদানি নিয়ে দূরে ছুড়ে ফেললো। মূহুর্তের মধ্যে ফুলদানি ভাঙার শব্দ পুরো ফ্ল্যাটে প্রতিধ্বনি তুলেছে।

— আমি তখনও জানতাম না সে আমার জীবনে ফিরে আসবে। কিন্তু, সে ফিরে এসেছে। শোয়েব আমি আর যা কিছুই করতে পারি না কেন কিন্তু মনে একজনকে রেখে আপনার সাথে বালুর সংসার গড়তে পারব না। পারলে আমাকে মাফ করে দিবেন।

মাথা নীচ করে কথাগুলো বলে শোয়েবের সামনে থেকে চলে উঠে চলে যায় মিলি। কিছুসময় পর এক লাগেজ আর অন্য হাতে একটি কাগজ নিয়ে বের হয়ে আসে মিলি। শোয়েব পলকহীন চোখে তাকিয়ে আছে মিলির দিকে। মিলি শোয়েবের দিকে কাগজটি বাড়িয়ে দিয়ে বললো,

— এই নিন আমাদের ডিভোর্স পেপার। আমি সাইন করে দিয়েছি। আপনি সাইন করলে আমাদের ডিভোর্স সম্পন্ন হবে। আমি উকিলের সঙ্গে কথা বলেছি। বাদবাকি যা কিছু করা লাগবে উনি সামলে নিবেন।

কথাগুলো বলে শোয়েবের হাতে কাগজটি দিয়ে ফ্ল্যাট ছেড়ে বের হয়ে যায় মিলি। আর শোয়েব তাকিয়ে আছে কাগজের দিকে। যেখানটায় মিলির স্বাক্ষর জ্বলজ্বল করছে। এই তো কিছুদিন আগেও এই একটি স্বাক্ষরের মাধ্যমে শোয়েবের স্ত্রী হয়ে শোয়েবের জীবনে এসেছিল। আর আজ এই একটা সাইনের মাধ্যমে শোয়েবের থেকো কত দূরে চলে গেছে মিলি?

— কেন এমনটা করলে,মিলি? ওয়াই? আমি তোমাকে ছাড়া এক মূহুর্তের জন্যেও বাঁচতে পারব না। মরে যাব আমি। তুমি কি করে পারলে তোমার শোয়েবকে ছেড়ে চলে যেতে?

পাগলের মতো নিজের চুলগুলো টেনে চিৎকার করে কাঁদছে আর বিলাপ করছে শোয়েব।

#চলবে