#এক_বেরঙ_চিলেকোঠায়
#লেখনীতে:মিথিলা মাশরেকা
পর্ব-২০
এ ব্যস্ত শহরে শুনশান রাত বলে হয়তো কিছুই হয়না। রাতের শহরের গাড়িগুলোর আওয়াজ যেনো আরো বেশি তীব্র শোনা যায়। ঘড়ির কাটা দশটার ঘরে পৌছালো। ব্যালকনির মেঝেতে বসে সামনের ফুলদানিটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে আরাব। মাঝেমধ্যে হাচি দিচ্ছে,নাক ডলছে। দোয়ার নিজহাতে তোলা পদ্মফুল ফুলদানিটাতে। ওই বাচ্চা মেয়েটার কাছ থেকে একহাজার টাকার নোটের বিনিময়ে দোয়ার স্পর্শ লেগে থাকা ফুলগুলো পেয়েছে ও। সে সময়টায় ভিজে একাকার হয়ে থাকা দোয়ার বিম্বটাই ভাসছে ওর চোখের সামনে। বৃষ্টিতে ভেজার দরুন হওয়া হাচিকাশির তোয়াক্কা করার সময় কই ওর?
-পুরোটা বিকেল,সন্ধ্যা নাকি ওভাবেই বসে থেকে কাটিয়ে দিলি তুই আরাব?
তৌফিকার গলার আওয়াজ শুনে আরাব পাশে তাকালো। ও ঘরে ঢুকেছে। আরাব উঠে দাড়িয়ে এগিয়ে গিয়ে ব্যস্তভাবে বললো,
-কখন আসলি? দোয়া কেমন আছে? হাইচ্ছু!
হাচি দিয়ে লাল হয়ে থাকা নাকটা আরো একবার টিস্যুতে ডলা লাগালো আরাব। তৌফিকা হতাশ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ভাইয়ের দিকে। ঠান্ডা বাধিয়ে রেস্ট নেওয়া বাদ দিয়ে এই ছেলেটা মেঝেতে বসে ওই ফুল দেখে দেখে গত কয়েকঘন্টা পার করে দিয়েছে। হাতটা আরাবের কপালের দিকে বারিয়ে বললো,
-জ্বর আছে?
-আরেহ্ না! খালি ঠান্ডাটাই! তুই এটা বল, বৃষ্টিতে ভিজে দোয়ার জ্বর হয়েছে নাকি? কেমন দেখে আসলি ওকে?
কপাল থেকে হাত সরালো তৌফিকা। তাপমাত্রা স্বাভাবিক আরাবের। বিছানায় পায়ের উপর পা তুলে বসে বললো,
-না। ঠিকাছে ও। অসুস্থ্য হয়নি।
শ্বাস ছাড়লো আরাব। ওর ভয় ছিলো ওভাবে বৃষ্টিতে ভিজে,পুকুরে ডুব লাগিয়ে দোয়ার জ্বর না হয়ে যায়। তাই তৌফিকাকে পাঠিয়ে দিয়েছিলো। এদিকে তৌফিকার তীক্ষ্মদৃষ্টি। নাক প্রচন্ডভাবে চুলকাছে আরাবের। হাচিও আসছে। কিন্তু তৌফিকার সামনে হাচি দিলে ওর তীক্ষ্মদৃষ্টি তীক্ষ্ম কথায় পরিনত হবে ভেবে এদিকওদিক করছে সমানে। আটকে দেওয়ার তীব্র চেষ্টা। তৌফিকা বললো,
-ওষুধ খেয়েছিলি?
-না। ঠান্ডার ওষুধে ঘুম চলে আসে।
-তো? ঘুমাবি! হোয়াটস্ দ্যা প্রবলেম ইন দ্যাট?
সেন্টার টেবিলে থাকা ফাইল হাতে নিয়ে তৌফিকাকে দেখালো আরাব। তৌফিকা কাটকাট গলায় বললো,
-একদম মিথ্যে বলবি না! ওই ফুল দেখতে গিয়ে ওষুধ খাওয়ার কথা ভুলেছিস তুই। অথবা ইচ্ছে করেই টাইমওয়েস্ট হবে বলে ওষুধ খাসনি! খুব ভালোমতো চিনি তোকে আরাব! আজ রাতে তোর ঘুমানোর কোনো ইন্টেশনই নেই,তা বেশ বুঝতে পারছি আমি!
তাড়াতাড়ি ওর সামনে থেকে সরে দাড়ালো আরাব। বললো,
-ত্ তুই রংধনুতে কেনো? দোয়ার খোজ মোবাইলেও নিতে পারতাম আমি!
-আগে বল ওষুধ খাবি কি না?
-এটা বল দিয়ান,কাকাবাবু কেমন আছে? দোয়ার মা,সালমা আন্টি?
আরাবের টপিক পাল্টানোর ধান্দা বুঝে শান্ত চোখে তাকিয়ে রইলো তৌফিকা। ওষুধের বিষয়ে আর কোনো কথাতেই কান দেবে না আরাব,তা বেশ ভালোমতো জানে ও। আরাব হাচি দিতে দিতে কাবার্ড থেকে কিছু বের করছিলো। একটু চুপ থেকে তৌফিকা বললো,
-দোয়ার মায়ের শরীরটা বেশি ভালো নেই আরাব। বেশ অনেকটাই শ্বাসকষ্ট আছে ওনার।
আরাব চুপ। তৌফিকা ভাইয়ের মন বুঝে বললো,
-আমি জোর করেই কিছু ওষুধ প্রেসক্রাইব করে এসেছি দোয়াকে। ওগুলো দিলেই ইনশাল্লাহ্ ইম্প্রুভ আশা করা যায় আন্টির।
আরাব মেঝেরদিকে দৃষ্টিস্থির রেখে ধীর গলায় বললো,
-ওষুধগুলোর দাম কেমন হবে আপু?
-হাজার দুই।
….
-ওগুলো আমি দিয়ে আসলে ভালো হতো না?
আরাব হেসে দিলো।মুচকি হেসে বোনের পাশে বিছানায় বসলো ও। বললো,
-দোয়াকে তো দেখলি কিছুদিন। ওকে তোর কেমন মেয়ে বলে মনে হয় আপু? বলতো?
তৌফিকা বুঝেছে আরাবের কথার মানে। তাই বলার কিছুই খুজে পেলো না ও। চুপ করে রইলো। এরমাঝে টুইঙ্কেলকে নিয়ে ঘরে ঢুকলেন মিসেস ওয়াহিদ। বললেন,
-দেখেছিস তৌফিকা? কেমন অসুখ বাধিয়েছে তোর ভাই? কি দরকার ছিলো এই অসময়ী বৃষ্টিতে ভেজার? এখন ঠান্ডায় নাকচোখ লাল হয়ে আছে দেখ!
আরাব কিছুই বললো না। দুবার হাচি হলো শুধু ওর। টুইঙ্কেল গুটিগুটি পায়ে ব্যালকনিতে পৌছে গেছে। ওদিকেই তাকিয়ে রইলো ও। তৌফিকা বললো,
-ছাড়ো তো মা ওর কথা! জানোই তো তোমার ছেলে কেমন! আর এটুক ঠান্ডায় কিছু হবে না। তারচেয়ে বড় অসুখ বাধিয়ে রেখেছে তোমার ছেলে!
ছেলেমেয়ের দিকে বিস্ময়ে তাকালেন মিসেস ওয়াহিদ। বললেন,
-মানে? আরাব? কি হয়েছে তোর? এসব কি বলছে তৌফিকা? এজন্যই কি তুই ইদানিং এমন অদ্ভুত ব্যবহার করছিস বাবা? কোথায় কষ্ট হয় তোর? আমাকে আগে কেনো বলিস নি? এই তৌফিকা,তুইও বললি না আমাকে। আরাবের কবে থেকে এমন…
-তোমার ছেলে প্রেমে পরেছে মা।
বিস্ফোরিত চোখে আরাবের দিকে তাকালেন মিসেস ওয়াহিদ। ঠোট টিপে হাসছে তৌফিকা। আরাব সকালেই বলেছিলো মাকে জানাবে বিষয়টা। তাই আর দেরি করেনি ও। বিস্ময় কাটিয়ে মিসেস ওয়াহিদ একরাশ উচ্ছাসে বললেন,
-সত্যি?
আরাব ঠোট টিপে হেসে মাকে ধরে বিছানায় বসালো। নিজে মায়ের সামনে মেঝেতে হাটু গেরে বসে বললো,
-শান্ত হও। ভেবেছিলাম একেবারে বিয়ের সময় তোমাকে জানাবো। তারপর ভাবলাম ওই শকটা শুধু বাবার জন্যই থাক!
হাত উঠিয়ে চড় মারার ভঙিমা বোঝালেন মিসেস ওয়াহিদ। হেসে মায়ের কোলে মাথা রাখলো আরাব। টুইঙ্কেল বারান্দা থেকে বললো,
-এটা কি ফুল আরাব মামা?
আরাব নাক ডলে বললো,
-পদ্ম। তোমার উইশমাম দিয়েছে!
-মেয়েটা…
মিসেস ওয়াহিদ বলার আগেই টুইঙ্কেল বলে উঠলো,
-জানো আম্মু,কিছুদিন আগে আমাদের ক্লাসের এক মেয়ে এইটা ড্রয়িং করে স্কলারশিপ পেয়েছিলো। তখন উইশমাম থাকলে ওইটায় আমিই ফার্স্ট হতাম বলো?
স্কলারশিপ কথাটা শুনে তৎক্ষনাৎ উঠে দাড়ালো আরাব। হাসিমুখে এগিয়ে এসে টুইঙ্কেলকে চুমো দিয়ে বললো,
-তুমি সবসময় মামার এতো হেল্প কেনো করো টুইঙ্কেল? মামা লাভস্ ইউ আ লট!
এই কথাগুলো বলেই আরাব মোবাইলটা নিয়ে বেরিয়ে আসলো ওর রুম থেকে। মিসেস ওয়াহিদ আটকাতে চেয়েছিলেন ওকে,তৌফিকা বাধা দিতেই উনি থেমে গেলেন। দুজনের মুখেই প্রসন্নতা,আরাব যা করবে,ভালোর জন্যই করবে। টুইঙ্কেল আস্তেধীরে রুমে ঢুকে দরজায় তাকিয়ে বললো,
-উইশমামকে রংধনুতে এনে দাও মামা। টুইঙ্কেল অলসো লাভস্ ইউ।
•
নতুন একটা দিন। ভার্সিটি থেকে ফিরতে আজও দেরি হয়েছে দোয়ার। বাসায় ফিরে সবকাজ সেরে টিউশনির জন্য দ্রুতপায়ে হাটছে ও। আবাসিক এলাকার এক রাস্তায় অল্পবয়স্ক কিছু ছেলে ব্যাডমিন্টন খেলার দাগ আকছে। দোয়াকে দেখে দুটো ছেলে বাজে আওয়াজ করে ফেলে হঠাৎই। রাগ উঠে গেলো দোয়ার। হাটুরবয়সী বাচ্চাকাচ্চাগুলোকে ঠাটিয়ে চড় লাগবে বলে হনহনিয়ে পা বারালো ওদের দিকে।
আচমকাই একটা রিকশা অনেক বেশি গতিতে এসে দোয়ার ওড়নায় বাঝিয়ে দেয়। ঘটনার আকস্মিকতায় টাল সামলাতে না পেরে দুবার ঘুরে উঠে কারো বুকে গিয়ে পরে দোয়া। সে মানুষটা দুহাতে জরিয়ে ধরেছে তাকে। সরে আসতে গেলেই লোকটা একদম শান্তভাবে বললো,
-তোমার গায়ে ওড়না নেই দোয়া।
চেনা স্বর শুনে চমকে উঠলো দোয়া। সরে যেতে পারলে বাচতো ও। কিন্তু ওড়না ছাড়া কিভাবেই বা পাশ ফিরবে? দুহাত বুকে আকড়ে ধরলো। ওর ওটুকো সঞ্চালনে ঠোটে ঠোট চেপে চোখ বন্ধ করে রইলো আরাব। বাইরের স্তব্ধ পরিবেশের উল্টোরুপ,ভেতরে তান্ডব হচ্ছে ওর। তৌফিকা বাসার কিছু জিনিসপত্র নিয়ে যেতে বলেছিলো ওকে। ওগুলো দিয়ে একপলক দোয়াকেও দেখে আসতে পারবে ভেবে বায়োমেডি থেকে সোজা এদিকেই এসেছে ও। ভেবেছিলো দোয়া আগের টিউশনির ওখানে পৌছে গেছে। কিন্তু দেখাটা হয়েই গেলো রাস্তায়। ওকে রাগীভাবে ছেলেগুলোর দিকে এগোতে দেখে বাইক থামাতে বাধ্য হলো একপ্রকার। নেমে হাটা লাগানোর মুহুর্তেই রিকশাটা ওভাবে পাশ কাটিয়ে ওর ওড়না নিয়ে চলে গেলো।
-ওরে মামা! আজকাল আমাদের কলোনিতেও এমন ফিল্মি সিন দেখা যায়!
শক্ত হয়ে দাড়িয়ে রইলো দোয়া। চোখ মেলে একপলক ছেলেগুলোর দিকে তাকালো আরাব। ওরা বাজেভাবে হেসে রং দিয়ে কোর্ট আকাতে লাগলো। মুখ দিয়ে জোড়ে শ্বাস ফেলে জ্যাকেটটা খুলে ফেললো আরাব। একটুখানি পিছিয়ে চোখ অন্যদিক রেখে দোয়ার সামনে জ্যাকেটের পিঠের দিকটা তুলে ধরে বললো,
-হাত ঢুকাও।
বিস্ময়চাওনি নিয়ে রোবটের মতো দুহাত সামনে ঢুকিয়ে দিলো দোয়া। আরাব অন্যদিকেই তাকিয়ে। হাত ঢুকানো হলে আবারো ওকে জরিয়ে আরাব জ্যাকেটের পেছনের চেইনটা লাগিয়ে দিলো অতি সন্তর্পনে। দোয়ার গায়ে ওটার সামনের অংশ পেছনে আর পিঠের দিকটা সামনে। বেনুনি করা চুলগুলোও খুলে দিলো আরাব। তারপর অর্ধেক অর্ধেক ভাগ করে ওর ঢেউখেলানো বড়বড় চুলগুলো সামনে দু পাশে দিয়ে দিলো।
দোয়া যেনো পাথর হয়ে গেছে আজ। আরাবের দিক থেকে চোখ সরছেই না ওর আজ। বারবার মনে হচ্ছে,কতোগুলো দিন পর দেখলো ও এই মানুষটাকে। আরাব এখনো অবদি তাকায়নি ওর দিকে। এজন্যই হয়তো ওভাবে দেখে চলেছে ও। জ্যাকেট পরানো,চুল সেট করা শেষে অনেকটা পিছিয়ে দোয়ার দিকে ঠিকঠাকমতো তাকালো আরাব। চোখাচোখি হতেই হুশ ফিরলো দোয়া। নিজেরদিকে তাকিয়ে আরো বড়বড় চোখে তাকালো ও আরাবের দিকে। একটা মুচকি হাসি দিয়ে পকেটে হাত গুজে দোয়ার দিকে তাকিয়ে থেকেই আরাব ছেলেগুলোর দিকে এগোলো। দম মেরে দাড়িয়ে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছে দোয়া। ওর দিক তাকিয়ে থেকেই ঝুকে কোর্ট আকাতে থাকা এক ছেলের কলার ধরে দাড় করালো আরাব। এ গালে,ও গালে ঠাটিয়ে দুটো চড় লাগিয়ে দিলো ওর। শব্দ শুনে বাকি ছেলেগুলোর মধ্যে দুজনের হাত আপনাআপনিই গালে চলে গেছে। আরাব একহাতে ছেলেটার চুলে আঙুল চালিয়ে মিষ্টিস্বরে বললো,
-দুধদাত পরেনি,এখনি বিষদাত গজিয়েছে দেখছি! সমস্যা নেই,ওমন দু চারটে বিষদাতসহ একেবারে পুরো সর্পকুলকেই উপরে দিতে জানে আরাব! পরেরবার তোদের কোনোটাকেও যদি কর্কটা পাস করো,এই কথা ছাড়া কোনো পথচারীকে অন্য কথা বলতে শুনেছি,একেবারে চান্দামামাকে ডেকে এনে টিপ পরিয়ে দেবো খোকা! মনে থাকে যেনো!
কথা শেষ করে আরেকপলক দোয়ার দিকে তাকালো আরাব। তারপর ছেলেটার কলার ছেড়ে দিয়ে শার্টের হাতা টান মেরে হুইস্টলিং করতে করতে পা চালালো ও। গালে হাত বুলাতে বুলাতে স্তব্ধ হয়ে দাড়িয়ে রইলো ছেলেটা। বাকি ছেলেগুলো একবার দোয়ার দিকে তাকিয়ে তাড়াতাড়ি স্থানত্যাগ করতে লাগলো। কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে দাড়িয়ে রইলো দোয়া। আরাব আড়াল হলে আস্তেধীরে ঘাড় নামিয়ে গায়ের জ্যাকেটটার দিকে তাকালো একপলক। শীত মোটেও নেই এ সময়। কিন্তু ওই জ্যাকেটটা পরেই যেনো শরীরে অসম্ভব কম্পন অনুভব হচ্ছে ওর। আলাদা এক অনুভুতি! আলাদা এক…শিহরন!
#চলবে…
#এক_বেরঙ_চিলেকোঠায়
#লেখনীতে:মিথিলা মাশরেকা
পর্ব-২১
প্রতিটা স্বাভাবিক দিনের মতো আজও ভার্সিটির ফাকা বাসে চড়ে বসলো দোয়া। পুরো বাসে দুটো ছেলে আর ও সহ তিনটে মেয়ে শুধু। সকালে এই একটাই ট্রিপ যায় এদিক থেকে। সেটাও অনেক বেশি সকালে। লোকাল বাসে,লেগুনায় ভাড়া বিবেচনা করে এ বাসেই যাতায়াত দোয়ার। সকাল সাতটার বাস,ক্লাস সাড়ে নটায়। আধঘন্টার পথ। আগেআগেই তাই ভার্সিটি এসে বসে থাকতে হয় ওকে। ওইতো,লাইব্রেরি,বই। আছে এক সময় কাটানোর জায়গা। জানালায় মাথা ঠেকিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলো দোয়া। ড্রাইভার মামা হঠাৎই বলে উঠলো,
-শুনতাছি কাল থাইকা নাকি এইদিকে নয়টায় আরেকটা বাস আইবো ভার্সিটির?
চকচকে চোখে তাকালো দোয়া। নয়টায় ভার্সিটির বাস মানে ওর আরো দুঘন্টা বেচে যাওয়া। আরো দু দুটো টিউশনি! আরো কিছুটা উপার্জন। বাসের আর বাকিসব তেমন আগ্রহ দেখালো না। হয়তো ওদের ক্লাসটাইম সকালেই। বাধ্য হয়ে দোয়াই বললো,
-স্ সত্যি বলছেন মামা? নতুন বাস চালু হবে কাল থেকে?
-হ। ওমনই তো হুনলাম কেরানির কাছে। নতুন কি জানি এক বেসরকারী ফাউন্ডেশন আইবো আজ ভার্সিটিতে। তেনারাই নাকি দুইডা বাস দিবো!
আরো আগ্রহভরে দোয়া জিজ্ঞাসা করলো,
-সে দুইটা কি নয়টায় হবে? এদিকেরই হবে?
-এমনই তো হুনতাছি।
মন ভালো হয়ে গেলো দোয়ার। স্বস্তির শ্বাস ফেলে মনেমনে দোয়া করতে লাগলো,এমনই যেনো হয়। উপরওয়ালা এভাবেই আস্তেআস্তে ওর দিকে মুখ তুলে তাকাক। ভার্সিটির গেইটে বাস থামলো। বাস থেকে নামতেই চোখ পরলো গেইটের সামনের দিকটা বেশ জাকজমকভাবে সাজানো,বেলুন,ফুল দিয়ে। গুরুত্ব না দিয়ে সোজা ক্লাসে চলে আসলো ও। কিন্তু ক্লাসেও একই অবস্থা। কোনো উৎসবের আমেজ তো আছে সবার মাঝে। এসবের মধ্যে তাজীন নেই বলে চুপচাপ বসে রইলো ও। দুটো ক্লাস শেষে প্রিন্সিপাল স্যার নিজে ঢুকলেন ওদের ক্লাসে। সাথেসাথে দাড়িয়ে গেলো সবাই। স্যার বসতে বললেন ওদের। ওনার সাথে আরো বেশ কয়েকজন ভদ্রলোক। দোয়ার চোখ আটকালো মাঝের সবচেয়ে গুরুত্ব পাওয়া মানুষটার দিকে। সুটবুট পরা লোকটাকে মধ্যবয়স্কের চেয়ে বেশিই মনে হয়। কিন্তু চেহারায় অর্থবিত্তের চাকচিক্য স্পষ্ট। স্যার বললেন,
-আসসালামু আলাইকুম স্টুডেন্টস্। আশা করি ভালোই আছেন সবাই? পরিচয় করিয়ে দেই। উনি বিশিষ্ট ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট তৌফিক ওয়াহিদ। আপনারা হয়তো চেনেন ওনাকে বেশিরভাগই। ওনার কোম্পানি,রংধনু গ্রুপ অফ ইন্ডাস্ট্রিজ সারা বাংলাদেশেই আছে।
বেঞ্চ শক্ত করে ধরলো দোয়া। ইনি আরাবের বাবা,বুঝতে সময় লাগেনি ওর। আগে দেখিনি বলে চিনতে পারেনি। প্রিন্সিপাল বললেন,
-ওনার আজকে আমাদের ভার্সিটিতে আসার কারন,ভার্সিটির দুটো নতুন বাসের ওপেনিং। যেটা ওনারই গ্রান্ট করা। তাছাড়া ভার্সিটির কমার্স ব্যাকগ্রাউন্ডের ডিপার্টমেন্টগুলো টপ থ্রি স্টুডেন্টসদের এককালীন স্কলারশিপও দেবেন উনি।
হাততালিতে মুখরিত হলো ক্লাসরুম। দোয়া দৃষ্টিনত করলো। টপ থ্রি! তারমানে ওকেও টাকা দেওয়া হবে। মানা করার ইচ্ছে ছিলো,টাকাটা না নেওয়ার ইচ্ছে ছিলো ওর। তবুও কিছু বললো না। এই টাকা ওর মেধার বিনিময়ে পাওয়া টাকা হতে চলেছে,ওর শত রাতজাগা পরিশ্রমের উপহারস্বরুপ। নইলে কখনোই আরাবের বাবার টাকা নিতো না ও! কখনোই না!
•
হাতে চকচকে দশটি এক হাজার টাকার নোট নিয়ে রোবটের মতো ভার্সিটি থেকে বেরোলো দোয়া। ওর ভাবনাতেও কুলোচ্ছে না,সব কমার্স ব্যাকগ্রাউন্ডের ডিপার্টমেন্টে টপ থ্রি স্টুডেন্টসদের দশ হাজার করে টাকা দিতে ঠিক কতোটাকা ফুরিয়েছে তৌফিক ওয়াহিদের। কিন্তু তাতে ওর মতো অনেক স্টুডেন্টেরই অনেকবড় উপকার হয়েছে। গেইট দিয়ে বেরোতেই ওর সামনে ভার্সিটির বাস এসে থামলো। চুপচাপ উঠে পরলো ওতে দোয়া।
খানিকটা দুরে গাড়ির বাইরে দাড়িয়ে দোয়ার হতভম্ব চেহারাটা বেশ উপভোগ করলো আরাব। সারাদিনে হয়তো এই একটা ঘটনাই সবচেয়ে ভালো ঘটলো ওর সাথে। নইলে এই বাস,স্কলারশিপ আবদারের সাথে ওর বাবা যে অফিসে যাওয়া শর্ত জুরেছে,তাতে দিনটা ওর বোরিংই কাটবে। তবুও হাসিমুখে দোয়ার চেহারাতে চোখ আটকালো ও। গাড়ির ভেতর থেকে তৌফিক ওয়াহিদ বাজখাই গলায় বললেন,
-আরাব? চলো অফিস!
আরাব দোয়ার দিকে তাকিয়ে থেকেই বললো,
-যদি না যাই,তুমি এই বাস,এই স্কলারশিপের টাকা ফেরত নিয়ে নেবে বাবা?
ভাষাহীনভাবে আরাবের দিকে তাকালেন তৌফিক ওয়াহিদ। ও সেই বাসের দিকে তাকিয়েই মিটমিটিয়ে হাসছে। তৌফিক ওয়াহিদ বললেন,
-মানে কি আরাব? একটা প্রশ্ন না করে তোমার কথামতো বাস,স্কলারশিপ গ্রান্ট করেছি এই ভার্সিটিতে। এখন যদি তুমি…
-রিল্যাক্স বাবা! টেক আ চিল পিল! যাচ্ছি তোমার গাড়িতে,তোমার অফিস! চলো!
গাড়িতে উঠে বসলো আরাব। যদি দোয়ার জন্য এটুকো করতে ওকে বায়োমেডি ছেড়ে অফিসে বেশি সময় দিতে হয়,এতোটুকো আফসোস নেই ওর। এতোটুকোও নাহ্!
•
মাঝে একদিন কেটে গেছে। স্কলারশিপের টাকায় মায়ের ওষুধ বেশ অনেকগুলো কিনে নিয়েছে দোয়া। অরুনাভ মুখার্জীর বাড়িভাড়া,আর বাকিটা দিয়ানের জন্য। সকালে বাসটাইমটা ঠিক হওয়ায় আরো একটা টিউশনি নিয়েছে ও। আজকের ক্লাস শেষ করে ভার্সিটির পাশেরই এক ক্যাফেতে কাচুমাচু হয়ে বসে আছে দোয়া। আশেপাশে আড়চোখে তাকাচ্ছে একরাশ ইতস্ততবোধ নিয়ে। এসব জায়গায় একদমই বসার অভ্যেস নেই ওর। থাকবেই বা কেনো? এতো দামিদামি খাবার কেনার না আছে সামর্থ্য,না আছে মা ভাইয়ের চিন্তায় ওগুলো মুখে তোলার এতোটুকো ইচ্ছা।
কিন্তু আজ কোনো উপায়ন্তর ছিলো না। তাজীন বারবার করে বলে গেছে ওকে এখানেই বসতে। বেশ কিছুক্ষন লাইব্রেরিতে ছিলো ও। তারপর চলে এলো এ দিকটায়।বেশ অনেকটা সময় একাকী বসে থাকার পর তাজীন হাপাতে হাপাতে এসে ওর পাশে বসলো। দোয়া ওর চোখমুখ দেখে অস্থিরতার কারন বোঝার চেষ্টা করছে। টিস্যুতে চেহারা মুঝে তাজীন গলা ঝেড়ে সোজা হয়ে বসে বললো,
-ক্ কি হয়েছে? ওভাবে কেনো তাকিয়ে আছিস?
দোয়া সন্দিহান কন্ঠে বললো,
-তুমি এমন হাপিয়েছো কেনো তাজ?
হচকিয়ে গেলো তাজীন। আমতা আমতা করে বলতে লাগলো,
-ও্ ও কিছু না! বাইরে থেকে আসলাম,ঘেমে তো যাবোই তাইনা?
-হ্যাঁ কিন্তু এতো তাড়াহুড়ো করে আসলে যে!
-তো তোকে এখানে বসিয়ে রেখে আমি কচ্ছপের গতিতে আসবো?
-ন্ না। সেটাও নয়। আমরা লাইব্রেরিতে বসলেই পারতাম। তুমি হুট করে ওভাবে চলে এলে কেনো বলতো? আমরা…
তাজীন জোরে শ্বাস ফেলে ওরদিকে ফিরে বললো,
-এই তোকে ভার্সিটিতে পড়তে বলেছে কে রে? কোনো প্রাইভেট ইনভেস্টিকেটিং গ্রুপে ঢুকে যেতি! যা ক্রসকোশ্শেন করতে পারিস না তুই! সেই একটা বেতনে তোকে রেখে দিতো বড়বড় ইনভেস্টিগেটরস্! তারপর সেখানেই চালাতি তোর যতো কিউ এন্ড এ পর্ব! উফ্!
তাজীনের দম না ফেলা কথাগুলো শুনে আর কিছুই বললো না দোয়া। মুচকি হেসে ব্যাগ থেকে একটা মোড়কবাধানো বক্স বের করে তাজীনের সামনে ধরলো। তাজীন বিরক্তিতে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে ছিলো। ওটা দেখেই বিস্ময়ে কিছু বলার আগে দোয়া বললো,
-হ্যাপি বার্থডে তাজ!
তাজীন মুগ্ধভাবে তাকিয়ে রইলো ওর দিকে। গত তিনবছরের ওর প্রতিটা জন্মদিন মনে রেখেছে দোয়া। কোনো ফেসবুক নোটিফিকেশন ছাড়াই প্রতিটা জন্মদিনে ওকে স্পেশাল ফিল করিয়েছে। টিউশনির টাকার একাংশ দিয়ে কখনো চুড়ি,কখনো ওড়না,তো কখনো বই উপহার দিতে ভোলেনি। সে হিসেবে ও কিছুই দিতে পারেনি দোয়াকে। কোনো বিশেষ দিন দোয়ার জন্য ছিলোই না যেনো। জন্মদিন জানার বহু চেষ্টা করেছে,বলেনি। এমনকি সার্টিফিকেটটাও দেখতে দেয়নি দোয়া। দোয়ার সাথে ওর যেনো শুধু নেওয়ার সম্পর্ক। বিনিময়ে ভালোবাসা ছাড়া কিছুই গ্রহন করেনি দোয়া। তাই এবার তাজীন ভেবেছিলো নিজের জন্মদিনেই কিছুটা সারপ্রাইজ দেবে ওকে। দোয়া বক্সটা নাড়িয়ে বললো,
-নাও? খুলে দেখো?
-এবার একটা শর্তে তোর উপহার আমি নেবো দোয়া!
-কি বলছো তুমি? শর্ত কেনো আসছে আমাদের মাঝে তাজীন?
-আসছে কারন পরেরবছর এই সময়টাতে আমি তোর সাথে দেখা করতে পারবো কিনা জানি না! আজকের দিনটাতে তোকে আমার সাথে খেতে হবে দোয়া,ঘুরতে হবে আমার সাথে। আজকে খাবার তুই বাসায়ও প্যাক করে নিয়ে যাবি। নইলে এবার তোর গিফট আমি নিবো না!
দোয়া বুঝলো,সত্যিই এবারে তাজীনের জন্মদিন পালন,ওরজন্য শেষবার হতে পারে। তাই মুচকি হেসে ওর হাতে বক্সটা গুজে দিয়ে বললো,
-বেশ। আজকে বার্থডে গার্ল যা বলবে,তাই!
তাজীন খুশিমনে জরিয়ে ধরলো দোয়াকে। দোয়া ওকে ছাড়িয়ে বক্সটা খুলে দেখার জন্য ইশারা করলো। তাজীন বক্সটা খুলেই নেতিয়ে গেলো। একবার উপহারটার দিকে,তো একবার দোয়ার দিকে তাকাচ্ছে ও। ভেতরে অনেক দামি একটা ঘড়ি। দোয়া এতো টাকা দিয়ে ওর জন্য উপহার কিনেছে ভেবেই প্রচন্ড অভিমান হলো তাজীনের। অন্যদিক তাকিয়ে বললো,
-এবার এটা কেনো দোয়া?
-এবার তো তোমার প্লানও ভিন্ন তাজীন! মানা করো না প্লিজ। প্রতিবার রাস্তার দোকানগুলো থেকে কমদামী জিনিস দিয়ে উইশ করি তোমাকে। তুমিও হাসিমুখে অভ্যস্ত না হওয়া সত্ত্বেও ওগুলো নিয়ে নাও। কিন্তু সত্যি বলতে,একদমই ভালোলাগতো না আমার তখন। আজকে এটা…
-দোয়া!
-আরে টেনশন কেনো করছো বলোতো? তোমাকে বলেছিলাম না? আগেরদিন যে বেসরকারী ফাউন্ডেশনটা স্কলারশিপের টাকা দিয়ে গেলো আমাকে,মনে নেই তোমার? আমার তো মনে হয় আল্লাহ্তায়ালা জানতেন,আমি কতো করে চাই তোমাকে ভালো কিছু গিফট করতে। এজন্যই স্কলারশিপটা জুটে গেলো বলো?
-কিন্তু…
-কোনো কিন্তু না! ওটা হাতে পরো তুমি! দেখি কেমন লাগছে?
তাজীন আর মানা করলো না। দোয়ার সবকথাতেই ভয় হয় ওর। এই বুঝি হ্যাঁ বলার জন্য ওর আত্মসম্মানে লাগে,এই বুঝি না বলার জন্য ওদের বন্ধুত্বটা নষ্ট হয়। ঘড়িটা পরে দোয়াকে দেখালো ও। দোয়া হাসিমুখে বললো,
-খুব সুন্দর মানিয়েছে তোমার হাতে ওটা!
তাজীন মৃদ্যু হাসলো। বললো,
-তোর জন্যও একটা সারপ্রাইজ আছে।
ভ্রুকুচকে তাকালো দোয়া। তাজীন হাসছে শুধু। টেবিলের উপর থাকা তাজীনের মোবাইলটার আলো জ্বলে উঠতেই আরো প্রসারিত হলো ওর হাসি। টেবিলে কনুই ঠেকিয়ে গালে হাত দিয়ে দোয়াকে ক্যাফের দরজায় তাকানোর জন্য ইশারা করলো। দোয়া একবার দরজায় তাকালো। তারপর কিছু বুঝে না উঠে আবারো তাজীনের দিকে তাকালো ও। কপাল চাপড়ে উঠে গেলো তাজীন। দরজার কাছ থেকে এক লোকের হাত জরিয়ে ধরে দোয়াকে দেখিয়ে বললো,
-মিট মাই ফিয়নসে। ডক্টর সজল মুফতাহির। মুফতাহির? ও দোয়া। আমার বেস্টফ্রেন্ড!
লোকটাকে দেখে,তার নাম শুনে দাড়িয়ে গেলো দোয়া। অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো মানুষটার দিকে। ভেতর থেকে তীব্র বিস্ময়ের শ্বাস আটকে গেলো যেনো। পরিশেষে শুধু একটা কথাই গলায় দলা পাকিয়ে আসতে লাগলো,এ কি করে সম্ভব???
#চলবে…