এক বেরঙ চিলেকোঠায় পর্ব-২৪+২৫

0
817

#এক_বেরঙ_চিলেকোঠায়
#লেখনীতে:মিথিলা মাশরেকা
পর্ব-২৪

তীব্র গতিতে বাইক চালাচ্ছে আরাব। কাল পুরোটা রাত ঘুম হয়নি ওর। দোয়ার ফোনকলের পর ঠিক কতোটা অস্থিরতায় ওর প্রতিটা মুহুর্ত কেটেছে তা ওই‌ জানে। দেখা করার জায়গাটা আর সময়টা ও দোয়ার সুবিধামতো ভেবেই বলেছিলো। কিন্তু পরপরই প্রচন্ড আফসোস করেছে। দোয়াকেআরো আগে‌‌ আসতে‌ বলা উচিত ছিলো ওর। সকালবেলা বায়োমেডি থেকে কল এসেছিলো। খুব জরুরি বিষয় এমনটাই বলছিলো নিরব। আরাব শোনেনি। রেডি হয়ে সোজা বাইক ছুটিয়েছে,দোয়ার সাথে দেখা করবে বলে। জায়গাটায় পৌছে বাইক পার্ক করে অস্থিরচিত্ত্বে দোয়াকে খুজতে লাগলো আরাব।

রাস্তার পাশেই এক কৃত্রিম লেইক। পুকুরের পাড়বাধানো ঘাটের মতোই সিড়ি। সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে আসলে উপরে বটতলার ছায়া। বটগাছের নিচেও বসার জায়গা বাধানো। ওখানে দুটো বাচ্চা ছেলেমেয়ে খেলছে। পাশেই এক কাপল ঝালমুড়ি খাচ্ছে,হাসছে,বাচ্চাগুলোর সাথে কথা বলছে। বোঝাই যাচ্ছে,ওরাই বাচ্চাগুলোর মা বাবা। এপাশে আরো একটা কাপল আছে। দুজনেই মাস্কপরিহিত কলেজড্রেসে। সিড়িতে বসে দুপলক জুটিদুটোকে দেখে নিলো দোয়া। একেবারেই পাশাপাশি,তবুও কতো বিচিত্রতা। একটা শ্বাস নিয়ে মনেমনে কথা গোছাতে লাগলো ও। আজ ওকে বলতে হবে। সবদিক সামলে,গুছিয়ে কথা বলতে হবে। আরাবকে আজ বলার সুযোগ দেওয়া যাবে না! কোনোমতেই না!

দোয়াকে দেখে লাফানোর ভঙিমায় দৌড় লাগালো আরাব। একেবারে ওর সামনের নিচু সিড়িটায় হাটু গেরে বসে গিয়ে বললো,

-কেমন আছো দোয়া?

আরাবের আকস্মিক আগমনে দোয়া চমকে গেছে ভালোমতোই। কিন্তু ওর চোখের দিকে তাকিয়ে আর চমকে ওঠা চাওনি স্থবির রাখতে পারলো না। ওই‌ চোখজোড়াতে আকুতি,ও কেমন আছে,তা জানার তীব্র ব্যাকুলতা। থেমে রইলো দোয়া বেশ অনেকক্ষন। আরাব বললো,

-কি হলো দোয়া? বললে না? কেমন আছো?

ধ্যান ভাঙলো দোয়ার। নিজেকে সামলে তৎক্ষনাৎ উঠে দাড়ালো ও। একটা শুকনো ঢোক গিলে,জিভ দিয়ে ঠোট ভিজিয়ে ওড়না আঙুলে পেচাতে লাগলো। হুট করে ওর মনে এক অন্য ভয় ঘুকে গেছে। সেটা আরাবকে নিয়ে। যে যে কথা আরাবকে বলবে বলে এখানে এসেছে ও,সেগুলো আরাবকে বলা কি ঠিক হবে? সুমনের মতো একজন মানুষের সাথে আরাবকে কোনোভাবে যুক্ত করা কি ঠিক হবে? এতে যদি আরাবের কোনো ক্ষতি হয়ে যায়?
না না! আরাবের কোনো ক্ষতি হবে কেনো?‌ ও তো আরাবকে কিছু করতে বলবে না! যা করার ও‌ নিজেই করবে! আরাবকে এসবে জড়াবে না ও। মনেমনে হিসাবটা আতো একবার কষে নিলো দোয়া। আরাব একদম ওর সামনে এসে দাড়িয়ে বললো,

-নিঃসংকোচে বলো দোয়া। কি হয়েছে?

-আমি আছি দোয়া। বলো?

দোয়া চোখ বন্ধ করে একটা জোরে শ্বাস ছাড়লো। এই আমি আছি কথাটায় কতো‌‌না স্বস্তি! সে আছে! চোখ মেলে‌ বললো,

-আমার কিছু দরকারী কথা বলার আছে আপনাকে।

-হ্যাঁ,সেটাই‌ তো‌ শুনতে এসেছি! বলো?

-হ্যাঁ বলবো আপনাকে। কিন্তু তার আগে আমার একটা শর্ত আছে।

ভ্রু কুচকে তাকালো আরাব। মেয়েটা এতো অচেনা কেনো? নিজে থেকে ডেকেছে,তবুও এতোটা গুটানো কেনো? এতো সীমাবদ্ধতা কিসের? পরপরই মনে পরলো,ও দোয়া! সেই দোয়া,যার আত্মসম্মানবোধে ওর গর্ব হয়। এমন কাউকে ভালোবাসে ও,যার সামনে ভালোবাসি বলার আগে লুকিয়ে চুরিয়ে একটার পর একটা ভালোবাসার প্রকাশ করতে বাধ্য হচ্ছে ও। মুচকি হেসে আরেকপা দোয়ার দিকে এগোলো আরাব। মাথা নিচু করে বললো,

-সবসময়,তোমার সবরকম শর্ত সমর্থিত দোয়া।

দোয়া নির্বাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। আরাব মাথা তুলে ওকে চোখ মেরে বললো,

-বেশি ফিল্মি হয়ে গেলো?

নিজের উপর প্রচন্ডরকমের রাগ হলো দোয়ার। কি জন্য এসেছিলো,আর এই লোকটা কি কি অদ্ভুত ব্যবহারে দুর্বল করে দিচ্ছে ওকে। আর ওউ সব ভুলে কেনো গা ভাসাচ্ছে তাতে? আরাব মুচকি হাসছিলো। দোয়া চড়া গলায় বললো

-আমি আপনাকে যা বলবো,তার বিপরীতে আপনি আমাকে কোনো প্রশ্ন করতে পারবেন না!

-ওকে ফাইন। প্রশ্ন করবো না। তুমি বলো।

একদমই স্বাভাবিক গলায় বললো আরাব। দোয়া বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলো। মানুষটা কিসের তৈরী,মাঝেমধ্যে এই কথাটা বড্ড ভাবায় ওকে। দোয়া ব্যাগ থেকে আরাবের সেই কাগজটা বের করে বললো,

-এ্ এই ডক্টর সজল মুফতাহির আপনার বোনের বর?

-হ্যাঁ।

দোয়া থামলো। আরাবের কেনো কথাটায় প্রশ্ন আসা করেছিলো ও। ওকে অবাক করিয়ে দিয়ে আরাব বললো,

-দিয়ানকে নিয়ে যখনতখন যেতেই পারো।

-বিষয়টা দিয়ান না।

মুচকি হাসলো আরাব। কেনো প্রশ্ন না করেও বেশ ভালোমতোই বুঝে গেলো,দিয়ানকে নিয়ে দোয়া মুফতাহিরের খোজ করছে না। দোয়া বললো,

-ওনার নিউ এইড হসপিটাল?

-হ্যাঁ।

খানিকটা সময় চুপ করে রইলো দোয়া। মাথা নিচু রেখে আস্তে করে বললো,

-বায়োমেডির ডক্টর সুমনকে চেনেন?

আরাব বিস্ফোরিত চোখে তাকালো দোয়ার দিকে হাত মুঠো করে পেছন ফিরে দাড়ালো ও এবার। এতোক্ষন দোয়ার জটিলতার মাঝেও ওকে স্বাভাবিক করার সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাচ্ছিলো ও। কিন্তু এবার ওর সমস্ত স্বাভাবিকতায় জটিলতা এনে দিয়েছে দোয়া। নিজেকে সামলে জোরপুর্বক হাসি টেনে দোয়ার দিকে ফিরলো ও। দোয়া তখনো মাথা নিচু করেই দাড়িয়ে। আরাব বললো,

-না তো! চিনিনা! বাট ইফ ইউ‌ ওয়ান্ট,এনকুয়েরি করতে আমার কোনো সমস্যা নেই!

দোয়া মাথা তুলে তাকালো আরাবের দিকে। ওর চেহারায় আশ্বাস! হঠাই অনেকটা সাহস সঞ্চার হলো যেনো ওর মাঝে। বলে উঠলো,

-এই ডক্টর সুমন আপনার বোনজামাইয়ের নাম ব্যবহার করে মানুষজনকে ঠকাচ্ছে মিস্টার আরাব!

আরাবের চোখেমুখে বিস্ময়,প্রশ্নের ঢল। কিন্তয়ওু দোয়ার শর্তের জন্য কিছুই বলছে না। বুঝলো সবটাই দোয়া। বললো,

-এই ডক্টর সুমন আমার বান্ধবী তাজীনকে বলেছে,সে নাকি ডক্টর সজল মুফতাহির। সে নাকি নিউ এইড হসপিটালের হার্টসার্জন! এই পরিচয়ে ওদের বিয়ে অবদি ঠিক হয়ে গেছে মিস্টার আরাব!

মুখ যেনো তালাবন্ধ করে রেখেছে আরাব। এই মুহুর্তে শতশত প্রশ্ন ওর ভেতরে তোলপাড় চালাচ্ছে। সুমন এখানে? কবে? কিভাবে? মুফতাহিরকে না দেখেও দোয়া কি করে এতোকিছু ভেবে নিলো? তারমানে স্পষ্ট,সুমনকে আগে থেকেই চেনে ও। কিন্তু কিভাবে? সুমনই বা কেনো তাজীন নামের কারো সাথে জরাচ্ছে? আর তো আর,এসবে মুফতাহিরের নাম কেনো আসছে? হতবিহব্বল চেহারা সামলে দোয়ার দিকে তাকালো ও। ও মেয়েটাও‌ চিন্তায় কপালে ভাজ ফেলে দাড়িয়ে। পুর্বাকাশের সুর্য মাথার উপর আসায় শুধু বটের পাতার ছায়াটা দিয়ে ঢেকে আছে সুর্যকিরনের কিয়দাংশ। বাকি সবটুকো উপচে পরেছে দোয়ার চেহারায়। আরাব শান্ত গলায় বললো,

-তাজীনের সাথে কোনো ফ্রডের বিয়ে হবে না দোয়া। তুমি নিশ্চিন্ত থাকো।

-ম্ মানে? আপনি…আপনি কি করবেন মিস্টার আরাব? ডক্টর সুমন…ডক্টর সুমন কিন্তু খুবই…

-ডেন্জারাস পার্সোন!

-মানে?

-কিছুনা। বাংলা ফিল্মের ডায়লগ ছুড়লাম। এনিওয়েজ,তুমি নিশ্চিন্তে বাড়ি যাও। বিয়েটা হবে না।

-কিন্তু মিস্টার আরাব…

-ভরসা করে ডেকেছো। একটু ভরসা রাখো?

কাদার তীব্র ইচ্ছা ছিলো দোয়ার। কিন্তু তবুও শক্ত রাখলো নিজেকে। কাউকেই ভরসা করতে পারেনা ও। সবাই এক। সবাই!বললো,

-কি করবেন আপনি?

আরাব তাচ্ছিল্যে হেসে বললো,

-নিজের বেলায় বলে দিলে প্রশ্ন করো না। আর আমাকে একের পর এক প্রশ্ন বিদ্ধ করছো। যাইহোক,আমি কিছুই করবো না। আমি জানি আমি কিছু করতে চাইলেও তা গ্রহন করবে না তুমি। তাই তোমার ফেভারটাই আমি গ্রহন করলাম। আমার বোনজামাইয়ের নাম কেউ‌ বাজেভাবে ব্যবহার করছে,তা জানানোর জন্য থ্যাংকস্! আপাতত আমি মুফতাহির ভাইয়াকে দিয়ে ওই ফ্রডের বিরুদ্ধে থানায় জিডি করাই,তুমি না হয় কপিটা তোমার বান্ধবী আর তার ফ্যামিলিকে দেখিয়ে দিয়ো। ব্যস্! শাদি ক্যান্সেল!

দোয়া‌ শ্বাস ফেললো। খুব সরল তবে কার্যকরি কিছু ভেবেছে আরাব। এমনটা হলে,খুব ভালোভাবেই সবটা মিটে যাবে। আরাবের দিকে দু দন্ড তাকিয়ে রইলো ও। আরাব ঠোট টিপে হেসে বললো,

-এমনটাই করতে যাচ্ছি। বেশি কিছু না! পাক্কা!

-ধন্যবাদ।

-ধন্যবাদ তো তোমার প্রাপ্য দোয়া। আমার বোনের বরের মানসম্মানটা তো তোমার জন্যেই বাচবে বলো?

-জ্ জ্বী। আপনি তবে…

-হ্যাঁ হ্যাঁ,জিডির কপি পৌছে যাবে তোমার কাছে। ডোন্ট ওয়ারি।

-জ্বী। আ্ আসছি।

-আবার আসবে?

দোয়ার বড়বড় চাওনি দেখে আরাব আরো বড়সর হাসি দিয়ে বললো,

-এসো।

দোয়া পা বাড়ালো। কেমন যেনো ভয় হচ্ছে ওর। যতোটা সহজ সবটা দেখাচ্ছে,আদৌও কি ততটা সহজ সবটা? আরাব পেছন থেকে আবারো বললো,

-আমার জ্যাকেটটা ফেরত দিলে না দোয়া?

একপলক পেছন ফিরে তাকলো দোয়া আরাবের দিকে। পকেটে হাত গুজে হাসছে ও। ওকে যে সবেমাত্র প্রায় অচেনাই বলা চলে এমন একটা মেয়ে এতোসব কথা বললো,এতোগুলো ধোয়াশা ছড়িয়ে রেখে গেলো,তা যেনো একদমই গায়ে লাগেনি ওর। আরাব বললো,

-পরেরবার মনে করে জ্যাকেটটা নিয়ে আসবে কেমন? আমার জিনিস কাছে রাখার অনেক বাজে সাইড ইফেক্ট হতে পারে তোমার!

ওখান থেকে তাড়াতাড়ি চলে আসলো দোয়া। কেনো যেনো সব অস্থিরতার মাঝে এই লোকটার উপস্থিতি,অনুপস্থিতি ওর আলাদা এক অস্থিরতার কারন। তবে এক বিষয়ে নিশ্চিন্ত হলো ও। আসল ডক্টর মুফতাহিরের করা জিডি দেখালে কোনোমতেই তাজীন আর অবিশ্বাস করবে না ওকে। ছেড়ে দেবে ডক্টর সুমনের মতো ধোকাবাজকে। আর রইলো বাকি ওর নিজের সুমনের সম্মুখিন হওয়া, এবারতো কোনো আড়াল নেই। ও জানে,কতোটা হিংস্র হতে পারে সুমন। তাই নিজেকে সেভাবেই না হয় প্রস্তুত করে নেবে ও।

দোয়া আড়াল হতেই পাশের ছোট্ট টঙের দোকানের দিকে এগোলো আরাব। এককাপ চা নিয়ে হাসিমুখে লেকের দিকে তাকিয়ে চুমুক দিলো চায়ের কাপে। দোয়া নিজেও জানে না,ও ঠিক কতো গুরুত্বপুর্ন ইনফর্মেশনস্ দিয়ে গেলো ওকে। কাপে চুমুক দিয়ে আরাব বাকা হেসে বললো,

-ডক্টর সুমন,ক্লোজেস্ট এসিসটেন্ট অফ ডক্টর রওশন! ওয়েলকাম ব্যাক ডিয়ার ! ওয়েলকাম ব্যাক! অনেক তো হলো লুকোচুরি! এন্ড নাও…দ্যা ফাইনাল রাউন্ড বিগেনস্!

#চলবে…

#এক_বেরঙ_চিলেকোঠায়
#লেখনীতে:মিথিলা মাশরেকা
পর্ব-২৫

আরাবকে অফিসে দেখে কিছুক্ষন অবিশ্বাসের চোখে তাকিয়ে রইলো মুফতাহির। ও শুনেছিলো আরাব তৌফিক ওয়াহিদের শর্ত মানতে অফিস এসেছিলো একবার। কোনো কাজ না করে শুধু কিছু কাগজপত্র নিয়েই নাকি বাসায় চলে গিয়েছিলো,এমনটাই কানে এসেছিলো ওর। দ্বিতীয়বার ওকে অফিসে দেখবে,আশা করেনি মুফতাহির। ধীর গলায় উচ্চারন করলো,

-আরাব? তুমি?

কোটটা টেনে হাসিমুখে ওর দিকে এগোলো আরাব। মুখোমুখি দাড়িয়ে বললো,

-হ্যালো ভাইয়া। সারপ্রাইজ!

মুফতাহির উৎফুল্লভাবে হাত এগিয়ে বললো,

-হোয়াট আ সারপ্রাইজ আরাব! ফিলস্ গ্রেট টু সি ইউ হেয়ার!

হাতে হাত মিলিয়ে মুফতাহিরকে আলিঙ্গন করলো আরাব। বললো,

-ফিলস্ ওয়াও টু বি হেয়ার! এজ আপকামিং ওনার অফ রংধনু ইন্ডাস্ট্রিজ!

মুফতাহির আবারো বিস্ময়ে তাকালো। আরাব এর আগে কখনোই এ ধরনের কথা বলেনি। আজকে ওরই একের পর এক কথা আর কাজে বিস্মিত না হয়ে পারছে না। আরাব বললো,

-বাবা কোথায় ভাইয়া?

-উনি এখনো আসেননি আরাব। উম..তা তুমি এতো সকালসকাল এখানে?

-কেনো? উচিত হয়নি আসা?

-হোয়াট আর ইউ সেয়িং আরাব? এসব তো তোমারই। ইউ ক্যান কাম,হোয়েনএভার ইউ ওয়ান্ট টু। আমি তো জাস্ট এটা জিজ্ঞাসা করছিলাম আজ বায়োমেডি অফ ডে কি না!

আরাব রহস্যময় হেসে বললো,

-না। আজকে অফ ডে না!

-তাহলে…

-একচুয়ালি অনেক ভাবলাম জানোতো মুফতাহির ভাইয়া। বাবার তো বয়স হয়েছে। আর তোমারও চেম্বার আছে। দুজনে রংধনু আর কতো সামলাবে বলো? তাই ডিসিশন নিলাম এখন থেকে বায়োমেডির অফ ডে না থাকলেও আমি অফিসে আসবো। ইনফ্যাক্ট রেগুলার আসবো। ফ্রম ওনায়ওর্ডস্,বায়োমেডি ইজ গোয়িং টু বি মাই পার্শিয়াল জব কর্নার। আর প্রায়োরিটি হিসেবে থাকবে বাবার বিজনেস!

শেষের কথাটা বেশ শক্তভাবে বলেছে আরাব। মুফতাহির চুপচাপ তাকিয়ে রইলো ওর দিকে। তারপর হেসে ওর কাধ ধরে হাটা লাগিয়ে বললো,

-ওকে ফাইন। এজ ইউ উইশ। এসো,আমি তোমাকে ডিটেইলস্ দেখিয়ে দিচ্ছি।

আরাব বাধা দিলো না। পা বাড়ালো মুফতাহিরের সাথে। হ্যাঁ দেখবে,ডিটেইলস্ দেখবে। অনেক হিসাব দেখার আছে ওর। অনেক হিসাব মিটানোর আছে।

ভার্সিটির জন্য বাড়ি থেকে বেরোলো দোয়া। সদর দরজায় দাড়িয়ে আশপাশটা দেখে নিলো কয়েকবার। আগেরদিন আরাবের সাথে দেখা করে আসার পর থেকেই অদ্ভুত এক অনুভুতি হচ্ছে ওর। মনেহয় সবসময় কেউ চোখেচোখে রাখছে ওকে। মাহিমকে পড়াতে যাওয়ার সময়,টুইঙ্কেলদের বাসায়,এমনকি মুখার্জীবাড়িতেও মনে হয় ওকে কেউ অনুসরন করছে। সকালবেলা বারান্দায় অনেকগুলো কাঠগোলাপ রাখা ছিলো।

ঘুম থেকে উঠে এগুলো দেখে আরো অজানা ভয় জাপটে ধরতে শুরু করেছে দোয়াকে। এসব কার জন্য? কে হতে পারে ভাবতেই মাথা ফেটে যাচ্ছিলো ওর। চটজলদি সব ফুল তুলে ফেলে দিয়েছে। কোনোমতে নিজেকে সামলে,সকালের কাজ সামলেছে। বেরিয়েছে,ভার্সিটি যাবে বলে। হাটা লাগালো দেখেশুনে। বাস থামার জায়গাটায় এসে দাড়ালো ও। আচমকা বাইক এসে দাড়ালো ওর সামনে। দোয়া চমকে খানিকটা পিছিয়ে দাড়িয়ে গেলো। গ্রে প্যান্ট,হাতে ঘড়ি,নীল শার্ট,বুকপকেটের কাছে আইডিকার্ড লাগানো। ওটা দেখে ব্যাগটা আরেকটু শক্তিতে আকড়ে ধরলো দোয়া। হেলমেট খুলে আরাব বড়সর হাসি দিয়ে বললো,

-গুড মর্নিং!

দোয়া নিরবে তাকিয়ে রইলো। সবসময় এক আলাদা স্নিগ্ধতায় ভরপুর এই মানুষটার চেহারা। সকালসকাল আরাবের চেহারা দেখে রাগ হওয়া উচিত ছিলো ওর। কিন্তু এ কয়দিনের চেনাজানায়,পাল্টে যাচ্ছে সে চিরায়ত নিয়ম। আরাব ভ্রু নাচালো। দোয়া একটু অস্বস্তিতে পরে গেছে। চোখ সরিয়ে নিলো অতি সন্তর্পনে। ওর মনে পরলো সুমনের বিরুদ্ধে জিডির বিষয়ে। আবারো চোখ তুলে কিছু বলার আগেই ওর সামনে একটা কাগজ তুলে ধরে আরাব বললো,

-এই নাও,ওই ডক্টর সুমনের বিরুদ্ধে জিডি করে দিয়েছি। তাহসানুল আরাবের বোনজামাইয়ের নাম ব্যবহার করে মেয়েদের ঠকানো? ওকে দিনে তারা দেখানোর ব্যবস্থা করে দেবে পুলিশ। ডোন্ট ওয়ারি।

কাগজটা হাতে নিলো দোয়া। পুরোটা পড়ে নিলো ওটার। সবকিছুই ঠিকঠাক। কেমন যেনো মানতে কষ্ট হচ্ছে দোয়ার। সবটা এতো স্বাভাবিকভাবে,এতো সহজভাবে কিভাবে হতে পারে? আরাব শান্ত গলায় বলে উঠলো,

-তোমাকে বললাম তো দোয়া। ডোন্ট ওয়ারি। এতো চিন্তিত দেখতে ভালো লাগে না তোমাকে।

দোয়া তাকালো ওর দিকে। এতোক্ষনে বাইক ছেড়ে নামলো আরাব। ওর সামনে দাড়িয়ে বললো,

-খুব দেখার ইচ্ছা দোয়া। নিমীলিত চোখজোড়ার চঞ্চলতা,মলিন বিনুনীতে আবদ্ধ চুলের উচ্ছ্বলতা,নয়তোবা গাজরায় বদ্ধ খোপা,মুঠোতে আটকে থাকা ওড়নার মৃদ্যু বাতাসে উড়োউড়ি,ভাজের পরিবর্তে কপালে কালোটিপ,হাতে সময় ধরে রাখার কঠোরতা ছাপিয়ে ডজন খানেক কাচের চুড়ি,লাল পার সাদা শাড়িতে সরলতার আরেক রুপ। খুব দেখার ইচ্ছা।

-এ্ এসব কি বলছেন আপনি মিস্টার আরাব?

আরাব চোখ সরালো দোয়ার থেকে। এভাবে বলাটা ঠিক হয়নি ওর। কিন্তু দোয়ার শুধু এইটুক রিয়্যাক্ট ওকে অবাক করেছে। তারপর বুঝলো হয়তো নাম ধরে বলেনি বলে বেশি কিছু বললো না। গলা ঝেড়ে বললো,

-লিভ ইট! আম দোয়া? কাল তো তুমি প্রশ্ন করতে মানা করেছিলে,কিছুই জিজ্ঞাসা করতে পারি এজন্য। আজ করবো?

দোয়ার চেহারায় ভয় স্পষ্ট। ও বেশ বুঝতে পারছে আরাব ওকে সুমনের পরিচয় নিয়েই‌ জিজ্ঞাসা করবে। এটাও জিজ্ঞাসা করবে,সবটা জেনেও কেনো দোয়া নিজেই তাজীনকে বললো না। কেনো ও নিজেই থানায় যায়নি? কি উত্তর দেবে ও এসবের? এসব করতে গেলে তো ওর পুর্নপরিচয় দিতে হতো। এজন্যই তো কিছুই করেনি ও। আমতা আমতা করে বললো,

-জ্ জ্বী মানে…

আরাব স্বাভাবিক গলায় বললো,

-আরে আরে! ঘাবড়ে কেনো যাচ্ছো? সিম্পল কোশ্শেন করবো! এমন তু তু তুতলিয়ে গেলে যে?

কপাল কুচকে তাকিয়ে রইলো দোয়া। নিজেকে সামলে বললো,

-দ্ দেখুন,আ্ আসলে…

-আ্ আবারো তো তো তোলাচ্ছো?

দোয়া চোখ বন্ধ করে অন্যদিক ফিরলো। রাগ হচ্ছে ওর এবার। আরাব ঠোট কামড়ে হেসে বললো,

-তা তো তো তোতলানো দোয়া? তোমার বান্ধবী কেমন মেয়ে বলোতো?

বড়বড় চোখে তাকালো দোয়া। কেমন মেয়ে মানে? তাজীন কেমন মেয়ে তা দিয়ে ওর কি? আরাব মাথা চুলকে বললো,

-ওমন করে তাকাচ্ছো কেনো?

-মানে? আপনি ঠিক কি বুঝাতে চাচ্ছেন?

-কেনো বোঝোনি? তোমাকে বললাম তাজীন কেমন মেয়ে।আর তুমি এমন লুক দিচ্ছো যেনো কোনো মেয়ে কেমন,এটা জিজ্ঞাসা করা যাবে না আমার!

-যাবে। তবে আমাকে নয়!

কড়া গলায় বলে নিজে নিজেই‌ থেমে গেলো দোয়া। আরাব মাথা নিচু করে সন্দিহান কন্ঠে বললো,

-হুয়াই? তোমাকে জিজ্ঞাসা করবো না তো কাকে জিজ্ঞাসা করবো? তোমার বান্ধবীর খবর তুমি ছাড়া আর কে‌ দেবে হুম?

-ও অনেক ভালো মেয়ে!

-হুহ! কতো ভালো মেয়ে দেখলাম! তারপর শুনি ভালো মেয়েটা কাউকে না জানিয়ে একাএকাই বিয়ে করে নিয়েছে!

আফসোসের স্বরে বললো আরাব। দোয়া শুধু তাকিয়ে রইলো। দুবার ভ্রু নাচালো আরাব। একটা জোরে শ্বাস ফেলে রাস্তার দিকে তাকিয়ে বিরবিরিয়ে বললো,

-এই বাসটা কেনো আসছে না এখনো?

-বাস মেরে বাসমে হ্যায়। যাবতাক তুম বাসমে না আও,বাস ভি নেহি আয়েগা! হু হা হা!

আরাব নিজেনিজেই হেসে ধীরগলায় বললো। কয়েকবার বাস উচ্চারন করেছে ও,এটা বুঝে আবারো ওর দিকে তাকালো দোয়া। আরাব কথা পাল্টাতে বললো,

-আমি তো নর্মালি জিজ্ঞাসা করছিলাম তাজীন কেমন মেয়ে। আইমিন,এই জিডিটা তোমার বান্ধবীকে দেখিয়ে দিলে তোমার বান্ধবী একটা ফ্রডকে এটলিস্ট বিয়ে করবে না তাইনা?

-না।

সোজা জবাব দিয়ে পাশ ফিরলো দোয়া। ও জানে তাজীন ওর মুখের কথাতেই অনেককিছু বিশ্বাস করতো। এখন জিডিটা যখন দেখাবে,আর কোনো সন্দেহই থাকবে না ওর। তাই বেশ অনেকটাই নিশ্চিন্ত ও। হঠাৎই আরাব ঠান্ডা গলায় বলে বললো,

-ডক্টর সুমনকে কি করে চেনো দোয়া?

শিরদাড়া যেনো হিম হয়ে গেলো দোয়ার। পাশে তাকিয়ে আরাবকে দেখার সাহসও ওর নেই। হাত কচলাতে লাগলো ও। ঠিক তখনই সামনে ভার্সিটির বাস এসে থামলো। পাশ না ফিরে বললো,

-আ্ আমার দ্ দেরি হয়ে যাচ্ছে।

-এ্ এ্ এসো।

দোয়া পাশ ফিরতেই ওকে ইনোসেন্ট একটা হাসি উপহার দিলো আরাব। একটা কথাও না বলে সোজা বাসে চরে বসলো দোয়া। কোনোদিক তাকায় নি ও। বাসে উঠে যাওয়ার পর অসহায়ভাবে তাকিয়ে থেকে নিরব প্রেয়সীর প্রস্থান সহ্য করলো আরাব। বাস ছেড়ে দিলে হাতদুটো মুঠো করে রেখে বললো,

-কেনো এতো আড়াল দোয়া? কেনো এতো বাধা? কেনো তোমাকে কঠোর হতে হলো? আর কেনো আমাকেই বা এতো অসহায় পরিস্থিতিতে পরতে হলো? দোষটা তো কারোরই ছিলো না! শাস্তিটা কেনো এতোদিন তোমাকে আর তোমার পরিবারকে সইতে হলো? আর কেনো অবশেষে আমিও তার শিকার? কেনো দোয়া? পৃথিবীটা এতো নিষ্ঠুর কেনো?

স্তব্ধ দুপুর। ক্যাম্পাসের এক বড় গাছের নিচে দাড়িয়ে দোয়া আর তাজীন। তাজীন শান্ত দৃষ্টিতে হাতের কাগজটার দিকে তাকিয়ে। শুকনো ঢোক গিললো দোয়া। ডক্টর সুমন যে ওকে ভুল পরিচয়ে ঠকাচ্ছে এটা বলে দিয়েছে ও তাজীনকে। আরাবের দেওয়া জিডির কাগজটাও দেখিয়ে দিয়েছে। এখন বুঝে উঠতে পারছে না তাজীন কি বলবে,তার বিপরীতে ওই বা কি বলবে। দোয়া একপা এগিয়ে তাজীনের কাধে হাত রেখে কাপাকাপা গলায় বললো,

-ত্ তাজ?

ভাষাহীন দৃষ্টিতে তাজীন দোয়ার দিকে তাকালো। দোয়া ব্যস্তভাবে বললো,

-তাজ? তাজ উনি…ডক্টর সুমন…উনি…

-আমার বিয়ে হয়ে গেছে দোয়া।

বিস্ফোরিত চোখে তাজীনের দিকে তাকালো দোয়া। ওকে ছেড়ে দু পা পিছিয়েও গেছে। যা শুনলো,তা কি ঠিক শুনলো ও? যদি তাই হয়,তবে তা কি করে সম্ভব? তাজীনের মাটির দিকে স্থির চাওনি। দোয়া জিভ দিয়ে ঠোট ভিজিয়ে আবারো এগোলো ওর দিকে। বললো,

-ম্ মানে? তাজ…

তাজীন মাথা তুলে তাকালো। নাকটা টেনে শক্ত গলায় বললো,

-গতকাল রাতেই আমার বিয়ে হয়ে গেছে।

#চলবে…