এক মুঠো অনুভূতি পর্ব-০১

0
637

#সূচনা_পর্ব
#
💖
লেখিকা- তাহসীন নাওয়ার রীতি।

”এই রুমালটায় একটা ছোট্ট চিরকুট লিখে ভার্সিটির ছাদ থেকে নিচে ফেলে দিবে। তারপর যেই ছেলে রুমালটা পেয়ে ছাদে আসবে, তোমার তাকে প্রোপজ করতে হবে।”

রোহানের বলা কথায় বিস্ফোরিত নয়নে তার দিকে তাকিয়ে আছে ওহি আর জাইমা। এদিকে রোহানের আশপাশে থাকা তার বন্ধুরা খুশিতে হৈহৈ করে উঠে।
হঠাত তাদের মাঝে মিতু নামের একজন বলে উঠলো,
–প্রতিবারের মতো এবারও তোমার আইডিয়া খারাপ না রোহান। কিন্তু, তুমি কিভাবে শিওর হচ্ছো যে রুমালটা নিয়ে কোন ছেলেই আসবে। কোন মেয়েও তো আসতে পারে। তখন কি হবে?
–হুম, আসতেই পারে। এটা সম্পূর্ণ নির্ভর করবে তার ভাগ্যে উপর। শর্ত এটাই, যদি রুমালটা কোন ছেলে নিয়ে আসে তবে তাকে প্রোপজ করতে হবে। আর যদি ভাগ্য খারাপ হয়ে কোন মেয়ে আসে তবে তোমাকে আমাদের সবার অ্যাসাইনমেন্ট করে দিতে হবে।

রোহান কথায় ওহি ভ্রু কুঁচকে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। এদিকে রোহানের বন্ধুরা তার প্রশংসা করে যাচ্ছে। ওহি জাইমার দিকে একবার ফিরে তাকিয়ে,
–এসবের কোন কিছুই আমরা করতে পারবো না। ভার্সিটিতে আমরা নতুন, তাই বলে আপনারা আমাদের দিয়ে যা ইচ্ছা তাই করাতে পারেন না। ভালোয় ভালোয় আমাদের বইগুলো ফিরিয়ে দিন নয়তো আমি এখনি গিয়ে স্যারকে বিচার দিবো।

ওহির কথায় রোহান আর তার বন্ধুরা হেসে উঠে। মিতু ওহির কথায় কিছুটা ব্যঙ্গ করে,
–আহারে! কি সুন্দর করে বাচ্চা বাচ্চা কণ্ঠে কথাটা বললো মেয়েটা। রোহান, আমি কিন্তু তার কথায় খুব ভয় পাচ্ছি!
মিতুর কথায় সবাই আবার হেসে উঠলো। জাইমা জড়সড় হয়ে ওহির হাত শক্ত করে ধরে আছে আর ওহি কঠোর চোখে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে।
–এই চশমিশ, তোমার কি মনে হয় স্যারকে বলেও কোন লাভ হবে? শুনে রাখো, আমি যখন একবার বলেছি তোমাকে কিছু করতে, যতো যাই হোক তোমাদের সেটা করতেই হবে। নাহয়, পালিয়ে যাবে কোথায়?

ওহি জাইমার দিকে তাকাতেই জাইমা ভীত চোখে ইশারা দিয়ে বোঝায় যে রোহান ঠিক বলছে। মিতু মুচকি হেসে তাদের সামনে এসে একটা সাদা রঙের রুমাল ওহির হাতে দিয়ে,
–এসো, আমাদের সাথে।

ভার্সিটির ছাদে দাঁড়িয়ে আছে সবাই। মিতু রোহানের কথায় ওহির হাত থেকে রুমালটা নিয়ে সেখানে একটা ছোট্ট চিরকুট লিখে দিয়েছে।
–এই নাও, এখন ভালোয় ভালোয় রুমালটা নিচে ফেলে দাও। আর তারপর..শুধু অপেক্ষা।
ওহি রুমালটা হাতে নিতেই জাইমা তার কাছে এসে ফিসফিস করে,
–শোন, রুমালটা ফেলেই দুজন সুযোগ বুঝে দৌড়ে পালিয়ে যাবো। বুঝেছিস? ক্লাস শুরু হতে কিন্তু আর বেশি দেরি নেই ওহি।
ওহি জাইমার কথায় মাথা নেড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রুমালটা নিচে ফেলে দিলেও দুর্ভাগ্য ক্রমে রোহানের জন্য তাদের পালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়না।

অনেক্ষণ ধরে ছাদে দাঁড়িয়ে আছে ওহি আর জাইমা। রোহান আর তার বন্ধুরা মিলে ছাদের কোণায় রেলিং ধরে বসে আড্ডা দিচ্ছে।
হঠাত সিঁড়িঘর থেকে কারো পায়ের শব্দ শুনতে পায় রোহান। সে তড়িঘড়ি করে ওহি বাদে সবাইকে নিয়ে দেয়ালের পেছনে লুকিয়ে পড়ে।
এদিকে এতোক্ষণ ধরে ওহি আর জাইমা বিরক্ত হয়ে বসে থাকলেও কেউ ছাদে আসছে শুনে মুহূর্তেই তাদের হাত পা ঠান্ডা হয়ে যায়। ভয়ে দুজনই দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে। হঠাত মিতু এসে জাইমাকে টেনে তাদের সাথে নিয়ে যায়। ওহি অসহায়ভাবে তাদের দিকে তাকিয়ে কিছুটা এগিয়ে যেতে নিতেই শুনতে পায় এক ভরাট পুরুষালি কণ্ঠ,
–এই রুমালটা কি তোমার?

ছোট্ট এই কথা মুহূর্তেই স্তব্ধ করে তুলে ওহিকে। তার শিরদাঁড়া দিয়ে বয়ে যায় এক ঠান্ডা বাতাস।
কিছুটা দ্বিধা দ্বন্দ্বে ভুগে ধীরে ধীরে মাথা তুলে পিটপিট করে তাকাতেই দেখতে পায় সামনে দাঁড়িয়ে বলিষ্ঠ দেহের অধিকারী এক সুদর্শন পুরুষ। হিতাহিত জ্ঞান ভুলে মুগ্ধ নয়নেই তার দিকে তাকিয়ে আছে ওহি। ছেলেটি ওহির দিকে কিছুটা এগিয়ে এসে,

–রুমালটা কি তুমি ফেলেছো নিচে? কি হয়েছে এখানে? কি সাহায্য প্রয়োজন তোমার?
ছেলেটির কথায় ওহি ঘোর লাগা দৃষ্টিতে ভ্রু কুঁচকে তাকায়। তার তো কোনো সাহায্য প্রয়োজন নেই। আর কারো কাছে তো কোন প্রকার সাহায্যও চাইনি সে। তাহলে ছেলেটি কিসের সাহায্যের কথা বলছে?
তখনই মনে পড়ে রুমালে লেখা চিরকুটের কথা। মিতু খুব সুন্দর করে সেখানে লিখেছিলো,

“জরুরী সাহায্য প্রয়োজন। যে ব্যক্তি রুমালটা পাবেন দ্রুত ভার্সিটির ছাদে চলে আসুন।”

কথাটা মনে হতেই ঘোর কেটে গিয়ে মুহূর্তেই ভয়ে ওহির হাত পা কাঁপতে শুরু করে। রোহানের কথায় তো সে রুমালটা ফেলে দিয়েছে কিন্তু এখন সে প্রোপজ করবে কিভাবে? ভয়ে কথা বলার শক্তি পাচ্ছে না, বারবার গলা শুকিয়ে আসছে তার। এলোমেলো চোখে আশেপাশে তাকাতেই দেখে রোহান আর তার বন্ধুরা আড়াল থেকে তাদের দেখছে। তাদের দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে জাইমা ছাড়া বাকিরা বিষয়টা খুব উপভোগ করছে।
ইতিমধ্যে রোহান তাকে বারবার কিছু বলার জন্য ইশারা দিয়েই যাচ্ছে। ওহি একবার ছেলেটার দিকে তাকিয়ে আমতা আমতা করে,

–হ্যা…মানে না। না..মানে হ্যা। ইয়ে মানে, রুমালটা আমার না। কিন্তু আমিই রুমালটা নিচে ফেলেছি।
ছেলেটা ওহির এখন খাপছাড়া কথায় কিছুটা সন্দিহান দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে,
–যা বলবে ঠিকঠাক ভাবে বলো। এভাবে কথা ঘুরিয়ে আমায় দো’টানায় ফেলেছো কেনো? কি সমস্যা তোমার?
ওহি কি করবে ভেবে না পেয়ে একটা কাশি দিয়ে নিজেকে সামলে, আড়চোখে জাইমার দিকে একবার তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে,

–আমি আপনাকে ভালোবাসি!

হুট করে বলা ওহির এমন কথায় হয়তো ছেলেটা অবাক হয়েছে। চোখ বড় বড় করে জোর গলায় সে বলে উঠলো,
–কিহ? কি বললে তুমি?
–বলেছি, আমি আপনাকে ভালো..!

কথাটা আর শেষ করা হলোনা ওহির। তার আগেই এক বলিষ্ঠ হাতের চ/ড় এসে পড়লো তার গালে। কিছু বুঝে উঠার আগেই হঠাত এমন হওয়ায় ওহি আহাম্মকের মতো গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, কানের কাছে ভেসে আসছে ঝিনঝিন এক শব্দ, চোখ থেকে চশমা কিছুটা সরে যাওয়ায় সামনে দেখতে পাচ্ছে সবটা অস্পষ্ট।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ঝিনঝিন শব্দের বেগ কমে যেতেই সে শুনতে পেলো,

–এটা কোন ধরনের অসভ্যতা? সাহস কিভাবে হলো তোমার এভাবে সাহায্যের কথা বলে নিয়ে এসে আমাকে এসব বলার?
ওহি গাল থেকে হাত সরিয়ে কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে দ্রুত চশমা ঠিক করে দেখে ছেলেটা অসম্ভব রাগি ভাবে তার দিকে তাকিয়ে আছে।

–এখন কথা বলছো না কেনো? এভাবে রুমালে চিরকুট লিখে…এক মিনিট! রুমালে..চিরকুট!

চিরকুট কথাটা বলে ছেলেটা অদ্ভুত ভাবে ওহির দিকে তাকিয়ে হঠাত রেগে তেড়ে আসতেই, ওহি ভয়ে কিছুটা পিছিয়ে যায়।
–তারমানে ক’দিন ধরে আমার কাছে যেসব চিরকুট আসছিলো সেগুলো তুমিই দিচ্ছিলে। তাই না?
কথাটা শুনে ওহির মাথায় যেনো আকাশ থেকে পড়ে।
–কিসের চিরকুট? আমি আপনাকে কোন চিরকুট দেইনি। আর চিরকুট দেওয়া তো দূরের কথা, আপনাকেই তো আগে কখনো দেখিনি আমি।
–আচ্ছা? দেখোনি তাহলে এভাবে প্রোপজ করলে কেনো?
–আমার বয়েই গেলো আপনাকে প্রোপজ করতে।

ওহির কথায় ছেলেটা রেগে একটা ধমক দিয়ে ওহির দিকে কিছুটা এগিয়ে আসতেই জাইমা দৌড়ে এসে ওহিকে আগলে ফেলে।
এদিকে জাইমাকে তাদের কাছে চলে আসতে দেখে রোহান আর তার বন্ধুরা হুড়মুড় করে দৌড়ে ছাদ থেকে নিচে চলে যায়।
আর ছেলেটা আচমকা রোহানদের আড়াল থেকে বেরিয়ে এভাবে চলে যাওয়া দেখে কিছুটা অবাক হয়। ঠিক তখনই একটি মেয়ে আর একটি ছেলে ছাদে প্রবেশ করে।

আফরা নামের মেয়েটি তাদের কাছে এসে,
–আশ্বিন! কি হয়েছে? তুই এখানে কি করছিস? আর এরা কারা এভাবে দৌড়ে চলে গেলো?
আশ্বিন এবার ওহি আর জাইমার দিকে তাকিয়ে,
–কি হচ্ছে এখানে?
জাইমা এবার ওহির দিকে তাকিয়ে বললো,

–ভাইয়া, কিছু মনে করবেন না। আসলে, আমরা ভার্সিটিতে নতুন। তিনদিন হলো ক্লাস করছি তাই কাউকে তেমন ভাবে চিনিও না। আজ সকালে প্রথম ক্লাস শেষে লাইব্রেরি থেকে বই নিয়ে আসার সময় রোহান নামের ওই ভাইয়া আমাদের বইগুলো কেড়ে নিয়ে আমাদের এমনটা করতে বলেছে। ওহি প্রথমে এমন করতে চায়নি কিন্তু তারা হুমকি দিয়ে বললো করতেই হবে। তাই ভয় পেয়ে আমরা..।

আশ্বিন এতোক্ষণ ওহির দিকে তাকিয়ে জাইমার কথাগুলো শুনছিলো। অতঃপর একটি দীর্ঘশ্বাস নিয়ে রাগকে যথাসম্ভব নিয়ন্ত্রণ করে খুব শান্ত কণ্ঠে,
–তোমরা এখন ক্লাসে যাও।

যাওয়ার কথা শুনতেই জাইমা ওহির হাত ধরে টেনে এক ছুটে যাওয়া শুরু করে।
এদিকে ওহি এতোক্ষণ ধরে আশ্বিনের দিকে রাগী ভাবেই তাকিয়ে ছিলো। যাওয়ার সময় একবার পিছনে ফিরে আশ্বিনের দিকে আবারো একটা কড়া দৃষ্টি নিক্ষেপ করে চলে যায়।
আশ্বিন তার যাওয়ার দিকে অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে ছাদের রেলিং ধরে কিছুটা হেলান দিয়ে দাঁড়ায়,
–একটা মুহুর্তের জন্য আমি ভেবে নিয়েছিলাম এই মেয়েটা হয়তো আমাকে এসব চিরকুট দিচ্ছে।

আফরা তাদের যাওয়ার দিকে একবার তাকিয়ে আশ্বিনের সামনে এসে,
–এই চিরকুট গুলো নিয়ে তুই খুব বেশি টেনশন করছিস আশ্বিন।
–তুই বুঝতে পারছিস না আফরা। চারদিন হয়ে গেলো এই চিরকুট লেখক আমাকে অপ্রকাশিত ভাবে হুমকি দিচ্ছে। এতোটা নিখুঁত ভাবে সে কাজ করছে যে আমরা এখনও তার খোঁজ পাচ্ছি না, যে সে আসলে কে।
–তুই এতো চিন্তা করিস না। আমাকে কদিন সময়’দে। আমি তাকে খুঁজে বের করছি। কার এতো বড় সাহস হয়েছে আমার বেস্ট ফ্রেন্ডকে হুমকি দেওয়ার।
আফরার কথায় আশ্বিন মাথা নেড়ে হ্যা বোঝাতেই সে ফোন বের করে কাউকে কল দিয়ে কথা বলতে বলতে চলে যায়।

এদিকে রোদ্দুর আশ্বিনের কাছে এসে নিচে পড়ে থাকা রুমালটা উঠিয়ে একটু মজা করে,
–মেয়েটা তোকে ডেকে এনে কি বলেছে আশ্বিন? প্রোপজ করেনি তো আবার??
আশ্বিন রোদ্দুরের দিকে রাগী ভাবে তাকিয়ে,
–ভার্সিটিতে এখনো কারো সাহস হয়নি আশ্বিনকে প্রোপজ করার। বুঝেছিস?
–তাহলে তুই এতো হাইপার হচ্ছিস কেনো?
–ঠিক আছি আমি। তুই এখনই গিয়ে ওই মেয়ের নাম পরিচয় সব কালেক্ট করবি। আর কি যেনো নাম বললো ছেলেটার? ওহ হে, রোহান। তাদের ধরে আমার কাছে নিয়ে আয়। ভার্সিটিতে যে রেগিং এলাও না কথাটা হয়তো তারা ভুলে গিয়েছে। একটু মনে করিয়ে দিতে হবে।

রোদ্দুর একটা বাঁকা হাসি দিয়ে যাওয়ার সময় আশ্বিনের হাতে রুমালটা দিয়ে চলে যায়। আশ্বিন রুমালটার দিকে তাকাতেই কানে বেজে ওঠে ওহির কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলা কথাটা,
”আমি আপনাকে ভালোবাসি”

আশ্বিন রুমালের থেকে চোখ সরিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
চোখের সামনে ওহির কড়া চোখে তাকানোর মুহূর্তটা ভেসে উঠতেই বাঁকা হাসি দেয় সে। এই প্রথম কোন মেয়ে তার সামনে দাঁড়িয়ে ভালোবাসি কথাটা বলেছে! কথাটা মনে হতেই সে আনমনে বলে উঠে,
–মানতে হবে এই চশমাকে! তোমাকে তো আমি দেখে নিবো।
কথাটা বলেই আশ্বিন মুচকি হেসে রুমালটা পকেটে ভরে নেয়।

–চলবে(ইনশাআল্লাহ)